সুমনপাল ভিক্ষু
"আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা.....
...... বন্যার কাছে ঘূর্ণির কাছে রাখলাম নিশানা।" সলিল চৌধুরী
সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো বহু কবি, শিল্পী কেন সর্বহারার মর্তাদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন, এ প্রশ্ন অবাস্তর। কেননা যুগের আকর্ষণই তাঁদের টেনে এনেছিল। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তখন কেমন ছিল? এর উত্তর সুকান্ত ভট্টচার্যের কবিতায় উদ্ভাষিত হয়।
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাতে
তার মুখে খবর পেলুমঃ
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।
খর্বদেহ, নিঃসহায়, তবু তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উত্তোলিত, উদ্ভাষিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
ভারতবর্ষে তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামাখা বেজে উঠেছে, তার সুযোগ নিয়ে ভারতের জনগন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির বিরদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, দেশের মাটিতে তীব্র হতে তীব্রতর হয়েছে ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং তার কয়েক বছর পরে নৌবিদ্রোহ যার সামগ্রিক প্রভাবে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত ক্রমশই আলগা হয়ে উঠেছে। ভারত হতে ছেড়ে চলে যাওয়া ব্যতীত যে গত্যন্তর নেই তা এতদিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উপলব্ধি করতে পেরেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্যবাদী আন্দোলনের দাবানল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পরাভূত করে ফেলেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে 'বলশোভিক পার্টি' (পরবর্তীকালে সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টি)র রাশিয়ার প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ, রোমা রোলাঁ প্রমুখ বিশ্বের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীগণ এই নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শক্তি সোভিয়েত জণগনের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কাছে পরাভূত হয়েছে এবং পূর্ব ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পুঁজিবাদী শাসন শোষনের অবসান ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মেহনতী জনগণের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। চীনের জনগণ এগিয়ে চলেছে স্বাধীনতা'র পথে। এশিয়া আফ্রিকার ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছে। অপরদিকে সামাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে সমানতরাল সমাজতান্তিক বিশ্ব ব্যবস্থা। ফলে সাম্রাজ্যবাদ এক অর্থে হয়ে উঠেছে কাগুজে বাঘ। এমন প্রেক্ষিতে বিশ্বের দেশে দেশে তখন মার্কসবাদ লেলিন বাদ ও বামপন্থী আন্দোলনের পক্ষে প্রবল জনমত সৃষ্টি হয়েছে।
'জনগনই শেষ পর্যন্ত শেষ কথা বলে।
জনগণই ইতিহাস রচনা করে।'
প্রগতিশীল মানুষ, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক মাত্রই তখন কমিউনিষ্ট মতাদর্শের পথে এগিয়ে চলেছে। অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ছাত্র-যুব মেহমতী জনগণের সংগ্রাম-সংগঠন। এঁরা কিন্তু কেরিয়ার গড়তে অসে নি। যুগোপযোগী আন্দোলনের ইস্তেহার রূপেই তাঁরা সর্বহারা মতাদর্শের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন শাসকের রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা না করেই।
"বিচার পতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা.....
নিঃস্ব যারা সর্বহারা
তোমার বিচারে সেই নিপীড়িত জনগণের পায়ের ধারে
নামিয়ে মাথা....।"
বাংলা সাহিত্যের এক ক্ষণজন্মা প্রতিভাধর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য আপামর বাঙালী পাঠকের কাছে 'কিশোর কবি' নামে সুপরিচিত।
ইংরেজী সাহিত্যের শেলি, কীটস্ প্রমুখের ন্যায় তাঁর জীবন ও ফুরিয়ে গিয়ে ছিল খুব অল্প বয়সেই। মাত্র ২১ বছরের জীবনকালে বাংলা সাহিত্যকে যে অসামান্য অবদানে পরিপূর্ণ করেছেন সুকান্ত তা তুলনারহিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন তিনি। কৈশোর থেকেই তিনি যুক্ত হয়েইছলেন সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে। ছাত্রপত্র, ঘুম নেই, মিঠেকড়া ইত্যাদি তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। শুধু কবিতাই নয়, তার পাশাপাশি কয়েকটি প্রবন্ধ এবং 'অভিযান নামে একটি নাটিকাও লিখেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির পূর্ণ সময়ের কর্মী হিসেবে প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সংঘে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। বয়সের সীমাকে অতিক্রম করে বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য।
১৯২৬ সালের ১৫ আগষ্ট কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম। তাঁর পিতার নাম নিবারণ ভট্টাচার্য এবং মাতা সুনীতি দেবী। নিবারণ চন্দ্র বইয়ের ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সারস্বত লাইব্রেরী। তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার উনিশয়া গ্রামে। সুকান্তের দাদু সতীশচন্দ্রের ইংরেজী সাহিত্য ও জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চার প্রতি গভীর দখল ছিল। মামার বাড়ীর পরিবেশ থেকেই পরবর্তীকালে সুকান্তের লেখাপড়ার প্রতি অনুরাগ, কুসংস্কারকে অগ্রাহ্য করার সাহস, দরিদ্র মানুষের প্রতি অগাধভালোবাসা ও দরদ এসব প্রবৃত্তিগুলো চরিত্রে ফুটে উঠেছিল। ১৯৩৭ সালে সুকান্তের যখন মাত্র ১১ বছর বয়স, সেই সময়েই তাঁর মাতা প্রয়াত হন। কমলা বিদ্যামন্দিরে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তিনি। কমলা বিদ্যামন্দিরে বিদ্যা শিক্ষাকালে 'সঞ্চয়' নামক তাঁর নিজের হাতে লেখা একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন সুকান্ত। এরপর তিনি বেলেঘাটা দেশবন্ধু উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয়ে তাঁর পরিচয় হয় সুহৃদ অরুনাচল বসুর সঙ্গে। সুকান্ত ভট্টচার্য এবং অরণাচল বসু একত্রে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় 'সপ্তমিকা' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।
"হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ-ললিতা-ঝংকার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো! প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়ঃ
পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।।" --ছাড়পত্র, সুকান্ত ভট্টাচার্য।
বিজন কুমার গঙ্গোপাধ্যায়'এর সম্পাদনায় 'শিখা' পত্রিকায় তাঁর প্রথম লেখা বিবেকানন্দের জীবনী প্রকাশিত হয়। মাত্র ১১ বছর বয়সে 'রাখাল ছেলে' নামক একটি রূপক গীতিনাট্য রচনা করেন সুকান্ত। তাঁর সাহিত্য জীবনে শিক্ষক নবদ্বীপ চন্দ্র দেবনাথ এবং তাঁর বন্ধু অরুণাচল বসুর মাতা সরলা দেবীর গভীর প্রভাব ছিল। কৈশোরে ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় সুকান্তের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
১৯৩৯ সাল থেকেই কলকাতার পথে পথে মিছিল, ধর্মঘট ইত্যাদির প্রভাব সুকান্তের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। ১৯৪২ সালের গোড়ার দিকে কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ হয়ে ওঠেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং রাজনীতিতে অন্নদাশংকর ভট্টাচার্য। এই বছরেই মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে কমিউনিষ্ট পার্টির একনিষ্ট সদশ্যরূপে কাজ করতে শুরু করেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। ঠিক এই সময়েই ঘটে যায় বাংলার পঞ্চাশের মন্বন্তর।
তিনি দুর্ভিক্ষ-পীড়িত নর-নারীর সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই দুর্ভিক্ষের বিরোধিতা করে সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন 'অভিযান নামে একটি বিখ্যাত নাটক। মোটামুটি ভাবে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যেই তাঁর সাহিত্য জীবন সীমায়িত ছিল।
সুকান্তের কবিতায় সাধারণ মানুষের কথাই বেশী প্রাধান্য লাভ করেছে এবং এই কারণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণ মানুষের কবি। অসহায় নিপীড়িত-সর্বহারা মানুষের সুখ-দুঃখ ছিল তাঁর কবিতার মুখ্য বিষয়। তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে শ্রেণী বৈষম্যের কথা বলেছেন। 'দৈনিক স্বাধীনতা' (১৯৪৫) পত্রিকার কিশোর সভা বিভাগের সম্পাদনার দ্বায়িত্ব ছিল তাঁর উপরে। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য হল-
ছাড়পত্র, পূর্বাভাস, মিঠেকড়া, অভিযান, ঘুমনেই, হরতাল, গীতিগুচ্ছ প্রভৃতি।
সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও রচনা দক্ষতায় অনন্যা। কখন ও বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি, কখনও মোরগ, কখনও পথ ইত্যাদি বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। সিঁড়ি, একটি মোরগের কাহিনী, রবীন্দ্রনাথের প্রতি, দেশলাই কাঠি, ঘুমভাঙ্গার গান, রৌদ্রের গান, ফসলের ডাক, ১৩৫১, কৃষকের গান, আঠারো বছর, প্রিয়তমাসু ইত্যাদি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত কবিতা।
"তবুও নিশ্চিত উপবাস
আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস,
আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি,
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি!"
রাজনৈতিক মতাদর্শকেই সুকান্ত তাঁর কবিতার প্রধান বর্শাক্ষুম রূপে গ্রহণ করেছিলেন সুকান্ত। তাই তাঁর কবিতাগুলি হয়ে উঠেছিল স্লোগান সর্বস্ব। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার মধ্যে তাই উদ্ভাষিত হয়েছে প্রাচীন সিংহদ্বারের আগল ভেঙে ফেলার আহন। কেননা তিনি কখনই সামন্তবাদী চিন্তা ও জীবনবোধকে প্রশ্রয় দেননি। সেই অর্থে বিপ্লবের ধারাবাহিকতাতেই সুকান্ত হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রেহী কবি। তিনি বিপ্লবী আদর্শর কথা শ্রেণী সংগ্রামের কথা দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন বারংবার। সুকান্ত তাঁর কবিতার চিন্তাজগতে নতুন ফর্ম সৃষ্টি করেছিলেন। এই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সুকান্ত দেখিয়েছিলেন নতুন দিনের নতুন সকাল কেমন হওয়া উচিত। তিনি তাঁর কবিতার ভাষাকে নির্ভীকভাবে এমন রূপে উপস্থাপন করেছিলেন যা তার পূর্বাবৃত্তি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
এক্ষেত্রে মানিক মুখোপাধ্যায় (পথিকৃৎ, বিশেষ সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৮৩) এর একটি বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তিনি বলেছেন- ".... চিন্তার একটা আপেক্ষিক স্বাধীনতা আছে, কিন্তু বস্তুজগতের স্থানকালের সীমার মধ্যেই সেই স্বাধীনতা, তার বাইরে নয়।"
কবি সুকান্ত উপলব্ধি করেছিলেন সংস্কৃতিগত বিপ্লব শুরু না হলে ভারতীয় জনগণের মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। কেননা কবি সাহিত্যিক সমাজ পরিবেশ থেকে তাঁদের কাব্য-সাহিত্যের রসদ সংগ্রহ করেন। এমনকি যে রূপাশ্রয়ে তাঁদের শিল্পসৃষ্টি, সেটিও সমাজ জমিন হতে আহরিত। তাই তিনি দীপ্তকণ্ঠে তাঁর কবিতার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে 'জনযুদ্ধ' ঘোষণা করেছেন।
"লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে,
কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায়?
কতদিন তুষ্ট থাকবে আর
অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়ে? মনের কথা ব্যক্ত করবে ক্ষীণ অস্পষ্ট কেঁউ কেউ শব্দে?
ক্ষুধিত পেটে ধুকে ধুঁকে চলবে কত দিন?
ঝুলে পড়া তোমার জিভ...।" --১লা মে-র কবিতা।
সুকান্ত'র কবি প্রতিভা সম্পর্কে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিবাদী বাংলা সাহিত্যিক তথা শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, "গভীরতা", ব্যপ্তি, তীব্রতা, ভাবৈশর্ষ ইত্যাদি সবকিছুর ধারক ও বাহক হিসাবে সাদামাটা স্পষ্টভাষী সার্থক কবিতা কল্পনা করতে আমরা অপটু ছিলাম, আমাদের অভিজ্ঞতা ও স্বীকৃতি গীতি কবিতা পর্যন্ত। সুকান্তের কবিতায় তাই বাংলা কাব্য সাহিত্যের নবজন্মের সূচনা ছিল।"
সারি সারি বাড়ি সব
মনে হয় কবরের মতো।
মৃত মানুষের স্তূপ বুকে নিয়ে পড়ে আছে চুপ করে সজয় নির্জনে।
মাঝে মাঝে শব্দ হয়ঃ
মিলিটারি লরির গর্জন
পথ বেয়ে ছুটে যায় বিদ্যুতের মতো
সদম্ভ আক্রোশে। --সুকান্ত ভট্টাচার্য, সেপ্টেম্বর' ৪৬।
১৯৩৬ সালে রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির জন্য সমগ্র দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়। অবিভক্ত বঙ্গ এবং অন্যত্র 'সর্বভারতীয় ব্যক্তি স্বাধীনতা' কমিটি গড়ে ওঠে। ঐ বছরেই বাংলার দুইজন রাজবন্দী মৃত্যুবরণ করেন। এই বিষয়টি বাংলার জনগণের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। ফলে বিনা বিচারে আটক আইনের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ সোচ্চার হয়ে ওঠে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও ধিককার জানান। ১৯৩৭ সালে রাজবন্দীদের সাহায্যের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বুদ্ধিজীবীগণের স্বাক্ষরিত আবেদনপত্রে তৎকালীন দেশের পরিস্থিতির কথা অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিবৃত হয়েছে "বিনাবিচারে বন্দী করা, বিচারে মুক্তি লাভের পর পুনরায় গ্রেপ্তার ও অন্তরীন করা, সভা-সমিতি ও বক্তৃতা করিবার অধিকার ক্ষুন্ন করিয়া ১৪৪ ধারা জারি করা, স্বাধীন চিন্তা এবং মত প্রকাশ বন্ধ করিবার উদ্দেশ্যে সংবাদপত্রকে আইন দ্বারা আষ্ঠে পৃষ্ঠে আবদ্ধ করা এবং আরও বহু প্রকারে সাধারণের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করাই হইতেছে আজিকার বাংলার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।"
১৯৩৭ সালের আগষ্ট মাসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, "জগতের অধিকাংশ দেশের দন্ডবিধিতে যে শাস্তিদানের নিষ্ঠুর প্রথা প্রচলিত আছে, উহাই মানব সভ্যতার কলঙ্ক। তাহার উপর সম্প্রতি পাশ্চাত্যের কোনও কোনও প্রদেশে রাজনৈতিক বন্দীদের উপর প্রতিহিংসা গ্রহণের এক উদ্দাম প্রবৃত্তি সহসা জাগিয়া উঠিয়াছে। ভারতবর্ষের গভর্ণমেন্টের মধ্যেও এই ফ্যাসিষ্ট-নীতি কতকটা সংক্রামিত হইয়াছে বলিয়া দেখা যাইতেছে। এই নীতি আইন এবং মানব স্বাধীনতার ন্যায্য দাবির প্রতি ভ্রূক্ষেপ করে না।"
পণ করো, দৈত্যের অঙ্গে
হানবো বজ্রাঘাতে, মিলবো সবাই এক সঙ্গে;
সংগ্রাম শুরু করো মুক্তির
দিন নেই তর্ক ও যুক্তির।
আজকে শপথ করো সকলে
বাঁচাব আমরা দেশ, যাবে না তা শত্রুর দখলে;
তাই আজ ফেলে দিয়ে তুলি আর লেখনী,
একতাবদ্ধ হও এখনি -জাগবার দিন আজ, পূর্বাভাস।
কোনো ভাব, কল্পনা বা আদর্শ মূলঅর্থে আকাশ থেকে পড়ে না, জীবনের অভ্যন্তরেই তার সৃষ্টি এবং সেই জীবন সমাজবদ্ধ। সুতরাং যে কোনো ভাব বা আদর্শের মধ্যেই নিহিত আছে সৃষ্টি কালের সমাজ চেতনা। সেই অর্থে সামাজিক ইতিহাসের অভ্যন্তরেই সে যুগের চেতনার সধান করতে হয়।
তবে প্রকৃত অর্থে মনে রাখা প্রয়োজন, যে দিন থেকে ইতিহাসের উদ্ভব ঘটেছে সে দিন থেকে দেখা যায় সমাজ দ্বিধাবিভক্ত (শাসক এবং শোষিত)। কমিউনিষ্ট পার্টির ম্যানিফেস্টোর জার্মান সংস্ককণের ভূমিকায় (১৮৮৩ সাল) এঙ্গেলস বলেছেন, "প্রত্যেক ঐতিহাসিক যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং তার থেকে উদ্ভূত সমাজ কাঠামো সেই যুগের রাজনৈতিক এবং মানসিক ইতিহাসের ভিত্তিভূমি। সুতরাং অদিম যুগের ভূমির উপর যৌথ মালিকানা অবলুপ্তির পর থেকে সমস্ত ইতিহাসই হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস, শোষক ও শোষিতের সংগ্রামের ইতিহাস, সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তরে অবদষিত ও প্রভূত্বকারী শ্রেণীর সংগ্রামের ইতিহাস।"
দূর পূর্বাকাশে
বিহ্বল বিষান উঠে বেজে
মরণের শিরায় শিরায়।
মুমূর্ষু বিবর্ণ মত রক্তহীন প্রাণ-
বিস্ফারিত হিংস্র বেদনায়। -- পূর্বাভাস।
১৯৪২'এর আগষ্ট, তীব্র হয় ভারত ছাড়ো আন্দোলন, চলতে থাকে ইংরেজদের দমন-পীড়ন এবং গ্রেপ্তার। এই উত্তাল সময়ে সুকান্ত কমিউনিষ্ট পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সেই অনুভব সুকান্তের কবিতায় দৃষ্টিগোচর হয়-
জনগণ হও আজ উদ্বুদ্ধ
সুরু করো প্রতিরোধ, জনযুদ্ধ,
জাপানী ফ্যাসিস্টদের ঘোর দুর্দিন মিলেছে ভারত আর বীর মহাচীন। সাম্যবাদীরা আজ মহা ক্রুদ্ধ
শুরু করো প্রতিরোধ, জনযুদ্ধ।
--জনযুদ্ধের গান।
ওই সময়ে মধ্যবিত্ত মানসিকতার সংশয়, দোদুল্যমানতা, জাগ্রত চেতনা প্রভৃতির প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় সুকান্তর 'মধ্যবিত্ত, ১৯৪২ কবিতায়। অন্যদিকে ৪২-এর উত্তাল পরিস্থিতিতে মানুষের মনের কথা ম্যানিফেস্টো হয়ে উঠেছে তাঁর 'উদ্যোগ' কবিতায়। তিনি লিখেছেন-
বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষন করো চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
মূঢ় শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে করো ছিন্ন,
একাগ্র দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন।
এরপরই তাঁর লেখনীতে বিধৃত হয় বিপ্লবী চেতনায় সময়ের উজ্জ্বল স্বাক্ষর 'চট্টগ্রাম ১৯৪৩' কবিতা
ক্ষুধার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম-
চট্টগ্রাম: বীর চট্টগ্রাম।
বিক্ষত বিধ্বস্ত দেহে অদ্ভুত নিঃশব্দ সহিষ্ণুতা
আমাদের স্নায়ুতে স্নায়ুতে
বিদ্যুৎ প্রবাহ আনে, আনে চেতনার দিন।
ফ্যাসীবাদী আগ্রাসনের মধ্যেই বাংলায় দেখা দিয়েছিল ৫০'এর মন্বন্তর। তার উপর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের নির্মমতা। সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ সময়। এই তমসাচ্ছন্ন সময়ে সুকান্তের কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে নব অরুণোদয়'এর গভীর প্রত্যয়-
রক্তে আনো লাল
রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল - বিবৃতি।
'চট্টগ্রাম: ১৯৪৩' কবিতায় রয়েছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লালফৌজের অজেয় সংগ্রামের কাহিনী। আর 'লেলিন' কবিতায় উদ্ভাসিত মহামতি লেনিরে নেতৃত্বে ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দূরন্ত ঘোষণা-
হাজার লেনিন যুদ্ধ করে,
মুত্তর সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে।
বিদ্যুৎ ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন
ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন,
বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ, বুকে আর্তনাদ;
আসে শত্রুজয়ের সংবাদ। --লেনিন।
অন্যায় এবং সংগ্রামের বিরুদ্ধে সংগ্রামই একমাত্র পথ। সংগ্রামী পথে কবি কন্ঠ হয়ে উঠেছে সুদৃঢ় :
আমি এক ক্ষুধিত মজুর
আমার সম্মুখে আজ এক শত্রু: এক লাল পথ,
শত্রুর আঘাত আর বুভুক্ষার উদ্দীপ্ত শপথ। --শত্রু এক।
৩০ দশকের মাঝামাঝি থেকে ইউরোপে যে বিরাট অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল তা ১৯৪১ সালে একেবারে কলকাতার দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত হোল। ১৯৪১ থেকে জাপানী বোমার ভয়ে কলকাতার মানুষ লাখে লাখে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেল। তখন দিনের কলকাতা ও জনশূণ্য। রাতে নিষ্প্রদীপ। ভয়ে সব শব্দহীন। মাঝে মাঝে মিলিটারি গাড়ি বা বুটের শব্দ। সুকান্ত লিখেছিলেন "....ম্লানায় মান কলকাতার ক্রমন্তস্বমান স্পন্দনধ্বনি শুধু বাংরবার আগমী ঘোষণা করছে আর মাঝে মাঝে আসন্ন শোকের ভয়ে ব্যথিত জননীর মত সাইরেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। নগরীর বুঝি অকল্যান হবে। আর ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে অবাতীর্ণ হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কলকাতা, তবে নাটকটি হবে বিয়োগান্তক। ১৯৪২ সাল কলকাতার নতুন সজ্জাগ্রহণের এক অভূত পূর্ব মুহূর্ত। বাস্তবিক ভাবতে অবকে লাগে, আমার জন্ম পরিচিত কলকাতা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাবে অপরিচয়ের গর্ভে, ধ্বংসের সমুদ্রে, তুমি ও কি তা বিশ্বাস কর, অরুণ?"
সুকান্তের এই বক্তব্যের মাধ্যমে একদিকে যেমন তখনকার কলকাতার অবস্থা জানা যায়, তেমনি অন্যদিকে সুকান্তের মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায়। মৃত্যু তো জীবনের অপরিহার্য পরিণতি কিন্তু সেই মৃত্যু যদি একটা বিরাট পরিবর্তনের মূল্য রূপে দিতে হয়, আগামী বসন্তের জন্য আত্মত্যাগ করতে হয় তবে সে মৃত্যু সার্থক।
আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতিক্ষায়,.....। -- রবীন্দ্রনাথের প্রতি।
৫০'এর ভয়াবহ ক্ষবন্তরের অভিঘাত সুকান্তের মনে গভীর বিষন্নতা সৃষ্টি করেছিল। সর্বোপরি যুদ্ধের অজুহাতে খাদ্যসামগ্রীর কৃত্তিম সংকট ইত্যাদি তাঁকে বিস্মিত এবং ক্ষুব্দ করে তুলেছিল। ফলে প্রতিবাদী কবির কলম হয়ে উঠেছিল বর্শামুখ-
আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে,
জমে ভিড় ভ্রষ্টনীড় নগরে ও গ্রামে,
দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিল,
প্রত্যেক নিরন্ন প্রাণে বয়ে আনে অনিবার্য মিল।
.....পথে পথে দলে দলে কঙ্কালের শোভাযাত্রা চলে,
দুর্ভিক্ষ গুঞ্জন তোলে আতঙ্কিত অন্দর মহলে! -- বিবৃতি।
এই যুদ্ধ, মন্বন্তর, বুভুক্ষা মানুষের হাহাকার, সমবেত আর্তনাদ তরুণ কবি সুকান্তের অন্তরকে দীর্ণ করেছিল। তাই তিনি লিখেছেন-
.....একদা দুর্ভিক্ষ এল
ক্ষুধার ক্ষমাহীন তাড়ানায়
পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁসি সবাই দাঁড়ালে একই লাইনে
ইতর-ভদ্র হিন্দু আর মুসলমান
একই বাতাসে নিলে নিঃশ্বাস।
-- ঐতিহাসিক।
কমিউনিষ্ট কবি স্বপ্ন দেখেছিলেন সমাজতান্ত্রিক ভারত একদিন হয়তো এশিয়ার মুক্তি সূর্যের প্রতীক হবে।
তাঁর আহ্বানষআর এক যুদ্ধ শেষ,
পৃথিবীতে তবু কিছু জিজ্ঞাসা উন্মুক্ত।
....জানো না এখানে যুদ্ধ শুরু দিন বদলের পালা।
অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র বলেছেন, "সাহিত্য গড়িয়া ওঠে যুগধর্মে।" সুতরাং শরৎচন্দ্রের কথাকে উপলব্ধি করে বলা যায় যে যুগের বিষয়টিকে অনুধাবন না করলে সাহিত্যের যথার্থতা অনুভব করা সম্ভব নয়। কেননা সুকান্ত যে সময়কালে জন্মেছিলেন সেই সময় কালের আর্থ সামাজিক পরিকাঠামো তাঁকে নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্নে আত্মনিবেদন করেছিল। লেনিন বলেছেন, "মানুষ তাদের নিজেদের রক্তমাংসেই রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে। যে বিপ্লবী কর্মী নিজের অভিজ্ঞতা গুলোকে সুস্পষ্ট করে তুলতে সক্ষম হবার জন্যে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে এই জীবনের মধ্যে সক্রিয়, তাঁর রাজনীতির মূল সমষ্যাগুলো কোনোক্রমেই নীরস আর শিল্প রচনার বিরোধী হিসেবে উপস্থিত হতে পারে না।"
মাও সে তুং বলেছিলেন, "বিপ্লবী লেখক ও শিল্পীদের লক্ষ্য হবে শুধু পরদেশ আক্রমণ কারীদের, শোষক ও উৎপীড়নকারীদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা, জনসাধারণের নয়। জনসাধারণের নিজস্ব ত্রুটি বিচ্যুতি আছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই, কিন্তু এ ত্রুটি প্রধানত তাদের অত্যাচারীদের শাসনেরই ফল স্বরূপ।" সুকান্ত যথার্থ অর্থেই ছিলেন সর্বহারা মতাদর্শের কবি। তিনি তাঁর জীবনের গভীরতম আবেগের মধ্য দিয়েই সর্বহারা রাজনৈতিক ধারণার পথে ধাবিত হয়েছিলেন।
হে সূর্য।
তুমি আমাদের উত্তাপ দিও-
শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড, তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকই
এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ডে
পরিণত হব। -- প্রার্থী।
বুদ্ধদেব বসুর সমকালীন কবি বিষ্ণু দে লিখেছিলেন, "সুকান্তের কবিতা চার-পাঁচ বছর আগে হাতে আসে, হাতে-লেখা তিনটি কবিতা, পরিস্কার পরিণত হাতের লেখা। আশ্চর্য হয়েছিলুম সুকান্তর কবি প্রতিভা প্রকাশিত হলো প্রতিশ্রুতিতে নয়, একেবারে পরিণতিতে। তারপর থেকে মাঝে মাঝে তার কবিতা পড়েছি। অক্লান্ত কর্মীর আত্মত্যাগের অবসরহীন মাসন কিন্তু সুলিখিত কবিতা। একাধারে তার এই পরিণত কবিত্ব এবং মার্কসিস্ট তত্ত্বের জনগাম্ভীর্য বারবার বিস্মিত করেছে ভেবেছিল গৌঢ়ত্বে আর কি লিখবে, এর বিস্ময়কর প্রতিভার কি বিকাশ সম্ভব?" (স্বাধীনতা ১৮ মে, ১৯৪৭)। বাস্তবিক অর্থে সুকান্ত ছিলেন অসামান্য কবি। বিষ্ণু দে'র এই বক্তব্যের মাধমে সুকান্তের কবি প্রতিভার একটি সঠিক প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।
আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক,
হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল,
রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ,
আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি। আজ নীল আকাশ আমাাকে পাঠিয়েছে আমন্ত্রন,
স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ,
চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠি,
কিছুতেই বুঝি না কী করে এড়াব তাকে? -- প্রিয়তমায়ু।
কমিউনিষ্ট পার্টির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জনগণের সংগ্রামের সঙ্গে ঘণিষ্ঠ সম্পর্কে এসেছিলেন কিশোর কবি সুকান্ত। নিপীড়িত জনগণের দুঃখ-বেদনা, আশা-আকাঙ্খা, প্রতায় ও সংগ্রামের সঙ্গে গভীর একাত্মতার মধ্যে লালিত এবং বিকশিত হচ্ছিল তাঁর বলিষ্ঠ কাব্যচেতনা। ফলে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিল গণসংগ্রাম কার্যক্রমেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুকান্তের আহ্বান --
আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
যে সন্ধ্যায় রাজ-পথে পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরে জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।
নিজের কবি ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সুকান্ত বলেছিলেন, "কবি বলে নির্জনতাপ্রিয় হব, আমি কি সেই ধরণের কবি? আমি যে জনতার কবি হতে চাই, জনতা বাদ দিলে আমার চলবে কি করে? তা ছাড়া কবির চেয়ে বড়ো কথা আমি কমিউনিষ্ট, কমিউনিষ্টদের কাজ করবার সব জনতা নিয়েই।"
দুর্বল পৃথিবী কাঁদে জটিল বিকারে, মৃত্যুহীন ধরণীর জ্বলন্ত প্রলাপ
অবরুদ্ধ বক্ষে তার উন্মাদ তড়িৎ
নিত্য দেখে বিভীষিকা পূর্ব অভিশাপ।
অধ্যাপক জগদীশ ভট্টচার্যের মতে, "সুকান্তের কাব্যে এ যুগের তিনটি চিত্তবৃত্তি প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে।
১। জনজীবন চেতনা, ২। সমপ্রাণতা ও ৩। শুভকর্ম প্রেরণা। প্র্যতকে যুগের কতগুলো সঞ্চারী ভাব মুখ্য হয়ে ওঠে। এ যুগের তিনটিই মুখ্য সঞ্চারী।"
জীবন চেতনার অনেকগুলো লক্ষণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সুকান্তের কর্ম এবং কাব্যচর্চায়। সুকান্তের অভিব্যক্তি বৃহত্তর মঙ্গলময়তার দিকে অগ্রসর হওয়া, সেখানে ব্যক্তি জীবন নয়, সুখ-সমৃদ্ধি নয়, ব্যক্তি জীবন সমগ্র সমাজ জীবনের কথা বলে। সমষ্টিগত প্রতিযোগ এক সম্ভবনাময় ভবিষ্যতের আধার।
আমার মৃত্যুর পর থেমে যাবে কথার গুঞ্জন
বুকের স্পন্দনটুকু মূর্ত হবে ঝিল্লির ঝংকারে,
জীবনের পথ প্রান্তে ভুলে যাবে মৃত্যুর শংকারে,
উজ্জ্বল আলোর চোখে আঁকা হবে আঁধারের অঞ্জন।
জগদীশ ভট্টাচার্যের মতে সুকান্তের সবচেয়ে অবিস্মরণীয় কবিতা 'রানার'। এই কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় বাস্তব জীবন বোধের এক অদ্ভুত অনুভূমি। পরবর্তী সময়ে এই কবিতাটি সলিল চৌধুরীর সুরে এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যয়ের কন্ঠে বাংলার পথ প্রান্তর অতিক্রম করে সকল শ্রেণীর মানুষের ভাবাবেগকে নাড়া দিয়েছিল।
রানার! রানার!
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,
বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে;
রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়, আরো জোরে, আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয়।
তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিয়ে সরে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ-বুঝি হয় লাল ও পূর্ব কোণ।
সুকান্ত প্রকৃত অর্থে ৩০ ও ৪০'এর দশকের অবক্ষয়ী সমজের জ্বলন্ত ইতিহাস। তাঁর জীবন বিদ্রোহী অথচ মানবিকতা পূর্ণ। তিনি মেহনতী জনগণের কবি। সুকান্তের কাব্য স্পষ্ট, আপসহীন, শানিত, হাতুড়ির মতো শক্ত, কঠিন এবংনতুন চিন্তার ফসল। গভীর নৈরাশ্য এবং যন্ত্রণার মধ্য হতে জেগে ওঠা আশাবাদই সুকান্তের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
তোমাকে দিচ্ছি চরমপত্র রক্তে লেখা, অনেক দুঃখে মথিত এ শেষ বিদ্যে শেখা অগণ্য চাষী মজুর জেগেছে শহরে গ্রামে সবাই দিচ্ছে চরমপত্র একটি খামে; পবিত্র এই মাটিতে তোমার মুছে গেছে ঠাঁই
ক্ষুব্ধ আকাশে ধ্বনিত 'স্বাধীনতা চাই'।
--চরমপত্র।
সুকান্ত ছিলেন সমাজ জীবনে শোষণ বঞ্চনা বিরোধী শান্তি প্রতিষ্ঠাকামী বিপ্লবী এবং স্বাপ্নিক কবি। রাজনীতি ও কবিতা কোনোটিকেই তিনি ভিন্নরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন নি। উভয় বিষয়কেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন জীবনের সমগ্রতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিলিয়ে। ফলে রাজনীতি এবং কবিতার এই মেলবন্ধনে রাজনীতি হয়েছে তাঁর কবিত্বের স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ প্রকাশ। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, দেশের জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তি আসবে শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। উপলব্ধি করেছিলেন, সুখী সুন্দর নতুন জীবনের জন্য, শোষণ ও শৃঙ্খলমুক্ত মানবতা প্রতিষ্ঠার জন্য চাই এক সফল বিপ্লব। এই বিপ্লব পরিচালিত হবে সর্বহারা অর্থাৎ মেহনতী জনগণের নেতৃত্বে। সুতরাং সেই অর্থে ৪০'এর দশকের উত্তাল গণসংগ্রামে যুক্ত হয়ে সুকান্ত সাম্রাজ্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ধ্বংসকামী এক রক্তাক্ত বিপ্লবকেই যেন আসন্ন ও অনিবার্য বলে অনুভব করেছিলেন।
আমরা বেড়িয়ে পড়ব,
আমরা ছড়িয়ে পড়ব শহরে, গঞ্জে, গ্রামে-দিগন্ত থেকে দিগন্ত।
আমরা বারবার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়-
তা তো তোমরা জানোই।
কিন্তু তোমরা তো জানো নাঃ
কবে আমরা জ্বলে উঠব-
সবাই শেষবারের মতো। -- দেশলাই কাঠি।
৩০ এবং ৪০'এর দশকে বামপন্থী জীবনবোধকে আলোকবর্তিকা করে যে সকল কবি পৃথিবীতে পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী শোষনের পোষন যন্ত্রে মানুষের মর্মযাতনায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, এবং বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে কলমকে তীব্র কুঠার করেছিলেন, সাকন্তু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম।
একদা যুদ্ধ হল সারা বিশ্ব জুড়ে জগতের যত লুণ্ঠনকারী আর মজুরে, চঞ্চল দিন ঘোড়ার খুরে।
উঠি উদ্ধত প্রাণের শিখরে, চারিদিকে চাই
এল আহ্বন জনপুঞ্জেও শুনি রোশনাই দেখি ক্রমাগত কাছে উৎরাই।
হাতছানি দিয়ে গেল শষ্যের উন্নত শীষ,
জনযাত্রার নতুন হদিশ-
সহসা প্রাণের সবুজে সোনার দৃঢ় উষ্ণীষ -- হদিশ।
মার্কসবাদ অনুসারে প্রতিটি সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর নিজ নিজ শ্রেণী স্বার্থের বৈরীতামূলক প্রকৃতিই শ্রেণী সংগ্রামের উৎস। পুঁজিবাদী সমাজে বুর্জোয়া শ্রেণী থাকে সমাজ ব্যবস্থার নিয়ত্তার অবস্থানে বিরাজমান শোষণ ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক আধিপত্য ও স্বার্থ সংরক্ষণে তারা থাকে সদা তৎপর। পক্ষান্তরে শ্রমিক ও অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণী শোষণ ও সামাজিক নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি ও অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে।
মার্কস-এঙ্গেলস্'এর তত্ত্ব অনুসারে পুঁজিবাদী সমাজে এই দুই শক্তির মধ্যে শ্রেণীগত সংগ্রামই সমাজবিকাশের মূল চালিকাশক্তি। সমাজ বিবর্তনের একটা পর্যায়ে শ্রেণী সংগ্রাম চূড়ান্ত রূপ নেয় সমাজবিপ্লবে। পুঁজিবাদী সমাজে সংঘটিত সমাজ বিপ্লবের ভেতর দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে বিপ্লবী শ্রেণী।
এখানে চল্লিশ কোটি এখনো জীবিত ভারতবর্ষের পরে গলিত সূর্য ঝরে আজ-
দিগ্বিদিকে উঠেছে আওয়াজ
রক্তে আনো লাল,
রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল, -- বিবৃতি।
সুকান্তের কবিতায় সামাজিক মুক্তি এবং জনচেতনা নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এসেছে বঞ্চিত, নিপীড়িত জনগণের প্রতি সহানুভূতি। তাই শোষন নির্ভর সমাজব্যবস্থার ধ্বংসের কথা সুকান্তের কবিতায় নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
দেখব, ওপরে আজো আছে কারা, খসাব আঘাতে আকাশের তারা,
সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া,
ছড়াব ধান।
জাতি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান -- বিদ্রোহের গান।
মনে রাখতে হবে উপনিবেশ গুলি থেকে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ ব্যতীত পুঁজিবাদী সভ্যতার তাক্-লাগানো সৌধ যে কখনই গড়ে উঠতে পারত না, তার অমোঘ যুক্তি আমরা পাই লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ সংক্রান্ত আলোচনায় বা রোজা লুক্সেমবুর্গের 'আদি পুঞ্জীকরণ' এর বিশ্লেষণে। পুঁজিবাদের সংকটমোচনের উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবিস্তারের চেষ্টা ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছিল। ৩০'এর দশক থেকে পুঁজিবাদ এবং ফ্যাসিষ্ট বিরোধী সংস্কৃতির নতুন ধারাটি কেবল ধর্মীয় জাতিয়তাবাদের বিপক্ষেই দাঁড়ায়নি, স্বাধীনতার আকাঙ্খার মধ্যে যুক্ত করেছে তার আন্তর্জাতিকতার বার্তা। ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লাল ফৌজের (সোভিয়েত রাশিয়া) অসমসাহসিক প্রতিরোধ ঔপনিবেশিক শাসনে থাকা দেশগুলির কাছেও অনুপ্রেরণার বিষয় হয়ে উঠেছিল। আর সেই সঙ্গে এই ফ্যাসিষ্ট বিরোধী চেতনায় মেহনতী জনগণের জাগরণ স্বাধীনতার একটি গুরুত্ব পূর্ণ সূচক রূপে চিহ্নিত হয়েছিল। প্রগতি আন্দোলনে উদারপন্থী মানবতাবাদী লেখক চিন্তকদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংস্কৃতির যৌথ মঞ্চ গড়ে তোমার আহ্বান বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একথা স্পষ্ট করে যে, এই উদ্যোগগুলিতে প্রগতিশীল লেখক শিল্পী দার্শনিকদের প্রচেষ্টার অংশীদার ছিলেন সোভিয়েত রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশের কমিউনিষ্টরা।
শঙ্কাকুল শিল্পীপ্রাণ, শঙ্কাকূল কৃষ্টি, দুর্দিনের অন্ধকারে ক্রমশ খোলে দৃষ্টি। হত্যা চলে শিল্পীদের, শিল্প আক্রান্ত, দেশকে যারা অস্ত্র হানে, তারা তো নয় ভ্রান্ত।
বিদেশী চর ছুরিকা তোলে দেশের হৃদ্-বৃন্তে
সংস্কৃতির শত্রুদের পেরেছিল তাই চিনতে। -- 'ছুরি', ঘুম নেই।
১৯৪২ সারে ৮ মার্চ ঢাকাতে 'সোভিয়েত সুহৃদ সংঘের আহ্বানে একটি ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে তরুণ ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী ও লেখক সোমেন চন্দ নৃশংসভাবে খুন হন। সোমেন চন্দের মৃত্যু সুকান্ত কে প্রবলভাবে ব্যাথিত করেছিল। সুকান্ত লিখেছেন-
শহীদ খুন, আগুন জ্বালে, শপথ, অক্ষুন্নঃ
এদেশে অতি শীঘ্রই হবে বিদেশী, চর, শূন্য।
বাঁচার দেশ, আমার দেশ হানবো প্রতিপক্ষ,
এ জনতার অন্ধ চোখে আনবো দৃঢ় লক্ষ্য। -- 'ছুরি, ঘুম নেই।
১৯৪৩ সালের মার্চে সমগ্র ইতালি জুড়ে প্রবল শ্রমিক আন্দোলন, গণবিক্ষোভ এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মুখে ফ্যাসিবাদের জনক মুসোলিনীর পরাজয় সুকান্তের কবিতায় উঠে এসেছে:
ভেঙেছে সাম্রাজ্যস্বপ্ন, ছত্রপতি হয়েছে উধাও;
শৃঙ্খল গড়ার দুর্গ ভূমিসাৎ বহু শতাব্দীর।
'সাথী, আজ দৃঢ় হাতে হাতিয়ার নাও'-রোমের প্রত্যেক পথে ওঠে ডাক ক্রমশ অস্থির।
উদ্ধত ক্ষমতালোভী দস্যুতার ব্যর্থ পরাক্রম,
মুক্তির উত্তপ্ত স্পর্শে প্রকাশিত-
যুগ যুগ অন্ধকার রোম। -- রোম ১৯৪৩।
সুকান্তের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে সমাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যেকার দ্বন্ধ হলো শোষণ ও বঞ্চনার বিশ্ব বনাম সমৃদ্ধ, শোষণহীন, উন্নত বিশ্বের মধ্যেকার সংগ্রাম। মানবসভ্যতার অগ্রগতিকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় সুনিশ্চিত করে সমাজতন্ত্র স্থাপনের সংগ্রামকে জোরদার করতেই হবে। সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধ পরস্পরকে জড়িয়ে রয়েছে। চিরতরে শান্তি দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার জন্যও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে শক্তিশালী করতেই হবে। দেশে দেশে প্রগতির শক্তির অগ্রগতি, গণতন্ত্র ধর্ম নিরপেক্ষতার পক্ষে সংগ্রাম, শ্রমিক কৃষক সহ মেহনতি জণগনের সংগ্রাম জোরদার করে, পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ'এর বিরুদ্ধে লড়াই আরও তীব্রতর করতেই যুগের কেন্দ্রীয় দ্বন্ধ সমাজতন্ত্র বনাম সাম্রাজ্যবাদ তার তীব্রতা বৃদ্ধির ওতর মানব সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
সামনে ধূম-উজ্জীরণত কামান,
পেছনে খাদ্যশস্য আঁকড়ে ধরা জনতা
-কামানের ধোঁয়ার আড়ালে দেখলাম, মানুষ।
আর দেখলাম ফসলের প্রতি তাদের পুরুষানুক্রমিক মমতা।
অনেক যুগ, অনেক অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র পেরিয়ে
তারা এগিয়ে আসছে ঝানো কঠোর মুখে --কনভয়।
সুকান্ত কমিউনিষ্ট আদর্শে অটল থাকলেও কখনই তিনি বাধাহীন ভাবাবেগে অবগাহন করেন নি। তিনি ছিলেন স্থির চিন্তক। তাঁরসংগ্রাম শীল জীবনধারা তাঁকে জনগণ মুখী এবং জনগণের নিকটবর্তী করেছিল। কেননা ১৯৪০-১৯৪২ সালের সন্ধিক্ষণে সুকান্ত সর্বহারা মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং জনগণকে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এইকালপর্বে সুকান্ত ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। 'পরিখা' কবিতায় তিনি প্রতিরোধ লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছেন-
মরণের আজ সর্পিল গতি বক্রবধির-
পিছনে ঝটিকা, সামনে মৃত্যু রক্তলোলুপ।
বারুদের ধূম কালো ছায়া আনে, তিকরত রুধির;
পৃথিবী এখনো নির্জন নয় জ্বলন্ত ধূপ নৈঃশব্দ্যের তীরে তীরে আজ প্রতীক্ষাতে সহস্র প্রাণ বসে আছে ঘিরে অস্ত্র হাতে-
বস্তুত সুকান্তের দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম ছিল ভারতীয় জনগণের মুক্তিসংগ্রাম। তাঁর এই উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে 'মণিপুরে' কবিতায়।
এ ধূলোয় প্রতিরোধ, এ হাওয়ায় ঘূর্ণিত চাবুক,
এখানে নিশ্চিহ্ন হল কত শত গর্বোদ্ধত বুক।
এ মাটির জন্যে প্রাণ দিয়েছি তো কত যুগ ধরে,
রেখেছি মাটির মান কতবার কত যুদ্ধ ক'রে।
প্রত্যক্ষভাবে সর্বহারা মতবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার পূর্বেই সুকান্ত পীড়িত করেছিল স্বদেশের পরাধীনতা, দারিদ্রতা এবং মৃত্যু মিছিল। তারই বেদনামথিত রূপায়ন ঘটেছে 'অনুভব' কবিতায় ১৯৪০'এর অংশে :
অবাক পৃথিবী। আমরা যে পরাধীন অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন;
------------------------------ -
হিসেবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে
দেখেছি লিখিত 'রক্ত খরচ' তাতে;
এ দেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম,
---- অনুভাব: ১৯৪০।
১৯৪১ সালে (জুন মাস) নাৎসী জার্মান বাহিনী হিটলারের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ করলে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি সোভিয়েত রাশিয়া সহ মিত্রশক্তির পক্ষে এবং ফ্যাসিবাদী অক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মিত্রশক্তিকে সমর্থন করতে গিয়ে কমিউনিষ্ট পার্টি কংগ্রেস এবং সুভাষ চন্দ্র বসুর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারে নি। সেই সময় কমিউনিষ্ট পার্টির এই অবস্থান প্রসঙ্গে অমলেন্দু সেনগুপ্ত (উত্তাল চল্লিশ অসমাপ্ত বিপ্লব) লিখেছেন- ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে, আন্তর্জাতিকতাবোধ ও জাতীয়তাবাদের দ্বন্ধ কমিউনিষ্ট ও অন্যদের মধ্যে সৃষ্টি করল এক দুস্তর ব্যবধান। আন্তর্জাতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কমিউনিষ্টদের দৃষ্টিতে মূল শত্রু ফ্যাসিজম। এবং যুদ্ধে ফ্যাসিজমের জয় ও লালফৌজের পরাজয়ের অর্থ ানব সভ্যতার বিনাশ ও সমাজবিকাশের ধারায় ছেদ। অপরদিকে জ্বলন্ত বাস্তব হল দেশের মাটিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন অস্তিত্ব। স্বদেশ ও বিশ্বকে মেলাতে গিয়ে এক সংকটের আর্বতে গিয়ে পড়ে ভারতের কমিউনিষ্টরা।
কমিউনিস্টরা ভারতের স্বাধীনতা বিরোধী এই কুৎসার জবাবে কবি সুকান্ত তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন 'বিক্ষোভ' কবিতায়-
দৃঢ় সত্যের দিতে হবে খাঁটি দাম,
হে স্বদেশ, ফের এই কথা জানালাম। যারা আজ এত মিথ্যার দায়ভাগী, আজকে তাদের ঘৃণার কামান দাগি।
সুকান্তের কবি প্রতিভা সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, 'সাধারণ মানুষের জীবনকে সমবেদনায় অর্ন্তদৃষ্টিতে দেখবার যে শক্তি সুকান্তের কাব্যের প্রতি ছত্রে অনুরণিত হয়ে উঠেছে সে শক্তি সুকান্ত লাইব্রেরী বিহারিণী সরস্বতীর কাছে পায় নি, সে শক্তি সুকান্ত লাভ করেছিলেন জীবনের পাঠশালায় যার অধিষ্ঠান মাঠে গ্রামে, বস্তিতে মিলে রাজপথে। প্রসঙ্গত সুকান্ত বড়ো কবি হতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন জনগণের অসহায়ত্বকে প্রতিবাদের ভাষা দিতে এবং দিতে পেরেও ছিলেন।
আনন্দ বাগচী বলেছেন, 'সুকান্তর কবিতা আকাশ কুসুম নয়, অগ্নি কুসুম।' আর তারাশঙ্কর আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, 'আমি বিশ্বাস করি ইতিহাসের অমোঘ অস্ত্রসালায় এই কবিদধীচির অস্থিমালা দিয়ে যে বজ্র তৈরী হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে বঞ্চিত মানুষের বুকে তার ক্ষমাহীন নির্ঘোষ শোনা যাবে।'
১৯৪৬ সালের ১লা মে'র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সুকান্ত আহ্বান জানাচ্ছেন শাসক শ্রেণীর বশ্যতাকে অস্বীকার কারে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে:
তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো,
অস্বীকার করো বশ্যতাকে
চলো, শুকনো হাড়ের বদলে
সন্ধান করি তাজা রক্তের,
তৈরী হোক লাল আগুনে ঝলসানো আমাদের খাদ্য।
শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে গজিয়ে উঠুক
সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে -- ১লা মে- এর কবিতা ৪৬।
জালিয়ানওয়ালাবাগ (১৯১৯), চট্টগ্রাম (১৯৩০), ধর্মতলা (১৯৪৫) তে ব্রিটিশবিরোধী যে সংগ্রাম হয়েছে, সেই সকল সংগ্রামের সঙ্গে ঘোষিত হয়েছে তাঁর বিপ্লবী চেতনা:
জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু
সে পথে আমাকে পাবে,
জালালাবাদের পথ ধরে ভাই
ধর্মতলার পরে,
দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেকের ঘরে
---ঠিকানা।
চারিদিকে বিদ্রোহের আগুন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে, উন্মেষ ঘটেছে নতুন চেতনার, বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণী সাম্রাজ্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সচেতন কবি তখন শেকল ভাঙা সংস্কৃতির স্বপ্নে বিভোর হয়ে বলেছেন-
হে কলম! হে লেখনী! আর কত দিন ঘর্ষণে হবে ক্ষীণ?
আর কত মৌন-মুক, শব্দহীন দ্বিধান্বিত বুকে
কালির কলঙ্ক চিহ্ন রেখে দেবে মুখে? আর,
কত আর আর কাটবে দুঃসহ দিন দুর্বার লজ্জার?
রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী' নাটকে দেখা যায় যক্ষপুরীর অবিরাম শোষণের চিহ্ন। বহুশ্রমিকের রক্ত-শ্রম শোষণ করে পুঁজিপতি লাভ করে আরাম নিবিড়তা আর মুনাফা। কিন্তু এই শোষণ ও একদিন পুঁজিপতির নিকট বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। শ্রমিক শ্রেণী ও তার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠে সচেতন। সে তখন হাতুড়ির আঘাতে ধ্বংস করে দিতে চায় দাসত্বের নির্মম বন্ধন।
শোন রে মালিক, শোন্ রে মজুতদার।
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়
হিসাব কিদিবি তার?
প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি,
সে কথা কি আমি জীবনে
মরণে কখনো ভুলতে পারি?
শ্রেণী সংগ্রামের প্রশ্নে মার্কস বলেছেন, 'সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী.... সমাজ ব্যবস্থার যে অন্তাবন্ধ চলেছে মানুষ ও তার অংশীভূত; উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থার সংঘাত মানুষকে চেপে ধরেছে, মানুষকে ভঅবিয়ে তুলছে। এই সংঘাতের তীব্রতা মাষকে নতুন সমাধানের সন্ধানে চালিত করছে। উৎপাদন ব্যবস্থা তো মানুষ বর্জিত প্রকৃতি জগতের বিষয় নয়। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে নিয়েই উৎপাদন ব্যবস্থা সংগঠিত। সেজন্য মানুষকেই সমাজের অর্ন্তাবন্ধ সম্বন্ধে সচেতন হতে হয়। কারণ উৎপাদনের উপকরণের মধ্যে বৈপ্লবিক শ্রমিক শ্রেণীই হলো সবচেয়ে শক্তিশালী উৎপাদিকা শক্তির (প্রভার্টি অফ ফিলোসফি, মার্কস)।
শোন রে বিদেশী, শোন্
আবার এসেছে লড়াই জেতার চরম শুভক্ষণ!
আমরা সবাই অসভ্য, বুনো-
বৃথা রক্তের শোধ নেব দুনো
একপা পিছিয়ে দু'পা এগোনোর আমরা করেছি পন,
ঠ'কে শিখলাম
তাই তুলে ধরি দুর্জয় গর্জন। --একুশে নভেম্বর, ১৯৪৬।
রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, দুঃখের মন্থনে জীর্ণ প্রাচীনতা থেকে নবীণের সাধনা উঠে আসবে। ঝড় সমস্ত কিছু আর্বজনা পঙ্কিলতা ধ্বংস করে নবসৃষ্টির সূচনা করে দেয়। এই অর্থবোধকে পাথেয় করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন---
আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিয়ে তখনি,
এই স্বর সাধনায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক-
রয়ে গেছে ফাঁক।
৪০'এর দশকে সাম্যবাদের আদর্শ আমাদের দেশে প্রবলভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সেই সময় আধুনিক কবিদের অনেকেই 'মধ্যবিত্ত রোমান্টিজম্' কে পরিত্যাগ করে সর্বহারার মতাদর্শকে গ্রহণ করেছিল। সুকান্ত ভট্টাচার্য দূর থেকে দাঁড়িয়ে কবিতা লেখেন নি। রাজনৈতিক জীবনে সাম্যবাদের পতাকাতলে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, "ফলে, কবিতাকে সে সহজেই রাজনীতির সঙ্গে মেলাতে পেরেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে কোনো দ্বিধা ছিল না।" সুকান্ত ও বলতেন, "আমার কবিতা পড়ে পার্টির কর্মীরা যদি খুশি হয় তাহলেই আমি খুশি কেন না এই দলবলই তো বাড়তে বাড়তে একদিন এ দেশের অধিকাংশ হবে।"
হে জীবন, হে যুগ সন্ধিকালের চেতনা
আজকে শক্তি দাও, যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি,
প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের
তুষার গলানো উত্তাপ। -- বোধন।
আদ্যোপান্ত বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও সুকান্ত'র মনে রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিপুল শ্রদ্ধাভাব ছিল।
এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি,
প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি,
এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি,
নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রুকুটি;
এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে
তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে।
এখনো স্বগত ভাবাবেগে,
মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে।
রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের পর উভয় বাংলায় সুকান্ত ছিলেন প্রগতি পন্থী বিপ্লবী মানবতাবাদী ধারার অন্যতম বলিষ্ঠ প্রতীক। সুকান্তের রচনায় কবি বিষ্ণু দে প্রত্যক্ষ করেছেন পরিণত কবিত্ব: 'সুকান্তর কবিপ্রতিভা প্রকাশিত হলো প্রতিশ্রুতিতে নয়, একেবারে পরিণতিতে, অক্লান্ত কর্মীর আত্মত্যাগের অবসরহীন মানস কিন্তু সুলিখিত কবিতা। একধারে তাঁর এই পরিণত কবিত্ব এবং মার্কসীয় তত্ত্বের জনগাম্ভীর্য। ক্রিস্টোফার কডওয়েল বলেছেন, 'কবি কাব্যের চিরন্তন অনুভূতিগুলিকে অক্ষুণ্ণ রেখেই অনুভবের প্রতি আকৃষ্ট হন। নারায়ণ চৌধুরীর ভাষায় (লেখক পাঠক ও সমাজ), 'কবিতায় শাশ্বত মূল অব্যাহত রেখে কবিতায় নতুন মূলবোধের পোষকতা করেছিলেন। কাব্যের চিরন্তন সৌন্দর্যের উপাসক হয়েও (সুকান্ত) কাব্যবস্তুতে যুগোচিত ভাবগত পরিবর্তন সাধন করেছিলেন-
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ তারপর হব ইতিহাস। -- ছাড়পত্র।
কবি সুকান্ত ভট্টচার্য (১৫ আগষ্ট, ১৯২৬, ১৩ মে ১৯৪৭)'র সৃষ্টিশীল সত্তার তত্ত্বগত অনুপ্রেরণা ছিল বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের রূপকার লেনিন। কিন্তু একথা বললে ও তাঁর আদর্শবোধ কোনও ভাবেই খর্ব হবে না যে যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাতে...." এই কবিতাটির মধ্যে মহামানব গৌতম বুদ্ধের প্রভাব অবেচতন ভাবে উঠে এসেছে। কেননা বুদ্ধের মূল সিদ্ধান্ত ছিল মানব জীবনের দুঃখ মুক্তি। সুকান্ত ও এই বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন উত্তরকালে মার্কসবাদের আঙ্গীকে। যদিও বুদ্ধের সময়কাল এবং সুকান্তের সময়কাল এক নয় এবং তা হওয়ার বিষয়টি সম্ভব নয়। কারণ যুগের পরিবর্তন। কিন্তু একথাও ভুলে গেলে চলবে না বুদ্ধের সিদ্ধান্ত উত্তরকালের প্রগতিবাদী কোনো দার্শনিক নস্যাৎ করেন নি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং তাঁর কবিতায় শ্রদ্ধাভাবের বিষয়টি বারংবার উদ্ভাষিত হয়েছে।
মহামানব বুদ্ধ এই পৃথিবীকে যে সত্যের আলোক বর্তিকা প্রদান করেছিলেন, ঠিক সেই ভাবে সুকান্ত ও আশাবাদী ছিলেন যে একদিন মেহনতী জনগণ বিপ্লবের মাধ্যমে পৃথিবীকে জঞ্জাল মুক্ত করবে এবং সেই জঞ্জালমুক্ত পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবে নতুন শিশু।
মাত্র আট বছরের সংক্ষিপ্ত কাব্য জীবনে সুকান্ত তাঁর সৃষ্টিরাজিতে তৎকালীন বিশ্ব এবং স্বদেশ, এই দুই'এর পরিসরে বিপ্লব-বিদ্রোহ, রাজনীতি, নিজের চিন্তা-চেতনা, মূলবোধ'এর রূপকে বিপ্লবী আঙ্গিকে চিত্রয়িত করেছেন। কবির স্বপ্ন ছিল তিনি এই বিশ্বকে আগাম শিশুর বাসযোগ্য করবেন, করবেন, সৃষ্টির কাজে, প্রিয় আদর্শের স্বপ্নে বিভোর হয়ে কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করবেন। কিন্তু এক বৈশাখী সকালে তিনি বিদায় নিলেন......।
ছাড়পত্রের অধিকারে হয়তো কেউ আসবে না
আঠারোর জয়গানে পংতি ভাসবে না অল্প আয়ব অগ্নি বায়ু কেউ দেখবে না তোমার মতো করে কেউ দেখবে না আর কেউ লিখবে না।
কবি, তোমার মতো করে কেউ লিখবে না
আর কেউ লিখবে না।
আকর কুঞ্চিকা :
১। সুকান্ত ভট্টাচার্য, ঈশান সামী, কথা প্রকাশ, বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০১৭।
২। সুকান্তের জীবন ও কাব্য, ড. সরোজ মোহন মিত্র, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৮।
৩। রাজনীতির কবি বিপ্লবের কবি সুকান্ত, সন্দীপ দে, দেশহিতৈষী, শারদ সংখ্যা ১৪৩২, ২০২৫।
৪। সুকান্ত ভট্টাচার্য, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, বাড়িঘর, ২য় মুদ্রণ, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ, ২০১৮।
৫। তিনজন আধুনিক কবি, সমর সেন সুভাষ মুখোপাধ্যা সুকান্ত ভট্টাচার্য, ড. মাহবুবুল হক, কথা প্রকাশ, বাংলাদেশ, ঢাকা, ২০০৫।
৬। কবি সুকান্ত নিঃসঙ্গ বাতিওয়ালা, তরুণ মুখোপাধ্যায়, রাধা প্রকাশনী, কোলকাতা, ২০২৫।
৭। কোরক' সাহিত্য পত্রিকা, প্রাক্ শারদ সংখ্যা, ২০২৫, জন্ম শতবর্ষে সুকান্ত ভট্টাচার্য।
No comments:
Post a Comment