Thursday, November 2, 2023

ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ: বৌদ্ধাচার্য শীলভদ্রের উত্তরসুরী

 সুমনপাল ভিক্ষু 

"যা চেয়মমধ্যমা প্রতিপদা আত্মকায়কলপথানুযোগো দুঃশোহনর্পো প্রসংহিতো দৃষ্টধর্মদুঃশশ্চায়ত্যাং চ দুঃখবিপাক :। এতো চ ভিক্ষবো দ্বাবত্তাবপুপগম্য মধ্যময়ৈব প্রতিপদা তথাগতো ধর্ম দেশয়তি।"

- ললিতবিস্তর,পৃঃ ৩৩৩।

যখন একজন বুদ্ধ শাসনে নিযুক্ত হন,তখন তিনি এই পৃথিবীকে আলোকিত করেন,যেমনভাবে তমসাচ্ছন্ন মেঘ হতেমুক্ত চাঁদ আলোকিত হয়।এই নিবন্ধে বিংশ শতাব্দীর এমন এক ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুর সম্পর্কে আলোচনা করতে চলেছি,যিনি অমাগারিক ধর্মপাশ,মহাপন্ডিত রাহুল সায়ংকৃত্যায়ন এবং ভান্তে আনন্দ কৌশল্যায়নের দ্বারা বুদ্ধ শাসনকে পুঃনপ্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।তিনি ভগবান বুদ্ধের দেশনা কে (ত্রিপিটক) মূল পালি ভাষায় নাগরী অক্ষরে লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি পালি থেকে হিন্দি অনুবাদ, হিন্দিতে পালি ব্যাকরণ প্রস্তুত করা,স্বাধীনভাবে বিভিন্ন নতুন পাঠ্যক্রম নির্মাণ এবং নব নালন্দা মহাবিহারের ন্যায় (বিশ্ববিদ্যালয়) একটি উদীয়মান আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।

১৯০৭ খ্রীঃ ২ মে,ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ তদানিন্তন বৃটিশ শাসিত ভারতের রাঁচী শহরে(বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্তর্গত) জন্মগ্রহণ করেছিলেন।তাঁর পিতা শ্যাম নারায়ণ ছিলেন রাঁচী আদালতের একজন কর্মচারী, তিনি তার নাম রাখেন 'জগদীশ নারায়ণ'। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা রাঁচীতে সম্পন্ন হয়।তিনি ১৯২৯ খ্রীঃ পাটনা কলেজ হতে বি.এ., বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় হতে(১৯৩১খ্রীঃ) দর্শন শাস্ত্র অধ্যয়নের পরে ১৯৩২ খ্রীঃ সংস্কৃত এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভের সময়কালে তিনি রাহুল সাংকৃত্যায়নের সংস্পর্শে আসেন এবং বৌদ্ধধর্ম দর্শনের প্রতি জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠেন।জগদীশ নারায়ণের মূল স্বপ্ন তথা অভিপ্রায় ছিল পালি ভাষা শিক্ষা গ্রহণ এবং সদ্ধর্মের প্রতি স্বয়ং সমর্পিত হওয়া।তবে তাঁর পিতা-মাতা চেয়েছিলেন যে জগদীশ আর পাঁচটি সাধারণ মানুষের ন্যায় গার্হস্থ্য জীবন(সংসার জীবন) অতিবাহিত করুক।কিন্তু তাঁর মধ্যে এমন এক বোধিচিত্তের ---- হয়েছিল যে যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সদ্ধর্ম কে হিন্দি ভাষার মাধ্যমে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতে পুঃন প্রচার, ফলে তিনি কোন রূপে তথাকথিত বন্ধনে আবদ্ধ হতে প্রস্তুত ছিলেন না।

বৌদ্ধ ধর্ম দর্শন তথা পালি ভাষা শিখনের অভিপ্রায়ে জগদীশ নারায়ণ রাহুল সাংকৃত্যায়ন এবং শ্রী কাশী প্রসাদ জয়সওয়ালের সহায়তায় শ্রীলঙ্কার বিদ্যালংকার গিরিভেনে গিয়েছিলেন।বিদ্যালংকার গিরিভেন সেই সময়ে পালি ভাষা ও ত্রিপিটক অধ্যয়নের এক বৃহত্তম কেন্দ্র ছিল,যা পরবর্তী সময়ে কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল।সেখানে তিনি ভিক্ষু ধম্মানন্দ মহাথেরোর নিকট হতে গভীরভাবে পালি ভাষা অধ্যয়ন করেন।

১৯৩৪ খ্রীঃ সদ্ধর্মের প্রতি গভীর আকর্ষণের কারণে ভিক্ষু ধম্মানন্দ মহাথেরোর নিকট হতে উপ-সম্পদা লাভ করেন এবং ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ নামে পরিচিত হন।

"ধম্মারমো ধম্মারতো,ধম্ম অনুচিন্তায়ম।

ধম্ম অনুসারম ভিক্ষু, সদম্মো ন পরিহারতি।।"

- ধম্মপদ,গাথা ৩৬৪।

 অর্থাৎ,একজন ভিক্ষু এমন হওয়া উচিত যিনি ধম্মে আনন্দিত হন,এমন একজন হওয়া উচিত যিনি ধম্মকে অনুসরণ করেন এবং তার কখনই সদ্ধম্ম ত্যাগ করা উচিত নয়।ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ ছিলেন অত্যন্ত মৃদুভাষী এবং নম্র ভিক্ষু।

 "ন তেন হোতি ধম্মাট ঠো যেন তমং সহসা নয়ে।

যো চ অতমং অনতমং চ উভৌ নিচ্ছেয্য পন্ডিতো।।

আসহসেন ধম্মেন সমেন নয়তো পরে। 

ধম্মসস গুত্তো মেধাবী ধম্মটঠো তি সবুব্বতি।।"

-ধম্মপদ

- পুনঃ

"পে কেবি ওসধা লোকে বিজ্জন্তি বিবিধা বহু।

ধম্মোপধপমং পতিপ এবং সিবপ ভিক্খবো।।"

-ধম্মপদ।

ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপের মন বুদ্ধ,ধম্ম ও সংঘের পুনরুত্থানের প্রশ্নে পদ্ম-দলের ন্যায় প্রস্ফুটিত হয়েছিল ।

 তিনি শ্রীলঙ্কার বিদ্যালংকার গিরিভেনা হতে ত্রিপিটকাচার্য উপাধি লাভ করেন।অতঃ ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরে তিনি রাহুল সাংকৃত্যায়নের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং রাহুল মহাশয় সেই সময় তিব্বত হতে সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্যের পান্ডুলিপির প্রতিলিপি সংগ্রহ করে এনেছিলেন।ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ এগুলি অবলোকন করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুনরুদ্ধার এর বিষয়টিতে দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করেন।

 ১৯৩৬ খ্রীঃ তিনি রাহুল সাংকৃত্যায়নের সঙ্গে জাপান ভ্রমণে যান।সেই সময় ভারতে বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরাধে পথিমধ্যে মালয়েশিয়ার পেনাং শহরে ধৃত হন এবং তাঁকে পেনাং কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়।বন্দীবাস কালে তিনি পালিগ্রন্থ দীঘনিকায় এবং মিলিন্দ পঞহো গ্রন্থদ্বয় এর হিন্দি অনুবাদ করেছিলেন। পেনাং এ ১ বৎসর কারাবাস কালে তিনি চীনা ভাষা শিখেছিলেন এবং এই সময় বৌদ্ধ পন্ডিত রূপে তাঁর খ্যাতি সর্বত্র প্রসারিত হয়েছিল। ১৯৩৭ খ্রীঃ তিনি মালয়েশিয়ায় বন্দীজীবন সম্পূর্ণ করে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বেনারসের সারনাথে নিজের কর্মভূমি গড়ে তোলেন।এই সময় তিনি বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগে বৌদ্ধ বিদ্যা অধ্যয়ন শুরু করেন।সারনাথে অবস্থান কালে তিনি মহাবোধি সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া'র সাধারণ সম্পাদক দেবপ্রিয় বালিসিংহ'র সংস্পর্শে আসেন এবং অস্পৃশ্য শিশুদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে সারনাথে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৪০ খ্রীঃ পালি শিক্ষা প্রচার-প্রসারে মোগগল্লান পালি ব্যাকরণের ভিত্তিতে "পালি মহাব্যাকরণ" নামক একটি দীর্ঘ ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেন।তিনি পালি ব্যাকরণ ব্যতীত সংযুক্ত নিকায় সহ অন্যান্য বৌদ্ধ গ্রন্থের হিন্দি অনুবাদ ও সম্পূর্ণ করেছিলেন।

বৌদ্ধ ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। অতঃ তাঁর কর্মপদ্ধতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামপুরের এক মুসলিম জমিদার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ১১ একর জমি নিঃশর্তে দান করেছিলেন।১৯৫১ খ্রীঃ ২০ নভেম্বর স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড.রাজেন্দ্র প্রসাদ মহাশয় নব নালন্দা মহাবিহারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।অতিবিলম্বে নালন্দায় পুনঃ পালি ও বৌদ্ধ ধর্ম দর্শন অধ্যয়ন শুরু হয়।একসময় ভিক্ষু শীলভদ্র প্রমুখ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ বিংশ শতাব্দীতে ঐ একই কার্য সম্পাদন করেছিলেন।আর এভাবেই বিধর্মীদের অজ্ঞতার কারণে বিনষ্ট হওয়া নালন্দার পরিচয় পুনঃ বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আচার্য শীলভদ্র 'র যোগ্য উত্তরসূরী রূপে ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপের এই অবদান বাস্তবিক অর্থে অনস্বীকার্য।

ভগবান বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের ২৫০০ তম বার্ষিকীতে ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ সমস্ত ত্রিপিটক গুলিকে নাগরী লিপিতে প্রকাশ করার একটি প্রকল্প রূপে ভারত সরকারের  নিকট হতে আর্থিক অনুমোদন লাভ করেছিলেন।১৯৫৬-৬১ খ্রীঃ'র সময়কালে ৫ বৎসর কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি নব নালন্দা মহাবিহার হতে ৪১ খন্ডে সম্পূর্ণ ত্রিপিটক সাহিত্য প্রকাশ করেন।ত্রিপিটকের এই নাগরী লিপি সংস্করণ 'নালন্দা সংস্করণ' নামে বিশ্ব নন্দিত হয়েছে।

মহান ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ ১৯৭৬ খ্রীঃ ২৮ জানুয়ারি রাজগীরে জাপানি ফুজি গুরু দ্বারা নির্মিত শান্তি স্তুপে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।নালন্দায় তাকে দাহ করা হয়।ত্রিরত্ন বৌদ্ধ ফেডারেশনের প্রধান আচার্য সংঘ রক্ষিত তাঁর আট গুরুর মধ্যে ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপকে তাঁর শিক্ষক রূপে গ্রহণ করেছেন।

বিংশ শতাব্দীর যে সকল ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু তথা পন্ডিত ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের নবজাগরণের প্রশ্নে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন, তাদের মধ্যে জগদীশ কাশ্যপ অন্যতম।যিনি নালন্দার হৃত গৌরবকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন এবং সম্পূর্ণ ত্রিপিটকসহ পালি সাহিত্যকে আমাদের প্রতি সমর্পণ করেছিলেন।তাঁর এই মহান অবদানের কথা স্মরণ করে ধম্মপদের এই গাথা তথা অভিধর্ম কোশের(৪,১,পৃ:৮৫) এই কথাটি অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে

"কর্মজং লোকবৈচিত্র্যং,চেতনাতৎকৃতং চ তত।

চেতনা মানসং কর্ম,তজ্জে বাককায়কর্মনি।।"

ভগবান বুদ্ধ ও ধর্মচক্রপ্রবর্তন

 সুমনপাল ভিক্ষু


এই বিশ্ব সংসারে বুদ্ধের উৎপাদ অত্যন্ত দুর্লভ এইরূপ মহামানব কদাচিৎ এই লোকে অবতীর্ণ হন তাঁর উৎপাদ বাস্তবিক অর্থে মনুষ্যজাতির মঙ্গলার্থেই অভিবৃদ্ধি হয়েছে সাধারণ মনুষ্য রূপে উৎপন্ন হয়ে, সামান্য মানবীয় সমস্যার সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করে নিজেও প্রচেষ্টায় বুদ্ধ রূপে তার আবির্ভাবে চতুর্দিকে হাহাকার, উৎপীড়ন এবং নৈরাশ্যগ্রস্ত মানবজাতির এক প্রকৃত অবলম্বন প্রাপ্তি পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে এই কারনেই তাঁর প্রবর্তিত ধর্ম সম্পূর্ণ অর্থে হিংসা বিহীন ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে অত্যন্ত লোকপ্রিয় হয়েছে কোথাও কোনো ভাবে বিবাদ বা  সংঘর্ষ হয়নি ধর্ম বিকাশের ইতিহাসে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার এবং বিস্তার এক অভূতপূর্ব ঘটনা

মহামানব বুদ্ধ বাল্যাবস্থায়ী হতেই (যুবরাজ সিদ্ধার্থ) কতিপয় মানবীয় সমস্যার প্রভাবে অত্যন্ত পীড়িত হয়েছিলেন সেই সকল সমস্যা হতে মুক্তি লাভের প্রশ্নে তিনি সদা সচেষ্ট ছিলেন তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন যুবরাজ সিদ্ধার্থ এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছিলেন না যে জন্ম, জরা, ব্যাধি এবং মরণ ইত্যাদি নানাবিধ বিপত্তি জগতে পরিব্যাপ্ত হলেও সামান্য সুখের জন্য তথা ব্যক্তি এই বিষয়ে সচেতন নয় কেন তারা কেনই বা নানাবিধ মনোরঞ্জন এবং জাগতিক ক্ষণিক সুখের পঙ্কে নিমজ্জিত রয়েছে ফলে তিনি তৎকালীন ধর্ম-সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে অত্যন্ত নিরাশ হয়ে এই সংকল্প গ্রহণ করেন যে এই সমস্যার কারণ (মূল) এবং তার নিবারণের উপায়টিকে সন্ধান করবেন অতঃ তিনি একদিন তথাকথিত পার্থিব সুখ তথা গৃহত্যাগ পূর্বক প্রব্রর্জিত হলেন তিনি তৎকালীন সেই সকল জ্ঞানী সাধকগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, যারা তত্ত্বের জ্ঞাতা ছিলেন তাদের সঙ্গে (আলার-কালাম এবং উদ্ধক রামপুত্ত প্রমুখ) তিনি আলাপ-আলোচনা তথা তাদের দ্বারা উপদিষ্ট সাধনা পদ্ধতির অভ্যাস করলেন, কিন্তু তার পরিণাম সন্তোষজনক ছিল না সে সমস্যার সমাধানার্থে তিনি গৃহত্যাগ পূর্বক প্রব্রর্জিত হয়েছিলেন, তার সমাধানার্থে কোনও গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি তিনি লাভ করতে পারলেন না তিনি কঠোর তপস্যা করলেন কিন্তু তার দ্বারাও কোনও ফল লাভ হলো না

অতঃ সিদ্ধার্থ তথাকথিত সাধনা পাদতিক পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব আবিস্কৃত সাধনা পদ্ধতির মাধ্যমে জগতের প্রাণীকূলের সমগ্র দুঃখের উৎস এবং তাহতে মুক্তিলাভের উপায় আবিষ্কার করলেন। এই অমোঘ সত্য অনুসন্ধান তথা মুক্তি’র বিষয়টি সম্পূর্ণ অর্থে স্বয়ং তাঁর দ্বারা ব্যাখ্যাত (আবিষ্কার) হওয়ার কারনে তিনি সম্যক্ সম্বুদ্ধ হন। তিনি বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী দর্শনের প্রথম আবিষ্কার কর্তা তথা ধারকও বটে। এই কারণেই তাঁর প্রবর্তিত ধর্ম রহস্যাবৃত্ত নয়, মানধায় সংবোনো দ্বারা ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত এবং হৃদয়গ্রাহ্যও বটে।

ধর্মাচক্র প্রবর্তন

ভগবান্ বুদ্ধ প্রজ্ঞা এবং করুণার মূর্ত্ত প্রতীক রূপে পরিগণিত হয়েছিলেন। এই উভয়গুণ তাঁর অভ্যন্তরে উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত ক’রে ‘সোমরস’ রূপে স্থিত ছিল। শুধু তা’ই নয়, ভগবান বুদ্ধ অত্যন্ত উপায় কৌশলও ছিলেন। উপায় কৌশল বুদ্ধের একটি বিশিষ্ট গুণ। অর্থাৎ তিনি বিভিন্ন প্রকার বিনেয় জন’কে বিবিধ উপায়ে কমার্গে আরুঢ় করার প্রশ্নে অত্যন্ত প্রবীন চীলেন। তিনি উত্তমরূপে অবগত ছিলেন যে কোনকোন উপায় কৌশল দ্বারা সন্মার্গে আরুঢ় করে যেতে পারে। ফলতঃ তিনি বিনেয় জনকে বিচার, রুচি, অধ্যাশয়, স্বভাব, ক্ষমতা এবং পরিস্থিতির অনুরুপ উপদেশ প্রদান করতেন। ভগবান্ বুদ্ধের অপর বৈশিষ্ট্য ছিল যে তিনি সন্মার্গে উপদেশ দ্বারাই জনকল্যাণ কার্য সম্পাদন করতেন, না কি বরপ্রদান বা ঋদ্ধিবল দ্বারা, যেমন ব্রাহ্মণ্যধর্মের দেবতা ইত্যাদির বিষয়ে তথাকথিত অনেক কল্পনাশ্রয়ী কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তাঁর বক্তব্য ছিল যে তথাগত শুধুমাত্র উপদেষ্টা, কৃত্যসম্পাদন তো স্বয়ং সাধক ব্যক্তিকেই করতে হবে। ভগবান্ বুদ্ধ ‘বহুজনের হিতার্থে-সুখার্থে’ ধর্মের যথার্থতা উপদেশ প্রদান করেছিলেন। তিনি ভিন্ন-ভিন্ন সময় এবং ভিন্ন-ভিন্ন স্থানে বিনেয় জনকে অনন্ত উপদেশ প্রদান করেছিলেন। তাঁর উপদেশের অন্তিম লক্ষ্য ছিল বিনেয় জনকে দুঃখ হতে মুক্তি প্রদান। মোক্ষ বা নির্বাণ তাঁর সমস্ত উপদেশের একমাত্র রস ছিল।

ধর্মচক্রের নৈতিকতা

বিজ্ঞানবাদ এবং স্বাতন্ত্রিক মতানুসারে নীতার্থ সূত্র হল এইরূপে, যার অভিপ্রায় যথাবত্ (শব্দ অনুসারে) গ্রহণ করা যেতে পারে তথা নৈয়ার্থ সূত্ত হল এই, যার অভিপ্রায় শব্দশঃ গ্রহন করা যায় না, অমিতু তার অভিপ্রায় সংধান করতে হয়, যেমন- মাতা এবং পিতার হত্যা করলে ব্যক্তি নিষষ্পাপ হয়ে নির্বাণ লাভ করেন। মাতরং পিতরং হন্তবা.. অনীঘো মাতি ব্রাহমনো (ধম্মপদ, মকিন্মক বগ্‌গ, ২৯৪) এই বচনের অর্থ শব্দতঃ গ্রহণ করা যায় না, অমিতু এখানে পিতার অভিপ্রায় কর্মভব এবং মাতার অভিপ্রায় তৃষ্ঞা রূপে গৃহীত হয়েছে। এইভাবে দেশনা আভিপ্রায়িকী বা নৈয়ার্থ বলা হয়।

প্রাসঙ্গিক মাধ্যমিক মতানুসারে নৈয়ার্থ এবং নীতার্থে’র ব্যাখ্যা উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা হতে কিঞ্চিত্‌ ভিন্ন। মাধ্যমিক সিদ্ধান্ত অনুসারে যে সূত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় পরমার্থ সত্য অর্থাৎ শূণ্যতা, অনিমিত্ততা, অনুৎপাদ অনিরোধ ইত্যাদি হয়, তা হ’ল নীতার্থ সূত্র তথা যে সূত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় সংবৃত্তি সত্য, তাকে নৈয়ার্থ সূত্র বলে। নৈয়ার্থতা এবং নীতার্থতা’র ব্যবস্থা সে আর্য-অফয়মতিনির্দেশসূত্র অনুসারে সম্পাদন করে।

“বীপ্সর্থত্বাৎপ্রত্যুপসর্গস্য, এতঃ প্রাপ্ত্যর্থত্বাত্, সমুঃপাদশব্দস্য চ সম্ভবার্থ ত্বাত্, তাংস্তান্ প্রত্যযান্ প্রতীত্য সমুৎপাদঃ প্রাপ্য সম্ভব ইত্যেকে। প্রতীত্য সমুৎপাদ-ইত্যন্যে”- ইতি পরব্যাখ্যানসনূদ্য দূষণমভিধত্তে, তস্য পরমক্ষানুবাদ। কৌশলত্বমেব তাবৎসম্ভাব্যতে। ...এবং তাবদনুবাদাকৌশলমাপর্থস্য।।’’ – মধ্যমকশাস্ত্র, প্রত্যয়পরীক্ষা, ৩। 

প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন :

বারাণসীর “ঝর্ষিপত্তন মৃগাবে’তে ভগবান দ্বারা দেশিতে হয়েছিল। এর বিনেয় জন (পাত্র) শ্রাবকজন ছিলেন, যা স্বলক্ষণ এবং বাহ্যার্থ সত্তার প্রতি আধৃত চতুর্বিধ আর্যসত্যের দেশনার পাত্র (ভব্য) হন। স্বলক্ষন সত্তা এবং বাহ্য সত্তার প্রতি ভিত্তি করে চার আর্যসত্যের স্থাপনা এই প্রথম ধর্মাচক্রের বিষয়বস্তু ছিল। শ্রাবক বর্গীয় জনের দৃষ্টিকোন অনুসারে এই হল নীতার্থ দেশনা। যোগাচার এবং মাধ্যমিক একে নেয়ার্থ দেশনা বলেছেন। কালের দূষ্টিকোন অনুসারে এইটি মধ্যম। স্থান-প্রমুখতঃ গৃহকূটঃ খর্বত । এর বিনেয় জন ছিলেন মহাযানী পুদ্‌গল। শূণ্যতা, অনিমিত্ততা, অনুৎপাদ, অনিরোধ ইত্যাদি তার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল। এই দেশনা দ্বারা সমস্ত ধর্ম নিঃস্বভাব প্রতিপাদিত করা হয়েছে। বিজ্ঞানবাদীকে নেয়ার্থ দেশনা বলেছেন। আচার্য ভাববিবেক, জ্ঞানগর্ভ, শান্তরক্ষিত, কমলশীল ইত্যাদি স্বাতন্ত্রিক মাধ্যমিক এই দেশনার নৈতার্থতা এবং নীতার্থতার বিষয়ে প্রাসঙ্গিক মাধ্যমিক’এর সঙ্গে মতপার্থক্য রয়েছে। তাদের মতে শতসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা ইত্যাদি কিছু সূত্র হল নীতার্থ সূত্র, কারণ এতে সমস্ত ধর্মের পরমার্থতাঃ নিঃস্বভাবতা নির্দিষ্ট রয়েছে। ভগবাতী-প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয়সূত্র ইত্যাদি কিছু সূত্র যদিও দ্বিতীয় ধর্মচক্রের অন্তর্গত সংগৃহীত হয়েছে, তথাপি তা নীতার্থ নয়, কারণ এর দ্বারা যে ভাবে সর্বধর্মনিঃস্বভাবতা প্রতিপাদিত করা হয়েছে, সেইরূপ নিঃস্বভাবতা স্বাতান্ত্রিক মাধ্যমিক মত স্বীকার করেননি। যদিও এই সূত্রের অভিপ্রায় ও পরমার্থতঃ নিঃস্বভাবতা হয়, তথাপি তাতে ‘পরমার্থতঃ’ এই বিশেষন স্পষ্টতয়া উল্লেখিত হয়  নি, যা তাদের মতে আর্য শতসাহস্রিকা প্রজ্ঞামারমিতা ইত্যাদি নীতার্থ তথা ভগবতী প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয়ে ইত্যাদি কিছু সূত্র হল নৈয়ার্থ সূত্র।

প্রাসঙ্গিক মাধ্যমিক অনুসারে দ্বিতীয় ধর্মচক্র হল নীতার্থ দেশনা। তাদের মতে যে সূত্রের মুখ্য বিষয় হল শূণ্যতা, সেই সূত্র নীতার্থ তথা যার মুখ্য প্রতিপাদ্য সংবৃত্তিসত্য, তা নৈয়ার্থ সূত্র হল। অতঃ তাদের মতে ভগবতী প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয় ইত্যাদি সূত্র ও নীতার্থ’ই হয় তথা এদের মতে ‘পারমার্থতঃ’ এই বিশেষণ অনাবশ্যক।

তৃতীয় ধর্মচক্র প্রবর্তন :

কালের দৃষ্টিতে এইটি হল অন্তিম। স্থান- মুখ্যতঃ বৈশালী। শ্রাবক এবং মহাযান উভয় প্রকার পুদগল্‌ এর বিনেয় জন। শূণ্যতা, অনুৎপাদ, অনিরোধ ইত্যাদি হল এর বিষয়বস্তু। বিজ্ঞানবাদী অনুসারে এইটি নীতার্থ দেশনা। যদিও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় উভয়তেই (ধর্মচক্র) শূন্যতা প্রতিপাদিত করা হয়েছে, তথাপি দ্বিতীয় ধর্মাচক্রতে সমগ্র ধর্মকে সমান রূপে নিঃস্বভাব যুক্ত এবং অমুক ধর্ম নিঃস্বভাব নয়, অমিতু সস্বাভাব যুক্ত। এর প্রতি ভিত্তি করে বিজ্ঞানবাদী দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কারণে বিজ্ঞানবাদী সমস্ত ধর্মকে সমানরূপে নিঃস্বভাব মনে করেন না। তাদের মতে ধর্মে’র মধ্য হতে কিছু নিঃস্বভাবতা যুক্ত এবং কিছু সস্বভাব যুক্ত। অতঃ তারা সমান রূপে সর্বধর্ম নিঃস্বভাবতা প্রতিপাদক দ্বিতীয় ধর্মচক্রকে নীতার্থ মনে করেন না। তাদের মতানুসারে যে সূত্র ধর্মের নিঃস্বভবতা এবং সস্বভাবতা’র সম্যগ্‌ বিভাজন করে, তাকেই নীতার্থ বলা হয়। এর মধ্যে আর্য সন্ধিনির্মোচনসূত্র প্রমুখ হয়।

 

আচার্য ভাববিবেক, শান্তরক্ষিত ইত্যাদি এই তৃতীয় ধর্মাচক্রকে নীতার্থ দেশনা বলেছেন, কারণ’এর দ্বারা ভগবতী প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয় ইত্যাদি সূত্র (যা দ্বিতীয় ধর্মচক্রতে সংগৃহীত হয়েছে, আর যা নৈয়ার্থ)র অভিপ্রায় স্পষ্ট করা হয়েছে। তাদের মতানুসারে ‘ভগবতী প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয় ইত্যাদি সূত্র নৈয়ার্থ, কারণ তাতে ‘পারমার্থতঃ’ এই বিশেষণ সংযুক্ত না করে সামন্যতঃ ‘সর্বধর্মনিস্বভাবতার’ প্রতিপাদন করা হয়েছে। এই তৃতীয় ধর্মচক্রতে সেই বিশেষনকে স্পষ্ট রূপে সংযুক্ত করে তার অভিপ্রায়কে স্পষ্ট করা (প্রকট করা) হয়েছে। অতঃ তাদের মতানুসারে এই (তৃতীয় ধর্মচক্র) হ’ল নীতার্থ দেশনা।

তাহলে প্রশ্ন উথ্থাপিত হয় যে বিজ্ঞানবাদী এবং স্বাতন্ত্রিক মাধ্যমিক উভয় তৃতীয় ধর্মচক্র সমানরূপে নীতার্থ কীভাবে গন্য হবে, কারণ যেখানে ইভয় সিদ্বান্ত পরস্পর অত্যন্ত ভিন্ন?

যদিও উভয় সম্প্রদায় একে নীতার্থ অবশ্যই মনে করেন, তবুও স্বাতন্ত্রিক মাধ্যমিক এইকনা বলেন না যে তৃতীয় ধর্মচক্রের অভিপ্রায় যেমনটি বিজ্ঞানবাদীগণ উপলব্ধি করেছেন, ঠিক সেই রকমই হবে। তাদের মতে বিজ্ঞানবাদী বিষয়টি ভূলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

আচার্য বুদ্ধপালিত, চন্দ্রকীর্তি ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক মাধ্যমিক তটতীয় ধর্মচক্রকে সর্বদা দেশনা করেছেন। তাদের মতে তটতীয় ধর্মচক্রের অভিপ্রায় ঠিক সেই রকম, যেমনটি বিজ্ঞানবাদী মনে করেন, কারন বিজ্ঞানবাদীর সিদ্ধান্ত যুক্তিহীন এবং দোষগ্রস্থ, অতঃ তটতীয় ধর্মচক্র হ’ল নৈয়ার্থ দেশনা। তাদের মতানুসারে তৃতীয় ধর্মচক্রের প্রবর্তন ভগবান্ এইরূপে বিনেয়জনকে অনুগ্রহের উদ্দেশ্যে সম্পাদন করেছিলেন, যারা শূন্যতা ইত্যাদি গম্ভীর বিষয়ের দেশনার পাত্র নয়। অতঃ এওরূপ বিনেয়জনকে তৎকাল শূন্যতার ন্যায় গম্ভীর বিষয় সম্পর্কিত দেশনা প্রদান না ক’রে বিজ্ঞানবাদের দেশনা প্রদান পূর্বক পশ্চাত্’এ কুশলতা দ্বারা তাদের গম্ভীর বিষয় (সর্বধর্মনিঃস্বভাবতা) এর প্রতি নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উপায়কুশল ভগবান বুদ্ধ তটতীয় ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছিলেন। আচার্য চন্দ্রকীর্তি মধ্যমকাবতার ভাষ্য’তে এই বিষয়’এর সুস্পষ্ট এবং বিস্তৃত বিবেচন প্রস্তুত করেছেন।

ভগবান বুদ্ধের শিক্ষার সার্বভৌমিকতা 

১. ভাষা :

ভগবান্ বুদ্ধ কোন ভাষাতে তাঁর উপদেশ (ধর্মদেশনা) প্রদান করেছিলেন, তা অবগত করার ক্ষেত্রে বলা যায় যে তিনি জনবোধ্য ভাষাতে তাঁর উপদেশ প্রদান করেছিলেন। কারণ তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল যে সাধারণ জনগন যেন তাঁর দেশনা উপলব্দি করতে পারেন। এই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় যে দুইজন ভিক্ষু ভগবান্ কে ‘ছন্দস্’ (বৈদিক সংস্কৃত) ভাষায় উপদেশ প্রদানে অনুরোধ করেছিলেন। ভগবান তাঁদের প্রার্থনা স্বীকার করেননি এবং তিনি বলেছিলেন – আমি নিজ-নিজ ভাষাতে তা সংগৃহীত করার অনুমতি প্রদান করছি – “অনুজানামি, ভিক্খবে, সকায় নিরুত্তিয়া বুদ্ধবচনং পরিয়াপুনিতুং তি” (চুল্লবগ্‌গ, পৃ: ২২৮)। ফলতঃ তাঁর উপদেশ মাগধী ইত্যাদি অনেক ভাষাতে সংকলিত হয়েছে।

২. মানব-সমতা :

ভগবান্ বুদ্ধের মতানুসারে ধার্মিক এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সকল নারী এবং পুরুষ সমান যোগ্যতার অধিকারী। তাঁর মতে একজন মানবের সঙ্গে অমর মানবের ব্যবহার মানবতার প্রতি ভিত্তি করে হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, গোত্র ইত্যাদি বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ সকলপ্রানী সমানরূপে দুঃখী, অতঃ সকলেই সমান। দুঃখ প্রহান’এর প্রশ্নে তার ধর্মের প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং সমবেদনা এবং সহানুভূতি এই সমতার আধারভূত তত্ত্ব। তিনি বলেছেন যে সকল নদী, মহানদী যেমন সমুদ্রে মিলিত হয়ে নিজ নাম, রূপে এবং বৈশিষ্ট্য ইত্যাদিকে বিনষ্ট ক’রে ফেলে, ঠিক সেইভাবে মানবমাত্র সংঘে প্রবিষ্ট হয়ে জাতি, বর্ন, ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলিকে হারিয়ে ফেলে এবং সমান হয়ে যায়। নির্বাণ’ই তার ধর্মের একমাত্র রস।

৩. মানব শ্রেষ্ঠতা :

বুদ্ধ অনুসারে মানব জন্ম অত্যন্ত দুর্লভ। মনুষ্যের মধ্যে সেই বীজ নিহিত রয়েছে, যার ফলে সে যদি মনে করে তাহলে অভ্যুদয় এবং নিঃশ্রেয়স অর্থাৎ নির্বাণ তথা বুদ্ধত্বের ন্যায় পরম পুরুষার্থ ও লাভ করতে পারেন। দেবতা (?) শ্রেষ্ঠ নয়, কারণ সে ব্যাপক তৃষ্ঞার ক্ষেত্র হতে বাইরে নয়। অতঃ মনুষ্য তার দাবানুদাস নয়, আমিতু তাদের উদ্দারের ভার ও মনুষ্যের সকন্ধে রয়েছে। এই কারণে তিনি বলেছেন, “হে ভিক্ষুগণ! বহুজনের হিতার্থে এবং সুখের প্রশ্নে তথা দেব – মনুষ্যের কল্যাণে লোকে বিচরণ করো।” ঋষিপত্তন মৃগদাব (সারনাথ)’তে তাঁর প্রথম বর্ষাবাসের অনন্তর ভিক্ষুগণকে তাঁর এই উপদেশ মানবীয় স্বাধীনতা এবং মানবশ্রেষ্ঠতার অপ্রতিম উদ্‌ঘোষ ছিল।

৪. ব্যাবহারিকতা :

ভগবান্‌ বুদ্ধের শিক্ষা অত্যন্ত ব্যাবহারিক ছিল। তাতে কোনরূপ রহস্যতা এবং আড়মবরতার স্থান ছিল না। তিনি কখনই অব্যাকরণীয় (অব্যাখ্যেয়) প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতেন না, যেমন – লোক শাশ্বত না কি অশাশ্বত; অনন্ত, নাকি অনন্ত নয় অথবা তথাগত মরণান্তে উৎপত্তি হন বা নয় – ইত্যাদি। তিনি বলতেন, এইরূপ প্রশ্নের উত্তর না তো যুক্তি সঙ্গত এবং তার উত্তর না তো অর্থসঠ্গত এবং না তো ধর্মসঙ্গত। মনুষ্য জন্ম, জরা, মরণ ইত্যাদি দুঃখ দ্বারা পীড়িত, যার তিনি বিধান করতে পারেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন – বিষাক্ত বানে বিদ্ধ এবং যন্ত্রণায় কাতর ব্যক্তির এইটী কি উচিত হবে ‘প্রথমে আমাকে এইটি বলা হোক যে বানটিকে নির্মাণ করেছে? অতঃ আমাকে বৈদ্যের নিকট নিয়ে যাওয়া হোক অথবা এইটি উচিৎ হবে না কি তাকে প্রথমে বৈদ্যের নিকট উপস্থিত ক’রে বেদনা মুক্ত করা হোক? তখন ভিক্ষুগণ বললেন, তাকে প্রথমে বৈদ্যের নিকট উপস্থিত ক’রে বেদনা মুক্ত করা উচিৎ। কারণ এইরূপ প্রশ্নের এক তো উত্তর প্রদান সহজ নয় এবং সাথে তা নির্বিবাদও হবে না। তখন ভগবান্ বললেন মনুষ্য নানাবিধ দুঃখ দ্বারা পীড়িত, অতঃ অন্য সকল প্রশ্ন ব্যতীত সর্বপ্রথম তাকে দুঃখ হতে মুক্তির উপায় সন্ধান এবং কার্যান্বিত করা উচিত।

৫. মধ্যমা প্রতিপদা :

ভগবান্ বুদ্ধ যে ধর্মচক্রের প্রবর্তন করেছিলেন অথবা যে মার্গের উপদেশ তিনি প্রদান করেছিলেন, তাকে ‘মধ্যমাপ্রতিপদা’ বলা হয়। পরস্পর বিরোধী দুই অন্ত বা অতিকে নিষেধ করে ভগবান্‌ মধ্যম মার্গ প্রকাশিত করেছিলেন। মনুষ্যের স্বভাব হল সে অত্যন্ত সহজেই কোনও অন্তে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং সেই অন্তকে নিজ পক্ষ’তে রূপান্তরিত করে তার প্রতি আগ্রহশীল হয়ে যায়। এই আগ্রহশীলতাই হল সমগ্র মানবীয় বিভেদ, সংঘর্ষ এবং দুঃখের মূল। মধ্যমা প্রতিপদ্ হল আগ্রহশীলতা এবং সমস্যা হতে মুক্তি লাভের সর্বোত্তমা রাজমথ। এর ক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক এবং এতে অনন্ত সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে। সামাজিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের প্রশ্নে এর উপযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রূপে প্রমাণিত হয়েছে। শীল, সমাধি এবং প্রজ্ঞা বা দর্শনের ক্ষেত্রেও এর প্রাচীন বৌদ্ধ ব্যাখ্যাও দুষ্ট হয়।

ভগবান বীণার উদাহরণ প্রদান পূর্বক বলেছেন, যদি বীনার তার’কে ঢিলা রাখা হয় তাহলে তাতে মধুর ধ্বনি উৎপন্ন হয় না, আর যদি তাকে অত্যধিক ঋজু করা হয় তাহলে তা ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা প্রদান করে, অতঃ তাকে না তো অধিক ঢিলা দিতে হবে আর না তো অধিক ঋজু, তাহলেই মধুর ধ্বনি উৎপন্ন হবে। ঠিক সেই ভাবেই সমাধিতে নিমগ্ন সাধক চিত্ত কে না তো অধিক শিথিল (আলস্য মুক্ত বা তন্দ্রাচ্ছন্ন) হওয়া উচিত, আর না তো অত্যাধিক উৎসাহ (অশান্ত, অসহিষ্ঞুতা ইত্যাদি) হওয়া উচিত। আলস্য এবং ঔদ্ধত্য, উভয়ই দোষমুক্ত হয় এবং যা সমাধির দৃষ্টিতে মধ্যম প্রতিপদা হয়। প্রজ্ঞার দৃষ্টিতে শাস্বতবাদ (নিত্যতার প্রতি আগ্রহ) এক অন্ত হয় এবং উচ্ছেদবাদ (ঐহিকবাদ) দ্বিতীয় অন্ত। এই দুই অন্তের নিরাশ’ই হল মধ্যমা প্রতিপদ্। আর এই হল সম্যগ্‌ দৃষ্টি। এর ব্যতীত অভ্যুদয় এবং নিঃশ্রেয়স কোনও পুরুষার্থ সিদ্ধ করা সম্ভব নয়। সকল বৌদ্ধ দার্শনিক মধ্যম প্রতিপাদাকে স্বীকার করেন, কিন্তু তারা শাশ্বত এবং উচ্ছেদ’এর ভিন্ন-ভিন্ন প্রস্তুত করেছেন।

৬. প্রতীত্যসমুৎপাদ :

প্রতীত্যসমুৎপাদ হল বুদ্ধ সিদ্ধান্তের মূল। প্রতীত্যসমুৎপাদের জ্ঞানই বোধি। এই হল প্রজ্ঞাভূমি। প্রতীত্যসমুৎপাদকে সম্বোধিতে অধিগত ধর্ম কথা হয়েছে এবং এইটি বলা হয়েছে, “যে প্রতীত্যসমুৎপাদকে অবলোকন করেন, প্রতীত্যসমুৎপাদ’এর মুখ্য অভিপ্রায় হল দুঃখের উৎপত্তি ব্যক্ত করা এবং কার্যকারণ নিয়মের প্রতিপাদন। প্রতীত্যসমুৎপাদের দুটি রূপ রয়েছে-একটি হল ব্যাপক রূপ, যেখানে দুঃখের পরমকারণতা উদ্ভূত হয় এবং অপরটি হল সীমিত রূপ, যা পুনর্জন্ম এবং দুঃখ-সংবেদন’এর আসন্ন কারণকে নির্দেশ পূর্বক প্রথম বিষয়টিকে নিরুপন করো। অর্থাৎ একদিকে প্রতীত্যসমুৎপাদ দুঃখময় সংসারকে পরমার্থের ভূমি হতে নিরুমিত করে, অপরদিকে ব্যবহারের অন্তর্গত কার্যপ্রণালীর প্রতি ইঙ্গিত। দুঃখের মূলাধার হ’ল অবিদ্যা এবং প্রতীত্যসমুৎপাদ বস্তুতঃ অবিদ্যার স্বরূপ প্রকট পূর্বক পরমার্থের প্রতি সংকেত করে। অবিদ্যাবষ্টম্ভ জগত’এর অভ্যন্তরে কার্য-কারণ নিয়মের বিষয় থাকে এবং প্রতীত্যসমুৎপাদ গীণরূপে অবিদ্যাকুন্ডলিত জীবনের অভ্যন্তরে দুঃখের চক্রাকার বিকাশ প্রদর্শিত করে।

“ইমস্মি সতি ইদং হোতি, ইমস্‌স উথপাদা ইদং উথ্থজ্জতি, ইমস্মিং অসতি ইদং ন হোতি, ইমস্‌স নিরোধা ইদং নিরুজঝতি।” – অভিধর্মকোশ, খন্ড-২, পৃঃ ৭৭।

৭. কর্মস্বাতন্ত্র্য :

বৌদ্ধকর্ম সিদ্ধান্ত বিশ্বের অন্যান্য ধার্মিক পরম্পরা হতে সম্পূর্ণ অর্থে পৃথক। প্রায় সকল ব্যক্তিজন কর্মফল’কে জড় রূপে স্বীকার করেন, অতঃ কর্মের কর্তাকে সেই কর্মের কর্তাকে সেই কর্মের ফল হতে অন্বিত করার প্রশ্নে এক অতিরিক্ত চতন বা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করে। তাদের মতে এইরূপ অতিরিক্ত চেতনের অভাবে কর্ম-কর্মফল ব্যবস্থা নির্মিত হতে পারে না এবং সমগ্র ব্যবস্থা অস্তব্যস্ত হয়ে পড়বে। অপর দিকে বৌদ্ধ মত কর্মকে জড়রূপে স্বীকার করে না। ভগবান্ বুদ্ধ কর্মকে ‘চেতনা’ বলেছেন (চেতনাহং ভিকখবে, কম্মং বদামি, অঙ্গুত্তর নিকায়, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা ১২০)। কর্ম তার ফলকে স্বয়ং অঙ্গীকার বা আকৃষ্ট করে নেয়। চেতনা-প্রবাহতে কর্ম-কর্মফল’এর সমগ্র ব্যবস্থা সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়ে যায়। এই কারণে ফল প্রদানের প্রশ্নে কোনরূপ অতিরিক্ত চেতন বা ঈশ্বর’কে স্বীকার করার কোন প্রয়োজন নেই। এই কারণে বিশ্বের সকল আধ্যাত্মিক ধর্মের মধ্যে বৌদ্ধ একমাত্র অনীস্বরবাদী ধর্ম।

নিজ সুঃখ-দুঃখের প্রশ্নে প্রাণী স্বয়ং উত্তরদায়ী। নিজ অজ্ঞানতা এবং মিথ্যাদৃষ্টির কারণেই সে স্বয়ং তাকে দঃখ হতে মুক্তি প্রদান করতে পারেন না। এই কারণে স্বয়ং তাকে প্রয়াস করতে হবে। কারও বরদান বা কৃপাদ্বারা দুঃখ মুক্তি সম্ভব নয়। এই বিষয়ে বুদ্ধ বলেছেন তিনি দুঃখ মুক্তির উপায় অবশ্যই বলতে পারেন, কিন্তু তা পরীক্ষা করে, সঠিক মনে হলে সেই মার্গে প্রাণীকে স্বয়ং চলতে হবে। তবেই দুঃখ হতে সে মুক্তি লাভ করতে সফল হবে। এই মর্মে সিদ্ধান্তের দ্বারা মানব-স্বাধীণতা এবং আত্ম-উত্তরদ্বায়িত্বের বিশিষ্ট বোধ প্রতিফলিত হয়।

“খন্তী পরমং তপো তিতিক্‌খা

নিব্বানং পরমং বদন্তি বুদ্ধ।

নহি পব্বজিতো পরুপধাতী

সমনোহোতি পরং বিহেঠমন্তো।।

সব্বপাপস্‌স অকরণং পুসলস্য উপসম্পদা।

সচিত্তপরিমোদপনং এতং বুদ্ধান সাসনং।।

                                 _দীর্ঘনিকায়, খন্ড-২, পৃ: ৩৯

মানুষের অধ্যাত্মবোধের স্ফটিক সংহত রূপ : বুদ্ধ গৌতম

 সুমনপাল ভিক্ষু 


সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ ভগবান বুদ্ধের আবির্ভাব তিথি অর্থাৎ বুদ্ধ পূর্ণিমা উদযাপন করে (এই পবিত্র তিথি বুদ্ধ জয়ন্তী নামেও পরিচিত, যা বৈশাখী অর্থাৎ বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়)। এই তিথিতে শাক্য বংশের রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে লোক কল্যাণের অভিপ্রায় গ্রহণ করে সম্যক সম্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক তত্বই হল 'বৌদ্ধধর্ম'। 

'জয়ন্তী' শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ জন্ম তিথি বা জন্মদিবস। যারা 'বোধি' বা লোক জ্ঞান অর্জন করেন, তাঁরা বুদ্ধ নামে পরিচিত হন। সেই অর্থে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম মার বিজয় সম্পূর্ণ করে বোধি জ্ঞান লাভ করেছিলেন।

বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিকে সমগ্র বৌদ্ধ বিশ্ব একটি অত্যন্ত পবিত্রতৃ দিন রূপে বিবেচনা করন কারণ এই তিথি মহান বুদ্ধের জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে চিহ্নিত করে, যেমন তাঁর জন্ম, বোধিলাভ এবং মহাপরিনির্বাণ। বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে লুম্বিনী উদ্যানে (বর্তমানে নেপালে অবস্হিত) মায়াদেবীর কুক্ষি হতে আজ হতে ২৭৭৫ বৎসর পূর্বে বোধিসত্ত্ব রাজকুমার সিদ্ধার্থ রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। 

যৌবন কালে তিনি জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুর ভয়াবহ বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করে এই অনন্ত দুঃখ হতে মুক্তি লাভের সন্ধানে সংসার ধর্মকে ত্যাগ পূর্বক একসময়ে বর্তমান বুদ্ধগয়ার নৈরঞ্জনা নদীর অনতিদূরে বোধিবৃক্ষ মূলে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করেছিলেন। সেই ত্রুটি হাসিক ঘটনাও বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সংঘঠিত হয়েছিল। অবশেষে ৮০ বৎসর বয়সে তিনি উপাসক চুন্দের নিকট হতে অন্তিম অন্ন গ্রহণ করে কুশীনারা'র নিকট বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে ভিক্ষু সংঘকে সম্বোধিত পূর্বক শালবৃক্ষ তলে 'মহাপরিণর্বাণ' লাভ করেছিলেন। 

নিঃসন্দেহে মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রেম ও শান্তির প্রথম দূত রূপে মহামানব বুদ্ধ এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন। তার মূল শিক্ষা হলো কামনা বাসনাই হল মনুষ্য জীবনের সকল দুঃখের মূল কারণ এবং এই সকল অমূলক বিষয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করলেই আমরা শান্তি লাভ করতে পারি। বর্তমান বিশ্ববায়নের যুগে মনুষ্যের জীবন জীবিকা ক্রমশই তার বোধ বুদ্ধির বিরুদ্ধে খাতে বইতে শুরু করেছে। ফলে পৃথিবী হয়ে উঠেছে 'যুদ্ধভূমি'। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্য করা প্রয়োজন বুদ্ধ যে সময়কালে পৃথিবীর বুকে যে দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেই সময় সমাজ জীবন ছিল আরো বেশি নিষ্ঠুর এবং কার্যে। সুতরাং বাস্তবিক অর্থে বুদ্ধ তাঁর সময়কালে অনেক বেশি আধুনিক তথা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী ছিলেন। 
অহিংসা ,জীবনের প্রতি সম্মান এবং নারীদের প্রতি আরো সমান মর্যাদার প্রতি জোর দেওয়ার কারণে বৌদ্ধ ধর্ম দর্শন অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর ফলে এশিয়ার অনেক দেশ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে নিজেদের দেশকে বিকশিত করে তুলেছে। বৌদ্ধ ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মের মধ্যে মূলগত পার্থক্য হল এই যে বৌদ্ধ ধর্ম অদৃষ্টবাদ বা কোনরূপ অতিপ্রাকৃত শক্তি অর্থাৎ তথাকথিত ঈশ্বরতত্ত্বের প্রতি বিশ্বাসী নয়। 
বিদর্শন অর্থাৎ বুদ্ধ দ্বারা প্রদর্শিত ধ্যান চর্চা হল দৈনন্দিন জীবনের চাপ এবং উদ্বেগ হতে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায়। এই কারণে, বিদর্শন চর্চা আমেরিকা তথা প্রাশ্চাত্য দেশগুলিতে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তবে এর জন্য একজনকে কঠোর সময়সূচী অনুসরণ করতে হবে না ,তার দৈনন্দিন সময়ানুসারে তা( বিদর্শন) পালন করা যেতে পারে। 
বুদ্ধ আমাদের এই শিক্ষা প্রদান করেছেন দুর্বল দারিদ্রদের প্রতি শ্রদ্ধা তথা যতনশীল হ'তে এবং অসহায় পশুদের আশ্রয় বা বৃদ্ধাশ্রম-এর ন্যায় যে কোন মানবিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করতে পারি যে অন্যের মঙ্গলের প্রতি আমরা কতটা উদ্বিগ্ন তথা দায়বদ্ধ। 
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে শ্রীলংকার কলম্বোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বৌদ্ধ প্রথম সম্মেলনে মে মাসের পূর্ণিমা তিথিকে বুদ্ধ পূর্ণিমা দিবস রূপে ঘোষণা করা হয়। 
উদাহরণ স্বরূপে শ্রীলঙ্কায় ভেসাক বা বৈশাখ রূপে, নেপালে সোয়ান্যা,মায়ানমারের কাসন, মালয়েশিয়াতে হরি ওয়েসাক, তিব্বতে সাগা দাওয়া, ইন্দোনেশিয়াতে হরি রায়া ওয়াইসাক্ ভিয়েতনামে ভ্যান ও লাওসে ভিক্সাখা বক্সার রূপে এই উৎসব পালিত হয়। 
চীনে এই উৎসব ফো-দান এবং ইউ-ফোজি নামেও পরিচিত।জাপানে একে বলা হয় হানা-মাস্তুরী। এই উৎসবটি সেদেশে সৌর ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে ৮ এপ্রিল পালিত হয়। 
দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জনগণ অত্যন্ত আড়ম্বর সহকারে বুদ্ধ পূর্ণিমা দিবস পালন করেন।ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ প্রাতঃকালে বৌদ্ধবিহারে সমবেত হয়ে বৌদ্ধ পতাকা উত্তোলন এবং ত্রিশরন-পঞ্চশীল ইত্যাদি পাঠ করেন। এই দিনে বুদ্ধের প্রতি সম্মান জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা এবং বহু সংখ্যক পশু পাখিকে বন্দী দশা হতে মুক্তি দানের প্রথা প্রচলিত আছে।
তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে ভারতীয় উপমহাদেশে বুদ্ধ এবং তার ধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদী তথা অন্য ধর্মের অত্যাচারে তার ন্যায্য মর্যাদা হতে বঞ্চিত হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ বৌদ্ধ ধর্মকে বিলীন করার অভিপ্রায়ে বুদ্ধকে তথাকথিত অবতারবাদের পঙেক নিমজ্জিত করেছে। এমনটি অনেক বৌদ্ধ বিহার এবং বুদ্ধমূর্তিকে হিন্দু মন্দির বা দেবী দেবতায় পরিণত করে বৌদ্ধ ধর্মকে বিনষ্ট করে দিয়েছে। 
বর্তমানে আম্বেদকর প্রভাবিত নব বৌদ্ধ আন্দোলন মহারাষ্ট্র ,উত্তরপ্রদেশ ,ছত্তিশগড় ,ঝাড়খন্ড ইত্যাদি রাজ্যের যথেষ্ট সফলতা অর্জন করলেও প্রাদেশিকতার প্রভাব হতে মুক্ত হতে পারেনি। 
শেষে আমরা বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর নামক গ্রামে (পূর্বস্থলী থানার অন্তর্গত) এক অদ্ভুত উচ্ছবের কথা আলোচনা করবো। 
উক্ত দিনে দেবতার উদ্দেশ্যে 'পশু বলি' প্রথা প্রচলিত রয়েছে । যদিও উৎসবটি বৌদ্ধ উৎসব নয় তথাপি বৌদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে কেন পালিত হয় তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া সম্ভব হলো না । কারণ বৌদ্ধ উৎসবে প্রাণী হত্যা সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধ শাসন বিরোধী এবং অবিবেচনাহীন ও বটে। অপরদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই দিনে গুরু পূর্ণিমা উৎসব ও পালন করে সম্ভবতঃ মহান বুদ্ধের ধর্ম দর্শনকে বিকৃত করার উদ্দেশ্যে বেদব্যাসের কল্পিত কাহিনী প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু এই ধরনের অসামঞ্জস্যহীন আচার- অনুষ্ঠান সত্ত্বেও 'বুদ্ধ পূর্ণিমা' আজও তার মহান গরিমাকে বহন করে চলেছে। 

"..... কহিল যে করজোড়ে,দয়া করে ক্ষমা মোরে-
 এ ফুল বেচিতে নাহি মন। 
এত বলি ছুটিল সে যথা রয়েছেন বসে 
বুদ্ধদেব উজলি কানন।
বসেছেন পদমাসনে প্রসন্ন প্রশান্ত মনে,
নিরঞ্জন আনন্দমুরতি। 
দৃষ্টি হতে শান্তি ঝরে, সফুরিছে অধর-পরে
করুনার সুধাহাস্যজ্যোতি। 
সুদাস রহিল চাহি-নয়নে নিমেষ নাহি, 
মুখে তার বাক্য নাহি সরে। 
সহসা ভূতলে পরি পদম টি রাখিল ধরি
প্রভুর চরণ পদ্ম পরে।
বরষি অমৃতরাশি বুদ্ধ শুধালেন হাসি, 
'কহো বৎস্য, কি তব প্রার্থনা। 
ব্যাকুল সুদাস কহে, 'প্রভু, আর কিছু নহে, 
চরণের ধূলি এককণা। '
                                          ‌ ‌ ‌ ‌ অবদানশতক ' অবলম্বনে
                                            -মূল্যপ্রাপ্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


২৬.০৪.২০২৩

বৌদ্ধ তন্ত্র সাধনা উদ্ভব ও বিকাশ

 

সুমনপাল ভিক্ষু

 

প্রকৃতিপ্রভাস্বরাধর্মাঃ সুবিশুদ্ধাঃ নমঃ সভাঃ

বোধির্নাভিসময়মিদং বোধিনয়ং হৃঢ়ম্

অহো বুদ্ধ অহোধর্ম অহোসভস্য দেশনা

শুদ্ধতত্ত্বার্থ শুদ্ধার্থ বোধিচিত্তনমোহস্তুতে।।

ধর্ম নৈরাত্ম্যসমভূত বুদ্ধবোধিপ্রপূরক

নির্বিকল্প নিরালমব বোধিচিত্ত নমোহস্তুতে।।

সমন্তভদ্রসত্ত্বার্থ বোধিচিত্তপ্রবর্ত্তক

বোধিচর্প মহাবজ্র বোধিচিত্ত নমোহস্তুতে।।

চিত্তং তথাগতং শুদ্ধ কায়বাক্চিত্তবজ্রধৃক

বুদ্ধবোধিপ্রদাতা বোধিচিত্ত নমোহস্তুতে।।

-গুহ্যসমাজতন্ত্রম্, পটল-, পৃঃ -১০

পুনঃমা কুলপুত্রা ইমাং হীনসংজ্ঞাং জুগুপ্সিতসংজ্ঞাং চোঃপাদয়াথা তত্ কস্মাদ্দেতোঃ রাগচর্যা কুলপুত্রা যদুত বোধিসত্ত্বার্যা যদুত অগ্রচর্যাত্ দ্যথা অপি নাথ কুলপুত্রা আকাশং সর্বত্রানুগতথাকাশানুগতানি সর্বধর্মানি তানি কামধাতুস্থিতানি রূপধাতুস্থিতানি নারূপধাতুস্থিতানি চতুর্থহাভূতস্থিতানি এবমেব কুলপুত্রাঃ সবধর্মা অনুগন্তব্যাঃ ...এবমেব কুলপুত্রা সর্বতথাগতবজ্রসময়াঅনুগন্তব্যাঃ গমনাগমনাদ্যৈরিতি” -গুহ্যসমাজততন্ত্রম্, পৃঃ৩

 

মহাযানবাদের পরবর্তী বিকাশকে বৌদ্ধ আচার্যগণ আলোচনা তথা ব্যাখ্যা করেছেনঅদয়বজ্রসংগ্রহতে সংগ্রহীত তত্ত্বরত্নাবলীতে মহাযানকে ভাগে বিভক্ত করা হয়েছেপারমিতানয় এবং মন্ত্রনয় মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান সাধারণ ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে অত্যধিক কঠিন, গম্ভীর এবং রহস্যপূর্ণ ছিল মন্ত্রযানকে শুধুমাত্র উন্নত সাধক, তীক্ষেন্দ্রিয়াধিকারসম্পন্ন সাধকের ক্ষেত্রেই উপযুক্ত বলা হয়েছে  “মহাযানং দিবিধং পারমিতানয়ো মন্ত্রণয়শ্চেতি; ‘মন্র্রণয়স্তু অস্মাদি (মৈ) রিহাতিগম্ভীরবাদ গম্ভীরণয়াধিমুক্তিক পুরুষ বিষয়ৎবাদ চতুর্মুদ্রাধিসাধন প্রকাশনবিস্তারৎবাচ্চ ব্যাক্রিয়তেতথা -একার্থৎবহস্যসংমোহাত্ বহুপায়োদদুষ্করাত্ তীক্ষ্নেন্দ্রিয়াধিকারচ্চ মন্ত্রশাস্ত্রং বিশিষ্যতে” -অদয়বজ্রসংগ্রহ, পৃঃ ১৪, ২১

 

এই মন্ত্র নয়হতে পরবর্তী বজ্রযান, কাশচক্রযানাদি বিকসিত হয়েছিল এর দ্বারা স্পষ্টতর হয় যে অদয়বজ্রের এই বিভাজন বিকাশ, সাধনাবস্থা এবং সাধনভেদ (এই তিনটি বিষয়) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রূপেই বিদ্বানগণ একে স্বীকার করেছিলেন প্রসঙ্গত কারণে বলা যায় যে বোধিসত্ত্বপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পারমিতা সাধন এবং মন্ত্রসাধন উভয়ই প্রচলিত ছিল তবে তান্ত্রিক তত্ত্বে মন্ত্র, মুদ্রা, মদ্য, মৈথুন, মাংস ইত্যাদি তত্ত্বের প্রয়োগ প্রারম্ভ প্রশ্নে কোন ব্যক্তি অথবা গ্রন্থ উত্তরদায়ী ছিল, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়

 

মহাযান ধর্মে মৈথুন শব্দটি বারংবার ব্যবহত হয়েছে এই তত্ত্ব মহাযানে কিভাবে উদভূত হয়েছে, তা আলোচনা করার পূর্বে মহাযানের উদ্ভবকাল সম্পর্কে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয় মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নঅন্ধকসম্প্রদায়ের প্রতি পর্যাপ্ত গুরুত্ব প্রাবেন করেছিলেন এবং এর অন্তর্গত বৈপুল্য, পূর্বশৈলীয়, অপরশৈলীর, রাজগিরিক এবং সিদ্দার্থক নিকায়ের গননা করা হয় এইভাবে আচার্য নাগার্জুন হতে এদের সম্পর্ক প্রতীত হয় কথাবত্তু (কথাবতথু) তে মোগ্গলিপুত্ত তিস্এদের যে সিদ্দান্তের খন্ডন করেছিলেন, তার দ্বারা প্রতীত হয় যে বৈপুল্যবাদী এইটি স্বীকার করতেন যে . সংহ না তো দান গ্রহণ করে, না তাকে পরিশুদ্ধ করে তথা উপভোগ করে, না তো সংঘকে প্রদান করলে মহাফল হয় . বুদ্ধকে দান প্রদান করলে না তো মহাফল হয়, না তো বুদ্ধ লোকে অবস্থান করেন আর না তো বুদ্ধ ধর্মোপদেশ করেছেন . বিশেষ প্রয়োজনে (একাভিপ্রায়েন) মৈথুনএর সেবন করা যেতে পারে এর মধ্যে ঐতিহাসিক বুদ্ধের অস্বীকৃতি তথা মৈথুনের অনুজ্ঞা ইত্যাদি ২টি বিষয় প্রাচীন বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে অত্যাধিক উদ্যোগজনক ছিল মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন চারঅন্ধকনিকায়ের উৎপত্তি খ্রীঃ পূর্ব প্রথম শতাব্দী অনুমান করেছেন বৈপুল্যবাদের প্রচারকগণের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান আচার্য নাগার্জুনের ছিল এবং তার বাসস্থান শ্রীথবর্ত এবং ধান্যকটক ছিল এর দ্বারা মৈথুন সমবলিত ধর্ম প্রচারকগনের মধ্যে নাগার্জুনএর মহত্ত্ব স্থাপিত হয়

 

এই রূপ ধর্মসাধনার আদ্য আচার্য রূপে অথবা তান্ত্রিক মহাযান ধর্মের প্রারম্ভিক চরণের পুরসতর্ক রূপে কিছু বিদ্বান আচার্য অসঙ্গকে প্রতিষ্ঠিত করে থাকেন মহাযান সূত্রালংকারে পঞ্চপরাবৃত্তি (পঞ্চেন্দ্রিয় পরাবৃত্তি, মানস পরাবৃত্তি, সসার্থোদ্গ্রহ পরাবৃত্তি, বিকল্প পরাবৃত্তি, প্রতিষ্ঠাপরাবৃত্তি এবং মৈথুনপরাবৃত্তি) দ্বারা বিভূত্ব প্রাপ্তি বলা হয়েছে মৈথুন এবং পরাবৃত্তি শব্দ অত্যন্ত বিবাদাস্পদ মনে হয়েছে এই বিষয়ে সিল্ভা লেবী, . উইন্টরনিৎস এবং সুজুকি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন . উইন্টরনিৎসএর মতে বিষয়টি ভোগ-বিলাস হতে বিরতি হবে হয়ত . বাক্চী এই বিষয়ে বলেছেনমৈথুনস্য পরাবৃত্তৌ অর্থ হল মৈথুন হতে বিরতি বা বিরাগ না হয়েমৈথুন জনিত আনন্দের সমান সুখ উপভোগ করা এই অর্থটি . উইন্টরনিৎসএর মন্তব্যের প্রায় সমার্থক হয়

 

. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য অসঙ্গকে আদ্য তান্ত্রিক আচার্য রূপে সিদ্দ করার প্রশ্নে তাকে গুহ্যসমাজতন্ত্রের রচয়িতা বলেছেন যেখানে ষট্কর্ম, পঞ্চমকার তথা সিদ্দি বিষয়ক বিস্তৃত উপদেশ প্রাপ্ত হয়

চিত্তবজ্রধরোরাজা সর্বাগ্রূয়ো ভূবনেশ্বরঃ

ধর্মচর্যাগ্রূয়ধর্মার্থং ভাষাতে চর্যলফশম্।।

নির্বিকল্পার্থসম্ভথতাং রাগদ্বেষমহাকুলাম্

সাধয়েত্ প্রবরাং সিদ্ধিসগ্রযানেহ্যনিত্তরে।।

চন্ডালবেনুকারাদ্যা মারনার্থার্থচিন্তকাঃ

সিস্ধমন্ত্যগ্রূয়মানেহস্মি্ মহাযানে হ্যনুত্তরে।।

আনন্ততর্যপ্রভূতয়ঃ মহাথাপকৃতোহপি।।

সিদ্ধমন্তে বুদ্ধযানেহস্মিন্ মহাযানমহোদধৌ।।

-গুহ্যসমাজতন্ত্রম্‌, পঞ্চম পটল, পৃঃ ১৫

 

বৌদ্ধধর্মে শক্তি তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা, এর (গুহ্যসমাজতন্ত্র) সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য এর সাথে এতে পঞ্চধ্যানী বুদ্ধ এবং তার শক্তিকেও কল্পনা করা হয়েছে মঞ্জুশ্রীমূলকল্প এর পরবর্তী অর্থাৎ ৭ম শতাব্দীর রচনা, অপরদিকে এই গুহ্যসমাজতন্ত্র অসঙ্গকালীন, অর্থাৎ ৩য় খ্রীষ্টিয় শতাব্দীর গ্রন্থ সাধনমালারপ্রজ্ঞাপারমিতা সাধনকেও তিনি অসঙ্গকৃত বলেছেন তবে . উইন্টরনিৎস বিস্তারিত ভাবে . ভট্টাচার্যের মতকে খন্ডন করেছেন তিনি তান্ত্রিক নাগার্জুন এর সময় ৭ম শতাব্দী বলেছেন এবং যিনি মাধ্যমিক মতের প্রতিষ্ঠাপক আর্য নাগার্জুন হতে সম্পূর্ণ অর্থ ভিন্ন ছিলেন এর প্রতি ভিত্তি করে . উইন্টরনিৎস বৌদ্ধধর্মে ৭ম শতাব্দীর পূর্বে তন্ত্র প্রচারকে স্বীকার করেননি তিব্বতী পরম্পরা অনুসারে নাগার্জুনের জীবনাবধি ৬০০ বর্ষ স্বীকার করা হয়েছে এবং পুনঃ তাঁকে মাধ্যমিক শাস্ত্র এবং গুহ্যসমাজ পদ্ধতি উভয়ের সঙ্গে সমবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে গুহ্যাত্মক মহাযান ধর্মের তান্ত্রিকতা মান্যতা তথা ধারণী হতে বিকসিত হওয়া মন্ত্রতত্ত্বকে পন্ডিতগণ বিশেষরূপে ব্যাখ্যান করেছেন মহাসাংঘিকগণ একটি বিদ্যাধরপিটক তথা ধারণীপিটক সংগ্রহ করেছিলেন ললিতবিস্তর, সদ্ধর্মপুন্ডরীক সূত্র এবং লংকাবতার সূত্রও ধারণী হতে পরিচিত ছিল সদ্দর্মপুন্ডরীক ধারণীমন্ত্রপদের পর্যাপ্ত পরিচয় পাওয়া যায়

 

দিব্যাবদানেওম্ মনিপদেম্ হুম্ইত্যাদি প্রসিদ্ধ মন্ত্র অবলোকিতএর ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছে . বিনয়তোষ ভট্টাচার্য ধারণী দ্বারা মন্ত্রের বিকাশকে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা কালে অষ্টবাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার বিকাশ প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয়ে সূত্র, প্রজ্ঞাপারমিতা ধারণী, প্রজ্ঞাপারমিতা মন্ত্রের ক্রমানুসারেপ্রংনামক বীজাক্ষর বলেছেন এইটি প্রজ্ঞাপারমিতার প্রতীক এইভাবে মন্ত্রযানের প্রাচীনতা সিদ্ধ করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থের উদ্ধারকর্তা এবং প্রজ্ঞাপারমিতাস্তবএর রচয়িতা নাগার্জুনের মহাপ্রজ্ঞাপারমিতা শাস্ত্র হতে তথা ধারণী হতে (মন্ত্রের বিকাশ ক্রমকে পর্যালোচনা করলে) এই সত্যে উপনীত হওয়া যায় যে বস্তুতঃ পারমিতা যানের ধারণা বা সাধনা হল মন্ত্রযানএরই সাধনা প্রজ্ঞা হল স্বয়ং শক্তি এর প্রতি ভিত্তি করে বলা হয় যে এইটি একপ্রকারশক্তি সাধনা অতএব নাগার্জুনকে তান্ত্রিক মহাযান ধর্মের আদ্য আচার্য রূপে স্বীকার করা যেতেই পারে অপর দিকে মৈত্রেয়নাথ এবং অসঙ্গকে যা ইতিপূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে, মৈথুনপরক রহস্যবাদের সঙ্গে সম্পদ করা হয়েছে যদি নাগার্জুনকে আদ্য আচার্য রূপে স্বীকার করা হয় তাহলে প্রজ্ঞার অভ্যুদয়এর কারণ তান্ত্রিক মহাযান ধর্মের উদয় খ্রীঃ পূর্ব ১ম শতাব্দী নয় অধিকিন্তু তারও পূর্বে স্বীকার করতে হবে মঞ্জুশ্রীমূলকল্পকে যদিও কিছু বিদ্বান ২য় শতাব্দীর রচনা বলে স্বীকার করেছেন কিন্তু তা ৮ম শতাব্দীর হওয়া উচিত অতঃ বিদ্বানগন পর্যাপ্ত প্রমাণ প্রদান পূর্বক এইটি প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে ৭ম শতাব্দীর পূর্বেই মহাযান ধর্মে তন্ত্রের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ হয়েছিল এইভাবে . উইন্টরনিৎসএর অভিমতকে খন্ডন করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে

 

তিব্বতী বৌদ্ধ ঐতিহাসিক লামা তারানাথ (তারনাথ)’এর অভিমতকে পাথেয় করে বিদ্বানগন বলেছেন যে তান্ত্রিক সাধনা অত্যন্ত গুপ্ত রূপে গুরু শিষ্য পরম্পরানুসারে অসঙ্গ হতে ধর্মনীতির সময়কাল পর্যন্ত জীবিত ছিল এই রহস্য সাধনা উত্তরকালে জনসামান্যতে প্রচলিত হয় এবং দীক্ষা প্রদানের মাধ্যমে রহস্যোপদেশ এবং সাধনা ৪র্থ শতাব্দী হতে প্রায় ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত জীবিত ছিল বলে মনে হয় তবে নাগার্জুন (প্রথম শতাব্দী) হতে শুরু করে প্রায় ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত এইরূপে প্রচলিত থাকার না তো কোন প্রমাণ পাওয়া যায় আর না তো বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় সাধক এবং সাধ্য উভয়ক্ষেত্রেশক্তি কল্পনা নিশ্চয়ই পরবর্তী সময়ের, কিন্তু এও নিশ্চিত যে তন্ত্র-মন্ত্র-মন্ডল ইত্যাদি পূর্বেই লিখিত গ্রন্থে স্থান লাভ করেছিল এবং এও হতে পারে যে শক্তির কল্পনা গুরু-শিষ্য পরম্পরা অনুসারে দীর্ঘকাল পর্যন্ত হয়ত জীবিত ছিল তথাপি গুহ্যসমাজতন্ত্র, হে বজ্রতন্ত্র ইত্যাদি গ্রন্থের পূর্বে এর ব্যবস্থিত বিবরণ পাওয়া যায় না সর্বোপরি প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ সঙ্গীতি এবং পালি গ্রন্থ সমূহে (ত্রিপিটক, অটঠ্কথা সাহিত্য ইত্যাদি) তন্ত্র তথা গুহ্য সাধনার কোন রূপ উল্লেখ পাওয়া যায় না এই অর্থে বৌদ্ধতন্ত্রের প্রাচীনতা প্রতিষ্ঠিত হয় না

 

উপর্যুক্ত বিবরণ হতে এইটি স্পষ্টতর হয় যে প্রায় ১ম শতাব্দী হতে ৪র্থ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধের পরম দেবত্ব রূপ, অমিতাভ, বোধিসত্ত্ব, অবলোকিতেশ্বর, পঞ্চধ্যাণী বুদ্ধ, মঞ্জুশ্রী ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হয়েছিল এদের পূজা-প্রার্থনার প্রশ্নে অনেক স্ত্রোত্র, ধারণী এবং মন্ত্রের নির্মাণ বোধিসত্বের ক্ষেত্রে করুণা-প্রসার এবং প্রজ্ঞার উপলব্দি দ্বারা অভিন্ন স্বীকার করা হয়েছিল নাগার্জুনের মাধ্যমিক মত অথবা শূন্যবাদ সেখানে দার্শনিক ভূমিকা বিচারনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সেখানে যোগাচার মত যোগ এবং আচারকেও প্রতিষ্ঠিত করেছিল প্রজ্ঞাপারমিতা সাধনা নাগার্জুনের সৎপ্রযত্ন দ্বারা শক্তি সাধনার বীজ রোপন করেছিল এবং এর বিকাশ যান্ত্রিক প্রয়োগের প্রজ্ঞাপারমিতার সাধন রূপে হয়েছিল বিজ্ঞানবাদ অধবা যোগাচার মতের আচার্য মৈত্রেয় এবং অসঙ্গ মৈথুনপরক সাধনার ঔপম্যাবিধানপরক স্বরূপ প্রস্তুত করেছিলেন এবং সাথে বিজ্ঞানতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠাপূর্বক চিত্তকেই এই সম্পূণফ সংসারের উৎপত্তি প্রাণাশের মূল বলেছেন

 

 বোধিচিত্তোপাদের ক্রমনিবিষ্ট প্রক্রিয়াতে সময়ের অপব্যয় তথা শ্রঘ্র প্রজ্ঞোপলব্দি বা প্রত্যাত্মগতিকে প্রাপ্তির ভাবনা দ্বারা ধারনী এবং মন্ত্রকে অত্যধিক গুরিত্ব প্রদান করা হয়েছিল এই ধারণী মন্ত্র দ্বারা অর্জিত শক্তির সহায়তা দ্বারা প্রাণীমাত্র দুঃখের সমুদ্ধরণের প্রক্রিয়াতে সদৈব লীন হওয়া বোধিসত্ত্বের অভ্যুদয় বহুলতা পূর্বক শুরু হল মূর্ত্তি এবং সেই সকল দেবতার প্রতীক সমূহের বিস্তার হতে লাগল মূর্ত্তি-নির্মাণ এবং তাদের পূজা-বিধানের প্রতি পর্যাপ্ত সময় প্রদান তথা এদের মাহাত্ম্য তথা গুণ-কীর্ত্তন অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে সম্পাদন শুরু হল এইভাবে ধার্মিক, সাধনাত্মক এবং দার্শনিক পরিস্থিতিতে মন্ত্রযান হতে বজ্রযানের উদ্ভব হল

 

মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন মান্ত্রিক সাধনা অথবা মন্ত্রযানের অবধি ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বলেছেন যদি ধর্মকীর্তির সমব ৭ম শতাব্দীর উত্তরার্দ্ধ স্বীকার করা হয়, যেমনটি এইচ.কর্ণ (ম্যানুয়েল অর্ বুড্ডিজম্‌) বলেছেন, তাহলে উপর্যুক্ত পারম্পরিক বিশ্বাসের প্রতি ভিত্তি করে কথা বলা যায় যে উত্তরকালে এখন অনেক সিদ্ধাচার্য উৎপন্ন হয়েছিলেন যারা উপর্যুক্ত প্রকারের গুপ্ত পরম্পরা দ্বারা প্রচলিত সাধনা পদ্ধতিকে অপেক্ষাকৃত অধিক ব্যাপক, ব্যবস্থিত এবং প্রকাশিত রূপে প্রচারিত করা আরম্ভ করেছিলেন এর এক অর্থ এও হতে পারে যদিও মন্ত্র-তন্ত্রের প্রচার তো জনসামান্যতে অবশ্যই ছিল কিন্তু শক্তি তত্ত্ এবং পঞ্চমকার (মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন, মাংস এবং মদ্য) এর সাধনা অত্যন্ত গুপ্ত, সীমিত এবং দীক্ষিত মন্ডলীতে প্রচলিত ছিল অতঃ এই তত্ত্ব সমন্বিত সাধনা সাধারণ জনগনের মধ্যে প্রচার ৭ম শতাব্দীর পরবর্তী সময়ে হয়েছিল, এই অনুমান করা যায় যদিও ৭ম শতাব্দীর পূর্বে এইরূপ কোন তন্ত্রগ্রন্থ পাওয়া যায়নি যেখানেপঞ্চমকারএর বিবরণ রয়েছে তবুই অশ্বকোষ, নাগার্জুন এবং কুমারজীবনএর সমকালীন এবং নাগার্জুনের শিষ্য আর্যদেবেরচিত্তবিশুদ্ধিপ্রকরণকে দ্বিতীয় শতাব্দীর উত্তরাদ্ধের গ্রন্থ ঘোষিত করে তাকে উপর্যুক্ত তত্ত্ব দ্বারা সমন্বিত রূপে স্বীকার করা হয়েছে মহামহোপাধ্যায় হরপ্র্রসাদ শাস্ত্রী এইরূপে অভিমতকে স্বীকার তথা গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি . বিনয়তোষ ভট্টাচার্য এই গ্রন্থের লেখককে ৭ম শতাব্দীর আর্যদেব বলেছেন শ্রী পি.ভি. প্যাটেল (চিত্তবিশুদ্ধি প্রকরণ অফ্ অর্যদেব) উক্ত গ্রন্থের সম্পাদন কালে এর ভূমিকাতে প্রভূত প্রমাণের প্রতি ভিত্তি করে এইটি প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্ঠা করেছেন যে এই গ্রন্থের রচয়িতা আর্যদেব রাহুল ভদ্র অথবা সরহের শিষ্য নাগার্জুনের সমকালীন ছিলেন অন্য প্রমান হতে এইটি প্রতিষ্ঠিত হয় যে এর রচয়িতা আর্যদেব পালবংশীয় শাসক গোপালএর সমকালীন শাক্যমিত্রের পূর্ববর্তী অথবা ৮ম শতাব্দীর প্রারম্ভিক সময়ের কিছু পূর্বে বিদ্যমান ছিলেন তবে ৭ম শতাব্দীর পূর্বের কোনোরূপ লিখিত প্রমান এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি এখন আমরা মন্ত্রযানের পরবর্তী তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধনা (তন্ত্রযান), ধর্ম এবং দর্শনের বিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব

 

অনেকযান এবং আচার ত্রয়

 

. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য পরবর্তী বৌদ্ধমতের বিভাজন বজ্রযান, কাল-চক্রযান এবং সহজযান ইত্যাদি করেছেন এর অতিরিক্ত কিছু অন্যযানেরও বিবরণ পাওয়া যায় এবং যাদের সম্পর্ক এই তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেমন- তন্ত্রযান, মন্ত্রযান এবং ভদ্রযান ইত্যাদি সংক্ষেপে সম্প্রদায়-বিভাজনএর মতকে এইরূপে প্রস্তুত করা যেতে পারে যেমন

. কে. দবাসম্দুপ (শ্রী চক্রসম্ভার তন্ত্র তান্ত্রিক টেক্সট)

মন্ত্রযান

ক্রিয়াতন্ত্রযান চর্যাতন্ত্রযান যোগতন্ত্রযান

মহাযোগতন্ত্রযান অনুত্তরযোগতন্ত্রযান অতিযোগতন্ত্রযান

. . শশীভূষণ দাশগুপ্ত (আবস্ক্যোর রেলিজাস্কাল্টস্‌)

মন্ত্রযান ক্রিয়াতন্ত্রযান চর্যাতন্ত্রযান যোগতন্ত্রযান অনুত্তরযোগতন্ত্রযান নিম্নতন্ত্র, অনেক প্রকার বিধি-বিধান দ্বারা যুক্ত, উত্তমন্ত্রতা, পরমসত্যের সাক্ষাৎকার সম্পাদনের দেবী-দেবতার পূজা এবং অন্য বাহ্য পূজা-বিধান নিমিত্তে যৌগিক সাধনার প্রধানতা, পরম সত্যের  দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি প্রতি পর্যালোচনা অতিযোগতন্ত্রকে কে দবাসম দুম মহাশয় সর্বোত্তম যান বলেছেন তাই তন্ত্র মূলতঃ অদ্বৈতবাদী এবং শুণ্যবাদী ছিল সংসার এবং নির্বাণের অদ্বৈততা কেই সাধক চরম সিদ্ধিলাভ রূপে স্বীকার করেছেন . দাশগুপ্ত দ্বারা প্রস্তুত বিভাজনে অনুত্তর যোগতন্ত্রযান অন্তিম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ; কিন্তু তারানাথের প্রমাণের প্রতি ভিত্তি করে এইচ. কর্ণ অনুত্তরযোগতন্ত্রযানকে পরবর্তী সময়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা বলেছেন ইতিপূর্বে বিভাজনে যে নিম্নতন্ত্র এবং উত্তমতন্ত্রের উল্লেখ হয়েছে, তার দ্বারা উভয় ক্ষেত্রেই বাহ্য এবং অন্তস্সাধনার পার্থক্যটি স্পষ্টতর হয় অনুত্তরযোগ সাধনার পূর্ণ প্রকৃষ্ট রূপ সহজযান রূপে বিকসিত প্রতীত ্য়, যাকে অতিযোগ তন্ত্রযান বলা হয়েছে এই দুই যানের অতিরিক্ত কালচক্রযানের উল্লেখ করা হয় সম্ভবত কালচক্রযান পূর্বে স্বতন্ত্র মত ছিল কিন্তু উত্তরকালে তান্ত্রিক বৌদ্ধ সমাজ দ্বারা সম্মিলিত করা হয়েছিল তবে . ভট্টাচার্য কালচক্রযানকে বজ্রযানের পরে স্থান প্রদান করেছেন . বেভেল বজ্রযানের পূর্বে কালচক্রযানের উৎপত্তি বলেছেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মতে বেডেলের এই ধারণা সম্পূর্ণ অর্থে অযৌত্তিক কারণ শ্রীকালচক্র মূলতন্ত্রের বিবরণঅভিনিশ্রয়ণসূত্রতে পাওয়া যায় কাস্মা ডে কারাস অনুসারে ভারতে এর প্রবর্তন সম্ভবত ৯৬৬ খ্রীঃ হয়েছিল

 

ইতিপূর্বে সম্প্রদায়এর যে বিভাজন প্রস্তুত করা হয়েছিল, তাতে স্পষ্ট অর্থেই অধিকার ভেদের সিদ্ধান্ত নিবিষ্ট রূপে দৃষ্ট হয় অধিকারভেদেবাদ হল তন্ত্রের প্রিয় বিষয় ফলে ক্রিয়াতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র ইত্যাদির বিভাজন এই সিদ্ধান্তের প্রতি ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেই মনে হয় . ভট্টাচার্য এই বিষয়টি সিদ্ধ করছেন, যেভাবে হিন্দুতন্ত্রের দক্ষিনাচার এবং বামাচার নামক দুটি বিভাজন স্বীকৃত ঠিক সেইভাবে বৌদ্ধতন্ত্রের ক্রিয়াতন্ত্র এবং চর্যাতন্ত্রকে দক্ষিনাচারে তথা যোগতন্ত্র এবং অনুত্তর যোগতন্ত্রকে বামাচারের অন্তর্গত গননা করা হয় দক্ষিনাচারে পূর্ণ কঠোর ব্রহমষর্য, নিয়মিত ভোজন, নিয়মিত যান এবং নৈতিক আচার মুখ্যরূপে গণ্যকরা হয় যখন সাধক এই আচারে পূর্ণতা লাভ করেন তখন তিনি বামাচারে দীক্ষিত হওয়ার অধিকারী হন এই বামাচারে বামা বা শক্তি বা নারীকে আচার সাধনের অনিবার্য উপকরণ রূপে স্বীকার করা হয়েছে উপরে যে বিবরণ প্রস্তুত করা হয়েছে, তার প্রতি ভিত্তি করে বলা যায় যে প্রায় ৭ম শতাব্দীর পূর্বে যেরূপ সাধনা প্রচলিত ছিল, যার প্রাথমিক বিবরণ মহাযান সূত্র এবং অন্যান্য সংসখরত বৌদ্ধ গ্রন্থে পাওয়া যায়, তা মূলঅর্থে দক্ষিনাচার ছিল অর্থাৎ সেই সময় ক্রিয়াতন্ত্র এবং যোগতন্ত্রের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হোত

যদি বামাচারের কোন সাধনা সেই সময় প্রচলিত থাকত তাহলে তার প্রমান এই সময় দৃষ্ট হয় না ৭ম শতাব্দীর গ্রন্থ বামাচারের প্রমকার সমন্বিত সাধনার প্রতি ইঙ্গিত করে কিন্তু বীদ্ধ দিদ্ধাচার্যগনের লোকভাষার প্রতি সহজসিদ্ধান্তের প্রতিমাদক রচনাসমূহ ভাব সাধনা বা দিব্য সাধনা প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে

 

প্রায় ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত সাহিত্য এবং সাধনের যে বিবরণ প্রস্তুত করা হয়েছে, তার প্রতি ভিত্তি করে একথা বলা যেতে পারে এই কাল বস্তুতঃ এবং প্রমুখতঃ আচার্যের কাল ছিল অতঃ বিদ্ধাচার্য কালএর আরম্ভ বলা যেতে পারে এই সিদ্ধাচার্য অধবা মহাসিদ্ধ ৮৪ সংখ্যাতে প্রখ্যাত ছিল এবং বিভিন্ন প্রাচীন সংস্কৃত বৌদ্ধ গ্রন্থে এদের বিবরণ পাওয়া যায় এদের অধিকতর বিস্তারকাল ১২ শতাব্দী স্বীকার করা হয় প্রমুখ সিদ্ধের বর্তমানতা - শতাব্দী পর্যন্ত বলা যেতে পারে এই শতাব্দীতে বজ্রযান বিপূল প্রচার-প্রসার লাভ করেছিল প্রথম সিদ্ধ অথবা আদি সিদ্ধরূপে প্রায়ঃ সরহপাদ বা রাহুলভদ্র নাম উঠে আসে এদের বজ্রযানের আদ্য আচার্য রূপে স্বীকার করা হয় এদের সময়কাল ৮ম শতাব্দী কিন্তু . ভট্টাচার্য সরহপাদের সময় ৬৩৩ খ্রীঃ বলেছেন মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ণ সরহপাদকে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন এবং অনেকে প্রমাণের প্রতি ভিত্তি করে এই আচার্যের সময়কাল ৭৬৮-৮০৯ খ্রীঃ স্বীকার করেছেন এই সরহপাদ তাঁর রচনার দ্বারা বিচিত্র রীতি-পদ্ধতি তথা যোগ ক্রিয়া দ্বারা বজ্রযানকে এক সর্বজনীন ধর্মে রূপান্তরিত করেছিলেন সর্বোপরি হেবজ্রন্ত্রের যে তান্ত্রিক পরম্পরাতে জলন্ধরপাদ এবং কৃষ্ঞপাদের উল্লেখ পাওয়া যায়, তার প্রবর্তক এবং প্রচারকরূপে সরহপাদের নাম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ

 

বস্তুতঃ বজ্রযানের আরম্ভ বজ্রভাবনার প্রতিষ্ঠার সাথেই স্বীকার করা উচিৎ দেবী-দেবতার কল্পনা, তাদের বৈশিষ্ট্য, চিহ্ন, অস্ত্র-শস্ত্র, আভূষণ, বেশ-ভূষা, সকল ক্ষেত্রেই মহান পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল তাই যানের নেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে কিছু মুখ্যগ্রন্থ হল এইরূপ- আদিকর্মপ্রদীপ, অষ্টমী ব্রতবিধান, সাধনমালা, সাধন সমুচ্চয়, পঞ্চক্রম, গুহ্যসমাজ অথবা তথাগতগুহ্যক, মঞ্জুতশ্রীমূলকল্প, জ্ঞানসিদ্ধি, অদ্বৈতসিদ্ধি, চন্ডমহারোষতন্ত্র, চক্রসম্ভার তন্ত্র, অদয়বজ্র সংগ্রহ এবং হে বজ্রতন্ত্র ইত্যাদি তান্ত্রিক মহাযানের পূর্বোক্ত উথ্থান অনুসারেই বজ্রযান সাহিত্যের বিভাজন দৃষ্ট হয় ক্রিয়াতন্ত্রে মন্দির-নির্মাণ, দেবমূর্ত্তি-স্থাপনা ইত্যাদি ধার্মিক বিধির আলোচন দৃষ্ট হয় চর্যাতন্ত্রে ব্যবহারিক আচার সম্পর্কিত বিধান প্রযুক্ত হয়েছে যোগতন্ত্রে যোগাভ্যাস তথা অনুত্তরযোগতন্ত্রের উচ্চতর রহস্যবাদ ব্যাখ্যাত হয়েছে প্রথম বিভাগে আদি কর্মপ্রদীপ, অষ্টমী ব্রত বিধান, সাধনমালা, সাধন সমুচ্চয় ইত্যাদি গ্রন্থের গননা করা হয় পঞ্চক্রম অনুত্তরযোগতন্ত্রের গ্রন্থ এবং মঞ্জুশ্রমূলকল্পের গননা এই বিভাবে করা হয় আদিকর্মপ্রদীল্পেএর পদ্ধতি হল গুহ্যসুত্রের যেখানে প্রতিদিনের ক্রিয়াতন্ত্র ইত্যাদি বিধি-পদ্ধতি পাওয়া যায় অষ্টমী ব্রত বিধান ব্রত, মুদ্রা এবং যন্ত্র-তন্ত্র-মন্ত্র সহ প্রার্থনা (সেমন হুং হুং ফট্ফট্স্বাহা ইত্যাদি) প্রয়োগ বুদ্ধ এবং বোধিসত্বের ক্ষেত্রেই নয় অন্যান্য দেবতার ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়েছে এতঢ সিদ্ধি প্রবৃত্তি সঙ্গে অঙ্গুলির মুদ্রা বিধান রয়েছে এইরূপ গ্রন্থে দেব-দেবীর উচিৎ রূপ, আকার, বর্ণ ইত্যাদির পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় এক্ষেত্রে সাধনমালা এবং সাধন সমুচ্চয় গ্রন্থদ্বয় অতীব গুরত্বপূর্ণ উক্তগ্রন্থ সমূহে যে সকল দেবী দেবতা সমূহের পূজা-পদ্ধতি তথা মন্ত্রাদির বিধান দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে মুখ্য হলধ্যানী বুদ্ধ বা পঞ্চধ্যানী বুদ্ধ, তাদের কুল, দেবী তারার বিভিন্ন রূপ সাধনমালা (খন্ড-)’ বিষয়টি এইভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে যেমন

মাতৃমন্ডলমধ্যস্থাং তারাদেবীং বিভাবয়েত্

অষ্টবাহুং চতুর্বক্রাং সর্ব্বালঙ্কার ভূষিতাম্।।

কনকবর্ণানিভাং ভব্যা কুমারীলক্ষনোজ্জ্বলাম্

বিশ্বপদ্মবসামাসীন চন্দ্রাসনসুসংস্থিতাম্।।

থীতকৃষ্ঞাসিত রক্ত সব্যাবর্ত্তচতুর্মুখাম্

প্রতিমুখং ত্রিনেত্রাং বজ্রপর্য্যঙ্কসংস্থিতাম্।।

-সাধনমালা, খন্ড-, বজ্রতারাসাধনম্

বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী অবতার তথা বজ্রানঙ্গ বিবরণ সাধনমালার সাধন ৪৯-৬০ পাওয়া যায় যদিও এই সাধনের মূলতত্ত্ব ভূতবিদ্যা এবং সিদ্ধি লাভ, তথাপি তাতে (যোগসাধনা, পূজা-উপসনা ইত্যাদিরও বিবরণ রয়েছে এই গ্রন্থের ৩১২ সাধনের লেখকগণ- তান্ত্রিক অসঙ্গ নাগার্জুন, ইন্দ্রভূতি, পদ্মব্রজ, লক্ষীকরা, সহজযোগীনী চিন্তা, রত্নাকরগুপ্ত, অদ্বয়বজ্র, সহরপাদ, রত্নাকরশান্তি, শ্রীধর ইত্যাদি

 

উত্তমতন্ত্রের মধ্যে গুহ্যসমাজতন্ত্র অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত একটি তন্ত্রযান গ্রন্থ এই গ্রন্থটিকে বৌদ্তন্ত্রের সর্বাধিক প্রাচীন গ্রন্থ বলা হয় এতে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম অথবা বজ্রযানের বিবিধ-পক্ষীয় আলোচনা দৃষ্ট হয় এর বৈশিষ্ট্য হল এই যে এখানে শক্তিতত্ত্বের বিভিন্ন রূপকে ব্যক্ত করা হয়েছে গুহ্যসমাজতন্ত্রে সামান্য সিদ্ধি (অন্তার্দ্ধান, অনিমা, লঘিমা ইত্যাদি), উত্তম সিদ্ধি (বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি), এই জন্মে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি, ষড়ঙ্গযোগে নিষ্ঞাত হওয়ার পরে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি, ইচ্ছাভোগ দ্বারা বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি, শক্তিতত্ত্বপ্রতিষ্ঠা, প্রত্যেক ধ্যানী বুদ্ধের সাথে এক-এক শক্তির কল্পনা, প্রত্যেক সাধকের সঙ্গে শক্তির প্রয়োজনীয়তা, প্রজ্ঞাভিষেক, মদ্য-মাংস-মৈথুন-মৎস্যের মুক্ত উপযোগ, হয়-হস্তি-শ্বান-মাংসের অতিরিক্ত মহামাংস পর্যন্ত বিধান, পবিত্র গ্রন্থপাঠ, মন্ডল-নির্মান, রত্নপূজা ইত্যাদি সর্বপ্রথম ব্যাখ্যাত হয়েছে গুহ্যসমাজ তন্ত্রের দৃষ্টকোন অনুসারে সাধকের ক্ষেত্রে সামাজিক নিয়ম এবং মর্যাদা ব্যবহার্য নয় সে এগুলিকে উল্লঙ্ঘন করতে পারেন তাতে অসত্য ভাষণ, জীবহিংসা, পরদ্রব্যহরণ ইত্যাদি অনৈতিক কার্য হতে বিরত হতে হবে একেি বজ্রমার্গ বলা হয় শূন্যতার সাক্ষাতকাতী ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংসার হল নাতক এবং এর কোনোরূপ অস্তিত্বই নেই এই গ্রন্থে প্রকার উপায়, প্রকার সেবাষড়ঙ্গযোগ এবং হট্যোগ ইত্যাদির উপদেশ পাওয়া যায়

বলা হয়েছে যে উত্তম সিদ্ধির সাধনা প্রারম্ভ করার পূর্বে সাধককে হঠযোগে পূর্ণ নিপূণ হওয়া প্রয়োজন সামান্য চমৎকারিক সিদ্ধির বিষয়েও পূর্ণ নির্দেশ পাওয়া যায় যট্কর্ম (মারণ, মোহন, উচ্চাটন, বশীকরণ, স্তম্ভন, বিদ্বেষন, আকর্ষন, শান্তিক ইত্যাদি)’ বিধানও নির্দেশিত হয়েছে বোধিসত্ত্ব তথা তাঁর উৎপাদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় তথা বজ্রমার্গের অনুসরণ দ্বারা পতিততম অথবা অনৈতিকত ব্যক্তি নির্বাণ লা্য করতে পারেন বলা হয়েছে দেবতা বিবেচনএর দৃষ্টকোন অনুসারে এইগ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রন্থে সর্বপ্রথম ধ্যানী বুদ্ধের ব্যবস্থিত বিবরণ দৃষ্ট হয় এই ধ্যানী বুদ্ধঅক্ষোভ্য, অনিতাভ, বৈরোচন, অমোঘসিদ্থি এবং রত্নসম্ভব তথা এদের শক্তি সমূহলোচনা, মামকী, তারা, পান্ডরা এবং সময়তারা চার চার রক্ষকপ্রজ্ঞান্তক, পদ্মান্তক, সমান্তক, বিঘ্নান্তক অচল, টক্কিরাজ, নীলান্ডে, মহাবল নামক চার দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায় যারা মঞ্জুতশ্রী সাথে অবস্থান করেন অথবা উষ্ঞীষ বিজয়া সাথে ভূতাধিপতি, অপরাজিত, জম্ভল, মঞ্জুতবজ্র, অবলোকিতেশ্বরএর বিবরণ রয়েছে এইগ্রন্থে বজ্রধর এবং বজ্রসত্ব পরস্পর মিশ্রিত হয়ে গেছে এবং পরবর্তী সময়ে বজ্রসত্ব হয়েছেন ষষ্ঠধ্যানী বুদ্ধ এবং বজ্রধর পরমোদ দেবতা রূপে পরিগণিত হয়েছেন গুহ্যসমাজে বজ্রসত্ব বৌদ্ধ দেবতার অধিদেব রূপে প্রস্তুত করা হয়েছে

 

স্বচ্ছং তত্স্বভাবং নানারূপং সমন্ততঃ

বুদ্ধমগ্নি সমাকীর্ণং সফুলিভগগনজ্বলম্

স্বচ্ছাদিমন্ডলৈর্যুক্তং সর্বতথাগতং পুরম।।।।

অহো হি সর্ববুদ্ধানাং বোধিচিত্তপ্রবর্তণম্

সর্বতথাগতং গুহ্যং অপ্রতর্ক্যমণাবিলম্।।।। ইতি।।

ভাষস্ব ভগবন্তত্ত্বং বজ্রসারসমুচ্চয়ং

সর্বতথাগতং গুহ্যং সমাজং গুহ্যসম্ভবম্।।।।ইতি।।” -গুহ্যসমাজতন্ত্রম্, সর্বতথাগত সমাধিমন্ডলাধিষ্ঠানপটল : প্রথম :

 

অন্য গ্রন্থ সমূহের মধ্যে প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধি, জ্ঞানসিদ্ধি, অদ্বয়বজ্রসংগ্রহ ইত্যাদি গণনা করা যেতে পারে প্রথম ২টি গ্রন্থে প্রজ্ঞোপায়, সংসারনিধান, তত্ত্বচর্যা, গুরুশিষ্যবাদ, দীক্ষা, মুদ্রা, বজ্রাচর্যপূজা ইত্যাদি অনেক দার্শনিক এবং সাধনাত্মক বিষয় আলোচিত হয়েছে অদ্বয়বজ্রসংগ্রহতে দার্শনিক সিদ্ধান্ত রয়েছে এতে অন্য বিষয়গুলি বজ্রযান গ্রন্থের সমান

এই সম্পূর্ণ আলোচচনার তাৎপর্য এই যে তান্ত্রিক মহাযান ধর্মে সাধনা উপাসনার দৃ্ষ্টিতে তিনটি স্তরে বিভক্ত তাকে আমরা আম্নায় বলতে পারি প্রথমতঃ সাধকের একটি অংশ এইরূপে ছিল, যারা মন্ত্রমন্ডল, অঙ্গুলির মুদ্রা, দেবী-দেবতার তান্ত্রিক বিধি-বিধান যুক্ত পূজা-উপাসনা ইত্যাদি বিশ্বাস করতেন এবং এর অনুসরণ পূর্বক সিদ্ধি, ভৌতিক-সাংসারিক উপলব্দি, ব্যাধিনাশ, ষট্কর্ম ফল ইত্যাদি প্রাপ্ত করতেন এক্ষেত্রে সংযম, সদাচার, শীল ইত্যাদি পালনের বিধান ছিল দ্বিতীয় অংশ শুদ্ধ এবং শক্তি সম্পন্ন হয়ে তান্ত্রিক বিধি অনুসারে প্রজ্ঞা সাধনাতে প্রবৃত্ত হতেন পঞ্চমকার, পঞ্চপবিত্র সেবনাদিতে পূর্ণ স্বচ্ছন্দতার আচরণ করতেন তৃতীয় সাধক বর্গের কিছু সংকেত উপর্যুক্ত গ্রন্থে পাওয়া যায়, যারা এই সকল বাহ্যাচার (প্রথম এবং দ্বিতীয়, উভয়ই) খন্ডন পূর্বক পরমমহাসুখএর অনুভব অন্তসাধনা দ্বারা সম্পন্ন করতেন

 

মন্ত্রযান এবং বজ্রযান ব্যতীত কালচক্রযান এবং সহজযান এবং সহজযানের কথা বিদ্বানগণ আলোচনা করেছেন কালচক্রযান মূলতঃ আদিবুদ্ধ সিদ্ধান্ত একে বৌদ্ধধর্মের ঈশ্বরবাদী রূপও বলা যেতে পারে যার প্রচার তিব্বতে কালচক্রযান রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এই যানকেও মহাযানী সিদ্ধান্তের স্বাভাবিক বিকাশ বলা হয়েছে এক্ষেত্রে পঞ্চধ্যানী বুদ্ধ কেও এক আদিম বু্দ্ধের প্রকাশন অথবা অবতার রূপে কল্পনা করা হয়েছে যদিও এই সম্প্রদাবের উল্লেখ কালচক্রযানী সাহিত্য উদ্ভবের পূর্বে কোন নিশ্চিত উল্লেখ পাওয়া যায় না তবে আদিবুদ্ধ সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা করন্ডব্যুহ ইত্যাদি মহাযান সূত্রে পাওয়া যায়

 

তিব্বতে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বিকাশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বঙ্গীয় বৌদ্ধ আচার্য অতীশ দীপঙ্কর অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন বিদ্বানগণের মতানুসারে ১০২৫ খ্রীঃ তিব্বতে কালচক্রযানের সূত্রপাত হয় সআর চালর্স এলিয়টের মতে শাক্যমুনি কালচক্র সিদ্ধান্ত উড়িষ্যার ধ্যান্যকন্টক স্থানে করেছিলেন অতঃ শম্ভল নামক শাসক সুচন্দ্র অত্যন্ত অলৌকিক ভাবে এই উপদেশ প্রাপ্ত করেন এবং কালচক্রতন্ত্রের স্ফূর্ত রচনা করেছিলেন, যদিও এর প্রকাশন ৯৬৬ খ্রীঃ হয়েছিল তবে এলিয়টের এই তথ্য সমর্থন যোগ্য নয়

 

মহামহাপোধ্যায় হয়প্রসাদ শাস্ত্রী অনুসারে কাল অর্থ মৃতা এবং বিনাশ কালচক্রের অর্থ হল নাশচক্রের অর্থ হল নাশচক্র এবং এর সঙ্গে যান সংযুক্ত হওয়ার ফলে এর অর্থ হবেকাল বা বিনাশের চক্র হতে রক্ষাকারী মার্গ তবে সেকোদ্দেশে টীকাতে এর অর্থ ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে এবং এই অনুসারেকাএর অর্থ শান্ত কারণ, ‘’- অর্থ হললয়’, ‘এর অর্থ চঞ্চলচিত্ত তথাক্রএর অর্থক্রমবর্ধন

দানং গোময়মম্বুনা সহিতং শীলং সম্মার্জনং

ক্ষান্তিঃ ক্ষুদ্রপিপীলিকাপনয়নং বীর্য্যং ক্রিয়াস্থাপণম্

ধ্যানং তৎক্ষণমেকচিত্তকরণং প্রজ্ঞা সুরেখোজ্জ্বলা ()

রুতাঃ পারমিতাঃ ষভেব লভতে কৃত্বা মুনের্মন্ডলম্।।

ভবতি কণকবর্ণ সর্ব্বরোগৈর্বিমুক্ত:

সুরমনুজবিশিষ্টশ্চন্দ্র [৪ক] বদ্দীপ্তকান্তিঃ

ঘনকনসমৃদ্ধো জায়তে রাজবংশ সুগতবরগৃহে হস্মিন্ কায়কম্মাণি কৃত্বা।।” -অদ্দয়বজ্রসংগ্রহ, মন্ডলপূজাবিধিঃ, পৃঃ ১০

সাংসারিক বিষয় দ্বারা চঞ্চল চিত্তের সাথে পরম শান্ত কারণ (আদিবুদ্ধ)’ প্রাণের লয়কেকালচক্রবলা হয়

ককারাৎকারণে শান্তে লকারাল্লয়ো অত্র বৈ চকারাচ্চলচিত্তস্যক্রকারাৎ ক্রমবন্ধনৈঃ” -সেকোদ্দেশটীকা, পৃঃ

 

আদিবুদ্ধের কল্পনা করুনা এবং শূন্যতার মূর্ত্তি রূপে করা হয়েছে এরই সংজ্ঞা হল কাল তার শক্তি সংবৃতিরূপীনি হয় অর্থাৎ জগতের এই ব্যবহারিক রূপ (সংবৃতি) এর শক্তি চক্র সতত্ পরিবর্তনশীল বিশ্বের প্রতিনিধি অর্থাৎ সক্তি দ্বারা সম্বলিত রূপই হল কালচক্র এই অদ্বয় (দুই হয়েও এক) তথা সে নিত্য অবিনশ্বর তথা অক্ষর

 

করুণাশূন্যতামূর্তিঃ কাল সংবৃত্তিরূপীনী শূন্যতা চক্রমিত্যুক্তং কালচক্রোহদ্বয়োকরঃ।।” -বৌদ্ধদর্শন মীমাংসা, পৃঃ ৪৫৭

 

কালচক্রতন্ত্রম্ বলা হয়েছে-

আদৌ সন্তাভিষেকো যো বালানামবতারনম্

ত্রবিধৌ শোকসংবৃত্যা চতুর্থঃ পরমার্থতঃ।।।।

সত্যাদয়েন ধর্মানাং দেশনা বজ্রিনো মম

লোকসংবৃতিসত্যেন সত্যেন পরমার্থতঃ।।।।

উদকং মুকুটঃ পট্টো বজ্রঘন্টা মহাব্রতম্

নামানুজ্ঞাসমাযুক্তঃ সেকঃ সপ্তবিধ নৃপ।।।। -দীক্ষাপ্রকরণম্, পৃঃ৪৩

এইযানের মূলগ্রন্থ হল- শ্রীকালচক্রমূলতন্ত্র, সেকোদ্দেশটীকা, বিমলপ্রভা এবং পরমার্থ সেবা পিন্ডব্রহমান্ডবাদ ইত্যাদি সিদ্ধান্তকে এই মান পুর্ণরূপে স্বীকার করে প্রাণাপাননিয়ন্ত্রণকে সর্বোত্তম সাধন বলেছেন এই তথ্যের প্রতি ভিত্তি করে . দাশগুপ্ত উভয়যানের মধ্যে কোনরূপ মৌলিক পার্থক্য খুঁজে পাননি পন্ডিত বলদেব উপধ্যায়ের মতে পিন্ডব্রহমান্ডবাদকে মূলরূপে গ্রহন পূর্বক তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায় কালচক্রপানের ন্যায় নবীন যান প্রবর্তন করেছিলেন তবে সম্প্রদায় রূপে এর পৃথক সত্তা স্বীকার করার বিষয়টি বিবাদাস্পদ হয়ে রয়েছে

 

সহজযানের নামকরণ এবং তার স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকারের প্রশ্নটি অত্যন্ত বিবাদ পূর্ণ বিষয় মন্ত্রযান অথবা মন্ত্রমার্গের অবান্তর বিষয়গুলিকে পর্যালোচনা করে পন্ডিত গোপীনাথ কবিরাজ বজ্রযান, কালচক্রযান তথা সহজযানকে ক্রমশঃ মন্ত্রমার্গ হতে আবিভূত বলেছেন তার মতে এদের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও বহুক্ষেত্রেই সাদৃশ্য রয়েছে বস্তুতঃ সকলই মন্ত্রমার্গের প্রকার ভেদ তবে বাস্তবিক অর্থেই কোন মতাদর্শগত পার্থক্য নেই মনে হয়, একই সাধনধারা বিভক্ত হয়ে ভাবকে গৌণ এবং প্রধান ভাব হতে বিভিন্ন রূপে ব্যাপ্ত হয়েছে ...মন্ত্রনয়এর তিন ধারা পরস্পর একত্রীভূত হয়েছে বস্তুতঃ এই হল বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্ম বা বৌদ্ধতন্ত্র . বলদেব উপাধ্যায় সহজযানকে বজ্রযানের আরও একটি নাম বলেছেন সহজযানকে সেই তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের পরবর্তী শাখা রূপে দৃষ্ট হয়; কিন্তু এইরূপ কালচক্রযান, সহজযান ইত্যাদি রূপে বিভাজনকে তিনি দোষপূর্ণ বলেছেন কারণ উভয় যানই বজ্রযানের অন্তর্গত বলেই মনে হয়

 

. দাশগুপ্তসহজযানশব্দটিকে ২টি কারণে বিশিষ্ট রূপে স্বীকার করেছেন আত্মা(?) পরম সহজা প্রকৃতির সাক্ষাৎকারকে লক্ষ্যরূপে স্বীকার করার কারণ তথা ধর্ম বা পদার্থের সহজ প্রকৃতির জ্ঞানকে লক্ষ্য রূপে স্বীকার করার কারণে সহজযান নামটি স্বার্থকতা লাভ করেছে অপর অর্থে, মনুষ্যের সহজ প্রকৃতির প্রতি অনাবশ্যক চাপ প্রদানের স্থানে এই মার্গ বা যান ব্যক্তিকে পরম সত্যের সর্বাধিক স্বাভাবিক মার্গ দ্বারা সাক্ষাৎকার করার অবসর প্রদান করে এটি সেই মার্গের প্রতি অণুসরণ করার ছাড় প্রদান করে যেখানে মানব প্রকৃতি তাকে নিয়ে যায় . দাশগুপ্ত সম্পুটিকা হতে উদাহরণ প্রদান পূর্বক এইটি স্পষ্ট করেছেন যে মন্মথ তো প্রত্যুৎপন্ন হয় এবং তা স্বভাবেরই অঙ্গ মানব স্বভাব তো দুরতিক্রম হয়

অসৌহি ভগবান্ যোগঃ স্থির-শাশ্বত পরমঃ মন্মথতঃ প্রত্যুৎপন্নঃ (সদা চৈব) স্বভাবো দুরতিক্রমঃ।।” -অদ্ধয়সিদ্ধি, তৃতীয় পটল, পৃঃ ৫৭

 

সহজ অথবা বোধিচিত্তের সক্ষাৎকার অথবা তার উপলব্দি যদি একবার সম্পূর্ণ হয়, তাহলে সকল বিষয়ের উপলব্দি হয়ে যায় তাহলে মন্ত্রতন্ত্র, হোম, মন্ডল তথা মন্ডল ক্রিয়ার কোনরূপ প্রয়োজনই থাকে না মহাসুখ রূপে সহজ অথবা বোধিচিত্ত, মন্ত্র, তপ ইত্যাদি একত্রীভূত হয়ে যায় এরদ্বারা স্পষ্টতর হয় যে . দাসগুপ্ত সহজমানকে বজ্রযানের অন্তর্গত একই অম্নায় রূপে মান্যতা প্রদান করেছেন সেখানে চরমাবস্থা প্রাপ্ত করলে বাহ্যাচারের কোন প্রয়োজনীয়তা থাকে না

. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য তান্ত্রিক বীদ্ধ সাহিত্যের বিভাজন পরবর্তী বৌদ্ধ মত বজ্রযান, সহজযান এবং কালচক্রযানের নামানুসারেই স্বীকার করেছেন যদিও তিনি তন্ত্রযান, মন্ত্রযান এবং ভদ্রযান ইত্যাদি কিছু লঘুযানের চর্চাও করেছেন, যা উদয় বজ্রযান হতে উদভূত হয়েছে সহজিয়া সিদ্বান্ত বজ্রযানের একটি শাখা কিন্তু সহজযানের কোন পৃথক সাহিত্য নেই এবং পদও দোহাকে সহজিয়া কবি তাদের প্রামান্য গ্রন্থরূপে স্বীকার করেছেন সহজিয়ার প্রবর্তক নিজেদের সম্পূর্ণ আগ্রহ জীবন এবং ধর্মের আড়ম্বর ঔপচারিকতার বিরোধ ব্যক্ত করেছেন সত্যের উপলব্দি না তো কখনও তথ, কৃচ্ছসাধন ইত্যাদি দ্বারা হতে পারে আর না তো পাঠ, দর্শন, ব্রত, স্নান, মূর্তি-পূজা অথবা বজ্রযানে প্রতিপাদিত কর্মকান্ড দ্বারা হতে পারে এর স্বয়ংবেদন সর্বথা পরম্পরাবিরুদ্ধ পদ্ধতি দ্বারা তত্ত্বদীক্ষা তথা যোগাভ্যাস দ্বারাই হতে পারে এই বৈশিষ্ট্য দ্বারা সহজিয়া মতের পৃথক সত্তা সামান্যতয়া বজ্রযানী হতে স্পষ্ট ভাসিত হয় এই সহজকায় হল সেই চতুর্থকায় যা ধর্মকায়এর উর্দ্ধে স্থিত এই যান বজ্রযানে প্রচলিত মহাযানী বোধিচিত্তের সংস্কার করেছে এবং এইরূপ মহাসুখ নির্বাণে অভিন্নতা স্থাপন করেছে মহাযানী বোধি চিত্তোৎপাদের ধারণাকে সহজযানী যৌনযৌগিক সাধনা দ্বারা উৎপন্ন সঘন আনন্দের ব্যবস্থাতে রূপান্তর হয়ে গেছে বজ্রযানে বোধিচিত্তকে কখনও কখনও শক্রের পর্যায় রূপে ব্যক্ত করা হয়েছে কিন্তু সহজযানে সর্বদা এর ব্যবহার শুক্র রূপেই হয়েছে এই তথ্যের পপতি ভিত্তি করে . শশীভূষণ দাশগুপ্ত সহজযানের পৃথকতা প্রতিপাদিত করেছেন মন্ত্রজানো তপো হোমো মন্ডলেয়ম্ মন্ডলং মন্ত্রজানঃ তমঃ হোমঃ মন্ডলেয়ম্ তন্মন্ডলং ।।” -হেবজ্রতন্ত্র, পৃঃ ৫৩

 

বজ্রযানের কর্মকান্ড প্রধাণতা তথা বাহ্যাভমবরএর প্রচুরতা সময়সাধ্য এবং বিশিষ্টজনসাধ্য ছিল তার প্রতিক্রিয়াতে এই সহজ পদ্ধতি বিশেষ একটি পৃথক যান রূপে বিকশিত হয়েছিল মহাপন্ডিত রাহুলসাংকৃত্যায়ন যদিও বজ্রযান এবং সহজযানের স্পষ্ট ভেদ তত্ত্বের বিষয়ে কিছুই বলেননি তবুও প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বলা যায় যে সরহ (সরহপাদ) দ্বারা প্রবর্তিত (সহজ-) যান বজ্রযানীদের নিজেদের প্রতি আকর্ষিত করতে সচেষ্ট হয়েছিল মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে লুইপাদ ৯তম শতাব্দী সহজপাদ মত প্রচার করেছিলেন এবং -১৩ শতাব্দী পর্যন্ত এই অত্যাধিক বিকশিত হয়েছিল . উইন্টরনিৎসএর মতানুসারেলক্ষমীঙ্করাঅদ্বয়সিদ্ধি নামক গ্রন্থ হতে নবীন অদ্বৈতবাদী মত সহজযানের প্রবর্তন করেছিলেন, যা আজও বঙ্গদেশে বাউল সম্প্রদায়এর মধ্যে জীবিত রয়েছে লক্মীঙকা সিদ্ধাচার্য ইন্দ্রভূতির ভগিনী ছিলেন তিনি সন্ন্যাস, ধর্মীয় শিষ্টাচার, মূর্ত্তিপূজা ইত্যাদির পরিবর্তে সকল দেবতার আশ্রয় একমাত্র শরীরের প্রতি বল (ধ্যান) প্রদান করতে বলেছিলেন লক্ষমীঙ্করা নারীর প্রতি ঘূণাভাব কে নিন্দা করেছেন, কারণ তাঁর মতে সকল নারীর হল প্রজ্ঞার অবতার . ভট্টাচার্য লক্ষমীঙকরা সময় ৮ম শতাব্দী পূর্বাদ্ধ বলেছেন কষ্ট কল্পনাং কুর্যাত্ নোপবাসী ক্রিয়াম্ স্নানং শৌচং চৈবাত্র গ্রামধর্মবিবর্জনম্।। চাপি গাম্যগম্য-বিকল্প তু ভক্ষ্যাভক্ষ্যং তথৈব ...সর্ববর্ণসমুদ্ভুতা জুগুপ্সা নৈব ঘোষিতঃ সৈব ভগবতী প্রজ্ঞা সমবৃত্যা রূপমাশ্রিতা”  -অদ্বয়সিদ্বি, পৃঃ ১৭, শ্লোক ১৪

 

. ভট্টাচার্য লক্ষমীঙকরা কে অদ্বয়সিদ্বি রচয়িতা এবং সহজিয়া মতের প্রবর্তিকা বলে মনে করেছেন কিন্তু অদ্বায়সিদ্ধি যে রূপ এইসময় প্রাপ্ত হয় তাতে কোথাও সহজ শব্দের প্রয়োগ দৃষ্ট হয় না কিন্তু উক্ত গ্রন্থ হতে এই তথ্য পাওয়া যায় যে প্রাণযোগ অথবা বায়ুযোগএর প্রয়োগের দ্বারা ক্রমশঃ অন্তস্সাধনাতে অগ্রসর হয়ে সাধক স্বাধিষ্ঠানক্রমএর সাধন পূর্বক অন্ততঃ মুগনাদক্রম পর্যন্ত উন্নীত হন

 

বঙ্গদেশে সহজিয়া সম্প্রদায়এর উদয় এবং বিকাশকে অনুসন্ধান পূর্বক বিদ্বানগন সহজজানকে ব্যাখ্যা করেছেন এক্ষেত্রে বজ্রযানের অন্তিম বিকাশ হল সহজযান এবং যেখানে রাগ অথবা প্রিতিকে বিশষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বজ্রযান এবং সহজযানের ভেদক তত্ত্বকে তথা সহজযানের বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান পূর্বক এই বিষয়টি স্পষ্টতর করেছেন যে এই যান পদ্ম এবং বজ্রের পরস্পর সংযোগ হতে উদিত হওয়া সহজানন্দের প্রতি বিশ্বাস করে এই যান ঈশ্বরাদি অস্তিত্বকে স্বীকার করেনি কিন্তু তান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য (তন্ত্রযান) তথা ডাকার্ণবতন্ত্রে বর্ণিত নাড়ী, চক্র, যোগিনী ইত্যাদিকে স্বীকার অর্থাৎ গ্রহন করেছে আধ্যাত্মিক যাত্রার সফলতার প্রশ্নে গুরতত্ত্বকেও স্বীকার করা হয়েছে এক্ষেত্রে প্রমাণ রূপেহেবজ্রতন্ত্রঅনুসারে (পৃঃ ১০) বলা যায় – “তস্মাত্ সহজং জগৎসর্ব সহজং স্বরূপমুচ্যতে স্বরূপমেব নির্বানং বিশুদ্ধকার চেতসাঃ (?)।।তথা স্বভাবং সহজং ইত্যুক্তং সর্বকারিক সংবরম্ এবং দেহস্থোহপি দেহজঃ

 

মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নএর মতানুসারে বৌদ্ধ তান্ত্রিক আচার্য পরম্পরা এই রূপ হতে পারে যেমন

. জালন্ধরিপাদ বা জালন্ধরপাদমৎসয়েন্দ্র (মৎসেন্দ্র), গোরক্ষ (?) আচার্য কমকল, গোপীচন্দ্র, ময়নামতী, ভর্তৃহরি, জ্ঞানগুপ্ত, বিভূতিচন্দ্র, ভগবতী লক্ষমীঙকরা, ইন্দ্রভূতি, কচ্পাদ, ধর্মপাল

. কৃষ্ঞপাদগোবিন্দপাদ, জালন্ধরপাদ, গোপীচন্দ্র, দেবপাল, তান্তিপা, ইন্দ্রভূতি, গোরক্ষনাথ (?)

. শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে জালন্ধরপাদ পালশাসক ধর্মপালের সমকালীন ছিলেন তিনি স্বয়ং কৃষ্ঞপাদকে উপদেশ প্রদান কালে নিজের দেশের শাসকের নাম ধর্মপাল বলেছিলেন ধর্মপালের রাজ্যারোহন ৭৭০ খ্রীঃ হয়েছিল এবং তিনি প্রায় ৮১০ খ্রীঃ পর্যন্ত শাসনকার্য করেছিলেন বৌদ্ধধর্ম, সাহিত্য এবং তর্কশাস্ত্রতে ধর্মকীর্তি নামক বৌদ্ধচার্যের সন্ধান পাওয়া যায় এক ধর্মকীর্তি ন্যায়বিন্দু রচয়িতা (প্রায় ৬৩৫ খ্রীঃ) এবং সৌত্রান্তিক দার্শনিক ছিলেন . সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত হিস্ট্রি অফ্ ইন্ডিয়ান ফিলোসফিগ্রন্থে এই দার্শনিক সময়কাল ৬৫০ খ্রীঃ বলেছেন আচার্য নরেন্দ্র দেবএর মতে ধর্মকীর্তি সময় ৬৫০-৭০০ খ্রীঃ পর্যন্ত বলেছেন

 

অপর একজন তান্ত্রিক টীকাকার ধর্মকীর্তি উল্লেখ পাওয়া যায় এবং এর সময়কাল ৯তম শতাব্দী ছিল রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রথম ধর্মকীর্তি সময়কাল ৬তম শতাব্দী বলেছেন কিন্তু দ্বিতীয় ধর্মকীর্তি সম্পর্কে কোনোরূপ আলোচনা তিনি করেননি তান্ত্রিক ধর্মকীর্তি হেবজ্রতন্ত্র টীকা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তিনি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশএর সময়কালীন ছিলেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানএর সময়কাল প্রায় ১০ম শতাব্দী বলা হয় . বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে সরহপাদ ধর্মকীর্তি (৬০০-৬৫০ খ্রীঃ) সময়কালীন ছিলেন সিদ্ধাচার্য কমবলাম্বরপাদ, কমবল বা কমরিপা ঘন্টাপাদের শিষ্য ছিলেন ঘন্টাপা দেবপালের (৮০৯-৮৪৯ খ্রীঃ) সময়কালীন ছিলেন এই অর্থে কমবলামবপাদ দেবপালের কণিষ্ঠ সমকালীন এবং জালন্ধরের চতুর্থ সমকালীন ছিলেন ইন্দ্রভূতি ভগবতী লক্ষমীঙ্করা ইন্দ্রভূতি ভগিণী ছিলেন লামা তারানাথ (তারানাথ) ইন্দ্রভূতি নামক - জন সিদ্ধাচার্যের উল্লেখ করেছেন এদের মধ্যে এক ইন্দ্রভূতি উদ্যান (উড্ডিয়ান) এর রাজা ছিলেন এবং মহাপদ্মবজ্রের গুরু ছিলেন অপর ইন্দ্রভূতি সরোহ এবঢ কমবলের শিষ্য ছিলেন যাই হোক, আমরা উপরিউক্ত তথ্যের প্রতি ভিত্তি করে কালনির্নয়ের বিষয়টিকে এইভাবে প্রস্তুত করলাম

ধর্মপাল : ৭০০-৮১০ খ্রীঃ (৮ম শতকের শেষ এবং শতকের সূচনা)

ধর্মকীর্তি (দার্শনিক) : ৭ম শতাব্দী (খ্রীঃ)

ধর্মকীর্তি (তান্ত্রিক সিদ্ধাচার্য) : শতাব্দী

কমবলাম্বরপাদ : শতাব্দী

দেবপাল : শতাব্দী

ইন্দ্রভূতি এবং

লক্ষমীঙ্করা : শতাব্দী

. হাজারীপ্রসাদ মহাশয় সিদ্ধাচার্যদের গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে এইভাবে একত্রিত করেছেন যেমন-

. জালন্ধরপাদকৃষ্ঞপাদ, বুদ্ধজ্ঞানপাদ, ভর্তৃহরি, কনিষ্ট বিরুপ, গোপীচন্দ্র, তান্তিয়া, মৎস্যেন্দ্র

. ঘন্টাপাদকূর্মপাদ, জালন্ধরপাদ

. আদিনাথজালন্ধরপাদ, মৎস্যেন্দ্রনাথ

. আচার্য কমবলজালন্ধরপাদ

. ইন্দ্রভূতিকৃষ্ঞপাদ

এই সূচনার প্রতি ভিত্তি করে জালন্ধরপাদের গুরু তথা আচার্যের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন-

. আচার্য কমবল - > জালন্ধরপাদ

. আদিনাথ -> জালন্ধরপাদ

. ঘন্টাপাদ -> কুর্মপাদ -> জালন্ধরপাদ

এর মধ্যে প্রথম এবং তৃতীয়টি তিব্বতী বৌদ্ধ পরম্পরা হতে প্রাপ্ত অর্থাৎ জালন্ধরপাদের ২টি গুরু ছিলেনআচার্য কমবল এবং কূর্মপাদ এই অর্থে কৃষ্ঞপাদের গুরু জালন্ধরপাদ ইন্দ্রভূতি . বিনয়তোষ ভট্টাচার্য টি তিব্বতী স্রোত হতে ২টি পরম্পরার উল্লেখ করেছেন

. পদ্ম বজ্র -> অনঙ্গবজ্র -> ইন্দ্রভূতি -> ভগবতী পক্ষমীঙ্করা -> লীলাবজ্র -> দারিকাপা -> সহজযোগিনী চিন্তা -> ভোমবী হেরুক

(থৈগ-সাম-জান-জৈন নামক তিব্বতী বৌদ্ধ গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত রচনা কাল ১৯৪৭ খ্রীঃ)

. সরহ- নাগার্জুনশবরীপালুইপাবজ্রঘন্টাপাকচ্ছপাজালন্ধরীপাকৃষ্ঞাপাদগুহ্যপাবিজয়াথাতৈলোচপানারেপা (কাজী দবাসম্ দুপ দ্বারা লিখিতচক্রসংবরতন্ত্র ভূমিকাতে উল্লিখিত পরম্পরা)

 

এই তথ্য অনুসারে (তিব্বতী পরম্পরা) জালন্ধরীপা (জালন্ধরপাদ)’ তিনজন ভিন্ন-ভিন্ন গুরুর নাম পাওয়া যায়লুইপা, বজ্রঘন্টাপা এবং কচ্ছপা আবার কিছু অন্য তিব্বতী ধারা অনুসারে জালন্ধরপাদএর তিন মুখ্য আচার্য ছিলেনকথবলামবরপাদ, কুর্মপাদ এবং কচ্ছপা

মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন-স্ব্য-ব্কং-বুম্‌’ (১০৯২-১২৭৯ খ্রীঃ) নামক তিব্বতী গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে নিম্নলিখিত ভাবে প্রস্তুত করেছেন

. সরহ

নাগার্জুন শবরপা

কর্ণরীপা পঙ্কজপা নাগবোধিপা

উধালপা

      জোগীপা লুইপা সর্বভক্ষপা

      দারিকাপা ভোম্বীপা ভেঙ্গিপা

. জালন্ধরীপা

কন্হপা অন্তিপা মীনাপা মৎস্যেন্ত্র

কনখলাপা মহীপা ভদ্রপা কন্থালীপা মেখলাপা ধর্মপা

বীনাপা

       গৌরক্ষপা চৌরঙ্গীপা

. খঙ্গমা

চর্পটীপা----

  মীন পা(?)

. তিলোপানারোপা

. মণিভদ্রা

কুকরীপা

 মীনপা

. কর্মারিপা

অবধূতিপা

 চেলুকপা

. থনগপাশান্তিকুদ্দর্লিপা

. লীলাপাগুন্ডরীপা

. ভুসুকুপাসর্বভক্ষপা

১০. অনঙ্গবজ্র

  ইন্দ্রভূতি

 কমবলপা

 

এইভাবে রাহুল সাংকৃত্যায়ন দ্বারা ১০ স্বন্তন্ত্র সিদ্ধাচার্যের বংশপরম্পরার তথ্য পাওয়া যায় তবে এদের মূল অর্থাৎ আদি গুরু সম্পর্কিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না ফলে রাহুল সাংকৃত্যায়নের তথ্য হতে জালন্ধরীপা গুরু পরম্পরার কোন সঠিক তথ্য উদ্ভূত হয় না যদি পূর্বোল্লিখিত বংশ পরম্পরা এবং এই বংশ পরম্পতার সংযোজন করা যায় যেতে পারে

সরহনাগার্জুনশবরীপাবজ্রঘন্টাপাকচ্ছপা ->

জালন্ধরীপা

কন্থপা তান্তিপা মীনপা মৎস্যেন্দ্র

গুহ্যপা কনখলাপা মহীপা ভদ্রপা কন্থলীপ মেখলাপা ধর্মপা

        গোরক্ষাপা চৌরঙ্গীপা

বিজয়পা বীনাপা

তৈলোপা

নারোপা

 

বৌদ্ধ মূর্ত্তি শাস্ত্রের ভিত্তি মূলতঃ তান্ত্রিক বৌদ্ধ গ্রন্থের উপর প্রতিষ্ঠিত তান্ত্রিক বৌদ্ধ গ্রন্থ সমূহের মধ্ষে সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্যনীয় হল সাধনমালা, গুহ্যসমাজ তন্ত্র, অদ্বয় বজ্রসংগ্রহ, তত্ত্বসংগ্রহ এবং নিষ্পন্নযোগাবলী সাধনমালায় ৩১২ টি সাধনার অগনিত দেবদেবীর বর্ণনা, মূর্ত্তির ধ্যান, পূজা পদ্ধতি, মন্ত্র এবং মন্ত্রপ্রয়োগাদি বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে এই গ্রন্থটি . বিনয়তোষ ভট্টাচার্য দ্বারা গায়কোয়াড়্ ওরিয়েন্টাল সিরিজ (বরোদা, গুজরাত) হতে খন্ডে প্রকাশিত হয়েছিল বর্তমানে এই মূল্যবান পুস্তক দ্বয় নিঃশষেইত এবং দুষ্প্রাপ্যও বটে নিষ্পন্নযোগাবলী বৌদ্ধ তন্ত্রের আরও একটি মূল্যবান গ্রন্থ পুস্তকটি প্রনয়ণ করেছিলেন বাঙালি বৌদ্ধপন্ডিত অভয়াকর গুপ্ত (১১৩০ খ্রীঃ) এই গ্রন্থে প্রায় ৬শত দেবদেবীর বিবরণ এবং সাধন পদ্ধতি বর্নিত হয়েছে এই গ্রন্থটিও বর্তমান দুষ্প্রাপ্য

 

তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মূল দেবতা আদিবুদ্ধ আদি বুদ্ধ মূল অর্থে শূন্যতার রূপকল্পনা আদি বুদ্ধ হতে পঞ্চধ্যানী বুদ্ধের উদ্ভব পঞ্চধ্যানী বুদ্ধ ৫টি সকন্ধের অধিষ্ঠাতা আদি বুদ্ধ যখন দেবতাকারে কল্পিত হন, তখন তাঁর নাম হয় বজ্রধর বজ্রধরের মূর্ত্তি আবার দুই প্রকারে কল্পিত হয়ে থাকেএকটি একক মূর্ত্তি এবং অপরটি যুগবদ্ধ মূর্ত্তি ধ্যানী বুদ্ধ ৫টবৈরোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, অপোঘসিদ্ধিও অক্ষোভ্য কখনও কখনও আবার ষষ্ঠ ধ্যানী বুদ্ধের মূর্ত্তির বিবরণও প্রদত্ত হয় এই ধ্যানী বুদ্ধের নাম বজ্রসত্ত্ব বজ্রসত্ত্ব বিগ্রহ আবার প্রকারের হয়একক এবং যুগনাদ্দ

 

প্রত্যেক ধ্যানী বুদ্ধের এক-একটি করে বিভিন্ন শক্তি কল্পিত হয়েছে এদের পূর্ণ বিবরণ সর্বপ্রথম গুহ্যসমাজতন্ত্রে দেখতে পাওয়া যায় সেখানে তাদের নাম বিভিন্ন প্রকারের যেমন- “স্ববিম্বানি স্ত্রীবিম্বান্যভিনির্মায় গভবতো বৈরোচনস্য কায়দ ভিনিষ্ক্রান্তা অভূবন্ তত্র কেচিত্ বুদ্ধলোচনাকারেন কেচিত্ মামক্যাকারেন কেচিৎমান্ডরবাসন্যকারেন, কেচিত্ সময়তারাকারেন সংস্থিতা অভূবন্” -গুহ্যসমাজতন্ত্রম্‌, পৃঃ

 

এখানে কলেবর বৃদ্ধির কারণে বৌদ্ধতন্ত্রের বিষয় তথা তান্ত্রিক দেবদেবীর বিষয়টি অতিসংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা হল সর্বোপরি গুহ্যসমাজতন্ত্রে বর্ণিতসর্বতথাগতসমাধিমন্ডলাধিষ্ঠাননামক প্রথম পটলের মন্দলটি ব্যক্ত করা হল

বিঘ্নাত্মক

অমোঘসিদ্ধি

প্রজ্ঞান্তক

“...তে সর্বতথাগতাস্তে বোধিসত্ত্বা মহাসত্ত্বা স্বকায়বাক্চিত্তবজ্রেষু বিহরন্তং কায়বাক্চিত্তবজ্রস্য কায়বাক্চিত্তং স্বকায়বাক্চিত্তেনালমব্য তূষ্ঞীমভূবন্ ।।

 

 

সহায়ক গ্রন্থসূচী :-

. গুহ্যসমাজতন্ত্র, সম্পাদনা. এস. বাক্চী, মিথিলা বিদ্যাপীঠ, দ্বারভাঙ্গা, বিহার, ১৯৬৫

. সাধনমালা, . বিনয়তোষ ভট্টাচার্য, খন্ড-০১, বরোদা, গুজরাত (গায়কোয়াড ওরিয়েন্টাল সিরিজ), ১৯২৫

. অদ্বয়বজ্রসংগ্রহ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, গায়কোয়াড ওরিয়েন্টাল সিরিজ, বরোদা, গুজরাত, ১৯২৭

. অদ্বয়সিদ্ধি, স্বামী দ্বারিকাদাস শাস্ত্রী, বৌদ্ধ ভারতী, বেনারস, ১৯৮১

. সদ্ধর্মপুন্ডরীক্, . রামমোহন দাস, বিহার রাষ্ট্রভাষা পরিষদ, পাটনা, ২০০০

. সেকোদ্দেশ টীকা, এম. . কেরেল্লী, গায়কোয়াড ওরিয়েন্টাল সিরিজ, বরোদা, গজরাত, ১৯৪২

. বৌদ্ধ দর্শন মীমাংসা, . বলদেব উপাধ্যায়, হিন্দি সাহিত্য সম্মেলন, প্রয়াগ, ১৯৯০

. দীক্ষাপ্রকরণম্‌, . গোপীনাথ কবিরাজ, বৌদ্ধ ভারতী, বেনারস, ১৯৯৮ (কালচক্রতন্ত্রের খন্ডিত অংশ)*

. হেবজ্রতন্ত্র, কাশীনাথ নৌপান্যে, ইন্ডিয়ান মাইন্ড, নিউ দিল্লী, ২০২০

১০. তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধনা সাহিত্য, . নাগেন্দ্রনাথ উপাধ্যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী, বেনারস, ১৯৮৭

১১. ভারতীয় সংস্কৃতি সাধনা, . গোপীনাথ কবিরাজ, বিহার রাষ্ট্রভাষা পরিষদ, পাটনা, ১৯৯০

১২. মহাযানসূত্রালঙ্কার, স্বামী দ্বারিকাদাস শাস্ত্রী, বৌদ্ধ ভারতী, বেনারস, ১৯৯০