Friday, August 25, 2023

Book Review

Book Review


Book: Understanding Early Bihar Archaeology, History and Culture.

Author: Rajiva Kumar Sinha.

Publisher: 

Year: 2022

Page:

Language: English

Price:

 

The author mentions his purpose of writing the book in the following words," The book is an attempt towards understanding issues related to archaeology, history and culture of early Bihar by adopting a multidisciplinary approach." This book is divided into 14 chapters namely 1. Preliminaries 2. Theoretical postulates on Cultural Change 3. Early Farming Cultures and Urban Beginnings in Ancient Bihar 4. From Exchange Network to Developed Trade Routes 5. Archaeology, Ecology and Social Formations in Early Bihar 6. Migration, Settlements and Gender Issues in Early Bihar 7. Early Cultures of North Bihar Ganga Plain 8. Emergence of States in Bihar 9. The Making of the Mauryan Empire 10. Historiographical Dimension of Oral Tradition 11. Mother Goddess Worship in Early Bihar 12. Folk- Art and the Study of Past Cultures 13. Towards Understanding Nalanda Mahavihara 14. Ego.

The aim of the author in this book is not merely to present its subject matter before his reader in a separate form but also to examine and discover its connection with the larger history of India. In this way the author establishes it beyond doubt that local or regional history of a particular area is not separate from the comprehensive history of the nation as a whole. By describing frontiers of Bihar the author very aptly remarks," The above geographical description clearly suggests that in no way Bihar could be separated from the rest of India by physical or cultural barriers."

In the second chapter the author underlines the transition from hunting gathering to food production in South Bihar plains. He says the tribes of this area takes the meat of wild animals found in this area for food and it is supplemented by fishing. Some tribes practice shifting cultivation They grow mainly maize, millet, bean, arhar, and sutri. They sow seeds in summer and harvest the crops in winter. 

In the third chapter of the book the author discusses the topic of urbanization of ancient Bihar. During the 3rd millennium B.C.E we see the emergence of full-fledged agricultural and pre- metallic villages in the river banks of Bihar.  

In Chapter 4 of the book the author tells us that the ancient Anga Magadha region in the. south Bihar Ganga plains was the place where archaeological research began as early as the second half of the eighteenth century which started with the identification of Pataliputra. This success was followed by further research which resulted in the discovery of enormous materials. 

In chapter5 the author says that it is believed that the climatic condition of Bihar has remained unchanged over the last 11000 years or so. The heavy rainfall of 1000 to 1600 mm has resulted in the growth of thick vegetation. Various social groups came there in three stages and a new society emerged. 

In Chapter 6 the author discusses about the Aryan migration in middle Ganga valley. In Chapter 7 we find a discussion on the early cultures of north Bihar Ganga plain from an archaeological perspective. In this chapter a description of the landscape is presented by the author. The area is rich in early alluvial deposit accumulated by the rivers like Ghagra or Sarayu, Gandak and Buri Gandak, Kamala, Baghmati, and Koshi. 

Chapter 8 of the books surveys the emergence of states in early Bihar. Till date many theories regarding this matter have formed and many theories have been discarded. In Bihar we find that two factors of state formation and social stratification are blended. Chapter 9  of the book deals with the emergence of Mauryan empire in Bihar. Agriculture was the key factor in the origin of Maurya empire. The Mauryan emperors very sincerely tried for the development of agriculture. However, the transformation from non-state to Magadha empire was very curious. 

Chapter 10 of the book presents a case study of the coastal trade of ancient Champa with South East Asia and Sri Lanka. From folklores of Bhagalpur region, we find an idea about this trade. These folklores and songs were in angika language which is the local dialect of Bhagalpur. The word angika may have evolved from ''anga' or part if the body.

Chapter 11 of the book discusses mother goddess worship in early Bihar from the perspective of Bihar. This topic has posed great difficulty among scholars because of its ubiquitous nature. In India the worship of mother goddess is rooted deep into the religious and cultural beliefs of the country. Mother earth is supposed to be the guardian of the dead and she is connected both with the corpse and the core beneath the earth. It was also believed that the Neolithic god is not the life producing mother, she was also like a woman who can be influenced by requests and spells.

Chapter 12 of the book discusses about the Manjusa art of the ancient Anga Janapada. In recent years historians are trying to identify the manifestations of art in terms of social backgrounds and functions. Material remains of art objects are not silent. They always tell us something and we should try to understand them. In its earliest form Manjusha was a simple decorated open basket of offering to the goddess Bishahari who was the foster daughter of Shiva and was known as Jhapoli. 

In Chapter 13 of the book the author writes about the university of Nalanda. From archaeological evidence the scholars have come to the conclusion that the mahavihara existed between the fifth and twelfth century of the common era. In Chapter 14 of the book the author says that  in the book he has made an attempt to understand the archaeology, history and culture of early Bihar by adopting a multidisciplinary approach for the benefit of students and scholars in perspectivation early Bihar.

In short, the book 'Understanding Early Bihar' is very interesting and it gives valuable information about the subject. The style of the author is very engaging and it captivates the reader's heart. So it can be said without any doubt that the author is successful in his aim which is"... to examine issues related to them (the archaeology, history, and culture of early Bihar) and place them in the wider context of mainstream national history."

Sumanapal Bhikkhu

Editor: Nalanda, Guest lecturer, Department of Pali  University of Calcutta.

 

 

Thursday, August 17, 2023

বুদ্ধ দর্শন এবং রবীন্দ্র দর্শন

সুমনপাল ভিক্ষু


বুদ্ধ দর্শন এবং রবীন্দ্র দর্শন দুটি দর্শনই সমুদ্র গভীরে তত্ত্বে ভাস্কর।  ব্যক্তিসত্তায়, জীবনমুখী অভিজ্ঞতায়     এবং  জীবনদর্শনে উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য যেমন আছে, বৈশাদৃশ্য তেমনি অপ্রচুর নয়। দুজনেরই জন্ম বৈশাখ মাসে। দুজনেই ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। দুইজনেই সপুত্রক পিতা। দুজনেই মহামানব কিন্তু দুজনেরই জন্মের কালের বিস্তর ব্যবধান। সাধন ধর্মের বিশিষ্টতায় বৌদ্ধ দর্শন ব্যঞ্জিতপক্ষান্তরে জীবন ধর্মের নিকষ উপলব্ধিতে রবীন্দ্র দর্শন আলোকিত। মহাজাগতিক কাল চেতনার প্রজ্ঞাময় আবেগের  অনুভব এবং নান্দনিকতার উৎসব রবীন্দ্র জীবন সাধনাকে বাস্তবিকই মনোময় করে তুলেছে।  অপরপক্ষে রৌদ্রদগ্ধ তপস্যার আড়ালে মাধুরী মঞ্জুরীর গুঞ্জনধ্বনি এবং স্মৃতিজাগানিয়া দীর্ঘশ্বাস যেন  বিস্ময়করভাবে অশ্রুত বৌদ্ধদর্শনে।  বুদ্ধদেব এবং রবীন্দ্রনাথ দুজনেই লোকান্তর প্রজার অধিকারী। দুই দর্শনে  আছে জীবনধর্মের গাঢ়  উপলব্ধিতে অবগাহ বিস্তার।  অন্তর্গুঢ় উপলব্ধির বিস্মরণহীন চিরায়মানতা  যেন দুই দর্শনকেই গভীর দার্শনিকতা নন্দিত করেছে।  সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারকা সমন্বিত সুন্দর ধরনীতে জন্মগ্রহণ করে দুজনেই যেন নিখিল বিশ্বের অন্তলীন সম্পর্কের ইতিহাস উন্মোচন করতে চেয়েছেন।  রবীন্দ্রনাথ মূলতঃ  কবি।  আবার সংগীতের রচয়িতা হিসেবে জীবন ধর্মের গাঢ় উপলব্ধইতে  তিনি যেভাবে প্রতিভাত, বুদ্ধদেবের জীবনে সে পরিচয় মেলে না।  রবীন্দ্রনাথ গৌতম বুদ্ধ কে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ বলে শ্রদ্ধা  জানিয়েছেনকিন্তু বৌদ্ধ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে স্বীকার করেননি।  বুদ্ধদেব সংসার ত্যাগ করে আলাড়   কালাম এবং রামপুত্র উদ্দক নামে দুজন গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সংসার ত্যাগ করেননি। রবীন্দ্রনাথ বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীত্য সমুৎপাদ, যোগাচার, মহাযান, সহজযানকালচক্রযান, মন্ত্রযান ,বোধিসত্ব ধারনা, নির্বাণ তথ্যমৈত্রীকরুণা, মুদিতা, উপেক্ষাব্রহ্মবিহার মহাশূন্য, জগত, চুরাশিচতুরার্যসত্য  মধ্যমপন্থা প্রভৃতি স্বরুপ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন।  বুদ্ধদেবের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম।  তার প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেছিলেনবৌধিদ্রু মত্তলে তব সেদিনের মহাজাগরণ  আবার সার্থক হোকমুক্ত হোক মোহ আবরণবিস্মৃতির  রাত্রি শেষে জগতে তোমারে স্মরণ নবপ্রাতে উঠুক কুসুমি”(“পরিশেষবুদ্ধের প্রতি)  

রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং নাটকে বৌদ্ব শ্রস্নগের উল্লেখ খুজে পাওয়া দুস্কর নয়। রবীন্দ্রনাথেরশ্রেষ্ঠভিক্ষা’, ‘পূজারিণী’,’পরিশোধ”,’অভিসার’, ‘মূল্যপ্রাপ্তি’, ‘সামান্য ক্ষতিপ্রভৃতি কবিতা এবং  রাজা, অচলায়তন, নটীর পূজা, চণ্ডালিকা, শ্যামাও  মালিনী প্রভৃতির নাটক নাটিকায় বৌদ্ধ প্রসঙ্গ আছে।  ‘মালিনীনাটকের উপাদান মহাবস্তু অবদান থেকে গৃহীত।  বুদ্ধদেবের প্রেম এবং করুণার বাণী মালিনীতেও রুপ লাভ করেছে।  বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ধর্মদর্শের  এর মূল পার্থক্য  নির্বাণ তত্ত্বে।  বুদ্ধদেব মুক্তির কথা বলেছেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সংসার থেকে মুক্তি চান নি। তিনি বলেছেন  “বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয় অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ  রবীন্দ্রনাথ প্রেমের বন্ধন এর কথা বলেছেন। প্রেমেই আছে পূর্ণতা।  বুদ্ধদেব বলেছেন জগত দুঃখময়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন জগত আনন্দময়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন দুঃখ-সুখের বিপরীত কিন্তু আনন্দের বিপরীত নয়। বরং  আনন্দের পরিপূরক।  বুদ্ধদেব বলেছিলেন মানুষ দৈবাধীন হীন  পদার্থ নয়।  রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানব ধর্মে বিশ্বাসী, মৈত্রী ধর্মের উপাসক আষাঢ়ী পূর্ণিমা বুদ্ধদেব ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথও  ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছিলেন। সুত্তুমিপাতে বুদ্ধদেব বলেছেন, “ সর্বে সত্তা সুখিতা হন্তু, অবেরা হন্তু, অব্যাগজঝা হন্তু, সুখী অত্তানাং পরিহরন্তু(সমস্ত প্রাণী সুখী হোক, শত্রুহীন হোক অহিংসিত হোক,   সুখী আত্মা হয়ে কালহরণ করুক ) বুদ্ধদেব যেখানে ত্রিতাপ দুঃখের হাত থেকে নিষ্কৃতি দানের কথা বলেছেনসেখানে রবীন্দ্রনাথ দুঃখের বীজকে  বিধ্বস্ত করে আনন্দময় চেতনাকে সঞ্জীবিত করে তোলার কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে  জীবনের মতই ভালোবেসেছেন।প্রভাত সঙ্গীতেতিনি বলেছেন  “জীবন   তোমার এত ভালবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয় মৃত্যুরে এমনই ভালবাসি নিশ্চয় বৌদ্ধ ধর্ম চীন, কোরিয়া, জাপান, দক্ষিণ-পূর্ব সিংহল, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তানে বিস্তার লাভ করে।  পক্ষান্তরে সারা বিশ্বজুড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবি খ্যাতি বিস্তৃত। দুঃখ মানব জীবনের অনিবার্য দুর্ভাগ্য।  জগতে দুঃখ অবশ্যম্ভাবী। রবীন্দ্রনাথের গানে  নানাভাবে এই দুঃখের প্রসঙ্গ এসেছে। যেমন )দুঃখ যে তোর নয় চিরন্তন (পূজা ৩১২),) আছে দুঃখ আছে মৃত্যু(পূজা ২৪৮)দুঃখের তিমিরে যদি(পূজা১৯৩), দুঃখের বেশে এসেছে বলে(পূজা ২৩৩) ) সহসা দারুন  দুঃখতাপে(পূজা ৫৭২) ) দুঃখ দিয়েছোদিয়েছো  ক্ষতি নাই(পূজা ২৩২) প্রভৃতি।   বুদ্ধদেব বলেছেনসব্বং অমিচ্চং/ “সব্বং দুখং/ “সব্বং অনন্তং(সমযুক্ত নিকায়,১৪) বুদ্ধদেব বলেছেন দুঃখ আসে তৃষ্ণা থেকে। তাই তৃষ্ণা' মূলে কুঠারাঘাত করতে হবে। বুদ্ধদেব ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জীবনের বৃহত্তম অংশে ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ গৌতম বুদ্ধের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বৌদ্ধ ধর্ম ভারতে প্রায় বিলুপ্ত হলেও বুদ্ধদেব কিন্তু হিন্দু অবতার বরিষ্ঠদের একজন তাঁর জীবন বাণী সর্ব যুগের আদর্শ হতে পারে সেই মহতী বাণী সমগ্রের সারমর্ম বিধৃত আছে চারটি শব্দের মধ্যে : মৈত্রী , করুণা, মুদিতা উপেক্ষা

প্রতিদিনের জীবন যাত্রায় এই চারটি গুণ অনুসৃত হলে মানুষ তার ক্ষুদ্র সত্তা অতিক্রম করে মহাত্ম্যা হবে , পুনর্জন্মের দুর্ভোগ ভুগতে হবে না ।ব্যাপারটা একটু বিশদ করি আমরা সাধারণ মানুষরা আলাদা আলাদা সংসার পেতে সুখের সন্ধানে মেতে উঠি এটা চাই , ওটা চাই - চাওয়ার শেষ নেই ! এই যে সর্বগ্রাসী অভিলাষ , এটাই সকল দু:খের মূল তাই বুদ্ধ বললেন ," কামনা উপেক্ষা কর হৃদয়ে সদা বহমান হোক মৈত্রী করুণা ধারা সকলকে আপন কর শুধু মানুষ নয় , মনুষ্যেতর প্রাণীকুলকেও আপন কর এই অবাধ সেবা ধর্মের আচরণের ফলে মানুষ মহামানব হবে যা দেবত্ব প্রাপ্তির চেয়েও বড ।সেই অবস্থায় এক অনির্বচনীয় প্রশান্তিতে তার মুখমণ্ডল শোভিত হবে এরই নাম মুদিতা এই অপার্থিব রূপই পরিলক্ষিত হয় বুদ্ধদেবের ধ্যানমূর্তিতে

এই মহামানবের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা ছড়িয়ে আছে তাঁর অসংখ্য কবিতা , নাটক প্রবন্ধে আমরা " কথা " কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কাহিনির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব আমাদের বক্তব্য পরিস্ফুট করার জন্য। "কথা " কাব্যের প্রথম কবিতা : শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা তাতে দেখা যাচ্ছে দামি বসন ভূষণ , সোনাদানা , মণি মাণিক্য- কোনটাকেই বুদ্ধ শিষ্য অনাথপিণ্ডদ শ্রেষ্ঠ দান বলে গ্রহণ করছেন না কিন্তু যে " দীন নারী " অরণ্য - আড়ালে রহি কোনমতে একমাত্র বাস নিল গাত্র হতে , বাহুটি বাড়ায়ে ফেলি দিল পথে , ভূতলে , " তখনই " ধন্য মাত : করি আশীর্বাদ " এই বলে সেই জীর্ণ বাসখানি মাথায় নিয়ে চললেন বুদ্ধের চরণে সমর্পণ করতে এই কবিতার বক্তব্য : অধিকাংশ মানুষের দানের মধ্যে কার্পণ্য লুকিয়ে থাকে সবটা দান করার উদারতা থাকে না তাই তাদের দান দামি হলেও শ্রেষ্ঠ হতে পারে না

" পুজারিনী " কবিতায় দেখি - অজাতশত্রুর পূজা বিরোধী আদেশের ফলে নগরবাসী ভীত সন্ত্রস্ত কেউ স্তুপে পূজা দিতে সাহস পাচ্ছে না কিন্তু প্রভু - অন্ত প্রাণ শ্রীমতীর কাছে মৃত্যু কোন বাধাই নয় তাই অকম্পিত হাতে সে আর্রতিরশিখা প্রজ্জ্বলিত করে অক্লেশে প্রাণ দিল এরই নাম আসল ভক্তি

"অভিসার " কবিতায় সেবাধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে রোমান্টিকতার এক আশ্চর্য রূপকের মাধ্যমে মথুরাপুরীর পাঁচিলের পাশে সুপ্ত ছিলেন সন্ন্যাসী উপগুপ্ত নগরনটী বাসবদত্তার পা পডে যায় তার গায়ে নর্তকী তাকে আহ্বান করে তার ঘরে সন্ন্যাসী বললেন , যথা সময়ে তিনি যাবেন তারপর যেদিন প্রবল বসন্ত রোগে বাসবদত্তার শরীর ক্ষতবিক্ষত হল , নগরবাসী ফেলে দিয়ে এল নগরের বাইরে , সেদিন উপগুপ্ত নিজের হাতে রোগীর গায়ে মুখে চন্দনের প্রলেপ লাগিয়ে তাকেকোলে তুলে নিয়ে এলেন তার কুন্জে ।এ কবিতায় সেবা করুণার এক দুর্লভ চিত্র অংকিত হয়েছে

" মূল্যপ্রাপ্তি " কবিতার কাহিনি এরকম : হেমন্তে শিশিরের ছোঁয়ায় পদ্ম মরতে শুরু করে শেষ পদ্মটা নিয়ে সুদাস মালী রাজদ্বারে চলল ভাল দামের আশায় পথে এক বুদ্ধ -ভক্ত অকালের পদ্ম দেখে এক মাষা সোনা দিয়ে ফুলটা কিনে নিল রাজাও যাচ্ছিলেন বুদ্ধ দর্শনে অসময়ের পদ্মর ওপর চোখ পডা মাত্র তিনি তা কিনতে চাইলেন শুরু হল দর কষাকষি ।দাম উঠল বিশ মাষা ! মালী ভাবল , যাঁর জন্য এত কাড়া কাডি ,তাঁকে দিলে না জানি মূল্যপাওয়া যাবে এই ভেবে পদ্ম ফিরিয়ে নিয়ে সে এল সেইখানে যেখানে বসে আছেন বুদ্ধদেব পদ্মাসনে-" দৃষ্টিহতে শান্তি ঝরে , স্ফুরিছে অধর-'পরে / করুণার সুধাহাস্যজ্যোতি " সেই আনন্দমূর্তি যখন সুদাসকে শুধায় , কি তার প্রার্থনা ?

"ব্যাকুল সুদাস কহে , ' প্রভু আর কিছু নহে , / চরণের ধুলি এক কণা "

" নগর লক্ষ্মী " কবিতায় বুদ্ধদেব তাঁর ভক্তদের ডেকে বললেন , " ক্ষুধিতেরে অন্নদানসেবা/ তোমরা লইবে বলো কেবা "-তখন শেঠ , সামন্ত , রাজা -সকলের মাথা হেঁট! কেউ সাহস পেল না এই গুরু ভার নিতে অবশেষে অনাথপিণ্ডদের কন্যা সুপ্রিয়া ভিক্ষুণী সকলকে অবাক করে দিয়ে ভিক্ষাপাত্র তুলে নিয়ে বলল,

" আমার ভান্ডার আছে ভরে

তোমা সবাকার ঘরে ঘরে......

ভিক্ষা অন্নে বাঁচাব বসুধা-

মিটাইব দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা "

 

এখনও পর্যন্ত এটাই সেবাধর্মের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ প্রেরণা উৎসবের আডম্বরে অনেক সময়েই কবিবর ঢাকা পডে যান ! বছরের বাকি দিনগুলোতে তাঁর বই ফটো যথাস্থানে সযত্নে রাখা থাকে এখনকার ছেলেমেয়েদের তো রবীন্দ্রনাথমুখি হতেই দেখি না ।তাই কিছু কাহিনিমূলক কবিতার দিকে টানার চেষ্টা করেছি একটা মহৎ প্রসঙ্গ আঁকডে ধরে ।যদি তারা " কথা " কাব্যের সব আখ্যান পডে মুগ্ধ হয়ে " পলাতকা " শ্যামলীর ঠিকানায় পৌঁছে যায় তো নেশায় বুঁদ হবেই হবে - কথা হলফ করে বলতে পারি ।তখন ক্রমে তাদের চোখে পডবে থরে বিথরে সাজানো মণিমুক্তা ,তরী ভরা তাল তাল সোনা !

উনিশ শতক বাঙালির নবজাগরণের সূচনায় সাহিত্য-সংস্কৃতির উপলব্ধির সঙ্গে ধর্মচিন্তাজাত দার্শনিক উপলব্ধির সংযোগ ঘটে। বৌদ্ধসাহিত্যের অনুবাদ সমালোচনা এই উপলব্ধিকে জাগ্রত রাখে। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামদাস সেন, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন, অঘোরনাথ গুপ্ত, নবীনচন্দ্র সেন, শরৎচন্দ্র দেব, সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ প্রমুখ মনীষীতুল্য ব্যক্তি বুদ্ধদেবের জীবন দর্শন নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। রবীন্দ্রমানস গঠনে এদের চিন্তাাধারা প্রভাব ফেলেছিল। বুদ্ধ সম্পর্কে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গিও তাঁর অজানা ছিল না। হীনযান-মহাযান সম্পর্কেও তাঁর ধারণা স্পষ্ট ছিল। বুদ্ধদেবকে নিয়ে তাঁর নানামাত্রিক ভাবনা নিয়ে গ্রন্থও রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক আবহেও ছিল বৌদ্ধ দর্শনের চর্চা। তাঁর ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিতআর্যধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মের পরস্পর ঘাতপ্রতিঘাত সঙ্ঘাত’ (১৮৯৯) এবং সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিতবৌদ্ধধর্ম’ (১৯০১) গ্রন্থদুটিই তার প্রমাণ বহন করে। এছাড়া রাজেন্দ্রলাল মিত্রেরদি সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার অফ নেপালগ্রন্থটি তাঁকে অনেক বৌদ্ধআখ্যানের সন্ধান দেয়। এই গ্রন্থ থেকে কবি যে সকল আখ্যান তাঁর সৃষ্টিসম্ভারে ব্যবহার করেছেন, তা হলো, শ্রেষ্ঠভিক্ষা, পূজারিণী, উপগুপ্ত, মালিনী, পরিশোধ, চন্ডালী, মূল্যপ্রাপ্তি, নগরলক্ষ্মী মস্তকবিক্রয়।কথা কাহিনীকবিতাগ্রন্থের সকল আখ্যানই তিনি গ্রহণ করেছেন বৌদ্ধ কাহিনী থেকে। এই গ্রন্থের আখ্যা-অংশেবিজ্ঞাপনশিরোনামে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য থেকে মেলে- ‘এই গ্রন্থে যে-সকল বৌদ্ধ-কথা বর্ণিত হইয়াছে তাহা রাজেন্দ্রনাথ মিত্র-সংকলিত নেপালী বৌদ্ধসাহিত্য সম্বন্ধীয় ইংরাজি গ্রন্থ হইতে গৃহিত। রাজপুত-কাহিনীগুলি টডের রাজস্থান শিখ-বিবরণগুলি দুই-একটি ইংরাজি শিখ-ইতিহাস হইতে উদ্ধার করা হইয়াছে। ভক্তমাল হইতে বৈষ্ণব গল্পগুলি প্রাপ্ত হইয়াছি। মূলের সহিত এই কবিতা গুলির কিছু কিছু প্রভেদ লক্ষিত হইবে-আশা করি, সেই পরিবর্তনের জন্য সাহিত্য-বিধান-মতে দন্ডনীয় গণ্য হইব না।’ ‘কথা কাহিনীগ্রন্থের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কবি অন্যত্র বলেছেন, ‘এক সময়ে আমি যখন বৌদ্ধ কাহিনী এবং ঐতিহাসিক কাহিনীগুলি জানলুম তখন তারা স্পষ্ট ছবি গ্রহণ করে আমার মধ্যে সৃষ্টির প্রেরণা নিয়ে এসেছিল। অকস্মাৎকথা কাহিনী গল্পধারা উৎসের মতো নানা শাখায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। সেই সময়কার শিক্ষায় এই-সকল ইতিবৃত্ত জানবার অবকাশ ছিল, সুতরাং বলতে পারা যায়কথা কাহিনীসেই কালেরই বিশেষ রচনা।’ [সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা, সাহিত্যের স্বরূপ]

কথাকাব্যে যে কয়েকটি কবিতা আছে তা হলো: কথা কও, কথা কও, শ্রেষ্ঠভিক্ষা, প্রতিনিধি, ব্রাহ্মণ, মস্তকবিক্রয়, পূজারিণী, অভিসার, পরিশোধ, সামান্য ক্ষতি, মূল্যপ্রাপ্তি, নগরলক্ষ্মী, অপমান-বর, স্বামীলাভ, স্পর্শমণি, বন্দী বীর, মানী, প্রার্থনাতীত দান, রাজবিচার, গুরু গোবিন্দ, শেষ শিক্ষা, নকল গড়, হোরিখেলা, বিবাহ, বিচারক, পণরক্ষা আরকাহিনীকাব্যে রয়েছে ৮টি কবিতা। তা হলো: কত কী যে আসে, গানভঙ্গ, পুরাতন ভৃত্য, দুই বিঘা জমি, দেবতার গ্রাস, নিষ্ফল উপহার, দীনদান, বিসর্জন। অর্থাৎকথাকাহিনী এই ৩৩টি কবিতাই বৌদ্ধকাহিনীজাত। এর বাইরেও অজস্র কবিতা রয়েছে যাতে বৌদ্ধসংস্কৃতির উপকরণ রয়েছে। তবেপুনশ্চকাব্যেরশাপমোচন’, ‘পরিশেষকাব্যেরবুদ্ধজন্মোৎসব’, ‘বোরোবুদুর’, ‘সিয়াম, ‘বুদ্ধদেবের প্রতি, ‘প্রার্থনা, ‘বৈশাখী পূর্ণিমা; ‘পত্রপুটকাব্যের ১৭-সংখ্যক কবিতা, ‘নবজাতককাব্যেরবুদ্ধভক্তিএবংজন্মদিনেকাব্যের সংখ্যক কবিতায় তীব্রভাবে রয়েছে ভগবান বুদ্ধের উপস্থিতি।কথা কাহিনীকাব্যের প্রায় পুরোটাই বুদ্ধ প্রসঙ্গ।শ্রেষ্ঠভিক্ষা, ‘মস্তক বিক্রয়, ‘পূজারিণী’, ‘অভিসার’, ‘পরিশোধ’, ‘সামান্য ক্ষতি’, ‘মূল্যপ্রাপ্তি’, ‘নগরলক্ষ্মী’, ‘শাপমোচনপ্রভৃতি কবিতায় বৌদ্ধআখ্যানের প্রত্যক্ষ গ্রহণ রয়েছে। এছাড়াপুনশ্চকাব্যেরশাপমোচনকবিতায় আছে বৌদ্ধধর্মীয় আখ্যান- গান্ধর্ব সৌরসেন সুরলোকের সংগীতসভায় কলানায়কদের অগ্রণী। সেদিন তার প্রেয়সী মধুশ্রী গেছে সুমেরুশিখরে সূর্যপ্রদক্ষিণে। সৌরসেনের মন ছিল উদাসী।পরিশেষকাব্যেরবুদ্ধজন্মোৎসব () আমরা রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধপ্রশস্তি উপলব্ধি করতে পারি- হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ। নূতন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী, কর ত্রাণ মহাপ্রাণ, আন অমৃতবাণী, বিকশিত কর প্রেমপদ্ম চিরমধুনিষ্যন্দ।বোরোবুদুরদেখার প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ একটি অসাধারণ কবিতা লিখেছেন। তাতে তিনি বোরাবুদুরের বর্ণনার পাশাপাশি বুদ্ধের আদর্শের কথা প্রকাশ করেছেন একান্ত অনুসারীর মতো। সবশেষে তিনি লিখেছেন- তাই আসিয়াছে দিন, পীড়িত মানুষ মুক্তিহীন, আবার তাহারে আসিতে হবে যে তীর্থদ্বারে শুনিবারে পাষাণের মৌনতটে যে বাণী রয়েছে চিরস্থির- কোলাহল ভেদ করি শত শতাব্দীর আকাশে উঠিছে অবিরাম অমেয় প্রেমের মন্ত্র,-চ্বুদ্ধের শরণ লইলাম। সারনাথে মূলগন্ধকুটিবিহার প্রতিষ্ঠা-উপলক্ষেবুদ্ধদেবের প্রতিনামের এক কবিতায় তিনি বুদ্ধদেবের নামের মহিমা প্রচার করেছেন। বুদ্ধের নামে এই দেশ ধন্য হয়েছে, সেই গৌরবও প্রকাশ পেয়েছে অই কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের কাছে বুদ্ধের জন্ম মানে মহাজাগরণ। তাই তিনি লিখেছেন- ওই নামে একদিন ধন্য হল দেশে দেশান্তরে তব জন্মভূমি। সেই নাম আরবার দেশের নগর প্রান্তরে দান করো তুমি। বোধিদ্রুমতলে তব সেদিনের মহাজাগরণ আবার সার্থক হোক, মুক্ত হোক মোহ-আবরণ, বিস্মৃতির রাত্রিশেষে ভারতে তোমারে স্মরণ নবপ্রাতে উঠুক কুসুমি। চিত্ত হেথা মৃতপ্রায়, অমিতাভ, তুমি অমিতায়ু, আয়ু করো দান। তোমার বোধনমন্ত্রে হেথাকার তন্দ্রালস বায়ু হোক প্রাণবান। খুলে যাক রুদ্ধদ্বার, চৌদিকে ঘোষুক শঙ্খধ্বনি ভারত-অঙ্গনতলে, আজি তব নব আগমনী, অমেয় প্রেমের বার্তা শতকণ্ঠে উঠুক নিঃস্বনি- এনে দিক অজেয় আহ্বান।

সিয়ামনামে দুটি কবিতা আছে তাঁর। প্রাচীন সিয়াম হলো থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহর থেকে সুখুমভিট সড়কে ৩০ মিনিটের দূরত্বের একটি দর্শনীয় স্থান। এটি সমুট পার্কন প্রদেশে অবস্থিত। প্রায় ৩২০ একর স্থান জুড়ে রয়েছে বিচিত্র স্থাপনা। প্রায় ১১৬টি সৌধ রয়েছে এখানে। প্রথম দর্শনে এবং বিদায়কালে কবির যে অনুভূতি তারই প্রকাশ এই দুটি কবিতায়। প্রধম দর্শনের উপলব্ধি করতে গিয়ে কবি লিখেছেন বুদ্ধের কথা- হৃদয়ে হৃদয়ে মিল করি বহু যুগ ধরি রচিয়া তুলেছ তুমি সুমহৎ জীবনমন্দির,- পদ্মাসন আছে স্থির, ভগবান বুদ্ধ সেথা সমাসীন চিরদিন- মৌন যাঁর শান্তি অন্তহারা, বাণী যাঁর সকরুণ সান্ত্বনার ধারা। আবার সিয়াম দেখে বিদায় নেওয়ার কালেও কবি বুদ্ধের নাম বিস্মৃত হননি। কেবল বুদ্ধের কারণে সিয়ামকে কবির আপন মনে হয়েছে। সেখানে এক সপ্তাহের অবস্থানেই রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে শতাব্দীর শব্দীহ গান। কোন্? সে সুদূর মৈত্রী আপন প্রচ্ছন্ন অভিজ্ঞানে আমার গোপন ধ্যানে চিহ্নিত করেছে তব নাম, হে সিয়াম,… বিদায়ের সময়ে তাই বুদ্ধের কথা স্মরণ করেন কবি। সিয়ামের পুরাকীর্তি এবং বুদ্ধমূর্তি দেখে রবীন্দ্রনাথ কেবল আপ্লুত নন, শ্রদ্ধায় আনত হন। তাই তাঁর সশ্রদ্ধ উচ্চারণ ধ্বনিত হয়- পূজার প্রদীপে তব, প্রজ্বলিত ধূপে। আজি বিদায়ের ক্ষণে চাহিলাম সি্নগ্ধ তব উদার নয়নে, দাঁড়ানু ক্ষণিক তব অঙ্গনের তলে, পরাইনু গলে বরমাল্য পূর্ণ অনুরাগে- অমস্নান কুসুম যার ফুটেছিল বহুযুগ আগে।প্রার্থনাশিরোনামের কবিতায় রয়েছে ভগবান বুদ্ধের নানাকৌণিক উপস্থাপনা।পত্রপুটকাব্যের ১৭ সংখ্যক কবিতাও বুদ্ধের প্রসঙ্গ নিয়ে রচিত।নবজাতককাব্যেরবুদ্ধভক্তিএবংজন্মদিনেকাব্যের সংখ্যক কবিতা বুদ্ধদর্শনধন্য।খাপছাড়াকাব্যের ৬৬-সংখ্যক কবিতায় বুদ্ধের এক ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরা হয়েছে- বটে আমি উদ্ধত, নই তবু ক্রুদ্ধ তো, শুধু ঘরে মেয়েদের সাথে মোর যুদ্ধ তো যেই দেখি গুন্ডায় ক্ষমি হেঁটমুন্ডায়, দুর্জন মানুষেরে ক্ষমেছেন বুদ্ধ তো পাড়ায় দারোগা এলে দ্বার করি রুদ্ধ তো- সাত্তি্বক সাধকের আচার শুদ্ধ তো প্রবন্ধসাহিত্য যেহেতু চিন্তামূলক, তাই তাতে বুদ্ধ প্রসঙ্গ বেশি উচ্চারিত হয়েছে।সমালোচনা ১৮৮৮গ্রন্থেরঅনাবশ্যকনামের প্রবন্ধে রয়েছে বুদ্ধের উপস্থিতি।আত্মশক্তিগ্রন্থে স্বদেশী সমাজ দেশীয় রাজ নামের প্রবন্ধদুটিতে রয়েছে বুদ্ধের কথা।ভারতবর্ষগ্রন্থেসমাজভেদ’, ‘নববর্ষ’, ‘ব্রাহ্মণ’, ‘চীনেম্যানের চিঠিঅত্যুক্তিপ্রবন্ধে বুদ্ধের উল্লেখ রয়েছে। প্রবন্ধগ্রন্থসমালোচনা’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’, ‘প্রাচীন সাহিত্য’, ‘সাহিত্য’, ‘সমাজ’, ‘শিক্ষা’, ‘রাজাপ্রজা’, ‘ধর্ম’, ‘সঞ্চয়’, ‘পরিচয়’, ‘জাপানযাত্রী’, ‘লিপিকা’, ‘জাভাযাত্রীর পত্র’, ‘মানুষের ধর্ম’, ‘ভারতপথিক রামমোহন’, শান্তিনিকেতন’, ‘কালান্তর’, ‘পথের সঞ্চয়’, ‘আত্মপরিচয়’, ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ ‘বিশ্বভারতী’, ‘ইতিহাস’, ‘বুদ্ধদেব’, ‘খৃস্টপ্রভৃতি গ্রন্থে একাধিকবার বৌদ্ধধর্ম, সংস্কৃতি আখ্যানের উল্লেখ রয়েছে। রবীন্দ্রসাহিত্যে গৌতম বুদ্ধ, বৌদ্ধধর্ম বৌদ্ধআখ্যান এসেছে নানাভাবে। নাটকে, কবিতায় প্রবন্ধে বুদ্ধ প্রসঙ্গের অবতারণা ব্যাপক হলেও উপন্যাস এবং ছোটগল্পে সরাসরি বুদ্ধপ্রসঙ্গ নেই বললেই চলে। নাটকে আমরা দেখতে পাই ১০টি নাটকে বৌদ্ধআখ্যান রয়েছে। মালিনী (১৮৯৬), রাজা (১৯১০), অচলায়তন (১৯১২), গুরু (১৯১৮), অরূপরতন (১৯২০), নটীর পূজা (১৯২৬), চন্ডালিকা (১৯৩৮), নৃত্যনাট্য চন্ডালিকা (১৯৩৮), শ্যামমোচন (১৯৩১) নাটকে বৌদ্ধআখ্যান রয়েছে। তবে শাপমোচনকে কেউ কেউ নাটক না বলেকথিকাবলতে চান। এই ১০টি নাটক ছাড়াওশোধবোধনাটকে প্রাসঙ্গিক উক্তি সংলাপে বৌদ্ধপ্রসঙ্গ রয়েছে।

বৌদ্ধআখ্যান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কোনো উপন্যাস রচনা করেননি। তবেঘরে বাইরে” (১৯১৬) উপন্যাসে নিখিলেশের আত্মকথায় এবংশেষের কবিতা’ (১৯২৯) উপন্যাসে ১৩শ পরিচ্ছেদের প্রাসঙ্গিক উক্তিতে বুদ্ধপ্রসঙ্গ রয়েছে।শোধবোধ’ (১৯২৬) নাটকে বুদ্ধদর্শনের প্রভাব নেই, কিন্তু বুদ্ধপ্রসঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। যেমন সতীশ নলিনীর সংলাপে- নলিনী আমি যদি তোমাকে সত্যি কথা বলি, খুশি হোয়ো, অন্যে বললে রাগ করতে পার। সতীশ। তুমি আমাকে অযোগ্য বলে জান, এতে আমি খুশি হব? নলিনী। এই টেনিস্?কোর্টের অযোগ্যতাকে তুমি অযোগ্যতা বলে লজ্জা পাও? এতেই আমি সব চেয়ে লজ্জা বোধ করি। তুমি তো তুমি, এখানে স্বয়ং বুদ্ধদেব এসে যদি দাঁড়াতেন, আমি দুই হাত জোড় করে পায়ের ধুলো নিয়েই তাঁকে বলতুম, ভগবান, লাহিড়িদের বাড়ির এই টেনিস্?কোর্টে আপনাকে মানায় না, মিস্টার নন্দীকে তার চেয়ে বেশি মানায়। শুনে কি তখনই তিনি হার্মানের বাড়ি ছুটতেন টেনিস্?সুট অর্ডার দিতে। সতীশ বুদ্ধদেবের সঙ্গে- নলিনী তোমার তুলনাই হয় না, তা জানি। আমি বলতে চাই, টেনিস্?কোর্টের বাইরেও একটা মস্ত জগৎ আছে-সেখানে চাঁদনির কাপড় পরেও মনুষ্যত্ব ঢাকা পড়ে না। এই কাপড় পরে যদি এখনই ইন্দ্রলোকে যাও তো উর্বশী হয়তো একটা পারিজাতের কুঁড়ি ওর বাট্?ন্?হোলে পরিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হবে না-অবিশ্যি তোমাকে যদি তার পছন্দ হয়। সতীশ বাট্?ন্?হোল তো এই রয়েছে, গোলাপের কুঁড়িও তোমার খোঁপায়-এবারে পছন্দর পরিচয়টা কি ভিক্ষে করে নিতে পারি। নলিনী আবার ভুলে যাচ্ছ, এটা স্বর্গ নয়, এটা টেনিস্?কোর্ট। এখানে গৌতম বুদ্ধদেবকে সর্বমান্য গণ্য করা হয়েছে। বুদ্ধের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধাবোধের কারণেই এখানে তাঁর প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। সনাতনধর্মাবলম্বী চরিত্রের মুখে রাম, কৃষ্ণ কিংবা কোনো দেবতার নাম না বলে বুদ্ধের নাম বলার মাধ্যমে বুদ্ধধর্মের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আস্থারই প্রমাণ বহন করে।ঘরে বাইরে’ (১৯১৬) উপন্যাসেও আছে বুদ্ধের উল্লেখ। নিখিলেশের আত্মকথা- এসেছে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের প্রসঙ্গ। যেমন- ‘এই-সব কথা ভাববার কথা। স্থির করেছিলুম এই ভাবনাতেই প্রাণ দেব। সেদিন বিমলাকে এসে বললুম, বিমল, আমাদের দুজনের জীবন দেশের দুঃখের মূল-ছেদনের কাজে লাগাব। বিমল হেসে বললে, তুমি দেখছি আমার রাজপুত্র সিদ্ধার্থ, দেখো শেষে আমাকে ভাসিয়ে চলে যেয়ো না। আমি বললুম, সিদ্ধার্থের তপস্যায় তাঁর স্ত্রী ছিলেন না, আমার তপস্যায় স্ত্রীকে চাই।বুদ্ধদেব যে তাঁর স্ত্রীপরিজন ছেড়ে সাধনার পথে নেমেছিলেন, অর্থাৎ সর্বত্যাগী হয়ে পথে নেমেছিলেন। তাঁর এই ত্যাগের উদাহরণকে সামনে এনে নিখিলেশ তাঁর বিপরীতে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই তপস্যার কথা বলেছেন। একই উপন্যাসে আছে সমস্ত ভারতবর্ষে জাগরণের নায়ক হিসেবে বুদ্ধের প্রসঙ্গ। যেমন- ‘মানুষ এত বড়ো যে সে যেমন ফলকে অবজ্ঞা করতে পারে তেমনি দৃষ্টান্তকেও। দৃষ্টান্ত হয়তো নেই, বীজের ভিতরে ফুলের দৃষ্টান্ত যেমন নেই; কিন্তু বীজের ভিতরে ফুলের বেদনা আছে। তবু, দৃষ্টান্ত কি একেবারেই নেই? বুদ্ধ বহু শতাব্দী ধরে যে সাধনায় সমস্ত ভারতবর্ষকে জাগিয়ে রেখেছিলেন সে কি ফলের সাধনা?’ আলেকজান্ডার নয় গৌতম বুদ্ধ যে পৃথিবী জয় করেছিলেন তার উল্লেখও আছে এই উপন্যাসের অন্যত্র। এই উক্তির মাধ্যমে বুদ্ধের মানবপ্রেমের কথা প্রকাশিত হয়েছে। আলেকজান্ডার জয় করেছিলেন অস্ত্রে, বুদ্ধ জয় করেছেন প্রেমে। উপন্যাসে উলি্লখিত প্রসঙ্গটি এমন- ‘আমি বললুম, মাস্টারমশায়, অমন করে কথায় বলতে গেলে টাক-পড়া উপদেশের মতো শোনায়; কিন্তু যখনই চোখে ওকে আভাসমাত্রেও দেখি তখন যে দেখি ঐটেই অমৃত। দেবতারা এইটেই পান করে অমর। সুন্দরকে আমরা দেখতেই পাই নে যতক্ষণ না তাকে আমরা ছেড়ে দিই। বুদ্ধই পৃথিবী জয় করেছিলেন, আলেক্?জান্ডার করেন নি, কথা যে তখন মিথ্যেকথা যখন এটা শুকনো গলায় বলি। এই কথা কবে গান গেয়ে বলতে পারব? বিশ্বব্রহ্মান্ডের এই-সব প্রাণের কথা ছাপার বইকে ছাপিয়ে পড়বে কবে, একেবারে গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গার নির্ঝরের মতো?’ ‘শেষের কবিতা’ (১৯২৯) উপন্যাসেও আছে বুদ্ধপ্রসঙ্গের অবতারণা। লাবণ্য অমিতের সংলাপে পাওয়া যায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারের পথ সম্পর্কে।

শোভনলালের পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ হিউয়েন সাঙের তীর্থযাত্রা আলেকজান্ডারের রণযাত্রার খবর জানিয়েছেন। বৌদ্ধধর্মের প্রচার কোন এলাকা দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে তার রূপরেখাটিও লেখক তুলে ধরেছেন। এতে লেখকের ঐতিহাসিক জ্ঞানের পাশাপাশি বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে ধারণারও প্রকাশ ঘটেছে। উপন্যাসের পাঠ থেকেই তা তুলে ধরা যায়।- লাবণ্যর বুকের ভিতরে হঠাৎ খুব একটা ধাক্কা দিলে। কথাটাকে বাধা দিয়ে অমিতকে বললে,শোভনলালের সঙ্গে একই বৎসর আমি এম.. দিয়েছি। তার সব খবরটা শুনতে ইচ্ছা করে। এক সময়ে সে খেপেছিল, আফগানিস্থানের প্রাচীন শহর কাপিশের ভিতর দিয়ে একদিন যে পুরোনো রাস্তা চলেছিল সেইটেকে আয়ত্ত করবে। রাস্তা দিয়েই ভারতবর্ষে হিউয়েন সাঙের তীর্থযাত্রা, রাস্তা দিয়েই তারও পূর্বে আলেকজান্ডারের রণযাত্রা। খুব কষে পুশতু পড়লে, পাঠানি কায়দাকানুন অভ্যেস করলে। সুন্দর চেহারা, ঢিলে কাপড়ে ঠিক পাঠানের মতো দেখতে হয় না, দেখায় যেন পারসিকের মতো। আমাকে এসে ধরলে, সেখানে ফরাসি পন্ডিতরা এই কাজে লেগেছেন, তাঁদের কাছে পরিচয়পত্র দিতে। ফ্রান্সে থাকতে তাঁদের কারো কারো কাছে আমি পড়েছি। দিলেম পত্র, কিন্তু ভারত-সরকারের ছাড়চিঠি জুটল না। তার পর থেকে দুর্গম হিমালয়ের মধ্যে কেবলই পথ খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কখনো কাশ্মীরে কখনো কুমায়ুনে। এবার ইচ্ছে হয়েছে, হিমালয়ের পূর্বপ্রান্তটাতেও সন্ধান করবে। বৌদ্ধধর্ম-প্রচারের রাস্তা দিক দিয়ে কোথায় কোথায় গেছে সেইটে দেখতে চায়। পথ-খেপাটার কথা মনে করে আমারও মন উদাস হয়ে যায়। পুঁথির মধ্যে আমরা কেবল কথার রাস্তা খুঁজে খুঁজে চোখ খোয়াই, পাগল বেরিয়েছে পথের পুঁথি পড়তে, মানববিধাতার নিজের হাতে লেখা। আমার কী মনে হয় জান?চ্ আর গানের কথা যদি বলা হয়, তাহলে অজস্র গানে রয়েছে বুদ্ধের বাণী দর্শনের অভিঘাতসৃষ্ট চরণ। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্যকর্মের বিচারেই বলা যায় যে, গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা দর্শন যতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে, আর কোনো একক মনীষী তা করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত না থেকেও বুদ্ধের বাণী প্রচারে যতটা ভূমিকা রেখেছেন, আর কোনো লেখক তা পেরেছেন বলে মনে হয় না। গৌতম বুদ্ধ এবং বৌদ্ধধর্ম নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি মূল্যায়ন বিধৃত রয়েছে বিভিন্ন রচনায়। সেখান থেকে কয়েক মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যায়। . বৌদ্ধযুগের যথার্থ আরম্ভ কবে তাহা সুস্পষ্টরূপে বলা অসম্ভব ্ত শাক্যসিংহের বহু পূর্বেই যে তাহার আয়োজন চলিতেছিল এবং তাঁহার পূর্বেও যে অন্য বুদ্ধ ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই ইহা একটি ভাবের ধারাপরম্পরা যাহা গৌতমবুদ্ধে পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়াছিল মহাভারতের যুগও তেমনি কবে আরম্ভ তাহা স্থির করিয়া বলিলে ভুল বলা হইবে পূর্বেই বলিয়াছি সমাজের মধ্যে ছড়ানো কুড়ানো এক সঙ্গেই চলিতেছে ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা, পরিচয়]  

. ভগবান বুদ্ধ একদিন যে ধর্ম প্রচার করেছিলেন সে ধর্ম তার নানা তত্ত্ব, নানা অনুশাসন, তার সাধনার নানা প্রণালী নিয়ে সাধারণচিত্তের আন্তর্ভৌম স্তরে প্রবেশ করে ব্যাপ্ত হয়েছিল। তখন দেশ প্রবলভাবে কামনা করেছিল এই বহুশাখায়িত পরিব্যাপ্ত ধারাকে কোনো কোনো সুনির্দিষ্ট কেন্দ্রস্থলে উৎসরূপে উৎসারিত করে দিতে সর্বসাধারণের স্নানের জন্য, পানের জন্য, কল্যাণের জন্য। [ সংযোজন, শিক্ষা] . মহাপুরুষেরাই পুরাতন সত্য বলিতে পারেন-বুদ্ধ, খৃস্ট, চৈতন্যেরাই পুরাতন সত্য বলিতে পারেন। সত্য তাঁহাদের কাছে চিরদিন নূতন থাকে, কারণ সত্য তাঁহাদের যথার্থ প্রিয়ধন। [সত্য, সমাজ] . মনে ক্রোধ দ্বেষ লোভ ঈর্ষা থাকলে এই মৈত্রীভাবনা সত্য হয় নাু এইজন্য শীলগ্রহণ শীলসাধন প্রয়োজন। কিন্তু শীলসাধনার পরিণাম হচ্ছে সর্বত্র মৈত্রীকে দয়াকে বাধাহীন করে বিস্তার। এই উপায়েই আত্মাকে সকলের মধ্যে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। .. এই মৈত্রীভাবনার দ্বারা আত্মাকে সকলের মধ্যে প্রসারিত করা তো শূন্যতার পন্থা নয়। তা যে নয় তা বুদ্ধ যাকে ব্রহ্মবিহার বলছেন তা অনুশীলন করলেই বোঝা যাবে। [শান্তনিকেতন ] . জাপান স্বর্গমর্ত্যকে বিকশিত ফুলের মতো সুন্দর করে দেখছে; ভারতবর্ষ বলছে, এই যে এক বৃন্তে দুই ফুল, স্বর্গ এবং মর্ত্য, দেবতা এবং বুদ্ধুমানুষের হৃদয় যদি না থাকত তবে ফুল কেবলমাত্র বাইরের জিনিস হত এই সুন্দরের সৌন্দর্যটিই হচ্ছে মানুষের হৃদয়ের মধ্যে। [জাপান-যাত্রী ১৩] . বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে জনসাধারণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রবল হয়ে প্রকাশ পেয়েছে; এর মধ্যে শুদ্ধ মানুষের নয়, অন্য জীবেরও যথেষ্ট স্থান আছে। জাতককাহিনীর মধ্যে খুব একটা মস্ত কথা আছে, তাতে বলেছে, যুগ যুগ ধরে বুদ্ধ সর্বসাধারণের মধ্য দিয়েই ক্রমশ প্রকাশিত। প্রাণীজগতে নিত্যকাল ভালোমন্দর যে দ্বন্দ্ব চলেছে সেই দ্বন্দ্বের প্রবাহ ধরেই ধর্মের শ্রেষ্ঠ আদর্শ বুদ্ধের মধ্যে অভিব্যক্ত। অতি সামান্য জন্তুর ভিতরেও অতি সামান্য রূপেই এই ভালোর শক্তি মন্দর ভিতর দিয়ে নিজেকে ফুটিয়ে তুলছে; তার চরম বিকাশ হচ্ছে অপরিমেয় মৈত্রীর শক্তিতে আত্মত্যাগ। জীবে জীবে লোকে লোকে সেই অসীম মৈত্রী অল্প অল্প করে নানা দিক থেকে আপন গ্রন্থি মোচন করছে, সেই দিকেই মোক্ষের গতি। জীব মুক্ত নয় কেননা, আপনার দিকেই তার টান; সমস্ত প্রাণীকে নিয়ে ধর্মের যে অভিব্যক্তি তার প্রণালীপরম্পরায় সেই আপনার দিকে টানেরপরে আঘাত লাগছে। সেই আঘাত যে পরিমাণে যেখানেই দেখা যায় সেই পরিমাণে সেখানেই বুদ্ধের প্রকাশ। [জাভাযাত্রীর পত্র ১৯] . ইতিহাসের যে-একটা আবছায়া দেখতে পাচ্ছি সেটা এই রকম-বাংলা সাহিত্য যখন তার অব্যক্ত কারণ-সমুদ্রের ভিতর থেকে প্রবাল-দ্বীপের মতো প্রথম মাথা তুলে দেখা দিলে তখন বৌদ্ধধর্ম জীর্ণ হয়ে বিদীর্ণ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে নানাপ্রকার বিকৃতিতে পরিণত হচ্ছে। স্বপ্নে যেমন এক থেকে আর হয়, তেমনি করেই বুদ্ধ তখন শিব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। শিব ত্যাগী, শিব ভিক্ষু, শিব বেদবিরুদ্ধ, শিব সর্বসাধারণের। বৈদিক দক্ষের সঙ্গে এই শিবের বিরোধের কথা কবিকঙ্কণ এবং অন্নদামঙ্গলের গোড়াতেই প্রকাশিত আছে। শিবও দেখি বুদ্ধের মতো নির্বাণমুক্তির পক্ষে; প্রলয়েই তাঁর আনন্দ। [বাতায়নিকের পত্র, কালান্তর]

. বুদ্ধ যখন অপরিমেয় মৈত্রী মানুষকে দান করেছিলেন তখন তো তিনি কেবল শাস্ত্র প্রচার করেন নি, তিনি মানুষের মনে জাগ্রত করেছিলেন ভক্তি। সেই ভক্তির মধ্যেই যথার্থ মুক্তি। খৃষ্টকে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ভালোবাসতে পেরেছেন তাঁরা শুধু একা বসে রিপু দমন করেন নি, তাঁরা দুঃসাধ্য সাধন করেছেন। তাঁরা গিয়েছেন দূর-দূরান্তরে, পর্বত সমুদ্র পেরিয়ে মানবপ্রেম প্রচার করেছেন। মহাপুরুষেরা এইরকম আপন জীবনের প্রদীপ জ্বালান; তাঁরা কেবল তর্ক করেন না, মত প্রচার করেন না। তাঁরা আমাদের দিয়ে যান মানুষরূপে আপনাকে। [খৃষ্ট] . যখন ভারতবর্ষে উন্নতির মধ্যাহ্নকাল তখন ধীরে ধীরে কতকগুলি নূতন দর্শন নূতন দল নির্মিত হইতে লাগিল এবং তাহাদের প্রভাবে বৌদ্ধধর্ম উত্থিত হইয়া সমাজে একটি ঘোরতর বিপ্লব বাধাইয়া দিল। পৌরাণিক ঋষিরা ভুল বুঝিলেন, তাঁহারা মনে করিলেন এরূপ বিপ্লব অনিষ্টজনক। অমনি পুরাণে, সংহিতায় অন্যান্য নানাপ্রকার সমাজের হস্তপদ অষ্টপৃষ্ঠে বন্ধন করিয়া ফেলিলেন এবং ভবিষ্যতে এরূপ বিপ্লব না বাধে তাহার নানা উপায় করিয়া রাখিলেন। সমাজের স্বাস্থ্য নষ্ট হইল এবং সমাজ ক্রমশই অবনতির অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল। সংস্কারশীলতার অভাবে রক্ষণশীলতার বাড়াবাড়িতেই হিন্দুসমাজ নির্জীব হইয়া পড়িল। [বঙ্গে সমাজ-বিপ্লব, পরিশিষ্ট] ১০. বৌদ্ধধর্ম সন্ন্যাসীর ধর্ম। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন দেখি তারই প্রবর্তনায় গুহাগহ্বরে চৈত্যবিহারে বিপুলশক্তিসাধ্য শিল্পকলা অপর্যাপ্ত প্রকাশ পেয়ে গেছে তখন বুঝতে পারি, বৌদ্ধধর্ম মানুষের অন্তরতম মনে এমন একটি সত্যবোধ জাগিয়েছে যা তার সমস্ত প্রকৃতিকে সফল করেছে, যা তার স্বভাবকে পঙ্গু করে নি। ভারতের বাহিরে ভারতবর্ষ যেখানে তার মৈত্রীর সোনার কাঠি দিয়ে স্পর্শ করেছে সেখানেই শিল্পকলার কী প্রভূত পরমাশ্চর্য বিকাশ হয়েছে। শিল্পসৃষ্টি-মহিমায় সে-সকল দেশ মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে। [বৃহত্তর ভারত, কালান্তর] ১১. বাংলায় যত ধর্মবিপ্লব হয়েছে তার মধ্যেও বাংলা নিজমাহাত্ম্যের বিশিষ্ট প্রকাশ দেখিয়েছে। এখানে বৌদ্ধধর্ম বৈষ্ণবধর্ম বাংলার যা বিশেষ রূপ, গৌড়ীয় রূপ, তাই প্রকাশ করেছে। [ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ, সংগীতচিন্তা] ১২. বুদ্ধদেব যে অভ্রভেদী মন্দির রচনা করিলেন, নবপ্রবুদ্ধ হিন্দু তাহারই মধ্যে তাঁহার দেবতাকে লাভ করিলেন। বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের অন্তর্গত হইয়া গেল। মানবের মধ্যে দেবতার প্রকাশ, সংসারের মধ্যে দেবতার প্রতিষ্ঠা, আমাদের প্রতি মুহূর্তের সুখদুঃখের মধ্যে দেবতার সঞ্চার, ইহাই নবহিন্দুধর্মের মর্মকথা হইয়া উঠিল। শাক্তের শক্তি, বৈষ্ণবের প্রেম, ঘরের মধ্যে ছড়াইয়া পড়িল; মানুষের ক্ষুদ্র কাজে-কর্মে শক্তির প্রত্যক্ষ হত, মানুষের স্নেহপ্রীতির সম্বন্ধের মধ্যে দিব্যপ্রেমের প্রত্যক্ষ লীলা অত্যন্ত নিকটবর্তী হইয়া দেখা দিল। এই দেবতার আবির্ভাবে ছোটোবড়োয় ভেদ ঘুচিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। সমাজে যাহারা ঘৃণিত ছিল তাহারাও দৈবশক্তির অধিকারী বলিয়া অভিমান করিল, প্রাকৃত পুরাণগুলিতে তাহার ইতিহাস রহিয়াছে। [মন্দির, ভারতবর্ষ]

প্রখ্যাত রবীন্দ্র-জীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালনির জবানিতে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ‘জীবনে একবারমাত্র একটি মূর্তির সামনে আমার প্রণত হওয়ার প্রেরণা জেগেছিল, সেটা বুদ্ধগয়ায়, যখন আমি বুদ্ধমূর্তি দর্শন করি।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তির তাৎপর্য এই যে, ব্যাপারটি তাঁর পরিবার সমাজের পক্ষে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ তাঁরা ব্রাহ্ম, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক, মূর্তিপূজার ঘোরতর বিরোধী। সেই রবীন্দ্রনাথের হৃদয় ভগবান বুদ্ধ এমনভাবে জয় করেছিলেন যে তাঁর পবিত্র মূর্তির সামনে প্রণাম নিবেদনের জন্য তাঁর অন্তর প্রস্তুত হয়েছিল।

কৃপালনি যে কোনও অতিশয়োক্তি করেননি তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত কবি নিজে রেখে গিয়েছেনকবিতায়, গানে, ভাষণে, ধর্মতত্ত্ব আলোচনায়। ভগবান বুদ্ধদেবকেই কবিঅন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধিকরেছেন এবং তাঁর বিচিত্র সৃষ্টির ভিতর দিয়ে তাঁর প্রতি বারবার প্রণাম নিবেদন করে ধন্য হয়েছেন।

১৩৪২ সালে বৈশাখী পূর্ণিমায় কলকাতা মহাবোধি সোসাইটি হলে কবি আমন্ত্রিত ছিলেন। বুদ্ধ-জন্মোৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেদিন যে দীর্ঘ ভাষণটি দেন সেটি বিশ্বসাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। তাঁর সেই স্মরণীয় ভাষণ শুরু হয়েছিল এইভাবে—‘আমি যাঁকে অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর জন্মোৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি। কোনও অনুষ্ঠানের উপকরণগত অলংকার নয়, একান্তে নিভৃতে যা তাঁকে বার বার সমর্পণ করেছি সেই অর্ঘ্যই আজ এখানে উৎসর্গ করি।

কবি কৃতজ্ঞচিত্তে বারবার উচ্চারণ করেছেন, অমেয় প্রেমের মন্ত্রবুদ্ধের শরণ লইলাম আমাদের কৌতূহল হয়, রবীন্দ্রনাথের উপর বুদ্ধের এই অপরিমেয় প্রভাব কেন? খোঁজ নিলে দেখা যায় যে, বুদ্ধের জীবন সংস্কৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথই প্রথম পরিচিত হননি, তাঁর পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ-সহ তাঁর পরিবারের পরিচয় বরং আরও আগে। বৌদ্ধ ধর্ম সংস্কৃতির বিশিষ্ট স্থান ছিল সিংহল (আজকের শ্রীলঙ্কা) ১৮৫৯ সালে দেবেন্দ্রনাথ স্বয়ং সিংহল ভ্রমণে যান। সঙ্গী ছিলেন পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ এবং ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম নেতা কেশবচন্দ্র সেন। বঙ্গদেশে মাঝে ক্ষীণ হয়ে আসা বুদ্ধচেতনা নিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন। ঠাকুর পরিবারে তা চর্চারও বিষয় হয়ে ওঠে। সত্যেন্দ্রনাথবৌদ্ধধর্মনামে একটি বই লেখেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ লেখেনআর্যধর্ম্ম এবং বৌদ্ধধর্ম্মের পরস্পর ঘাত-প্রতিঘাত সঙ্ঘাত সত্যেন্দ্রনাথ বিলেতে গিয়ে প্রখ্যাত ভারতত্ত্ববিদ ম্যাক্সমুলারের সংস্পর্শে পৌঁছে এই বিষয়ে আরও সম্পৃক্ত হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের উপর তাঁর পিতা বহু কৌণিক প্রতিভাধর দাদাদের বিরাট প্রভাবের কথা আমাদের অজানা নয়। অতএব রবীন্দ্রনাথের সমগ্রসত্তা বুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণটি সহজেই অনুমেয়। বুদ্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধামিশ্রিত কৌতূহল জাগিয়েছিলেন আর একজনইংরেজ কবি এডুইন আর্নল্ড। আর্নল্ডেরলাইট অব এশিয়াকাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনায় এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে বুদ্ধগয়াতেও আর্নল্ডের বইটি নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

কবি একবার নয়, অন্তত দুবার বুদ্ধগয়ায় গিয়েছিলেন১৯০৪ এবং ১৯১৪ সালে। প্রথমবার তাঁর সঙ্গী ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র, ভগিনী নিবেদিতা, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার-সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরা একত্রে বসে আর্নল্ডেরলাইট অব এশিয়াএবং হার্ভার্ডের প্রাচ্যবিশারদ হেনরি ক্লার্ক ওয়ারেনেরবুদ্ধিজমবই থেকে অংশবিশেষ পড়ে আলোচনা করতেন। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক গোঁসাইজিকে উদ্ধৃত করে অধ্যাপক সুধাংশুবিমল বড়ুয়া লিখেছেন, ‘এবার (১৯০৪) বুদ্ধগয়া থেকে আসার পর রবীন্দ্রনাথ মস্তক মুণ্ডন করেছিলেন। তখন কবির মনে নাকি বৈরাগ্যের সঞ্চার হয়েছিল।কবি দ্বিতীয়বার বুদ্ধগয়ায় গিয়ে তিনদিনে দশটি গান লিখেছিলেনযেগুলিতে ভগবান বুদ্ধের প্রতি অনুরাগ প্রচ্ছন্ন। জাপানযাত্রী কবি ১৯১৬-তে ব্রহ্মদেশের (আজকের মায়ানমার) তৎকালীন রাজধানী রেঙ্গুনে (আজকের ইয়াঙ্গন) পা রাখেন। পরদিন ছিল ২৫ বৈশাখ। জন্মদিনের সকালে কবি সেখানকার বিখ্যাত শোয়েডেগান বৌদ্ধমন্দির দর্শন করে অভিভূত হন। ওই মন্দিরের ভিতরেই তিনি বিরাট ব্রহ্মদেশের নিজস্বতার প্রকাশ আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, কোনও এককালে ভারতীয় সাধনার আলোকে ব্রহ্মদেশের হৃদপদ্ম বিকশিত হয়েছিল। ওই মন্দিরের ভিতরে কবি উপলব্ধি করেছিলেন তারই প্রকাশ। সেদিন তাঁর মনে এমন ভাবের উদয় হয়েছিল যে, শুধুমাত্র ব্রহ্মদেশের অচেনা কোনও এক গাঁয়ের বৌদ্ধমঠে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারলে বেশ আরাম পাবেন ভেবেছিলেন। কবি চীনে যাওয়ার পথে ১৯২৪-এও ফের রেঙ্গুনে অবস্থান করেন। নাগরিক সংবর্ধনার উত্তরে রবীন্দ্রনাথমৈত্রীর আদর্শকেই ভারতের শ্রেষ্ঠ দান বলে উল্লেখ করেন। এর ভিতরে তিনি যে বুদ্ধের নীতিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন তা বুঝতে বাকি থাকে না। বৌদ্ধ সংস্কৃতির টানে কবি তিনবার সিংহলে এবং দ্বীপময় ভারতে (থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাভা, সুমাত্রা, বালি প্রভৃতি) গিয়েছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিংসার নীতি কবিকে ভীষণ ব্যথিত করে। আক্রান্ত চীনের জন্য কবির মন কেঁদে উঠেছিল। দুই সুপ্রাচীন সভ্য দেশের ধর্ম সংস্কৃতির নিবিড় আত্মীয়তাকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। চীনবাসীদের জন্য প্রাণভরা ভালোবাসা শুভেচ্ছা নিয়ে কবি চীনে পাড়ি দেন ১৯২৪-এ। কবি সেদিন নানাভাবে চীনের জয় কামনা করেছিলেন। তিনি আশা ব্যক্ত করেছিলেন, অতীতের সাধনা যেমন ভারত চীনকে মৈত্রীর বাঁধনে বেঁধেছিল অদূর ভবিষ্যতেও সেই শক্তি দুই প্রতিবেশীকে প্রীতির বাঁধনে বাঁধবে। গত কয়েক দশকে ভারত-চীন সম্পর্কের তিক্ততা দেখে, আজ হলে, কবি কতটা ব্যথা পেতেন অনুমান করা শক্ত নয়। ভারত চীন দুই রাষ্ট্রের বিষয়টি নতুন করে ভাবা উচিত। হাংচৌ, সাংহাই, পিকিং, নানকিং প্রভৃতি শহরে কবির জন্য অনেকগুলি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। পিকিঙে অবস্থানকালে নির্বাসিত মাঞ্চু সম্রাট কবিকে তাঁর প্রাসাদে সাদর অভ্যর্থনা জানান। কবির হাতে উপহার হিসেবে সম্রাট তুলে দেন অমূল্য এক বুদ্ধমূর্তিচীনের ইতিহাসে এক বিরল সম্মান প্রদর্শন। কবির চীন সফরকালে পড়ল ২৫ বৈশাখ, কবির জন্মদিন। ক্রিসেন্ট মুন সোসাইটি বিশেষ চৈনিক রীতিতে সেদিন তাঁর সম্মানে এক উৎসবের আয়োজন করে। বিশিষ্টজনেরা তাঁকে ভারত-চীন ঐক্যের প্রতীক হিসেবে উল্লেখসহচু-চেন-তানউপাধি প্রদান করেন।

বৌদ্ধ কালচারের প্রতি কবির অনুরাগ এতটাই গভীর ছিল যে, পৃথিবীর নানা প্রান্তের বৌদ্ধ পণ্ডিতদের শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীতে শামিল করেছিলেন। যেমন ফ্রান্সের সিলভ্যাঁ লেভি, চীনের লিন -চিয়াং এবং রোমের জোসেপ তুচ্চি। লেভিই বিশ্বভারতীর প্রথম অতিথি অধ্যাপক। আচার্য লেভিরই আন্তরিকতায় বিশ্বভারতীতে চীনভবন প্রতিষ্ঠা-সহ বৌদ্ধশাস্ত্র গবেষণার ব্যবস্থা হয়। বলা বাহুল্য, ভারতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিতও ছিলেন একাধিক।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করার মতো একটি তথ্য এই যে, কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি প্রতিষ্ঠার দুবছর বাদে ১৮৯৩-তে শিকাগো বিশ্ব ধর্মমহাসভায় বৌদ্ধধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন সিংহলের তরুণ অনাগারিক ধর্মপাল। সেখানেই স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। হিন্দু বৌদ্ধধর্মের এই দুই তরুণ নেতার প্রীতির সম্পর্কের বিষয়টি কবিরও দৃষ্টি এড়ায়নি। ধর্মপাল কলকাতায় ফিরে বুদ্ধচেতনায় ভারতবাসীকে জাগাতে চেষ্টা করেন। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুদ্ধ-জয়ন্তী পালনেরও উদ্যোগ নেন তিনি। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ লেখেন তাঁর বিখ্যাত দুটি গান—‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বীএবংসকল কলুষ-তামস হর

শুধু ধর্ম নয় রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্র সমাজচিন্তার ভিতরেও বুদ্ধের আদর্শের কোমল স্পর্শ ছিল। ভগবান বুদ্ধকে উদ্ধৃত করে কবি আমাদের সাবধান করে গিয়েছেন, বাহুবলের সাহায্যে ক্রোধ-প্রতিহিংসাকে জয়ী করে শান্তি মিলবে না। শান্তির উপায় হচ্ছে ক্ষমা। রাষ্ট্র সমাজনীতিতে এই জিনিস মানুষ যতদিন না স্বীকার করবে ততদিন অপরাধ বেড়ে চলবে। রাষ্ট্রগত বিরোধের আগুন নিভবে না। পৃথিবীর মর্মান্তিক পীড়া উত্তরোত্তর দুঃসহ হতে থাকবে। কোথাও এর শেষ পাওয়া যাবে না।

যুদ্ধক্লান্ত তৎকালীন ইউরোপ রবীন্দ্রনাথকে মানবপ্রেমিক আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু সে ছিল রাজনীতির ক্ষেত্রে। পশ্চিমের মানুষ জানত না যে সাহিত্যক্ষেত্রেও তিনি সর্বাগ্রে মানবপ্রেমিক। আরও বিশদে বলা যায় যে তাঁর সমস্ত প্রেম ছিল জীবন মাটির পৃথিবীটার জন্য। স্বর্গের চাইতে মর্ত্যকে, পরলোকের চাইতে ইহলোককে এবং দেবতার চাইতে মানুষকেই বেশি মূল্য দিয়েছেন তিনি। এরপর বুঝতে অসুবিধা হয় না, সবাই যাঁকেভগবানবুদ্ধ বলেছেন, কবি কেন তাঁকে প্রণাম নিবেদন করতে গিয়ে অন্তরের সমস্ত শ্রদ্ধা ঢেলেশ্রেষ্ঠ মানববলে উল্লেখ করেছেন।