Thursday, June 29, 2023

মৌর্য সম্রাট অশোক ও বৌদ্ধধর্ম

 

সুমনপাল ভিক্ষু

অনেক ঐতিহাসিক গবেষক (প্রাচ্য পাশ্চাত্যের) তাঁদের গবেষণার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন সম্রাট অশোকের কর্মকীর্তি। তাঁদের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই শুরু করার প্রয়াস করবো সম্রাট অশোকের অখণ্ড ভারতভূমির পরিধি, বিস্তার তাঁর দূরদর্শী চিন্তা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিবৃত্ত।এইচ. জি. ওয়েলসের মতে— “ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে হাজার হাজার নৃপতির নাম। ভিড় করে থাকা এত নামের মাঝে শুধু অশোকের নামটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো দীপ্তিমান।'

বাংলার ঐতিহাসিক গবেষকদের মতে-‘অশোক ভারতের ইতিহাসের অসাধারণ কিছু চরিত্রের অন্যতম। সব-যুগে কিম্বা সব জাতি অশোকের মতো নৃপতির জন্ম দিতে পারে না। পৃথিবীর ইতিহাসে সম্রাট অশোকের সমকক্ষ আর কোন চরিত্র এখনও জন্মেনি। ধর্ম এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত ভারতবর্ষের ন্যায় অদ্ভুত বৈচিত্র্য পৃথিবীর কোথাও কখনই ছিল না এবং এখনো নেই। ধর্ম এবং জাতির বৈচিত্র্য ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে যে জটিল হতে জটিলতর করেছে অপর দিকে এই জটিলতা হতে উত্তরণের পথও উন্মুক্ত হয়েছে প্রাচীন এবং মধ্যযুগে।

আজ হতে প্রায় ২৪০০ বছর পূর্বে ধর্মকে যে মানবিক মূল্যবোধের প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায় এবং রাষ্ট্র শাসক প্রকৃত অর্থেই হয়ে ওঠেন জনগণের বন্ধু, সেই মহান কর্মটি সম্পন্ন করেছিলেন মৌর্য সম্রাট প্রিয়দর্শী অশোক।

অশোক সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র সম্রাট, যিনি কলিঙ্গ জয়ের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে যুদ্ধপরিত্যাগ করেছিলেন। তাঁর যুদ্ধ পরিত্যাগের মূল কারণ ছিল বহু মানুষের মৃত্যু এবং জনগণের দুর্দশা। সৈনিক এবং সাধারণ মানুষ সকলের দুর্দশাকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। সম্রাট অশোকের যুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে পরিত্যাগের কারণগুলিকে উল্লেখ করা যায়।

) সম্রাট অশোক ছিলেন তৎকালীন সময়ে বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের শাসক

) তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় কিছু বছর পূর্বে গ্রীকরাজ আলেকজাণ্ডার যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষ সহ পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে তার প্রভুত্বকে বিস্তার করলেও সেই প্রভুত্ব কিন্তু চিরস্থায়ী হয় নি। অপরদিকে অশোক হিংসা ত্যাগ করে পৃথিবীতে প্রথম জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণ করেছিলেন।

) অশোক তাঁর সাম্রাজ্যের সকল প্রজাকে নিজের সন্তান মনে করে ঘোষণা করেছিলেন, কেবল মানুষ নয়, পশু পাখি বৃক্ষ এবং জল সম্পদের উপরও করুণা নীতি প্রয়োগ করে তাঁর সাম্রাজ্যের একটি যুদ্ধপরিপন্থি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন

8) অশোক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মানুষ পশু পাখির জন্য চিকিৎসালয় নির্মাণ করেছিলেন। যা এই আধুনিকযুগে সবদেশে নির্মাণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বরং এই পরিসেবাটি ক্রমশঃ পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে। এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চিকিৎসালয় নির্মাণ আজ যা করা হচ্ছে তা অশোক ২৪০০ বছর পূর্বে সৃষ্টি করেছিল।

অশোক বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হলেও কোন অবস্থাতেই তাঁর সাম্রাজ্যকে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেন নি বরং তিনি নিদের্শনা দিয়েছিলেন যে কোন অবস্থাতেই অন্য ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপতা পোষণ করা যাবে না। বরং তিনি বলেছেন যে, অপর ধর্মকে সন্মান করলে নিজের ধর্মের গৌরব বৃদ্ধি পায়

মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য অশোকের পিতামহ।অর্থশাস্ত্রেররচয়িতা চাণক্য বা কৌটিল্যের সহযোগীতায় চন্দ্রগুপ্ত নন্দবংশের উচ্ছেদ সাধন করে ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। (খ্রীঃ পূর্ব ৩২১-২৯৭) চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বিন্দুসার খ্রীঃ পূর্ব ২৯৭-২৭২ অব্দ বা ২৬৯ পর্যন্ত মগধের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। অশোকের মাতা সুভদ্রাঙ্গী মতান্তরে দেবীধারা বিন্দুসারের মুখ্য মহিষী ছিলেন কিনা তা জানা যায় না। অনেকে মনে করেন সম্ভবত মৌর্যবংশীয় ছিলেন।

২৯৯খ্রীঃ পূর্বাব্দে সম্ভবত পাটলিপুত্রে অশোক জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে কিংবদন্তী আছে যে তিনি ৩১৪ খ্রীঃ পূর্বাব্দে জন্মেছিলেন। তাঁর আত্মীয় পরিজনের মধ্যে ছিলেন ভিক্স নামক একজন বৈমাত্রেয় ভ্রাতা। তার নাম বীতশোক বা বিগতাশোক। চৈনিক ইতিহাসে তাকে সুদত্ত বা সুগত নামে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সিংহলী ইতিহাসাশ্রয়ী গ্রন্থে মহাবংশে তাঁর ভ্রাতা সংখ্যা ৯৮ এর মধ্যে জ্যোষ্ঠ ছিলেন সুমন বা সুসিম। তাঁর জীবনকাহিনী নিয়ে নানা ভুল তথ্য পাওয়া যায়। সেগুলো সবার জানা, সুতরাং চর্বিত চর্বন না করে আমরা বিশ্বকবির ভাষায় বলতে পারি— 

জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক আপনার যে কথাগুলিকে চিরকালের শ্রুতিগোচর করিতে চাহিয়া ছিলেন তাহাদিগকে তিনি পাহাড়ের গায়ে খুদিয়া ছিলেন। ভাবিয়াছিলেন, পাহাড় কোন কালে মরিবে না,সরিবে না, অনন্তকালের পথের ধারে অচল হইয়া দাঁড়াইয়া নব নব যুগের পথিকদের কাছে এককথা চিরদিন ধরিয়া আবৃত্তি করিতে থাকিবে। পাহাড়কে তিনি কথা কহিবার ভার দিয়াছিলেন।

অশোক শিলালিপি সমূহ যেভাবে ভৌগোলিক অবস্থানে উৎকীর্ণ হয়েছিল, আপাতদৃষ্টিতে তার মধ্যে বিন্যাস কৌশল পরিলক্ষিত হয় না। তাঁর ধর্মলিপি সমূহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পণ্ডিতের সুগভীর অভিনিবেশের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা মোটামুটি চারটি ভাগে এই লিপিগুলিকে বিন্যস্ত করেছেন। অশোক এই লেখামালার নাম দিয়েছিলেনধর্মলিপি' অশোক সর্বত্রই একই সংখ্যক অনুশাসন উৎকীর্ণ করেছিলেন তা মনে করা কারণ বাস্তবিক অর্থেই অমূলক। যেমন ২টি অনুশাসন পাওয়া গেছে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে (মধ্যপ্রদেশ) এবং কাথিয়াবাড়ের একটি শিলালিপিতে ১৪টি। ওড়িশাতে যে দুটি শিলালিপি পাওয়া গেছে তাকে ১৪টির পরিবর্তে ১১টি অনুশাসন রয়েছে। সুরেন্দ্রনাথ সেন সেগুলিকে গিরিলেখমালা বলে অভিহিত করেছেন। অপরদিকে রোমিলা থাপার বলেছেন মুখ্য-গৌণ শিলানুশাসন, স্তম্ভানুশাসন।

 

লিপির ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ২টি অদ্ভুত বৈচিত্র্য উঠে আসে ব্রাহ্মী এবং খরোষ্ঠী। ব্রাহ্মী অক্ষর বিন্যাস বাম দিক হতে ডানদিকে (বাংলা-ইংরেজী) ইত্যাদি। খরোষ্ঠী লেখার ভঙ্গি ডান দিক হতে বাম দিক (বর্তমানে আরবি, ফারসী) উত্তরপ্রদেশ হতে প্রাপ্ত টি মাত্র শিলালিপি ব্যতীত আর সকল ব্রাহ্মী অক্ষরে খোদিত।

অশোককে আধুনিক বিশ্ব মানচিত্রে সর্ব প্রথম তুলে ধরেছিলেন জেমস্ প্রিন্সেপ। প্রিন্সেপ অশোকের ধরনের লিপি পাঠোদ্ধারেই মুন্সীয়ানা দেখিয়েছিলেন। প্রিন্সেপ ছাড়াও ল্যাসেন, গোরিস এবং ক্যানিংহাম খরোষ্ঠী লিপি পাঠোদ্ধারে যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছিলেন।

১৮২২ সালে সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয় গিরনার লিপি। কর্নেল লর্ড জুনাগড় হতে দেড় কিলোমিটার পূর্বে গিরনার পাহাড়ের গাত্রে সর্বপ্রথম দেখতে পান। এই সুবিশাল উৎকীর্ণ লিপির পরিমান ছিল প্রায় একশত বর্গফুট। ১৮২২ সালে মুম্বই এর প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্র সোপরাতে একটি শিলাখণ্ড আবিষ্কার করেন ভগবান লাল ইন্দ্রাজি। ১৯২৯ সালে তৎকালীন খনন বিশেষজ্ঞ অনুঘোষ মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কুর্নুল জেলার গুত্তি নামক শহর হতে ১৪ কি.মি. দূরে য়েরাজুড়ির গ্রামের নিকট গজগিরিতে চতুর্দশ শিলালিপি আবিষ্কার করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের . মিত্র এই লিপির এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য দেখেন যে লিপির একটি অংশ ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা হলেও প্রত্যেক পংক্তির এক অর্ধেক ডানদিক হতে বামদিকে এবং অপরার্ধ বাম হতে ডান দিকে লেখা। সম্ভবত ব্রাহ্মীলিপি উভয়দিক হতে লেখা হতো।

উৎকীর্ণ লিপি সমূহতে তাঁর বাল্যজীবন সম্পর্কিত কোন তথ্যই পাওয়া যায় না। এছাড়া তাঁর কলিঙ্গ বিজয়, সম্পর্কিত কোন তথ্যের উল্লেখ নেই। তাঁর জীবনের অনেকগুলি উল্লেখনীয় দিক হল এই শিলালিপি সমূহ। অশোকের রাজ্যাভিষেকের বৎসর অনুসারে এই লিপিসমূহ হল

) অষ্টম বৎসর কলিঙ্গ বিজয় (গিরিলেখমালা, ত্রয়োদশ অনুশাসন),

) দশম বৎসর বুদ্ধগয়া গমন (গিরিলেখমালা, অষ্টম অনুশাসন)

) দ্বাদশ বৎসর ) প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কর্মচারীগণকে রাজ্য পরিদর্শনের নির্দেশ (অষ্টম অনুশাসন)

) নৈতিক উন্নতি বিধান (অষ্টম অনুশাসন)

) ধর্মলিপি লিখন (স্তম্ভ লেখমালা, ষষ্ঠ অনুশাসন)

) বরাবর পাহাড়ে আজীবক সন্ন্যাসীদের গুহাদান (গুহালিপি)

) ত্রয়োদশ বৎসর ধর্মমহামাত্র নিয়োগ ( গিরিলেখমালা,পঞ্চম)

) চতুর্দশ বৎসর কনকমুনির স্তূপ সংস্কার পরিবর্ধন।

) ঊনবিংশ বৎসর বরাবর পাহাড়ে তৃতীয় গুহাদান (গুহালিপি)

) বিংশতি বৎসর লুম্বিনী উদ্যান কনকমুনির স্তূপে গমন (রুক্মিনদেই নিদিনি সাহর (নিজালিসাভার)

) ষড়বিংশ বৎসর স্তম্ভ লেখমালার ১ম, ৪র্থ, ৫ম ৬তম অনুশাসন প্রচার। ) সপ্তবিংশ বৎসরে দিল্লি তোপরা স্তম্ভলিপির সপ্তম অনুশাসন।

কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে মানবজাতি সহ অন্যান্য প্রাণীর কল্যাণ বিধানই হল প্রকৃত মুক্তির পথ। অশোক উপলব্ধি করেছিলেন পাপকর্ম হল পঞ্চবিধ-চণ্ডভাব, নিষ্ঠুরতা, ক্রোধ, অহংকার এবং পরশ্রীকাতরতা। পরধর্ম সহিষ্ণুতা তাঁর মূলমন্ত্র ছিল। 

তিনি বুদ্ধের ধর্ম দর্শনকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিলাসিতা বর্জন করে ধর্মযাত্রা অনুমোদন করেছিলেন। শুধু মানুষ নয় অন্যান্য প্রাণীদের প্রতি তাঁর কারুণ্য প্রদর্শিত হয়েছিল। তাই তিনি পরিবেশ বান্ধব হয়ে গাছ লাগিয়ে উদ্যান তৈরী করেছিলেন এবং পশু চিকিৎসালয় নির্মাণ করেছিলেন।

বৈদিক ধর্মতত্ত্ব যখন ভারতবর্ষের মানুষকে মূক বধির এবং ক্লীবে পরিণত করেছিল, তখন সমগ্র মানব জাতির মুক্তি পথের অগ্রদূত রূপে শাক্যমুনি (ভগবান বুদ্ধ) তথাকথিত ঈশ্বর বিহীন, কার্যপ্রধান ধর্ম প্রচার করেছিলেন। সেই নব্য ধর্মের আলোক স্পর্শে ভারতবর্ষের সমাজ এবং অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। এই মহান যুগকেই নিখিল বিশ্ব বৌদ্ধযুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরে যে সকল বৌদ্ধ উপাসক নৃপতি মানবকল্যাণে তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম দেবানাম প্রিয়ঃ প্রিয়দর্শী অর্থাৎ সম্রাট ধৰ্ম্মশোক। যিনি সকল প্রকার শোক, দুঃখ থেকে সকলকে পরিত্রাণ দেন তিনিই অশোক। 

মৌর্য বংশীয় সম্রাটগণের রাজত্বকালে ভাগীরথী এবং শোন নদীর সঙ্গমস্থলে পাটলিপুত্র মগধের রাজধানী। গ্রীকগণ এই পাটলিপুত্র নগরকেপালিবোথরা' নামে অভিহিত করেছেন। তিব্বতী ঐতিহ্যে মগধ কথাটির অর্থ পুণ্যবান বা পূজনীয়দের বাসভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভারতবর্ষের মৌর্যদের উত্থান খ্রীঃ পূর্ব চতুর্থ শতকে। বৌদ্ধাগম হতে জানা যায় যে মৌর্য বা মৌরীয় গোষ্ঠীর মূল আবাসস্থল ছিল নেপালের তরাই অঞ্চলে। ঐতিহাসিক প্লিনির মতে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর সংলগ্ন অঞ্চলই হল মৌর্যদের আদি বাসভূমি। সেই অঞ্চলে ময়ুর থাকার কারণে এই জনগোষ্ঠীর নামকরণ হয় মোরীয় বা মৌর্য। মহাপরিনির্বাণ সূত্রের বর্ণনানুযায়ী পিপ্পলীবনের মোরীয় থেকে এই মৌর্যবংশের উৎপত্তি।

বৌদ্ধাগম হতে আরো জানা যায় যে, কৌটিল্য নামক এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নন্দবংশের উচ্ছেদ সাধনে চন্দ্রগুপ্তকে যুদ্ধবিদ্যা এবং রাজনৈতিক শাস্ত্রে সুনিপুণভাবে তৈরী করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্তের বংশপরিচয় অজ্ঞাত হলেও তিনিই ছিলেন ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম চক্রবর্তী সম্রাট। মতান্তরে পিপ্পলীবনের ক্ষত্রিয় শাসক মোরীয় বংশের জন্মগ্রহণ করেন চন্দ্রগুপ্ত কিংবা তাঁর মাতা ছিলেন মুরা নামে এক মহিলার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন বলে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নামে খ্যাত হন।

খ্রীঃ পূর্ব ৩২১ অব্দে/৩২০ অব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসনে আরোহন করেন। ঐতিহাসিক . কে. নারায়ণের মতে, “ভারতবর্ষ হতে বিদায় গ্রহণ করার সাথে সাথে আলেকজাণ্ডার এই অঞ্চলে বিদ্রোহ এবং ফিলিপের হত্যার সংবাদ পেয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতিগণ যখন সুবিশাল গ্রীক সাম্রাজ্য বিভক্ত করবার বিষয়ে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় একজন মৌর্য যুবক (চন্দ্রগুপ্ত) একটি নতুন সাম্রাজ্যর ভিত্তি প্রস্তর রচনা করেছিলেন।” (দ্য ইন্দো গ্রীকস্ পৃঃ-২০)। গ্রীক রাজদূত মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্তের রাজদরবারে এসেছিলেন খ্রীঃ পূর্ব ৩০৪ অব্দে। তিনি খ্রীঃ পূর্ব ৩০৪ অব্দ হতে ২৯৯ অব্দ পর্যন্ত ভারতে অবস্থান করেছিলেন।

মৌর্য সাম্রাজ্যই দেশকে দিয়েছিল পরবর্তীকালের রাজনৈতিক সংহতি, আর তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রকে দিয়েছিল নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এই সাম্রাজ্য ছিল ইউরোপীয় রোমান সাম্রাজ্যের সমতুল্য। (ধর্মানন্দ কোশাম্বী, ভারত ইতিহাস চর্চার ভূমিকা, পৃঃ-১৫৫) ঐতিহাসিকের কাছে প্রায় ২০০ বছর পূর্বেও সম্রাট অশোক সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন তথ্য ছিল না। অশোককে কাল্পনিক এক চরিত্র আবার কেউ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকেই অশোক মনে করতেন। অশোক যে কোন কাল্পনিক চরিত্র নয় সেটা পৃথিবীর কাছে তুলে ধরেছিলেন জেমস্ প্রিন্সেপ। অশোকের শিলালিপি পাঠোদ্ধার করে তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীকে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন।

 

বর্তমান ভারতবর্ষ, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান অঞ্চল হতে আবিষ্কৃত অশোকের শিলালিপি পাঠসমূহে পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে প্রিন্সেপ লক্ষ্য করেন প্রায় সকল শিলালিপির সূচনা বাক্য একই প্রকারের। তখনও অবশ্য তিনি জানতেন না এই শিলালিপিগুলি অশোকের। প্রিন্সেপ যে বাক্যটি প্রথম সনাক্ত করেছিলেন তা হল- 

দেবানাং প্রিয়ো পিয়ালি লাজা (রাজা) হোম (এবং) আহা (-) দ্বাদসবাসা ভিসিতেন ময়া ইদং আঞাপিতং সর্বত বিজিতে মম সুতা রাজুকে প্রাদেসিকে সংচসু বালেস অনুসংযানং নিয়াঙ্কু (নিয়াত) ততায়েব তথায় ইথায় ধ্বংমানুসদ্যিয় যথা অঞ্চায় পিকংমায় (-) সাধু মাতরি পিতরি সুসুতা মিতাসংস্ততজ্ঞতীনং ব্রাহ্মণসমনানং সাধু দানঃ (),

জেমস্ প্রিন্সেপ প্রথমে উপলব্ধি করতে অসমর্থ ছিলেন যে এই শিলালিপিগুলি কোন ভারতীয় শাসকের, পরে প্রিন্সেপ অতি শীঘ্রই তাঁর সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, শিলাগুলিতে উল্লেখ রয়েছে 'আমার রাজত্বের দ্বাদশ বৎসরে এই পাঠ থেকে।

ঐতিহাসিক টার্নার ছিলেন পালি সাহিত্যে এবং ইতিহাসের সুপণ্ডিত। টার্নারকে শ্রীলঙ্কার একজন বৌদ্ধভিক্ষুমহাবংশগ্রন্থটি তিনি ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। প্রিন্সেপ মহাবংশের এই অনুবাদ হতে সিদ্ধান্তে আসেন যে উক্ত শিলালিপিগুলি শ্রীলঙ্কার রাজা দেবানাম পিয়তিস্যের কিন্তু অচিরেই তিনি টার্নার অনূদিত দ্বীপবংশ পড়ে হতবাক হয়ে যান। সেখানে লেখা রয়েছেসম্বুদ্ধের পরিনির্বাণের দুই শত অষ্টাদশবর্ষ পরে প্রিয়দর্শীর অভিষেক হয়......এই পিয়দসসী ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র, বিন্দুসারেরর আত্মজ তখন যুবরাজ এবং উজ্জয়িনীর রাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত  

১৯১৫ খ্রীঃ কর্নাটকের উত্তরাঞ্চলের মালিক হতে হতে একটি গিরিলেখ আবিষ্কৃত হয়। যেখানে সম্রাট নিজের নাম লিখেছিলেন দেবানাম প্রিয় অশোক। এই লেখ এবং শ্রীলঙ্কার ইতিবৃত্ত প্রমাণ করে যে সম্রাট অশোক এবং দেবানাম পিয়দসী একই ব্যক্তি

১৯৫৫ খ্রীঃ গুজরাটে একটি গিরিশাসনে অশোকের নাম পাওয়া যায়। আশির দশকে কর্নাটকের দুটি গ্রামে অশোকের গিরিশাসন পাওয়া যায়। সেগুলিতে অশোকের নাম উল্লিখিত রয়েছে। সম্রাট অশোক কেন পিয়দসী বা প্রিয়দর্শী নাম গ্রহণ করেছিলেন সেই বিষয়ে ডি. পি. সিংহল বলেছেন, 'অশোক সম্ভবত বৌদ্ধ দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণীত হয়ে নিজের নাম গোত্র হতে মুক্তি প্রদান হেতুপিয়দসী' নামটি ব্যবহার করেছিলেন। ‘(ইণ্ডিয়া অ্যাণ্ড ওয়ার্ল্ড সিভিলাইজেশন, খণ্ড, পৃ:-৩৮৭)লাজিনা পিয়দসিনা দুবাভসব (সাভিসিতেনা) (য়ং) নি (গো) হকুভা দি (না) আজিবিকেহি।' বরাবর গুহালিপি, বিহার, রাজা)

বিভিন্ন দেশ সাহিত্যে অশোক প্রচলিত কাহিনী : ভারতবর্ষ : 

ভারতবর্ষ এবং বহিঃবিশ্বে অশোকের কাহিনী প্রচলিত আছে। ভারতীয় কাহিনীতে উল্লেখ আছে রাজা বিন্দুসার পাটলিপুত্রে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর প্রথম পুত্রের নাম সুযীম। চম্পা নগরের জনৈক ব্রাহ্মণ কন্যা ছিলেন (মতান্তরে ধর্মা) শুভদ্রাঙ্গী। তিনি অপরূপ লাবণ্যের অধিকারী ছিলেন। একসময় বিন্দুসার অপূর্বশ্রী, উন্নত গুণসম্পন্ন, বুদ্ধিমতী, অহিংসার সাক্ষাৎ ধ্বজাধারী যুবতীকে দেখে মুগ্ধ হলেন এবং সম্রাট অবগত হলেন যে সুভদ্রাঙ্গী ব্রাহ্মণকন্যা। বিন্দুসার শুভদ্রাঙ্গীকে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করেন এবং তাঁকে প্রধান মহিষী পদে প্রতিষ্ঠিত করেন। 

বিন্দুসার এবং শুভদ্রাঙ্গীর দুই পুত্র সন্তান অশোক বিগতশোক। বিন্দুসারের রাজত্বকালে তক্ষশীলাবাসী বিদ্রোহী হয়ে উঠলে সেই বিদ্রোহ নিবারণে সম্রাট কুমার অশোককেই প্রেরণ করলেন। অশোক বিচক্ষণতার সঙ্গে তক্ষশিলাবাসীর সঙ্গে সাক্ষাৎ পূর্বক বিনাযুদ্ধে বিদ্রোহ শান্ত করলেন। সম্রাট বিন্দুসারের মৃত্যুর পর মন্ত্রীগণ অশোককে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। সুযীম বড় সন্তান হলেও তার উগ্র চপল স্বভাবের জন্য রাজদরবারে কেউই তাকে পছন্দ করতেন না। পিতার মৃত্যু সংবাদ শুনে সসৈন্য পাটলীপুত্রের দিকে অগ্রসর হলে অশোকের রাক্ষস সৈন্যসমূহ সুষীমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করলেন। ঘটনাচক্রে সুযীম রাজধানীর দূর্গ পরিখা অতিক্রম করতে সচেষ্ট হলে অশোকের সৈন্যরা উক্ত পরিখাকে অগ্নিপূর্ণ করে দেন। যুবরাজ সুষীম সেই অগ্নিপূর্ণ পরিখায় পতিত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। 

সিংহলদেশীয়:

সিংহলদেশীয় কাহিনী অনুযায়ী চাণক্য মগধরাজ ধননন্দকে চক্রান্ত করে নিহত করে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে আসীন করান। বিন্দুসারের জ্যেষ্ঠপুত্রের নাম সুমন বা সুযীম এবং কনিষ্ঠ তিস্য। অশোক বিন্দুসারের রাজত্বকালে পশ্চিম ভারতের শাসনবর্গ ছিলেন। বিন্দুসারের মৃত্যু হলে অশোক সিংহাসন লাভের আশায় যুবরাজ সুযীম এবং অপর ভ্রাতাকে হত্যা করেন। তবে কনিষ্ঠ ভ্রাতা তিস্যকে হত্যা করেন নি। এই ভাবে রক্তবন্যা বাহিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন বলে তার নাম হয় চণ্ডাশোক। অশোকের সিংহাসন আরোহনের তিন বৎসর কালে এক বালক বৌদ্ধশ্রমণ নিগ্রোধ তাকে বৌদ্ধশাস্ত্র সম্পর্কে অবগত করান। তথাগতের জীবন চরিতে এই বৌদ্ধ তত্ত্ব শ্রবণ দ্বারা সম্রাট বিমোহিত হলেন। অতঃপর তিনি আগ্রহের সঙ্গে সেই নিবৃত্তিমূলক ধর্ম গ্রহণ করলেন। সিংহাসনে আরোহণের চার বৎসর পরে সম্রাটের জীবনে এই পরিবর্তন সাধিত হল। সম্রাট অশোক ভারতবর্ষের ৮৪ হাজার নগরে ভগবান বুদ্ধের ৮৪ হাজার স্কন্ধের এক একটি স্মারক স্তম্ভ চৈত্য নির্মাণ করতে কৃতসংকল্প হলেন। তিনি পাটলিপুত্রে অশোকারাম প্রতিষ্ঠা করলেন। সম্রাট অশোকের আশ্চর্য ধর্মানুরাগের কল্যাণে তিনি পরিণত হলেনধর্মাশোকে

তিব্বত দেশীয়: 

তিব্বত দেশীয় কাহিনী অনুযায়ী বুদ্ধের পরিনির্বাণের ২৩৪ বৎসরে ধর্মাশোক মগধের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন। প্রথম জীবনে তিনি অতি ক্রুর নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিলেন, অনেকেই তাঁর হাতে নিহত হয়েছিলেন,পরে তাঁর জীবনের ভূষণ স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই মহান পরিবর্তন অর্ঘ্য যশের দ্বারা সংশোধিত হয়েছিল। ধর্মাশোকের রাজত্বের ৩০ বৎসরকােেল, তাঁর মহিযী একটি পুত্র প্রসব করেন। দৈবজ্ঞ জানালেন, শিশুটির শরীরে রাজ চিহ্ন বিদ্যমান এবং সে পিতার জীবিতাবস্থাতেই রাজ সিংহাসনে আরোহন করবেন। রাজা ভীত হয়ে শিশুটিকে ত্যাগ করতে আদেশ করলেন। এইরূপ কথিত আছে যে, শিশুটি পরিত্যক্ত হলে স্বয়ং ধরণী তাকে লালন করেছিলেন। অতঃপর শিশুটির নাম হয় কুন্তন বা কুস্তন। এই বালকই পরবর্তীকালে খোটান রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। এই স্থানেই ধর্মাশোকের যশ নামক মন্ত্রী হাজার অনুচর সহ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। কুন্তন খোটানের রাজা এবং বৈশ্লষণ মহাদেবী সেই স্থানের প্রধান দেবতারূপে পূজিত হতে লাগলেন। 

ব্ৰহ্মদেশীয় :

ব্রহ্মদেশীয় কাহিনীতে উল্লেখ আছে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দেহত্যাগের পর তাঁর পুত্র বিন্দুসার ১৬ বৎসর বয়সকালে মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন। বিন্দুসারের রাজত্বকাল ২৭ বৎসর এবং তাঁর ১০১ টি পুত্র সন্তান ছিল। ধর্মা ছিলেন তাঁর প্রধান মহিষী এবং তাঁদের দুটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। পিতা বিন্দুসারের দেহত্যাগের পর অশোক পাটলিপুত্রে প্রত্যাবর্তন করলে রাজপুরী তাঁর নিকট শত্রুপুরীতে পরিণত হয়। তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা সুযীম বা সুমন তাঁর বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হলেন। অশোকের অন্যান্য ভ্রাতাগণও তাঁর বিপক্ষে ছিলেন। সুমন অন্যান্য ভ্রাতাগণ যুদ্ধে অশোকের নিকট পরাজিত এবং নিহত হলে অশোক পাটলিপুত্রের সিংহাসন অধিগ্রহণ করেন। 

কাশ্মীর অঞ্চলের কাহিনী :

কাশ্মীর অঞ্চলের প্রচলিত কাহিনীতে উল্লেখ যে, কলহন রচিতরাজতরঙ্গিনীনামক সংস্কৃত গ্রন্থে কাশ্মীরের ইতিহাস এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের রাজন্যবর্গের ইতিহাস সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত আছে। এই অশোক সম্পর্কে অনেক তথ্য কাশ্মীরের অনেক সুবিন্যস্ত ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থানের সঙ্গে অশোকের নাম যুক্ত আছে। অশোকের সময়কালে কাশ্মীর মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। এই সময় অশোক কাশ্মীরে পাঁচশত সংঘারাম নির্মাণ করেছিলেন।রাজতরঙ্গিনী' হতে অবগত হওয়া যায় যে, অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেও সম্পূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। বিজয়েশ্বর নামক শৈবতীর্থের উন্নতির জন্য তিনি অর্থ সাহায্য করেছিলেন। এছাড়া তিনি কাশ্মীরেঅশোকেশ্বর' নামক ২টি মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন। তার মধ্যে একটি মন্দির কলহনের সময়কালে বিদ্যমান ছিল। কলহনের মতে অশোক শ্রীনগর নামক নগরের প্রতিষ্ঠাতা। খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত এই স্থানেই কাশ্মীরের রাজধানী ছিল। পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ শতাব্দীতে রাজা দ্বিতীয়প্রবরসেন সুর' নামে অপর একটি রাজধানী নির্মাণ করেছিলেন।

সাহিত্য পরম্পরা:

অশোকাবদান মহাবংশের বর্ণনানুযায়ী অশোক সম্পর্কিত কাহিনীগুলি ভারতীয় মহাবংশের সিংহল দেশীয়। মহাবংশে লিখিত আছে যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং অশোকের পিতামহ কিন্তু অশোকাবদানে চন্দ্রগুপ্তের নাম মাত্র উল্লেখিত নেই। মহাবংশে রয়েছে যে, সম্রাট বিন্দুসারের শুভদ্রাঙ্গী ব্যতীত আরও ১৫ জন মহিষী ছিল। তবে অশোকাবদানে শুভদ্রাঙ্গীর নাম পাওয়া গেছে। মহাবংশ বিন্দুসারের সর্বমোট ১০১ পুত্র সন্তান ছিল। জ্যেষ্ঠের নাম সুমন এবং কনিষ্ঠের নাম তিস্য কিন্তু অবদানের নাম সুযীম। মহাবংশে আরো উল্লেখ আছে যে, বিন্দুসারের মৃত্যুকালে উজ্জয়িনীর শাসনকর্তা পদে আসীন ছিলেন এবং বিন্দুসারের মৃত্যু সংবাদশ্রবণ করে তিনি পাটলিপুত্রে উপস্থিত হয়ে সুমন এবং ৯৯ জন ভ্রাতাকে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে বসেন। অবদান গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে পিতার মৃত্যুকালে তিনি পাটলিপুত্র নগরেই ছিলেন। মহাবংশ অবদান গ্রন্থের অনেক পার্থক্য বিদ্যমান তবে একথা সত্য যে অশোকের সিংহাসন লাভের পথ মোটেও মসৃণ ছিল না।

অশোকের ৯৯ জন ভ্রাতৃহত্যার বিবরণ মহাবংশে বর্ণিত হলেও অবদান গ্রন্থে ভ্রাতৃহত্যার উল্লেখ নেই। কিন্তু অশোকের নৃশংসতার বিবরণ অবদান গ্রন্থে অন্যভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহাবংশ মতে রাজা বিন্দুসারের মৃত্যুর বছর পর অশোকের অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এবং রাজ্যভিষেককালেই অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। যুবরাজ সুমনের পুত্র শ্রমণ নিগ্রোধ সম্রাট অশোককে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। অবদান গ্রন্থে এক অলৌকিক ভিক্ষু দ্বারা অশোকের জীবনের পরিবর্তন সাধিত হয়। মহাবংশে ভিক্ষু উপগুপ্তের কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু মৌদগলিপুত্র তিস্যর উল্লেখ রয়েছে। মহেন্দ্রের সিংহল যাত্রা উভয় কাহিনীতে বর্ণিত হলেও মহাবংশ মতে মহেন্দ্র অশোকের পুত্র। অশোকের রাজ্যভিষেকের পর খ্রীঃ পূঃ ২৬৮ অব্দে অশোকের কনিষ্ট ভ্রাতা তিস্য ভ্রাতুষ্পুত্র অগ্নিব্রহ্ম এবং পৌত্র সুমন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

শুয়াং জাঙর মতে অশোক ৮০ হাজার বৌদ্ধস্তূপ এবং সংঘারাম নির্মাণ করোছিলেন। তিনি অশোক নির্মিত অনেক বৌদ্ধস্তূপের কথা লিখেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ যে সকল স্থানে ধর্মপ্রচার করেছিলেন, সেই সকল স্থানে অশোক বৌদ্ধ স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। আরো উল্লেখ আছে যে, মহেন্দ্র হলেন অশোকের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। মহেন্দ্র প্রাসাদের সকল সুবিধা ত্যাগ করে বৌদ্ধ শ্রমণদের সঙ্গে ধর্মপ্রচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ( দ্য লাইফ অফ হিউয়েন সাঙ, পৃ: ১২৮)

দিব্যাবদানে উল্লেখ আছে যে অশোক অত্যন্ত কুৎসিত ছিলেন তাই বিন্দুসার অশোককে পছন্দ করতেন না। পালি মহাবংশ সাহিত্যে গর্ভবতী সুভদ্রাঙ্গীর অদ্ভুত স্বপ্নের কথাও আলোচিত হয়েছে। এও প্রচলিত আছে যে বুদ্ধ কয়েকশত বৎসর পূর্বে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে, তাঁর নির্বাণের শত বৎসর পরে অশোক নামে এক রাজার আবির্ভাব হবে এবং তিনি সমগ্র জম্বুদীপের অধীশ্বর হবেন। দিব্যাবদানে উল্লেখ আছে যে অশোকের জন্মের সময়কালে একজন আজীবক সন্ন্যাসী তাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে, অশোকের শরীরে বহু লক্ষণ বিদ্যমান। তিনিই মগধের অধীশ্বর হবেন। এই আজীবক সন্ন্যাসীর নাম ছিল 'পিঙ্গল বৎস' 

সম্রাট বিন্দুসারের আদেশে অশোক তক্ষশিলার বিদ্রোহ দমনে গমন করেন। তক্ষশিলার বিদ্রোহের কারণগুলি ছিল-

) তক্ষশিলা ছিল পারস্য সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত।

) মৌর্য সংস্কৃতির সঙ্গে তক্ষশিলা সংস্কৃতির (ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মাচরণ) কোনরূপ মেলবন্ধন ছিল না। 

) মৌর্য শাসক প্রেরীত অমাত্যগণকে তক্ষশিলাবাসী পছন্দ করত না। 

) যুবরাজ সুষীমেরউদ্ধত্বপূর্ণ আচরণ তক্ষশিলাবাসীর মনঃপুত ছিল না। 

) মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে তক্ষশিলাবাসীর কর বিন্যাসের বিপুল পার্থক্য ছিল। 

) অশোক বিনাযুদ্ধে তক্ষশিলাবাসীর সমস্যাগুলি দূরীভূত করে উক্ত অঞ্চলে শান্তি স্থাপন করলেন।

দীনেশচন্দ্র সরকার বর্ণিত ঘটনাটি ছিল অশোকের আগমনের সংবাদেই বিদ্রোহ শান্ত হলে, অশোক তক্ষশিলা নগরীর আড়াই যোজন দূরে অবস্থানকালে উক্ত অঞ্চলের জনগণ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের অমাত্যগণের অত্যাচারের কাহিনী তাঁকে বিবৃত করলেন। অশোক তাদের আশ্বস্ত করে শান্তি স্থাপন করলেন, অবশেষে বিদ্রোহ শান্ত হলো।

অশোক ছিলেন বিচক্ষণ, কূটকৌশলী এবং যুদ্ধ বিদ্যায় নিপুন। তক্ষশিলা বিদ্রোহ দমনের পর পুনরায় উজ্জয়িনীর শাসনকর্তা রূপে নির্বাচিত হন এবং বিদিশা অঞ্চলের এক বণিকের কন্যাদেবীকে বিবাহ করেন। এই দেবীর গর্ভে পুত্র মহেন্দ্ৰ কন্যা সংঘমিত্রার জন্ম হয়।

অশোক বা প্রিয়দর্শী' গ্রন্থে চারুচন্দ্র বসু লিখেছেনঅশোকের গিরিলিপিতে অন্যান্য অনুশাসনে তাঁর ভ্রাতা এবং ভগিনীগণের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। একমাত্র কনিষ্ট সহোদর জীবিত থাকলে ভ্রাতা ভগিনীগণের প্রতি এইরূপ উক্তি প্রস্তরগাত্রে খোদিত অনুশাসনে দেখা যেতনা। সুযীমের শোচনীয় মৃত্যুতে গৃহে গৃহে ভ্রাতৃহত্যার অপবাদ প্রচলিত হয়েছিল। তা নানা বর্ণে অতিরঞ্জিত হয়ে, এই সকল অমূলক নৃশংস অত্যাচারের কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়েছে বলে মনে হয়। অথবা বৌদ্ধ গ্রন্থকারগণ অশোকের ধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে এই সকল কাজের চিত্র বর্ণনা দ্বারা অশোক চরিত্রের বিস্ময়কর পরিবর্তন সূত্রে বৌদ্ধ ধর্মের মহিমা ঘোষণা করতে চেষ্টা করেছেন। তা সত্য বলে প্রতিপন্ন হয় না। সুতরাং এই সকল কথাগুলির মূলে যে আদৌ কোন সত্য নিহিত নেই, তাও নিঃসংশয়ে রূপে বলা দুরূহ। আব্ৰাহ্ম তরালি প্রায় একই ধরনের মূল্যায়ন করেছেন। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে অশোককে কখনই চণ্ডাশোক বলা হয়নি। সম্ভবত কোন বিবৃত তথ্য অশোক সম্পর্কে এইরূপ প্রচার করেছিল। (জেম এফ লোটাস, পৃ: ৩৮৯)

অশোকের সিংহাসনে আরোহণ কালও সংশয়পূর্ণ। কোসাম্বীর মতে খ্রীঃ পূর্ব ২৭০ অব্দে অশোক সিংহাসনে আরোহন করেন, জে. এফ. ফ্লিটের মতে অশোকের অভিষেক হয় খ্রীঃ পূর্ব ২৬৪ অব্দের ২৫ এপ্রিল।

ভিনসেন্ট স্মিথের মতে খ্রীঃ পূর্ব ২৬৮ অব্দে। ক্যানিংহাম-এর মতে ২৬০ খ্রীঃ পূর্ব। অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মতে সময়কালটা ছিল ২৬৯ ২৭৭ খ্রীঃ পূর্বের কোন একটি সময়ে।

অশোকের রাজ্যভিষেকের কাল সম্পর্কিত বিভিন্ন অভিমত-

বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ

ক্যানিংহামারের মতে, অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল ২৬০ খ্রীঃ পূর্ব, আর মহাপরিনির্বাণ ৪৭৮ খ্রীঃ পূর্ব। 

ম্যাক্সমূলারের মতে, অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল ২৫৯ খ্রীঃ পূর্ব, আর মহাপরিনির্বাণ ৪৭৭ খ্রীঃ পূর্ব।

সিংহলীর মতে, অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল, ৩২৬ খ্রীঃ পূর্ব, আর মহাপরিনির্বাণ ৫৪৩ খ্রীঃ  

ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল ২৬৮ খ্রীঃ পূর্ব, আর মহাপরিনির্বাণ ৪৮৩ খ্রীঃ

জে. এফ. ফ্লিটের মতে, অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল ২৬৪ খ্রীঃ পূর্ব, আর মহাপরিনির্বাণ ৪৮৩ খ্ৰীঃ

এই সকল অভিমতগুলির মধ্যে ভিনসেন্ট স্মিথের অভিমতটি সঠিক বলে অনেকে মনে করেন। আবার স্মিথ এবং ফ্লিটের প্রদত্ত সময়কাল কাছাকাছি। শুধু পার্থক্য একটাই স্মিথ বিন্দুসারের রাজত্বকাল ২৫ বৎসর গণনা করেছেন। ফ্লিট সেই স্থলে ২৮ বৎসর ধরেছেন। ১৯০১ খ্রীঃ রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় (১ম খণ্ডে) ফ্লিটের অভিমতটিকে গ্রহণ করা হয়েছে। 

মহাবংশ এবং সমস্তপাসাদিকার উপক্রমনিকা হতে এসব তথ্য লাভ হয় যে বুদ্ধের পরনির্বাণের ২১৮ বৎসর পরে অশোক পাটলিপুত্রের সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। অমিত্রাঘাত ২৭২ খ্রীঃ পূর্ব অর্থাৎ বুদ্ধের পরিনির্বাণের ২১৪ বৎসর পরে দেহত্যাগ করেন। সুতরাং এই চার বছরের মধ্যে যে অশোক মগধের সিংহাসনে অভিষিক্ত হন নি, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এই অভিষেক এবং বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ কালের মধ্যে কলিঙ্গ বিজয় তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা

কলিঙ্গ অতি প্রাচীন প্রদেশ। খ্রীঃ ৭ম শতাব্দীতে কলিঙ্গ রাজ্য বর্তমান গঞ্জাম প্রদেশের প্রায় ২৫৩ মাইল দক্ষিণে পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। ঐতিহাসিক প্লিনি এই কলিঙ্গ রাজ্যকে টি অঞ্চলে বিভক্ত করেছিলেন। কলিঙ্গ, মধ্য কলিঙ্গ, এবং মহাকলিঙ্গ। আবার বলেছি ত্রিলিঙ্গন (তিগলিপাট্রন) নামে একটি জনপদের কথা উল্লেখ করেছেন। . রাজেন্দ্রলাল মিত্র ত্রিকলিঙ্গ অর্থে তিনটি কলিঙ্গ নির্ণয় করেছেন। উৎকলিঙ্গের অর্থ হল উৎকল। কালপুরির অনুশাসন হতে জানা যায় যে, চেদীয় হৈহয় রাজবংশ কালাঞ্চর পুর এবং ত্রিকলিঙ্গের অধীশ্বর ছিলেন। বেশান্তর জাতকেও কলিঙ্গের বর্ণনা আছে। ক্যানিংহামের মতে কৃষ্ণানদীর তটশোভিত অমরাবতীর প্রধান রাজ্য, প্রাচীন তন্ত্ররাজ্য, এবং কলিঙ্গ (রাজমহেন্দ্রী বা রাজমুণ্ডরী) এই তিনটি প্রদেশ ত্রিকলিঙ্গ নামে অভিহিত হত।

শুয়াং জাঙ ৭ম শতাব্দীতে ভারত ভ্রমণকালে কলিঙ্গ দেশে আগমন করেছিলেন। শুয়াং জাঙের ভ্রমণের সময়কালে ললিতেন্দ্রকেশরী এই প্রদেশে রাজত্ব করতেন। কলিঙ্গের ধারাবাহিক ইতিহাস এবং রাজবংশের কোন বিবরণ দৃষ্টিগোচর হয় না। মহাবংশেও কলিঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। কলিঙ্গ রাজকুমারী বঙ্গরাজের প্রধান মহিষী ছিলেন। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর কলিঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্ত বুদ্ধের দত্ত ধাতুর সংরক্ষণ করে তার উপর একটি সুবৃহৎ স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। সুজিত কুমার আচার্যের মতে, অশোক যখন কলিঙ্গ জয় করেন তখন সেখানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। কলিঙ্গযুদ্ধ হয়েছিল তাঁর সিংহাসন আরোহণের ৮ম বৎসরে। অশোকের ত্রয়োদশ শিলালেখাতে উল্লেখ আছে, রাজ্যাভিষেকের ৮ম বৎসর পরে দেবগণের প্রিয় রাজা প্রিয়দর্শী কলিঙ্গ জয় করেন। এই যুদ্ধে দেড় লক্ষ মানুষের নির্বাসন এক লক্ষ মানুষের প্রানহানি ঘটে। অতঃপর কলিঙ্গদেশে অধিকৃত হলে দেবপ্রিয় অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ধম্ম আচরণ এবং ধর্মপ্রচারে মনোনিবেশ করেন। কলিঙ্গ জয় করে দেবপ্রিয়ের অনুশোচনা জন্মায়। কোন স্বাধীন দেশ জয় করতে গেলে সেখানে যত মানুষ নিহত হয়, মৃত্যু মুখে পতিত হয় এবং বন্দি অবস্থায় নির্বাসিত হয় তা দেবপ্রিয়ের কাছে অত্যন্ত বেদনার বিষয় বলে মনে হয়েছে। .... দেবপ্রিয় এখন ধর্ম বিজয়কে শ্রেষ্ঠবিজয় বলেই মনে করেন। বি. এন. ঝা এবং ইতিহাসবিদ রামশরণ শর্মা অতিরঞ্জিত বলে বর্ণনা করেছেন। (ভারতের প্রাচীন অতীত, রামশরণ শর্মা, পৃ: ১০৮) তবে বালকৃষ্ণ গোবিন্দ গোখলে শর্মার অভিমতকে সমর্থন করেন নি। তিনি বলেছেন, 'চন্দ্রগুপ্তের সময়কাল হতেই মৌর্য সাম্রাজ্যে এক সুশৃঙ্খল আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অশোকের আমলেও তা বিদ্যমান ছিল। এইরূপ রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এতবড় যুদ্ধ নিয়ে মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত করে কিছু উল্লেখ করাতে তা অবশ্যই রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপক্ষে যেত এবং সাধারণ মানুষের নিকট অশোকের গ্রহণযোগ্যতাও বিনষ্ট হত। সুতরাং অশোকের অনুশাসনে উল্লেখিত সকল তথ্যই সত্য এবং নির্ভুল এটি ন্যায়সঙ্গত ভাবেই বলা যায়। (প্রাচীন ভারতে ইতিহাস সংস্কৃতি, পৃ:-৪২) কলিঙ্গ যুদ্ধ পরবর্তী যে প্রতিক্রিয়া অশোক তাঁর ত্রয়োদশ প্রধান শিলালেখতে লিপিবদ্ধ করেছেন। সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক রাজমোহন গান্ধী এক বিরাট মূল্যায়ন করেছেন, -সবদিক হতে কলিঙ্গ যুদ্ধ অশোকের জীবন কর্মপদ্ধতিকে বদলে দিয়েছিল। যুদ্ধের ভয়ানক ফলাফল তাঁকে পরিবর্তন করেছিল। যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তির পথ অনুসরণ করেছিলেন। (রিভে এণ্ড রিবন সিলিয়েশন, পৃ: ৬১) এসারিব মতে অশোকের চেয়ে বৃহৎ কোন শাসকের অস্তিত্ব দুনিয়ার ইতিহাসে নেই।ধর্ম বিজয়রাজ্যের নীতি করলেও সম্রাট অশোক কিন্তু রাজধর্ম কখনো ত্যাগ করেন নি। কলিঙ্গ জয় করে সেই রাজ্যকে তিনি যথেষ্ট কব্জায় রেখেছিলেন। সম্রাট হিসেবে বিদ্রোহীদের শাস্তি যা দেবার তিনি দিয়েছিলেন, সুবিচারে। কলিঙ্গে নিযুক্ত রাজকর্মচারীদের উপর সম্রাট ব্যক্তিগত তদারকি কায়েম রেখেছিলেন। বৌদ্ধ হলেও তিনি যে সম্রাট, তিনি তার যথেষ্ট প্রমাণ দিয়েছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মকে সরকারি ধর্ম মতে পরিণত করেন নি।

আমার মতে সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ আক্রমণ আর একটা অন্যতম কারণ ছিল অখণ্ড ভারতবর্ষ স্থাপনা। যা ছিল চাণক্য এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অদূরাস্বপ্ন। চন্দ্রগুপ্ত অখণ্ড ভারতবর্ষ স্থাপন করতে পারলেও কলিঙ্গ মগধ সাম্রাজ্যের বাইরে ছিল। সম্রাট মগধ সাম্রাজ্যের বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কলিঙ্গ আক্রমণ করে করায়ত্ব করেন। তাছাড়া একদা কলিঙ্গ সম্রাট অশোকের বাল্যাবস্থায় তাঁর মাকে দাসীপুত্র হিসাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিল সেরকম একটা প্রবাদ আছে তবে তা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে এই কথা হলফ করে বলা যায় যে চাণক্য যে অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্ন স্রষ্টা ছিলেন তার পরিপূর্ণতা দান করেছিলেন সম্রাট অশোক এবং তাই অশোককেই প্রকৃত অর্থে অখণ্ড ভারতের প্রতিষ্ঠাতা বা জনক বললে অত্যুক্তি হবে না।

অশোকের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ হেমচন্দ্র রাজচৌধুরী লিখেছেন শক্তিশালী কলিঙ্গ রাজ্য বিজয়ের মাধ্যমে অশোক তাঁর যুদ্ধযাত্রায় ইতি টানলেন। উত্তর-পশ্চিমে হিন্দুকুশ হতে দক্ষিণে পেনারনদী পর্যন্ত বিস্তৃতি ছিল অশোকের সাম্রাজ্য। কলিঙ্গ বিজয়ের পর অশোকের সুবিশাল সাম্রাজ্য ৫টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। সেগুলি হল - ) উত্তরাপথ, ) অবন্তী, ) দক্ষিণাপথ, ) কলিঙ্গ, ) মগধ, এই পাঁচটি প্রদেশের রাজধানী ছিল যথাক্রমে) তক্ষশীলা, ) উজ্জয়িনী, ) সুবর্ণগিরি, ) তোসলা এবং পাটলীপুত্র।

সুপ্রাচীন ভারতের নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম এবং পরবর্তী সময়কালে মৌর্য শাসকের অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। খ্রীঃ পূর্ব ষষ্ঠ শতকে এবং তৃতীয় শতকের সময়কালে ভারতবর্ষে ন্যারায়ন এবং বিকাশে বৌদ্ধধর্ম ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতি বৌদ্ধসংঘের অমূল্য অবদান ছিল।

বিশিষ্ট ঐতিহাসিক বি. এন. ঝা বলেছেন, মৌর্যদের উদ্যোগে যোগাযোগ ব্যবস্থার যে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল তার প্রমাণ আছে। পাটলিপুত্র বৈশালীর মাধ্যমে নেপালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারতের সঙ্গে পাটলিপুত্রকে যুক্ত করেছিল।

পালি বৌদ্ধ সাহিত্যে তপসুন ভল্লিক নামক দুইজন বণিক ভ্রাতা বুদ্ধগয়ার নিকটবর্তী উরুবেলাতে এসেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। এই দুইজন বণিক কলিঙ্গের এক সমুদ্র বন্দর থেকে তাদের বাণিজ্য সম্ভার নিয়ে এখানে এসেছিলেন বলে মনে হয়। এই বিবরণ হতে জানা যায় যে, মধ্য এবং নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যকা তথা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক আদান প্রদান মগধ, কলিঙ্গের রাজপথ, সমুদ্র বন্দরগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। (ভারতের ইতিহাস, দীপক রঞ্জন দাস, পৃ: ৭৫)

কলিঙ্গ বিজয়ের অব্যহতি পর হতে অশোক বুদ্ধের অনুসৃত মার্গের প্রতি প্রবল অনুরাগের সৃষ্টি হয়। এবং সুবিশাল উৎসাহের সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম প্রচার আরম্ভ হয়। অশোক তাঁর গিরিলিপিতে বিবৃত করেছেন, তিনি সার্দ্ধ দ্বিবৎসর কাল গৃহী শিষ্যরূপে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তবে এই লিপি প্রচারের বৎসরকাল পূর্বেই তিনি বৌদ্ধসংঘের আশ্রয় লাভ করেছিলেন। এমনও প্রবাদ আছে যে অশোক অতি অল্প বয়সে বৌদ্ধসংঘের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। কিন্তু তা তাঁর বয়সের অপ্রতুলতার কারণে সংশয় ত্যাগ করে বা দূরে সরে যান। উক্ত লিপি হতে অশোকের জীবনের চার বৎসরের ইতিহাস পাওয়া যায়। খ্রীঃ পূর্ব ২৬১ অব্দে বা অশোকের রাজ্যাভিষেকের নবম বৎসর পরে সম্ভবত কলিঙ্গ রাজ্য বিজিত হয়। রাজ্যাভিষেক হতে ত্রয়োদশ বৎসর পরে অর্থাৎ খ্রীঃ পূর্ব ২৫৭ অব্দে কলিঙ্গ রাজ্য আক্রমণ এবং বিহারের বর্ণনা সংকলিত প্রস্তর শাসন লিপি (ত্রয়োদশ গিরিলিপি সাহবাজ গিরি) প্রচারিত হয়। 

অশোকের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ সম্পর্কে নানাবিধ কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। মহাবংশে বর্ণিত আছে যে, যুবরাজ সুযীম-এর পুত্র নিগ্রোধ শ্রমণের নিকট হতে বুদ্ধের উপদেশগুলি শ্রবণ করে সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে প্রবল আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অপরদিকে অশোকাবদানে লিপিবদ্ধ আছে যে অশোক রাজধানীতে নরকপুরী নামক এক রমনীয় হত্যাগৃহ নির্মাণ করে চন্দ্রগিরি নামক এক কুখ্যাত জল্লাদকে হত্যাকার্যে নিযুক্ত করেছিলেন। এই হত্যাগৃহে ভিক্ষু সমুদ্রগুপ্ত বা উপগুপ্ত তাঁর অলৌকিক ঋদ্ধি বলে অশোকের শ্রদ্ধা এবং বিস্ময় উপাদান পূর্বক তাঁকে বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেন। মহাবংশে অপর একটি কাহিনী বিবৃত আছে এখানে তা উল্লেখের অবদান। রাখছি না কারণ অতি অলৌকিক কাহিনীতে ভরপুর তার কোন সত্যতা প্রমাণিত হয়। না, যাই হোক, যে পরিবর্তনের দ্বারা অশোকের জীবন, চরিত্র এবং সমগ্র রাষ্ট্রনীতির আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল তা বুদ্ধের অহিংসবাদ।

অশোকের পিতা বিন্দুসার ছিলেন ব্রাহ্মণ্য মতবাদের অনুসারী। তিনি শত সহস্র ব্রাহ্মণকে প্রতিপালন করতেন। অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পূর্বে মতেরই অনুসারী ছিলেন। তিনি অতিশয় মৃগয়া প্রিয় যুদ্ধপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তিনি তাঁর পূর্ব জীবন ত্যাগ করে বুদ্ধশাসন জগতে প্রচার করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। 

ত্রয়োদশ গিরিলিপি হতে জানা যায় যে, কলিঙ্গ বিজয়ে অশোক যে বেদনা বহুল ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তার ফলেই তিনি হিংসার পথ পরিত্যাগ করে এই মহান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তার উল্লেখ করেননি।


সম্রাট অশোক শিলালিপিতে ধর্ম, শব্দ বহুবার বহুভাবে ব্যবহার করেছেন। সম্রাট ধর্ম বলতে বুঝিয়েছেন নৈতিক আদর্শ, যা সব ধর্মেই রয়েছে। দান, দয়া, সত্যবাদিতা, সংযম, অহিংসা, গুরুজনদের ভক্তি, সহনশীলতা, ক্ষমা, সুব্যবহার, সৎ নির্মলজীবন। স্নেহশীলতা প্রভৃতি হচ্ছে সম্রাট অশোকের ধর্ম। ধর্ম শব্দের মাধ্যমে সম্রাট অশোক বুদ্ধের ধর্ম প্রচার করেন নি। নীতিজ্ঞান বিস্তার করে মানুষের মন জয় করাকে সম্রাট বলেছেন 'ধর্ম বিজয়' সম্রাট নিজে বৌদ্ধ হলেও তিনি সেই প্রজাদের উপর মোটেও চাপান নি। তিনি সবাইকে নৈতিকতায় উন্নত করতে চেয়েছিলেন। “Ashoke personal religion was no doubt Buddhism but his dhamma was a collection of some of the great principle of ethics which were not exclusively the monopaly of Buddhism, Indeed now where in the edicts does he mentation the chief charecterists of Buddhism to wife. the four noble truthes the eight fold paths, and the goal of niavana.(history of ancient India. (Dr. R S Tripathi).

সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে প্রধান ঘটনা হল তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি অশোকের রাজপদে অভিষিক্ত হওয়ার পর সপ্তপদ বৎসর পরে এই সভার অধিবেশন হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের সংঘ প্রধান তিস্য বৌদ্ধধর্মে স্বার্থান্বেষী ভিক্ষুবেশী প্রতারকগণের অধিকমাত্রায় অনুপ্রবেশ দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। প্রকৃত সদাচারী ভিক্ষুগণ এই সকল দুনীর্তি পরায়ণ, কপট ভিক্ষুদের অত্যাচারে জম্বুদ্বীপের কোন বৌদ্ধ বিহারে উপাসনা কিংবা প্রবারণা অনুষ্ঠান করতে পারতেন না।

অশোক বৌদ্ধধর্মের এই অবনতির কথা শ্রবণ করে, এই গ্লানি দূরীভূত করার জন্য একজন অমাত্যকে অশোকারামে প্রেরণ পূর্বক ভিক্ষু সংঘকে উপোসথ অনুষ্ঠান করতে অনুরোধ করলেন। ভিক্ষুসংঘ কপটচারীগণের সঙ্গে উক্ত অনুষ্ঠান করতে অসম্মত হলে রাজ অমাত্য কুপিত হয়ে ভিক্ষুগণকে হত্যা করেন। অশোক সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হয়ে ব্যাকুল হৃদয়ে অশোকারামে উপস্থিত হলেন এবং হত্যাজনিত পাপ কিভাবে মোচন করবে সেই বিষয়ে সমবেত ভিক্ষুসংঘকে প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পেলেন না। অশোকের বিমর্ষতা দেখে ভিক্ষুসংঘ জানালেন; একমাত্র তিস্য সমস্যার সমাধান করতে পারেন।

ভিক্ষুদের স্থবিরের নিকট প্রেরণ করলেন। সকলে স্থবিরের নিকট উপস্থিত হয়ে বৌদ্ধধর্মের পবিত্রতার রক্ষা করার জ্ঞাপন করলে স্থবির অশোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হেতু রতিবৰ্দ্ধন নামক প্রাসাদে উপস্থিত হলেন। স্থবির মোগলিপুত্ত তিস্যের অনুরোধে সপ্তম দিবসের মধ্যে সম্রাট নানা স্থানে দূত প্রেরণ করে সমস্ত ভিক্ষুসংঘকে আহ্বান করলেন। ভিক্ষুসংঘ সমবেত হলে স্থবির সহ অশোক সকল ভিক্ষুকে একে একে আহ্বান করে বুদ্ধের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা শাশ্বতবাদ এবং অন্যান্য মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন প্রত্যুত্তর প্রদান করলে সেই ভিক্ষুগণকে ভিক্ষুসংঘ হতে বিতাড়িত করলেন। প্রকৃত ভিক্ষুকে অশোক প্রশ্ন করলে তাঁরা প্রত্যুত্তরে বিভজ্যবাদ বা বিচারমূলক ধর্মের উল্লেখ করলেন। স্থবির তখন সেই অসংখ্য ভিক্ষুগণের মধ্যে হতে এক সহস্র অরহতকে বা রিপুজয়ীদের ধর্ম সঙ্গীতির জন্য নির্বাচন করলেন। এই সকল ভিক্ষুরা সকলেই ছিলেন ত্রিপিটকজ্ঞ, সুপণ্ডিত, সংযমী, জিতেন্দ্রিয় এবং বহু গুণসম্পন্ন। 

অশোক অনুশাসনের সবগুলি এখনো অনাবিষ্কৃত। যা আবিষ্কৃত হয়েছে তার দ্বারা অশোকের রাজত্বের সমগ্র ঘটনাবলী বিবেচনা করা সম্ভব নয়। অনুশাসন গিরিলিপিতে যে ঘটনাগুলির উল্লেখ আছে তা সম্পূর্ণরূপে প্রমাণসিদ্ধ। তবে যে ঘটনা সমূহের উল্লেখ নেই, তা আদৌ সংঘটিত হয় নি। একথাও মেনে নেওয়া যায় না, কারণ পুষ্যমিত্র শুঙ্গ নামক ব্রাহ্মণ রাজা মৌর্য সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে ব্রাহ্মণদের পৃষ্ঠপোষকতায় যে সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন তা বৌদ্ধদের পক্ষে সুখবর ছিলনা। তাঁর সময়কালে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু, গৃহস্থ, উপাসক এবং বৌদ্ধবিহার স্থাপত্য ধ্বংস করা হয়েছিল। সম্ভবত তার সময়কালেই অশোকের গিরিলিপির মূল্যবান অংশগুলির ক্ষতি সাধন করা কোনো কঠিন কাজ ছিল না বলেই মনে হয়। এই বিষয়গুলি নিয়েই ঐতিহাসিকগণ নীরব থেকে গেছেন। বিশেষত ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসও সযত্নে রক্ষিত হয় নি। কারণ শুঙ্গ শাসন, সেনযুগ এবং অবশেষে ইসলামিক শাসনকালে বহু বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়, বৌদ্ধ স্থাপত্য বৌদ্ধগ্রন্থের বিলোপ সাধন করা ইত্যাদি কারণে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্ম নিঃশেষিত প্রায় এছাড়া বিদেশী পরিব্রাজকদের নিকট হতে সমুদায় বৌদ্ধধর্মের ঐতিহাসিক তথ্য আহরণ করাও সম্ভব। কারণ লোকশ্রুতি এবং অবৌদ্ধ শাসকদের দুরাচার। সুতরাং তাঁদের গ্রন্থসমূহে তৃতীয় ধর্মসঙ্গীতের কোন উল্লেখ নেই। অর্থাৎ ধর্মসঙ্গীতির ঘটনা অসত্য বা কল্পিত তা নির্ধারণ করার অর্থই হল সত্যকে মিথ্যা দ্বারা আচ্ছাদিত করা।

বৌদ্ধধর্ম মহাসঙ্গীতি অধিবেশন সমাপ্ত হওয়ার পর মহামতি অশোক ভিক্ষুসংঘ কর্তৃক অনুপ্রাণীত হয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের নিমিত্তে বিহার স্তূপ নির্মাণ করেন। অশোকারাম বিহার নির্মিত হওয়ার পর বৌদ্ধতীর্থ পরিভ্রমণ। সাতদিন ব্যাপী দীপাবলী উৎসব, নগর প্রান্তে ধর্মপ্রচার, উৎকীর্ণ শিলালিপির দ্বারা ত্রিরত্নের গৌরব ঘোষণা ইত্যাদির দ্বারা ধর্মপ্রচার নীতি আরম্ভ করলেন। সারা বিশ্বে বিস্তৃতভাবে ধর্মপ্রচারের দায়িত্ব তিনি মোগ্গলিপুত্ত তিস্যকে অর্পণ করেন এবং স্থবির ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এবং ভারত বহিঃভূত নানা বৈদেশিক রাষ্ট্রে ধর্মপ্রচারকগণকে প্রেরণ করলেন।

বৌদ্ধধর্ম অন্যান্য ধর্ম হতে এই কারণে পৃথক যে এই ধর্ম মানবিক এবং বিশ্বশান্তির ধর্ম। এই ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে হত্যা বা কোনরূপ বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হয় নি। বৌদ্ধধর্মে সংকীর্ণতা উগ্রধর্মান্ধতা অনুপস্থিত। বৌদ্ধধর্মে কোন জাতি বিশেষ একাধিপত্য নেই। বুদ্ধ বোধিদ্রুম তলে যে জ্ঞান লাভ করেছিলেন তা তিনিচরথ ভিক্খবে চারিকং বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায় লোকানুকম্পায় অথায় হিতায় সুখায়....”

দ্বীপবংশ মহাবংশে সম্রাট অশোক কর্তৃক ধর্ম প্রচারের বিস্তৃত বর্ণনা আছে পুনরুক্তি করা নিষ্প্রয়োজন। দ্বীপবংশ মহাবংশ গ্রন্থদ্বয়ের বর্ণনা ব্যতীত অশোকের শিলালিপি সমূহে ধর্মপ্রচারের উল্লেখ আছে। উত্তর পশ্চিম, পূর্ব এবং মধ্যভারতে অশোক ধর্মপ্রচারার্থে ভিক্ষুগণকে প্রেরণ করেছিলেন। অশোক যে ভিক্ষুগণকে ইরানে ধর্মবিধির প্রচার নিমিত্ত ভিক্ষুগণকে প্রেরণ করেছিলেন, তা দ্বিতীয় ত্রয়োদশ গিরিলিপিতে বর্ণিত আছে।

উৎকীর্ণ শিলালিপি অনুসারে অশোক দ্বারা বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার অঞ্চল নিম্নরূপ- 

) মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশ সমূহ। 

) সাম্রাজ্যের সীমান্ত অর্থাৎ কম্বোজ, গান্ধার, রাষ্ট্রিক, পতিত্ত, নাভাগ, ইত্যাদি এবং নভপন্থী জাতির আবাসভূমি।

) অরণ্য অঞ্চল এই অঞ্চলে বহুবিধ বনচারী জাতির বাসভূমি ছিল।

) দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ্যরাজ্য সমূহ- কেরলপুত্ত, চোল, অন্ধ্র, পাণ্ড্যদেশ।

) সিংহল। 

) মিশর (ইজিপ্ট)

) ইপিরাস ম্যাসিডোনিয়া (বর্তমান গ্রীস)

সিংহলী সাহিত্যে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যসমূহ এবং তদানীন্তন গ্রীকরাজ্যে সমূহে (মিশর, ইপিরাস ম্যাসিডোনিয়া) অশোক দ্বারা বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রেরণের উল্লেখ নেই। দ্বীপবংশ মহাবংশ অশোক পরবর্তী বৌদ্ধ সাহিত্য, আনুমানিক ৬০০ বৎসর পরে রচিত। সম্ভবত সেই সময়কালে গ্রীকরাজ্যে সমূহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। সর্বোপরি ব্রাহ্মণ রাজ্য সমূহ (অন্ধ্র, চোল, কেরল পাণ্ড্য) এর সঙ্গে বৌদ্ধ সিংহলবাসীর সুসম্পর্ক ছিল না, সম্ভবত এই কারনেই হয়ত উক্ত গ্রন্থদ্বয়ে তামিল প্রদেশ সমূহের বৃত্তান্ত বর্ণিত হয় নি। অধ্যাপক স্মিথ, কান্ট, রীম, ডেভিডস, সেনার্ট এবং কার্ল প্রমুখ ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করেছেন যে অশোকের দ্বারাই ভারতবর্ষ হতে বহিঃবিশ্বে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়েছিল। সিংহলী সাহিত্য ব্যতীত তিব্বতী গ্রন্থে স্থবির মঝিম দ্বারা কাশ্মীরে ধর্মপ্রচারের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। সাঁচীর নিকটবর্তী স্তূপ হতে যে ভস্মাধার আবিষ্কৃত হয়েছে তাতেসমগ্র হিমবন্তর আচার্য কাশ্যপখোদিত আছে। ভিক্ষু মহেন্দ্ৰ যে সিংহলে ধর্ম প্রচারার্থে গমন করেছিলেন, তা কেবল থেরবাদী গ্রন্থে নয় এবং মহাযানী গ্রন্থেও বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে। অশোকের ধর্মদূত সুবর্ণভূমিতে উপস্থিত হয়েছিল কিনা এই বিষয়ে সঠিক কোন তথ্য নেই। যদিও সিংহলী গ্রন্থদ্বয়ে বিষয়ের উল্লেখ আছে।

সিংহাসনে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের পূর্বে দেবপ্রিয় তিস্য (খ্রীঃ পূর্ব ৩০৯ অব্দে) বহুমূল্য উপহারসহ মগধরাজ অশোকের নিকট জন দূত প্রেরণ করেন। মহাঅরিষ্ট ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এই জন সিংহল হতে সমুদ্রপথে তাম্রলিপ্ত বন্দরে (বর্তমানে তমলুক) উপস্থিত হন। অতঃপর পাটলিপুত্র নগরে উপস্থিত হয়ে সিংহল নরপতি প্রদত্ত উপহারসমূহ মগধাধিপতিকে প্রদান করলে সম্রাট অশোক তাঁদের যথারীতি সম্মান প্রদান করেন।

অশোক যুগের অনুশাসনাবলী:

ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ভুলুণ্ঠিত হয়েছে ১৭-১৯ শতকের পূর্বে ভারতবর্ষের বৌদ্ধযুগের ইতিহাস সম্পর্কে এদেশবাসী এবং পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গের নিকট কিছুতেই অবগত ছিল না। অনেকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে বলতে হিন্দুযুগ, ইসলামিক আধিপত্যের যুগ এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যুগকে চিহ্নিত করত। কারণ এই ধারাবাহিকতার মধ্যেই সুমহান বৌদ্ধযুগের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছিল।

পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই ইউরোপীয় পণ্ডিতবর্গ এবং বাংলার নব- জাগরণের বলে বলীয়ান শিক্ষিত বাঙালী সমাজের কিয়দংশ বৌদ্ধদর্শন চর্চার মাধ্যমে ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাসকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

প্রাচীন ভারতে অশোকের উৎকীর্ণ শিলালিপি পৃথিবীর পাঠশালায় সর্বপ্রথম অনুশাসনাবলী। অশোকের পূর্বে পৃথিবীর আর কোন সম্রাট এই দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তাঁর অনুশাসনাবলী মূলত চার ভাগে বিভক্ত যথা ) স্তম্ভ লিপি, ) ক্ষুদ্র স্তম্ভলিপি, ) বৃহৎ গিরিলিপি এবং ) ক্ষুদ্র গিরিলিপি।  

অশোকের ধর্মনীতি: 

পালিধৰ্ম্মআর সংস্কৃতেধর্মযার ইংরেজী অর্থ হল রিলিজিয়ন, ইউরোপে রিলিজিয়ন বলতে নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বাস (অর্থাৎ ঈশ্বরবাদ) এবং আচরণ বোঝায়। তবে ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রে ধন্ম বা ধর্মের মূল অর্থ হল সদাচার, যা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে অবশ্য পালনীয়। ওখানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রাসঙ্গিক নয়। সম্রাট অশোকের অনুশাসনে উল্লেখিত ধর্ম বা ধৰ্ম্ম অনেক বেশি বিস্মৃত। এই ধৰ্ম্ম কেবলমাত্র নিজের ধর্ম পালন অর্থে বিধিবদ্ধ হয় নি। সকল ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই ছিল আক্ষরিক অর্থে অশোকের ধর্ম। অন্য অর্থে বলা যায় যে মানবিক গুণাবলীর সমন্বয়ই হল অশোকের ধৰ্ম্ম। বিবেকানন্দ ঝা এবং ইরফান হাবিবের মতে— ‘তিনি যে ধর্ম প্রচার করেছিলেন সেটি প্রকৃত পক্ষে মানসজগত আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গির একটি আকাঙ্খিত রূপ। 

অশোকের ধর্মনীতি প্রসঙ্গে রোমিলা থাপার বলেছেন, অতীত ঐতিহাসিক সাধারণভাবে অশোকের ধৰ্ম্মকে বৌদ্ধধর্মের প্রায় সমার্থক অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন এবং এইভাবে বোঝাতে চেয়েছেন যে, অশোক বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। যদিও তিনি নিজে বৌদ্ধধর্মের একজন দৃঢ় অনুরাগী ছিলেন এবং একথা বিশ্বাস করতেন এই ধর্মই মুক্তির একমাত্র পথ।

অশোক দ্বিতীয় স্তম্ভানুশাসনে ধর্ম্মের সংজ্ঞা অর্থে বলেছেন দেবপ্রিয় রাজা প্রিয়দর্শী এই কথা বলেছেন 'ধৰ্ম্ম' ভালো। আর ধৰ্ম্ম কী? অনেক ভালো কাজ সামান্য ত্রুটি, দয়া, করুণা, সত্যবাদিতা এবং বিশুদ্ধতাই হল ধৰ্ম্ম। আমি নানাভাবে অর্ন্তদৃষ্টি প্রদান করছি। আমি মানুষ, পশু, পাখী সকলেরই অনেক উপকার করেছি এমন কি তাদের প্রাণরক্ষা সহ আরো অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেছি। ধর্ম্মের ওপর এই .....আমি উৎকীর্ণ করালাম যাতে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়।'

ইতিহাসবিদ বি. এন. ঝা লিখেছেন, ‘অশোকের ধর্ম ছিল কিছু নৈতিক বিধি, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণের মনে সামাজিক দায়িত্ব বোধকে জাগ্রত করা। তাঁর ধৰ্ম্ম নীতির মুল লক্ষ্য ছিল মানুষের মর্যাদার স্বীকৃতি দান। সহিষ্ণুতা ছিল অশোকের ধর্মের অন্যতম মূল ভিত্তি।

অশোকের শিলালিপিগুলি পর্যবেক্ষণ করলে তাঁর ধর্ম্মনীতির মূল কথা হল-জীব সমূহের প্রতি দয়া এবং সহিষ্ণুতা, মাতা পিতাকে মান্য করা, বন্ধু, আত্মীয়, শ্রমণ এবং ভিক্ষুদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন। জীব হত্যা হতে বিরতি, মিতব্যয়ী হওয়া, নিজস্ব ধন অর্জন করা ইত্যাদি। তাঁর অন্যান্য ধৰ্ম্মরীতি সমূহগুলি হল, জীবের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ ত্যাগ করা, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিরোধ ত্যাগ করা। দাস এবং ভৃত্যদের প্রতি সদাচার করা, সত্যবাদিতা, করুণা, বিশুদ্ধতা, আত্মসংযম অধিকারের সমতা, শিক্ষক, প্রবীণদের প্রতি সম্মান এবং হিংসা নিষ্ঠুরতা, ক্রোধ ইত্যাদি বর্জন। 

ইরফান হাবিবের মতেঅনুশাসনে বিশেষভাবে উল্লিখিতদাস ভৃত্যদেরএবং সেই সঙ্গেদরিদ্র হতভাগ্যদের প্রতি শোভন ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশগুলি আধুনিক পাঠকদের অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করবে। কোন রাজকীয় অধ্যাদেশে দরিদ্র এবং ক্রীতদাসদের প্রতি এমন মনোযোগ খুবই কম পড়ে।

অশোক মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন আচার অনুষ্ঠানকে বর্জন করে জনগণকে অর্থবহ কার্যসম্পাদনের উপদেশ প্রদান করেছেন। নবম শিলালিপিতে বর্ণিত আছেদেবগণের প্রিয় রাজা প্রিয়দর্শী বলেন— “জনসাধারণ নানাকারণে বহু প্রকার অনুষ্ঠান করে থাকেন। বিশেষত মহিলারা বিভিন্ন প্রকার তুচ্ছ, মূল্যহীন অনুষ্ঠান সম্প্রদান করে থাকেন। অনুষ্ঠান সম্পাদন অবশ্যই করা উচিত। তবে এইরূপ অনুষ্ঠান কোন ফল প্রদান করে না। দাস-দাসীদের, ভৃত্যদের প্রতি যথাযথ ব্যবহার করা, প্রাণীদের প্রতি বলপ্রয়োগ না করা, এবং ভিক্ষুদের প্রতি উদারতা প্রদান করা ইত্যাদি অনুরূপ কর্মই হল প্রকৃত ধর্মের অনুষ্ঠান।' অশোক তাঁর সাম্রাজ্য জুড়ে ধৰ্ম্মনীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। রাষ্ট্রের সকলেই যেন অশোকের ধম্মনীতির সকল সুবিধা পান এবং সর্বত্র যেন তা প্রতিফলিত হয় সেই কারণে নিয়োগ করা হয়েছিল ধর্মমহামাত্র নামক এক বিশেষ শ্রেণীর কর্মচারী। এরা সমাজে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অশোকের ধম্মনীতি প্রচার করতেন। ধর্মযুক্তক নামক কর্মচারীদের কাজ ছিল ধর্ম মহামাত্রগণের কাজে সহায়তা করা। 

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখনীয় যে নারীরাও ধর্মমহামাত্র এবং ধর্মযুক্তক পদে নিযুক্ত হতে পারতেন। ধর্মমহামাত্রগণ রাজকর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। অর্থভাণ্ডার হতে তারা দুঃস্থ জনসাধরণকে অর্থ সাহায্যে প্রদানও করতেন। তারা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন এবং কারাগারের বন্দীদেরও অভাব অভিযোগ শুনতেন। বস্তুত অশোকের সময়কাল হতে কারাগার সংশোধনাগার রূপ নেয়। এছাড়া তারা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্ভাবনা প্রচারের প্রতিও যত্ন নিতেন। অর্থাৎ সমাজের সকল স্তরের মানুষেরা গৃহে প্রবেশের তাদের সম্পূর্ণ অধিকার ছিল। 

অশোক তাঁর ধম্মনীতির মধ্যেই বুদ্ধও তাঁর দর্শনের সন্ধান করেছেন। তাঁর নিকট জনগণের জীবনের মূল্য ছিল অপরিসীম এবং এই কারণেই তিনি জনগণকে বিপদগামী হতে নিষেধ করেছিলেন, তিনি প্রকৃত সুখ বলতে জীবের প্রতি সদাচারকেই উপলব্ধি করেছিলেন এবং জনগণকেও তা পালন করতে বলেছেন। তাঁর দশম মুখ্য শিলানুশাসনে সেই কারণেই আমরা দেখতে পেয়েছি— 'দেবপ্রিয় রাজা প্রিয়দর্শী যা কিছু চেষ্টা করেছেন তা পরকালের দিক চেয়েই যাতে সকল মানুষদুষ্ট প্রবণতা হতে মুক্ত হতে পারে।'

অশোকের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা নীতি: 

সম্রাট অশোক ব্যক্তিগতভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও জনগণের উপর বৌদ্ধ ধর্মকে বলপূর্বক চাপিয়ে দেন নি কিংবা বৌদ্ধধর্মকে রাজধর্মরূপে ঘোষণাও করেন নি। এইটি অশোকের মহত্বতম কীর্তি।

অশোক অন্যান্য ধর্ম তথা গোষ্ঠীর প্রতি সহনশীল আচরণ করেছেন। সেই সময় আজীবক তথা অন্য তৈর্থীকগণ বৌদ্ধদের প্রতি বৈরীভাব পোষণ করতেন। এই সমস্যাকে অবগত করেও অশোক আজীবকদের অবস্থানের জন্য তিনটি গুহা দান করেছিলেন। অশোকের ঘোষিত এবং পালিত নীতি ছিল ভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। দ্বাদশ মুখ্য শিলানুশাসনে তিনি বলেছেন, ‘সব উপলক্ষেই অন্যের গোষ্ঠীরই প্রভাব বৃদ্ধি পায় অন্য গোষ্ঠী উপকৃত হয়।' সপ্তম মুখ্য শিলানুশাসনে অশোক উল্লেখ করেছেন, দেবপ্রিয়, প্রিয়দর্শী রাজার অভিপ্রায় যে, তাঁর ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অনুসরণকারী প্রজাগণ কোন বিশেষ স্থানে বাস না করে সর্বত্র মিলেমিশে বসবাস করুক।

অশোক বিভিন্ন ধর্মের প্রতি সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করলেও ধর্মীয় সমাবেশের প্রতি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন। তাঁর এই নীতি গ্রহণের পেছনে অত্যন্ত দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন সকল ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত।

অশোকের সময়কালে শাসনব্যবস্থা: 

অশোকের সময়কালে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ, কাশ্মীর, সোয়াট উপত্যকা, হিন্দুকুশ অঞ্চল, আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, সিন্ধুপ্রদেশ, কচ্ছ, কাথিয়াবাড় অঞ্চল মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে বঙ্গদেশ সহ বর্তমান ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল অশোকের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহাবংশে বর্ণিত আছে যে ভারতের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত তাম্রলিপ্ত বন্দর হতে জাহাজ সিংহল দেশে যাতায়াত করত। অশোক তাম্রলিপ্ত (বর্তমান তমলুক) একটি বৌদ্ধস্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। ফা-শিয়েন তাঁর ভারত ভ্রমণ বৃত্তান্তে এই স্থানে ২২ টি বৌদ্ধ বিহার দেখেছিলেন। তমধ্যে খ্রিষ্টিয় ৭ম শতাব্দীতে কেবল ৭টি মাত্র বিদ্যমান ছিল। সুতরাং মৌর্য রাজাদের রাজত্বকালে তাম্রলিপ্ত একটি মুখ্যকালে এবং সমৃদ্ধশালী অঞ্চল ছিল বলেই মনে হয়। সর্বোপরি অশোক পুত্র মহেন্দ্র কন্যা সংঘমিত্রা এই বন্দর হতে জাহাজে সিংহলে গিয়েছিলেন। অতএব এই ধারণা পোষণ করা যায় যে বঙ্গদেশে অশোক সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। কারণ গুলি উপস্থাপন করলে স্পষ্ট হবে-

) বঙ্গদেশের অধিবাসীরা নৌ বিদ্যা এবং নৌ বাণিজ্য, নৌ যান নির্মাণে অত্যন্ত কুশলী ছিলেন।

) নৌ যান নির্মাণের জন্য কাঠ ইত্যাদি এখানে সহজলভ্য ছিল। 

) তাম্রলিপ্ত অঞ্চলের নিকটবর্তী বঙ্গোপসাগর হওয়ার কারণে সহজেই জলপথে সিংহল এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চলত।

) বঙ্গদেশের মৌসুমি জলবায়ু চরমভাবাপন্ন না হওয়ার কারণে বাণিজ্যিক সুবিধা ছিল।

) তাম্রলিপ্ত অঞ্চল হতে মগধ এর দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। 

পাটলিপুত্র ছিল মগধ সাম্রাজ্যের মূল রাজধানী। অশোকের অনুশাসনে এরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়। আফগানিস্তান প্রভৃতি ভারত বর্হিভূত অঞ্চল সমূহ প্রাদেশিক শাসন কর্তা নিযুক্ত ছিল। মৌর্যশাসনতন্ত্র পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, তৎকালে যাতায়াতের বিশেষ সুবিধা ছিল। নতুবা পাটলিপুত্র হতে সুদূর উজ্জয়িনী, তক্ষশীলা এবং গান্ধার নগরী পর্যন্ত অবাধে রাজকার্য পরিচালনা করা অসম্ভব হতো।

মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্যান্য শাসকগণের ন্যায় অশোকের শাসনপ্রণালী রাজশক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না, অশোকের রাজ্যশাসন প্রণালী ধৰ্ম্মের উপর সংস্থাপিত ছিল। অশোকের শিলালিপি হতে অবগত হই যে, রাজকর্মচারীগণের মধ্যে রাজপ্রতিনিধির পর সর্বশ্রেষ্ঠ পদ ছিলরাজুক রাজুকগণ রাজস্ব এবং রাজ্যশাসন সম্পর্কিত প্রভূত ক্ষমতা পরিচালনা করতেন।

অপরাধীকে শাস্তিপ্রদান এবং উপযুক্ত ব্যক্তিগণকে সম্মান প্রদর্শন বিষয়ে তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। রাজুকগণের পর ছিল প্রাদেশিক পদ। প্রাদেশিকগণ রাজুকগণের আজ্ঞাবাহক ছিলেন। রাজুক প্রাদেশিকদের সাধারণ নাম ছিল মহামাত্র। রাজুক, প্রাদেশিক, যুক্ত এবং অযুক্তগণ মিলিত হয়ে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। এছাড়া লেখকশ্রেণীর কাজ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

যুক্ত এবং অযুক্তগণ সাম্রাজ্যের সর্বত্র শান্তিরক্ষার কার্যে নিযুক্ত থাকতেন মহামাত্রগণের উপর একটি প্রদেশের শাসনভার অর্পিত ছিল। এই সকল উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ব্যতীত ধর্মমহামাত্রগণের উপরে একটি প্রদেশের শাসনভার অর্পিত ছিল। এই সকল উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ব্যতীত ধর্মমহামাত্র নামক একদল রাজকর্মচারী ছিল যারা বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মবিধি প্রচার করতেন। এছাড়া ধর্মনিযুক্ত নামক একশ্রেণীর রাজকর্মচারী ছিল যারা ধর্মমাত্রগণের সকল প্রচারের সহায়ক হতেন। সাম্রাজ্যের সকল কৃষিজমি রাজসম্পত্তি রূপে পরিগণিত হত। রাজস্ব বিভাগে রাজকর্মচারীগণ নিয়মিত রূপে রাজস্ব আদায় করতেন। ঐতিহাসিকগণের মতে শস্যের এক চতুর্থাংশ অথবা শস্যের ষষ্ঠভাগ রাজ কোষাগারে প্রদত্ত হত। কৃষক ব্যতীত, সূত্রধর, শ্রেষ্ঠী এবং খনিস্বামীগণও রাজকর প্রদান করতেন। অশোক প্রতিবেদক নামক এক প্রকার রাজকর্মচারী সৃষ্টি করেছিলেন, সম্ভবত এরা গুপ্তচর ছিলেন। সুনিপুণ ব্যক্তিগণই এই পদে যোগদান করতেন।

সামরিক বিভাগ ছিল ৬টি শ্রেণীতে বিভক্ত। প্রত্যেক বিভাগে জন করে সচিব থাকতেন। নৌ-বিভাগ, রসদ বিভাগ, পদাতিক, অশ্বারোহী, রথ এবং হস্তিবিভাগ ছিল। রাজধানীও এইরূপ ৬টি বিভাগ দ্বারা শাসিত হত। জন্ম মৃত্যু বিভাগ প্রজাগণের জন্ম মৃত্যুর হিসাব রাখতেন। বাণিজ্য কৃষিবিভাগে পন্যমূল্যের নীতি নির্ধারণ করতেন। প্রতারণার জন্য গুরুতর শাস্তির বিধান ছিল।

অশোকের রাজ্যশাসন প্রণালী তাঁর সামাজিক কার্যকলাপ, শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদির মূল্য লক্ষ্য ছিল বুদ্ধ প্রদর্শিত দর্শনের প্রচার করা। তাঁর ধর্ম্মনীতি অতি উদার নীতিপূর্ণ ছিল। অশোকের শাসনতন্ত্রের মূল ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। তাঁর প্রজাবাৎসল্য, করুণাপূর্ণ হৃদয়, নিরপেক্ষ উদারভাব এবং অমূল্য অনুশাসনাবলী ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ।

অশোক বিশ্ব ইতিহাস:

বিশ্ব ইতিহাসের একমাত্র চরিত্র হলেন অশোক, যিনি কলিঙ্গযুদ্ধের পর যুদ্ধকে ত্যাগ করেছিলেন। যে সময়কালে তিনি যুদ্ধ ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, সেই সময় তিনি ছিলেন সুবিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের অধিশ্বর। তিনি যুদ্ধ ত্যাগের মধ্যে দিয়ে ধর্ম বিজয় করেছিলেন। কিন্তু অশোকেরধৰ্ম্ম বিজয় গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের প্রবর্তিতধর্ম বিজয়' বলতে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের ধর্মবিজয়কে বোঝায়। সম্রাট অশোক যেটা করেছেন সেটাকে বিজয় না বলে 'বিস্তার' বলা চলে। বিহারের অর্থ হলো পররাজ্যাধিকার। সম্রাট অশোক জনগণের মধ্যে নৈতিক আদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। অশোক রাষ্ট্রকে পরিণত করেছিলেন জনকল্যাণমূলক সংঘে। অধ্যাপক সান্যালের মতেঅশোককে কেবল একজন বৌদ্ধ শাসকরূপে বিবেচনা না করে একজন বিশ্বজনীন রাজা হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।

ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্যের বৌদ্ধধর্মের অবলুপ্তি: 

মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথ নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে (খ্রীঃ পূর্ব ১৮৩ অব্দে বা খ্রীঃ পূর্ব ১৮৫/১৮৭ অব্দে) ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্যের অবলুপ্তি ঘটেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্য প্রায় ১৪০ বৎসর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল (খ্রীঃ পূর্ব ৩২৪-১৮৭ অব্দ) অর্থাৎ অশোকের মৃত্যুর প্রায় ৫০ বৎসর মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিল। মোট সাম্রাজ্যের পতনের কারণ সম্পর্কিত তথ্যগুলিও ধোঁয়াশা পূর্ণ। অনেকে মনে করেন মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হল অশোকের ধম্মনীতি এবং বৌদ্ধধর্মের অহিংসবাদ। তাঁর প্রত্যুত্তরে বলা যায় বৌদ্ধ অহিংসবাদ বা অশোকের ধম্মনীতি দায়ী নয়। দিব্যাবদান গ্রন্থ হতে জানা যায় মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ ছিল অশোক পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং প্রাদেশিক বিদ্রোহ। সান্যালের মতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উত্থান এবং বৌদ্ধধর্মের পতন মৌর্য সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দিয়েছিল তাই এই পতন অনিবার্য হয়ে উঠে। অশোক যে ৮৪০০০ বিহার ধর্মরাজিকা তৈরী করেছিলেন ভারতের নানা স্থানে, গুলো আজ কিংবদন্তী নয়, কোথায় গেল সকল ঐশ্বর্যরাজি। সেগুলো আজ ধ্বংসের লীলানিকেতন রূপে ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে।

মাটির নীচে কিংবা অদৃশ্য গ্রাহ্য নয় সেটা হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। ভারতের হিন্দু ঐতিহাসিক গবেষক পণ্ডিতরা শুধু অশোক এবং বৌদ্ধধর্মকে দায়ী করে উচ্চস্বরে বিষোদ্গার করেছেনতাঁদের মতে যত তন্ত্রমন্ত্র, যত মূর্তি পূজা প্রতীক উপাসনা, যত অনাচার ব্যভিচার মতের জন্য দায়ী বৌদ্ধ ধর্ম। হিন্দু নিস্তেজ হল, যুদ্ধ ছেড়ে দিল, শৌর্যবীর্য হারাল শক, কুষাণ, হুন, তুর্কি, কারো গতিরোধের সমর্থ হল না শুধু বৌদ্ধধর্মের কারণ। ছিল ভাল চতুর্বর্ণব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য শূদ্রের জাতি বিভাগও কর্ম বিভাগ, সবকিছু নষ্ট হল তারও কারণ বেদবিদ্বেষী বৌদ্ধধর্ম  

যত দোষ সব নন্দ ঘোষের। ঘর যখন ভেঙে পড়ে যা কিছু এর দাঁড়াবার ইট, পাথর, পিলার সবেতে এর পতনের সহায় হয়, বলা যায় হিন্দু ঐতিহাসিক, গবেষক, আপনি আপনারা ভ্রান্ত, আপনার সবকিছুতেই বিদ্বেষপূর্ণ বিদ্রুপবান নিক্ষেপ করেন। দেবানং প্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা অশোকের ধম্মনীতিতে বা ধর্মবিজয়ে, ধর্মঘোষের দ্বারা এদেশে দিগ্বিজয় করেনি, যুদ্ধ বিগ্রহ থামেনি, কূটনীতি পরিত্যাগ হয়নি অশোকের ধম্মনীতি বৌদ্ধ সংস্কৃতি দ্বারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সৃষ্টি করেছিলেন অশোক। অধিকন্তু রাণীদের দানে প্রায় সকল, স্থান গড়ে উঠেছে, বৌদ্ধ মহাচৈত্য, স্থাপত্য ভাস্কর্য্য, দানগৃহ বিদ্যাপীঠ, আর রাজারা ছিলেন অগ্নিহোত্রী, অশ্বমেধাজ্ঞী, দিগ্বিজয়ী। মন্ত্রী ছিলেন বেদ বেদাঙ্গ বিশারদ কৌটিল্যের। কূটনীতিজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ জ্যোতিষী বা গণককার হলেন রাজ্যের ভাগ্যনিয়ন্তা। যা বর্তমান ভারতবর্ষেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। গতানুগতিকতা চতুরঙ্গ সৈন্যের বাহ্যাড়ম্বর, বেতনভোগী সৈনিক দ্বারা যুদ্ধ, অন্তর্কলহ, সাধারণ জাতীয়তাবোধের তলানিতে সবকিছুই হল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হারাবার এবং বহির্শত্রুর আক্রমণের কারণ। মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় কোন বহির্শত্রু ভারতবর্ষের দিকে চোখ রাঙাতে পারেনি। অশোকের রাজদরবারে কূটনীতিজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিল তাঁদের প্রতিপত্তি পদের মোহ ছিল কিন্তু অশোকের সময় তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। অশোক পরবর্তী শাসকদের পদলেহন, লোভ, পদের প্রতিপত্তি সাংঘাতিক রূপ নিল এবং তারা রাজাদের তুষ্ট করতে গিয়ে কোন সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করেনি। (বৌদ্ধবিদ্যা পীঠ, ভূমিকা বেণীমাধব বড়ুয়া) বরং অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেও কোন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে রাজ মহামাত্য পদে বসাননি এবং যা বুদ্ধের নীতি বিরুদ্ধও ছিল। সুতরাং বলা যায় যে অশোক বৌদ্ধ উপাসক হলেও বুদ্ধের ধর্মকে রাজধর্মে পরিণত করেনি কিংবা রাজ্যশাসন প্রণালীতে নীতি নির্ধারণে কোন বৌদ্ধ ভিক্ষু হস্তক্ষেপ করেননি। 

অশোক পরবর্তী ভারতবর্ষের রাজারা হেলে সাপ ধরার জন্য ডাকতেন ? পরে বিরাট যজ্ঞ, হোম, পূজা শান্তি-ব্যবস্থা, আর শেষে হত মহিষমর্দিনী, অসুরঘাতিনী, দশপ্রহরধারিণী শক্তির উপাসনা, এসব যদি একজন শাসকের কৃত্যকলাপ হয় তাহলে কিভাবে আশা করা যায় যে, নিরস্ত্র নিরীহ নগরের উপকণ্ঠবাসী কিভাবে বহির্শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে পারবে। হিন্দু ঐতিহাসিক-গবেষক বিদিত নন যে যেখানে যেখানে বৌদ্ধ কেন্দ্রছিল সেখানে সেখানে পাশুপত শৈব ছিল, কেউ কিছু করতে পারেনি। বৌদ্ধধর্ম এদেশে নতুন সমাজ গড়েনি। হিন্দুকে আচারভ্রষ্ট করেনি, জাতিচ্যুত করেনি, সমাজ শৃঙ্খলা নষ্ট করেনি, সর্বোপরি রাজশক্তি পরিচালনা করেনি। আপনার বেদবেদাঙ্গ আপনাকে চিরদিন আছে, আপনার জাতিভেদ আপনাতে আছে, শ্রুতিস্মৃতি, ইতিহাস, পূরাণ, ভৃগুপরাশর আপনাতে আছে। হিন্দু ভাবপ্রবণতা, গতানুগতিকতা ধর্মান্ধতা দূরীকরণের জন্য বৌদ্ধ ধর্মের অভ্যুদয়। বৌদ্ধধর্ম কলুষিত হলে এদেশ হতে হারিয়ে যেত না। যদিও বা বৌদ্ধধর্ম এদেশ হতে বহিষ্কৃত হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে বৌদ্ধধর্মের মধ্যে কোন বুজরুকি ছিল না, ছলচাতুরি ছিল না। বৌদ্ধধর্মে ছিল আছে সব রকমের জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন, প্রচার বিস্তার; আর সভ্যতায় এশিয়ার বহু দেশ জাতিকে ভারতবর্ষের অনুগত করা। বৌদ্ধধর্মের দাঁড়াবার ভিত্তি ছিল সমাজ নয়, রাজশাসন নয়বরং সংঘারাম শিক্ষালয়। যেদিন সকল সংঘারাম ইসলাম-পন্থী বিজয়ী তুর্কিবীর এক এক করে ধুলিসাৎ করলেন বৌদ্ধধর্মের সর্বস্ব গেল আর টিকতে পারেনি। 

বৌদ্ধেরা হিন্দুর সর্বনাশ করতে মুসলমান আক্রমণকারীকে এদেশে ডেকে এনেছেন-এসব সধৈব মিথ্যে। সাধু বেশে হিন্দু রাজাদের অবিশ্বাসী গুপ্তচরগণ সর্বত্র চলাফেরা করতেন এসব নতুন কথা নয়। এসব ভ্রান্ত ধারণা মিথ্যাচার যেখান থেকে বাহিত হয়েছে তা হল যমাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণের শেষেনিরজ্ঞনের রুষ্মা' শীর্ষক কবিতাটি হল এক হিন্দু ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্তের ভিত্তি।দেব নিরঞ্জন' যে বুদ্ধ আরশূন্যপুরাণযে বৌদ্ধগ্রন্থ সেটি হিন্দু ঐতিহাসিকগণ করল না। আর প্রমাণ না করেই আশোকের ধর্মনীতিকে আর বৌদ্ধ অহিংসবাদকে দোষী সাব্যস্ত করে বসল। এদেশ এবং এদেশের (বর্হিদেশে) উপনিবেশ সমূহে বহু লেখমালা যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী আবিষ্কৃত পঠিত হবে। হিন্দু ঐতিহাসিক, গবেষক, পণ্ডিতদের এসব অধ্যয়ন করে চিন্তা করে বলা উচিত তাঁদের সিদ্ধান্ত ভুল না সঠিক। 

হিন্দু ঐতিহাসিক পণ্ডিতরা মনে করেন, এদেশের জন সাধারণের মধ্যে ধর্মের দ্বারা হলব্রহ্মা মহেশ্বর এক (প্রপিতা মহেশ্বর), হরি হর এক, বুদ্ধ শিব এক, যেই বুদ্ধ সেই শিব (সৌগত-মহেশ্বর) আর সবকথা সত্য হলেও একথা সত্য নয়বৌদ্ধধর্মই হিন্দুর জাতীয়তা নষ্টের কারণ। এসব অলিক কল্পনা ছেড়ে হিন্দু ঐতিহাসিক পণ্ডিতদের চিন্তা করা উচিত গৃহত্যাগীও ভিক্ষান্নে কালাতিপাতকারী বৌদ্ধাচার্যগণ কিরূপে এদেশের আনাচে কানাচে জ্ঞান, বিজ্ঞান চরিত্রের উৎকর্ষসাধনের জন্য সংঘারাম, শিক্ষাগার, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।' (বৌদ্ধবিদ্যাপীঠ, ভূমিকা, বেণীমাধব বড়ুয়া)

ইতিহাসবিদ রামশরণ শর্মার মতে অশোকের গৃহীত নীতি ব্রাহ্মণদের মূল স্তম্ভ। অশোক এই স্তম্ভকেই সমূহে উৎপাটিত করতে চেয়ে ছিলেন। এবং যাগ-যজ্ঞ, বলিপ্রথা ইত্যাদি বিলোপ সাধনের ফলে ব্রাহ্মণরা প্রবলভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণ অমাত্য পুষ্যমিত্র দ্বারা মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথ হত্যার মধ্য দিয়ে এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। শুঙ্গবংশের আগমনে হিন্দু ধর্মের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে অশোকের ইতিহাস এবং বৌদ্ধধর্মকে সম্পূর্ণভাবে ভারতবর্ষ হতে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা শুরু এবং আজও সুকৌশলে অব্যাহত।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী:


. চারু চন্দ্র বসু, (সম্পা) বারিদবরণ ঘোষ, অশোক বা প্রিয়দর্শী অশোক অনুশাসন, মর্ডাণ কলাম, কোলকাতা, ২০১৫।

. . দীনেশচন্দ্র সরকার, অশোকের বাণী, সাহিত্যলোক, কোলকাতা, ২০০১।

. দেওয়ান গোলাম মোর্তজা, লিপিতত্ত্বের নতুন আলোকে ব্রাহ্মী অথবা ব্রাহ্মীলিপি সম্রাট প্রিয়দর্শী, ফারজানা প্রকাশনী, গরলা, ১৯৮৭।

. ডক্টর অমূল্যচন্দ্র সেন, অশোক লিপি, মহাবোধি বুক এজেন্সি, কোলকাতা, ২০১৬।

. রোমিলা থাপার, অশোক মৌর্যদের পতন, কে. পি বাগচী অ্যাণ্ড কোম্পানী, কোলকাতা, ২০০0 |

. ডক্টর অমূল্যচন্দ্র সেন, অশোক চরিত, মহাবোধি বুক এজেন্সি, কোলকাতা, ১৯৯৯।

. কৃষ্ণবিহারী সেন, অশোক চরিত (সম্পা) বারিদবরণ ঘোষ, করুণা প্রকাশনী, কোলকাতা, ২০০8 |

. সাধনকমল চৌধুরী, অশোকের শিলালিপি, ক্যাম্প, কোলকাতা, ২০০০।

. ইরফান হাবিব বিবেকানন্দ ঝা, (ভাষান্তর) কাবেরী বসু, মৌর্যযুগের ভারতবর্ষ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কোলকাতা বইমেলা, ২০০৬।

১০. লতা পাল, রাষ্ট্রীয় প্রতীক অশোকস্তম্ভ, প্রজ্ঞান প্রগতি প্রকাশন, হাওড়া,

১১. . সুচিত্রা রায় আচার্য্য, অশোক অভিলেখ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা, ২০১৪।

১২. সলিল বিহারী বড়ুয়া, মহামতি অশোক তাঁর লিপি, বুডি-ষ্ট রিসার্চ এণ্ড পাবলিকেশন সেন্টার, বাংলাদেশ, ২০১৬।

১৩. বিশুদ্ধাচার স্থবির, অশোক চরিত, সাতকানিয়া বৌদ্ধ সমিতি, চট্টগ্রাম, ২০০৭।

১৪. শানজিদ অর্নব, মৌর্য সম্রাট প্রিয়দর্শী অশোক, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৬।

১৫. . রেবপ্রিয় বড়ুয়া (সম্মাত), সম্রাট অশোক, ঢাকা, ২০০২।

১৬. বেণীমাধব বড়ুয়া, অশোক এণ্ড হিজ ইনসক্রিপশনস, (পার্ট-ওয়ান টু), নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিঃ, কোলকাতা, ১৯৬৯।

১৭. রাধাকুমুদ মুখার্জী, অশোক, মতিলাল বানারসিদাস, নিউদিল্লি, ১৯৮৯।

১৮. ডি. সি, সরকার, ইন্সক্রিপশনস অফ অশোক, পাবলিকেশন ডিভিশন, মিনিষ্ট অফ ইনফরমেশন এণ্ড ব্রোডকাস্টিং গর্ভঃ অফ ইণ্ডিয়া, দিল্লি, ১৯৯৮।

১৯. প্রফেসর ডি. আর. ভাণ্ডারকার, অশোক, ইউনির্ভার্সিটি অফ ক্যালকাটা, কোলকাতা, ১৯৬৯।

২০. জন এস. স্ট্রং, দি লিজেণ্ড অফ কিং অশোক ( স্টাডি এণ্ড ট্রানস্লেশন অফ দি অশোকাবদান), মতিলাল বালারসিদাস, দিল্লি, ১৯৮৯।

২১. দীপক চক্রবর্তী, রয়্যাল ম্যাজেজেস বাই দি ওয়েসাইড, হিস্ট্রিক্যাল জিওগ্রাফি অফ দি অশোকান এডিক্টস্, আরিয়ান বুকস্ ইন্টারন্যাশনাল, দিল্লি, ২০১১।

২২. সুত্তিস লাপ্পেরমসাপ, অশোকান এডিক্টস্ অ্যান এসেম্বলজ অফ সোসিওলজিক্যাল এসারশাসনস এণ্ড মোরাল গাইডলাইনস্, ইস্টার্ন বুক লিংকারস্, দিল্লি, ২০১৭।

২৩. মিনা তালিম, এডিক্টস অফ কিং অশোক, নিউ ভিশন, অরিয়ান বুকস্ ইন্টারন্যাশনাল, নিউ দিল্লি, ২০১০।

২৪. ডি. সি. আহির, অশোক দ্যা গ্রেট, বি. আর, পাবলিশিং কর্পোরেশন, দিল্লি, ১৯৯৫।

২৫. এস, বিরানারায়ন রেড্ডি, অশোক বিলাভড্ অফ দি গডস্, আনন্দ বুদ্ধ বিহার ট্রাস্ট, সেকেন্দ্রাবাদ, ২০০৪।

২৬. . এন সি পাণ্ডা, অশোক হিস্ট্রি এণ্ড ইনক্রিপশনস্, ভারতীয় কলা প্রকাশন, দিল্লি, ২০১৩।

২৭. সুজিত কুমার আচার্য, নির্বাসিত কলিঙ্গীদের ঠিকানা, ক্যাম্প, কোলকাতা, ২০০০।

২৮. কল্পনা উরেতি, ইণ্ডিয়া এস্ রিফ্লেক্টেড ইন দি দিব্যাবদান, মুন্সিরাম মনোহরলাল পাবলিশার্স প্রা. লি., দিল্লি, ১৯৯৪।

২৯. আলফ্রেড সি. উলনার, অশোক টেক্সট এণ্ড গ্লোসারি, লো প্রাইস পাবলিকেশনস, দিল্লি, ১৯৯৩।

৩০. ভিনসেন্ট স্মিথ, দি এডিক্টস অফ অশোক, লো প্রাইস পাবলিকেশন, দিল্লি, ১৯৭২।

৩১. অমূল্যচন্দ্র সেন, অশোকাস এডিক্টস, দি ইনস্টিটিউট অফ ইণ্ডোলোজি, দি ইণ্ডিয়ান পাবলিসিটি সোসাইিটি, ক্যালকাটা, ১৯৫৬।