Tuesday, October 21, 2025

অভিমত

ভূমিকা
সুমনপাল ভিক্ষু

সহজ স্তব্ধ শব্দ দ্বারা অর্থাৎ যে শব্দে শিহরণ নেই বা কল্পমান অবস্থা নেই, মানব জীবনে সংঘঠিত ঘটনার বিবরণ বহন করা চলে না। শুধুমাত্র মানব জীবনই নয়, অজৈব বস্তুর রূপ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ও গতিদীপ্ত ভাষার প্রয়োজন অশেষ। এক্ষেত্রে একজন লেখকের কর্তব্য হচ্ছে নৈমিত্তিক ক্ষেত্র থেকে, বৌদ্ধিক বাস্তবতা থেকে অনসম্বল জীবনকে উদ্ধার করে এনে শব্দের জগতে তাকে প্রাণবন্ত ও চঞ্চল করা। অবশ্য এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, শব্দের জগতে প্রাণবন্ত করার অর্থ কি বস্তুজগৎ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা? অথবা জীবন কে শব্দক্ষেত্রে জীবন্ত ও বাস্তব করে বস্তুজগৎকে আরো বেশী সত্য মূল্য দেওয়া? এ কথার উত্তর হচ্ছে, জীবনের জন্য নতুন যে শব্দের পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে, সৃষ্টির ক্ষেত্রে একমাত্র এ-পরিমণ্ডলেই বাস্তব জীবন আমাদের বোধায়ও।

আমাদের অর্থজ্ঞাপক কথোপকথনের ভাষার সর্বাপেক্ষা সহজ ও সংক্ষিপ্ত উপাদান যে শব্দগুলি নিয়ে, সেগুলি বিভিন্ন ব্যক্তির মনে বিভিন্ন ভাবের জাগৃতির সহায়তা করতে পারে। যে যতটা নিবিড়ভাবে কোনো বস্তুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার মনে সে বস্তুর আবেদন ততটাই গভীর। এ আবেদন বস্তু সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল।

কোনো লেখকের রচনাশৈলীতে বিশিষ্টতা তখনই অবধারিত হয় যখন তিনি ঘটনা বা কর্মের সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের একটি বৌদ্ধিক চিত্র উপস্থিত করেন। প্রধাণতঃ যে রচনায় মার্মিক মূল্যবোধ বা দাহনের পরিচয় থাকে, তা সহজে প্রাচীন হয় না, কেননা সেখানে সর্ব সময়ের একটি চৈতন্যের প্রশ্রয় থাকে। এ চৈতন্যই হচ্ছে লেখক বা শিল্পীর অহমিকা, যাকে আমরা আঙ্গিক আখ্যা দিতে পারি।

উপাদান অথবা লিরিক তৈরী করার জন্য অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নীহারিকার মতো পরস্পর সংলগ্ন অনেকগুলো অনুভূতি। এক্ষেত্রে তাঁর অর্থাৎ লেখকের উপলব্ধি এমন প্রগাঢ় হবে যে, তিনি তার প্রতিরূপ আবিস্কার করবেন শব্দ বোধের মধ্য দিয়ে। আবিষ্কার করবেন না বলে বলা যায় যে স্বতঃ সিদ্ধান্তে তিনি একটি বক্তব্যে উপনীত হবেন। আমি অনেক সময় সকালবেলায় জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকাই, তখন হয়তো কুয়াশার অস্পষ্টতায় পাখি দেখি, দেখি মেঘ, এলোমেলো ছেঁড়া কাগজের টুকরো উড়ে যেতে দেখি, হয়তো গানের শব্দ কানে আসে......। তখন এ সমস্ত সত্যকে শব্দে অথবা উপমায় একটি সাহিত্য লোক এর বাণীরূপের মধ্যে ধরে রাখাবার চেষ্টা করি। একটি উপলব্ধির পরিপূর্ণতার এভাবেই হয়তো প্রথম পদক্ষেপ ঘটে। এ পরিপূর্ণতার পথে অন্তরঙ্গ ধ্যান এবং চিন্তায় শব্দগুলো আবেগ ও বিশ্বাসের উষ্ণতায় হৃদয় বোধকে উন্মোচিত করে। সমস্ত ঘটনা এবং চিন্তা তখন শব্দ হিসেবে বিকশিত হয়।

মুক্ত গদ্য অথবা সৃজনশীল চিন্তনবোধের মধ্যে যে বিষয়টি নিহিত থাকে তা জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাবের জন্য, কিন্তু সর্বশেষের সরলতা অভিজ্ঞতার প্রগাঢ়তার জন্য। অতি অল্প কথায় আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাকে বাঙময় করবো। আমরা প্রতিদিন জীবনের অলিন্দে দাঁড়িয়ে অভিজ্ঞতার নিশ্বাস গ্রহণ করছি। আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের মধ্যে জীবনবোধের যে সঞ্চয়, অভিজ্ঞতার আহরণ নিয়ে একজন গদ্যকারের জীবনে তা যেমন সত্য, অন্য কারো জীবনে তেমন নয়।

পাঠকের বুদ্ধিকে দীপিত করা এবং আবেগকে পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব গদ্যকারের। শব্দের বিন্যাসের মধ্যে নতুন ধ্বনি-ব্যঞ্জন দান করে, বক্তব্যকে এই সঙ্গে চিন্তা ও আবেগের মধ্যে শিহরিত করে পাঠকের আপন বোধের রাজ্যে গদ্যকার আপন সত্যবোধকে কম্পিত দেখবেন।

অনেক সময় বিষয়টিকে নিছক আবরণের মনে হয়, যেন তা বর্ণিত একটি বিষয়ের আচ্ছাদন, কিন্ত আচ্ছাদন ও দেহকে সুষম মাধুর্যে উদ্ঘাটিত করে, আচ্ছাদনের ও বর্ণ বৈচিত্র আছে এবং আচ্ছাদন ও দেহকে স্বীকার করেই মূল্যবান। এক্ষেত্রে গদ্যকারকে লক্ষ্য রাখতে হয় যাতে আবরণের চাপে পড়ে বিষয়চিট বিকৃত না হয় অর্থাৎ আবরণ যেন বিষয় বা দেহের সত্যকে করে।

কেন না সংবাদের গাণিতিক হিসেবে তো বিষয়সমূহে মুখরতা আসে না। তাই আবরণ নিয়ে, অলঙ্কার নিয়ে ভূষণ সম্ভারে আলোকিত হয়ে বিষয়টি চিত্তগ্রাহী হয়।

উপরোক্ত বিষয়গুলি পণ্ডিত প্রবর ভিক্ষু জ্ঞানবোধির ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, কেননা তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন অথবা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন....।

'যদি আমি সমস্ত জীবন ধারে 
একটি বীজ মাটিতে পুঁততাম 
একটি গাছ জন্মাতে পারতাম
সেই গাছ ফল ছায়া দেয়....।'

আমার কেন জানি না কখনোই মনে হয় নি ভিক্ষু জ্ঞানবোধি এই মহা মূল্যবান নিবন্ধটি লিখিছেন বরং মনে হয়েছে এই নিবন্ধটি ভিক্ষু জ্ঞানবোধি'কে লিখেছেন।

ভিক্ষু জ্ঞানবোধির এই নিবন্ধটিকে অনুসরণ করলেও এই একই কথা মনে হয়। অনেকে হয়তো বিষয়টিকে 'ফরমায়েশি' বলবেন কিন্তু আমার কখনই তা ফরমায়েশি বলে মনে হয়নি বরং মনে হয়েছে বুদ্ধানুশাসনের প্রতি দায়বদ্ধতা।

ভিক্ষু জ্ঞানবোধি বিরচিত নিবন্ধটি অনুশীলন করার পর আমার মনে হয়েছে নিবন্ধটির বিন্যাস জরুরী। একজন ভিক্ষু বুদ্ধানুশালনের প্রতি তাঁর আনুগত্য এবং শ্রদ্ধাভাব বজায় রেখে কি ভাবে বা কোন আঙ্গিকে এই বিষয়গুলির প্রতি অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল তার সঙ্গে আলোচনা করেছেন তা এই বিন্যাস থেকে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যাবে। আরও সঠিক করে বলতে হলে নিবন্ধটির বিষয় সমূহ গুলিকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করে ফেলা। কোনো নাম থাকবে না সেই পর্যায়ের, এমন কি বিভাজন রেখাও হবে সূক্ষ্ম। কেননা তিনি নিবন্ধটি প্রথমে (সম্বোধির পথে) বলেছেন, অনুবাদের সময় আমি কিছু বৌদ্ধিক পরিভাষা ও তাত্ত্বিক ধারণা সঠিকভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছি। যেমন- শূন্যতা, অহংবোধের আসক্তি, নির্মাণকায়, ধর্মকায়, সম্ভোগকায় এবং স্বাভাবিক কায় ইত্যাদি।'

"ন স্বতো নাপি পরতো ন দ্বাভ্যাং নাব্যহেতুতঃ।
উৎপন্না জাতু বিদ্যন্তে ভাবাঃ কবচন কেচন।।" মাধ্যমিক-কারিকা।

নাগার্জুন'এর মতে কোন পদার্থের উৎপত্তি কখনই হয় না, না তো স্বতঃ, না তো অপর (পরতঃ) দ্বারা, না তো উভয়ত, আর না তো অকস্মাৎ। চার প্রকার প্রত্যয় বলা হয়েছে হেতু প্রত্যয়, আলম্বন প্রত্যয়, অনন্তর-প্রত্যয় এবং অধিপতি-প্রত্যয়। এর অতিরিক্ত কোন পঞ্চম প্রত্যয় স্বীকার্য নয়। 'অষ্ট সাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা'র প্রারম্ভে আচার্য সুভূতি'র একটি অদ্ভুত উক্তি দৃষ্ট হয় 'তমপ্যহং ভগবন্ ধৰ্ম্ম ন সমনৃপশ্যামি যদৃত প্রজ্ঞাপারমিতা নাম। অর্থাৎ সুভূতির মতে অস্তিত্ব এবং নাস্তিত্ব পারমার্থিক বোধ এর বহির্ভুত বিষয়। বস্তুতঃ বোধিচিত্ত অচিত্ত'ই হয়। অদ্বয় বজ্ররত্নাবলী এবং সূত্রালংকার (পৃ: ৪১-৪২)'এ শূন্যতার বিষয়টি এই ভাব এসেছে-

"অনাদিনিধনং শান্তং ভাবাভাবক্ষয়ং বিভূম্।
শূন্যতাকরুণাভিন্নং বোধিচিত্তমিতি স্মৃতম্।।"

ভিক্ষু জ্ঞানবোধি বিরচিত 'সম্বোধির পথে' গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে একটি কথা সব সময় মনে হয়েছে তিনি অত্যন্ত সচেতনার আঙ্কিকে গ্রন্থটি রচনা করেছেন। তাঁর গ্রন্থের অভ্যন্তরে আমি তীব্র চেতনার আভাসকে খুঁজে পেয়েছি। আবার এক এক সময় মনে হয়েছে এ তো ধীরে ধীরে বৌদ্ধ দর্শন তত্ত্বের অতল সমুদ্রে প্রবেশ করতে চাইছে।

প্রসঙ্গক্রমে মহাপরিনিব্বান সুত্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, "তস্মতিহানন্দ অন্তদীপা বিহরথ অত্তসরণা অনঞঞসরণা, ধম্মদীপা ধম্মসরণা অনঞঞসরণা।" বুদ্ধের এই দার্শনিক চিন্তা সমকালীন এবং উত্তরাকালীন মানব সভ্যতা ও মানবসমাজের পটভূমিকায় ঐতিহাসিক সত্য। কেননা বুদ্ধের সৃষ্টি সূর্যের আলোর মতো আমাদের নষ্ট চেতনাকেও রোগমুক্ত করে, আমাদের নির্মল এবং আনন্দিত করে। অপর অর্থে বলা যায় যে বুদ্ধ এনেছেন জীবন অনুভবের মানবিয় চেতনা, এই চেতনার পরিশ্রমী ফসল, পরিশুদ্ধ মানবতা।

সম্বোধির পথে গ্রন্থটির মূল নিবন্ধের সংখ্যা ৭। প্রথমে রয়েছে বোধিচিত্ত অনুশীলনের ভিত্তি। দ্বিতীয় নিবন্ধটি বোধিচিত্ত বিষয়ক। আচার্য অসঙ্গের ভাষায় বলা যায়-

"পশ্যতো বোধিমাসন্নাং সত্ত্বার্থস্য চ সাধনম্।
তীব্র উৎপদ্যতে মোদো মুদিতা তেন কথ্যতে।।
দৌঃ শীল্যাভোগবৈমল্যাদ্বিমলা ভূমিরূচ্যতে।
মহাধর্মাবভাসস্য করুণাচ্চ প্রভাকারী।।"

ভিক্ষুজ্ঞান বোধি এই বিষয়টি আলোচনা করার পূর্বে গ্রন্থের মুখ বন্ধে বলেছেন 'কারুণ্যমধি-মুক্তিশ্চ ক্ষান্তিশ্চাদি প্রয়োগতঃ। সমাচারঃ শুভস্যাপি গোত্রে লিঙ্গ নিরুপ্যতে। চতুর্বিধ লিঙ্গ বোধিসত্বগোত্রে। অদিপ্রয়োগত এবং কারুব্যং সত্বেষু।' এই পরোপকারী মনোভাব হচ্ছে বুদ্ধের মহাযান বা মহৎ মার্গের সমস্ত শিক্ষার ভিত্তি এবং কেন্দ্র হিন্দু। তিনি বলেছেন বুদ্ধের শিক্ষার সার মর্ম হল:

সর্বপ্রকার অকুশল কর্ম বর্জন করা,
কুশল কর্মে অনুশীলন
চিত্তকে বশীভূত করা
এটি বুদ্ধের প্রকৃত শিক্ষা। ধর্মপদ, গাথা ১৮৩।

ভিক্ষু জ্ঞানবোধি মনে করিয়ে দিয়েছেন মানব মননের ক্ষতিকর প্রভাবে করুণার বিষয়টি বিনষ্ট হয় সুতরাং ক্রমাগত সৎ অর্থে কায়িক বাচিক বিশুদ্ধতা অত্যত আবশ্যক নতুনা জীবন বিষময় হতে বাধ্য। সম্বোধির পথে গ্রন্থটি মূলত বুদ্ধ চেতনার সার্থক প্রতিফলন রূপেই বর্ণিত হয়েছে। অপর অর্থে শুদ্ধ জীবনবোধ এবং পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার চারণ গীতি রচিত হয়েছে। কেননা ভিক্ষু জ্ঞান বোধি এই উপমাই প্রদান করেছেন।

No comments:

Post a Comment