সুমনপাল ভিক্ষু,
২৪মার্চ ২০২৩।
“...যদি
ফিরে যেতে হয়
দুব দিয়ে
দিয়ে পৌঁছতে হবে নিত্যদিনের পৃথিবীতে,
কি জানি কে
জানে নতুনতর এক জীবনের তাগিদে
হয়তো আবার
উঠে আসতেও হবে, হতে পারে”
আগুণের
সবথেকে নিকট ও গূঢ় পটভূমিতে উপভূমিতে উপস্থাপিত, সূর্যের আলো এসে গেছে যার ওপর,
শুকনো রুক্ষ কাঠ থেকে বেরিয়ে আসা সেই ধোঁয়াই নীলাজ্ঞম অন্তত তাই দেখায়”
-সুবিমল
মিশ্র, ডায়েরি থেকে।
ইতিহাস কেবল
একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈব
প্রক্রিয়া...। এজন্যই বহুমাত্রিক সমাজের কোন দিকটির রদবদল বা বাঁকবদল ঘটবে সে
সম্পর্কে আগাম সংকেত দেওয়া অসম্ভব। যতক্ষণ নিজস্ব ক্ষমতা থাকে ততক্ষণ সাহিত্য
সংস্কৃতি সমৃদ্ধ থাকে। কিন্তু সময়ের চাপে প্রায়ই সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুর্বর হয়ে
পড়ে। আর তখনই তরুণ প্রজন্ম দ্বারা আন্দোলনের সূত্রপাত করা জরুরি হয়ে ওঠে। সাহিত্য
শিল্প-র সঙ্গে সমকালের যোগ অচ্ছেদ্য, সমসাময়িক কালের আশা, হতাশা সমস্ত সাহিত্য
সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলির জন্ম দিয়েছে। জীবনবোধের স্বপ্ন যেখানে ধূলিসাৎ হয় তখন
ক্ষুধার্ত প্রজন্ম হয়ে ওঠে অতৃপ্তিহীন।
“সন্তপ্ত
কুসুম ফুটে পুনরায় ক্ষোভে ঝরে যায়
দেখে কবিকূল
এত ক্লেশ পায়, অথচ হে তরু
তুমি নিজে
নির্বিকার, এই প্রিয় বেদনা বোঝনা।
কে কোথায়
নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানিনা।
নিজের অন্তর
দেখি, কবিতার কোনো পংক্তি আর
মনে নেই
গোধূলিতে, ভালবাসা অবশিষ্ট নেই।
অথবা গৃহের
থেকে ভুলে বহির্গত কোনো শিশু-
হারিয়ে
গিয়েছে পথে, জানে না নিজের ঠিকানা।”
-বিনয়
মজুদার, হাংরি বুলেটিন – ১৯৬৩।
প্রতিষ্ঠান
বিরোধিতার আঙ্গিক হতে জন্ম নেয় সাহিত্যচর্চা। এখানে পারমুটেশন বা কম্বিনেশনের কোন
স্থান নেই। আবার নেই কোন ইত্যকার প্লেটোনিকতা। কিন্তু মাধ্যম তো একটা চাই...। সেটা
কি সমাজিক হবে না কি অসামাজিক? এই আপ্ত বাক্যটির সরল অর্থ হবে ‘একটি স্ফুলিঙ্গই
দাবানল সৃষ্টি করতে পারে’। অপর অর্থে বিদ্রোহ, বিপ্লব এবং ভালোবাসা। যেখানে
শব্দগুলো হয়ে উঠবে এক-একটি বর্ষামুখ। সুবিমল মিশ্রের কথায় “...প্ল্যান্ড
ভায়োলেন্স’। তাহলে মাধ্যম? অবশ্যই উজান পত্র (লিটল ম্যাগাজিন)। হাংরির ভাষায়
বুলেটিন বা সমবেত আর্তনাদ।
“জীবনেই
একবার শিল্পঅনুরাগিণির কাছে ন্যাংটার উদ্বৃত অংশ হাতড়ে বলেছিলুম, কী ভাবো শিল্পই
যথেষ্ট! কেন কার্তুজ লটকানো হল দেহে?”
-শক্তি
চট্টোপাধ্যায়।
আবার এও হতে
পারে কারণ হওয়াটাই স্বাভাবিক আবার অস্বাভাবিকও হতে পারে। আর এটাই হল তরুণ প্রজন্ম!
থুড়ি ক্ষুধার্ত প্রজন্মের সামাজিক মাধ্যম।
“আমার লাশ
আগাগোড়া তল্লাস কোরে হৃৎপিন্ড না পেয়ে মানুষেরা যে যার করে ফিরে যাচ্ছে। মানুষই
মানুষকে শেখাচ্ছে খুন আর সেবা করার কায়দাকানুন। শরীর থেকে পড়ে যাওয়া হাতত পা তুলে
লাগিয়ে নিয়ে ফিরে যেতে হয়
দুপুরের
লালচে হওয়ায় আমি ২চোখ বুজে শুয়ে আছি”।
রবীন্দ্রনাথের
ভাষায় “...যেখানে প্রেম নেই বোবাদের সভা সেখানে গান নাহি জাগে।” আবার এরকম ও তো
হতে পারে “...কবিতা শ্লোগান হয়ে উঠেছে বলে দুঃখ করছো?” তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় যে
তরুণ প্রজন্ম কি চায়? ৯’এর দশকের কবির ভাষায় বলা যেতে পারে...।
“হে বন্ধু!
চলে যাওয়ার মুহুর্তে আমি কার্তুজ হতে চাই অথবা বেয়নেট কিমবা সুবিমলের হারান মাঝি
নয়তো ফাঁকা তাঁত চালিয়ে বলব কিছু একতা করতে হবে কিছু একটা।” – রিংকু শর্মা, গাধার
জবানবন্দী।
নবারুণের
ফ্যাতাড়ু কিংবা নীরা হারিয়ে যেও না। অথচ তরুণ প্রজন্ম তাদের সাহিত্য চর্চার আঙ্গিক
কে ক্রমশই লাল ইস্তেহার বা ম্যানিফেষ্টোতে পরিনত করতে চায়। কলম রাইফেল হতে
পারে...। তাতে কলমের আর দোষ কি? হাংরি নাকি কৃত্তিবাস অথবা দক্ষিণদেশে বা
দেশব্রতী! সুতরাং সবটাই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার গল্প-কবিতা এবং শিল্প। শিল্পের জন্য
শিল্প না কি জনগনের জন্য? প্রশ্নটা অবান্তর হতে পারে আবার নাও। তাহলে সামাজিক
মাধ্যম টা কি হতে পারে। আন্তর্জাল না কি কারুবাসনা?
“কারা
গড়েছিল থিবিস নগরীর সাত সাতটি প্রবেশদ্বার?
ইতিহাসের
কেতাবে লেখা হরেক রাজার নাম।
কিন্তু বড়
বড় চাঙরগুলো ঠেলে ঠেলে তুলেছিল যারা
তারা কি
রাজা ছিল?”
-বেরটন্ট্
ব্রেশ্ট’এর কবিতার অনুবাদ, সরোজ দত্ত।
লিবিভোর
হাড়মালা থেকে রৌরব...। শুভ দাশগুপ্ত কেন আত্মহত্যা করল? উত্তর মেলেনি আজও। অনন্ত
আকাশ জুড়ে বোবা নক্ষত্রের মিছিল, বুভুক্ষা চাঁদ। তবে এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। তবে
কি কৌরবের গাধাগুলো আজও কি ঘাস খায়? এগুলো অবান্তর হতে হতে তুলনামূলক সাহিত্যের
শবদেহ পেরিয়ে ভিডিও ভগবান কংবা নকুলদানা। রাজনৈতিক অবক্ষয়ের চিহ্ন সর্বত্র কিন্তু
তবুও নিরো বেহালা বাজায়...।
তিথির বরণ
অথবা দ্রোণাচার্য ঘোষ’এর মুক্তির দশক জার্নাল ৭০ এখন মেহের আলীর কথায় বেবাক ঝুটো।
প্রেসিডেন্সী এখন নিম সাহিত্যকে...। শাস্ত্র বিরোধী আন্দোলন? জিয়নকাঠি না কি সেই
বনলতা সেন নাটোরের। তাহলে বিদিশার দিশা কিংবা শ্রাবস্তীর কারুকার্য! তলস্তয় থেকে
একেবারে দক্ষিণায়ন আকিরা কুরুসোয়া আথবা সেই চিলেকোঠার সেপাই। হাঁসজারু হতে হতে
ক্রমশই...।
“বিভ্রান্ত
সব শব্দের ভিতরে প্রতিদিন একা একা হরপ্পা-মহেঞ্জেদরো
খেলা করি,
প্রতিদিন নিজের যুদ্ধ হয় নিজের ভেতরে-
শবমিছিলে
হাঁটি, শ্লোগান তুলি কবন্ধ হয়ে,
বেলা শেষে
নিজেকে নিজেই ফাঁসি দিই, ক্রসফায়ার করি
শুয়ে থাকি
পোষ্টমর্টেমের ঘরে...।
আমার মতো
তারা ও কি শুয়ে আছে?”
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মৃত্যু ঠিক কখন হয়েছে
অথবা আদৌ মৃত্যু হয়েছে কিনা, তা জানতে হয়তো আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু এ’কথা আমরা এখন ক্রমে উপলব্দি করতে পারছি যে তরুণ প্রজন্মের সাহিত্য চর্চার
জৈবিক মৃত্যু অনেক আগেই ঘটে গেছে। তাদের হৃদয় স্তব্দ হয়ে গেলেও, চিকিৎসাবিদ্যার
পরিভাষায়, যেহেতু তাদের মগজের মৃত্যু ঘটেনি, তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই তাদের ঠিক তখনই
মৃত বলে ঘোষনা করা যাচ্ছে না। অথবা ঘোষনা করা যাচ্ছে না এ’কারণেও যে আমরা (?) তখনও
সেই সত্য জানি না অথবা প্রকৃতির বিচিত্র কূটাভাসের জন্য, হাইসেনবার্গের বিড়াল নিয়ে
সেই বিখ্যাত কাল্পনিক পরীক্ষাটির মতো, কখনও জানতে পারবো না যে ঠিক এই মূহূর্তে
তারা মৃত না জীবিত, যদিও আত্মপ্রতারনার ছলে অন্তত বলতেই পারবো যে তারা মৃত নয়,
কিন্তু হ্যাঁ জীবিতও নয়। আমাদের কালের একটি নির্মম অভিশাপ এই যে সে সব কিছুকেই
নঞর্থে দেখে। তার শুরু নেতি দিয়ে, তার শেষ ও আরেক চূড়ান্ত নেতিতে। অর্থ থেকে
নিরর্থকতার দিকে তাদের ঝোঁক বেশি, আকার থেকে নিরাকারেই তাদের আনন্দ, পূর্ণ নয়
শূণ্যই তাদের প্রেয়। এর পিছনে রয়েছে কালের কুটিল সময় তাড়না বা দ্রুতির মিথ্যাভয় ও
অর্থহীন প্রহেলিকা ছাড়াও সবথেকে বড় কারণ হচ্ছে সামগ্রিকভাবে অনিশ্চয়তার প্রবল
আধিপত্য।
তবে বলতে হয়
সাহিত্য চর্চা একটা জীবন্ত কিছু, মাতৃগর্ভ সঞ্চারের মতো, সে বড় হবে, হাত-পা ছুঁড়বে
অবশেষে ভূমিষ্ট হবে। কিন্তু সবার আগে তো তাকে জন্মাতে হবে, মাতৃশরীরের মধ্যেই তার
প্রাণসঞ্চার হতে হবে। সুতরাং এই অর্থে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম লেখে না, তারা অন্য
কিছু করে এবং যেহেতু তারা লেখে না তাই তারা পড়ে না।
“...দূরে
নক্ষত্রেরা জ্বলে
যে নক্ষত্র
নীল হয়ে আছে, দেখি তাকে।
কখনো সে
পৃথিবীতে আসবে না, জানি, তবু
আসতে কি
পারে না সে মাঠের নিকটে?
মাঝে মাঝে
নক্ষত্র তো চাঁদ হয়ে পৃথিবীর কাছে এসে থাকে।”
-বিনয় মজুমদার, নক্ষত্রের
আলোয়।
No comments:
Post a Comment