সুমনপাল ভিক্ষু
ধর্মভিত্তিক গত ভাবে 'সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু' বিষয়টি অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়। কারণ এই বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে সর্বপ্রথম 'ধর্ম' ইত্যাদি ইত্যকার বিষয়গুলিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করা প্রছোজন নতুবা সমগ্র বিষয়টি অন্তঃসার শূণ্য হতে বাধ্য।
'ধর্ম' বলতে অধ্যাপক লিউ চুন তাঁর বিক্যাত গ্রন্থ 'ধর্ম ও দ্বন্ধ প্রসঙ্গে' বলেছেন, "...ধর্ম হল কতকগুলি অদ্ভুত আচরণ বিধি, নিয়ম, রীতি-নীতি, পদ্ধতি এবং এই সকলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে কিছু পৌরাণিক কথামালা, তথাকথিত ঈশ্বর তত্ত্ব ও জটিলতা।" বিখ্যাত রুশ দার্শনিক 'পৃথিবীর ইতিহাস' নামক গ্রন্থে বলেছেন- "শাসক শ্রেণী দ্বারা শাসন শোষণের উৎকৃষ্ট তথ হাতিয়ার হল ধর্ম। যা জনগণকে বিভাজিত করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত্য পোষণ করতে বাধ্য করে।"
"ধর্ম হল আফিম....।" এই বিখ্যাত উক্তির প্রবক্তা হলেন দার্শনিক কার্ল মার্কস।
"যারা ঈশ্বরের মহিমার কথা বলছে
তারা বোবা যাঁরা শ্রোতা সকলেই জন্ম থেকে বধির। অথচ ধর্ম সভায় কবন্ধের মিছিল চলছে। কবন্ধ হয়েছে কিম্বা মৃত কিন্তু সকলেই ঈশ্বরকে রক্ষার প্রশ্নে দায়বদ্ধ। তবে তা কী জন্য এবং কেন
তবে উপস্থিত যারা তারা বহুপূর্বেই
ঈশ্বর ও জানেন না। কারণ তিনি অসহায়।"
তবু মানুস্য নানাবিধ ধর্ম দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। এক্ষেত্রে যুক্তি বোধ বা মুক্ত চিন্তার বিষয়টি এক অর্থে অনুপলব্ধ। কারণ ধর্মমোহ তা বিবর্তন বা দ্বন্ধ তত্ত্বকে স্বীকার করে না। যজি তাদের প্রশ্ন করা হয় পরজাগতিক বিষয়টি তো 'শূণ্য'। তাহলে ঈশ্বর (?) নামক একটি পৃথক স্বত্তার প্রয়োজন কেন? সে অর্থে তো সাকার অথবা নিরাকার উভয়তই অপাংতেয় হয়ে যাবে। ঈশ্বরবাদীগণ তখন 'সনাতন', নারীর বাণী কিম্বা ঈশ্বরের প্রেরিত দূত ইত্যাদি অর্বাচীন শব্দ ছকের গোলক ধাধায় নিজেদের সিঞ্জার করে অথবা তাদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত (!) বিষয়টিকে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হয় এমনভাবে যেন তারাই সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশের একমাত্র পৃষ্টপোষক। এক্ষেত্রে তাদের মূল হাতিয়ার সেই ভাববাদী তাড়না। যার সম্পূর্ণটাই দ্বন্ধতত্ত্বের বিপরীত। এই বিষয়টিকে দ্যতর্থক অর্থে মিথ্যাদৃষ্টি ও বলা যেতে পারে।
ধর্ম তো এইরূপ হওয়া উচিত, যা সহজ হবে, সুগম হবে এবং সুগ্রাহ্য হবে। ধর্মের অর্থই হল অত্যন্তধার্য স্বভাব। জল যেমন শীতলতাকে ধারণ করে, অগ্নি যেমন উষ্ণতা কে ধারণ করে, ঠিক সেই ভাবে ধর্মও মনুষ্যের ক্ষেত্রে অযত্নধার্য অথবা সহজধার্য হওয়া উচিত
অত্তনো স্বভাবং ধারেতীতি ধম্মো।
বস্তুতঃ ধম্মপদে বলা হয়েছে-
ন তেন হোতি ধম্মাটঠো যেনতথং সহসা নযে।
যো চ অতথং অনতথং চ উভৌ নিচ্ছেয্য পণ্ডিতো।।
আচার্য শান্তিদের বোধিসত্ত্বের লোক কল্যাণ সংকল্পকে প্রকট করতে গিয়ে বলেছেন-
অনাথানামহং দাসঃ সার্থবাশ্চ যায়িনাম্।
পারেস্তনাং চ নৌভূতঃ সেতুসক্রম এব চ।।
দীপাথিনামহং দীপঃ শষ্যা শয্যাথিনামহম্।
দীসার্থিনামহং দাসো ভয়েয়ং সর্বদেহিনাম্।।
ধর্মের এই স্বরূপ প্রকৃত অর্থে অভিপ্রেত হওয়া উচিত। এত না তো তথাকথিত ঈশ্বর প্রান্তে শাস্ত্রে আগ্রহ আছে, আর না তো লোক অথবা পরলোকাভ্যুদয় সিদ্ধির লোভ। বস্তুরঃ ধর্মের এই স্বরূপ মানুবমাত্র প্রকৃতিরূপে বর্ণিত হয়। প্রকৃত অর্থে ধর্ম আমাদের 'উপাধি' নয় 'নিসর্গ' হওয়া উচিত। শাস্ত্রানুরোধ দ্বারা গ্রাহ্য হওয়ার পরিবর্তে ধর্মকে আত্মানুরোধ অথবা লোকানুরোধ দ্বারা গ্রাহ্য হওয়া উচিত। যদি ধর্ম আমাদের 'স্বভাব' রূপে নির্মিত হয়, তাহলে তার সিদ্ধির প্রশ্নে তন্ত্র-মন্ত্র, পূজা-পাঠ, তীর্থ ব্রত এবং মন্দির-প্রতিমা ইত্যাদির প্রয়োনীয়তা কোথায়? তাহলে তো তা আমাদের আচরণ মাত্র হবে। এইরূপ সহজস সঙ্গত, সর্বগ্রাহ্য ধর্মই সমাজের ক্ষেত্রে ঔষধ কল্প হবে
যে কেচি ওসধা লোক বিজ্ঞন্তি বিবিধা বহু।
ধম্মোসধসমং নতিম এবং সিবথ ভিকখবো।।
ধম্মোসধং পিবিত্বান অজরামরনা সিয়ং।
ভাবযিত্বা চ পসিত্বা নিৰ্ব্বতা উপধিকথযে।।
তবে উপরোক্ত বিষয় তথা মূল্যানয় টি স্বার্থানুমাগী ধর্ম তথা সম্প্রদায়ের নিকট কোনভাবেই বোধগম্য হবে না। কারণের প্রশ্নটি একটি উদাহরণের মাধ্যমে আলোচনা করা হল :
যেমন মধ্যপ্রাচ্য হতে উদ্ভূত হওয়া একটি বিশেষ ধর্ম (৬১০-৬৩২ খ্রীঃ) সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলে এখনও পর্যন্ত সে (বিংশ শতাব্দী) ব্যক্তি স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেয় নি। এই বিষয়টি সেই সকল ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য, যারা নিজ ধর্মগ্রন্থকে 'ঈশ্বরোদভূত' মান্য করে অনেক অমানধীয় দুষ্কৃত্যকে সমর্থন করেন। অতঃ এতপ্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে তাহলে কি ধর্মগ্রন্থের উপদেশ বলপূর্বক জনগণের প্রতি সমর্পিত করার বস্তু অথবা বিবেক এবং যুগা রোধ পূর্বক গ্রহণ করার যোগ? সেই ধর্মদেশনার বাস্তবিক গুরুত্ব কি, যার দ্বারা অন্তশ্চেতনার ক্ষতি হয়। সুতরাং এইরূপ অভদ্র, অগ্রাহ্য, অযৌক্তিক ধর্ম কেন স্বীকার করতে হবে?
'যতোহজুদয়নিঃ শ্রেয়সসিদ্ধিঃ স ধর্মঃ'
ভদন্ত সুমনপাল ভিক্ষু প্রণীত 'ধর্মকেতু' নামক গ্রন্থের অবতরনিকা'তে ধর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে যে।
'সংস্কৃত' ধৃ ধাতুর সঙ্গে 'মন' প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ধর্ম শব্দটির উৎপত্তি। 'ধৃ' ধাতুর অর্থ হল ধারণ করা। এই ধর্ম বলতে বোঝায় যা কোনো কিছুর অস্তিত্বকে ধারণ করে। রিলিজিয়ান বা ধর্ম হচ্ছে, বিশ্বাস ও আচার-আচরণ যা কোনো অতি প্রাকৃতিক সত্তা এবং ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃত্ত থাকে।'
পাশ্চাত্য পণ্ডিত বর্গের মতে, ধর্ম হল আত্মিক জীবে বিশ্বাস, আবার কেউ বলেন, তথাকথিত পবিত্র বস্তু সম্পর্কিত কতকগুলি বিশ্বাস ও প্রথার সমষ্টি।
ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে নানাবিধ তত্ত্ব উপস্থিত আছে। যেমন:
ক। প্রাকৃতিক এবং অতি প্রাকৃত মতবাদ।
খ। আধ্যাত্মিক মতবাদ।
গ। মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ।
ঘ। চারিত্রিক মতবাদ।
ঙ। সামাজিক এবং ঐশী মতবাদ।
এই মতবাদ গুলি আবার ২ ভাবে বিভক্ত; যেমন ১। বিভিন্ন দর্শনগত মতবাদ এবং ২। প্রচলিত সংস্কার গত ধর্মীয় মতবাদ। এছাড়া ধর্মের উৎপত্তিগত আরও কতকগুলি মতবাদ (তত্ত্ব) আছে, যেগুলি হল
১। মাননীয় বিচার বিশ্লেষণ যুক্ত মতবাদ।
২। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মতবাদ।
৩। মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ।
৪। নৃতাত্তিক মতবাদ।
দার্শনিক অ্যাডামসের মতে, বিশ্ব ধর্মগুলি বিভাজনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর ভৌগলিক বিষয় তথা বিভাজন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একটি সাধারণ ভৌগলিক শ্রেণী বিন্যাস মূল বিশ্বধর্ম সমূহকে এই ভাবে বিবেচনা করে -
১। মধ্য প্রাচ্যের ধর্ম সমূহ:
জরখ্রষ্টীয় ধর্ম বা প্রাচীন পারসিক ধর্ম, ইহুদী ধর্ম, খ্রীষ্টান ধর্ম, ইসলাম ধর্ম এবং অন্যান্য আদিম ধর্ম।
২। দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়ার ধর্ম সমূহ:
বৌদ্ধ ধর্ম (স্থবিরবাদ এবং মহাযান), অত্তবাদ এবং কণফুসিয় মতবাদ।
৩। ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্ম সমূহ:
প্রাচীন বৈদিক ধর্ম, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্ম, ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম (বর্ণ হিন্দুত্ববাদ), ভক্তি মূলক ধর্ম এবং টোটেম ধর্ম।
৪। আফ্রিকান মহাদেশের ধর্ম সমূহ:
প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম ব্যতীত টোটেম ধর্ম।
৫। দুটি আমেরিকা মহাদেশের ধর্ম সমূহ:
নানাবিধ আদিবাসী মানুষের বিশ্বাস তথা টোটেম ধর্ম।
৬। ইউরোপ মহাদেশের ধর্ম সমূহ:
প্রাচীন গ্রীস এবং রোমান ধর্ম সহ টোটেম ধর্ম।
তবে এই সকল ধর্ম সমূহের মধ্যে বর্তমানে অনেকগুলি ধর্মের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এর মূল গত কারণ হল খ্রীষ্টান এবং ইসলাম ধর্মের সম্প্রসারণ বাদী চিন্তা।
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ খ্রীষ্টান (রোমান ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, পিউরিটান, অর্থেডক্র এবং জিহোবিষ্ট ইত্যাদি), ২৪ শতাংশ ইসলাম (সিয়া, সুন্নি এবং ওয়াহবী), হিন্দু ১৫-১৬ শতাংশ, বৌদ্ধ (থেরবাদ এবং মহাযান) ৭ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ৩ শতাংশ অন্যান্য ধর্মালম্বী।
অর্থাৎ গণিতের নিরিখে খ্রীষ্টান ধর্ম হল সংখ্যাগুরু একটি ধর্ম। অবষ্টি অন্যান্য ধর্ম গুলি হল সংখ্যা লঘু ধর্ম। কিন্তু এই গাণিতিক পর্যায় দ্বারা এই সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যা লঘু ধর্মের মাপকাঠি বিচার করা এক প্রকার অসম্ভব। কারণ একটি সংখ্যাগুরু ধর্ম স্থান-কাল বিশেষ সংখ্যালঘু ধর্ম হয়। যেমন : মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দঃ পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশের ইসলাম একটি সংখ্যা গরিষ্ট ধর্ম। অপর দিকে খ্রীষ্টান, জিহোবিষ্ট ইত্যাদি সংখ্যালঘিষ্ট ধর্ম।
ইউরোপ, উঃ দক্ষিণ আমেরিকা, ওশিয়ানিয়া মহাদেশে আবার খ্রীষ্টান একটি সংখ্যা গরিষ্ট ধর্ম। তবে এই ধর্মের নানাবিধ গোষ্ঠী কোন দেশে সংখ্যা গরিষ্ট অথবা সংখ্যালঘু।
ইসলাম ধর্মের সুন্নি মতাবলম্বীরা মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা মহাদেশে সংখ্যাগুরু এবং ইরাণে শিয়া মতাবলম্বীগণ সংখ্যা গুরু।
আবার ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মতালম্বীরা সংখ্যাগুরু হলেও বাংলাদেশ, পাকিস্থান, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্থান সহ সম্পূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যে সংখ্যালঘু।
চীন, জাপান, তিব্বত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, কোরিয়া ইত্যাদি দেশ সহ শ্রীলংকাতে বৌদ্ধ ধর্ম সংখ্যা গুরু হলেও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে সংখ্যালঘু একটি ধর্ম।
এইভাবে জৈন, শিখ, কণফুসীয়, তাওবাদী ধর্ম সম্পূর্ণ ভাবে সংখ্যালঘু একটি ধর্ম। জিহোবিষ্টরা ও এই পর্যায় ভুক্ত। তবে এখানে প্রশ্ন আসতেই পারে যে পৃথিবীতে এতগুলি প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিরাজমান থাকলেও সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যা লঘু (?) এইভাবে আখ্যায়িত করা কেন? উত্তর হল ধর্মমোহতা এবং দ্বন্ধ। কারণ ইসলাম এবং বেশ কিছু টোটেম ধর্ম অপৌত্তলিক হলেও তাদের ধর্ম সম্পূর্ণরূপে সামন্ততান্ত্রিক। অর্থাৎ সংস্কারবাদী নয়। ঠিক তেমন ভাবে খ্রিষ্টান ধর্মের একতাংশ সংস্কার পন্থী কিন্তু ক্যাথলিক গণ প্রাচীন পন্থী। তবে উভয়েই পৌওলিক হলেও ধর্মীয় আচার-আচরণে অপৌত্তলিক।
প্রসঙ্গত উল্লেখনীয় যে 'ইসলাম ধর্ম' পথিবীতে প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের তুলনায় সম্পূর্ণভাবে নবীন (৬-৭ শতক খ্রীঃ) একটি ধর্ম হলেও ১২০০ খ্রীঃ'র মধ্যেই এই ধর্ম সম্প্রসারণবাদী হয়ে পড়লে অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে ক্রমাগত সামরিক সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার কারণে মধ্যযুগে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশে ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়লে তাদের মধ্যে প্যান-ইসলামীজমের ধারণ গড়ে উঠতে থাকে। অপর দিকে খ্রীষ্টান ধর্ম মধ্যপ্রাচ্য (বেথলেহেম শহর) হতে উৎপত্তি হলেও মধ্যপ্রাচ্যে এই ধর্ম রোমান শাসকদের নিকট অনুকূল ছিল না, কারণ সেই সময় রোমান বা পৌত্তলিকবাদী তথা বহু দেব দেবী প্রথায় বিশ্বাস ছিল। ফলে রোমান শাসকদের তথা পুরোহিত তন্ত্রের প্রভাবে খ্রীষ্টান ধর্ম মধ্যপ্রাচ্যে তেমন ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। ৩১৩ খ্রীঃ রোমান সম্রাট কণসস্টানটাইন সর্বপ্রথম খ্রীষ্টান ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মরূপে ঘোষণা করলে একদা প্রতিষ্ঠিত পেগান ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে পড়ে এবং পূর্ব ইউরোপে খ্রীষ্টান ধর্ম একটি শক্তিশালী সংখ্যা গরিষ্ট ধর্মে পরিণত হয়।
৬২২-৬৩২ খ্রীঃ সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদ দ্বারা মদিনাতে (আবর অঞ্চল) ইসলামিক রাজতন্ত্র স্থাপিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১২০০-১৫২৬ খ্রীঃ'র সময়কালে অটোমান তুর্কী সাম্রাজ্য, ইরাণে সাফাজিদ সাম্রাজ্য এবং দক্ষিণ এশিয়াতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এই সময় মধ্য প্রাচ্যে ইসলাম ধর্ম একটি সংখ্যা গরিষ্ট ধর্মে পরিণত হয়েছিল।
১০৯৬-১২৭২ খ্রীঃ পর্যন্ত সর্বমোট ৯টি ধর্মযুদ্ধ (ক্রুসেড) সংঘঠিত হয়েছিল। খ্রীষ্টান শাসকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যীশু খ্রীষ্টের জন্মস্থান বেথলেহেম শহরকে ইসলামিক অর্থাৎ মুসলমান শাসকদের হাত থেকে রক্ষা করা এবং অটোমান তুর্কীদের প্রভাব প্রতিপত্তি স্পেন হতে খর্ব করা। এই যুদ্ধে প্রায় ৩ লক্ষ লোক নিহত হয় কিন্তু মধওপ্রাচ্যে মুসলমানদের প্রভাব অক্ষুণ থাকে।
১৪৫৩ খ্রীঃ খ্রীষ্টানদের হাতে তুর্কী সাম্রাজ্যের পতন হলে পূর্ব ইউরোপে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে খ্রীষ্টান ধর্মে সংস্কারবাদী মতদর্শের উৎপত্তি হলে প্রোটেস্ট্যান খ্রীষ্টান ধর্ম সংখ্যা গরিষ্ট ধর্মে পরিণত হয়। এই আন্দোলনের পেছনে ছিল বুর্জোয়া এবং পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণী। অর্থাৎ ধর্ম বিভাজন তথা পুঁজির অনুপ্রবেশ ইউরোপের সামন্ত শ্রেণীকে উৎখাত করতেসহায়তা করেছিল।
ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের পতন এবং ব্রাহ্মণ ধর্মের উত্থানের মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন রাজা পুষ্যমিত্র শুঙ্গ (২০০ খ্রীঃ)। ৫১৫ খ্রীঃ ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল (বর্তমান আফগানিস্থান, পাকিস্থান ও উত্তর ভারত) হতে বৌদ্ধ ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছেন হুন নেতা মিহির কুল। আদি শঙ্করাচার্য (৯ শতক) সম্পূর্ণ ভাবে বৌদ্ধ বিরোধি ছিলেন। সর্বোপরি ১২ শতকে মুসলমান শাসকদের হাতে ভারতবর্ষ তথা বঙ্গদেশ হতে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে যায় ১২০০-১৮৬২ খ্রীঃ পর্যন্ত ভারতবর্ষে মুসলিম সংখ্যালঘু শাসকবর্গ একটি সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দু জনগোষ্ঠীকে পরাভূত করে রেখেছিল। এই সুদীর্ঘ সময়ে ভারতীয় জনগণের এক অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ফলে জনগণের মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ ক্রমশই প্রকট হয়েছিল।
১৭ শতকে ভারতবর্ষে 'ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী অফ গ্রেট বৃটেন' মুসলমান শাসন তন্ত্রকে ধ্বংস করে শাসন ক্ষমতা দখল করলে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা ভারতীয় জনগণের একঅংশ খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়। এই সময় ভারতবর্ষে খ্রীষ্টান এবং মুসলমানরা ধর্মগত ভাবে সংখ্যালঘু হলেও কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসী মনোভাব বজায় রেখেছিল। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হল অলিগড় আন্দোলন।
ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন (১৯ শতক)র প্রধান পৃষ্টপোষক গণ ছিলেন মূলতঃ হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা শিক্ষিত বুর্জোয়া শ্রেণী। অপরদিকে সংখ্যালঘু মুসলমানদের সিংহভাগই এই আন্দোলন বিরোধি এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের পক্ষপাতি ছিল। আর এই কারণের তৎকালীন ঢাকার নবাব এবং ইংরেজ শালক বর্গের বদান্যতায় তথাকথিত মুসলিম আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে মুসলিম লীগ (প্রতিষ্ঠাতা নবাব সলিমুল্লাহ, ১৯০৬ খ্রীঃ) প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯১৫ খ্রীঃ বিনায়ক দামোদর সাভারকার প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দু মহাসভা নামক রাজনৈতিক দল। ১৯২৯ খ্রীঃ এই রাজনৈতিক দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষিণপন্থী হয়ে ওঠে। ১৯২৫ খ্রীঃ কে.বি. হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠিত করেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আর এস এস)। ১৯৫১ খ্রীঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত করেন ভারতীয় জনসংঘ। এই সকল রাজনৈতিক দলের মূল আদর্শ ছিল ভারতবর্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের জাতীয় স্বার্থকে প্রতিষ্ঠিত করা।
১৯৪৬-৪৭ খ্রীঃ মহম্মদ আলী জিন্নার নেতৃত্বে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবীতে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হলে কোলকাতা, ঢাকা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, অবিভক্ত পাঞ্জাবে ধর্মীয় দাঙ্গায় কয়েক লক্ষ ব্যক্তি নিহত হয়। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্থান (মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রদেশ) গঠিত হলেও মূল ভারত ভূখণ্ডে সংখ্যাগুরু হিন্দু এবং সংখ্যালঘু মুসলমান সহ অন্যান্য ধর্মের সমন্বয় গত সমস্যা বজায় রইল। এর মূল কারণ হল ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বা মৌলবাদ।
বর্তমান ভারতে হিন্দু মতাবলম্বী জনগোষ্ঠী সামগ্রিক অর্থে সংখ্যা গুরু হলেও কোনো কোনো রাজ্যে, গ্রামে বা বাণিজ্যিক শহরে মুসলমান বা খ্রীষ্টান সংখ্যাগুরু। ফলে ধর্মগত বিদ্বেষের পরিমান ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বিষয়টি অত্যন্ত নিরাশাজনক তথা উদ্বেগ জনক ও বটে।
"এপারে হিজাব, আর ওপারে টিপ...।"
No comments:
Post a Comment