Friday, October 3, 2025

মেজর জেনারেল আলেকজাণ্ডার ক্যানিংহাম



সুমনপাল ভিক্ষু

স্যার আলেকজাণ্ডার ক্যানিংহামস (১৮১৪-১৯৯৩ খ্রিঃ) তৎকালীন ইংরেজ শাসিত ভারতের সামরিক বিভাগ 'বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপ' এর ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি পরবর্তী সময়ে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব, প্রাচীন ভূগোল তথা ইতিহাসবিদ, বিদ্বানরূপে প্রসিদ্ধ হয়েছলেন। এই অর্থে তিনি ছিলেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব অনুসন্ধান বিভাগের জনক (ফাদার অফ ইণ্ডিয়ান আরকিওলজি)। ক্যানিংহাম'এর ভ্রাতা জোসেফ ক্যানিংহাম ভারতীয় পুরাতত্ত্ব অনুসন্ধান এবং সংরক্ষণের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

ক্যানিংহাম ভারতে ইংরেজ সামরিক বাহিনীর উচ্চপদে আসীন ছিলেন এবং ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মেজর জেনারেল পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ২০ মে, ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে 'অর্ডার অফ ষ্টার ইণ্ডিয়া' (সি.এস.আই) হতে সম্মান লাভ করেন এবং ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে 'অর্ডার অফ ইণ্ডিয়ান এম্পায়ার হতে তথা ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে নাইট কমান্ডার অফ ইণ্ডিয়ান এম্পায়ার সম্মান লাভ করেন।

স্যার ক্যানিংহাম' এর জন্ম ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যাণ্ডে হয়েছিল। তিনি ভারতীয় বিদ্যার বিখ্যাত গবেষক জেমনস্ প্রিন্সেপকে প্রাচীন মুদ্রার লিপি এবং খরোষ্ঠী লিপি পাঠে সহায়তা করেছিলেন। মেজর কিট্রো, যিনি প্রাচীন ভারতীয় স্থানের গবেষক ছিলেন, তিনি ও ক্যানিংহাম'এর সহায়তা লাভ করেছিলেন। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ক্যানিংহাম ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের সার্ভেয়ার পদে নিযুক্ত হন এবং অনতিবিলম্বে উক্ত বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল পদে (১৮৮৫ খ্রিঃ পর্যন্ত) আসীন হন।

পুরাতত্ত্ব বিভাগের উচ্চ পদে অবস্থান কালে তিনি প্রাচীন ভারতীয় বিস্মৃত (বৌদ্ধ) ইতিহাস সম্পর্কিত বিমূল তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। প্রাচীন স্থলের সন্ধান এবং অভিলেখ তথা মুদ্রা ইত্যাদি সংগ্রহ দ্বারা তিনি ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাস সম্পর্কিত গবেষনার ক্ষেত্রে অতীব মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্যার ক্যানিংহাম'এর এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কার্যের বিবরণ 'পুরাতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থাবলী (২৩ খণ্ড) মুদ্রিত হয়েছে। যা ভারত ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

ক্যানিংহাম প্রাচীন ভারতে আগত গ্রীক এবং চৈনিক পর্যটক দ্বারা ভারত বিষয়ক বর্ণনার অনুবাদ তথা সম্পাদনা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন। চৈনিক পর্যটক (বৌদ্ধ ভিক্ষু) শুয়াং জাঙ'এর যাত্রা বিবরণ, বিশেষ করে প্রাচীন স্থানের অভিজ্ঞান, এখনও পর্যন্ত প্রামাণ্য তথ্য রূপে স্বীকার করা হয়। তিনি (ক্যানিংহাম) ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের প্রচীন ভূগোল (দ্য অ্যানসিপ্লেন্ট জিওগ্রাফি অফ ইণ্ডিয়া) নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন, যার গুরুত্ব আজও মলিন হয় নি। এই গবেষণা গ্রন্থে তিনি ভারত ভূমির প্রাচীন স্থলের যে বিবরণ প্রদান করেছেন, তার অধিকাংশই সত্য রূপে প্রমাণিত হয়েছে।

স্যার ক্যানিংহাম: ফাদার অফ ইণ্ডিয়ান আরকিওলজি :

আলেকজাণ্ডার ক্যানিংহাম মাত্র ২১ বৎসর বয়সকালে সারনাথে খননকার্য দ্বারা অশোকস্তম্ভ (বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক) এবং বৌদ্ধস্তূপ অনুসন্ধান সম্পন্ন করেছিলেন। সেই সময় কাশীর রাজা চেতসিংহের দেওয়ান জগত সিংহ নিজ প্রভাব প্রতিপত্তি অক্ষুন্ন রাখার পশ্নে জগত গঞ্জ হাট নির্মাণ করেন। বারাণসী হতে ২-২ ১/২ ক্রোশ দূরে সারনাথ নামক স্থানে একটি উচ্চ টীলার নিকট প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান ছিল। জগত সিংহ তাঁর গৃহ নির্মাণের স্বার্থে সেই স্থানের কিছু প্রস্তর স্তম্ভ বিনষ্ট করে ইট ভাঁটা নির্মাণ কার্য শুরু করেন। এই সময় তাঁর কিছু শ্রমিক উক্ত স্থান হতে একটি স্পরত্র নির্মিত মঞ্জুষা (কলস) উদ্ধার করে। উক্ত কলসে একটি ক্ষুদ্র পেটিকা ছিল, সেই পেটিকাতে কিছু অস্থি অবশেষ এবং মূল্যবান রত্ন ছিল। অজ্ঞানবশবর্তী দেওয়ান অস্থি সমূহ গঙ্গানদীতে বিসর্জন দিয়ে দেন এবং পেটিকাটি সেই অঞ্চলের একজন ইংরেজ অধিকর্তা ডানকান'এর হস্তে সমর্পণ করেন। ধর্মভীরু শ্রমিকগণ অন্যান্য বস্তুগুলি সংগ্রহ করতে অস্বীকার করে।

এই বিষয়টি কাশী অঞ্চলের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। এই স্থানে কিছু প্রাচীন স্তম্ভ, একটি স্তূপ এবং একটি চতুষ্কোণ ইমারত ছিল। হিন্দু সম্প্রদায়'এর বিষয়টি নিয়ে কোনরূপ আগ্রহ ছিল না, কিন্তু বেনারসে বসবাস রত জৈন, ইংরেজ অধিকর্তা বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন কারণ, সারনাথ ছিল ১১তম জৈন তীর্থঙ্কর শ্রেয়াংসনাথ'এর জন্মভূমি। ফলে দিগম্বর এবং শ্বেতাম্বর উভয় সম্প্রদায় দাবী করতে থাকে যে সেই স্তূপ তাদের তীর্থ ভূমি। এই বিবাদ বেশ কয়েক বৎসর বিদ্যমান ছিল।

সেই সময় ক্যানিংহাম  ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী (গ্রেট ব্রিটেন)'র বেঙ্গল রেজিমেন্ট'এর একজন অধিকর্তা ছিলেন। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে জেমস্ প্রিন্সেস'এর প্রভাবে ব্রিটিশ ভারত পুরাতত্ব বিভাগ কাণিংহামকে উক্ত স্থান অনুসন্ধানের ভার প্রদান করে। তিনি স্তূপ'এর শিখর হতে ৫ হাত গভীরে একটি শিলালেখর সন্ধান পান। প্রিন্সেস সেই শিলালেখর লিপি পাঠোদ্বার করেন এবং প্রমান করেন যে ব্রাহ্মী লিপিতে "যে ধম্মা হেতু প্পভবা" নামক বৌদ্ধ ধারণী রয়েছে। কিন্তু ক্যানিংহাম'এর কর্মব্যস্থাভার কারণে বিষয়টি সাময়িক ভাবে চাপা পড়ে যায়।

কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পরে ক্যানিংহাম বেশ কয় একটি গুরুত্ব পুস্তক লাভ করেন। এর মধ্যে চৈনিক ভিক্ষু ফা-শিয়েন এবং শুয়াং জাঙ'এর যাত্রা বিবরণ সম্পর্কিত ২টি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকের ফরাসী ও ইংরেজী অনুবাদ ছিল। উভয় ভিক্ষু ৫ম এবং ৭ম শতাব্দী কালে ভারতে উপস্থিত হয়েছলেন। উক্ত গ্রন্থদ্বয়ের অনুবাদ হতে ক্যানিংহাম অবগত হন যে সারনাথ সাধারণ বৌদ্ধস্থল নয়। মৃগদাব'তে যে স্থানে ধংসস্তূপ বিরাজমান, উক্তস্থানে ভগবান বুদ্ধ সর্বপ্রথম ধর্মোপদেশ দান করেছিলেন। এই স্থানেই কৌণ্ডিণ্য'র বিরজং বীতমলং ধম্মচক্ষু উন্মোচিত হয়েছিল। জিজ্ঞাসু ক্যানিংহাম অনুসন্ধান শুরু করলেন, সেই সকল বৌদ্ধ স্তূপ, বিহার এবং চৈত্য, যেগুলি কালের করাল গ্রাসে ধ্বংস বা বিনষ্ট হয়ে গেছে।

ফা-শিয়েন তাঁর যাত্র বিবরণে সেৎগ-কিও-শী নামক একটি স্থানের উল্লেখ করেছেন। কথিত আছে শাক্যমুণি তাঁর মাতা মহামায়াকে ধম্মোপদেশ প্রদানের নিমিত্তে তুষিত লোক'এ গমন করেছিলেন। অতপর জম্মুদ্বীপ প্রত্যাবর্তন কালে তিনি (বুদ্ধ) সাংকাষ্যতে অবতরণ করলে ভিক্ষু এবং উপাসকগণ তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তুষিত লোক'এর সিঁড়িটি জনৈক উপাসক (?) দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। ফা-শিয়েন উক্ত স্থানে একটি স্তূপ দর্শন করেছিলেন। তিনি সেই স্থানটি কণৌজের নিকট অবস্থিত বলেছেন।

ক্যানিংহাম সেই সময় সামরিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন এবং কণৌজ অঞ্চলে অবস্থান করছিলেন। তিনি উক্ত স্থান হতে ২৮ কোশ দূরে একটি গ্রাম দেখতে পান (সংকিশা অঞ্চল)। গ্রামটি ক্ষুদ্র হলেও তার নিকট পুরাতন ইট দ্বারা নিমিত বেষ্টনী প্রায় ৬ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ক্যানিংহাম'এর মতে এই সংকিশা'ই হল ফা-শিয়েন বর্ণিত সেংগ-শী। তিনি উক্ত স্থানে খনন কার্য শুরু করার প্রশ্নে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর উর্দ্ধতন কর্মচারীকে পত্র প্রেরণ করলে তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সেইরূপ কর্ণপাত না করার কারণে সেই বিষয়টিকে নিয়ে তাঁর পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মধ্য ভারতে ছিলেন, সেই সময় তিনি ভিলসা (বিদিশা)র নিকটবর্তী অঞ্চলে বেশ কিছু ক্ষুদ্র বৃহৎ বৌদ্ধস্তূপের সন্ধান পান। এই স্থানেই সাঁচীর একটি ক্ষুদ্র স্তূপ হতে তিনি ২টি মঞ্জুষা (কলস) উদ্ধার করেন। উক্ত কলসে ভগবান বুদ্ধের ২ প্রধান শিষ্য ধম্ম সেনাপতি সারিপুত্ত এবং ঋদ্ধিমান মহামৌদগল্লায়নের দেহধাতু সংরক্ষিত ছিল। সর্বোপরি স্তূপে অন্যান্য ভিক্ষুদের স্মৃতিও বিদ্যমান ছিল।

আরকিওলজিক্যাল সার্ভেয়ার আলেক্সজাণ্ডার ক্যানিংহাম 

১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেনা বিভাগ হতে নিবৃত্তি লাভ করলে লর্ড কাণিং তাঁকে ব্রিটিশ ভারত সরকারের আরকিলজিক্যাল সার্ভেয়ার পদে নিযুক্ত করেন। এই পদে তিনি ৫ বর্ষ কর্মরত ছিলেন। এই ৫ বর্ষে তিনি পশ্চিম হতে পূর্ব ভারত পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেছিলেন। 'দ্য ভিলসা টপস্' গ্রন্থে তিনি বৌদ্ধ সাহিত্য এবং বৌদ্ধ স্থাপত্য বিষয়ক তথা পুরাতত্ত্ব স্থান সামগ্রী সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেছিলেন।

ক্যানিংহাম চৈনিক বৌদ্ধ ভিক্ষু শুয়াং জাঙ'এর ভারত বিবরণ পাঠ করে ৬২ বৎসর বয়সে বৈশালী'র সন্ধান সম্পূর্ণ করেছিলেন। সেখানে তিনি কূটাগার ভবনের সন্ধান পান, যেখানে ভগবান তথাগত মহাপরিনির্বাণের ঘোষণা করেছিলেন। অতপর ক্যানিংহাম  গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের স্থান সেই শালবৃক্ষ বন (কুশীনারা বা কুশীনগর) ও চিহ্নিত করেন। মল্লরাজারা যেস্থানে ভগবানের নিষ্প্রাণ শরীরের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন।

১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কানিংহাম সাহেঠ-মাহেঠ নামক স্থানে উপস্থিত হয়। মাহেঠ'এ তিনি শ্রাবস্তীর সন্ধান পান, যে স্থানে ভগবান ৪৪ বর্ষাবাস সম্পন্ন করেছিলেন। এই স্থানে শুয়াং জাঙ বর্ণিত অঙ্গুলিমাল নির্মিত স্তূপের সন্ধান পেয়েছিলেন। সাহেঠ'কে তিনি জেতবন বলেছেন, শ্রেষ্ঠী সুদত্ত ভগবান বুদ্ধকে দান করার নিমিত্তে রাজকুমার জেত হতে ১৮ কোটি স্বর্ণমুদ্রা দ্বারা ক্রয় করেছিলেন।

১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তক্ষশিলা অঞ্চল সন্ধান করেন। এই স্থানে ক্যানিংহাম'এর বেশ কিছু সমস্যা হয়েছিল। প্লিনির মতে সিন্ধু পদ হতে ২ দিবস অতিবাহিত হওয়ার পর তক্ষশিলা উপস্থিত হওয়া যায়, অপর দিকে শুয়াং জাঙ'এর মতে ৩ দিবস। অবশেষে শুয়াং জাঙ'এর অভিমত সঠিক প্রমাণিত হয়। অবশেষে তিনি সিরকাপ এবং সিরসুখ নামক ২টি প্রাচীন শহরে তক্ষশিলা'র প্রত্নতাত্বিক স্থান গুলির সন্ধান পান।

১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন ইংরেজ সরকার ক্যানিংহাম'এর পদ এবং কর্ম সমাপ্ত করলে তিনি লণ্ডন চলে যান। এই সময় তিনি তাঁর গবেষণা পত্র গুলি গ্রন্থাকারে (দ্য অ্যানসিয়েন্ট জিওগ্রাফি অফ ইণ্ডিয়া) প্রকাশ করেন, এই গ্রন্থ বুদ্ধকালীন ভারতীয় ভূগোল'এর একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর গ্রন্থ রূপে বিবেচিত হয়েছে।

১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড মেয়ো আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া (এএসআই) নামক একটি স্বতন্ত্র সংস্থা তৈরী করেন এবং কানিংহাম এই সংস্থার সর্বপ্রথম ডিরেক্টর জেনারেল নিযুক্ত হন। এই পদে তিনি ১৫ বর্ষ কর্মরত ছিলেন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উক্ত পদ হতে অব্যহতি লাভ করে ইংল্যাণ্ড প্রত্যাবর্তন করেন। বৌদ্ধ পুরাতত্ব সম্পর্কিত তাঁর অন্তিম গ্রন্থ 'মহাবোধি' ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়।

১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ নভেম্বর প্রায় ৮০ বৎসর কালে ক্যানিংহাম গুরুতর ব্যাধির প্রকোপে কালকবলিত হন। তিনি তাঁর জীবনের ৬০ বর্ষ ভারতীয় পুরাতত্ব সম্পর্কিত তথ্য নিয়েই গবেষণা করেছিলেন। ক্যানিংহাম'এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পরিনাম স্বরূপ ভারত ভূমি হতে বিস্মৃত বৌদ্ধধর্ম লোক মানসে প্রত্যাবর্তন করেছিল।

ভারতীয় পুরাতত্ত্বের জনক ক্যানিংহাম 

স্যার আলেক্সজানণ্ডার কানিংহাম  (জন্ম ২৩ জানুয়ারী ১৮১৪, মৃত্যু ২৮ নভেম্বর ১৮৯৩, লণ্ডন) একজন ইংরেজ সেনা অধিকর্তা এবং পুরাতত্ব গবেষক ছিলেন, তিনি সারনাথ এবং সাঁচী সহ ভারতের অনেক স্থানের খনন এবং ভারতীয় পুরতত্ব বিভাগের প্রথম নির্দেশক রূপে কর্ম সম্পাদন করেছিলেন। মাত্র ১৯ বৎসর কালে তিনি বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্স'এ যোগদান করেন এবং ভারতে ব্রিটিশ সেবাকার্যে ২৮ বৎসর অতিবাহিত করার পর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে মেজর জেনারেল রূপে কর্ম হতে অব্যহতি লাভ করেন।

তাঁর কর্মজীবনের প্রারম্ভিক সময়ে প্রাচীন মুদ্রা বিশেষজ্ঞ এবং ভারতীয় ইতিহাসবীদ জেমস্ প্রিন্সেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্যানিংহাম সারনাথ স্থিত বৌদ্ধ বিহার খনন এবং উক্ত স্থান হতে প্রাপ্ত মূর্তির চিত্র তৈরী করেছিলেন। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সাঁচী খনন করেন। কাশ্মীর (১৮৪৮ খ্রিঃ) স্থিত মন্দিরের বাস্তুকলার অধ্যয়ন এবং লাদাখ (১৮৫৪ খ্রিঃ) সম্পর্কিত কর্ম সম্পাদন ব্যতীত ভিলসা টপস্ (১৮৫৪ খ্রিঃ) হতে প্রাপ্ত মূর্তির বাস্ত্রশিল্পের অবশেষ দ্বারা বৌদ্ধ ইতিহাস সন্ধানের বিষয়টি তিনি সর্বপ্রথম প্রয়াস করেছিলেন।

১৮৬১-১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্যার ক্যানিংহাম ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগের নির্দেশক ছিলেন। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৫ বর্ষ সময়কাল অবধি তিনি উত্তরভারতের প্রাচীন ভগ্নাবশেষ ইত্যাদি সম্পর্কিত পুরাতাত্বিক অন্বেষণ করেছিলেন। তিনি ভারতের প্রাচীন ভূগোল (১৮৭১ খ্রিঃ), ৩য় শতাব্দী (খ্রিঃ পূঃ)র ভারতীয় বৌদ্ধ সম্রাট অশোকের শিলালিপি'র মূল পাঠ এবং এরহুত স্তূপ (১৮৭৯ খ্রিঃ) গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিলেন। দীর্ঘ সময়কাল ব্যাপী তিনি প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রা সংগ্রহ করেছিলেন, বর্তমানে সেগুলি ব্রিটিশ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। পুরাতত্ত্ব বিভাগ হতে সেবানিবৃত্তির (১৮৮৫ খ্রিঃ) পর তিনি প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রা সম্পর্কিত গবেষণা শুরু করেন এবং উক্ত বিষয় সম্পর্কিত ২টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে নাইট কমান্ডার উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

স্যার আলেক্সজাণ্ডার ক্যানিংহাম  ভারতীয় পুরাতত্ব অনুসন্ধান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন এবং হরপ্পাকে বিশ্ব পুরাতাত্বিক মানচিত্রে আনয়নের প্রশ্নে প্রথম ব্যক্তি রূপে গৃহীত হয়েছিলেন। তিনি ১৮৫৩, ১৮৫৬ এবং ১৯৭২-৭৩ খ্রিষ্টাব্দে হরপ্পা উপস্থিত হয়েছিলেন এবং উক্ত স্থানের উৎখননের বিষয়টি সেই সময় (এএসআই রিপোর্ট) 'হরপ্পা' বিষয়ক নিবন্ধে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই বিষয়টি (প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা) পৃথিবীর বুকে দৃষ্টান্ত প্রদানে সক্ষম হয়েছিল।

গ্রেগরী পার্সেল 'ইন্ডাস্ এজ দি বিগিনিংস' গ্রন্থে বলেছেন "হরপ্পার অনিয়ন্ত্রিত লুণ্ঠনকার্য ক্যানিংহামকে সেই অঞ্চলে খনন কার্য করার প্রশ্নে উৎসাহিত করেছিল। তাঁর এই কার্য সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীর দরবারে উপস্থিত হয়েছিল যা বাস্তবিক অর্থে গুরুত্বপূর্ণ।"

ভারতীয় পুরাতত্বের গবেষণার ক্ষেত্রে ক্যানিংহাম'এর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হল সমগ্র উত্তর ভারতের পুরাতাত্ত্বিক অবশেষ সেই সম্পর্কিত সূচী নির্মাণ। সর্বোপরি তিনি বিপুল সংখ্যক শিলালেখর সন্ধান এবং সেগুলির পাঠোদ্ধার তথা সংরক্ষণ করেছিলেন। তিনি জেএএসবি এবং ন্যূমিজমৈটিক ক্রনিকল'এ প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রার সম্পূর্ণ বিবরণ সম্পর্কিত গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছিলেন। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রাচীন ভারতের ভূগোল সম্পর্কিত একটি মনোগ্রাফ প্রস্তুত করেন, ফলে তিনি হয়ে ওঠেন 'ভারতীয় পুরাতত্ত্বের জনক'।

১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ক্যানিংহাম সাধারণ সৈনিক শিক্ষার্থী রূপে ইংল্যাণ্ড হতে ভারতে উপস্থিত হন এবং সৈনিক ইঞ্জিনিয়ার রূপে যুদ্ধে অংশগ্রহণ তথা পরবর্তী সময়ে বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) এবং পশ্চিমোত্তর প্রান্তের মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্স-এর কার্যকালে তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি ঐতিহাসিক স্থানের অনুসন্ধান, পাণ্ডুলিপির অধ্যয়ন এবং গবেষণা পত্র নির্মাণের মাধ্যমে ভারতের প্রাচীন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে পৃথিবীর সম্মুখে উপস্থিত করেছিলেন।

১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলিকাতা সংগ্রহশালার মুখ্য কিউরেটার পদে যুক্ত হন এবং ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগের প্রথম মহানির্দেশক পদে আসীন হন। তিনি এই পদে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের সময়কাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ৭২৫টি পুরাতত্ব স্থানের পঞ্জিকরণ সম্পূর্ণ করা হয়, যার মধ্যে অন্যতম হল সাঁচী, সারনাথ ভারহুত ইত্যাদি। ক্যানিংহাম মৌর্য এবং গুপ্ত যুগ সম্পর্কিত শিল্পকলা, মুদ্রা, শিলালেখ অনুসন্ধান তথা সংরক্ষণের মাধ্যমে ভারতের প্রাচীন সময়রেখাকে উপলব্দি করার প্রশ্নে একটি সংরচনা প্রদান করেছিলেন যা অদৃশ্য ছিল।

ভারতীয় পরাতত্বের ইতিহাস

১৯ শতকের পূর্বে অব্যবস্থিত রূপে ভারতের প্রাচীন স্থল এবং শিল্পকলা সমূহের অনুসন্ধান ইংরেজ অধিকর্তা এবং অন্য ইউরোপীয় আগন্তুক দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিল কিন্তু উৎখনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থিত দৃষ্টিকোণের পূর্ব অভাব ছিল। আলেক্সজাণ্ডার ক্যানিংহাম'এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে এই অভাব দূরীভূত হয়। তিনি ৭০০'র অধিক পরিদৃশ্যকে সাবধানতার সঙ্গে অনুসন্ধান এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের উৎখনন করেছিলেন। ক্যানিংহাম ৩০টি ধ্বংসাবশেষ'এর প্রতিবেদন ও তৈরী করেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদ্বীপে ব্যবস্থিত পুরাতাত্বিক অন্বেষণ এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

ভারতে ১৯ শতকে ভারতীয় শিল্পকলা এবং পুরাতত্ত্বের বিকাশ শুরু হয়েছিল। আলেক্সজাণ্ডার ক্যানিংহাম তাঁর জেষ্ঠ্য ভ্রাতা জোসেফ'এর সঙ্গে লণ্ডনে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন এবং ২১ বৎসর বয়সে তিনি সারনাথে খননকার্য শুরু করেছিলেন। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ হতে সেবানিবৃত্তি লাভের পর গবেষণা কার্য সম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে লণ্ডনে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮৮৭খ্রিষ্টাব্দে ক্যানিংহাম নামটি কমাণ্ডার উপাধিতে ভূষিত হন।

১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ক্যানিংহাম সেনাবাহিনী হতে ইণ্ডিয়ান আরকিওলজির নিরীক্ষক পদে যুক্ত হন, সেই সময় তিনি এই বিষয়ে অত্যন্ত তৎপরতা প্রদর্শন করেছিলেন। সর্বপ্রথম তিনি মহানির্দেশক রূপে অনেক গুলি অঞ্চল অনুসন্ধান, পুরাতত্বিক প্রতিবেদ (৩০ খণ্ড) তৈরী এবং মুখ্যত প্রাচীন শহরগুলি উৎখনন করেছিলেন। এই অর্থে তিনি ছিলেন ভারতীয় পুরাতত্বের পিতামহ, কারণ : ১. তিনি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসকে বৈজ্ঞানিক ভাবে পুনঃ নির্মিত করার প্রশ্নে পুরতাত্ত্বিক সাক্ষ্য সংগ্রহ করেছিলেন।

২. তাঁর ব্যাপক অনুসন্ধানের ফলে সাঁচী, সারনাথ এবং ভারহুত ইত্যাদি বৌদ্ধ স্থলের সমৃদ্ধ শিল্পকলা, শিলালেখ ইত্যাদি আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছিল, ফলে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত ইতিহাস কালের অন্ধকার হতে আলোক লাভ করেছিল।

৩. তাঁর দ্বারা লিখিত প্রতিবেদন পুরাতত্ব গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পূর্ণ তথ্য রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

৪. ক্যানিংহাম প্রদত্ত মানচিত্র, আলোকচিত্র, দলিল-দপ্তাবেজ এবং সংরক্ষণ পদ্ধতি আজও অত্যন্ত মূল্যবান রূপে প্রমাণিত হয়েছে।

৫. তিনি স্থানীয় সহায়কগণকে প্রশিক্ষণ, উৎসাহপ্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে ভারতীয় পুরাতত্ত্বের অনুসন্ধানের গতি বৃদ্ধি করেছিলেন।

ভারতের প্রাচীন ভূগোল (বৌদ্ধযুগ) এবং ক্যানিংহাম 

ভারতবর্ষের ইতিহাসে ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজ্য শাসন, ভূগোল ইত্যাদি পরিদৃশ্যকে অতি সরলতার দ্বারা উপলব্ধি করার প্রশ্নে ইতিহাসের সময়কে কিছু বিশেষ অংশে বিভক্ত করা যেতে পারে তথা রাজ রাজাদের নাম, জনপদ, সেই সময়কালের প্রচলিত ধর্ম পদ্ধতি এবং রাজনৈতিক পদ্ধতি ইত্যাদির প্রতি ভিত্তি করে উক্ত ইতিহাস এইরূপ হয়। যেমন বৌদ্ধ যুগ, ব্রাহ্মণ যুগ এবং মুসলমান যুগ।

ব্রাহ্মণ যুগ'এর ভূগোলে আর্য গতি দ্বারা সর্বপ্রথম পাঞ্জাব বিজয় হতে শুরু করে বৌদ্ধধর্মের উত্থানের সময়কাল পর্যন্ত উত্তর ভারতে আর্য জাতির বিস্তারের বিবরণ পাওয়া যায় এবং এই সময় কালে আর্যদের প্রাচীনতম অংশের ইতিহাস তথা বৈদিক ধর্ম প্রচলিত ছিল।

বৌদ্ধ যুগ তথা ভারতের প্রাচীনতম ভূগোলে বুদ্ধের সময়কাল হতে মহম্মদ গজনী'র বিজয় পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান, বিস্তার এবং পতনের কাহিনী নিহিত আছে এবং এর অধিকাংশ সময়ে বৌদ্ধধর্মই ভারতের মুখ্য ধর্ম ছিল।

মুসলমান যুগ (তুর্কী হতে মুঘল যুগ) বা ভারতের আধুনিক যুগ'এর ভূগোল মহম্মদ গজনীর সময়কাল হতে পলাশীর যুদ্ধের সময় পর্যন্ত বা ৭৫০ বর্ষের সময় মুসলমান শক্তির উত্থান তথা বিস্তারের সময় ছিল এবং এই সময় মুঘল'রা মুখ্য শাসক ছিল। এম.বিধান ডি সেন্ট মার্টিন অপর একটি পুস্তকে ভারতের বৈদিক যুগ সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করেছেন। তাঁর এই মূল্যবান পুস্তক দ্বারা বৈদিক ধর্ম সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

অপরদিকে এইচ.এইচ. উইলসন্ লিখিত পুস্তক 'এরিয়ানা এনটিকা' তথা অধ্যাপক লাসেন দ্বারা পেন্ট পোটামিয়া ইণ্ডিকা গ্রন্থদ্বয়ে উত্তর পশ্চিম ভারতের ইতিহাস সম্পর্কিত আংশিক বিবরণ দৃষ্ট হয়। অধ্যাপক লাসেন অপর একটি গ্রন্থে সম্পূর্ণ ভূগোলের বিবরণ প্রদান করেছেন। সেন্ট মার্টিন তাঁর ২টি গ্রন্থে ভারতের সমগ্র ভূগোল বিস্তারিত ভাবে প্রদানের মাধ্যমে পূর্ব সীমাবদ্ধতা দূর করেছেন। এর মধ্যে ১টি গ্রন্থ গ্রীক তথা ল্যাটিন তথ্য হতে প্রাপ্ত সূচনার প্রতি ভিত্তি করে ভারতীয় ভূগোল রচিত হয়েছে এবং ২য় গ্রন্থটি এম. জুলীন দ্বারা চৈনিক বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী শুয়াং জাঙ'এর জীবনী তথা যাত্রা বিবরণের অনুবাদ পরিশিষ্ট রূপে গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতীয় ভূগোলের অনুসন্ধান এতটাই সাবধানতার সহেগ সম্পন্ন হয়েছে যে অনেক স্থানের প্রকৃত রূপ অত্যন্ত স্পষ্টতার সঙ্গে পরিস্ফুট হয়েছে।

তৃতীয় অর্থাৎ আধুনিক কালের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মুসলমান শাসনের অনেকগুলি ঐতিহাসিক পুস্তক দৃষ্ট হয়। তবে এক্ষেত্রে বলা যায় সেই সময় কালের অনেকগুলি স্বতন্ত্র রাজ্যের সীমাঙ্কন প্রকৃত অর্থে সম্পন্ন হয় নি, যেগুলির সূত্রপাত ১৫ শতাব্দীতে তৈমূর লঙ্'এর আক্রমণে উদ্ভূত অবব্যস্থার সময়ে হয়েছিল। এই সময়কালে স্বাধীন হওয়া দিল্লী, জোনপুর, বঙ্গ, মালব্য, গুজরাত সিন্ধু, মূলতান তথা গুলবাগ ইত্যাদি মুসলমান রাজ্য এবং গোয়ালিয়র ইত্যাদি বিভিন্ন হিন্দু রাজ্যের সীমারেখা অংকন করার ক্ষেত্রে অদূরদর্শিতার অভাবে এই সময়কালের ইতিহাস অত্যন্ত অসঙ্গতিপূর্ণ, স্পষ্ট নয়।

স্যার ক্যানিংহাম বৌদ্ধ যুগ বা ভারতের প্রাচীন ভূগোলকে তাঁর গবেষণার মূল প্রতিবাদ বিষয়রূপে গ্রহণ করেছিলেন কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল এই সময়কালের প্রাপ্ত বিষয়বস্তুগুলি সম্পূর্ণ অর্থে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রমাণযোগ্য ও বটে। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৪ শতাব্দী, অর্থাৎ আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণ এবং ৭ শতাব্দী (খ্রিঃ) তে চৈনিক তীর্থযাত্রী শুয়ং জাঙ'এর যাত্রা বিবরণকে তাঁর গবেষণার মুখ্য মার্গ দর্শক রূপে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস তথা এই চৈনিক তীর্থযাত্রীর তীর্থযাত্রার বিবরণ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা আলেকজাণ্ডারের বিজয় অভিযান। ম্যসিডোনিয়ার বিজেতার বাস্তবিক আক্রমণ সিন্ধু এবং তার সহায়ক নদীর তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত সীমিত ছিল কিন্তু স্বয়ং আলোকজাণ্ডার এবং তাঁর সহযোগী দ্বারা একত্রিত সূচনা তথা উত্তরকালে সিরিয়ার বাদশাহের দূর এবং আক্রণ দ্বারা প্রাপ্ত সূচনাতে, উত্তরে গঙ্গানীদর সমগ্র অঞ্চল, দক্ষিণে পূর্ব ও পশ্চিম ঘাটের পূর্ণ বিবরণ এবং ভারতের আন্তরিক অংশের বিবরণ নিহিত আছে। টলেমী এই সকল তথ্য গুলিকে ব্যক্তিগত ক্রমানুসারে বিস্তারিত রূপ প্রদান করেছেন। টলেমীর বিবরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই বিবরণ আলোকজাণ্ডার এবং শুয়াং জাঙ'এর সময়'এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত (আলোকজাণ্ডারের আক্রণ ৩৩০ খ্রিঃ পূর্ব টলেমীর ভূগোল ১৫০ খ্রিঃ অর্থাৎ ৪৮০ বৎসর পর এবং শুয়াং জাঙ এর যাত্রা শুরু ৬৩০ খ্রিঃ, টলেমীর ৪৮০ বৎসর পর)। এই সময় ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল যবনদের অধিকারে ছিল।

টলেমীর পরবর্তী সময়ে প্রাচীন শিলালেখ, পুরান ইত্যাদির সন্ধান মূলতঃ তথ্যের অভাবে তথসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু ৫ম-৭ম শতাব্দী (খ্রিঃ) কালে বেশ কিছু চৈনিক পর্যটকের যাত্রা বিবরণ ভারতবর্ষের ধর্ম-সংস্কৃতি, জনপদ এবং রাজ শাসন সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উন্মোচনে সহায়তা করেছে।

চৈনিক যাত্রী ফা-শিয়েন একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন। তিনি ৩৫৫ তথা ৪১৩ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধু অঞ্চল হতে গঙ্গানদীর অববাহিকা পর্যন্ত ভারতবর্ষ যাত্রা করেছিলেন। পরিতাপের বিষয় তাঁর বিবরণ অতি সামান্য ছিল এবং মুখ্য রূপে এই তথ্য বৌদ্ধধর্মের পবিত্র স্থান ও বস্তু সম্পর্কিত ছিল কিন্তু তা অতি গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় তীর্থ যাত্রী সুং ইউন'এর যাত্রা ৫০২ খ্রিষ্টাব্দে হয়েছিল কিন্তু এই যাত্রা কাবুল উপত্যকা হতে উত্তর পশ্চিম পাঞ্চাব পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে তাঁর বিবরণ মুখ্যরূপে অপূর্ণ বলেই গৃহীত হয়। উভয় যাত্রীর যাত্রা বিবরণ এস.উইল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অনুবাদ করেছেন।

তৃতীয় চৈনিক তীর্থযাত্রী এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু শুয়াং জাঙ তাঁর জীবনকালের ১৫ বৎসর ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র স্থানের যাত্রা এবং বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত পুস্তকের গভীর অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁর যাত্রা বিবরণের অনুবাদের প্রশ্নে আমরা এম. জুলীন'এর প্রতি কৃতজ্ঞ, যিনি এই উদ্দেশ্য পূর্তি হেতু চীনা এবং সংস্কৃত ভাষার চর্চা করার উপলক্ষ্যে ২০ বৎসর কাল অতিবাহিত করেছিলেন।

শুয়াং জাঙ'এর যাত্রার সময়কাল ৬২৫-৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল। এই সময় তিনি কাবুল তথা কাশ্মীর হতে গঙ্গা-সিন্ধুনদীর অববাহিকা পর্যন্ত এবং নেপাল হতে মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই)'এর নিকট কাঞ্চীপুর পর্যন্ত সমগ্র ভারতের বৃহৎ নগর সমূহের যাত্রা করেছিলেন। তিনি ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে যে মাসের অন্তিম দিবসে বামিয়ান মার্গ হতে কাবুলে প্রবেশ করেছিলেন এবং পরবর্তী বর্ষের এপ্রিলে ওহিন্দ হতে সিন্ধুনদ অতিক্রম করেছিলেন। শুয়াং জাঙ বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র স্থান ভ্রমণের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ সময় তক্ষশিলা অঞ্চলে অবস্থানরত ছিলেন। অতএব পরবর্তী সময়ে তিনি কাশ্মীরে প্রস্থান করেন। তিনি এই স্থানে ২ বর্ষ অতিবাহিত করেছিলেন।

পূর্ব দিকে তাঁর যাত্রা কালে তিনি সাংগলার ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করেছিলেন যা আলোকজাণ্ডার'এর ইতিহাসের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। চিন্নাপট্টীতে ১৪ মাস এবং জলন্ধরে ৪ মাস ধর্মীয় অধ্যয়ন হেতু অবস্থান করার পর হুয়েন সাং ৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দে সতলুজ নদী অতিক্রম করেন। অতঃ তিনি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মার্গ অনুসরণ করে মথুরা উপস্থিত হন। এই স্থান হতে উত্তর পশ্চিমে ২০০ মাইল দূরে থানেশ্বর, যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত শ্রুগনা তথা গঙ্গার তীরে স্থিত গঙ্গাদ্বার হতে ক্রমশঃ উত্তর পাঞ্জাব বা রুহেলাখণ্ড'র রাজধানী অহিছত্র'র উদ্দেশ্যে তিনি যাত্রা করেন। এই অঞ্চল অতিক্রম করে তিনি সংকিশা কনৌজ তথা কৌশাম্বীর প্রসিদ্ধ নগরের যাত্রার উদ্দেশ্যে গঙ্গা নদী কে পুণঃ অতিক্রম করেন এবং অতঃপর তিনি অযোধ্যা তথা শ্রাবস্তীর পবিত্র বৌদ্ধ স্থলের প্রতি শ্রদ্ধা ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যে উত্তর দিকে প্রস্থান করেন।

এই স্থান হতে তিনি কপিলবস্তু তথা কুশীনগর (ভগবান বুদ্ধের জন্ম এবং নির্বাণ স্থান)'এর প্রতি যাত্রা হেতু পুনঃ পূর্ব দিক অনুকরণ করেন ও সেই স্থান হতে একবার পুনঃ পশ্চিম দিকে বেনারস'এর পবিত্র নগর উপস্থিত হন যেখানে ভগবান বুদ্ধ তাঁর সর্বপ্রথম ধর্ম শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। অতঃপর পুনঃ পূর্ব দিক অনুকরণ করে তিনি তিহুত'এ বৈশালীর প্রসিদ্ধ নগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং উক্ত স্থান হতে তিনি নেপাল গমন করেন এবং পুনঃ বৈশালী হয়ে গঙ্গানদী অতিক্রম করে পাটলীপুত্র (পালিবোথরা) উপস্থিত হন।

পাটলীপুত্র হতে তিনি গয়ার সন্নিকটে বুদ্ধ গয়াতে সেই পবিত্র যজ্ঞ ডুমুর (কাক ডুমুর) বৃক্ষ, দেখঅনে বুদ্ধ ৫ বর্ষ তপস্যা করেছিলেন, হতে শুরু করে গিরিল্যেক (গিরিয়েক) এর পাহাড়, সেখানে বুদ্ধ দেবরাজ ইন্দ্রকে ধর্মদেশনা প্রদান করেছিলেন, শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। অতপর তিনি মগধের প্রাচীন রাজধানী কুসাগরপুর তথা রাজগৃহের প্রাচীন নগর, নালন্দার মহান বৌদ্ধ বিহার উপস্থিত হন। এই স্থানে তিনি সংস্কৃত ভাষা অধ্যয়ন হেতু ১৫ মাস অতিবাহিত করেছিলেন।

৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে তিনি গঙ্গা নদী হয়ে মোঘ গিরি তথা চম্পা পর্যন্ত পুনঃ অনুসরণ করেন এবং অতপর নদী অতিক্রম পূর্বক উত্তর দিকে পৌণ্ড্রবর্ধন বা পুনবা তথা কামরূপ বা আসামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

এইভাবে ভারতের সুদূর পূর্ব জনপদে উপস্থিত হওয়ার পর শুয়াং জাঙ সমতট সমতট বা যশোর তথা তাম্রলিপি বা তমলুক হয়ে ৬৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ওদরা বা ওড়ীসা (উড়িষ্যা) পৌঁছান। দক্ষিণ অংশে তিনি গঞ্জাম তথা কলিঙ্গ যাত্রা করেন তথা উত্তর দিকে প্রায়দ্বীপ'এর মধ্যবর্তী অঞ্চল কোশল বা বরার'এ উপস্থিত হন। অতপর দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র বা তেলেঙ্গানা প্রদেশ অতিক্রম করে অমরাবতী (ধনকাকটা) পৌঁছান। এই স্থানে তিনি বৌদ্ধধর্ম শাস্ত্র অধ্যয়নের স্বার্থে বেশ কয়েক মাস কাল অবস্থান করেছিলেন। ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম দিক তিনি দ্রাবিড়'এর রাজধানী কাঞ্চীপুর (কাঞ্জীভরম) পৌঁছান কিন্তু সেই সময় লংকার রাজার মৃত্যুর পর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তিনি তাঁর দক্ষিণ ভারত যাত্রা স্থগিত করেছিলেন।

লংকারে সংকটকালীন পরিস্থিতি রাজা বন মুগলানের মৃত্যুর পর উৎপন্ন হয়েছিল, তিনি ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধে পরাজিত এবং নিহত হয়েছিলেন। এই তথ্য হতে অনুমান করা যায় যে তিনি সম্ভবত ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে'র প্রথমার্ধে কাঞ্জীপুর পৌঁছেছিলেন। এক্ষেত্রে শুয়াং জাঙ'এর গতিবিধি সম্পর্কিত ক্যানিংহামের তথ্য সঠিক বলে প্রমামিত হয়।

দ্রাবিড় হতে শুয়াং জাঙ পুনঃ উত্তর দিকে গমন করেন তথা কোংকন এবং মহারাষ্ট্র হয়ে নর্মদা নদীর তীরে অবস্থিত ভড়েচ নগরে পৌঁছান। সেই স্থান হতে তিনি উজ্জয়নী, বল্লভী তথা অন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য অতিক্রম করে ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে সিন্ধু তথা মুখতান উপস্থিত হন। এরপর তিনি হঠাৎ মগধ'এর দিকে নালন্দা তথ্য তিলধকের মহান বৌদ্ধ বিহার'এ প্রজনভদ্র নামক প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ আচার্য'র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অতপর তিনি পুনঃ কামরূপ বা আসাম'এ চলে যান এবং সেই স্থানে ১ মাস অতিবাহিত করেন। ৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমদিকে তিনি পুনঃ পাটলিপুত্র হয়ে উত্তর ভারতের মুখ্য শাসক হর্ষবর্ষণ বা শিলাদিত্যের রাজদরবারে উপস্থিত হন।

সেই সময় হষবর্ধনের রাজদরবারে ১৮ সহায়ক শাসক পঞ্চবর্গীয় সংসদের পবিত্র কার্য সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছিলেন। শুয়াং জাঙ সেই পবিত্র উৎসবে যোগদান করেন এবং পাটলিপুত্র হতে প্রয়াগ, কোশাম্বী হতে কণৌজ'এর দিকে যাত্রা করেছিলেন। তিনি এই স্থনের ধার্মিক উৎসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ প্রদান তথা তৎকালীন বৌদ্ধ ধর্মের রীতি উৎসবের প্রতি আলোকপাত ও করেছিলেন। অতপর তিনি রাজা হর্ষবর্ধনের নিকট হতে অনুমতি গ্রহণ পূর্বক জলন্ধরের রাজা উদিত্যের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম দিকে চলে যান। এই সময় তিনি অনেক বৌদ্ধ মূর্তি এবং বৌদ্ধ পুস্তক একত্রিত করেছিলেন কিন্তু তার মধ্যে ৫০টি হস্তলিপি উৎখণ্ড বা ওহিন্দ নামক স্থানে নদী অতিক্রম কালে বিনষ্ট হয়ে যায়। ক্যানিংহাম'এর মতে হয়েন সাং ৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধু নদ অতিক্রম করেছিলেন।

শুয়াং জাঙ পুনঃরায় হস্তলিপি সমূহের নবীনতম প্রতিলিপি প্রাপ্ত করার উদ্দেশ্যে উৎখণ্ডে ৫০ দিবস অবস্থান করেছিলেন। অতঃপর তিনি কপিসা'র রাজার সাথে লমগান চলে যান। তিনি ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের মধ্যবর্তী সময়ে অথবা এর ৩ মাস পূর্বে সম্ভবত লমগান উপস্থিত হয়েছিলেন। এই প্রথম দক্ষিণ দিকে ফলনা বা বন্ন জেলা পর্যন্ত তাঁর হঠাৎ যাত্রার প্রতি আলোক পাত করে, যে স্থান হতে তিনি কাবুল তথা গজনী হয়ে কপিসা পৌঁছেছিলেন। এই স্থানে তিনি ধর্মীয় সংসদে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে পুনঃ অবস্থান করেছিলেন। ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে জুলাই মাসের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত বা বাথিয়ান মার্গ হতে ভারতে সর্বপ্রথম প্রবেশের ১০ বর্ষ পরে কপিসা হতে তিনি প্রস্থান হয়ত করতে পারেন নি। কপিসা হতে পঞ্চশীর উপত্যকা তথা সাবক দরে হয়ে তিনি অন্দেরার পৌঁছান, সম্ভবতঃ তিনি জুলাই মাসের অন্তিম সময়ে পৌঁছেছিলেন। ৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দে বসন্তের সময়কালে তিনি চীনের পশ্চিম অঞ্চলের রাজধানীতে সকুশল উপস্থিত হয়েছিলেন। স্যার ক্যানিংহাম'এর মতে শুয়াং জাঙ একমাত্র পর্যটক যিনি ভারতবর্ষের ভৌগোলিক পরিস্থিতি, সমাজ জীবন, ধর্ম, জনপদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে প্রদান করেছিলেন।

বুচালন হ্যামিলটন'এর অনুসন্ধান মূলত উত্তর ভারতের গঙ্গানদীর নিম্নভাগ তথা দক্ষিণ ভারতের মৈসুর জেলা পর্যন্ত সীমিত ছিল।

জ্যাকমান্ট সীমিত যাত্রা করেছিলেন। তবে এই ফরাসী পণ্ডিত মুখ্য রূপে বনস্পতি শাস্ত্র (বোটানি) এবং ভূগর্ভ শাস্ত্র (জুওলজি) তথা অন্য বৈজ্ঞানিক বিষয় আলোচনা করেছিলেন। তাঁর ভারত যাত্রা মূল অর্থে অসমাপ্ত ছিল। ক্যানিংহাম'এর ভারত যাত্রা উত্তর ভারতে সিন্ধু নদের নিকট পেশোয়ার তথা মূলতান, ইরাবতী নদীর তীরে রেঙ্গুন তথা প্রোম, কাশ্মীর হতে লাদাখ, সিন্ধু নদীর তটবর্তী অঞ্চল এবং নর্মদা নদীর তীরবর্তী দেশসমূহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে তিনি দক্ষিণ ভারত সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ছিলেন তথা পশ্চিম ভারতের এলিফ্যান্টা এবং কানহারীর প্রসিদ্ধ গুহা সহ শুধুমাত্র মুম্বই'এর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।

ক্যানিংহাম ৩০ বর্ষের অধিককাল'এর কর্মজীবনে ভারতের প্রাচীন ইতিহাস এবং ভূগোল অধ্যয়ন তথা গবেষণা কার্য সম্পূর্ণ করেছিলেন। তাঁর ভারত নিবাসের অন্তিম ৪ বর্ষে তিনি প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধান, পরীক্ষণ এবং বিবরণ প্রস্তত করেছিলেন। তিনি ভারতের প্রাচীন ভূগোল নামক গ্রন্থে প্রাচীন নগর, জনপদ ইত্যাদির সঠিক তথ্য প্রদান সক্ষম হয়েছিলেন। যেমন

১। এওরনাস্, আলোকজাণ্ডার মহান দ্বারা অধিকৃত প্রস্তর নির্মিত দুর্গ।

২। তক্ষশিলা, উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের রাজধানী।

৩। সাংগলা, আলেকজাণ্ডার দ্বারা অধিকৃত পাঞ্জাবের পর্বতীয় দুর্গ।

৪। শ্রুঘনা, যমুনা নদীর তীরবর্তী একটি প্রসিদ্ধ নগর।

৫। অহিছত্র, উত্তর পাঞ্চালের রাজধানী।

৬। বৈরাট, দিল্লীর দক্ষিণে জয়পুর'এর মধ্যবর্তী মৎস'র রাজধানী।

৭। সংকিসা, কণৌজের নিকটবর্তী অঞ্চল, যা স্বর্গ হতে বুদ্ধের অবতরণের স্থান রূপে প্রসিদ্ধ ছিল।

৮। রাপ্তী নদীর তীরে শ্রাবস্তী, যা বুদ্ধের ধর্মশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ ছিল।

৯। কৌশাম্বী, এলাহাবাদের নিকট যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত।

১০। কবি ভবভূতির পদ্মবতী।

১১। পাটনার উত্তরে বৈশালী।

১২। নালন্দা, সমগ্র ভারতে সব থেকে অধিক প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ বিহার।

No comments:

Post a Comment