সুমনপাল ভিক্ষু
"এমন এক অন্ধকার সময় আসে
যখন সৎ থাকার অর্থ রাস্তায় দাঁড়ানো যখন বিশ্বাস মানেই পায়ের নিচে মাটি নেই।
যে কবি হতে চেয়েছিল
তাকে দেখলাম মর্গে শুয়ে আছে ....এমন এক অন্ধকার সময় আসে যখন বন্ধুর দিকে দু'হাত বাড়ানোই আত্মহত্যা।" বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
নব্য বিশ্বায়নের যুগে শিক্ষা এবং সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে একটি দ্বন্দু অনিবার্যভাবে তীব্রতর হচ্ছে ভোগ্যপণ্য ও বাজার কেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনার সাথে সাথে সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে তথাকথিত জনকল্যাণ মুখী এবং আদর্শবাদী সমাজ গঠনের ভাবনা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল ভরকেন্দ্র তথা চালিকাশক্তি হল 'মুনাফা', তা সে শিক্ষার ক্ষেত্রেই হোক বা অন্যত্র। পুঁজিবাদী অর্থনীতি কোন ও মানুষে মানুষে বৈষম্য এবং অর্থেই জনকল্যাণমুখী নয়। অপরদিকে মুনাফা'র কারণে ধনবৈষম্যের বিষয়টা তো থাকবেই। যেমন আঞ্চলিক বৈষম্য এই কারণেই পুঁজিবাদী অর্থনীতির দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থা জনকল্যাণের প্রাথমিক শর্তকে নস্যাৎ করবেই। এই ব্যবস্থার নিত্যসঙ্গী তীব্র অসাম্য এবং প্রতিযোগীতাভিত্তিক অমানবিকতা।
আধুনিক সমাজের দ্বন্দ্ব এবং সংঘাতের প্রেক্ষাপট অত্যন্ত সুবিস্তৃত। বিশেষ করে আধুনিক কালের সেই সমস্ত সমস্যাগুলি যা প্রতিনিয়তই আমাদের অস্থির করে তুলেছে তার গতিপ্রকৃতি অত্যত জটিল, বহুমাত্রিক বটে। সমস্যাটা শুধু অর্থনৈতিক সংকট, দারিদ্র, কষ্ট এসব নয়। একটা অদ্ভুত ধরণের নৈতিক সংকট আমাদের সমাজের ভিতটাকে, তার ভিতরের বাঁধনটাকে একেবারে আলগা করে দিয়েছে। বোধকরি সবচেয়ে বড় সংকট এইখানেই। এর শেকড় একদম পরিবার গুলোর ভেতর পর্যন্ত চলে গেছে।
যে 'পবিত্র পরিবার' নিয়ে ছেলেবেলায় আমাদের স্বপ্ন, আমদের ভালো লাগা, আমাদের পথচলা, সেই 'পরিবার' যেন কোথায় কোন একটা অশান্তির কালো মেঘে ছায়াচ্ছন্ন হয়ে আমদের মনের তৃপ্তি, আমাদের জীবনের সুস্থ স্বাভাবিক চাহিদা এবং তাদে কেন্দ্র করে পরস্পরের সাথে মননগত সম্পর্কের যে কাঠামো, তাকে পর্যন্ত বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। সকলেই যেন কীরকম অখুশি, কীররকম যেন অস্থির। একটু পরিণত বয়সের মানুষের মুখের দিকে ভালো করে তাকালে দেখা যায় তার কুঞ্চিত ভ্রু আর বিরক্তি-ক্লিষ্ট ঠোঁট দুটির মাঝে মানুষটির অবিন্যস্ত জীবন, তার অস্থিরতা, তার একাকীত্বের যন্ত্রণা কী নির্মমতার সাথে ফুটে উঠেছে। একটা নিষ্ঠুর রকমের 'আইডেনটিটি ক্রাইসিসে' বা 'অস্তিত্বের সংকটে' ভুগছে সে। এই 'আইডেনটিটি ক্রাইসিস্' বিরাট বড় সমস্যা।
"কাতারে কাতারে লোক।
তৃতীয় বিশ্বের
বুভুক্ষু আর ক্ষিপ্ত।
ভীড় বাড়ছে, ট্রেন দাড়িয়ে আছে ঠায়। হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে আসছে জীবন কারও ফুরসৎ নেই তাকাবার,
তাকিয়ে দেখলাম।
কারও বন্ধু নেই, নিঃসঙ্গ,
মনে হয় সকলেই মারা গ্যাছে
বহুদিন আগে।"
উপদেশ অথবা বিজ্ঞাপন, রিংকু শর্মা।
ব্যক্তি মানুষ তার শেকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে 'আইডেনটিটি' খুঁজে পাচ্ছে না। এর ফলে কোথাও কোথাও অদ্ভুত ধরণের মানসিক সমস্যার শিকারে পরিণত হচ্ছে সে। কোটি কোটি মানুষের মধ্যে থেকে, সমজের মধ্যে অবস্থান করে, তার ভাল মন্দের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে সেই সমাজের মঙ্গল সাধনের মধ্যে জীবনের যথার্থ অস্তিত্বকে খোঁজার শিক্ষাটাকেই তিলে তিলে মেরে দেওয়া হচ্ছে।
সমাজের অগ্রগতির কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগের মধ্যেই তো জীবনকে আমরা সুন্দর করতে পারি। এইখানেই তো নিহিত জীবনের সত্য। এখানেই তো আমার অস্তিত্ব। সমাজ থেকে, তার অগ্রগতির পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অস্তিত্ব অনুসন্ধানের প্রযোজন কী? আমার কোথায় জন্ম, তার ইতিহাস কী, এসব কি খুব প্রয়োজনীয়? মানুষ হিসাবে আমার সামাজিক দ্বায়িত্ববোধ, আমার চাওয়া-পাওয়া, তার ভিত্তিতে আমার সচেতন ক্রিয়া এই তো আমার সত্যিকারের অস্তিত্ব। এই ধারণাগুলি বর্তমানে সমাজ থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছে। মধ্যবিত্ত এবং অবস্থাপন্ন পরিবারগুলিতে এই সমস্যার প্রভাব বেশী।
বর্তমানে সমাজের একটি বৃহত্তর অংশ সামাজিক দায়বদ্ধতার কোনরূপ ভূমিকা পালন করে না। এমন কি করতেও চায় না। তারা জনমায়, বাড়ে, খায়-দায়, কেরিয়ারের পেছনে ছোটে, তার পর চলে যায়। তাদের মৃত্যুর পর তেমন কেউ কাঁদে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনও শেখেনি বাঁচিতে।" যে আপন সীমানার মধ্যে থেকে বলে, 'অমি খুব স্বাধীন, আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করি, আমি যেমন তেমন পোশাক করি, বুক বাজিয়ে কিছু কথা সাজিয়ে ছড়ার মতো বলি তারা মনে করে আমরা খুব স্বাধীন। কিন্তু তারা তাদের ছোট্ট সীমার মধ্যে স্বাধীন ভাবলেই প্রকৃত অর্থে তারা আসলে নিজের ঘরের চার দেওয়ালে বন্দী। ফলে এই সমাজের মধ্য হতে ভালো কিছু আশা করা কাঁঠালের আমসত্ত্ব' বলেই মনে হ। কেননা এই আধুনিক সমাজের পরিচালকরা বর্তমান প্রজন্ম এবং তাদের পরিবারগুলিকে ক্লীবতার শৃংখল দ্বারা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে ফলে স্বাধীনতার প্রকৃত সংজ্ঞাই বদলে গিয়েছে। যা খুশি করার নাম কি স্বাধীনতা? যা খুশি করার দ্বারা তো আমরা প্রবৃত্তির দাস হয়ে যেতে পারি।
রবীন্দ্রনাথ'এর একটি উক্তি প্রসঙ্গক্রমে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, "জ্ঞানী ব্যক্তিই স্বাধীন ও সুন্দর। কিন্তু তার বিশাল স্বাধীনতা অন্তর্ভুক্ত থাকে প্রাকৃতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মের মধ্যে। ব্যক্তি একা কোনও দিন স্বাধীন হতে পারে না। তার মুক্তি সম্ভব হয় যখন সে সর্বদাই অপরের সঙ্গে সংযোগ করতে পারে।" শরৎচন্দ্র বলেছেন, "স্বাধীন অভিমতটা যেন কুসংস্কারে গিয়ে না দাঁড়ায়। তাও সীমা আছে এবং আছে বলেই তার মূল্য। একান্ত স্বাধীনতার মতো এতবড় দাসত্ব আর নেই।" প্রকৃত পক্ষে যথার্থ স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায় তা আমাদের বর্তমান প্রজন্মের নিকট অজ্ঞাত।
বর্তমান সমাজের চালচিত্র দেখে প্রতি মুহূর্তেই মনে হয়, এই যে আমরা এগিয়ে চলেছি, এই এগিয়ে চলার মধ্যে একটা ধারণা এসে গেছে, পুরাতন জিনিষকে ফেলে দাও। এসব 'প্রাগৈতিহাসিক'। আজকের দিনে চলে না। কেননা এখন প্রযুক্তির যুগ। আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেছি। ছুটছি জীবন যুদ্ধে প্রবল প্রতিযোগিতা, এতটুকু দাঁড়ানোর মতো সময় আমাদের নেই। ভয়, যদি পিছিয়ে পড়ি, হরে যাই। কিন্তু ঘরের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস, শান্তি নেই, নেই তৃপ্তি, ছটফট করছি। একা থাকতে গিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে তথাকথিত উন্নতির দৌড়ে মগ্ন হওয়ার ফলে পাচ্ছি সংকীর্ণ হৃদয়, সংকীর্ণ মন। অর্থাৎ আমাদের হৃদয় মন ক্রমাগতই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। মানবিক মূল্যবোধের আদান-প্রদান ক্রমাগতই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমাদের সম্পর্ক। এর ভয়াবহতা, বীভৎসতা'কে আমরা চোখের সামনে দেখতেই পারছি।
তাহলে সভ্যতা বলব কাকে? সভ্যতা বলতে যে জিনিষটা জানি এবং মানি, পৃথিবীতে মানুষের সাথে মানুষের মানবিক সম্পর্ক ব্যতীত অন্য কোনও সম্পর্ক আছে কি? আবার এই মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কটা কীসের উপর নির্ভরশীল? মানবিক মূল্যবোধের উপর নির্ভরশীল। মনে রাখতে হবে, জীবনকে আমরা সুদর করতে চাই, কিন্তু তার পথ কোথায়? উদ্দেশ্যহীন জীবনের মধ্যে কি মানবিক মূল্যবোধ থাকে? সমাজের অগ্রগতি, নতুন উন্নত সমজের প্রাপ্তির মধ্যে নিহিত থাকে সত্য সেই সত্যের ছন্দেই মিশে থাকে মানবিকতার ছন্দোবদ্ধতা।
এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, সমাজ যেখানে পরিবর্তনশীল সেখানে পুরাতনকে নস্যাৎ করার মধ্যে অন্যায় কী? আসলে এর মধ্যে একটা বিভ্রান্তি রয়েছে। এর যথাযথ উত্তর সর্বত্র পাওয়া যায় না। সমাজ পরিবর্তনশীল, তবে এই পরিবর্তনশীলতার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। আমার ছিন্নমূল নই, আকাশ থেকেই পড়িনি। আমরা যে আজকে এখানে এসেছি সেটা পুরকাতনকে নস্যাৎ করে নয়। তাই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যেমন যোগসূত্র আছে, তেমনি আছে বিচ্ছিন্নতাও। আমরা যদি এই সত্যকে উপলব্ধি করতে না পারি তাহলে প্রযুক্তির শত সফলতার পরেও কোনও যথার্থ সংস্কৃতি আমাদের এবং আমাদের পরিবারের মধ্যে গড়ে উঠবে না। এর পরিবর্তে আমরা ছিন্নমূল সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে যাব। কেননা নবারুন ভট্টাচার্য বলেছেন-
"যারা নেমেছিল তারা চলে গেছে
যারা উঠেছিল, তারাও
সবকিছুর পরে
এক দাঁড়িয়ে আছে বাসষ্টপ।"
এই ছিন্নমূল সংস্কৃতির ভয়াবহতার স্বরূপ 'ঋত্বিক ঘটক (সুবর্ণ রেখা, মেঘে ঢাকা তারা) তাঁর সিনেমাগুলিতে দেখিয়েছেন। কিনতু সেটা ছিল দেশভাগের পরিনামের এক 'ছিন্নমূল সংস্কৃতি'।
তাহলে এই দশকের সমস্যাটা আসলে কী? সমস্ত অতীত গৌরব হতে বর্তমান প্রজন্ম এবং তাদের পরিবারগুলি বিচ্ছিন্ন। সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে ধঅপে ধাপে এবং এই প্রত্যেকটি ধাপের মধ্যে যোগসূত্র বর্তমান। এই প্রজন্ম যোগসূত্রটাকে হারিয়ে ফেলেছে। আরও সঠিকভাবে বললে হারিয়ে দেয়া হয়েএছ। কেন? কারণ নিজের নিজের গন্ডীর মধ্যে প্রত্যেককে 'স্বাধীন' বানিয়ে রাখলে ওপরে যাঁরা সিংহাসনে (?) বিরাজমন ওঁদের ভারি সুবিধা। তাঁরা সজেই বলতে পারবে, যা হচ্ছে তা হতে দাও, নিরপেক্ষ থাকো, আর যেহেতু তুমি 'স্বাধীন', তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। তারা সকল সময় এটা বোঝাতে চায় যে, তোমার বিকট আনন্দের কারণ যেমন তুমি, তোমার দুদর্শার জন্যও দায়ী তুমি এবং তোর কপাল। 'স্বাধীনতার এইরকম ধারণার প্যাকেড আজকাল বাজারে বিক্রয় হয়। মিডিয়া-মাফিয়ারা তাদের চ্যালেনে চ্যানেলে এইসব প্যাকেজ বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে প্রচার করে। আমরা ক্রয় করি এবং তার আস্বাদ গ্রহণ করে উল্লসিত হই। অথচ এই 'স্বাধীনতা' যে কত বড় 'পরাধীনতা'র নামান্তর, একবারও তা ভাবি না। আসলে ভাবনার জন্য যে চেতনাটুকু প্রয়োজন তারই মারাত্মক রকমের অভাব।
"বোধ বুদ্ধি কোথায়?
রুদ্ধ দেশে মিথ্যে লেগে আছে।
চেতনার পাকশালে
বহুকাল জ্বলেনি আগুন।
মৃত মুখে
বোধহীন জৌলুস।
চ্যানেলে চ্যানেলে
শুধু মোরগ লড়াই।”
সবচরিত্র কাল্পনিক, রিংকু শর্মা।
ভীষণ অসুস্থ এক সমাজে আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছি। প্রতি মুহুর্তে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকছি প্রেয় এবং শ্রেয় হতে বঞ্চিত হবার আকাঙ্খায়। নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় এই বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে-
"আমি একটি ইতরের দেশে থাকি
এখানে বণিকেরা লেখকদের উদ্ভাবন করে
এবং লেখকেরা উদ্ভাবিত হয়।
আমি একটি ইতরের দেশে থাকি
যে দেশের বুদ্ধিজীবি অধ্যুষিত সরকার শীতের ইথারের মধ্যে
গরীব মানুষের ঘর ভেঙ্গে দেয়।
আমি একটি ইতরের দেশে থাকি....।"
অথচ রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাচিন্তার অন্যতম উপাদান রূপে আনন্দদানকেই গ্রহণ করেছিলেন, যান্ত্রিকতাকে নয়। তিনি বলেছেন, "আনন্দের সহিত পড়িতে পড়িতে পড়িবার শক্তি অলক্ষিত ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। গ্রহণ শক্তি, ধারণাশক্তি, চিন্তাশক্তি বেশ হসজে এবং স্বাভাবিক নিয়মে বল লাভ করে।" রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাচিন্তার বিষয়টি সম্পর্কে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়া ভ্রমণকালে বলেছিলেন, "শিক্ষা সম্বন্ধে আমার মত হল তাকে জীবনের সঙ্গে যোগ রাখতে হবে, তাকে জীবনের অংশ হতে হবে। যথার্থ শিক্ষালাভ করা যায় যথার্থ জীবনধারণের ফলে, জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয় যা সভ্য জগতে ইসকুলে কলেজে প্রায়ই ঘটে সে যেন এক খাঁচা, তার ভিতরে শিশুদের মত কৃত্তিম তথ্য জোগানো হয়।" শিখার এই খাঁচা রূপকে তুলে ধরার প্রশ্নে তিনি রচনা করেছিলেন 'তোতা কাহিনী।'
যান্ত্রিক শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথ কখনই বিশ্বাসী ছিলেন না। শুধু শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, যারা জীবন তিনি কঠিন নিয়মে বাঁধা অ-স্বাভাবিক শিক্ষার বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন।
তাঁর ঘোষণা ছিল, "মনুষ্যত্বের শিক্ষাই চরম শিক্ষা, আর সমস্তটাই তা অধীনে। এই মনুষ্যত্ব হচ্ছে আকাঙ্ক্ষার ঔদার্য; আকাঙ্ক্ষার দুঃসাধ্য অধ্যবসায়, মহৎ সংকল্পের দুর্জয়তা।"
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে, অনাথনাথ বসুকে একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "বিদ্যালয়ের শিশুকাল থেকে আমরা বাঁধা খোরাকে অভ্যস্ত হই বলে আমাদের মননশক্তির সজীবতা হারাই বুদ্ধির ক্ষেত্রে নিজেরা চরে খাবার অভ্যাস না করে তাদের চিত্ত কোনো কালে সবল হয় না। তোমারা গয়লার কাজ ছেড়ে দিয়ে রাখালের কাজ করো।" ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বলেছেন, "সেদিন আমার সংকল্প ছিল, বালকদের এমন শিক্ষা দেবো যা শুধু পুঁথির শিক্ষা নয়, প্রান্তরযুক্ত অবারিত আকাশের মধ্যে যে মুক্তির আনন্দ তারই সঙ্গে মিলিয়ে যতটা পারি তাদের মানুষ করে তুলব। শিক্ষা দেবার উপকরণ যে আমি সঞ্চয় করেছিলাম তা নয়। সাধারণ শিক্ষা আমি পাইনি, তাতে আমি অভিজ্ঞ ছিলাম না।" এই অভিজ্ঞতা না থাকায় ক্ষতি হয়নি বরং উপনিবেশের শিক্ষার দাপটের মধ্যেই তার অঙ্গীকার ছিল "আমি স্থির করলাম শিশুদের শিক্ষার মধ্যে প্রাণরস বহানো চাই।"
শিক্ষা পদ্ধতির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নীতি ছিল স্বাধীনতা, সৃজনশীলতার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ এবং প্রকৃতির সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগ। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, "মানুষ মানুষের কাছ থেকে শিখতে পারে, যেমন জলের দ্বারা জলাশয় পূর্ণ হয়, শিক্ষার দ্বারা শিখা জ্বালিয়া ওঠে, প্রাণের দ্বারা প্রাণ সঞ্চারিত হয়।"
জর্জ হিউম যেমন বলেছিলেন, "তোতা সকল সময় শ্রেণীকক্ষের দিনলিপি মেন চলে।" একথাই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'তোতা কাহিনী' রচনায়। কেননা নিছক পুঁথিগত শিক্ষায় তাঁর প্রতিবাদ ছিল। 'আবরণ' নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, "বিদ্যা জিনিষটা যেন একটা স্বতন্ত্র পদার্থ, শিশুর মন হইতে সেটাকে যেন তফাত করিয়া দেখিতে হয়, সেটা বইয়ের পাতা এবং অক্ষরের সংখ্যা, তাহাতে ছাত্রের মন যদি মিশিয়া যায়, সে যদি পুঁথির গোলাম হয়, তাহার স্বাভাবিক বুদ্ধি যদি অভিভূত হয়ে পড়ে সে যদি নিজের প্রাকৃতিক ক্ষমতাগুলি চালনা করিয়া জ্ঞান অধিকার করিবার শক্তি, অনভ্যাস ও উৎপীড়নশত চিরকালের জন্য হারায় তবু ইহা বিদ্য......।
রবীন্দ্রনাথ প্রাশ্চাত্য শিক্ষাবীদগণের শিক্ষাচিন্তা এবং শিক্ষাদর্শনের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। রুশো তাঁর অজ্ঞাত ছিল না, রুশো বাস্তবের কর্কশ জীবন থেকে শিশুদের বাঁচাবার তাগিদ উপলব্ধি করেছিলেন। পেস্তালাৎসী, ফ্রয়েবল, জন ডিউই'এর শিক্ষাদর্শের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাদৃশ্য এবং প্রভাব কাকতলীয় নয়। বিশেষত মনস্তাত্বিক শিক্ষার প্রতি রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ সমর্থন ও ছিল। তিনি পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি সৃজনশীল শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কবির রচনায় আজও ভাস্বর হয়ে আছে শিশুর শৈশব চাপল্য এবং সরলতা-
"....মনে পড়ে সেই সন্ধ্যাবেলা
শৈশবের।
কত গল্প কত বাল্যখেলা,
এক বিছানায় শুয়ে মোরা সঙ্গী তিন,
সে কি আজিকার কথা, হল কতদিন।"
ছেলেবেলা'য় লিখেছেন, "ঐখানে গুরু মশায়ের পাঠশালা বসত। কেবল বাড়ির নয়, পাড়া প্রতিবেশীর ছেলেদের ও ঐখানেই বিদ্যার প্রথম আঁচড় পড়ত তালপাায়। আমি ও নিশ্চয় ঐখানেই স্বরে ও স্বরে আ'র উপর দাগ বুলোতে আরম্ভ করেছিলুম....।"
বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "আজ বিশেষ করে মনে করিয়ে দেবার দিন এল যে, সৃষ্টিকর্তারূপে বিদ্যাসাগরের যে স্মরণীয়তা আজও বাংলা ভাষার মধ্যে সজীব শক্তিতে সঞ্চারিত, তাকে নব নব পরিণতির অন্তরাল অতিক্রম করে সম্মানের অর্ঘ্য নিবেদন করা বাঙালির নিত্যকৃত্যের মধ্যে যেন গণ্য হয়।"
বর্তমান শতাব্দীতে শিক্ষার প্রকৃত অর্থ হল চাকরি অর্জন এবং ধনোপার্জন। কবি পরিমল রায় বলেছেন, 'বিদ্যার বিপনিদ্বারে দলে দলে ক্রেতাদের মেলা'। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন, নৈর্ব্যক্তিক শিক্ষা লেখাপড়ার পরিবেশ পরিসর তৈরী করে না। নৈর্ব্যক্তিকতা শিক্ষার প্রতিবন্ধক। প্রকৃত পক্ষে এই শতাব্দীকালে মানবিক সম্পর্কের চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটেছে। কেননা আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী সমাজ তো স্বভাবে নিম্নগামী। পণ্যমুখী সমাজে শিক্ষা তো এক ধরণের প্রশিক্ষণ মাত্র, এটা চরিত্র গঠন বা মানুষ তৈরীর প্রক্রিয়া নয়। প্রকৃত শিক্ষার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় এই ভাবে যে এচা মানুষ তৈরীর প্রক্রিয়া এবং শিক্ষক তাই মানুষ তৈরীর কারিগর। এই কারণেই কান্ট বলেছেন, "মানুষ তখনই মানুষ হয় যখন সে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করে।"
পুঁজিবাদী সমাজের মূলগত বৈশিষ্ট্য হলো উৎপাদন শ্রম এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপাদনের মধ্যে বিচ্ছেদ তৈরী করা। আর তারই অনিবার্য ফলশ্রুতি হলো, সমাজের উৎপাদানের এবং শ্রমের একটি বৃহৎ অংশ উৎপদানের উপাদানের সঙ্গে সফলভাবে সম্পৃক্ত না হতে পেরে অপচয়ে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর বাস্তবতা হলো, একটি বিপুল সংখ্যক বেকার। এক্ষেত্রে ধারণা তৈরী করা হয় যে শিক্ষার সুযোগ বুদ্ধি বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং শিক্ষাকে আরও রোজগার মুখী করতে হবে। ফলে শিক্ষাকে পণ্যমুখী বাজারের স্বার্থে শুধুমাত্র চাকুরীর ছাড়পত্র হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। তবে এই শিক্ষা মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করা নয়, এই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বংশবদ দালাল তৈরী করা।
শাসক শ্রেণী এবং তার তল্পিবাহকেরা গণশিক্ষা এবং তার মানবিক দিগগুলিকে নিজেদের স্বার্থে বিনষ্ট করে দেয়। তারা শ্রেণীবিভক্ত সমাজে তাদের আধিপত্যকে সুরক্ষিত রাখার প্রশ্নে শিক্ষার পরিকাঠামো প্রস্তুত করে, এই শিক্ষা কখনই সমাজের উন্নতি করে না। বরং এইশিক্ষা প্রকৃত অর্থে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ভিতকে দৃঢ় করতে সচেষ্ট থাকে। মানব সমাজের পরম শত্রু হল কুসংস্কার কুপমণ্ডুকতা এবং ভোগবাদের ন্যায় ধর্মান্ধতা, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা। এই সামন্ততান্ত্রিক বিষয়গুলি ভারতবর্ষের ন্যায় তৃতীয় বিশ্বের পশ্চাৎপাদ দেশগুলির মূলগত বৈশিষ্ট্য। এখানে শাসক শ্রেণী পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অনুঘটক রূপে কাজ করে। তারা শোষিত বঞ্চিত মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করে এবং তাদের পরস্পর শত্রু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মেকি দেশপ্রেম তথা ধর্মসংকট ইত্যকার বিষয়গুলিকে সর্বদা ব্যবহার করে।
বর্তমান সময়ে তথাকথিত জাতীয়তাবাদের মোড়কে অতীত হতে তুলে আনা হচ্ছে বিজ্ঞানবিরোধী, পশ্চাৎমুখী, মৃত ও গলিত কাল্পনিক কাহিনী। যেগুলিকে নানা আঙ্গিকে সমাজের অভ্যন্তরে প্রোথিত করে দেওয়া হচ্ছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে প্রগতি আধুনিকতার মোড়কে পাশ্চাত্য সভ্যতার উচ্ছিষ্ট।
জীবনের ধর্ম এগিয়ে চলা। অবশ্য এই এগিয়ে চলা পশ্চাৎমুখী নয়, সম্মুখ পানে, আলোর দিকে। কিন্তু এখন, 'অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ। যে পথে হাঁটছি আমরা সে পথ কুসুমিত নয় কণ্টকাকীর্ণ। নিকষ-কালে সেই গাঢ় অন্ধকারে আর যে কথাই মনে পড়ুক, রবীন্দ্রনাথ অথবা দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশের কথা মনে পড়ে না। ভেতরে ভেতরে শুধুই ক্ষয়ে যাওয়া, 'প্রভু নষ্ট হয়ে যায়...।' অবিরাম রক্তক্ষরণ। মনে হয় এই মৃতবৎ সমাজে আমরাও প্রেত হয়ে বসে আছি।
এই ক্ষয়ে যাওয়া সমাজে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে নবীন প্রজন্ম। তাদের বিনষ্ট করার পেছনে রয়েছে এক গূঢ় অভিসন্ধি। বই পড়া কিম্বা সাহিত্যচর্চার বিষয়টি এখন অর্থহীন, ছাঁইপাঁশ। লোকঠকানো বিজ্ঞাপনে ঢেকে গেছে গগনচুম্বী ইমারত। অন্ধ বিশ্বাস মনের গভীরে বাসা বেঁধেছে। সবটাই অন্তঃসারশূণ্য মিথ্যে নাটকের প্রহসন মাত্র। মানবতা নেই, প্রীতি নেই, নেই করুণার আলোড়ন। পরিবার গুলো সম্পর্কের টানাপোড়েন'এ ব্যস্ত। সম্পর্কেকর মাধুর্য্য কোথায় হারিয়ে গেছে। গ্রাস করেছে বিপন্নতা। এই অযাচিত পরিবেশ ছোটদের কষ্ট দেয়, নিরাপত্তার অভাববোধ করে সে। পরিবারের চাহিদা পুরণে ব্যর্থ এই কৈশোরত একসময় হারিয়ে ফেলে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ।
"....যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে
দ্যাখে তারা; যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপারমর্শ ছাড়া। যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।"
জীবনানন্দ দাশ।
রবীন্দ্রনাথের 'তোতা-কাহিনী'তে বাস্তববোধ হীন বিজাতীয় শিক্ষার উজ্জ্বল চিত্রটি পরিস্ফুট হয়। "... খাঁচায় দানা নাই, পানি নাই, কেবল রাশি রাশি পুঁথি হইতে রাশি রাশি পাতা ছিঁড়িয়া কলমের ডগা দিয়া পাখির মুখের মধ্যে ঠাসা হইতেছে। গান তো বন্ধই চীৎকার করিবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা। দেখিলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়। রাজা পাখিটাকে চিপিলেন। সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না। বেকল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্থ গজগজ করিতে লাগিল।
বাহিরে নব বসন্তের দক্ষিণ হাওয়ায় কিশালয়গুলি দীর্ঘ নিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল করিয়া দিল।"
বাল্যজীবন তো শুধু বেড়ে ওঠার সময় নয়, প্রকৃত অর্থে গড়ে ওঠার সময় নয়। একা-একা তো সেই বালক বা কিশোর তো আর বেড়ে ওঠে না, গড়েও উঠতে পারে না। পরিবার অর্থাৎ মাতা-পিতার স্বতঃস্ফূত সহযোগীতা ব্যতীত এই গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদনের বিষয়টি সম্ভব নয়। সর্বোপরি চারপাশের পরিবেশটিও তাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু এই যান্ত্রিক সভ্যতার চাপে শিশুটি যে কখন 'ভোম্বলসর্দার' হওয়ার পরিবর্তে কালনেমিতে পরিণত হয়েছে তার খবরকে বা রাখে?
এদিকে খান ইঁটের মতো কত না বই! সেই সব বই সে অনিচ্ছায় পড়ে, মা-বাবা তাকে পোগ্রাসে গিলিয়ে খাওয়ায়। কেননা সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে হবে, সামিল হতে হবে ইঁদুর দৌড়ে। এইটুকু না পারলে তো জীবন ১৬ আনাই মিথ্যে। শেষ পর্যন্ত সব শিক্ষাই অসার হয়ে যায়। কিছুই শেখে না সে। কিছুই শেখা হয় না। কেননা শরীর ও মনের টানাপোড়েনে তার শৈশব কৈশোর তো ক্ষতবিক্ষত। তার চোখের সামনে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য আস্তে আস্তে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সমাজের অনুশাসনে বন্দী জীবন থেকে বেরিয়ে কোথাও না কোথাও সেই জীবনের অভাব তাকে হারিয়ে দিচ্ছে। সমাজের প্রস্তাবিত সুখী জীবন থেকেও সে বঞ্চিত। কোন আবেগমণ্ডিত জীবনসত্ত্বার বাস্তবায়ন যেন সবকিছুই একতর ফা-একমুখী জীবন। আইডেনটিটি থেকেও নেই।
প্রযুক্তির এই সময় যারা গড্ডালিকা প্রবাহের আবর্তে ভেসে চলেছে তারাও একসময়ে হতবাক্ বিস্ময়ে বোবা পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টিপাত করতে বাধ্য হবে। কেননা বিশ্ব পুঁজির চরম সংকট তাকে এই পথে ধাবিত করবে।
ধূর্ত জটিল সমাজ জীবনে পাঁচতারার স্বপ্ন দেখাটা সোনার পাথর বাটির সন্ধান বলে মনে হয়। কেননা চিন্তায় চেতনায় অপাংতেয় হওয়ার কারণে কুঁকড়ে যাচ্ছে অগণিত বিধ্বস্ত মানুষের জীবনযাত্রা। বিপন্নতার গহ্বরে নবীন প্রজন্মের প্রবেশ অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। "আমাদের এই পৃথিবীতে। সুসভ্য এই পৃথিবীতে। সুসভ্য এই পৃথিবী তো... প্রতি মিনিটে ৩০ শিশু স্রেফ না খেতে পেয়ে। একটু একটু করে ধুকে মারা যায়। আর মানুষ মারা অস্ত্র তৈরীর জন্য সর্বাধুনিক পারমানবিক বোমা তৈরীর জন্য আমরা খরচ করি প্রতি
মিনিটে ১৬ লক্ষ ডলার।" সুবিমল মিশ্র।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "আমার হাতে যদি পৃথিবীর ভার থাকতো, তাহলে শুধু শিশুদের জন্যই সমস্ত পৃথিবীটাকে ফুলের বাগান করে দিতুম' তখন বেনেবুদ্ধির মানুষেরা বিদ্রুপ করে।"
মানুষের বড় হওয়া কি শুধুই দেহে? আয়তনিক রূপে? না কি মনে? মনে যারা বড় হতে পারে, তারাই পারে শিশু কিশোরের মনকে ছুঁয়ে ফেলতে।
রবীন্দ্রনাথের মতে একবার প্রতিযোগীতার ভূত চাপিয়ে দিলে সেই ভূতকে আর নামানো যায় না। এখন রবীন্দ্রবর্ণিত সেই প্রতিযোগীতার ভূত সর্বত্র। এভাবে সমাজের স্বকীয়তা বিনষ্ট হয়। শিশু কিশোর কি তোতা পাখি?
"মন খারাপ করা বিকেল নামে মেঘ করেছে দূরে কোথাও এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে।" কবীর সুমন।
এখনকার অভিভাবকরা তাদের সন্তান সন্ততিকে ইংরেজীয়ানার মোড়কে শিকড়বিহীন শিক্ষার যাঁতাকলে জুড়ে দিতে প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই বিষয়টি মোহগ্রস্ত চিন্তার পরিচায়ক ব্যতীত আর কী বা হতে পারে? রবীন্দ্রনাথ ১৩১২ বঙ্গাব্দ (বৈশাখ) তে ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ' শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন
"একদিন গেছে যখন আমাদের শিক্ষিত লোকেরা ইংরেজি পুঁথির প্রত্যেক কথাই বেদবাক্য বলিয়া জ্ঞান করিত। ইংরেজি মগ্নতা এতদূর পর্যন্ত সাংঘাতিক হইয়া উঠিয়া ছিল যে, ইংরেজি বিধি বিধানের সহিত কোনো প্রকারে মিলাইতে না পারিয়া জামাইষষ্ঠী ফিরাইয়া দিয়াছে এবং আমোদ করিয়া বান্ধবের গায়ে আবির লেপন চরিত্রের একটা চিরস্থায়ী কলঙ্ক বলিয়া গণ্য করিয়াছে এত বড়ো শিক্ষিত মূর্খতার প্রমাণ আমরা পাইয়াছি।"
'ঘূনিভার্সিটি বিল' (১৩১১ বঙ্গাব্দ, আষাঢ়) শীর্ষক আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, "আমাদের ভাবনার বিষয় এই যে, দেশে বিচার দুর্মূল্য, অন্ন দুর্মূল্য, শিক্ষাও যদি দুর্মূল্য হয় তবে ধনী দরিদ্রের মধেও নিদারুণ বিচ্ছেদ আমাদের দেশেও অত্যন্ত বৃহৎ হইয়া উঠিবে" (রবীন্দ্র রচনাবলী, ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃষ্টা ৮৭, ১৯৯০)।
বলাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ সেই সময়কালে যে দিশা দেখাতে চেয়েছিলেন তা একবিংশ শতকের তথাকথিত আধুনিক সমাজ গ্রহণ করেছে বলে মনে হয় না। ফলে জীবনের একেবারে প্রারম্ভিক সময়কাল হতে সন্তান যেভাবে বৈষম্যের মধ্যে লালিত হয়, বড় হবার পর সেই বৈষম্য চিন্তা সমাজের সকল ক্ষেত্রে তাকে তাড়া করে বেড়ায়। এই কারণেই বোধ হয় সন্তান সন্ততির প্রতি সদয় হওয়ার পরিবর্তে পরিবার-পরিজন আরও নির্মম হয়ে উঠেছে। আর এইভাবেই সন্তানের স্বাভাবিক ও স্বাধীন স্বতস্ফুর্ততা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
প্রাথমিক প্রয়োজন এবং উচ্চাকাঙ্খাকে ঘিরে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক তথা অন্যান্য চাহিদাগুলি এত ব্যাপক হয়ে উঠেছে যে তার পরিসীমা নির্ধারণ করতে গেলে 'ঠগ বাছতে গাঁ উজার' হবার মত অবস্থা তৈরী হবে। ফলে আমরা বরং এই সকল চাহিদার পেছনে যে সকল আবেগ জনিত ভাবনা কাজ করে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটির রূপরেখা উদ্ধৃত করতে পারি। যেমন-
ক. মানুষ দাবী করে, জীবনে চলার পথে সকল কাজই যেন সকল সময় তার ইচ্ছানুসারে সম্পাদিত হবে।
খ. মানুষ চায়, তার অভিমত ও সিদ্ধান্ত যেন গুরুত্ব পায়, কারণ নিজে যা ভাবনা করে তার সম্পূর্ণটাই সঠিক, অন্যান্য গুলি অসার বা বিভ্রান্তিমূলক।
গ. প্রতিটি কর্মে যেন সফলতা উপস্থিত হয় এবং একই সাথে সুযোগ যেন তার জীবনকে ব্যাপৃত করে রাখে।
ঘ. কোনরূপ প্রতিকূলতা তাকে যেন গ্রাস না করে।
৫. জীবন যেন সুখময় হয় এবং দুঃখের উপস্থিতি যেন না আসে।
বাস্তবিক অর্থে এই কাঙ্খিত চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে মানুষের কর্মের উপর। সর্বোপরি দুঃখের উপস্থিতি তো কোনও অস্বাভাবিক বিষয় নয়, বিষয়টা তো স্বাভাবিক। অর্থাৎ যেমন কর্ম আছে, তেমন কর্ম ফল ও আছে। এতো অনাদি অনন্তকাল ধরে চলে আসছে।
"মনঃ পূর্বঙ্গমা ধর্মাঃ মনশ্রেষ্ঠা মনোময়াঃ।
মনসা চেত্ প্রদুষ্টেন, ভাষতে বা করোতি বা।
ততস্তং দুঃখমন্বেতি, চক্রবত্ বহতঃ পদম্।।১।।"
অর্থাৎ, মনুষ্য দুষিত মনে যা কিছু ব্যক্ত করে বা সম্পাদন করে, এই (৩ মনঃকর্ম, ৪ বাক্কর্ম তথা ৩ কায়কর্ম) অর্থাৎ দশ (১০) অকুশল কর্ম দ্বারা উৎপন্ন দুঃখ সেই মনুষ্যকে ঠিক সেইভাবে অনুগমন করে, যেমন কোনও বলদশকটের চক্র (চাকা) শকটে যুক্ত বলদের পদাঙ্ক অনুগমন (অনুসরণ) করে। (ধম্মপদ, যমক বর্গ, ১)।
অপূর্ণতা হতে মানসিক চাপের সূত্রপাত হয়। কেননা এই প্রজন্মের পরিবার বর্গের সিংহভাগই অপূর্ণতায় ভুগছে। মূলতঃ এই কারণে তারা সন্তুষ্ট হতে পারছে না।
১. অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্খা, যোগ্যতা থাকুক তার না থাকুক, আরও চাই। ২. পরশ্রীকাতরতা, অর্থাৎ অপরের যা আছে, তার চেয়েও বেশী আমার থাকতে হবে। ৩. হীন মানসিকতা, সমাজ বা পৃথিবী তোল্লায় যাক, আমি বেঁচে থাকলেই হল।
নরওয়ের একজন প্রখ্যাত গবেষণাকারী অধ্যাপক ডি. অলউইআস 'দুর্বলের প্রতি নির্গম উৎপীড়ন' নামক বিষয়টি নিয়ে একটি সুন্দর রেখচিত্র প্রস্তুত করেছেন। রেখচিত্রটি হল এইরূপ
দুর্বলের প্রতি নির্মম উৎপীড়ন
।
__________।___________________
। ।
শারীরীক শারীরীক নয়
উদাহরণ: আঘাত দেওয়া ।
লাথি, কিল, চড় মারা ।
।
______________________________
। ।
মৌখিক। ।
উদাহরণ: গালি দেওয়া, ।
বিদ্রুপ করা, ভীতি ।
প্রদান করা
_________________________
। ।
কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি পরোক্ষভাবে
অবহেলা করা
দুর্বলের প্রতি নির্মম উৎপীড়নের আধিপত্য সকুল, কলেজ, অফিস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, অঞ্চল, পাড়া অতিক্রম করে সংসারেও প্রভাব বিস্তার করেছে। এ এক সামাজিক ব্যাধি। এই অনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করতে না পারলে আগামী দিনে এই কু-প্রভাবে জন্ম নেবে আরও এক ভয়ংকর সমাজ।
ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব অনুসারে সহজাত প্রবৃত্তির ২টি ধারা সৃজনশীলতা এবং ধ্বংসাত্বক মনোভাব। যে মানসিক শক্তি সুস্থতার পথে পা বাড়িয়ে জীবনের ছন্দে নিজেকে অঙ্গীকার করে, সে কিছু গড়তে চায়, সৃষ্টি করে। এ সৃষ্টি শুধু যশ-প্রতিষ্ঠা অর্জন করা নয়। এ সৃষ্টি যে কোন মানবিক কাজে উৎসাহ ও মনোযোগের ফলে উৎকর্ষ লাভ করা। এর প্রভাবে মানুষের তৃপ্তি আসে, উপকার হয়, আনন্দবোধ উৎপন্ন হয়। অপরদিকে মানসিক হতাশা বোধের প্রভাবে জন্মনেয় আত্মপ্রচারের অহংকার, হীনমন্যতা। মনোবিজ্ঞান বলে নেতিবাচক আবেগ বা কষ্ট অন্য কোনো ভুল বা সামাজিক অগ্রহণযোগ্য আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হলে সমাজ তথা পরিবারে দ্বন্ধের জটিলতা দেখা দেয় সুতরাং মাতা-পিতার উচিত সন্তান-সন্ততিকে আমিত্বের বাঁধন হতে মুক্ত করে গঠনমূলক এবং সৃজনশীল কাজের মধ্যে সম্পৃক্ত করা, তাহলেই শিশুর কৈশোর ও যৌবন হবে কোমল মাধুর্যপূর্ণ। উন্নত হবে সমাজ সভ্যতা।
"আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম,
কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছে পূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।"
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
No comments:
Post a Comment