Tuesday, October 21, 2025

মাগধী ভাষাই পালি ভাষা/ভূমিকা

 সুমনপাল ভিক্ষু


বিহারী ভাষাসমূহ বা নেপালের তরাই অঞ্চলে বিহারের কথিত পূর্ব ইন্দো আর্য ভাষাগুলি। তিনটি প্রধান ভাষা রয়েছে: পূর্বে মৈথিলি (তিরহুতিয়া এবং মাগধী এবং পশ্চিমে ভোজপুরী হয়ে ছোটনাগপুরের দক্ষিণ অর্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাচীন মিথিলা (তিরহুত)-এ কথিত মৈথিলি প্রাচীনকাল থেকেই পণ্ডিতদের ব্যবহৃত ভাষারূপে সমাদৃত এবং এখনও এর অনেকগুলি ভাষাতাত্ত্বিক রূপ রয়েছে। এটি একমাত্র বিহারী ভাষা যার একটি প্রকৃত সাহিত্য রয়েছে এবং ১৯৪৭ এর পর থেকেই এই ভাষার প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মাগধীকে মাগধি প্রাকৃতের বর্তমান প্রতিনিধিরূপে গণ্য করা হয়। বিহারী ভাষাগুলি ভাষাতাত্ত্বিকভাবে বাংলার সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক থেকে এটিকে হিন্দীর সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয়। অধিকাংশ শিক্ষিত বিহারী ভাষাভাষী বাংলা ও হিন্দী জানেন।

মাগধী দক্ষিণ বিহারের মগধ অঞ্চলে কথিত হয়। এর কেন্দ্রস্থল হল সংস্কৃতির পাটনা। জেহানাবাদ, নালন্দা, গয়া, নওয়াদা এবং শেখরপুরা জেলা এবং মাগধী সংস্কৃতির কেন্দ্র হল পাটনা (পূর্বতন পাটলিপুত্র), এবং গয়া, পশ্চিমে, পশ্চিম পাটনা, আরওয়াল, ও আওরঙ্গবাদ জেলায় শোন নদীর ওপর তীরে মাগধী ও ভোজপুরীর সংমিশ্রণ দেখা যায়। গঙ্গার অপর পাড়ে মৈথিলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত কয়েকটি ভাষা কথিত হয়। পূর্বদিকে লক্ষ্মীসরাই ও জামুই জেলায় অঙ্গিকার সঙ্গে মাগধী মিশ্রিত হয়।

পালি মাগধী নামেও পরিচিত পালি ভাষা ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ধ্রুপদী মধ্য-আর্য ভাষা। এটিকে ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করা হয় কারণ এটি বৌদ্ধ পালি বৌদ্ধ সাহিত্য বা ত্রিপিটক এবং থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের পবিত্র ভাষা। পালিকে ভারত সরকার একটি ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছে।

পালি শব্দটিকে থেরবাদী বৌদ্ধ সাহিত্যের ভাষার নাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মনে হয় এই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল বৌদ্ধ ঐতিহ্য থেকে যেখানে পালিকে পৃথক করা হয়েছিল সেই ভাষা বা মাতৃভাষায় অনুবাদ থেকে
যেটি এটিকে পুঁথিতে অনুসরণ করেছিল। K.R. Nourman বলেন এর আবির্ভাবের ভিত্তি ছিল পালি ভাষা এই যৌগটিকে বোঝার ভ্রান্তি থেকে যেখানে পালিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে একটি বিশেষ ভাষার নাম হিসেবে।

পালি নামটি বৌদ্ধ সাহিত্যে আবির্ভূত হয় না এবং বৌদ্ধ সাহিত্যে এটিকেও পরিবর্তে কখনও তাঁতি শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ শিকল বা বংশ। মনে হয় এই নামটি খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে শ্রীলঙ্কায় আবির্ভূত হয়েছিল যখন রাজভাষা ও সাহিত্যের ভাষারূপে পালি ভাষার পূর্ণজাগরণ ঘটে।

সে অর্থে পালি ভাষার নামটি সমস্ত যুগের পণ্ডিতদের মধ্যে কিছু বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, নামটি বানানেরও পার্থক্য রয়েছে, এটিকে দীর্ঘ হ্রস্ব উভয়ের সঙ্গে এবং পালির সঙ্গে মগধের প্রাচীন রাজত্বে কথিত ভাষার সম্পর্ক নিয়ে বিভ্রান্তই রয়েই গেছে যেটিকে আধুনিক বিহারে সনাক্ত করা হয়েছে। থেরবাদী ভাষ্য থেকে শুরু হয়ে পালিকে মাগধীর সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করা হয়েছে যেটি মগধ রাজ্যের ভাষা ছিল। আবার এই ভাষাটিকে সেই ভাষারূপে মনে করা হয়েছে যেটিকে বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় ব্যবহার করেছিলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ প্রাচ্যতত্ত্ববিদ Robert Caesars Childers দাবী করেছেন যে পালি ভাষার প্রকৃত বা ভৌগোলিক নাম হল মাগধী প্রাকৃত এবং যেহেতু পালি শব্দের অর্থ 'পঙক্তি বা সারি', প্রাচীন বৌদ্ধরা শব্দটির অর্থ বাড়িয়ে করেছিলেন 'এক সারি বই' তাই পালি ভাষা শব্দটির অর্থ হল 'বইয়ের বা পুস্তকের ভাষা'।

তবে আধুনিক পণ্ডিতেরা পালি ভাষাকে মোটামুটিভাবে খ্রী. পূর্ব তৃতীয় শতক থেকে অনেকগুলি প্রাকৃত ভাষার সংমিশ্রণ বলে মনে করেছেন যেটির আংশিক সংস্কৃতভবন ঘটেছে। মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষার কোন প্রামাণ্য কথ্য ভাষা নেই যার মধ্যে পালির সব কটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বর্তমান যুগে পালিকে মাগধী প্রাকৃত নামে পরিচিত ভাষার লিপির সঙ্গে এবং অন্যান্য রচনাংশ ও ভাষার সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব হয়েছে যদিও বর্তমানে অস্তিত্বশীল কোন সূত্র থেকেই প্রাক্ অশোকীয় মাগধীর প্রমাণ মেলেনি, বর্তমানের প্রাপ্ত সূত্রগুলি থেকে এই ইঙ্গিত মেলে যে পালি ঐ ভাষার মত নয়।

আধুনিক পণ্ডিতেরা পালি ভাষাকে সাধারণত পূর্ব পশ্চিমের একটি কথ্য ভাষা থেকে উৎপন্ন হয়েছে বলে মনে করেন। পালি ভাষার সৌরাষ্ট্রের গিরনারের পশ্চিম অশোকীয় আদেশনামা এবং হাতীগুম্ফা লিপিতে প্রাপ্ত মধ্য পশ্চিম প্রাকৃতের কিছু মিল রয়েছে। এই সাদৃশ্যের জন্য পণ্ডিতেরা পালি ভাষাকে পশ্চিম ভারতের এই অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত বলে মনে করেছেন। তবে যাইহোক পালির মধ্যে কিছু পূর্বভারতীয় ভাষার বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলিকে মাগধীয় বলে মনে করা হয়েছে।

পালি এটি মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষারূপে সেটির কথ্যরূপের জন্য তার উৎপত্তির সময়ের থেকেও বেশী করে ধ্রুপদী সংস্কৃত থেকে পৃথক ত্রুটির অনেকগুলি রূপগত ও আভিধানিক অর্থগত বৈশিষ্ট্য থেকে প্রমাণিত হয় এটিতে ঋবৈদিক সংস্কৃতের প্রত্যক্ষ ধারবাহিকতা নেই। এর পরিবর্তে এটি এক বা একাধিক উপভাষা থেকে উৎপন্ন যেগুলি অনেক সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও সংস্কৃত থেকে পৃথক।

থেরবাদী ভাষ্যে পালি ভাষাকে 'মাগধী' বা মগধের ভাষা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই অভিন্নতা প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল ভাষ্যগুলিতে এবং এটি মৌর্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে নিজেদের আরও ঘনিষ্ট করার জন্য বৌদ্ধদের একটি প্রচেষ্টা হতে পারে।

তবে বুদ্ধের শিক্ষাগুলির মধ্যে মাত্রা কয়েকটি মগধ রাজ্যের ঐতিহাসিক এলাকার মধ্যে প্রদান করা হয়েছিল। পণ্ডিতগণ মনে করেন সম্ভবত তিনি মধ্য ইন্দো আর্য ভাষার ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত কয়েকটি উপভাষায় তাঁর উপদেশ দিতেন, যেগুলির যথেষ্ট বিধানে পারস্পরিক বোধগম্যতা ছিল।

মহাবংশের মত ইতিবৃত্তে লিপিবদ্ধ থেরবাদী ঐতিহ্যতে বলা হয়েছে ত্রিপিটক প্রথম লিপিবদ্ধ হয় খ্রী.পূর্ব প্রথম শতকে। পূর্ববর্তী ঐতিহ্যের কথ্য সংরক্ষণ থেকে যেখানে বলা হয়েছে যে এই লিপিবদ্ধকরণ ঘটেছিল সংঘের উপর দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ এবং বিরোধী ঐতিহ্য অভয়গিরি বিহারের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে। এই বিবরণ সাধারণভাবে পণ্ডিতগণের দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে যদিও এই ইঙ্গিত রয়েছে যে পালি তার পূর্বেই লিখিতরূপ লাভ করতে শুরু করেছিল। পণ্ডিতগণ মনে করেন যে ইতিহাসের এই সময়ের পূর্বেই পালি সম্ভবত সংস্কৃতের মধ্যে কিছু আত্মীকরণ ঘটেছিল যেমন মধ্য ইন্দো-ব্রাহ্মণের আরও পরিচিত সংস্কৃত ব্রাহ্মণে পরিণতি লাভ যার সঙ্গে সমসাময়িক ব্রাহ্মণেরা নিজেদের অভিন্ন বলে মনে করতেন।

শ্রীলঙ্কায় পালি খ্রীষ্টীয় ৪র্থ বা ৫ম শতকের শেষে অবনতির এটি পর্বে প্রবেশ করেছিল (যেহেতু সংস্কৃত প্রাধান্য লাভ করেছিল এবং বৌদ্ধধর্মের অনুগামীরা উপমহাদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশে পরিণত হয়েছিল)। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উদ্ধার পেয়েছিল। বুদ্ধঘোষের রচনা ছিল বৌদ্ধ চিন্তার বাহন রূপে পালির এই পুনরভ্যুত্থানের কারণ। বিসুদ্ধিমগ্ন এবং অন্যান্য ভাষ্য যা বুদ্ধঘোষ সংকলন করেছিলেন তা সিংহলীয় ভাষ্যের ঐতিহ্য বিধিবদ্ধ ও একত্রীকরণ করেছিল খ্রী.পূর্ব তৃতীয় শতক থেকে।

মাত্র কয়েকটি সম্ভাব্য ব্যতিক্রম ব্যতীত আজকে জানা পালি রচনার প্রায় সমস্তটাই শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরের মহাবিহার থেকে পাওয়া গিয়েছে বলে মনে করা হয়। যদিও ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের থেরবাদী সাহিত্যের প্রমাণ খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকেও পাওয়া যায়, কিন্তু এই ঐতিহ্যের কোন রচনা আবিষ্কার করা যায়নি। কিছু কিছু রচনা (যেমন মিলিন্দপঞহ) শ্রীলঙ্কায় পৌঁছানোর পূর্বে ভারতবর্ষে রচিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেই রচনার টিকে যাওয়া সংস্করণগুলি সংরক্ষিত হয়েছে শ্রীলঙ্কার মহাবিহার দ্বারা এবং এগুলি ভাগ হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থেরবাদী বিহারগুলির সঙ্গে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে প্রাপ্ত পালি ভাষার পূর্ববর্তী লিপিগুলি হল খ্রীষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের এর কয়েকটি সম্ভবত খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর। বর্তমান ব্রহ্মদেশ, লাওস, কাম্বোডিয়া, ও থাইল্যান্ডে প্রাপ্ত লিপিগুলি শ্রীলঙ্কা নয় দক্ষিণ ভারত থেকে বিস্তৃত হয়ে থাকবে। খ্রীষ্টীয় একাদশ শতকে পাগানের চতুর্পাশ্বস্থ অঞ্চলে একটি তথাকথিত পালি পূণর্জাগরণ শুরু হয় যা ক্রমশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের অবশিষ্ট অংশে ছড়িয়ে পড়ে কারণ রাজবংশগুলি অনুরাধাপুরের মহাবিহার থেকে উদ্ভুত ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির পৃষ্ঠপোষকতা করত। এছাড়াও এই যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল সংস্কৃত রীতিনীতি ও কাব্যরূপ গ্রহণ যেগুলি পূর্ববর্তী পালি সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ছিল না। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল খ্রীষ্টীয় ৫ম শতকেই কিন্তু এটি তীব্রতর হয় খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে যখন সংস্কৃতের উপর ভিত্তি করা কাব্যতত্ত্ব ও রচনা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এই পর্বের একটি মাইলফলক হল চতুর্দশ শতকে সুবোধালঙ্কারের প্রকাশনা, এই গ্রন্থগুলি রচনার কৃতিত্ব দেওয়া হয় সংঘরক্ষিত মহাস্বামীকে এবং এটি সংস্কৃত কাব্যদর্শনকে অনুসরণ করে রচিত। পিটার মেসফিল্ড ইন্দো-চৈনিক পালি বা খম পালি নামে পরিচিত পালি এক ধরণের রূপের উপর অনেক গবেষণা করেছিলেন। এখনও পর্যন্ত এটিকে পালির একটি ক্ষয়িষ্ণু রূপ বলে মনে করা হয়। কিন্তু মেসফিল্ড মন্তব্য করেছেন আরো প্রচুর গ্রন্থের আরো পরীক্ষা করলে সম্ভবত দেখা যাবে যে এটি অভ্যন্তরীণ দিক থেকে সঙ্গতিপূর্ণ পালি উপভাষা। এই পরিবর্তনের কারণ হল এই যে এই লিপিতে কয়েকটি অক্ষরের সমষ্টিকে লেখা কঠিন। মেসফিল্ড আরো বলেন যে শ্রীলঙ্কায় থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের তৃতীয় পুনঃপ্রবর্তনের (শ্যামদেশীয় সম্প্রদায়) সঙ্গে সঙ্গে থাইল্যাণ্ডের অনেক রচনাও গ্রহণ করা হয়। মনে হয় যে শ্রীলঙ্কায় ভিক্ষুধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়, একই সঙ্গে অনেক গ্রন্থও হারিয়ে যায়। অতএব শ্রীলঙ্কার পালি বৌদ্ধ সাহিত্য সম্ভার প্রথমে ইন্দো-চৈনিক পালিতে এবং তারপর আবার পালি ভাষায় অনূদিত হয়।

মহাবিহারের ভিক্ষুদের সংখ্যা ও প্রভাব বৃদ্ধি সত্ত্বেও পালি অধ্যয়নের পুর্নজাগরণের ফলে এই ভাষায় এমন নতুন কোন সাহিত্যগ্রন্থ রচিত হয়নি যা বর্তমানে অস্তিত্বশীল। এই যুগে শ্রীলঙ্কার এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের রাজদরবারের চিঠিপত্রের আদানপ্রদান ঘটত পালি ভাষায় এবং সিংহল, ব্রহ্মদেশ, এবং অন্যান্য ভাষা ব্যবহারকারীদের উদ্দেশ্য করে ব্যাকরণ রচিত হত। থেরবাদী বৌদ্ধ সাহিত্যের ভাষারূপে পালির আবির্ভাব ঘটেছিল এযুগেই। যদিও সাধারণভাবে পালিকে একটি প্রাচীন ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয় প্রাচীনতম যুগের কোন লিপি উৎকীরণবিদ্যা বা পুঁথিগত প্রমাণ আর টিকে নেই। পালির সর্বপ্রাচীন যে নমুনা আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলি হল লিপি সেগুলি খ্রীষ্টীয় ৫ম থেকে ৮ম শতক পর্যন্ত খোদিত হয়েছিল বলে মনে করা হয় এবং এগুলির অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে বিশেষত মধ্য শ্যাম ও নিম্নব্রহ্মে। এই লিপিগুলির মধ্যে প্রধানত রয়েছে পালি বৌদ্ধ সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত অংশ এবং মূল বৌদ্ধ সাহিত্য ব্যতীত রচনা যার মধ্যে রয়েছে 'হয়ে ধম্মা হেতু' গাথার অনেকগুলি দৃষ্টান্ত।

সর্বপ্রাচীন পালি পুঁথি আবিষ্কৃত হয়েছিল নেপালে এবং এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল খ্রীষ্টীয় নবম শতকে। এটি ছিল চারটি তাল পাতার ভাঁজ করা কাগজের

বইরূপে, যেখানে ব্যবহৃত হয়েছিল একটি পরিবর্তনশীল লিপি যেটি পাওয়া গিয়েছিল গুপ্ত লিপি থেকে যার দ্বারা চুলবন্ধের একটি খণ্ডিত অংশ রচিত হয়েছিল। শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বপ্রাচীন জ্ঞাত পুঁথিগুলি রচিত হয়েছিল ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে যদিও এর মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্ত টিঁকে আছে। ৪০০ বছরের থেকে বেশী প্রাচীন খুব কম সংখ্যক পুঁথিই টিকে আছে এবং চারটি নিকায়ের সম্পূর্ণ পুঁথি পাওয়া যায় কেবল খ্রিষ্টীয় ১৭শ থেকে পরবর্তী সময়ের।

পাশ্চাত্য সাহিত্যে পালির উল্লেখ পাওয়া যায় Sumon De la Loubere-র সিয়াম রাজত্বের ভ্রমণ বৃত্তান্তে। এই ভাষার এটি পুরাতন ব্যাকরণ ও অভিধান প্রকাশ করেছিলেন মেথডিস্ট প্রচারক বেঞ্জামিন ক্লাউ ১৮২৪ সালে এবং এর একটি প্রাথমিক অধ্যয়ন প্রকাশ করেছিলেন ১৮২৬ সালে Engene Burnouf ও Chrustian Lessen। প্রথম আধুনিক পালি-ইংরাজী অভিধান ১৮৭২ সালে ও ১৮৭৫ সালে প্রকাশ করেছিলেন Robert Childers পালি টেক্সট সোসাইটি স্থাপিত হবার পর ইংরাজী পালি অধ্যয়ন দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং Childer এর অভিধান পুরনো হয়ে যায়। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে নতুন একটি অভিধান রচনার পরিকল্পনা গৃহীত হয় কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি কারণে, বিলম্ব হওয়ায় কাজটি ১৯২৫ সালের পূর্বে বাস্তবায়িত হয়নি।

T.W. Rhys Davids তাঁর গ্রন্থ Budhist India এবং Wilhelm Geiger তাঁর গ্রন্থ Pali Literature and Language-এ ইঙ্গিত দিয়েছেন পালি সেই সমস্ত মানুষদের সাধারণ ভাষারূপে উৎপন্ন হয়ে থাকতে পারে যারা উত্তরভারতে বিভিন্ন উপভাষা ব্যবহার করত এবং সেগুলি বুদ্ধের সময়ে প্রচলিত ছিল এবং তাঁর দ্বারা ব্যবহৃত হত। অপর একজন পণ্ডিত মন্তব্য করেছেন সে সময়ে এটি ছিল পরিমার্জিত ও সুন্দর একটি দেশীয় ভাষা যেটি সমস্ত সাধারণ ভাষাভাষী মানুষ ব্যবহার করত। আধুনিক পণ্ডিতগণ এই বিষয়ে কোন সহমতে উপনীত হতে পারেন নি; এ বিষয়ে অনেকগুলি পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব রয়েছে যেগুলির প্রতিটিরই অনেক সমর্থক ও সমালোচক রয়েছে। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর পালি বুদ্ধের ভাষা থেকে ও বৌদ্ধদের মধ্যে থেকে বিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে একটি নতুন কৃত্রিম ভাষারূপে। R. C. Childers যিনি এই তত্ত্বের সমর্থক রয়ে গিয়েছিলেন যে পালি ছিল প্রাচীন মাগধী লিখেছেন, 'যদি গৌতম কখনও ধর্মপ্রচার না করতেন তাহলে মাগধী হিন্দুস্থানের অন্য অনেক দেশীয় ভাষার থেকে পৃথক হত বলে মনে হয় না, কেবল হয়ত এর একটি অর্ন্তনিহিত শক্তি ও সৌন্দর্য থাকত যেটি এটিকে প্রাকৃতদের মধ্যে এক ধরণের টাস্ক্যান বানিয়েছে।

K. R. Norman এর মতে, বৌদ্ধ সাহিত্যের বিভিন্ন রচনার মধ্যে পার্থক্য থেকে বোঝা যায় এর মধ্যে একাধিক উপভাষার উপাদান রয়েছে। তিনি এই মতও প্রকাশ করেছেন যে সম্ভবত উত্তর ভারতের বিহারগুলিতে স্থানীয় উপভাষায় উপাদানগুলি পৃথকভাবে সংরক্ষিত ছিল। সম্ভবত প্রথমদিকে এই উপাদনগুলিকে অন্যান্য জায়গায় স্থানান্তরণের জন্য কোন অনুবাদেরই প্রয়োজন ছিল না। অশোকের সময়কাল নাগাদ অধিকতর ভাষাতাত্ত্বিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় এবং সমস্ত উপাদানকে একত্রিত করার জন্য প্রচেষ্টা করা হয়। এমন হতে পারে যে পালির খুব কাছাকাছি একটি ভাষা এই প্রক্রিয়ার ফলে আবির্ভূত হয়, বিভিন্ন উপভাষার মাঝামাঝিরূপে এবং এই ভাষাতেই সমস্ত প্রাচীন উপাদান সংরক্ষিত হয়েছে। এই ভাষাটিই তারপর থেকে পূর্বের বৌদ্ধদের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী ভাষারূপে কাজ করতে থাকে। এই পর্বের পর ভাষাটির সামান্য সংস্কৃত প্রভাবিত ঘটে থাকে।

পাণ্ডিত্যের বর্তমান অবস্থার সংক্ষিপ্তসার প্রসঙ্গে ভিক্ষু বোধি মন্তব্য করেছেন যে ঐ ভাষাটি 'সেই ভাষাটির সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত (বা আরও বেশী করে বিভিন্ন স্থানীয় কথ্য ভাষা) যে ভাষা বুদ্ধ স্বয়ং কথা বলতেন। তিনি আরো লিখেছেন পণ্ডিতগণ এই ভাষাটি একটি সংকর ভাষা বলে মনে করেন যার মধ্যে খ্রী.পূ. ৩য় শতকের কাছাকাছি প্রাকৃত ভাষার অনেক বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে, যার কারণ হল পরবর্তীকালের আংশিক সংস্কৃতায়ন। যদিও ভাষাটি বুদ্ধ স্বয়ং যে ভাষায় কথা বলে থাকতেন তার সঙ্গে অভিন্ন নয়, এটি সেই বিশাল ভাষা পরিবারের অন্তর্গত যেগুলি তিনি ব্যবহার করে থাকবেন এবং যেগুলির উদ্ভব অভিন্ন ধারণাগত ছাঁচ থেকে। এইভাবে এই ভাষাটি সেই ভাবনা জগতের প্রতিনিধিত্ব করে যা বুদ্ধ উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন সেই বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে যার মধ্যে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন যাতে তার শব্দগুলি সেই ভাবনা জগতের সূক্ষ্ম তারতম্যগুলিকে খুঁজে নিতে পারে।'

-ভিক্ষু বোধি

A. K. Warder এর মতে, পালি ভাষা একটি প্রাকৃত ভাষা যা পশ্চিম ভারতের একটি অঞ্চলে ব্যবহৃত হত। Warder পালিকে ভারতবর্ষের অবন্তী জনপদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মনে করেছেন যেটি স্থবির নিকায়ের কেন্দ্র ছিল। বৌদ্ধ সংঘের প্রাথমিক বিভাজনের পর স্থবির নিকায় পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত এবং মহাসাংঘিক নিকায় মধ্য ও পূর্ব ভারতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে! সৌরাষ্ট্রীয় লিপির উদাহরণ দিয়ে Akira Hirakawa এবং Paul Groner পালিকে পশ্চিম ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন ও স্থবির নিকায়ের যেটি ভাষাতাত্ত্বিকভাবে পালি ভাষার সবচেয়ে নিকটবর্তী।

যদিও ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্যে সংস্কৃতকে মনে করা হত দেবতাদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি অপরিবর্তনীয় ভাষা যেখানে প্রতিটি শব্দের একটি অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য্য রয়েছে, প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্যে কোন ভাষা সম্পর্কে এই মতকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেখানে শব্দ হল কেবল প্রথাগত ও ক্ষণস্থায়ী চিহ্ন। ভাষার এই ধারণা স্বাভাবিকভাবেই পালির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয় এবং সংস্কৃতের পরিবর্তে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটির অবদান থাকতে পারে। তবে, পালি ভাষ্যগুলির একটি সংকলনের পূর্বেই অজ্ঞাতানামা লেখকেরা পালিকে স্বাভাবিক ভাষা, সমস্তপ্রাণীর মূল ভাষারূপে বর্ণনা করেছেন।

পাশ্চাত্যের অলৌকিক ঐহিহ্যে প্রাচীন মিশরীয়, হিব্রু বা ল্যাটিন ভাষার মতই পালি আবৃত্তিরও অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে বলে মনে করা হত (যার কারণ ছিল তাদের অর্থ, আবৃত্তিকারের চরিত্র, বা ভাষার গুণাবলী) এবং বৌদ্ধ সাহিত্যের প্রাথমিক স্তরে দেখা যায় যে পালি সারণি মন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত যেমন সর্পাঘাত থেকে নিরাময়ের ক্ষেত্রে। থেরবাদী সংস্কৃতির অনেক মানুষ এখনও বিশ্বাস করে যে পালি ভাষায় প্রতিজ্ঞাপাঠ গ্রহণের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে এবং শ্রীলঙ্কায় একথা বিশ্বাস করা হয় যে অঙ্গুলিমালের প্রতিজ্ঞা শপথ সন্তান জন্মাদানের যন্ত্রণাকে হ্রাস করে। থাইল্যাণ্ডে অভিধম্মপিটকে একটি অংশকে জপ করাকে সদ্যমৃতদের ক্ষেত্রে উপকারী বলে মনে করা হয় এবং এই উৎসবটি কারও মৃত্যুর পর সাতটি কর্মদিবস ধরে চলে। পরবর্তী রচনায় এমন কিছু নেই যা এই বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এই প্রথার উদ্ভব অস্পষ্ট।

ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডে একটি সাহিত্যিক ভাষারূপে পালির মৃত্যু হয়েছিল চতুর্দশ শতকেই কিন্তু অন্যত্র এটি টিকে ছিল অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত। এখনও পালি ভাষা অধ্যয়ন করা হয় প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র পাঠ করার জন্য এবং এটি আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রায়ই জপ করা হয়। পালি ইতিবৃত্ত, চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ এবং লিপি ইত্যাদি ধর্মনিরপেক্ষ সাহিতেরও যথেষ্ট ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। পালি জ্ঞানের মহান কেন্দ্রগুলি রয়েছে শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থেরবাদী দেশসমূহে মায়ানমার, থাইল্যাণ্ড, লাওস ও কাম্বোডিয়া। ঊনবিংশ শতক থেকে ভারতবর্ষে পালি চর্চার বিভিন্ন কেন্দ্র এই ভাষা ও তার সাহিত্য সম্পর্কে একটি চেতনা সৃষ্টি করেছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে অনাগারিক ধর্মপাল প্রতিষ্ঠিত মহাবোধি সোসাইটি।

১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই ইউরোপে পালি টেক্সট

সোসাইটি ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে পালি ভাষা অধ্যয়নে আগ্রহের সঞ্চার করেছে। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান রোমক হরফে বিভিন্ন পালি সংস্করণ প্রকাশ করেছে এবং এর সঙ্গে এই উৎসগুলির ইংরাজী অনুবাদও। ১৮৬৯ সালে পালি টেক্সট সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য Robert Caesar Childers-এর গবেষণাকে ভিত্তি করে প্রথম পালি অভিধানটি প্রকাশিত হয়। একটি ইংরাজীতে অনূদিত প্রথম পালি রচনা এবং এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭২ সালে। Childers এর অভিধান পরে ১৮৭৬ সালে Volney পুরস্কার লাভ করে।

পালি টেক্সট সোসাইটি আংশিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঊনবিংশ শতকের দ্বিয়ার্ধে যুক্ত ইংল্যাণ্ড ও যুক্তরাজ্যে ভারততত্ত্বের জন্য বরাদ্দ সেই অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণ অর্থ সাহায্যের ক্ষতি পূরণ করার জন্য; এটি অত্যন্ত সামঞ্জস্যহীন যে যুক্তরাজ্যের সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা চর্চায় জার্মানী, রাশিয়া এমনকি ডেনমার্কের মত অগ্রসর ছিল না। শ্রীলঙ্কা ও ব্রহ্মদেশের সাবেক ঔপনিবেশের অনুপ্রেরণা ছাড়াই Danish Royal Liberary-র মত প্রতিষ্ঠান পালি পুঁথির একটি প্রধান সংগ্রহ, এবং পালি চর্চার একটি প্রধান ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে।

Paisaci হল ধ্রুপদী ভারতবর্ষের একটি প্রধানত অপ্রমাণিক সাহিত্যিক ভাষা যার উল্লেখ প্রাচীন প্রাকৃত ও সংস্কৃত ব্যাকরণে দেখা যায়। এটিকে প্রাকৃত ভাষাগুলির সঙ্গে একটি গোষ্ঠীতে দেখা যায়, যার জন্য এটির কিছু ভাষাতাত্ত্বিক সাদৃশ্য রয়েছে, কিন্তু প্রথম পর্বের বৈয়াকরণিকরা এটিকে কথ্য ভাষা বলে বিবেচনা করেন নি কারণ এটিকে একটি বিশুদ্ধ সাহিত্যিক ভাষারূপে মনে করা হত।

দণ্ডির 'কাব্যশাস্ত্র' এর মত সংস্কৃত। কাব্যশাস্ত্রের কিছু রচনায় এটি 'ভূতভাষা' নামে পরিচিত, এটি একটি শিরোপা যার অর্থ হতে পারে 'মৃত ভাষা' (অর্থাৎ যে ভাষার জীবিত কোন ব্যবহারকারী নেই) বা 'ভূত' শব্দের অর্থ অতীত তাই এই ভূতভাষা শব্দটির অর্থ হল যে ভাষায় অতীতে কথা বলা হত। এই ব্যাখ্যার স্বপক্ষে যে প্রমাণ পাওয়া যায় তা হল এই পৈশাচি ভাষা সাহিত্য হল খণ্ডিত এবং অত্যন্ত বিরল, কিন্তু অতীতের কোন সময়ে এটি সাধারণ থাকতে পারে।

ত্রয়োদশ শতকের তিব্বতীয় ঐতিহাসিক Buton Renchien Drub মন্তব্য করেছেন প্রাচীন বৌদ্ধ সম্প্রদায়গুলি পৃথক ছিল তাদের ভাষার নির্বাচন দিয়ে: মহাসাংঘিকগণ প্রাকৃত ব্যবহার করেন, সর্বাস্তিবাদীগণ সংস্কৃত ব্যবহার করেন।

স্থবিরবাদীগণ পৈশাচি ব্যবহার করেন এবং সম্মিতিয়গণ অপভ্রংশ ব্যবহার করেন। এই পর্যবেক্ষণের ফলে কয়েকজন পণ্ডিত পালি ও পৈশাচীর মধ্যে তাত্ত্বিক যোগসূত্র অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন; Sten Konow এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে এটি দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড়ীয় মানুষদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি ইন্দো-আর্য ভাষা হতে পারে এবং আলফ্রেড মাস্টার পালি রূপমূলতত্ত্ব এবং টিঁকে যাওয়া খণ্ডিতাংশের অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন।

অর্ধমাগধী প্রাকৃত ছিল একটি মধ্য ইন্দো আর্য ভাষা এবং একটি নাট্যগুণসম্পন্ন প্রাকৃত যেটি আধুনিক বিহার ও পূর্ব উত্তর প্রদেশে কথিত হত এবং কয়েকটি প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন নাটকে ব্যবহৃত হয়েছিল। প্রথমে এটিকে মাগধী প্রাকৃতের একটি পূর্বসূরী বলে মনে করা হত, তাই এটির নামকরণ হয়েছিল অর্ধমাগধী। জৈন পণ্ডিতেরা ব্যাপকভাবে অর্ধমাগধীর ব্যবহার করতেন এবং এটি জৈন আগমে সংরক্ষিত রয়েছে।

অর্ধমাগধীর সঙ্গে পরবর্তীকালের মাগধী প্রাকৃতের যা পার্থক্য পালিরও তাই পার্থক্য এবং প্রায়শই এটিকে পালির সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করা হত এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে পালি ভাষায় একটি প্রাচীন মাগধী উপভাষায় বুদ্ধের শিক্ষা লিপিবদ্ধ হয়েছিল।

মাগধী প্রাকৃত একটি মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা যেটি বর্তমান বিহার ও পূর্ব উত্তর প্রদেশে কথিত হত। এটির ব্যবহার পরবর্তীকালে দক্ষিণ পূর্ব থেকে ছড়িয়ে পড়ে এবং আধুনিক বাংলা, ওড়িশা ও আসামের কিছু অংশ এর অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এটি দেশীয় সংলাপের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য কোন কোন মাগধী নাটকে ব্যবহৃত হয়। মাগধী প্রাকৃতের সংরক্ষিত উদাহরণ বুদ্ধের জীবদ্দশার বেশ কয়েক শতক পরবর্তীকালের এবং এর অন্তর্ভুক্ত হল লিপি যেগুলি রচনার কৃতিত্ব অশোক মৌর্যকে দেওয়া হয়।

মাগধী প্রাকৃত ও পালির সংরক্ষিত দৃষ্টান্তের মধ্যে পরিলক্ষিত পার্থক্যের কারণে পণ্ডিতেরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে পালি একটি মধ্য ভারতীয় ভাষার উত্তর পশ্চিম উপভাষার আঞ্চলিক ভাষা, এটি বুদ্ধের সময়কালে মগধ অঞ্চলে কথিত একটি নিরবিচ্ছিন্ন ভাষা নয়।

পালি ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দের অন্য মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ বা প্রাকৃতের সমধাতুজ শব্দ রয়েছে। বৈদিক সংস্কৃতের এর সম্পর্ক কম প্রত্যক্ষ ও আরও জটিল; প্রাকৃত ভাষাগুলির জন্ম হয়েছে প্রাচীন ইন্দো আর্য ভাষাগুলি থেকে। ঐতিহাসিক দিক থেকে পালি ও সংস্কৃতের পারস্পরিক প্রভাব উভয় দিকেই অনুভূত হয়েছে। পরবর্তীকালের সংস্কৃত রচনার সঙ্গে তুলনা করে পালি ভাষার সংস্কৃত সদৃশতাকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে-এগুলি সংস্কৃত ভাষা জীবন্ত ভাষারূপে শেষ হবার বহু শতক পর রচিত হয়েছিল এবং এটি প্রভাবিত হয়েছিল মধ্য ভারতীয় ভাষার বিকাশ এবং যার অন্তর্গত ছিল মধ্য ভারতীয় শব্দ থেকে সরাসরি ঋণগ্রহণ; অপরদিকে পরবর্তীকালের পালি পরিভাষার

অনেকটা গৃহীত হয়েছে সংস্কৃত ভাষার সমজাতীয় বিভাগের শব্দভাণ্ডার থেকে, হয় সরাসরি নয়ত কিছু ধ্বনিতত্ত্বগত গ্রহণের মধ্যে দিয়ে। 

বৌদ্ধযুগে পালি স্থানীয় ভাষা থেকে কিছু শব্দ ঋণ গ্রহণ করেছে যেখানে পালি ব্যবহৃত হত। এই ব্যবহার পরবর্তীকালের রচনা থেকে সুত্তপিটকে পালির থেকে পৃথক যেমন বৌদ্ধসাহিত্য রচনা বিষয়ক পালি ভাষ্য এবং লোককাহিনী (যেমন জাতক কাহিনীর উপর ভাষ্য) এবং তুলনামূলক আলোচনা এবং গ্রন্থের কালনির্ধারণ ঐ ধরনের ঋণ শব্দের ভিত্তিতে। এখন এটি একটি নিজেই একটি বিশেষ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র।

পালি কেবল বুদ্ধের শিক্ষা প্রচরের জন্যই ব্যবহৃত হত না এবং এটি বোঝা যায় এই ভাষায় রচিত অনেকগুলি ধর্ম নিরপেক্ষ গ্রন্থ থেকে যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞান, সংক্রান্ত গ্রন্থ। তবে, এই ভাষায় পাণ্ডিত্যপূর্ণ আগ্রহ নিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় ও দার্শনিক সাহিত্যে, কারণ এটি বৌদ্ধধর্মের একটি পর্যায়ের বিকাশের সামনে একটি অনন্য বাতায়ন উন্মুক্ত করে।

পালি একটি অত্যন্ত বিভক্তিযুক্ত ভাষা যেখানে প্রায় প্রতিটি শব্দে মূল অর্থ প্রকাশক মূল ছাড়াও এক বা একাধিক সংযোজক রয়েছে (সাধারণত পরসর্গ) যেটি কোনভাবে অর্থটিকে পরিবর্তিত করে। বিশেষ্যগুলি লিঙ্গ, বচন এবং কারকের জন্য; বাচিক বিভক্তি ব্যক্তি, বচন, কাল ও ভাব সম্পর্কে তথ্যদান করে।

পালি বিশেষ্যের তিনটি লিঙ্গ (পুং, স্ত্রী ও ক্লীব) এবং দুটি বচন রয়েছে (একবচন ও বহুবচন)। বিশেষ্য ও নীতিগতভাবে আটটি কারক প্রদর্শন করে যেমন কর্তৃকারক, কর্মকারক, করণকারক, সম্প্রদান কারক ও অধিকরণ কারক, তবে অনেক ক্ষেত্রে এই কারণগুলির এক বা একাধিক রূপগতভাবে অভিন্ন, এটি বিশেষভাবে সত্য সম্বন্ধপদ ও সম্প্রদান কারকের ক্ষেত্রে।

পালি ও সংস্কৃত অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এবং এই দুই ভাষার সাধারণ বৈশিষ্টগুলি তারা সকলে চিনতে পারেন যারা দুটি ভাষার সঙ্গেই পরিচিত। পালি ও সংস্কৃত Word Stem এর একটি বড় অংশ রূপে দিক থেকে অভিন্ন কেবল তে পার্থক্য রয়েছে।

একপ্রস্থ ধ্বনিতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কৃত কারিগরী পরিভাষা পালি ভাষায় পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তন সেই ধ্বনিতত্ত্বগত উপপ্রস্থকে নকল করে যা প্রোটো পালিতে ঘটেছে। এই সমস্ত পরিবর্তনের কারণে এই কথা বলা সর্বদা সম্ভবপর হয় না যে একটি প্রদত্ত পালি শব্দ প্রাকৃত শব্দভাণ্ডারের একটি অংশ নাকি সংস্কৃত থেকে গৃহীত একটি পরিবর্তিত ঋণ শব্দ। একটি পালি শব্দের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত একটি সংস্কৃত শব্দের অস্তিত্ব পালি শব্দের উৎপত্তিতত্ত্বের নিশ্চিত প্রমাণ নয় যেহেতু কোন কোন ক্ষেত্রে কৃত্রিম সংস্কৃত শব্দ প্রাকৃত শব্দগুলি থেকে back formation-এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল।

নিম্নলিখিত ধ্বনিতত্ত্বগত প্রক্রিয়াগুলি সেই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের বিশদ বিবরণ নয় যেগুলির মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় পূর্বপুরুষ থেকে পালি ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল। এবং এটি সংস্কৃত ও পালির সবচেয়ে সাধারণ ধ্বনিতাত্ত্বিক সমীকরণের একটি সংক্ষিপ্তসার, এর মধ্যে সম্পূর্ণতার কোন দাবী নেই।

সম্রাট অশোক অন্তত তিনটি স্থানীয় প্রাকৃত ভাষায় তার ব্রাহ্মীলিপিতে তাঁর আদেশনামা খোদাই করেছিলেন যেগুলির সঙ্গে পালির ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে। ঐতিহাসিক দিক থেকে বিশ্বাস করা হয় পালি বৌদ্ধ সাহিত্যের প্রথম লিপিবদ্ধকরণ ঘটেছিল শ্রীলঙ্কায়, যার ভিত্তি ছিল একটি ভূতপূর্ব মৌখিক ঐতিহ্য। শ্রীলঙ্কার পালি ইতিবৃত্ত মহাবংশ থেকে জানা যায় খ্রী.পূ. ১০০ অব্দে রাজা বট্টগামনীর রাজত্বকালে সে দেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বৌদ্ধ সাহিত্য লিপিবদ্ধ করে। খরোষ্ঠি আবুগিডা পাঠোদ্ধার করতে যেমস প্রিন্সেপ গ্রীক লিখন এবং খরোষ্টি লিপিতে ব্যবহৃত পালি যুক্ত দ্বিভাষাকি মুদ্রা ব্যবহার করেন। গান্ধারীয় বৌদ্ধ রচনা আবিষ্কৃত হওয়ার পর এই লিপিটি প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়নে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

লিখিত পালির সঞ্চারণ বর্ণমালাভিত্তিক মূল্যের একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা রক্ষা করেছে, কিন্তু ঐ মূল্যগুলিকে বিভিন্ন লিপির মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। ১৮৪০-এ রাজা মংকুট একটি আরিয়াকা লিপি উদ্ভাবন করেন। এটি গ্রীক ও ব্রহ্মদেশীয় খম লিপি থেকে পালি ভাষায় লিপ্যান্তরের একটি বিশ্ববাপী মাধ্যম রূপে গৃহীত হয় এবং এর উদ্দেশ্য ছিল খম থাই ও তাই থামসহ অন্যান্য অস্তিত্বশীল স্থানীয় লিপিগুলির স্থান দখল করা। তবে লিপিটির ব্যবহার জনপ্রিয় হয়নি। থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম যে সমস্ত অঞ্চলে অনুশীলন করা হয় সেখানে পালি ভাষা লিপ্যান্তরের জন্য পৃথক বর্ণমালা ব্যবহৃত হয়।

ভারত: দেবনাগরী, অহম লিপি

বাংলাদেশ: বাংলা, চাক্কা

শ্রীলঙ্কা: সিংহলা

মায়ানমার: মন-ব্রহ্মদেশীয়, লিক-তাই

কাম্বোডিয়া: খমের

থাইল্যাণ্ড: থাই (১৮৯৩ থেকে, ঐতিহাসিক দিক থেকে তাই থাম, খম থাই, এবং আরিয়াকা লিপি।
লাও: লাও (১৯৩০ থেকে, ঐতিহাসিক দিক থেকে তাই থাম)।

পালি বিভিন্ন পরিমাণে দক্ষিণপূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার ভাষাগুলিকে প্রভাবিত করেছে, এদের মধ্যে রয়েছে ব্রহ্মদেশীয়, খমের, এবং লাও, সিংহলা এবং থাই। কাম্বোডিয়াতে ত্রয়োদশ শতকে মর্যাদার ভাষারূপে পালি সংস্কৃতের স্থান অধিকার করে এবং একটি সেখানে থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের প্রসারের সঙ্গে সমঃপতিত হয়। ১৯০০ শতক ধরে Chuoon Nath পালি মূল ব্যবহার করেছিলেন 'ট্রেন' এর মত আধুনিক বিষয় বর্ণনার জন্য খমের neologism ব্যবহার করতে। একইভাবে বিংশ শতকে থাইল্যাণ্ডে ও লাওসে জিৎ ভূমিসেক ও বজিরাবুধসহ স্থানীয় পণ্ডিতগণ পালি মূল ব্যবহার করে নতুন শব্দ তৈরি করেছিলেন যা বিদেশী ধারণা এবং কারিগরি উদ্ভাবনা বর্ণনা করত।

মায়ানমারে ব্রহ্মদেশীয় ভাষা প্রাচীন ব্রহ্মদেশীয় রূপে তার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই পালি থেকে হাজার হাজার শব্দ তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করেছে বিশেষত ধর্ম, সরকার, কলা ও বিজ্ঞান বিষয়ে, অপরদিকে সংস্কৃত ভাষা থেকে ঋণ গ্রহণ সীমাবদ্ধ ছিল বিশেষ বিশেষ বিষয় যেমন জ্যোতিষশাস্ত্র, জ্যোতিবিজ্ঞান এবং চিকিৎসাশাস্ত্র। ব্রহ্মদেশীয় ভাষায় প্রথম দশটি পূরণবাচক সংখ্যা সরাসরি পালি থেকে ধার করা হয়েছে। ব্রহ্মদেশীয় ভাষার বিংশ শতকেও নতুন বর্মী শব্দ তৈরির জন্য পালি মূলের ব্যবহার ও তাদের নব প্রয়োগের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে; পালি বর্মী ব্যাকরণের গঠনকেও প্রভাবিত করেছে বিশেষত বর্মী সাহিত্যের ভাষাকে। ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে পালি ভাষায় প্রথম পুরুষের সর্বনাম পালি ব্যাকরণের অন্তর্গত হয়ে উঠেছে, যেটি পালি বাক্যগঠনরীতি অনুসরণ করে বিশ্লেষক রূপান্তরিত করেছে। ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত বর্মী গদ্যরচনা পালি রচনার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বিশেষত নিস্সয়া রচনাগুলির দ্বারা যেগুলি প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে।

শ্রীলঙ্কায় অনুরাধাপুর পর্ব থেকে পালি সিংহলী ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে বিশেষত সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর উদাহরণ হল দ্বীপবংশ ও মহাবংশ ইতিবৃত্ত যার দুটিই পালি গাথায় রচিত হয়েছিল।

অনুরাধাপুরের পর্বের পর সংস্কৃত সিংহলীয় ভাষার বিকাশে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

আমার নিজস্ব বিচার মতে- "পালি সাহিত্যের তথা ভাষার মাগধী ভাষার রূপতাত্ত্বিক, ধ্বনিতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রচুর মিল পরিলক্ষিত হয়। ললিত বিস্তর অনুসারে বুদ্ধ ৬৪ প্রকার লিপি শিক্ষা জানতেন। ৬৪টি প্রাচীন ভারতীয় লিপির এই তালিকায় এক সংস্করণ একটি ভারতীয় বৌদ্ধ গ্রন্থের চীনা অনুবাদে পাওয়া যায় এবং এই অনুবাদটি ৩০৮ খৃষ্টাব্দের বলে মনে করা হয়। মাগধী ভাষাই পালি ভাষা এই গ্রন্থে নামকরণ যথার্থ-সার্থক বলে মনে করি। ষোড়শ মহাজনপদে মগধ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী শৌর্যে বীর্যে-ভাষা সংস্কৃতিতে উন্নত। সেই হেতু বুদ্ধের সময়কাল হতেই এই মাগধী তথা পালি ভাষা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই ভাষার গ্রহণযো্যতা লাভ করে। আজকে যেমন আমরা ভারতের ১৬টি ভাষা পাই এবং ৬৩০টি উপভাষা পাই। ঠিক তদ্রূপ সেই মগধের শৌর্যবীর্যতার কারণে এই মাগধী ভাষা কম প্রভাব বিস্তার করেনি। বুদ্ধ অবশ্য সব আঞ্চলিক ভাষাও অন্ত্যেজশ্রেণীর ভাষাকে প্রাধান্য দিতেন এবং চুলবগ্নে উল্লেখ আছে ভিক্ষুদের সাধারণ মানুষের ভাষায় উপদেশ প্রদান ধর্মপ্রচার করতে বলেছেন। যেহেতু বুদ্ধ ও বৌদ্ধ সংঘ মগধ তথা কাশী-কোশল থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল সেহেতু ভিক্ষুরা মাগধী ও কাশী অঞ্চলের ভাষাই বেশী কথোকথন করতেন। বিম্বিসার রাজা কাশী যৌতুক হিসেবে মহাকোশলের থেকে পেয়েছিলেন সেই হেতু সেখানে মাগধী ভাষার প্রভাব পড়েছে এই সুনিশ্চিত বলে বলা যায়।”

"বিশেষত মৌর্য সম্রাজ্যের সূচনা হয় তখন মগধ ছিল সমগ্র ভারতের

রাজধানী। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময় অখণ্ড ভারতের রূপ লাভ করলেও স্থায়ী হয়নি। কিন্তু সম্রাট অশোকের সময়কালেই মগধ ভারতবর্ষের রাজধানী এবং অখণ্ড ভারতবর্ষ সম্রাট অশোক তৈরি করেছিলেন। সেই হেতু সম্রাট অশোককে অখণ্ড ভারতের জাতির জনক বলা যায়। এবং অশোক যেখানে গেছেন সেখানকার ভাষাকে প্রাধান্য দিতেন এবং সেই অঞ্চলের ভাষাতেই শিলালেখ লিখেছেন। তার মধ্যে অবশ্য মাগধী ভাষার রূপ কিছুটা হলেও লক্ষ্য করা যায়। সেই সময়ের শিলালেখগুলোকে অশোকান প্রাকৃত বা অশোকের ব্রাহ্মী। অশোকের শিলালিপি বলে ঐতিহাসিকরা পণ্ডিতরা তাঁদের লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেহেতু অশোক মগধ সাম্রাজ্যের অধীশ্বর সেই হেতু মাগধী ভাষাই পালি ভাষা হিসেবে নিঃসন্দেহে বলতে পারি। এখনও পর্যন্ত বর্তমান বিহার কাশী, কোলন বেনারস অঞ্চলের অনেক ভাষার সঙ্গে পালি বৌদ্ধ সাহিত্যের

৯০ শতাংশ মিল পাওয়া যায় এবং যাবে। এবং আচার্য বুদ্ধঘোষের রচিত অর্থকথার ভাষাও মগধ অঞ্চলের সঙ্গে অভিন্ন মিল পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলতে পারি মাগধী ভাষাই পালি ভাষা।" 

"বুদ্ধঘোষ যখন সিংহলে যাত্রা করছেন তখন সমুদ্র পথে আচার্য বুদ্ধঘোষের সঙ্গে সাক্ষাত হয় তখন একে অপরের কথোপকথন থেকে জানা যায়, আচার্য বুদ্ধঘোষ সিংহলে যাচ্ছে ত্রিপিটক সম্পূর্ণ মাগধী ভাষা অনুবাদ করতে। অর্থাৎ ভারতবর্ষ থেকে মাগধী বা পালি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গিয়েছিলো তার কোন হরফ ও রক্ষিত হয়নি। আচার্য বুদ্ধঘোষ সিংহলে গিয়ে সম্পূর্ণ ত্রিপিটক সিংহল থেকে মাগধী বা পালি ভাষায় অনুবাদ করেন'। তাঁর জীবনীগ্রন্থ আচার্য বুদ্ধঘোষোৎপত্তি এবং চুলবংশে থেকে জানা যায় তিনি সিংহলী থেকেই মাগধী ভাষায় বা পালি ভাষায় ত্রিপিটক অনুবাদ এবং অট্ট কথা পালি তথা মাগধী ভাষার অনুবাদ করেছিলেন। এর থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় মাগধী ভাষাই পালি ভাষা।"

এই গ্রন্থে ড. আচার্য সংঘরাজ সত্যপাল মহাথের সেই কথারই সারতত্ত্ব পরিবেশন করেছেন। সুতরাং ভন্তের কথা অবতারণা করেই বলা যায় ভন্তের চিন্তা চেতনা ও গবেষণা যথার্থই হয়েছে। ভন্তের প্রয়াণের আগে আমাকে এই গ্রন্থ প্রকাশের ভার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমি ভন্তেকে কথা দিয়েছিলাম আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব। এবং ভন্তে আমাকে আরো বলেছিলেন এই গ্রন্থটি আমার অনুজ ভ্রাতা-ভগিনির করকমলে তুলে দিতে চাই, সেহেতু এই গ্রন্থটি আমি সম্পাদনা করলেও পর উৎসর্গ ভন্তের মনোস্কামনা অনুযায়ী তাঁর ভ্রাতা ভগিনীর উৎসর্গ দান তুলে ধরলাম। এই গ্রন্থ সম্পাদনা করতে গিয়ে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি থাকতে পারে, পাঠক সমাজের সদয় দৃষ্টি কামনা করছি। গ্রন্থটি মূদ্রণে কর্ণধার ও সহায়কবৃন্দদের ধন্যবাদ জানাই। এবং আন্তর্জাতিক সাধনা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক শ্রী আশিষ বড়ুয়া মহোদয়কে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই আমাকে এই কাজের ভার অর্পণ করার জন্য। অলং ইতি বিত্থারেন।

প্রবারণা পূর্ণিমা
২৫৬৯ বুদ্ধাব্দ
২০২৫ ইং

সুমনপাল ভিক্ষু
অতিথি অধ্যাপক
পালি বিভাগ ও
বৌদ্ধবিদ্যা অধ্যয়ন বিভাগ,
কলিকাতা বিদ্যালয়
পালি বিভাগ,
সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়

No comments:

Post a Comment