Friday, October 3, 2025

প্রসঙ্গ : ড. সুকোমল বড়ুয়া একটি মননশীল অধ্যয়ন

সুমনপাল ভিক্ষু



"আত্মনোহর্থং পরার্থেন বহুনাপি ন হাপয়েত। আত্মনোহর্থমভিজ্ঞায়, সদর্থপ্রসূতো ভবেত্।।১৬৬।।

প্রখ্যাত অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া সম্পর্কিত আলোচনার করার পূর্বে বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম এবং বড়ুয়া জাতির সংক্ষিপ্ত তথ্য প্রদান করা প্রয়োজন, নতুবা সমগ্র বিষয়টি তথ্য প্রদানের অভাবে অঙ্কুরিত হওয়ার পরিবর্তে মৃতবৎ হয়ে পড়বে।

"বুদ্ধোৎপাদঃ সুখঃ প্রোক্তঃ, সুখা সদ্ধর্মদেশনা। সুখা সঙ্ঘস্য সামগ্রী, সমগ্রাণাং তপঃ সুখম্।।১৯৪।।" ধম্মপদ, বুদ্ধবর্গ।

প্রাচীনকাল হতে অবিভক্ত বঙ্গদেশে তথা সমতট অঞ্চলে পালিভাষা ও বৌদ্ধ সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। একথা স্মরণযোগ্য যে, তৎকালীন বঙ্গদেশে পাল, খড়গ, দেব এবং অন্যান্য সমসাময়িক রাজণ্যবর্গ (চন্দ্র বংশ এবং আরাকান) বৌদ্ধ ছিলেন। তাঁদের ঐকান্তিক সহযোগিতায় বৌদ্ধধর্ম বিশ্বব্যাপী প্রসার ও খ্যাতি লাভ করেছিল। বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী পালরাজা ধর্মপাল (৭৬৯-৮০৯ খ্রিঃ)'এর পৃষ্টপোষকতায় সোমপুর, জগদ্দল (রাজশাহী) এবং সমতট অঞ্চলের (বর্তমান চট্টগ্রাম) পণ্ডিত বিহার তথা অন্যান্য বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রাচীন এই সকল শিক্ষায়তনে দেশ-বিদেশের বহু শিক্ষার্থী ও বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত বর্গ অধ্যয়ন অধ্যাপনা করতেন।

পাল শাসনের অন্তিম লগ্নে নালন্দা বৌদ্ধ বিহারের পর সমতট অর্থাৎ চট্টগ্রামের পণ্ডিত বিহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিহারে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে চীন, তিব্বত, সিংহল (বর্তমান শ্রীলংকা), জাভা এবং মালয় হতে অনেক শিক্ষার্থী আসতেন। ডি. কে. বড়ুয়া ও (বিহারস্ ইন অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়া, পৃঃ ১৭৮) এবং গায়ত্রী সেন মজুমদার (বুড্ডিজম্ ইন বেঙ্গলস পৃ: ১২৮) উভয়েই পণ্ডিত বিহার সম্পর্কে একই অভিমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে "এই বিহার চিত্তগঙ্গ'এ অবস্থিত ছিল। সেই সময় ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধ পণ্ডিতদের মধ্যে তীব্র মতভেদ প্রকট হয়ে উঠেছিল। বৌদ্ধ মতের প্রমুখ একপ্রকার সূচাগ্র শিরস্ত্রান মস্তকে ধারণ করতেন। এই শিরস্ত্রান কাপড় (হলুদ বর্ণ) দ্বারা নির্মিত হোত। সম্ভবতঃ বৌদ্ধ পণ্ডিতদের নামানুসারে এই বিহার 'পণ্ডিত বিহার' হয়েছিল। বিহারটির মধ্যস্থলে একটি অতিশয় সুন্দর বৌদ্ধ মন্দির ছিল। এই বিহারটি তন্ত্রযানের এক মহান কেন্দ্র রূপে পরিগমিত হয়েছিল। বঙ্গদেশের সমস্ত ভাগে এই সময় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। মহান তান্ত্রিক বৌদ্ধ পণ্ডিত তিলি-পা বা তিলো-পা অথবা তিলপাদ (আচার্য প্রজ্ঞাভদ্র) যিনি নাদপাদ'এর শিষ্য তথা অতীশ দীপঙ্কর'এর গুরু ছিলেন, এই বিহারে নিবাস করতেন।"

বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল (সমতট) তৎকালীন 'চিত্তগঙ্গ' জনপদ। এই অঞ্চল তৎকালীন সময়ে বৌদ্ধ রাজবংশের শাসনাধীন ছিল। বাংলার এই অঞ্চলাটি মুসলিম বিজয়ের পূর্বে প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়েছিল। আর. সি. মজুমদার প্রণীত 'হিস্ট্রি অফ্ বেঙ্গল' গ্রন্থে (প্রথম ভাগ, পৃ: ৯৮) সমতট অঞ্চল কোন কোন রাজবংশের নিয়ন্ত্রণে ছিল তার সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়।

নথিভুক্ত রাজবংশ

৩'য় শতাব্দী খ্রিষ্টপূর্ব ১ম শতাব্দী খ্রিষ্টপূর্ব : মৌর্য সাম্রাজ্য।
৩'য় শতাব্দী ৬ষ্ঠ শতাব্দী : চন্দ্র রাজবংশ।
৬ষ্ঠ শতাব্দী ৭ম শতাব্দী : গৌ রাজ্য।
৭ম শতাব্দী ৮ম শতাব্দী : খড়গ রাজবংশ।
৮ম শতাব্দী ৯ম শতাব্দী : প্রথম দেব রাজবংশ।
৯ম শতাব্দী ১০ম শতাব্দী : চন্দ্র রাজবংশ।
১০ম শতাব্দী ১১ম শতাব্দী : বর্মন রাজবংশ।
১১ম শতাব্দী ১২ম শতাব্দী : সেন রাজবংশ।
১২ম শতাব্দী ১৩ম শতাব্দী : দ্বিতীয় দেব রাজবংশ।


মৌর্য শাসনের পতনের পর সমতট অঞ্চলটি একটি স্বতন্ত্র বৌদ্ধ পরিচয় অর্জন করে। তবে চট্টগ্রাম এবং সমতটের প্রথম উল্লেখ সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভের শিলালিপিতে পাওয়া যায় যেখানে এই অংশটিকে একটি উপরাজ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে (বি. পি. সিন্‌হা, ডাইনেষ্টিক হিস্ট্রি অফ্ মগধ, পৃঃ ১৭১)। সপ্তম শতাব্দীতে হুয়েন স্বাং (শুয়ান জাং)'এর মতো অনেক চীনা পর্যটকরা সমতটের বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করেছেন।

শিলালিপি, বিদেশী পর্যটক'দের ভ্রমণবৃত্তান্ত এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে সমতট জনপদে ট্রান্স মেঘলা অঞ্চলগুলি সম্পৃক্ত ছিল। শুয়ান জাং'এর বিবরণে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলা এবং উত্তর আরাকান (বর্তমান রাখাইন রাজ্য, মায়ানমার) অঞ্চলের বৌদ্ধ জনপদ, বিহার, সমুদ্র পথ এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুর সংখ্যা ইত্যাদির স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। তিনি এই অঞ্চলটির নাম লিখেছিলেন 'সান-মো-তা-চা' (সমতট)।

বিভিন্ন তন্ত্র এবং পুরান গ্রন্থে সমতট অঞ্চলের জলবায়ু এবং কৃষিকাজের বিবরণ পাওয়া যায়।

"ব্রীহিঃ স্তম্বকারিঃ প্রভূত পয়সঃ প্রত্যাগতা ধেনবঃ প্রত্যুজ্জীবিত ভিক্ষুনা ভূশামিতি ধ্যায়ন্নপেতান্যধীঃ। সান্দ্রোশীর কুটুম্বিনী.... ব্যালুপ্তঘর্মক্ল দেবে নীরমুদারমুজঝতি সুখং শেভে নিশাং গ্রামনীঃ।" সদুক্তিকর্ণামৃত, ২/৮৪/৩।

চট্টগ্রামের তান্ত্রিক এবং পৌরাণিক নাম 'চট্টল'। এছাড়া নানাবিধ পর্যটকগণের ভ্রমণ বৃত্তান্তে শাৎ-গঙ্গ, চিৎ-তৌৎ-গৌং, চাটিগ্রাম, চাঁতকাও/চাটগাও, চাটিকিয়ং, চাটিগান এবং জেটিগা ইত্যাদি নামের উল্লেখ রয়েছে।

"বিন্ধ্যপর্বত নারভ্য বিন্ধ্যাচলাবধি প্রিয়ে,
অশ্ববাক্রান্তেতি বিখ্যাত... দুর্লভং,
বিন্দু পর্বত মারভ্য যাবৎ চট্টল বাসিনী।" চণ্ডিকাখণ্ড, পৃঃ ৪১। 
"চট্টলে দক্ষ বাহুর্যে ভৈরবচন্দ্র শেখরঃ,
চূড়ামণি তন্ত্র, পৃঃ ১১। ব্যক্ত রূপা ভগবতী ভবানীচন্দ্র দেবতা।"

চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাংলাদেশর সিংহভাগ বৌদ্ধ মতাবলম্বীর বসবাস। তাদের মধ্যে 'মগ' বড়ুয়া বা 'বড়ুয়া মগ' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। ভূপেনদ্রনাথ দত্তের মতে (বাংলার ইতিহাস সামাজিক বিবর্তন, ১৯৭৭) "তারা প্রাচীন বৌদ্ধদের বংশধর বলে পরিচয় দেন। কিন্তু দেশের অন্যান্য লোকেরা তাহাদের 'মগ' বলে অভিহিত করেন। মগদের অপভ্রংশ হচ্ছে 'মগহ'। আজও পাটনা এবং গয়া জেলাকে 'মাগাহা' বলা হয়। সম্ভবত এই শব্দ থেকে 'মগ' শব্দের উৎপত্তি। কিন্তু চট্টগ্রামের বৌদ্ধগণ আরাকনের মগদেরই জ্ঞাতী বলে অনুমিত হয়। চট্টগ্রামে আরাকানদের প্রভুত্বকালে এরা উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন বলে কথিত হয়।"

বাংলাভাষায় বৌদ্ধ সাহিত্য চর্চার ইতিহাস প্রায় ১৫০ বৎসর'এর অধির নয়। আধুনিক বাংলাভাষায় রচিত প্রথম বৌদ্ধ গ্রন্থ 'মঘা খমুজা'। এর পূর্বে বাংলাভাষায় কোনো বৌদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। ডাক্তার রামচন্দ্র বড়ুয়া (১৮৪৭-১৯২২), পণ্ডিত ধর্মরাজ বড়ুয়া (১৮৬০-১৮৯৪), কবি সর্বানন্দ বড়ুয়া (১৮৭০-১৯০৮)। পণ্ডিত নবরাজ বড়ুয়া (১৮৬৬-১৮৯৬) এবং পণ্ডিত অগ্‌গসার মহাস্থবির (১৮৬০-১৯৪৫) প্রমুখ বৌদ্ধ পণ্ডিত বর্গের হাত ধরে ১৯ শতকে বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রচার প্রসার এবং বৌদ্ধদের ইতিহাস অগ্রযাত্রার শুরু হয়। যদিও ভারতীয় উপমহাদেশ সহ বর্হিবিশ্বে বৌদ্ধবিদ্যা, বৌদ্ধশাস্ত্র তথা ইতিহাস রচনার প্রশ্নে অ-বৌদ্ধ পণ্ডিত বর্গের ভূমিকা'কে কোন অংশেই খাটো করে দেখা সম্ভব নয়।

"এই নামে একদিন ধন্য হলো দেশ দেশান্তরে তব জন্মভূমি সেই নাম আবার এ দেশের নগরে প্রান্তরে দান কর তুমি। বোধিদ্রুম তলে তব সে দিনের মহাজাগরণ আবার সার্থক হোক মুক্ত হোক মোহ আবরণ।" রবীন্দ্রনাথ।

বড়ুয়া জাতিসত্ত্বার সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্যনীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯ শতকের দার্শনিক এবং মহাপণ্ডিত তথা 'ভারততত্ত্ববিদ' শ্রদ্ধেয় বোণীমাধব বড়ুয়া (১৮৮৮-১৯৪৮)। তিনি ছিলেন লণ্ডল বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রাপ্ত এশিয়া মহাদেশের সর্বপ্রথম ডি.লিট ডিগ্রি লাভ কারী ব্যক্তি। শ্রদ্ধেয় বেণীমাধব বড়ুয়ার কর্ম এককথায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তিনি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, দর্শন-সংস্কৃতি, ভাস্কার্য-কলা এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রের একজন মহান পণ্ডিত এবং গবেষক ছিলেন। সর্বোপরি তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (১৯২৫-১৯৪৮) পদে আসীন ছিলেন। তিনি শ্রীলংকার বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ কর্তক 'ত্রিপিটকাচার্য' উপাধি লাভ করেছিলেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে উত্তরকালে যে সকল গৃহী বড়ুয়া পণ্ডিত বৌদ্ধ সাহিত্য এবং দর্শনের গুঢ়তত্ত্ব গুলিকে নিজ প্রতিভাবলে বিকশিত করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া। পালিভাষা ও সাহিত্যে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী এই বিদগ্ধ পণ্ডিত তথা অধ্যাপক দেশ বিদেশে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছেন।

এক কথায় যেমন সমুদ্রের বর্ণনা দেওয়া যায় না, ঠিক তেমন ভাবেই ড. সুকোমল বড়ুয়ার কর্মজীবনকে ও বর্ণনা করা সম্ভব নয়। 

কোটি কোটে তরঙ্গের প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র-উচ্ছ্বাসে, ভঙ্গিমায়, জলভারে, বণে। অথচ ব্যষ্টির স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও কোটি তরঙ্গের সমষ্টিতে আবার সমুদ্রের একটি মহান সমগ্র রূপ ও প্রকাশমান। অধ্যাপক বড়ুয়ার শিক্ষা চেতনা তাঁর বহুস্তরী, বহুপ্রসারী গভীরতল সমগ্র জীবন শিল্পের একটি মাত্র অভিব্যক্তি, আবার তাঁর বৌদ্ধ সাহিত্যের গবেষণায় সে অগণিত বৈচিত্র্য আর অনন্ত সমৃদ্ধি যার তুলনা একমাত্র সমুদ্রেই সম্ভব। তাঁর এই কর্ম প্রতিভার সম্যক ব্যাখ্যা করবে কে? সমালোচক যতই সাবধানী যতই কুশলী হোক না কেন, তাঁর এই সাগরোপম বিশাল কর্মপ্রতিভার কোনো-না-কোনো অংশ তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে যেতে পারে। তবুও সমুদ্রের অংশ থেকেও, সমুদ্রের ধারণা লাভ করা অসাধ্য নয়, তুলনীয় সূত্রেই ড. সুকোমল বড়ুয়ার কর্মচেতনার কোনো কোনো বিশেষ দিক চিন্তনের ফলে তাঁর সম্পূর্ণ প্রতিভা, তথা জীবনশিল্পের, ধারণা সংগ্রহ করা অসম্ভব নয়, যদি সদিচ্ছা থাকে।

'শুনিতেছি ধ্বনি তব, ভাবিতেছি, বুঝা যায় যেন কিছু কিছু মর্ম তার।'

ড. সুকোমল বড়ুয়া'র কর্মচিন্তনের ধ্বনি মর্ম, যাকে মূল অর্থে বলা যেতে পারে 'বৌদ্ধিক চিন্তন সৃষ্টির ধ্বনি মন্ত্র'। সে ধ্বনি মন্ত্রের কিছু ভাষায় হয়তো পাওয়া যায় তাঁর বাক্ প্রতিমায়, বাচনিক ইমেজগুলিতে। তাঁর লেখন কৌশল অনুপম রূপে তাঁর সাহিত্য সত্ত্বার অভওন্তরেই নিহিত আছে। এই অর্থে তিনি হয়ে উঠেছেন এক জন বৌদ্ধ দার্শনিক। তাঁর সাহিত্যে শব্দবোধ উদ্ভাষিত হয়েছে অসামান্য বাক্ প্রতিমার এক অবিশ্লেষ্য রীতিতে।

তাঁর রচনা পাঠকের মনে বারংবার সৃষ্টি করেছে অনুসন্ধিৎসা। শুষ্ক যুক্তি নয়, তর্ক নয়, স্পর্শ করবে হৃদয়কে। স্পর্শ করবে যুক্তিপূর্ণ কথাতেই। হৃদয়ের অভ্যন্তরে জ্বেলে দেবে বৌদ্ধ সংস্কৃতির আলোকবর্তিকা। ঠিক এই জায়গাটিতেই তিনি অসাধারণ এবং সফল। মূল অর্থে বলা যায় বৌদ্ধদর্শনের আপাত-জটিল তত্ত্বগুলো রসময় প্রকাশ ঘটেছে ড. সুকোমল বড়ুয়ার কলমে।

মানুষের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সুকঠিন কাজটা কিছু বড় দার্শনিক এবং তাদের অনুমানকারীরাই করতে পারেন। তাদের সৃজনশীল মানবতবাদী কর্ম পরিবর্তন করে দিতে পারে মানুষকে। এই তত্ত্ব অনুসারে বলা যায় যে ড. সুকোমল বড়ুয়া অতি সাধারণ ভাবে মানুষের মনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেন, কোনো বড় কথা না বলে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'সহজ কথা যায় না লেখা সহজে কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে।' এই জায়গায় অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়ার অসাধারণত্ব প্রস্ফুটিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে আমি মনে করি ড. সুকোমল বাবু বৌদ্ধ সাহিত্য এবং দর্শনের অভ্যন্তরে যা দেখতে পেয়েছেন, আমি তাঁর নাগাল পাইনি।

প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন, প্রকৃত শিল্প, প্রকৃত সাহিত্য হল জীবনের সত্যকে রস সিঞ্চিত করে প্রকাশ করার প্রয়াস। অর্থাৎ এক কথায়, জীবনেরই প্রকাশ। কিন্তু প্রকাশটা স্থূল নয়, রসময়। অর্থাৎ রসের আকাশে প্রকাশ, রসের মধ্য দিয়ে প্রকাশ। কাজটা খুব শক্ত। তবুও বলব ড. সুকোমল বড়ুয়া বৌদ্ধ সাধনার মহত্বকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, হতাশাগ্রস্ত মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন জীবন দীপের মতো। কারণ তিনি মনে করেছেন বৌদ্ধ দর্শনের হুবহু প্রতিফলন নয়, তার বিমূর্ত রসময় প্রকাশ প্রয়োজন, নতুবা মানুষের চিন্তা চেতনার স্তর উন্নীত হবে কীভাবে?

ড. বড়ুয়া ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার অন্তর্গত ঢেমশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাতা উভয়েই ছিলেন ধর্মপরায়ন এবং শিক্ষানুরাগী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক তথা দেশে বিদেশে 'বৌদ্ধতত্ত্ববিদ ও প্রাচ্যবিদ' হিসেবে সুপরিচিত। ১৯৮৫ সালে তিনি সংস্কৃত ও পালি বিভাগে লেকচারার এবং ২০০৯ সালে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত প্রফেসর পদর্যাদা লাভ করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হতে 'এ স্টাডি অফ মাইন্ড ইন আর্লি বুড্ডিষ্ট টেক্সট'এর উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সংস্কৃত এবং পালি যৌথ বিভাগের চেয়ারম্যান ও পরবর্তীতে নব বিভাজিত পালি অ্যান্ড বুড্ডিষ্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ানম্যান ছিলেন।

আমি যখন এম. এ. পড়ার পূর্বে ভারত সরকারের আই.সি.সি.আর স্কলারশিপ স্কিম এপ্লাই করেছিলাম তখন ইংলিশ প্রপিয়েন্সি সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, ২০০১ সালেই বৃত্তি পেয়েছিলাম। তাঁর কাছে আমি অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা জানাই। ২০২৩ আমি যখন অসুস্থ হয়েছিলাম তিনি আমাকে দেখতে এসেছেন, তাঁর স্নেহ, শ্রদ্ধায় আমি আপ্লুত।

তিনি সর্বোচ্চ গবেষণাকর্মের জন্য ২০০৬ সালে 'ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্বর্ণপদকে' এবং শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য 'জাতীয় ২১শে পদক' লাভ করেছেন। অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়ার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১৫, সম্পাদিত ৬, দেশে-বিদেশের জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ নিবন্ধের সংখ্যা ৩৫। এছাড়া বিভিন্ন সাময়িকীতে ১২৫ এবং জাতীয় দৈনিকে ১১০ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি সুপারনিউম্যারারি অধ্যাপক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। তিনি পালি ত্রিপিটক এবং তার অট্ঠকথা সমূহ বঙ্গাক্ষরে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই ভূমিকা বৌদ্ধ জাতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গর্বের বিষয় বলেই প্রতীয়মান হয়। পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের ভাষা বলি - 'নিত্য তোমায় চিত্ত ভরিয়া স্মরণ করি, বিশ্ববিহীন বিজনে বসিয়া বরণ করি।' 


No comments:

Post a Comment