Friday, October 3, 2025

ভূমিকা

পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির- জীবন সাহিত্য সাধনা ও মূল্যায়ন

সুমনপাল ভিক্ষু

অতিথি অধ্যাপক

পালি বিভাগ ও বৌদ্ধবিদ্যা

অধ্যায়ন বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও পালি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

 

"যূযং বৈ স্বোপদেষ্টারমাচার্যং মার্গদর্শকম্।

প্রাতিমোক্ষং হি মন্যধেব পরং পারং গতে ময়ি।।

তদধীনং বর্তিতব্যথাচর্যং চ তদজ্ঞয়া।

গতেঽপি ময়ি কর্ত্তব্য: স্বাধ্যায়স্তস্য সর্বথা।।২৬।।" 

বুদ্ধচরিতম্, যডুবিংশঃ সর্গঃ।

 

"আমার মহাপরিনির্বাণের পর তোমাদের প্রাতিমোক্ষ-কে'ই (ভিক্ষু-জীবনের নিময়) নিজেদের আচার্য, নিজেদের প্রদীপ এবং নিজেদের দোষ উপলব্ধি করা উচিত। এই তোমাদের উপদেশক, যার অধীনে তোমরা অবস্থান করবে। তোমাদর বিষয়টিকে ঠিক সেইভাবে আবৃত্তি করা উঠিত যেমন আমার উপস্থিতিতে, জীবনে, সম্পাদন করতে।"

ভগবান বুদ্ধ অনুত্তর শান্তিপদের সন্ধানে গৃহত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর সন্ধান তখন সম্পূর্ণ হয়েছিল যখন তিনি সম্বোধিতে গম্ভীর শান্ত, উত্তম ও অতর্কাবার ধর্ম লাভ করেছিলেন। এই ধর্মকে দ্বিবিধ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে প্রতীত্যসমুৎপাদ এবং নির্বাণ। প্রতীত্যসমুৎপাদ, ইদম্প্রত্যয়তা অথবা মধ্যমা প্রতিপদ অনিত্য সংস্কারের প্রবাহরূপ সংসারকে পরতন্ত্র এবং সাক্ষেপ সূচিত করে তথা পরমার্থকে অন্ত বিবর্জিত এবং অনিবার্চনীয়। নির্বাণ অর্থাৎ 'নির্বাপিত হলে' সংসারের বিরোধ ও সত্যের প্রাপ্তি সূচিত হয়। প্রতীত্যসমুৎপাদ 'ধর্ম'কে নিয়ম এবং সীমারূপে সংকেতিত করে, নির্বাণ বিমুক্তি ও ভূমা রূপে। প্রতীত্যসমুৎপাদে সংসার'এর গভীরতম 'লক্ষণ' (এবং পরমার্থের অলক্ষণতা) প্রকাশিত হয়, নির্বাণে আধ্যাত্মিক জীবনের লক্ষ্য।

প্রাচীন বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম ভগবান বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই প্রসার লাভ করে ছিল এবং বুদ্ধ স্বয়ং বঙ্গদেশে পরিভ্রমণ করেছিলেন। 'অঙ্গুত্তর নিকায়'এ ব্যাখ্যাত হয়েছে "বঙ্গান্তপুত্র" নামক এক যুবক বুদ্ধের নিকট হতে ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায়, এই বঙ্গান্তপুত্র বঙ্গদেশ হতে ভগবান বুদ্ধের নিকট এসেছিলেন। 'থেরগাথা' ও 'অপাদান'এ "বঙ্গীয়" নামে সুপ্রসিদ্ধ এক বাঙালী ভিক্ষু ও স্বনামধন্য কবির পরিচয় মেলে, যিনি বিদ্যালাভের জন্য রাজগৃহে বসবাসকালে স্থবির সারিপুত্রের সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ পান, এবং অতঃপর বুদ্ধের সান্নিধ্য লাভ করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। 'ভেলপত্ত জাতক' এবং 'ধম্মপদ অট্ঠকথা'য় ব্যাখ্যাত হয়েছে ভগবান বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশাতেই 'সমূহ' (?) রাজ্যের 'সাতক' নগরে পরিভ্রমণ করেছিলেন, এই সমূহ রাজ্য ছিল প্রাচীন বঙ্গের অন্তর্গত। এই প্ররিভ্রমণের কথা ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সুম্প্রসিদ্ধ তিব্বতী লেখক 'সুমপা' কর্তৃক লিখিত 'পাগ-সাম্-জোঙ-জ্যাং' গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে, যা ধর্মপদ অট্ঠকথা'র বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

অনাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠীর এক কন্যা 'চুলসুভদ্রার' সঙ্গে পুণ্ড্রবর্ধণের এক বিত্তবান পরিবারের যুবকের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। এই পুণ্ড্রবর্ধন বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর সংলগ্ন অঞ্চল। শ্রেষ্ঠী কন্যার প্রচেষ্টায় অবৌদ্ধ স্বামী এবং তাঁর পরিবারের সকলেই বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। কথিত আছে এই চুলসুভদ্রা'র আমন্ত্রণে ভগবান বুদ্ধ পুণ্ড্রবর্ধনে পদার্পণ করেন এবং আতিথ্য গ্রহণ করেন। এই প্রসঙ্গে বুদ্ধ একটি পালি গাথায় বর্ণনা করেছিলেন:

"দূরে সন্তো পকাসেন্তি হিমবস্তো'ব পব্বতো।

অসন্তে'ত্থ ন দিস্সন্তি রত্তি খিতা যথা সরা।।"

অর্থাৎ, শীলবান সৎ ব্যক্তি হিমালয় পর্বত সদৃশ্য অতিদূর থেকে প্রকাশিত হন, তবে অসৎ ব্যক্তি রাত্রিকালীন নিক্ষিপ্ত শর তুল্য দৃশ্যপটে উপলব্ধি হন না।

এছাড়াও, ভগবান বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশাতেই যে বাংলায় এসেছিলেন তা চৈনিক পরিব্রাজক 'শুয়াং জাঙ্'এর বর্ণনাতেও সুস্পষ্ট হয়। তাঁর বর্ণনায় ব্যক্ত হয়েছে বুদ্ধ পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট (কুমিল্লা) ইত্যাদি স্থানে সপ্ত দিবসকাল ধর্মোপদেশ দান করেছিলেন। এবং সেই স্থান হতে কর্ণসুবর্ণ হয়ে মগধ (বিহার)'এ এসেছিলেন।

দশম হতে একাদশ শতাব্দীর সময়কালে বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান আচার্য ছিলেন বঙ্গীয় কৃতি সন্তান এবং তৎকালীন উজ্জ্বল জ্যোতিস্কসদৃশ সুপণ্ডিত ও দার্শনিক 'অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান'। তিব্বতের রাজার আমন্ত্রণে তিনি দুর্গম হিমালয় পর্বত অতিক্রম করে সে দেশে উপস্থিত হল এবং সেখানে বৌদ্ধধর্ম স্থাপন করেছিলেন। তাঁর এই অনন্য ও অসাধারণ কৃতিত্বের কথা কবি সতেন্দ্রনাথ দত্তের লেখনীতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে:

"বাঙালী অতীশ লঙ্ঘিন গিরি তুষারে ভয়ঙ্কর।

জ্বালিল জ্ঞানের দ্বীপ তিব্বতে বাঙালী দীপঙ্কর।।"

তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের নবজাগরণ কালে অতীশ দীপঙ্কর ১৭৫'টির অধিক বৌদ্ধ দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিব্বতী এবং চৈনিক বৌদ্ধদের নিকট অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এখনও দ্বিতীয় বুদ্ধরূপে পূজিত হয়ে থাকেন।

ভারত ভূমিতে অষ্টম শতাব্দীতেই বৌদ্ধধর্মের অবলুপ্তি শুরু হয়েছিল এবং মধ্যযুগে অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতকের শুরুতেই ভারতবর্ষ থেকে এর চিরবিলুপ্তি ঘটতে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ছয় শতক ভারত ভূমি নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ভারতবর্ষের এই সময়কাল বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে অন্ধকার যুগ হিসেবে বিবেচিত। বঙ্গদেশও এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। পঞ্চদশ শতক থেকে বৌদ্ধধর্ম বঙ্গদেশ হতে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হতে শুরু করে। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে অবশিষ্ট ছিল। উনিশশতকের সময়কালে বৌদ্ধধর্মের পূনর্জাগরণ কাল শুরু হয়। বাংলায় বৌদ্ধধর্মের অত্যাধিক বিস্তারের কারণ ছিল ভগবান বুদ্ধের সাম্যবাদী এবং মানব দরদী চিন্তা। তাই বঙ্গ-জননীর সন্তান-সন্ততিরা এই ধর্মকে আপনার করে নিয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই।

মহামতি বুদ্ধের প্রতি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আন্তরিক শ্রদ্ধা, ভক্তি ও অনুরাগের নিদর্শন তাঁর জীবনযাত্রা ও সাহিত্য সৃষ্টিতে সমুজ্জল হয়ে বারংবার।

সকল কলুষতামস হর,

জয় হোক তব জয়।

অমৃতবারি সিঞ্চন কর

নিখিলভুবনময়।

মহাশান্তি, মহাক্ষেম,

মহাপুণ্য, মহাপ্রেম। 

জ্ঞানসূর্য, উদয় ভাতি

ধ্বংস করুক তিথির রাতি,

দুঃসহ দুঃস্বপ্ন ঘাতি

অপগত কর' ভয়।

 

বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণের প্রশ্নে জেমস্ প্রিন্সেস'এর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি যদি কৌতুহলাবিষ্ট হয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল-সহ বহিঃবিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চল (বর্তমান পাকিস্থান এবং আফগানিস্থান) উৎখনন করে প্রাচীন বৌদ্ধ অবশেষ (চৈত্য, স্তূপ, বিহার ইত্যাদি) ও বৌদ্ধ রাজা অশোকের শিলালিপি আবিস্কার না করতেন তা হলে ভারতবর্ষের জনগণ এবং প্রাশ্চ্যাত্য পণ্ডিতগণ জানতেই পারতেন না যে ভারতবর্ষে এককালে বৌদ্ধধর্ম নামে একটি সুপ্রসিদ্ধ ধর্ম বিরাজ করত। উনিশ শতকে শ্রীলংকা হতে আগত বৌদ্ধ পণ্ডিত অনাগারিক ধর্মপাল ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বুদ্ধগয়ায় (বিহার) অবস্থিত মহাবোধি মহাবিহার শৈব সম্প্রদায়'এর হাত থেকে রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কেননা বুদ্ধগয়া বিশ্বের সকল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধানতীর্থস্থল। এইস্থানেই বোধিবৃক্ষতলে ভগবান বুদ্ধ বহুজনের হিতার্থে, সুখার্থে সম্বোধি লাভ করেছিলেন। ললিত বিস্তর'এ বিষয়টি এইভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে:

"ছিন্ন হয়েছে বর্ম, শান্ত রজ,

রুদ্ধ হয়েছে আস্রব শোষিত।

ছিন্ন হয়েছে বর্ম এবং এই

দুঃখের পরিসমাপ্তি হয়েছে অভিহিত।"

 

উত্তরকালে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের নবজাগরণে যে মহান মণীষী গুরুত্বপূর্ণ অবদান পালন করেছিলেন, তিনি হলেন ড. ভীমরাও আম্বেদকর। তাঁর অনুগামীরা বর্তমানে 'নব্যবৌদ্ধ' নামে খ্যাত। যাইহোক, বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল অতিপ্রাচীন কাল হতে বৌদ্ধজাতির আবাসস্থল। চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অভিমত হল, প্রাচীনকালে এই অঞ্চল আরাকান সাম্রাজ্যভুক্ত থাকার কারণে এই অঞ্চলে বহু বৌদ্ধ চৈত্য বিদ্যমান ছিল, ফলে এ স্থানের নাম হয় 'চৈত্যগ্রাম'। চৈত্য যেখানে বুদ্ধের দেহধাতু সংরক্ষিত করে প্রার্থনা করা হয়। পরবর্তীতে এই চৈত্যের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয়ে 'চৈত্যগ্রাম' নামের উৎপত্তি হয়। অতঃকালের বিবর্তনে চৈত্যগ্রাম হয় চট্টগ্রাম।

লামা তারনাথ-এর বিবরণে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৌদ্ধদের বিবরণ পাওয়া যায়। তারনাথের পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে ভ্রমণে আসেন (১৬২৯ এবং ১৬৪৩ খ্রীঃ) এফ.এস. ম্যানরিকিউ। তাঁর লেখায় বৌদ্ধ ধর্ম এবং মগ, পেণ্ড, আভা এবং মারমা জাতির উল্লেখ রয়েছে। সর্বোপরি তিনি 'রাউলি পুরোহিত'দের কথাও ব্যক্ত করেছেন। ঐ সময় কালে চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন আরাকানীরা। পণ্ডিত শ্রীমৎ ধর্মাধার মহাস্থবির প্রণীত 'সদ্ধর্মের পুনরুত্থান' গ্রন্থে এই বিষয় সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য প্রদত্ত হয়েছে। কবি দৌলত কাজীর, সতীময়না কাব্যে তৎকালীন আরাকানী রাজা শ্রী সুধমার পরিচয় এবং নগরের উল্লেখ দৃষ্ট হয়।

"কর্ণফুলী নদী পূর্বে আছে এক পুরী,

রোসাঙ্গ নগর নাম স্বর্গ অবতারী।

তাহাতে মগধ বংশ ধর্মে বুদ্ধাচার,

নাম শ্রীসুধর্মা রাজা ধর্ম অবতার।"

 

সম্ভবতঃ এই রোসাঙ্গ নগর পরবর্তী সময়ের রাঙ্গুনীয়া অঞ্চল (ডেভিড্ উব্লিউ, ম্যান্ড্রোয়েল, ইষ্ট পাকিস্থান ডিস্ট্রিক গেজেট, চিটাগং, ১৯৫৩, পৃঃ ৮১)। তবে সিলেটের তাম্রশাসন হতে এই তথ্য পাওয়া যায় যে রাঙ্গুনীয়া অঞ্চল চন্দ্রবংশীয় রাজাদের শাসনাধীন ছিল। একথা অনস্বীকার্য যে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া অঞ্চল ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ অনুসারে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অতি প্রাচীনকাল হতে এই অঞ্চলে মগ এবং অন্যান্য পাহাড়ী জনগোষ্ঠী বসবাস করত। এই জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই হল বৌদ্ধ মতাবলম্বী। অতীতের ইতিহাস হতে এই তথা পাওয়া যায় যে আরাকান অঞ্চলের মগদের সঙ্গে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের নদীপথে (কর্ণফুলী নদী বাণিজ্যিক কর্ম পরিচালিত হতো। অনেকে মনে করেন 'রান্যা' নাম হতে রাঙ্গুনীয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে। তবে ম্যাকোয়েল সাহেবের তথ্যের ন্যায় এই তথ্যের ও কোনরূপ ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করা হয় নি। কর্ণফুলী নদী ব্যতীত এই অঞ্চলের উপনদী গুলি হল রাইখালী, ডংখাল, শিলক খাল, ইচ্ছামতি এবং চিরিঙ্গা ইত্যাদি। উত্তর রাঙ্গুনীয়ার মহামুণি মন্দির, রাজবাড়ী, রাজনগর, রাজাভুবন এবং রাণীর হাট ঐতিাসিক বৌদ্ধ স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে।

ইতিপূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে সুপ্রাচীনকাল হতে রাঙ্গুনীয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদরূপে পরিগণিত হয়ে এসেছে। এপ্রসঙ্গে ঘনারাম'এর বর্ণনার কিছু উপাদান এইস্থানে প্রদান করা হল:

প্রথমে সেবক ছিল ভোজ মহারাজা।

পরিপাটী পরিপূর্ণ দিল আদ্যপূজা।।

ধূপাদত্ত দ্বিতীয়ে পুজিল সপ্রতুল।

মানিক দীপের মাঝে ধর্মের দেউল।।

 

অনেকের মতে এই ধর্মের দেউল হল 'মহামুণি মন্দির'। রাঙ্গুনীয়া জনপদের অন্তর্গত বর্ধিষ্ণু বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চল হল ঘাটচেক গ্রাম। জনশ্রুতি আছে এই বর্ধিষ্ণু গ্রামটি অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বেই গোড়াপত্তন হয়েছিল। এই গ্রামই ছিল একসময় কালের রাঙ্গুনীয়ার শষ্য ভাণ্ডার। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই গ্রামের পুণ্যপুরুষ সংঘমণীষা হরিচরণ মহাস্থবির (হরিচরণ মাথে) আকিয়াব (আরাকান) অঞ্চল হতে বৌদ্ধ ধর্ম বিনয় শিক্ষায় শিক্ষালাভ পূর্বক স্বগ্রামে (ঘাটচেক) প্রত্যাবর্তন করে রাঙ্গুনীয়া অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তিনি নিজগ্রামের ঘাটচেক ধর্মামৃত বিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই অর্থে হরিচরণ মহাস্থবির রাঙ্গুনীয়ার বৌদ্ধধর্মের সংস্কারক এবং একটি আলোকবর্তিকা স্বরূপ। ইতিহাসের সমুজ্জ্বল ধারায় বহমান এই গ্রামের অন্যান্য সংঘ মণীষাগণ বৌদ্ধধর্মের সোপানকে অত্যন্ত উচ্চ শিখরে উন্নীত করেছেন। তাঁদের মধ্যে মহাপণ্ডিত উপসং রাজ সুগতবংশ মহাস্থবির (১৯১২-১৯৯৮ খ্রীঃ) একজন অন্যতম সাংঘিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর ব্রহ্মচর্য জীবন এবং সাহিত্য কর্মের মহিমা উত্তর প্রজন্মের চেতনাকে আরও অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করবে।

১ সেপ্টেম্বর, ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে মহাপণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির রাঙ্গুনীয়ার বৌদ্ধ জনবহুল ঘাটচেক গ্রামের এক মধ্যবিত্ত বৌদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গৃহীনাম ফণীভূষণ বড়ুয়া। তিনি শৈশবকাল হতে ধর্মীয় অবধারায় পুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন এবং এই কারণেই তাঁর অন্তরে নিহীত ছিল মহাতাপস হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় বীজ।

'জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ,

আমি তো জীবন্তপ্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ;

মাটিতে লালিত ভীরু, শুধু আজ আকাশের ডাকে

যদিও নগন্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে

মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে। 

বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোর আনাগোনা

তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে,

শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা।'

 

শিশু ফণীভূষণ তাঁর জন্মের এক বৎসর পর মাতৃহারা (মহামায়া বন্ধুয়া) হন। সেই সন্ধিক্ষণে তাঁর সকল দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন জ্যেষ্ঠ মাতা সুকৃতিবালা বড়ুয়া। এর ক্ষণকাল পরেই বালক ফণীভূষণের পিতৃদেবও পৃথিবীর মায়া পরিত্যাগ করে চিরবিদায় নিলেন। এই হৃদয়বিদারক দুঃখ তাঁর জীবনে এনেছিল এক বিমূর্তভাব। কেননা জন্ম, জরা এবং মৃত্যু তিনি রাজকুমার সিদ্ধার্থের ন্যায় শিশুকালেই উপলব্ধি করেছিলেন।

শিক্ষা (মানবিক এবং আধ্যাত্মিক) মানব জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। কেনা একটি জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের মূল সোপান হল শিক্ষা। সুতরাং এই অর্থে শিক্ষা ব্যতীত মানব জীবন নিরর্থক হয়।

যাবদেব অনত্থায়, অত্তং বালস্স জায়তি।

হস্তি বালস্স সুক্কংসং, মুদ্দমস্স বিপাতয়ং।।৭২।।

মূর্খ মানুষ যতই জ্ঞানার্জন করুক না কেন, এই সকল তার অনর্থ কর্মেই সম্পাদিত হয়। এই জ্ঞান তার মস্তককে ছিন্ন ভিন্ন করে তার শুদ্ধ (শুক্ল) অংশকে সমূলে উচ্ছেদ করে দেয় (বালবগ্গো পঞ্চমো, ধম্মপদ)।

এক সময় প্রজ্ঞারত্ন মহাস্থবির'এর স্নেহধন্য বালক ফণীভূষণ ঘাটচেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (১৮৭৫ খ্রীঃ প্রতিষ্ঠিত) পঠন-পাঠন শুরু করেন। এই বিদ্যালয়ে তিনি ৫ বৎসর (১৯২০-১৯২৫ খ্রীঃ) পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দ, তাঁর জীবনে এক শুধু মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হল। এই সময় তিনি পুণ্যপুরুষ ভদন্ত প্রজ্ঞারত্ন মহাস্থবির'এর নিকট হতে ত্রিসরণ সহ ১০ প্রব্রজ্যা শীল গ্রহণ করলেন। ভগবান বুদ্ধের বিনয় মতানুসারে নব প্রব্রজ্যিত ফণিভূষণ হলেন "শ্রমণ সুগতবংশ"।

উপয্যঞ্জন্তি সতীমন্তো, ন নিকেতে রমন্তি তে।

হংসা বা পল্ললং হিত্বা, ওকমোকং জহন্তি তে।।৯১।।

সাধকজন স্মৃতিমান পূর্বক নিজ সাধনাতে মগ্ন থাকেন, সে গার্হস্থ্য জীবনে কোনরূপ আসক্তি ধারণ করেন না। যেমন স্বচ্ছ জলাশয়ে সন্তরিত রাজহংস মলিন জলাশয়কে পরিত্যাগ করে, ঠিক সেইভাবে সাধক সাধারণ গৃহস্থ পরিবারের সঙ্গে কোন আসক্তি পোষণ করেন না (অরহন্তো বগ্গো, সত্তমো, ধম্মপদ)।

তাঁর শিক্ষাজীবন সম্পর্কে পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির বলেছেন, "অসীম মেধাশক্তির অধিবাসী সুগতবংশ শৈশবেই প্রব্রজ্যাধর্মে দীক্ষিত হয় ভদন্ত প্রজ্ঞারত্ব মহাস্থবিরের নিকট স্বীয় জন্মভূমি রাঙ্গুনীয়ার ঘাটচেক গ্রামে। কিন্তু শিশিক্ষু ও মুমুক্ষু সুগতবংশ ত্রিপিটকশাস্ত্র অধ্যয়ন ও জ্ঞানাহরণের অতৃপ্ত আকাঙ্খা পরিতপ্তির সন্ধানে একস্থানে আবদ্ধ থাকে নি। যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেইখানে ছুটে গিয়েছিলেন। এই ছিল সুগতবংশের অত্যতম গুণ। সেই গুণ খুব সীমিত জনের হয়।"

সীলদস্সসম্পন্নং, ধম্মটঠং সচ্চবেদিনং।

অত্তনো কম্ম কুব্বানং, তং জনো কুরুতে পিয়ং।।২১৭।।

 

যে ভিক্ষু শীল তথা জ্ঞান (দর্শন) সম্পন্ন হন, যিনি ধর্মিষ্ঠ, সত্যবাদী হন, যিনি নিজের উত্তরাদায়িত্ব (তিন শিক্ষা) কে পূর্ণ করেছেন, বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিজন এইরূপ পুরুষকে 'প্রিয়' রূপে ধারণ করেন (পিয়বগ্গো, সোলসমো, ধম্মপদ)।

শ্রমন সুগতবংশের ক্ষেত্রে ধম্মপদের এই গাথাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল। কেননা অচিরেই তাঁর প্রজ্ঞাদীপ্তি সূর্যলোকের ন্যায় চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় মহামুণি পাহাড়তলী গ্রামের অন্যতম পীঠস্থান সংঘরাজ মহানন্দ বিহার ছিল (পূর্ববঙ্গের) থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের ভরকেন্দ্র। ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে মহাপণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবিরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সংঘরাজ মহানন্দ বিহারে 'মহামুণি' পালি কলেজ স্থাপিত হয়। তখন শ্রমন সুগতবংশ সেই কলেজে ছাত্র হিসেবে যোগদান করে যথেষ্ট মেধার পরিচয় প্রদান করেছিলেন। ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ভগবান বুদ্ধের বিনয় মতে উপসম্পদা লাভ করে ভিক্ষু সুগতবংশ নামে পরিচিত হন। ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির ছিলেন ভদন্ত হরিচরণ মহাস্থবিরের সার্থক উত্তরসূরী।

অপ্পমত্তো অয়ং গন্ধো, স্বয়ং তগরচন্দনং।

যো চ সীলবতং গন্ধো, বাতি দেবেসু উত্তমো।।৫৬।।

 

টগর এবং চন্দন ইত্যাদির গন্ধ তো সামন্য'ই হয়, কিন্তু সচ্চরিত্র (শীলবান) পুরুষের শীলের গন্ধ দেবগণ (এর বাসস্থান) পর্যত উন্নীত হয় (পুপ্ফবগ্গো চতুত্থো, ধম্মপদ)।

পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির ছিলেন কর্মযোগী সাধক এবং ত্রিপিটক শাস্ত্র বিশারদ। ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে এশিয়ার সর্বপ্রথম ডি.লিট. ডিগ্রী ভ্রান্ত অধ্যাপক ড. বেণীমাধব বন্ধুয়া এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত বিনয়াচার্য ভদন্ত বংশদীপ মহাস্থবিরকে অধ্যক্ষ করে প্রতিষ্ঠিত হয় 'নালন্দা বিদ্যাভবন'। এই 'ত্রিপিটক' বৌদ্ধ সাহিত্যচর্চা কেন্দ্রে ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির শিক্ষকতা করতেন। তাঁর এই মহানুভবতা বৌদ্ধ জাতির নিকট অত্যন্ত গর্বের বিষয়।

মহাপণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির ছিলেন দৃষ্টান্ত স্বরূপ ব্যক্তিত্ব। তিনি বুদ্ধ শাসন এবং সদ্ধর্মের উন্নতি বিধানে নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন যেমন-

ক) ভগবান বুদ্ধের প্রধান দুই শিষ্যের (ধর্মসেনাপতি সারিপুত্র এবং ঋদ্ধিশ্রেষ্ঠ মহামোগ্গয়ায়ন স্থবির) পবিত্র দেহধাতু উৎসবে ভারতে যোগদান, ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দ।

খ) ভগবান বুদ্ধের ২৫০০ তম জন্ম জয়ন্তীতে ভারত যাত্রা, ১৯৫৬ খ্রীষ্টাব্দ।

গ) বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) আয়োজিত ষষ্ঠ মহাসঙ্গীতিতে অংশ গ্রহণ, ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দ।

ঘ)বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) পটঠান অধ্যয়ন, ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দ।

ঙ) বিদর্শন ভাবনা প্রশিক্ষা গ্রহণ।

চ) বিদর্শন ভাবনার জন্য ভারতের ঈগতপুরী যাত্রা।

ছ) বিদর্শন ভাবনা প্রশিক্ষণ।

জ) তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার ধম্ম মহা সম্মেলনে যোগদান করেন।

বৌদ্ধ প্রধান দেশ মায়ানমার এ সুদীর্ঘ ছয় বৎসর মহাসঙ্গায়নে যোগদান সহ ত্রিপিটক শাস্ত্রচর্চা এবং বিদর্শন ভাবনা ইত্যাদির অনুশীলনের কারণে তাঁর জ্ঞানসাধনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকটাই সম্পূর্ণতা লাভ করেছিল।

যোগা বে জয়তী ভূরি, অযোগা ভূরিসঙ্খয়ো।

এতং দ্বেধাপন্থ ঞাত্বা, ভবায় বিভবায় চ।

তথাত্তানং নিবেসেয্য, যথা ভূরি পবভ্ঢতি।।২৮২।।

সাধনার প্রভাবেই জ্ঞান উৎপন্ন হয়। সাধনা না করলে জ্ঞানের ক্ষয় হয় (ধম্মপদ)।

তিনি সকল সময় বলতেন 'প্রকৃত ব্রহ্মচর্য তথা শ্রমন ও ভিক্ষুত্ব'র অর্থই হল ধ্যানময় জীবন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রত পালনের বিষয়টি হল ধ্যানের অঙ্গ। ভগবান বুদ্ধের লোকোত্তর জ্ঞান অধিগত করতে হলে ধ্যানের গভীরে নিমজ্জিত হতে হবে নতুবা বুদ্ধের লোকোত্তর জ্ঞান অর্জিত হবে না।

মহামহোপাধ্যায় তথা ধর্মদীপ'এর অধিকারী ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির প্রকৃত অর্থে একজন মহাজ্ঞানী ছিলেন। তিনি ত্রিপিটক শাস্ত্রে প্রগাঢ় বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। বাংলা, পালি, সংস্কৃত, হিন্দি এবং বর্মী ভাষায় তাঁর জ্ঞান ছিল যথেষ্ট। তিনি নব্য বিদ্যার্থীগণের অভিজ্ঞতার প্রশ্নে বহু দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন শাস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন। যদিও তিনি সেই অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না কিন্তু তিনি তাঁর অদম্য প্রচেষ্ঠা এবং জ্ঞান পিপসার কারণে হয়ে উঠেছিলেন জ্ঞানতাপস। তাঁর অসমান্য মেধাশক্তি, নিষ্ঠা এবং সততা বৌদ্ধজাতির অনুপ্রেরণার পথে সহায়ক হয়েছিল। তিনি সকল সময় তাঁর আচার্যগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির উপলব্ধি করেছিলেন যে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) বৌদ্ধ জাতি যদি তথাকথিত লোকাচার এবং বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা আর্চনা হতে মুক্ত না হয় তাহলে স্বজাতি, স্ব-জ্ঞাতি'র বিপদ অনিবার্য। এই কারণেই তিনি তাঁর কল্যাণমিত্র ভদন্ত হরিচরণ মহাস্থবিরের যোগ্য উত্তরসুরী রূপে সদ্ধর্মের চেতনা স্থাপন এবং কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনের কার্যে ব্রতী হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর কর্ম প্রচেষ্টা অত্যন প্রশংসার দাবী রাখে। বুদ্ধসেবক পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির ছিলেন প্রকৃত অর্থে সমাজ সংস্কারক।

নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাকে কোনও অর্থেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তিনি অনেক অসহায় নারীকে নানাবিধ সহযোগিতার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। এটাও একপ্রকার কল্যাণমিত্রের লক্ষণ।

পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির নারী জাগরণের পাশাপাশি বৌদ্ধ যুব সমাজের অগ্রগতির প্রশ্নে সদাজাগ্রত ছিলেন। তিনি মনে করতেন যুব সমাজকে আধুনিক শিক্ষা, ধর্মীয় চেতনা এবং ব্যবসা বাণিজ্যের কাজে অবশ্যই পারঙ্গম হতে হবে। মান মর্যাদা, শ্রদ্ধা-সম্মান, পরিচিতি লাভের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা প্রয়োজন, নতুবা সমাজে গ্রহণযোগতার বিষয়টি মূল্যহীন হয়ে যায়।

যথা সঙ্কারধানস্মিং, উজ্জিতস্মি মহাপথে।

পদুমং তথ জায়েথ, সুচিগন্ধং মনোরমং।।৫৮।।

এবং সঙ্কারভূতেসু, অন্ধভূতে পুথুজ্জনে।

অতিরোচেতি পঞ্ঞায়, সম্মাসম্বুদ্ধসাবকো।।৫৯।।

যেমন মলিনতা পূর্ণ রাজমার্গে পতিত হয়েও শুদ্ধ গন্ধযুক্ত মনোহর পদ্মপুষ্প প্রস্ফুটিত হয়, ঠিক সেইভাবে মলিনতার ন্যায় অবিদ্যারূপী মনুষ্যগণের মধ্যে ও ভগবান বুদ্ধের সম্যক জ্ঞান প্রাপ্ত শিষ্য স্বকীয় প্রজ্ঞা দ্বারা সর্বত্র প্রকাশিত হয় (ধম্মপদ)। ধম্মপদের এই গাথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা বাস্তবিক অর্থে ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির ছিলেন ভগবান বুদ্ধের সম্যক জ্ঞান প্রাপ্ত শিষ্য।

ঘাটচেক ধর্মামৃত বিহার (রাঙ্গুনীয়া) পুনঃনির্মাণ এবং আত্মযোগী কর্মসাধক শ্রীমং হরি মহাথের কর্তৃক আরাকান অঞ্চল হতে আনীত বুদ্ধ মূর্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুগতবংশ মহাস্থবিরের ভূমিকাকে কোন অংশেই খাটো করে দেখা সম্ভব নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীকে এই সুপ্রসিদ্ধ বিহারটি নির্মিত হলেও (হরি মহাথের প্রতিষ্ঠিত) ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ভয়ংকর বন্যা এবং ১৯৭৫ খ্রীষ্টাব্দে ইছামতী নদীর করাল গ্রাসে ধর্মামৃত বিহারটি বিলীন হয়ে গেলে সদ্ধর্মপ্রাণ সুগতবংশ মহাস্থবির'এর ঐকান্তিক প্রেরণা এবং প্রকৌশলী নিরোদ বরণ বড়ুয়া ও ড. জিনবোধি ভিক্ষুর পরিকল্পনায় এবং গ্রামবাসীদের আর্থিক সহায়তায় ১৯৮৮ খ্রীষ্টাব্দে বিহারটি নতুন আঙ্গিকে নির্মিত হয়েছিল। এই মহান কর্মযজ্ঞের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন শ্রীমৎ শীলালংকার মহাথেরো এবং বৌদ্ধ দার্শনিক অধ্যাপক শ্রীমৎ ধর্মাধার মহাস্থবির প্রমুখ।

বীর সন্ন্যাসী মহাপ্রাজ্ঞ সুগতবংশ মহাস্থবির ছিলেন একজন অঘোষিত মুক্তি যোদ্ধা। ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মুক্তি সংগ্রামে (পূর্ব পাকিস্থানের স্বাধীনতা যুদ্ধ) তিনি পরোক্ষভাবে (জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম) সহায়তা করেছিলেন। তাঁর যুদ্ধ ছিল অস্ত্র দিয়ে নয় সাম্য, মৈত্রী এবং মানব সেবার বন্ধন দিয়ে। তিনি তাঁর বিহারে অনেক আশ্রয়হীন নরনারীকে আশ্রয় প্রদানের পাশাপাশি তাদের নানাভাবে সহায়তা করে দেশ ও জাতির স্বার্থে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর অভিমত ছিল এইরূপ:

সুসুখং বত জীবাম, বেরিনেসু অবেরিনো।

বেরিনেসু মনুস্স সু, বিহরাম অবেরিনো।।

শত্রুর সাথে অশত্রুতা (মৈত্রী) মূলক ব্যবহারকারী সংসারে সুখপূর্বক জীবিত থাকতে পারেন। আমরা বৈরীতা পোষণকারীর সাথে মিত্রতাপূর্ণ ব্যবহার করি।

প্রতিভা এবং সাংগঠিক দক্ষতার কারণে তিনি একসময় বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁকে বাংলাদেশ ভিক্ষা মহাসভার উপ-সংঘরাজ পদে অভিষিক্ত করা হয় এবং সেই সময় মহামান্য সংঘরাজ ছিলেন শ্রীমৎ শীলালংকার মহাস্থবির মহোদয়। তিনি যেমন দীপ্তিমান ছিলেন, তেমনি আদর্শ আচার্য রূপে খ্যাতির শীর্ষে ছিল তাঁর অবস্থান।

তিনি স্বীয়প্রতিভা বলে বাংলাদেশ এবং ভারতে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়

"চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,

 জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর

আপন প্রাঙ্গনতলে দিবস শর্বরী 

বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি, 

যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে

উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে

দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়

অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়-"

 

পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির তাঁর অবদানকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন (১৯৭৭ খ্রীষ্টাব্দ) মহামায়া গ্রন্থ প্রকাশনী। এই প্রকাশনী হতে তাঁর গ্রন্থ সমূহ প্রকাশিত হয়েছে এবং উক্ত গ্রন্থ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উপাসক-উপাসিকা এবং সুধীজনের নিকট অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে। সুতরাং এই অর্থে ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির একজন ত্রিপিটক শাস্ত্রবিশারদ শুধু ছিলেন না বৌদ্ধ সাহিত্যকে মন্থন করে জনবোধ্যরূপে প্রস্তুত করা এবং যুগোপযোগী সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা তথা বিশ্লেষণ করার মতো তাঁর বোধশক্তি ছিল অসাধারণ। তার অধ্যয়ন নিষ্ঠা, পাণ্ডিত্য, সততা, বিনয়শীল চেতনা তিনি তাঁর সমগ্র জীবন অসংখ্য সৎ আচার্য ও সৎচরিত্রের পুণ্য পুরুষের স্পর্শে স্বীয় জীবনকে উজ্জীবিত করেছেন। এরূপ মহান এবং সর্বগুণ সম্পন্ন সাধকের সান্নিধ্য লাভ করা বৌদ্ধ সাংঘিক সমাজের পক্ষে সত্যই গৌরবের বিষয়।

ধর্মারামো ধর্মরতো, ধর্মং চানুবিচিন্তয়ন।

ধর্মং হ্যনুম্মরা ভিক্ষু:, ধর্মান্ন পরিহীয়তে।

ভদন্ত সুগত বংশ মহাস্থবির নিরন্তর ধর্মাচরণ এবং ধর্মচিন্তনে যদা নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর অনুপ্রেরণার প্রতিষ্ঠিত হয় মেরুল বাড্ডা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার (ঢাকা)। তিনি বৌদ্ধ সমাজ এবং সদ্ধর্মের কল্যাণে যে সকল কর্ম সম্পাদন করেছেন, তা নিরবে-নিভৃতে করেছেন এবং এটাই ছিল তাঁর জীবনের মহত্ত্বতা।

ধর্মদানং সর্বদানং জয়তি, ধর্মরসো সর্বরসং জয়তি।

ধর্মরতি: সর্বরতিং জয়তি, তৃষ্ণাক্ষয়: সর্বদুঃখং জয়তি।।

 

ধর্মদান অন্য সকল দানকে জয়ী করে নেয়। এইভাবে, ধর্মরূপ অমৃতপান'এর রস সকল রসকে জয়ী করে। ধর্মে প্রতি অনুরাগ (রতি-প্রেম) ও সকল রাগের প্রতি বিজয় লাভ করে। তথা তৃষ্ণার বিনাশ সকল দুঃখকে পরাভূত করে নেয়। ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির তৃষ্ণার ক্ষয় দ্বারা সকল দুঃখকে জয় করেছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন জাগতিক বিষয় ভোগ হতে মুক্ত একজন ধর্মাচারী ভিক্ষু। ১৯৯৮ খ্রীষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর, জীবনপুরের এই পথিক অর্থাৎ মহান পুণ্য পুরুষ বৌদ্ধ মণীষা সুগতবংশ মহাস্থবির মহোদয় কালগত হন। ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, অনিচ্চ বত সংখার। নিব্বানং পরম সুখং।'

পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবিরের জীবন সাধন ছিল সদ্ধর্মের অমৃতরূপী রসে পূর্ণ এবং অন্যদিকে জ্ঞানাকাশের দীপ্তশিখার দীপ্যমান। অর্থাৎ এইভাবে-

বীততৃষ্ণো হ্যনাদানো, নিরুক্তিম্পদবেনবিদঃ।

অক্ষরানাং সখিপাতং বেত্তি পূর্বাপরানি চ।

স বৈ অন্তিমশরীরে মহাপ্রাজ্ঞঃ স উচ্যতে।।

 

যিনি তৃষ্ণা মুক্ত হয়েছেন, যিনি অপরিগ্রহযুক্ত, যিনি পদ নির্বাচনে দক্ষ, যিনি অক্ষরের আদি-অন্তকে উত্তমরূপে অবগত করেছেন, এইরূপ মহাপ্রাজ্ঞ অবশ্যই এই সংসারে অন্তিম জন্মগ্রহণ করেছেন। সুতরাং তিনি সকল বিষয়কেই অবগত করেছিলেন। তিনি সকল (সাংসারিক) ধর্ম হতে অনুপলিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি সকল বিষয়কেই পরিত্যাগ করেছিলেন। তাঁর সর্ববিধ তৃষ্ণা ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার কারণে তিনি 'বিমুক্ত' হয়েছিলেন।

কথিত আছে যিনি মনুষ্যের অন্তর্নিহিত ভাবনাগুলি অনুসাধন করতে পারেন তিনিই সর্বজনীন সুগত পুরুষরূপে আবির্ভূত হন। এক্ষেত্রে তাঁর জীবনাচরণ প্রমান করে তিনি প্রকৃত অর্থেই 'সুগত'। ফলে তাঁর মৃত্যু হলেও তিনি বৌদ্ধ জাতির জন্য ধ্রুবতারা হয়ে আছেন।

এবং তাঁর মহান কীর্তি তাকে অমর করে রেখেছে আমাদের মাঝে। শ্রদ্ধেয় ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির আপনি আজও ফিনিক্স পাখির ন্যায় মৃতুঞ্জয়ী।

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ।

মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।।

হে মহাসুগত, আপনার জীবন থেকে সৃষ্টি হোক ক্রান্তিকাল। মুছে থাক অজ্ঞানতা, মলিনতা। বৌদ্ধ জাতির জীবনে নেমে আসুক নবজীবনের সঙ্গাত। জয় হোক সত্যের...।

পরম কল্যাণমিত্র উপসংঘরাজ ভদন্ত সুগতবংশ মহাস্থবির মহোদয়ের আর্শীবাদ পুষ্ট আমি। তাঁর সান্নিধ্যে যাওয়ার অনেকবার সুযোগ লাভ করেছি। তাঁর মধ্যে সত্যবাদিতা তেজস্বিতা, বিনয়াবরণে পরিপূর্ণ একজন মানুষ। তিনি দেশনা করতেন সেগুলি তাঁর অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানের আকর থেকে। তিনিও যাঁদের সান্নিধ্য পেয়েছেন, তাঁরা হলেন দার্শনিক বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির, পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির, ভগবানচন্দ্র মহাস্থবির, রাজগুরু ধর্মরত্ন মহাস্থবির, কবিরত্ন সুবিমল বিদ্যারত্ন মহাস্থবির। এই সুবিমল বিদ্যারত্ন মহাস্থবির ছিলেন আমার দাদুর মামা। পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবিরের বিভিন্ন গ্রন্থ সাধারণ মানুষকে সত্য ধর্ম দর্শনের পথ চলার সুগম করে দিয়েছেন। ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর পায়ে আঘাত লাগলেও তিনি সমগ্র বৌদ্ধপল্লী চষে বেড়িয়েছেন, সদ্ধর্ম প্রচার প্রসারে। ১৯৯১ সালে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে শিলক গ্রামে শ্রীমৎ জ্ঞানবংশ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে তিনি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছিলেন তাঁ নেতৃত্বে এবং সভাপতিত্বে। তাছাড়া আমার শিলক গ্রামে উপাধ্যায়দেব সংঘরাজ ড. রাষ্ট্রপাল মহাস্থবির কর্তৃক বিদর্শন ধ্যান শিবিরে গিয়ে তিনি দেশনা করতেন। সেখানে তিনি তাঁর রচিত "বৌদ্ধ যোগ সাধনা" গ্রন্থের অলোকে দেশনা করতেন। সেখানে তিনি বলতেন নির্বাণ লাভ বা স্রোতে পড়া এত সোজা নয়। খুব সজাগ ও সচেতন হয়ে ধ্যানানুশীল একান্ত অপারিহার্য। শিলক গ্রামে ধ্যান শিবির চলাকালীন আমাদের পরিবার থেকে আমার দাদু, ঠাকুর মা, মা বাবা সাধক সাধিকাদের ভোজন দান করতেন।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধর্মামৃত বিহারে আমি প্রায় সময় তাঁর আদেশ উপদেশ এ নিতে ও শুনতে যেতাম। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ ও আপন করে নিতেন। তিনি আমাকে আর্শীবাদ করে বলেছিলেন এই ছোট ভিক্ষু জীবনে অনেক উপরে উঠতে পারবে এবং সুপরিপূর্ণতা আসবে। আমাকে এই কথা সরাসরি বলেননি অন্যকে বলেছেন তারাই আমাকে এটি বলেছিলেন। তাঁর আর্শীবাদ আমি লাভ করেছি। তাঁর শুরু পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির ও তাঁর অন্যতম শিষ্য আমার আচার্যদেব ড. জিনবোধি মহাথের মহোদয়েরও আর্শীবাদ আমি পেয়েছি। আমি এই মহান গুণীদের আভূমি বন্দনা করছি। ড. জিনবোধি মহাথের প্রণীত " পণ্ডিত সুগতবংশ মহাস্থবির- জীবন সাহিত্য সাধনা ও মূল্যায়ন" গ্রন্থটি সময়োপযোগী ও কালের সাক্ষীরূপে পরিগণিত হবে এতে কোন দ্বিমতের অবকাশ থাকবে না। অনাগত সংঘ সমাজ এই মহাপুরুষের পথ চলে নিজেদের জীবনকে আলোকোজ্জ্বল হোক। অলং ইতি বিত্থারেন।

 

পোর্ট  ব্ল্যায়ার, আন্দামান নিকোবর। 

১৫ অগাস্ট ২০২৫, স্বাধীনতা দিবস। 

২৫৬৯ বুদ্ধাব্দ ।

 

সুমনপাল ভিক্ষু

অতিথি অধ্যাপক

পালি বিভাগ ও বৌদ্ধবিদ্যা

অধ্যায়ন বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও পালি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

ভূমিকা

পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবিরের মহোদয়ের জীবন, কর্ম ও সাহিত্যে সাধনা

সুমনপাল ভিক্ষু
অতিথি অধ্যাপক, পালি বিভাগ ও বৌদ্ধ বিদ্যা অধ্যয়ন বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও পালি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকোতা।


অনিক্কসাবো কাসাবং, যো বত্থং পরিদহিস্সতি।
অপেতো দমসচ্চেন, ন সো কাসাবমরহতি।।৯।।
যো চ বন্তকসাবস্স, সীলেসু সুসমাহিতো।
উপেতো দমসচ্চেন, স বে কাসাবমরহতি।।১০।।

অর্থাৎ, যে পুরুষ কামরাগাদি এবং কলুষযুক্ত হন, তিনি ভিক্ষুপযোগী কাষায় বস্ত্র (ত্রি-চীবর) পরিধানের যোগ্য নয়। তথা যিনি ইন্দ্রিয় দমন এবং সত্যভাষণে অযোগ্য, পরিত্যক্ত, তিনিও কাষায় বস্ত্র ধারণের অধিকারী নয়।

এর বিপরীত, যে পুরুষ (পুদ্গল) কলুষ মুক্ত, শীলে সুপ্রতিষ্ঠিত, সংযতেন্দ্রিয় এবং সত্যপরায়ণ, তিনি (এইরূপ পুরুষ) সেই নির্মল কাষায় বস্ত্র ধারণের অধিকারী হন। (ধর্মপদ, যমকবগ্গো-১)

১৯ শতক, বঙ্গদেশের ইতিহাসে 'নবজাগরণের যুগ' বা 'সুবর্ণযুগ' রূপে আখ্যায়িত। কেননা এই শতাব্দীকালে প্রাশ্চাত্য সংস্কৃতির ঢেউ তথা জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদি বঙ্গদেশে প্রবেশ করেছিল, ফলে এই বঙ্গ ভূমির সামন্ততান্ত্রিক সমাজের অর্গল মুক্ত করে নিদ্রাচ্ছন্ন সমাজকে সর্বপ্রথম জাগ্রত করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। এরপরই বঙ্গদেশের ভাগ্যাকালে উদয় হলেন বিদ্যাসাগর সম্পূর্ণ অর্থে কুসংস্কার মুক্ত। তিনি ছিলেন প্রভাতের প্রথম সূর্যের মতো, পূর্ব দিগন্ত নতুন সম্ভাবনাময় রক্তিম।

অপরদিকে বঙ্গদেশের বৌদ্ধদের জীবনেও এই নবজাগরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই কালখণ্ডে বঙ্গদেশের বৌদ্ধ সমাজে এমন কিছু যুগপুরুষ আর্বিভূত হয়েছিলেন যাদের পদরেণুর স্পর্শে বঙ্গদেশের বৌদ্ধ সমাজ ধন্য হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই ভূমি পুনঃরায় সদ্ধর্মের পবিত্র পুষ্প ঘ্রাণে সুভাষিত হয়ে এক পুণ্যতীর্থে পরিণত হয়েছিল। 

বৌদ্ধ নবজাগরণের এই আন্দোলন শুধু মানুষের চিন্তা, বুদ্ধিকে মুক্ত করতে চেয়েছে তা নয়। তারা দেশের অতীত বৌদ্ধ ইতিহাসকে ও অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছে। এই ভূখণ্ড ও একদিন জ্ঞানে গুণে বিদ্যায় শিল্প সাহিত্যে সমুজ্জ্বল ছিল। জন্ম নিয়েছিলেন মহাজ্ঞানী শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর। এই নবজাগরণের সংগ্রাম যে নতুন জীবনবোধ'এর জন্ম দিয়েছিল, তা প্রাণ লাভ করেছিল মহাপণ্ডিত শ্রীমৎ সারমেধ মহাস্থবিরের হাত ধরে, যিনি ১৯ শতকে নতুন করে ভগবান বুদ্ধের ধর্মবাণী চট্টলদেশে (বর্তমান চট্টগ্রাম) প্রচার করেছিলেন।

ইধ নন্দতি পেচ্চ নন্দতি, কতপুঞ্ঞো উভয়ত্থ নন্দতি।
পুঞ্ঞং মে কতং তি নন্দতি, ভিয্যো নন্দতি সুগগতিং গতো।।

অর্থাৎ একজন ধর্মরক্ষক এইস্থানে (এই লোকে) তাঁর সুখকর্মের প্রভাবে সুখী থাকেন তথা পরলোকে উপনীত হয়ে স্বকর্মফলের প্রভাবে সুখী থাকেন। সুতরাং, এই বিবিধ পুণ্যকর্মকর্তা উভয়স্থানেই সুখ ভোগ করেন। (ধর্মপদ, অপ্পমাদ বগ্গো-১৮)।

মানবজাতি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত, মহাপুরুষ ও সাধারণ মানুষ্। মহাপুরুষ যে সকল আধ্যাত্মিক ও মানসিক বিশেষ বিশেষ গুণ এবং শক্তি লাভ করে যেরূপ অসাধারণ কার্য সাধন করেন, সাধারণ মানুষ্ তদ্রুপ কখনও সংসাধন করতে সক্ষম নন। মহাপুরষগণ এই অর্থে বিশেষভাবে চিহ্নিত; তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ধর্মালোক জ্ঞানালোক লাভ করে প্রভূত তেজ ও শক্তি সহকারে জগতে উত্তম মঙ্গল কার্য সম্পাদন করেন। সাধারণ মানুষগণ মহাপুরুষদিগের উপদেশ, জীবনের দৃষ্টান্ত ও আলোক অনুসরণ দ্বারা মুক্তি মার্গে অগ্রসর হয়ে থাকেন। সর্বক্ষণ সকল স্থানে মহাপুরুষের আবির্ভাব হয় না, যখন পৃথিবীর বা দেশ-বিশেষের বিশেষ অভাব। দুরাবস্থা হয় তখন ধর্মরক্ষক অর্থাৎ মহাপুরুষ তাঁর জীবন দ্বারা সেই অভাব মোচন ও অবস্থার সংশোধন করে নেন। বস্তুতঃ যিনি ঈদৃশ মহাকার্য সম্পাদন করেন, যা অন্য ব্যক্তি সম্পাদন করতে পারেন না, তিনিই মহাপুরুষ।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-

ওই মহামানব আসে।
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক
এল মহাজন্মের লগ্ন।

পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির এক অর্থে কৃতবিদ্য, মহাপণ্ডিত, ত্রিপিটক বিশারদ, স্বর্ণপদক বিভূষিত, দার্শনিক, মহামনীষী, মহামতি, মহামনা প্রথিতযশাঃ ইত্যাদি বহুগুণের অধিকারী, সুতরাং তিনি মহাপুরুষ।

অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে বৌদ্ধ মতাবলম্বী পাল বংশ (৭৩০-১১৯৯ খ্রিঃ) সম্পূর্ণ বঙ্গদেশ এবং মগধ জনপদে এক নতুন যুগ স্থাপন করেছিল। উত্তরকালে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব তথা তুর্কী মুসলমানদের বঙ্গদেশে আগমনের ফলে সম্পূর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশ হতে বৌদ্ধধর্ম সম্পূর্ণ অর্থে নিশিহ্ন হয়ে গেলেও আরাকান সন্নিহিত চট্টগ্রামে বিকৃতভাবে (মহাযান এবং তন্ত্রযানের সংমিশ্রণ) বৌদ্ধধর্ম বিরাজমান ছিল। অর্থাৎ এই অর্থে তারা ছিলেন প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ। আর. কিমুরা রচিত- 'এ হিস্টোরিক্যাল স্টাডি অফ দ্য টার্ম হীনযান এণ্ড মহাযান এণ্ড দ্য অরিজিন অফ্ মহাযান বুড্ডিজিম' (পৃঃ ১৩) গ্রন্থ হতে এই তথ্য পাওয়া যায় যে স্থবিরবাদের (হীনযান) প্রচার শ্রীলংকা, থাইল্যাণ্ড, কাম্বোডিয়া, বার্মা (মায়ানমার) এবং চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শ্রী কৃষ্ণমোহন শ্রীমানী'র মতে (বুড্ডিজিম আণ্ডার দ্য পালস্: এ স্টাডি বেসড্ অন তারনাথ, পৃঃ ১৮৭-১৯৫) চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থবিরবাদ বজায় ছিল কিন্তু ৭০২ খ্রিষ্টাব্দ হতে এই অঞ্চলের বেশ কিছু অংশে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব সময়কাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলে মহাযানী বৌদ্ধ সম্প্রদায় ভুক্ত (রাউলী পুরোহিত) ধর্মগুরুদের প্রভাব ছিল। তাঁরা মহাযান মতাদর্শ অনুসারে যাবতীয় ধর্মীয় কার্য পরিচালনা করতেন। ১৯ শতকে (১৮৬৪ খ্রীঃ) বঙ্গদেশের চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্মের নবজাগরণের উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক সারমেধ মহাস্থবির সর্বপ্রথম থেরবাদী বৌদ্ধ বিনয় বিধান অনুসারে পাহাড়তলী গ্রামে শ্রদ্ধেয় হরি মহাথর (মাথে) এবং বেশ কয়েকজন রাউলী পুরোহিতকে থেরবাদ উপসম্পদা প্রদান করলে ঐ অঞ্চলের বৌদ্ধ জনগণর মধ্যে এক নতুন প্রভাতের সূচনা হয়।

যো চ বস্সতং জীবে, অপস্সং ধম্মমুত্তমং।
একাহং জীবিতং সেয্যো, পসতো ধম্মমুত্তমং।। ১১৫।।

যদি কোন মানুষ্ বুদ্ধোপদিষ্ট উত্তম ধর্মকে অনুসন্ধান না করে শতবর্ষ পর্যন্ত জীবিত থাকেন তাহলে তার জীবন নিরর্থক হয়ে যায়। হ্যাঁ, যদি কোন মানুষ সেই উত্তম ধর্মের মননে একদিবস নিজ চিত্তকে সম্পৃক্ত করেন তাহলে তার একদিবস'এর জীবন (বুদ্ধিমানী দৃষ্টিকোণ অনুসারে শ্রেয়কর রূপে গণ্য হয়। (ধম্মপদ, সহস্স বগ্গো)।

নানাবিধ কারণে তৎকালীন চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৌদ্ধ সমাজ ধর্মীয় অজ্ঞাতার কারণে অশিক্ষা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সারমেধ মহাস্থবির এর অনুকম্পার ফলে উক্ত অঞ্চলের বৌদ্ধ জনগণের অভ্যন্তরে এক বিমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। বিশেষ করে বৌদ্ধ সমাজ তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁরা স্বীয় কর্মপ্রতিভার দ্বারা এই জাগরণকে ভারতীয় উপমহাদেশে এক মাইল ফলক রূপে চিহ্নিত করেছিল। এই নবজাগরণকে সদ্ধর্মের অমৃতরসে পুষ্ট করার অভিপ্রায়ে যে সকল মহান কর্মযোগী সাধক সেই সময়কালে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সদ্ধর্মযোগী পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির।

সব্বদানং ধম্মদানং জিনাতি, সব্বং রসং ধম্মরসো জিনাতি।
সব্ব রতিং ধম্মারতি জিনাতি, তন্হক্খয়ো সব্বদুক্খং জিনাতি।।৩৫৪।।

ধর্মদান অন্য সকল দানকে পরাভূত করে। এইভাবে, ধর্মরূপ অমৃতপানের রস সকল রসকে পরাভূত করে নেয়। ধর্মের প্রতি অনুরাগ (রতি-প্রেম) ও অন্য রাগসমূহকে পরাজিত করে। তথা তৃষ্ণার বিনাশ সকল দুঃখকে জয়ী করে। (ধম্মপদ, ভিক্খু বগ্গো)।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুলাই, চট্টগ্রাম জনপদের ফটিকছড়ি উপজেলাধীনস্থ 'ধর্মপুর' নামক একটি বর্ধিষ্ণু গ্রামের এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত বৌদ্ধ পরিবারে পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবিরের জন্ম হয়। তাঁর পরিবার প্রদত্ত নাম ছিল শ্রীযুক্ত বিপিন চন্দ্র বড়ুয়া। বিপিন চন্দ্র তাঁর পিতা মাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন। পুণ্যশীলা প্রাণেশ্বরী বড়ুয়া।

'ধর্মপুর' গ্রামের একটি অতীত ইতিহাস রয়েছে। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে আরাকান অঞ্চলের বৌদ্ধ রাজবংশের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল এই গ্রাম। তাঁদের রাজত্বকালে এক ধর্মাপরায়ণ এবং প্রভাবশালী রাজার বসতি ছিল এই গ্রাম। সম্ভবতঃ তাঁদের ধর্মনীতির কারণে এই গ্রামের নাম হয়েছে 'ধর্মপুর'। 'পাল অভিলেখতে প্রতিপাদিত বৌদ্ধধর্ম গ্রন্থের বিষয় প্রবেশে সমুদ্রতটবর্তী সমতট প্রদেশে ধর্মপুর অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায় (পৃঃ ১২), তবে এই ধর্মপুর চট্টগ্রাম প্রদেশের ধর্মপুর গ্রাম কিনা জানা যায় নি।

শৈশবকাল হতে বালক বিপিন চন্দ্র ক্ষুরধার মস্তিস্ক সম্পন্ন ছিলেন। ফলে তাঁর পিতা মাতা তাঁকে স্থানীয় বৌদ্ধ বিহারের নৈশ পাঠপালায় শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে ভর্তি করে দেন।

সেই সময় উক্ত পাঠশালার শিক্ষক ছিলেন শ্রদ্ধেয় কবিরাজ নিশিচন্দ্র বড়ুয়া এবং নগেন্দ্র লাল বড়ুয়া। বালত বিপিন চন্দ্র অতি অল্পকালের মধ্যে তাঁর মেধাশক্তির পরিচয় প্রদান করেছিলেন। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ধর্মপুর, জাফর অলি মুনসী বাজারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। কিন্তু এই বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষাজীবন দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। নানাবিধ কারণে সেই বিদ্যালয়ের পঠন পাঠন বন্ধ হয়ে যায়। অতপর তাঁর পিতামাতা স্বগ্রামে প্রতিষ্ঠিত ধর্মপুর ক্যায়াং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুনঃ ভর্তি করে দেন।

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জীবনে ভয়াবহ সংকট নেমে আসে। এই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে সমগ্র বঙ্গদেশে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়। নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভিক্ষ এবং অগণিত মৃত্যু। এমন বিষাদময় অভিজ্ঞতার কালে তাঁর পিতৃদেব এর মৃত্যু হয়। কিন্তু মৃত্যুর প্রকৃত অর্থ কি তা তিনি প্রকৃত অর্থে উপলব্ধি করতে পারেন নি। ঐ বৎসরেই তিনি ভিক্ষু সংঘের উপস্থিতিতে প্রব্রজ্যা জীবন গ্রহণ করেন। তখন তিনি শ্রমণ বিপিন চন্দ্র রূপে পরিচিত হন।

ন তং মাতা পিতা কয়িরা, অঞঞে বা পি চ ঞাতকা।
সম্মাপনিহিতং চিত্তং, সেয্যসো নং ততো করে।।৪৩।।

মানুষের, মাতা-পিতা তথা আত্মীয় পরিজন সেই অর্থে হিতকারী হতে পারেন না, তার থেকে অধিক হিত সম্যক প্রাণিহিত (সম্মার্গে প্রবৃত্ত) চিত্ত সম্পাদিত করে দেয়। (ধম্মপদ, চিত্ত বগ্গো)।

১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে নভেম্বর মাসে তিনি তাঁর দীক্ষাগুরু ধর্মকথিক মহাস্থবিরের নিকট (বিনাজুরী শ্মশান বিহার) ধর্ম বিনয় এবং আন্যান্য বিষয়ের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। আচার্যের ইচ্ছানুসারে শ্রমণ বিপিনচন্দ্র 'বিনাজুরী সোনাইর মুখ উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয়ে তিনি ৩ বৎসর শিক্ষালাভ করেছিলেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আচার্যের অনুমতি গ্রহণ পূর্বক রাজা নগর রাজবিহারে গমন করেন। তখন সেই বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন রাজগুরু ধর্মরত্ব মহাস্থবির। তাঁর নির্দেশনায় ধর্ম বিনয় শিক্ষা ব্যতীত শ্রমণ বিপিনচন্দ্র প্রথাগত শিক্ষাও গ্রহণ করেছিলেন। ঐ বৎসর কালে তিনি বর্ষাবাস যাপনের উদ্দেশ্যে ভোজপুর বিহারে গমন করেন এবং ভোজপুর মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঐ বিদ্যালয় হতে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আচার্য বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবিরের (ত্রিপিটক বিশারদ পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রিপিটক শিক্ষা শুরু করেন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ নভেম্বর শ্রমণ বিপিন চন্দ্র উপসম্পদা লাভ করে 'ভিক্ষু ধর্মাধার' নামে ভূষিত হন। উপসম্পদা গ্রহণের ২ বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তিনি 'বহুজনের হিতার্থে, সুখার্থে সদ্ধর্ম প্রচার-প্রসার কার্যে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের সময়কালে তিনি চট্টগ্রাম ও তার সন্নিহিত অঞ্চলের বৌদ্ধ বিহার এবং গ্রাম পরিদর্শন করে সদ্ধর্মের পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। সেই সময় তাঁর এই ধর্মাভিযান প্রকৃত অর্থে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উট্ঠানেনপ্পমাদেন, সংযমেন দমেন চ।
দীপং করিয়াথ মেধাবী, যং ওঘো নাভিকীরতি।। ২৫।।

অর্থাৎ, বুদ্ধিমান পুরুষ বীর্যরূপ উত্থান, অপ্রমাদ, সংযম এবং দমন এই ক্রিয়ার মাধ্যমে স্বয়ং কে এইরূপ প্রদীপে (শরণস্থল) রূপান্তরিত করেন, যাকে (বিকাররূপ), জলপ্রবাহ তার অর্হত্বকে বিকীর্ণ করতে পারেন না। (ধম্মপদ, অপ্পমাদ বগ্গো)।

১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর আচার্য (দীক্ষাগুরু) ধর্মকথিত মহাস্থবির কালগতি লাভ করেন। আচার্যে মৃত্যু সংবাদ ধর্মাধার ভিক্ষু'র মনে গভীর বেদনা সৃষ্টি করেছিল। তখন তিনি স্মরণ করলেন ধম্মপদের অমোঘ বাণী। 

বীততন্হো অনাদানো, নিরুত্তিপদকোবিদো।
অক্খরানং সন্নিপাতং, জঞ্ঞা পুব্বাপরানি চ।
স বে অন্তিমসারীরো, মহাপঞ্ঞো তি বুচ্চতি।।৩৫২।।

যিনি তৃষ্ণা মুক্ত হয়েছেন, যিনি অপরিগ্রহযুক্ত, যিনি পদ নির্বাচনে দক্ষ, যিনি অক্ষরের আদি অন্তকে উত্তমরূপে অবগত করেছেন, এইরূপ মহাপ্রাজ্ঞ নিশ্চয়ই এমন এই সংসারে অন্তিম জন্ম গ্রহণ করেছেন। (তৃষ্ণা বগ্গো)।

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে ভিক্ষু ধর্মাধার উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে সিংহল গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিংহল গমনের পূর্বে তিনি কোলকাতা স্থিত বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহারে বেশ কিছু দিবস অবস্থান করেছিলেন। সেই সময় ধর্মাঙ্কুর বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্বামী পুন্নানন্দ সামনের। অতঃপর তিনি দীর্ঘ ১ মাস বুদ্ধগয়া সহ বৌদ্ধদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র গুলি দর্শন করেন এবং ঐ বৎসরের মার্চ মাসে সিংহলের সদ্ধর্মোদয় পরিবেণে উপস্থিত হন।

'সদ্ধর্ম্মোদয় পরিবেণ' মূল অর্থে সিংহলের একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষাকেন্দ্র। প্রাচীন ভারতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে এই পরিবেশ নির্মিত হয়েছে। এই পরিবেণ'এ ত্রিপিটক শাস্ত্র এবং অন্যান্য তুলনামূলক বিষয়ের শিক্ষা প্রদান করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩'য় শতকে মহামতি ধম্মাশোক (অশোক) বহিঃবিশ্বে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে নিজ পুত্র-কন্যা ভিক্ষু মহেন্দ্র এবং ভিক্ষুণী সংঘমিত্রাকে সিংহলে (বর্তমান শ্রীলংকা) প্রেরণ করেছিলেন। তথায় ভিক্ষুণী সংঘমিত্রার বদান্যতায় বুদ্ধগয়ার পবিত্র মহাবোধি বৃক্ষের একটি শাখা অনুরাধাপুরের ভূমিতে রোপিত হয়। যা আজও যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে পূজিত হয়ে চলেছে।

ভগবান বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের ৪৫০ বর্ষ পরে সিংহলী রাজা বট্টগামনির উদ্যোগে এবং মহারক্ষিত মহাস্থবিরের নেতৃত্বে ৪র্থ বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

যথাসময়ে ভিক্ষু ধর্মাধার মহাচার্য উপসেন মহাস্থবিরের সান্নিধ্য লাভ করলেন। মহাচার্য উপসেন মহাস্থবির 'অধিকরণ-নায়ক' নামে খ্যাত এবং বিনয় পিটকের অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের মীমাংসা কর্তারূপে ও প্রখ্যাত ছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ভিক্ষু ধর্মাধার তুলনামূলক শাস্ত্র ও বিনয় পিটক শিক্ষা আরম্ভ করলেন। ভিক্ষু ধর্মাধার প্রসঙ্গে সাহিত্যিক শীলানন্দ ব্রহ্মচারী বলেছেন, 'আমার সহাধ্যায়ীদের মধ্যে ভিক্ষু ধর্মাধারের ন্যায় পাঠস্পৃহা অন্য কারও দেখিনি। শয্যা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে চোখে মুখে জল দিয়ে বই খুলে তিনি পড়তে বসতেন। এ রকম পাঠানুরাগ সচরাচর দেখা যায় না।

ভিক্ষু ধর্মাধার অত্যধিক স্মৃতি সম্পন্ন এবং শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তিনি পরিবেণে অবস্থানকালে অবসর সময়ে দ্বিতীয় আচার্য পণ্ডিত বুদ্ধদত্ত মহাস্থবিরের নিকট বিশুদ্ধিমার্গ, পণ্ডিত ঞানাভিবংশ এবং ইন্দ্রগুপ্ত মহাস্থবিরের নিকট সূত্র পিটক, ব্যাকরণ শাস্ত্র, ছন্দ, অলংকার শাস্ত্র অধ্যয়ন পূর্বক পালি সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন।

সিংহলে ধর্ম-বিনয় অধ্যয়নকালে 'অম্বলংগোভা বনাশ্রমের উদক উক্ষেপ সীমায় পুণর্বার পণ্ডিত বুদ্ধদত্ত মহাস্থবিরের উপাধ্যায়ত্বে ভিক্ষু ধর্মাধার শুভ উপসম্পদা গ্রহণ করেন।

সিংহলে ভিক্ষু ধর্মাধার (১৯২৮-১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ) ৫ বৎসর কাল সমগ্র ত্রিপিটক শাস্ত্র এবং বৌদ্ধধর্ম দর্শন শাস্ত্র অধ্যয়ন পূর্বক বিপুল পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি কলম্বো শহরের জেতবনারাম হতে বার্মা (মায়ানমার) অভিমুখে যাত্রা করেন। বার্মায় সেই সময় পূর্ব বঙ্গীয় (চট্টগ্রাম অঞ্চলের) প্রবাসী বৌদ্ধদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল ধর্মদূত বিহার। তাঁর আগমনে উৎসাহিত হয়ে ধর্মাদূত বিহারে প্রবাসী পূর্ব বঙ্গীয় বৌদ্ধগণ একটি সম্বর্ধনা সভার  আয়োজন করেন। এই সভায় বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজের প্রথম বিদর্শনাচার্য ডা. রাজেন্দ্রলাল মুৎসুদ্দী সহ অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছিলেন। ডা. মুৎসুদ্দী ভিক্ষু ধর্মাধার প্রসঙ্গে বলেছিলেন "তিনি আমাদের বাঙালী বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহী সমাজের ভবিষ্যৎকাণ্ডারী এবং যোগ্য ভিক্ষু। তিনি আমাদের গর্বের রত্ন। তাঁর মত প্রতিভা আমাদের সমাজে বিরল।"

বার্মা অবস্থান কালে ভিক্ষু ধর্মাধার পণ্ডিত প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরের স্নেহসান্নিধ্য লাভ করেন এবং এ দেশের পবিত্র বৌদ্ধ তীর্থ সমূহ দর্শন করে ধন্য হয়েছিলেন।

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি চট্টগ্রাম প্রত্যাবর্তন করেন। ঐ বৎসরের প্রথম দিকে তিনি ভিক্ষু সংঘের সম্মতিক্রমে সংঘরাজ ভিক্ষু মহামণ্ডলের প্রধান সচিব পদে নিযুক্ত হন। এই সময়কালে সংঘরাজ ভিক্ষু মহামণ্ডলের অনুপ্রেরণায়, পাহাড়তলী (চট্টগ্রাম) গ্রামবাসীর সহায়তায় এবং পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষুর তত্ত্বাবধানে পাহাড়তলী সংঘরাজ মহানন্দ বিহারে প্রতিষ্ঠিত হয় 'মহামুণি পালি কলেজ'।

পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষু বৌদ্ধ সমাজের শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে অতীব যত্নশীল ছিলেন। তাঁর অনেক ছাত্র সাহিত্যিক, আন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পণ্ডিত এবং বিভিন্ন মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রূপে সুপরিচিতি লাভ করেছেন।

উট্ঠানবতো সতীমতো, সুচিকম্মস্স নিসম্মকারিনো।
সঞ্ঞতস ধম্মজীবিনো, অগ্গমত্তস্স যসোভিবডচতি।।২৪।।

অর্থাৎ, উত্থানশীল, স্মৃতিমান, পবিত্রকর্ম সম্পাদনকারী, যুক্তি পূর্বক ক্রিয়াবিধি নিষ্পন্নকারী, নিজ মন বাণী এবং কায়ের ক্রিয়াকে সংযত রক্ষাকারী তথা ধর্মপূর্বক জীবন নির্বাহকারী পুরুষের যশ নিরন্তর বুদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। (ধম্মপদ, অপ্পমাদ বগ্গো)।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ভিক্ষু ধর্মাধার কোলকাতায় বিনয় পিটক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান এবং ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে সূত্র পিটকের সম্পূর্ণ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় প্রদান করেছিলেন। বঙ্গীয় ভিক্ষু এবং বৌদ্ধ সমাজের অভ্যন্তরে পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষু সর্বপ্রথম 'ত্রিপিটক বিশারদ' উপাধি তথা বঙ্গীয় সংস্কৃত অ্যাসোসিয়েশন (বর্তমান বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদ) কর্তৃপক্ষ দ্বারা স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষু বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব আকিয়াব ধর্মদূত বিহারের অধ্যক্ষ তথা 'রেঙ্গুন' (মায়ানমার) বুড্ডিষ্ট মিশনের প্রতিষ্ঠাতা অগ্‌গ মহাপণ্ডিত ভদন্ত প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরের ৬০ তম জন্ম জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষ্যে বার্মা উপস্থিত হন। তিনি এই উৎসবের প্রধান বক্তা রূপে সারগর্ভ ভাষণ প্রদান করেছিলেন।

পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষু তাঁর জীবনের আদর্শ এবং উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপ দানের অভিপ্রায় ও সংঘরাজ নিকায়ের সংহতি রক্ষার নিমিত্তে সকল ভিক্ষুদের সহায়তা নিয়ে ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাস্থবিরের ঐকান্তিক সহযোগিতায় 'ভিক্ষু মহাসভা' গঠনের সংকল্প গ্রহণ করেন। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে শ্রদ্ধেয় তেজবন্ত মহাস্থবিরের সভাপতিত্বে এবং পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষুর সম্পাদকত্বে ভিক্ষু মহাসভা বা সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা প্রতিষ্ঠত হয়। তিনি ভিক্ষুসংঘের প্রতি নিবেদন করেছিলেন, "হে ভদন্তগণ! আমরা যেন ভগবান বুদ্ধের সেই মহাবাণীকে স্মরণ করি'- চরথ ভিক্খবে চারিকং বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়, অত্থায় হিতায় সুখায় দেবমনুস্সানং। কল্যানং পরিয়োসানং কল্যানং সাত্থং সব্যঞ্জনং কেবলপরিপুন্নং পরিসুদ্ধং ব্রহ্মচরিয়ং পকাসেথ।'

অর্থাৎ "হে ভিক্ষুগণ! বিশ্বপ্রাণীর হিতার্থে, সুখার্থে, দেব-মনুষ্যের উপকার সাধনের নিমিত্তে অর্থ ও ভাবযুক্ত আদি-মধ্য, অন্তকল্যাণ ধর্মদেশনা কর। সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ-পরিশুদ্ধ আদর্শ ভিক্ষু জীবন যাপন ও শান্তিময় নির্বাণ সাক্ষাৎকারের উপায় প্রচার কর।" সুতরাং এই অর্থে জগতে আমাদের কর্তব্য অপরিসীম।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষু "দিচাংপানি সদৌ আসাম বৌদ্ধ সমিতি'র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক বৌদ্ধ সম্মেলনে বিশেষ অতিথিরূপে যোগদান করেন। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধ ধর্মের সারতত্ত্ব, পরিবার সমাজে ব্যক্তির ভূমিকা ও রাষ্ট্রীয় জীবন সম্পর্কে আলোচনা। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ভাষণ অসমের ডিগবয় বৌদ্ধ বিহারের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরনিকায় সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডি ধর্মাধার ভিক্ষু শিলং হতে চট্টগ্রাম প্রত্যাবর্তন কালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এই সময় তিনি চট্টগ্রামের দুর্ভিক্ষ পীড়িত জনগণকে দু'মুঠো অন্নপ্রদানের উদ্দেশ্যে ত্রাণ প্রদান করেছিলেন। এই বিষয়টি তাঁর মানব সেবার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে আচার্য বিশুদ্ধানন্দ, মহাস্থবিরের আমন্ত্রণে পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষু কলিকাতা স্থিত বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহারে উপস্থিত হন। কলিকাতায় উপস্থিত হওয়ার পর তিনি বৌদ্ধ নবজাগরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষু ধর্মপুর বিহারের বিহারধ্যক্ষ পদে আসীন হন। 'নালন্দা বিদ্যাভবন' (১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই) প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তাঁর ভূমিকা অবশ্যই স্মরণযোগ্য।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের অন্তিম লগ্নে পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষু বুদ্ধগয়া, নালন্দা সহ ভারতের বৌদ্ধ তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বুদ্ধ শিষ্যদের সারিপুত্র ও মৌদ্গল্যায়নের পবিত্র দেহধাতু ভারতের আনয়ন উপলক্ষ্যে বেঙ্গল বুড্ডিষ্ট অ্যাসোসিয়েসন (বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা) এর উদ্যোগে কলিকাতায় যে আর্ন্তজাতিক বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই সম্মেলনে ও পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষু উপস্থিত ছিলেন। ১৯৪৯-১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ধর্মাঙ্কুর বিহারের আমূল সংস্কার সাধিত হয়।

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ভগবান বুদ্ধের ২৫০০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে বার্মা (মায়ানমার) তে ষষ্ঠ বৌদ্ধ সঙ্গীতির আয়োজন করা হয়। এই বৌদ্ধ সঙ্গীতিতে ভগবান বুদ্ধের ভূমি ভারত থেকে যে সকল বঙ্গীয় ভিক্ষু মহাসঙ্গীতি কারক হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পণ্ডিত ধর্মাধার ভিক্ষু (মহাস্থবির)। সর্বোপরি এই সঙ্গীতিতে ড. ভীমরাও আম্বেদকরও যোগদান করেছিলেন।

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ অক্টোবর ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসে বৌদ্ধদের নবজাগরণ রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। উক্ত দিবসে ড. ভীমরাও অম্বেদকর এবং তাঁর ৫ লক্ষ অনুগামী নাগপুরে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক দীক্ষা অনুষ্ঠানে পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির ভও উপস্থিত হয়েছিলেন। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবিরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং অনুপ্রেরণার ফসলরূপে সর্বপ্রথম ভারতীয় ভিক্ষু মহাসভা স্থাপিত হয়।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবিরকে অধ্যাপক রূপে গ্রহণ করে তাঁর পাণ্ডিজত্যকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন।

দুল্লভো পুরিসাজঞ্ঞো, ন সো সব্বত্থ জায়তি।
যত্থ সো জায়তি ধীরো, তং কুলং সুখমেধতি।।১৯৩।।

অর্থাৎ এইরূপ পুরুষোত্তম জ্ঞানী এই সংসারে পরম দুর্লভ হয়। তিনি সর্বত্র উৎপন্ন হন না। যে কুলে এই ধৈর্যশালী পুরুষ আবির্ভত। সেই কুলের অভ্যুদয় (সুখসমৃদ্ধি) অবশ্যম্ভাবী হয়। (ধম্মপদ, পৃঃ ৫৫)

পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির ১৩ বৎসর অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্ম সম্পাদন করেছিলেন। এর ফল স্বরূপ তিনি বৌদ্ধধর্ম এবং দর্শনমূলক বহু মূল্যবান গ্রন্থ তথা শতাধিক গবেষণা মূলক মৌলিক প্রবন্ধ রচনা করে বৌদ্ধ জাতিকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পরিণাম স্বরূপ জন্ম গ্রহণ করে 'নালন্দা' পত্রিকা। যা আজও প্রবাহমান। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বৌদ্ধ সংঘ সম্মেলন'এ ভারতীয় পণ্ডিত ভিক্ষু রূপে ধর্মাধার মহাস্থবির এবং ভদন্ত আন্দ কৌশল্যায়ন যোগদান করেন। ঐ বৎসরেই পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির 'সর্বদর্শনাচার্য' উপাধিতে ভূষিত হন।

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ নভেম্বর কলিকাতার শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে 'বৌদ্ধধর্ম দীক্ষা সমারোহ সমিতি'র উদ্যোগে এক দীক্ষানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা প্রদান করেন পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ভিক্ষু মহাসম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি রূপে ধর্মাধার মহাস্থবির যোগদান করেন। এই মহাসম্মেলনে ৩-৪ শতাধিক ভিক্ষু এবং বহু প্রতিনিধি সমবেত হয়েছিলেন। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব বিনাজুরী গ্রামে (চট্টগ্রাম)'র বিদর্শন ভাবনা কুটিরে বুদ্ধগয়া হতে আনীত পবিত্র বোধিবৃক্ষের চারা রোপণ করেন পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির।

১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারী বুদ্ধগয়া স্থিত আন্তর্জাতিক সাধনা কেন্দ্রের উদ্যোগে মহামান্য দলাই লামা এবং পরমপুজ্য তৎপুলু সেয়াডকে সম্বর্ধনা প্রদান করা হয়। ঐ সম্বর্ধনা সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির।

পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। তিনি ছিলেন একঅর্থে সাহিত্যিক, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক, আচার্য, শিক্ষক, মানবদরদী এবং কৃতবিদ্য পুরুষ। এ প্রসঙ্গে মহাকবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের একটি বিখ্যাত কবিতা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

"হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি....।"

তাঁর ন্যায় মহাপ্রতিভাধর ব্যক্তি এভূখণ্ডে বিরল। তিনি শুধু চট্টগ্রামের (অধুনা বাংলাদেশ) গর্বময়, ভারত-বাংলা উপমহাদেশের গর্ব। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে নাগপুর, সিরাজপুর এবং মৌলী প্রভৃতি স্থানে ড. বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের জয়ন্তী উৎসব এবং ধর্ম সম্মেলনে পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির যোগদান করেছিলেন। এই সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল ড. আম্বেদকরের জীবন কর্মপদ্ধতি এবং বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত আলোচনা।

১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ নভেম্বর কলিকাতায় 'নালন্দা বিদ্যাভবন'এর সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব এবং ২৮ ডিসেম্বর (১৯৮৬) সর্ব ভারতীয় বৌদ্ধ মিশনের উদ্যোগে মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের উপর একটি আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির।

১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম (বর্তমান বাংলাদেশ) জেলার পূর্ব সাতবাড়িয়া রত্নাংকুর বিহারের বিহারাধ্যক্ষ শ্রীমৎ ধর্মরক্ষিত মহাস্থবিরের ৭৫ তম জন্ম জয়ন্তী উৎসবে পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির প্রধান অতিথিরূপে আসন অলংকৃত করেছিলেন।

১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল, শ্রীমতী শকুন্তলা বড়ুয়া, শ্রীমতী সুদীপ্তিময়ী বড়ুয়া এবং শ্রীমতী প্রীতিময়ী বড়ুয়ার ৩ কাঠা জমি দান করার ফলে শ্রীমৎ প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাস্থবির ও ড. সুকোমল চৌধুরীর ঐকান্তিক কর্ম প্রচেষ্টায় গড়ে বিদর্শন শিক্ষা কেন্দ্র (৫০টি/১ সি, পণ্ডিত ধর্মাধার সরণী, পটারী রোড, কলকাতা)। এই ভাবনা কেন্দ্রের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত 'ভারতীয় সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা' (বুদ্ধগয়া)র প্রথম সংঘরাজ ছিলেন। পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ভারতীয় সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার বার্ষিক সম্মেলনে তিনি সভাপতিরূপে যোগদান করেছিলেন। এই সম্মেলনটি উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বিনাগুড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

'ন তেন হোতি ধম্মট্ঠো যেনত্থং সহসা ন'য়ে,
যো চ অত্থং অন্বত্থং চ উভো বিঞ্ঞায় পণ্ডিতো।
অসাহসেন ধম্মেন সমেন নয়তী পরে,
ধম্মস্স গুত্তো মেধাবী ধম্মচেঠাতি পবুচ্চতি। ধম্মপদ।

এখনকার সাধারণ মানুষগুলো ক্রমশই সদ্ধর্মহীন এবং শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। এখানে বিষয়টা হল, এক একজন মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করার পর যখনই আধ্যাত্মিক শক্তির লাভ করেন, তখন তাঁরা সাধারণ মানুষের কষ্ট, অজ্ঞানতা এসব দেখে কাতর হয়ে পনেন। আর তখন বহুজনের হিতার্থে, সুখার্থে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে দেন। ফলে তাঁরা সঞ্চিত যোগলব্দ বা যে কোন প্রকারে লব্দ আধ্যাত্মিক সম্পদ অকাতরে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে চলে যান। কিন্তু মানুষ জানতেও পারে না, এরা সমাজের জন্য মানুষের জন নিজেদের জীবনকে কীভাবে উৎসর্গ করে চলেছেন। এই অর্থে পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির একজন যুগপুরুষ মহাসাধক।

'ইমং সরত্তং পিসিত্তং সরীরং,
ধারেথি লোকস্স হিতত্থমেব।'

অর্থাৎ, রক্ত মাংস সহ এই সুপুষ্ট জীবন, লোকের হিতার্থে ধারণ করা উচিত। কেননা তিনি মনে করতেন ভারত এবং বাংলাদেশে সদ্ধর্মের প্রচার এবং ধর্ম সংগঠনের অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রশ্নে বহু তরুণ ভিক্ষুর প্রয়োজন। এই উপমহাদেশে বহু পশ্চাদপদ মানুষ রয়েছেন- যারা মানবীয় অধিকার হতে বঞ্চিত। আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে অনগ্রসর এবং উচ্চবর্ণেতর দ্বারা নানাভাবে ঘৃণিত এবং নির্যাতিত। তাঁদের উদ্ধারকল্পে ভিক্ষুদের আত্মনিয়োগ করতে হবে। বিশ্বের যে কোন অঞ্চলে বৌদ্ধগণ বিপন্ন হলে তার প্রতিকারার্থে স্ব-স্ব সরকার, বিশ্ববৌদ্ধ সংস্থা এবং জাতিসংঘের মাধমে প্রতিবাদ জানানো উচিত। এই সকল কর্মে বৌদ্ধ তরুণ তরুণীগণকে এগিয়ে আসতে হবে। পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির বৌদ্ধজাতির উদ্দেশ্যে বলেছেন যে আমাদের পূর্বপুরুষগণের প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম সমগ্র এশিয়া জয় করে ইউরোপ, আমেরিকা এবং আফ্রিকার উপস্থিত হয়েছে। এই ঐহিত্য কোনভাবে বিস্মৃত হলে চলবে না। সেবার মাধ্যমে কর্তব্য পালন করতে হবে।

পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির'এর অভিমতে এই দেশের জনজীবনকে বুদ্ধ প্রভাব নানাভাবে সমৃদ্ধ এবং সঞ্জীবিত করে তুলেছিল অতুল মহিমায়। উত্তরকালে তা ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হলেও বৌদ্ধধর্ম আজও বঙ্গ ভূমির শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক জীবন প্রণালীকে গভীরভাবে পুষ্ট করে চলেছে।

মহাকালের তমসাচ্ছন্ন সময় কখনই বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতিকে পরিপূর্ণ ভাবে গ্রাস করতে পারে নি। উত্তরকালে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে উনিশশতকে বৌদ্ধধর্ম বঙ্গদেশের ভাগ্যাকাশে পুনঃ উদ্ভাবিত হয়েছে। তাঁর মতে সেবাপরায়ণতা হৃদয়ের একটি মহৎগুণ। আচার্য ও উপাধ্যায়'এর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি শ্রামণ্য ধর্মের মূল সোপান। এই বিষয় ব্যতীত সদ্ধর্মের উন্নতি সম্ভব নয়। কেননা গুরুর সান্নিধ্য লাভ করে শিষ্য ধীরে ধীরে তার আদর্শ চরিত্র গঠন করে। এই সময় থেকে বস্তুতঃ পক্ষে তার চরিত্রের অনমনীয় দৃঢ়তা জীবনের মূলে প্রোথিত হয়। সমাজ হিতৈষণার ক্ষেত্রে এই কর্মধারা ভাবীকালের মানুষের নিকট অনুপম আদর্শ রূপে পরিগণিত হয়ে থাকবে। 

"অসেবনা চ বালানং পণ্ডিতানং চ সেবন।
পূজা চ পূজনীয়ানং এতং মঙ্গলমুত্তমং।।

অর্থাৎ মুর্খজনের সান্নিধ্যে না থাকা, পণ্ডিতগণের সেবা করা এবং পুজনীয় পুরুষের পূজা করা উত্তম মঙ্গল। অন্য অর্থে বলা যায় যে সমাজ পূজ্য ব্যক্তির পূজা করে না তার উন্নতি সম্ভব নয়।

পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির আন্তর্জাতিক সাধনা কেন্দ্রের (বুদ্ধগয়া) প্রতিষ্ঠাতা ড. রাষ্ট্রপাল মহাথেরকে ভারতীয় উপমহাদেশের একজন মুখ্য ধর্মগুরু রূপে আধ্যায়িত করেছেন। কেননা

"অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাজ্ঞনশলাকয়া।
বুদ্ধিউন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।।"

শিক্ষা সম্পর্কিত অলোচনা প্রসঙ্গে পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির সর্ব প্রথম স্ত্রী শিক্ষার কথা সর্বাগ্রে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, বৌদ্ধ সমাজে শিক্ষিতা নারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। অথচ বৌদ্ধ যুগে ভারতীয় উপমহাদেশের নারী সমাজ শিক্ষা, দীক্ষা, এমন বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক চেতনায় বহুদূর অগ্রসর হয়েছিল। তদানীন্তন ক্ষেমা, মহামায়া, উৎপলবর্ণা, ধম্মদিন্না এবং থেরী সংঘমিত্রার শ্রেষ্ঠ অবদান, উচ্চ দর্শনতত্ত্বের চিন্তা পালি সাহিত্যের বিভিন্ন স্থানে সূর্যালোকের ন্যায সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।

অনাথপিন্ডিক কন্যার সেবাকর্ম ও প্রচার কার্য, খনার অভিজ্ঞতা জগতে আদর্শ স্থান অধিকার করেছিল। অথচ তাঁদের উত্তরসূরীগণ পশ্চাদপদ অবস্থায় দিনযাপন করবে বিষয়টি সুখকর নয়। সুতরাং স্ত্রী শিক্ষার প্রসার আবশ্যক। তবে এই শিক্ষা বিলাসিতার শিক্ষা নয়, অলংকারের আড়ম্বরতা নয়। এই শিক্ষা হল নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং সদ্ধর্মের উৎকর্ষতার শিক্ষা। এইটি ব্যতীত সমাজের শ্রীবুদ্ধি সম্ভব নয়।

ভগবান বুদ্ধ বিশাখা উপাসিকাকে বলেছেন-

যথা পি পুপ্ফরাসিম্হা, কয়িরা মালাগুণে বহু।
এবং জাতেন মচ্চেন, কত্তব্বং কুসলং বহুং।।৫৩।।

যেমন (কোন বুদ্ধিমান মালী) পুষ্পসমূহ দ্বারা নানাবিধ মালা তৈরী করে (গাঁথে); ঠিক সেইভাবে এই লোকে উৎপন্ন মনুষ্যকে নানাবিধ শুভ কর্ম সম্পাদন করা উচিত। (ধম্মপদ, পুপ্ফ বগ্গো)।

পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির'এর মতে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সদ্ধর্ম শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। কেননা ধর্ম শিক্ষা অধ্যাত্ম জীবনকে উন্নত করে, উদ্দাম মানব প্রবৃত্তিকে সংযত এবং সুসংবাদ করে। সর্বোপরি সমাজে নিরক্ষরতা দূরীদরণ সর্বাগ্রে আবশ্যক। যে অবৌদ্ধ পারিপার্শ্বিক অবস্থা যেভাবে বৌদ্ধ সমাজকে গ্রাস করেছে তাহলে মুক্তি লাভের প্রশ্নে ধর্মশিক্ষা আবশ্যক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-

"যারে তুমি নীচে ফেলো সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছে যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।"

অপরদিকে বৌদ্ধ সমাজের একটি অংশ অশিক্ষা, দীনতা এবং পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার চাপে নিত্য জর্জরিত এবং নিষ্পেষিত হয়ে চলেছে। এই সংকটজনক অবস্থা হতে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হল সংঘবদ্ধতা এবং আত্মনির্ভরতা। পার্থিব বিষয়ে আত্মনির্ভরতার সঙ্গে অধ্যাত্ম জীবন ও আত্মনির্ভরতা হয়। আত্মনির্ভরতার মাধ্যমেই বৌদ্ধ জাতি সাংসারিক জীবনে উন্নতি সাধন করতে পারে। এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করা প্রয়োজন।

পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির দীর্ঘ গবেষণা এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছেন যে শিক্ষার আলোক যেমন বৌদ্ধ সমাজের সর্বত্র সমভাবে পতিত হয় নি, সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রেও এই সমস্যা বিদ্যামান। কেননা সর্বস্তরে বৌদ্ধদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছে, ফলে বেকারত্বও ক্রমশ বৃদ্ধি লাভ করছে। তিনি এক্ষেত্রে আত্মনির্ভর তার পাশাপাশি সমগ্র বৌদ্ধ জাতির একাত্ম বোধের কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন। অগ্রণীর অনুসরণ যেমন অনুগামীর কর্তব্য, অনুগামীকে সাহায্য করা এমন কি তাকে বিপদ হতে রক্ষা করাও অগ্রণীর তেমন অপরিহার্য্য কর্তব্য।

অপরদিকে ধনোপার্জন করলেই ধনবান হওয়া সম্ভব নয়। ধনবান হতে হলে সঠিক উপার্জন নীতি অবগত করা যেমন প্রয়োজন, সঞ্চয়, সংরক্ষণ এবং ব্যয়নীতিকে অবগত করাও ততোধিক প্রয়োজন তথা নতুন পথ অবলম্বের মাধ্যমে ধনাগমোপায় অবলম্বন করা আবশ্যক। নতুবা সমস্ত পরিশ্রম অন্তঃসার শূন্য হতে বাধ্য।

পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির এক অর্থে ছিলেন ভারত বাংলাদেশের বৌদ্ধ জাতির এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তিনি যেভাবে বৌদ্ধধর্ম এবং সংস্কৃতির প্রচারে দক্ষতার পরিচয় প্রদান করেছিলেন তা সাম্প্রতিক কালের ধর্ম প্রচারের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত রূপে পরিগণিত হয়েছে। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বঙ্গভূমির বৌদ্ধসমাজ ধর্মীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ভাবে পুষ্ট হয়েছে। বৌদ্ধ সমাজের হিতৈষণার ক্ষেত্রে তাঁর কর্মধারা উত্তরকালের মানুষের নিকট অনুপম আদর্শ হয়ে থাকবে।

"জয়ন্তো বোধিয়া মূলে সক্যানং নন্দিবড্ঢনো, এবং তুয়হং জয়ো হোতু জয়সু জয়মঙ্গলং।"

শাক্য রাজবংশের আনন্দ বর্ধন ভগবান বুদ্ধ যেমন উরুবেলার বোধিদ্রুম মূলে রিপু জয় করে মুক্ত হয়েছেন, সেইরূপ আপনার জয়হোক। আপনি সতত জয় এবং মঙ্গলের অধিকারী হোক।
 বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজে  সদ্ধর্মের পুনরুত্থান এবং বৌদ্ধ শাস্ত্র অনুশীলনের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাকে কোন ভাবেই বিস্মৃত করা সম্ভব নয়। তাঁর কর্মদক্ষতাই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সার্থবাহ হয়ে থাকবে।

"যস্মা ধম্মাং বিজানেয্য সম্মা সম্বুদ্ধদেসিতং, সক্কচ্চং তং নমসেয়্য অসিহুতং ব ব্রাহ্মণং।

যার নিটক হতে সম্যক সম্বুদ্ধের উপদিষ্ট সদ্ধর্ম অবগত করতে পারবে ব্রাহ্মণের যজ্ঞাগ্নি পূজার ন্যায় সেই শিক্ষাগুরুকে সগৌরবে বন্দনা জ্ঞাপন করতে হবে। সুতরাং এই অর্থে পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির আমাদের শিক্ষাগুরু। অপর অর্থে পূজনীয় ব্যক্তির পূজা মঙ্গলজনক কাজ। আমরা তাঁর অসমাপ্ত কর্মকে সম্পাদনের মাধমে তাঁকে বন্দনা জ্ঞাপন করব। এই কর্মসম্পাদনের মাধ্যমেই সদ্ধর্মের জয় ঘোষ ধ্বনিত হবে কামনা করি।

ভারতীয় সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার প্রথম সংঘরাজ, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ভূষিত, রাজগুরু, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব অধ্যাপক, পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবিরের সান্নিধ্য লাভ করি প্রথম ১৯৯৫ সালে। তখন সবে তীর্থ করতে আসি এবং বুদ্ধগয়া গিয়ে আন্তর্জাতিক সাধনা কেন্দ্রে, তৃতীয় সংঘরাজ ড. রাষ্ট্রপাল মহাস্থবিরের উপাধ্যায়ত্বে এবং ড. জিনবোধি ভিক্ষুর আচার্যের অধীনে উপসম্পদা লাভ হয় পুণ্যতীর্থ বোধিভূমিতে। তীর্থ ঘুরে এসে পূজ্য ধর্মাধার ভন্তের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা ও বিভিন্ন ইতিহাস নিয়ে কথা হয়। ১৯৯৭ সালে আবার বি. এ. পড়তে  আসি, তখনও ভন্তে ছিলেন স্মৃতিতে বেশ সতেজ, ৯৮ বছর বয়সে যেন চির নবীন। তিনি আমাদের গ্রামের কথা নখদর্পণে আমার মনোজগতে যেন এঁকে দিচ্ছেন। সেগুলো এখন রেখাপাত করে। তারপর কেটেছে ২ বছর তাঁকে এশিয়াটিক সোসাইটি ড. বি. সি. লাহা স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়, তাঁর সঙ্গে এশিয়াটিক সোসাইটি উপস্থিত হওয়া এক আনন্দ অনুভূতি। তাঁকে সকলে যে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন আপ্লুত হয়েছি। সেই অনুষ্ঠানে ড. ইউ. এন. বিশ্বাসও উপস্থিত ছিলেন। তারপর কলেজ পড়াশোনো তাঁর কাছে যেতাম তিনি জরাজীর্ণ বয়সেও ক্লান্তির অনুভব দেখাতেন না। ২০০০ সালে তাঁর শতবর্ষ উদযাপন ২৭ জুলাই, সেটা মহাসমারোহে আয়োজন হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে সার্বক্ষণিক তাঁর সান্নিধ্যে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল এটা আমার পুণ্যপারমী মনে করি। কিন্তু সেই অনিত্য তিথি কালের করাল গ্রাস একই বছর ৪ নভেম্বর তাঁর পবিত্র সূর্যাস্ত হল। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এসেমব্লী অফ গর্ডসার্চ, শচীন বাবু, আমি, প্রমথেশ বড়ুয়া,  ড. অমল দা, ক্ষীতিষ বাবু, ড. সুকোমল চৌধুরী, প্রদীপ ও শোভা মাসি যাঁরা ভন্তের সেবক ছিলেন।  ২০২১, ২৭ জুলাই একশত বছর পালন করা হয়। কেটে যায় ৪টা বছর ২০০৪ সালে পণ্ডিত ধর্মাধার ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট কতৃর্ক ধর্মাধার শতবার্ষিকী ভবনের প্লেন পাশ করতে সমর্থ হই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। নানা বাঁধাবিপত্তি পেড়োতে হয়। ড. সুকোমল চৌধুরী, ড. অমল বড়ুয়া, আমি মিলে অসাধ্য কাজ করেছিলাম, দীপিকা মাসির অবদান অনস্বীকার্য। অধ্যাপক প্রজ্ঞাবংশ মহাস্থবিরের অর্থ দ্বারা এই কাজ হয়েছিল। তখন একজন চৌধুরী অর্থায়ন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু বাঁধা হয় এক বরিষ্ট মহাস্থবির ও এক কনিষ্ঠ ভিক্ষু। পরবর্তীতে পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবিরের শিষ্য ধর্মবংশ মহাস্থবিরের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয় যে, তাঁর গুরুদেবের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে তাঁর সঞ্চিত অর্থ দান করবেন, আমি, ড. সুকোমল চৌধুরী, নীহার কান্তি বড়ুয়া, ড. অমল বড়ুয়া প্রমুখগণ। ২০০৯ সালে পটারী রোড নামকরণ করা হয় পণ্ডিত ধর্মাধার সরণী নামে, তাতে সর্বার্থক অবদান ও সাহায্য করেছিলেন ড. প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র। আমাকে এই নথি নিয়ে একাধিকবার কোলকাতা কর্পোরেশন ও ড. প্রতাপ চন্দ্রের বাড়িতে যেতে হয়েছিল। সরণী নামকরণ হওয়ার হস্তাক্ষর করেছিলাম,  আমি, প্রজ্ঞাজ্যোতি ভন্তে, ড. সুকোমল চৌধুরী, ড. অমল বড়ুয়া, নীহার কান্তি বড়ুয়া, ডা. এস. কে. রায়চৌধুরী, ডা. সেন, কাউন্সিলর জয়শ্রী দেবনন্দী, এবং সাহায্য করেছিলেন ভূপতি মোহন বড়ুয়ার বড় সন্তান, প্রকাশ বড়ুয়া।
ড. জিনবোধি মহাস্থবির প্রণীত
"পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবিরের মহোদয়ের জীবন, কর্ম ও সাহিত্যে সাধনা," গ্রন্থটি ১২৫ বছর জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষ্যে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ একটি যুগোপযোগী প্রকাশনার দাবী রাখে। গ্রন্থটি সঠিক ইতিহাসের আলোকপাত করবে নিঃসন্দেহাতীত।  অলং ইতি বিত্থারেন।