Friday, July 12, 2024

মহামানব বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত জীবনী

 ভূমিকা

 

গৌতম বুদ্ধ ছিলেন একজন তপস্বী, শ্রমণ। সর্বোপরি তিনি একজন সমাজসংস্কারক মানবতাবাদী যুগপুরুষ। যাঁর উদার চিন্তাধারা এবং যাঁর যুগপোযোগী শিক্ষার ভিত্তিতে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হয়। তিনি সিদ্ধার্থ গৌতম শাক্যসিংহ বুদ্ধ বা বুদ্ধ উপাধি অনুযায়ী শুধুমাত্র বুদ্ধ নামেও পরিচিত। আনুমানিক খ্রি.পূ. ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে প্রাচীন ভারতের পূর্বাঞ্চলে আবির্ভূত হয়েছিলেন ও তাঁর উপদেশিত ধর্ম বিঘোষিত হয়েছিল।

বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী ঐতিহ্যশালী জীবনী গ্রন্থগুলি সিদ্ধার্থ গৌতমের জীবনীর উৎস। দ্বিতীয় শতাব্দীতে অশ্বঘোষ দ্বারা রচিত 'বুদ্ধচরিত' নামক মহাকাব্যটি বুদ্ধের প্রথম পূর্ণ জীবনীগ্রন্থ। যেটি শ্রীরথীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক সংস্কৃত হতে প্রথম বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। তৃতীয় শতকে রচিত 'ললিত বিস্তর' গৌতম বুদ্ধের জীবনী নিয়ে লিখিত পরবর্তী গ্রন্থ। ১৯৯১ সালে বিজয়া গোস্বামী কর্তৃক অনূদিত হয় ও সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার হতে প্রকাশিত হয়।

চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত মহাসাঙ্গিক লোকোত্তর ঐতিহ্যের মহাবস্তু গ্রন্থটি অপর একটি প্রধান জীবনীগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হয়। এই গ্রন্থটি শ্রীরাধাগোবিন্দ বসাক কর্তৃক অনূদিত হয় ও সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী হতে প্রকাশিত হয়। তৃতীয় শতক থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত ধর্মগুপ্তের ঐতিহ্যের 'অভিনিষ্ক্রমণ সূত্র' গ্রন্থটি বুদ্ধের অপর একটি জীবনী গ্রন্থ। সর্বশেষ পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত বুদ্ধঘোষ রচিত থেরবাদ ঐতিহ্যের 'নিদান কথা' উল্লেখ্য। এই গ্রন্থটিকে ত্রিপিটকের অংশ হিসেবে জাতক, মহাপদান সূত্র, আচরিয়ভূত সূত্রে বুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ জীবনী না থাকলেও কিছু নির্বাচিত অংশ রয়েছে। এই 'নিদান কথা' গ্রন্থটি ধর্মপাল ভিক্ষু কর্তৃক অনূদিত ও বৌদ্ধ ধর্মানকার সভা হতে প্রকাশিত হয়। এবং ভিক্ষু সুমনপাল কর্তৃক দ্বিতীয়বার অনূদিত হয় কিন্তু এটি এখনো প্রকাশের অপেক্ষায়।

বুদ্ধের এই সমস্ত ঐতিহ্যশালী জীবনী গ্রন্থ সাধারণ অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত কাহিনীতে পরিপূর্ণ। মহাবস্তু প্রভৃতি গ্রন্থে বুদ্ধকে লোকোত্তর সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি জাগতিক বিশ্বের সমস্ত ভার থেকে মুক্ত। কিন্তু তা হলেও এই সমস্ত গ্রন্থ থেকে খুঁটিনাটি সাধারণ বিবরণগুলিকে একত্র করেও অলৌকিক কথাকাহিনীগুলিকে অপসারণ করে বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে আলোকপাত সম্ভব হয়েছে।

সুতরাং কোন নামটা ঠিক সেটা নিয়ে মতভেদ আছে। তাঁর 'রাহুল' নামে এক পুত্র সন্তানও জন্মে। মায়াময় জগতের দুঃখ যে সমস্ত জীবকে ঘিরে রেখেছে সেই উপলব্ধি তখন নিশ্চয়ই একটা কিছু করার সংকল্পে পরিণত করেছিল তাঁকে। সুতরাং 'গৃহত্যাগ' ছিল অবশ্যম্ভাবী।

সুত্ত নিপাতের প্রব্রজ্যা সূত্রে বলা হয়েছে কী কারণে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেছিলেন। সংসার থেকে অপার্থিব কিছু অর্জন করা খুবই কঠিন। মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে না পারলে সংসারের পঙ্কিলতাতেই এক সময় ডুবে যেতে হবে। এটা সঠিক উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। তাই সংসারের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আকুল হয়ে উঠেছিলেন সিদ্ধার্থ। 

ঊনত্রিশ বছর বয়সে, পুত্র রাহুলের জন্মের পর সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেন। নিদান কথায় বলা হয়েছে যেদিন তিনি গৃহত্যাগ করেন সেদিন রাহুলের জন্ম হয়। অট্টকথায় বলা হয়েছে রাহুলের জন্মের সপ্তম দিনে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেন। 'অরিয় পরিয়েসন সুত্তে' তিনি নজের গৃহত্যাগের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। 'সো গো অহং ভিক্খবে অপরেন সময়েন দহরো ব সমানো সুসু কালকেসো ভরেন যোব্বানেন সমন্নগতো পঠমেন বয়স অধামকানং মাতা পিতুন্নং, অসুমুখানং রুদন্তানং, কেসসম্পুং ওহারেত্বা কাসাবানি বখানি আচ্ছাদেত্বা অগারস্মা অনাগারিয়ং পব্বজিং'। 'হে ভিক্ষুগণ আমি তখন তরুণ। আমার একটি চুলও পাকেনি ও পূর্ণ যৌবনে ছিলাম। আমার মা বাবা আমাকে অনুমতি দিচ্ছিলেন না। চোখের জলে তাঁদের মুখ ভিজে গেছিল। তাঁরা অনবরত কাঁদছিলেন। তাঁদের কান্না উপেক্ষা করে কিছুকাল পরে মস্তক মুণ্ডন করে ও গোঁফ দাড়ি ইত্যাদি মুড়িয়ে, কাষায় বস্ত্র পরিধান করে গৃহত্যাগ করে আমি সন্ন্যাসী হলাম।' উক্ত নিকায় মৃত্ত গ্রন্থ হতে প্রমাণিত হয় সিদ্ধার্থ রাতের অন্ধকারে কাউকে না জানিয়ে ঘর ছাড়েননি। সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগের পর প্রথম গেলেন কোশলে 'আলাঢ় কালামের কাছে। 'অরিয় পরিয়েসন' সূত্রে তাই উল্লেখ রয়েছে। 'মঙ্গলকর পথ ও শ্রেষ্ঠ, লোকোত্তর শান্তিময় তত্ত্বের সন্ধানে আমি আলাঢ় কালামের কাছে গেলাম।'

বুদ্ধ দেহত্যাগ (মহাপরিনির্বাণ লাভ) করেছেন এখন ২৫৬৮ বছরে পতিত হয়েছে। তিনি ৬২৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ৬ এপ্রিল শুক্রবার বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে হিমালয়ের পাদদেশে শাক্যজাতির রাজা শুদ্ধোধনের ঔরসে ও রাণী মহামায়াদেবীর  গর্ভ হতে কপিলবাস্তু নগরী ও দেবদহ নগরীর মধ্যস্থলের লুম্বিনী উদ্যানে জন্ম নেন। বৈশাখ মাসে চাঁদ বিশাখা নক্ষত্রে এসে এই পূর্ণিমা ঘটায়। তখন ছিল গ্রীষ্ম ঋতু, বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি, শুক্রবারের ভোরবেলা, সিংহলগ্ন, বৃশ্চিক ও বিশাখা নক্ষত্রের সম্মিলনক্ষণ এবং এটি ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৪ অব্দ। 

সম্যক সম্বুদ্ধত্ব উপলব্ধি : সুদূর সেই ৫৮৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথির পূর্ণচন্দ্র উদীয়মান, বুধবার ৩৫ বছর বয়সে  সিদ্ধার্থ ধ্যান মগ্ন হয়ে বজ্রাসনে উপবিষ্টাবস্থায় অস্তগামী সূর্যের মত ডুবে গেলেন ধ্যানের  গভীরে। ধীরে ধীরে কাম্যবস্তু হতে, অকুশল সব হতে বিবিক্ত করে সিদ্ধার্থের চিত্ত প্রবেশ করল সবিতর্ক, সবিচার, বিবেকজ প্রীতি সুখমন্ডিত প্রথম ধ্যানে। তদনন্তর তাঁর চিত্ত গিয়ে পৌঁছলো বিতর্ক বিচার উপশমে অধ্যাত্ম স্তরে, চিত্তের একীভাব আনয়নকারী বিতর্কাতীত বিচারাতীত সমাধিজপ্রীতি সুখমন্ডিত দ্বিতীয় ধ্যানে। ক্রমে প্রীতিতেও বীতরাগ হয়ে উপেক্ষারভাবে অবস্থান করতঃ স্মৃতিমান ও সম্প্রজ্ঞাত হয়ে স্ব-চিত্তে প্রীতি নিরপেক্ষ সুখানুভব করতে করতে তিনি লীন হলেন তৃতীয় ধ্যানে। 

অতঃপর, মধ্যম মার্গ আবিষ্কার করে দেশনা করেছেন সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধির কথা। পদব্রজে ছুটে বেরিয়েছেন সারা উত্তরভারতে, শিষ্য অনুরাগীদেরও শিক্ষা দিয়েছেন নিজে সৎ থেকে অপরকে সৎ হতে উপদেশ দিতে, দেশান্তরে ছড়িয়ে যেতে। জগতকল্যাণে তাঁর সেই ছুটে চলা, আসমুদ্রহিমাচল ছাড়িয়ে, প্রাচ্য হতে প্রচীত্যে।

কুশিনগর অভিমুখে যাত্রা বৃত্তান্ত : তৎপর ভগবান আনন্দ স্থবির ও ভিক্ষুসংঘকে সঙ্গে নিয়ে কুশীনারা অভিমুখে যাত্রা করলেন। যাত্রা পথে বুদ্ধের বার বার রক্ত বাহ্য হলে তিনি অতিশয় ক্লান্ত হয়ে আনন্দকে বললেন, “আনন্দ, সংঘাটি চতুর্গুণ করে বিছাও, আমি ক্লান্ত , আমি বসব।” বুদ্ধ আসনে বসে আনন্দকে বললেন, “আনন্দ, পিপাসা লেগেছে, পানীয় জল পান করব।” 

সেদিন ছিল শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। ভগবান মহাভিক্ষুসংঘসমেত হিরণ্যবতী (বর্তমান নাম শোন মতান্তারে গন্ডক নদ) নদীর অপর তীরের কুশীনারার পূর্ব-উত্তর পাশের শালবনে উপনীত হলেন। সেখানে গিয়ে স্থবির আনন্দকে বললেন, “হে আনন্দ, তুমি আমার জন্য যমক শাল বৃক্ষের অন্তঃর্বর্তী স্থানে উত্তর শীর্ষ করে  মঞ্চ স্থাপন কর। আমি ক্লান্ত হয়েছি শয়ন করব।” স্থবির আনন্দ মঞ্চ প্রস্তুত করল। ভগবান মঞ্চে স্মৃতি ও জ্ঞানযোগে দক্ষিণ পায়ের উপর বাম পা কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম ভাবে রেখে দক্ষিণ পার্শ্ব হয়ে সিংহ শয্যায় শয়ন করলেন। পূর্বে ভগবান শয়ন করলে ‘অমুক সময় উঠব’ এই অধিষ্ঠান করে শয়ন করতেন কিন্তু এবারে তা করলেন না। এর কারণ হল এটি ভগবান তথাগতের অন্তিম শয়ন, এরপর তিনি আর এ শয়ন হতে উঠবেন না। সে সময় শালবন সর্বাংশে মুকুলিত ও পুস্পিত হল,  পুষ্পিত বৃক্ষের ফুলদল তথাগতের পূত পবিত্র অঙ্গে ঝরে পড়তে লাগল। 

বুদ্ধ ভিক্ষুদের কাছ হতে আনন্দের শোকাতুর রোরুদ্যমান অবস্থা অবগত হয়ে এক ভিক্ষুর মাধ্যমে তাঁকে ডেকে বললেন, “হে আনন্দ, তোমাদের তো আগেই বলেছি সমস্ত কিছুকেই প্রিয়জন-প্রিয়বস্তু হতে বিচ্ছিন্ন হতে হবে।  আনন্দ, তুমি কৃতপুণ্য ব্যক্তি, তোমা কর্তৃক দীর্ঘকাল তথাগত সেবা সম্পাদন হয়েছে।” 

লোকহিতকর বুদ্ধ গৌতম, যাঁর নৈতিকতা, বোধি ও মহাকরুণাবলে আসমুদ্রহিমাচল সাম্য ও শান্তির তলে ঠাঁই নিয়েছিলন। তাঁর করুণাপরশে, ঘাতক-দস্যু অঙ্গুলিমাল শান্ত-দান্ত ভিক্ষুতে রূপলাভ করেছিলেন; ঝাড়ুদার সুনীত হতে নাপিত উপালি, নগরসুন্দরী আম্রপালি, পুত্র-স্বামীহারা পটাচারা প্রমুখ জীবনের পরমার্থ খুঁজে পেয়েছিলন। 

তিনি মানবপুত্র বুদ্ধ। তিনি  মোহ হতে, দ্বেষ হতে, অন্ধতা-অজ্ঞতা হতে তিনি সদা জাগ্রত। তিনি মহাবোধসম্পন্ন সাম্যাচারী, তিনি পথের ধূলায় নেমেছিলেন রাজপ্রাসাদ হতে গণমুক্তির জন্য। ঐশ্বর্য, বিলাস, কামিনীকাঞ্চন ছেড়ে ভরা যৌবনেই তিনি প্রাসাদ ছেড়ে সাধারণের জন্য, সাধারণের কাতারে নেমে এসে করেছিলেন বহু দুষ্করচর্যা। 

কোন ভাব বা আবেগ নয়, ভয় বা লোভ নয়, কোন যুদ্ধ নয়, সঙ্ঘাত নয়, অস্ত্র নয়, নয় কোন অলৌকিক শক্তির জাদুকরী মন্ত্র। করুণা বিলিয়ে, আদর্শ দিয়ে, সচেতনতা ও কায় মনো-বাক্যের শুদ্ধিতা দিয়ে তিনি জগৎ জয়ী হয়েছেন। 

তিনিই পৃথিবীর আধুনিকতম মানব যিনি, অদৃশ্য স্বর্গের লোভ ও নরকের ভয় প্রদর্শনের চেয়ে আত্ম-পর কল্যাণের জন্য সৎ হতে বলেছেন। তাঁর শিষ্যদের প্রতি তাঁর উপদেশ ছিল অল্পেচ্ছু ও অল্পে তুষ্ট হয়ে জীবনবাহন করতে। 

শ্রী বিমল সরকার মহোদয় কতৃর্ক রচিত মহামানব  বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত  জীবনী, হলেই উপযুক্ত হবে, তিনি জাতক কাহিনী উল্লেখ করেছেন, তার তেমন পরিচিত প্রকাশ পায় নি, গ্রন্থে তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্য, তাঁর মানব হিতৈষী বাণী, বিভিন্ন কিছু তিনি প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় পরিবেশন করেছেন জনসাধারণের বোধগম্য করে। বেশ কিছু পালি শব্দ তথা বৌদ্ধ ধর্মীয় শব্দের, কিছু যথাযথ বাংলার খুব কাছাকাছি সমার্থক শব্দ মূল গ্রন্থে দিয়েছি, তিনি যেসব গ্রন্থ অধ্যয়ন করে গ্রন্থের অবতারণা করেছেন সেসব গ্রন্থে সর্বাস্তিবাদী গ্রন্থ ললিত বিস্তর গ্রন্থের তত্ব ও তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। আশা করি পাঠক সাচ্ছন্দ্তা অনুভব করবে। তিনি গ্রন্থটি রচনা করায় ধন্যবাদার্হ। প্রকাশককেও ধন্যবাদ জানাই।  অলং ইতি বিত্থারেন।


সুমনপাল ভিক্ষু

কোলকাতা

আষাঢ়ী পূর্ণিমা

২৫৬৮ বুদ্ধাব্দ 

২০২৪ ইং।

No comments:

Post a Comment