Friday, July 12, 2024

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম

 ভূমিকা


ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম - কখনও কখনও অজ্ঞেয়বাদী বৌদ্ধধর্ম, বৌদ্ধ অজ্ঞেয়বাদ,  বাস্তববাদী বৌদ্ধধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতা হিসাবেও উল্লেখ করা হয় - মানবতাবাদী, তত্ত্বগত মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে বৌদ্ধ ধর্মের একটি রূপের জন্য একটি বিস্তৃত শব্দ। বাস্তববাদ এবং (প্রায়শই) প্রকৃতিবাদ, অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক বিশ্বাসকে এড়িয়ে যাওয়া। 

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধরা বুদ্ধের শিক্ষা এবং বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিকে যুক্তিবাদী এবং প্রায়শই প্রমাণবাদী পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করে, যে সময়ে বুদ্ধের আবির্ভাব এবং যে সময়ে বিভিন্ন সূত্র ও তন্ত্র রচিত হয়েছিল তার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে।

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্মের মূল রয়েছে বৌদ্ধ আধুনিকতাবাদ এবং মানবতাবাদে এবং এটি ধর্মনিরপেক্ষকরণের বিস্তৃত প্রবণতার অংশ যা রেনেসাঁয় ধ্রুপদী গ্রীক সংস্কৃতির  পুনরুদ্ধারের পর থেকে পশ্চিমে চলমান রয়েছে। বিভিন্ন ধরণের বৌদ্ধ আধুনিকতার বিপরীতে, যা আধুনিকতার বক্তৃতার আলোকে বৌদ্ধ চিন্তাধারা এবং অনুশীলনের ঐতিহ্যগত স্কুলগুলির পরিবর্তন হতে থাকে, ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধ ধর্ম নিজেই ধর্মের মূল উপাদানগুলির পুনর্বিন্যাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই লক্ষ্যে এটি ঐতিহাসিক বুদ্ধ সিদ্ধার্থ গৌতমের মূল শিক্ষা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে, তবুও "বুদ্ধ আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন" তা প্রকাশ করার দাবি না করে বরং, এটি প্রাথমিক প্রামাণিক শিক্ষাগুলিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যা বুদ্ধের নিজস্ব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গাঙ্গেয় সমভূমির সংস্কৃতি) তাদের অর্থ রচিত হয় এবং  নিজেদের সময়ে বসবাসকারী মানুষের কাছে তাদের মূল্য এবং প্রাসঙ্গিকতা প্রদর্শন করে। 

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধ ধর্ম ভারতীয় ধর্মীয় সংস্কৃতির আধিভৌতিক বিশ্বাস এবং সোটেরিওলজিকে পিছনে ফেলে দেওয়ার শিক্ষা দান করে। এই সংস্কৃতি মানব জীবনকে দুর্ভোগের এক অপূরণীয় ক্ষেত্র হিসাবে দেখেছিল, যেখান থেকে একজনের একটি স্থায়ী-মানবীয় অবস্থার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত - এমন একটি অবস্থান যা কার্যত সমস্ত বৌদ্ধ বিদ্যালয়, সেই সঙ্গে হিন্দু ও জৈন ধর্ম স্থায়ী হয়। অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম এই জীবন এবং এই পৃথিবীতে পূর্ণ মানব বিকাশের পথপ্রদর্শক হিসাবে বুদ্ধের শিক্ষা প্রদান করেছে। 

ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম অর্থোডক্স বৌদ্ধ বিশ্বাসের অধিবিদ্যা দ্বারা বৈধ ক্ষমতা কাঠামো প্রত্যাখ্যান করে। এটি ধ্যান অনুশীলনের জন্য প্রমিত প্রায়োগিক পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে আধ্যাত্মিক অগ্রগতির ধারণা, সেই সঙ্গে এই ধারণাটি যে বৌদ্ধ অনুশীলন মূলত একটি ঐতিহ্যগত স্কুল বা শিক্ষকের কর্তৃত্ব দ্বারা অনুমোদিত ধ্যানের কৌশলগুলির একটি সেটে দক্ষতা অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত। পরিবর্তে, ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধধর্ম অনুশীলনের  উপর জোর দেয় , স্বায়ত্তশাসনকে উৎসাহিত করে এবং মানবতার প্রতিটি দিককে সমানভাবে  অন্তর্ভুক্ত করে, যেমনটি মহৎ অষ্টাঙ্গিক পথ (যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি, অভিপ্রায়, বক্তৃতা, কর্ম পদ্ধতি, জীবিকা, প্রচেষ্টা, মননশীলতা এবং একাগ্রতা), এই ধরনের একটি পদ্ধতি নির্দিষ্ট ব্যক্তি এবং সাম্প্রদায়িক চাহিদার জন্য বিস্তৃত প্রতিক্রিয়া তৈরি করার জন্য উন্মুক্ত, সব সময় এবং স্থানের জন্য বৈধ "আলোকিতকরণ" করার "একটি সত্য উপায়" থাকার উপর জোর দেয়।

 বৌদ্ধধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষ বলতে গেলে বিশাল আকার ধারণ করে, কিন্তু এই আলোচনা বিস্তৃতি না ঘটিয়ে অতি সংক্ষেপে পরিবেশিত হল। এই গ্রন্থের প্রকাশক সৃষ্টি প্রকাশনীকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। অলং ইতি বিত্থারেন।

                                                                                                                                   সুমনপাল ভিক্ষু
অক্ষয় তৃতীয়া
১৪৩০, বঙ্গাব্দ 
২৫৬৮ বুদ্ধাব্দ

একজন তীর্থযাত্রীর সঙ্গী (পবিত্র স্থানগুলিতে তীর্থযাত্রাকে উন্নত করতে বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে পাঠ)

 ভূমিকা

মূল লেখক ও সম্পাদক কেন এবং বিশাখা কাওয়াসাকি 

বৌদ্ধধর্মে অনেক তীর্থ, মহাতীর্থ ও ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। 'তীর্থ' শব্দের অর্থ হল 'পুণ্যস্থান'। সুতরাং যে স্থান দর্শন করলে পুণ্য অর্জন হয়, তাকে 'তীর্থস্থান' বলে, বুদ্ধের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহকে বৌদ্ধ 'তীর্থস্থান' বলা হয়। এ সকল পবিত্র স্থানগুলোকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- তীর্থ ও মহাতীর্থ। বুদ্ধের জীবনে নানা ঘটনাবহুল পবিত্র স্থানসমূহকে 'বৌদ্ধ তীর্থস্থান' বলা হয়। ঐতিহ্যমণ্ডিত স্মৃতিবহ এ সকল স্থানে বিহার, চৈত্য, স্তূপ প্রভৃতি নির্মিত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মে এ সকল স্থানকে 'তীর্থ' বলা হয়। যেমন, কপিলাবস্তু, শ্রাবস্তী, লুম্বিনী, বৈশালী, রাজগৃহ, প্রভৃতি। বুদ্ধের জীবনের উল্লেখযোগ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র স্থানগুলোকে 'মহাতীর্থ' বলা হয়। তীর্থস্থানগুলো হল পবিত্রস্থান, পুণ্যস্থান, পুণ্যক্ষেত্র। ধর্মপালনের মত তীর্থদর্শনও গুরুত্বপূর্ণ। চিত্তশুদ্ধি ও মনের শুচিতার জন্য তীর্থদর্শন উত্তম। মনের প্রসারতা বৃদ্ধি পায়। বুদ্ধ যেসব স্থানে গিয়ে ধর্মপ্রচার করেছেন, সেসব স্থান তাঁর জীবিতকালে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। এগুলো পবিত্র তীর্থস্থানরূপে বিবেচিত।

 বুদ্ধ লুম্বিনীতে জন্ম করেন, বুদ্ধগয়ায় বুদ্ধত্ব লাভ করেন, সারনাথে প্রথম ধর্মপ্রচার করেন এবং কুশীনগরে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। ভগবান বুদ্ধের উক্ত চারটি মহৎ ঘটনা এ চারটি স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। তাই এ চারটি স্থানকে 'মহাতীর্থস্থান' বলা হয়। বুদ্ধ জীবনের বিশেষ ঘটনাবলির জন্য আরো চারটি স্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্থানগুলো হলো- রাজগৃহ, বৈশালী, শ্রাবস্তী এবং সাংকাশ্য নগর। উপরি-উক্ত আটটি স্থান বৌদ্ধধর্মে 'অষ্টমহাতীর্থস্থান' নামে পরিচিত। বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্মের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো বৌদ্ধদের নিকট অতি পবিত্র পুণ্যভূমি। ঐতিহ্যমণ্ডিত স্মৃতিবহ এ সকল স্থানে বিহার, চৈত্য, স্তূপ, স্তম্ভ প্রভৃতি নির্মিত হয়েছে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে গৌতমবুদ্ধ বর্তমান নেপালের কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে জন্মগ্রহণ করেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর সর্বপ্রাণীর কল্যাণের জন্য বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করে তিনি ধর্ম প্রচার করেছেন। 

ঐতিহাসিক স্থান

বৌদ্ধদের অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। ঐতিহাসিক স্থানসমূহও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধ, বুদ্ধের শিষ্য, বৌদ্ধ রাজন্যবর্গ কিংবা প্রাচীন সভ্যতা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলার নিদর্শনসম্পন্ন স্থানকে ঐতিহাসিক স্থান বলা হয়। যেমন- গান্ধার, মথুরা, সাঁচি, অজন্তা, ইলোরা, তক্ষশীলা, নালন্দা প্রভৃতি। ঐতিহাসিক স্থান হল অতীতের বৌদ্ধ রাজা-মহারাজা বা স্বনামধন্য মহাপুরুষের রেখে যাওয়া কীর্তি। এসব কীর্তি কালের আবর্তে ধ্বংস হয়ে হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকরা আবার তা আবিষ্কার করেন। 

চার মহাতীর্থের মধ্যে লুম্বিনী প্রথম মহাতীর্থ। লুম্বিনী গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান। নেপালের দক্ষিণ সীমান্তের অন্তর্গত বুটন জেলার ভগবানপুর তহশিলের উত্তরে 'রুম্মিনদেই' নামক স্থানে অবস্থিত। শুদ্ধোদনের স্ত্রী রানি মহামায়া শ্বশুর বাড়ি থেকে পিত্রালয়ে যাবার পথে লুম্বিনী কাননে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয়। রাজপুত্রের জন্মের কারণে লুম্বিনীর পরিচিতি বৃদ্ধি পায় এবং এটি 'মহাতীর্থ' হিসেবে বিখ্যাত হয়।  লুম্বিনী মন্দিরের পাশেই আছে একটি অশোকস্তম্ভ। 

স্তম্ভে উৎকীর্ণ লিপি পাঠে জানা যায়, এখানেই সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয় এবং মহারাজ অশোক এ স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন তাঁর রাজত্বের বিংশতিতম বর্ষে। এখানকার প্রধান দর্শনীয় বস্তু হল অশোক স্তম্ভ ও রুম্মিনদেই মন্দির। সম্রাট অশোক তাঁর রাজ্য অভিষেকের ২০ বছরে দ্বিতীয়বার লুম্বিনী আগমন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দে তিনি সিদ্ধার্থের জন্মস্থানকে চিরস্মরণীয় ও চিহ্নিত করার জন্য একটি স্তম্ভ স্থাপন করেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে স্তম্ভটি আবিষ্কৃত হয়। এটি ‘অশোক গুপ্ত' নামে পরিচিত। অশ্বমূর্তি সিদ্ধার্থের সংসার ত্যাগের প্রতীক। স্তম্ভটি পরবর্তীকালে মাঝখানে ভেঙে গেলেও এর গায়ে যে শিলালিপি ছিল তা এখনো বর্তমান। শিলালিপিতে প্রাকৃত ভাষায় এরূপ খোদিত আছে - 'এ স্থানে শাক্যমুনি বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। স্তম্ভের গায়ে খোদিত অন্য অনুশাসনলিপি থেকে আরো জানা যায় যে, সম্রাট অশোক লুম্বিনী উদ্যান দর্শনের স্মারক এবং বুদ্ধের স্মৃতির প্রতি সম্মানার্থে এ স্থানকে করমুক্ত করেছিলেন। 

'বুদ্ধগয়া' হচ্ছে চার মহাতীর্থের একটি শ্রেষ্ঠ 'তীর্থ'। এটি অন্যতম মহাতীর্থ। যার প্রাচীন নাম ছিল উরুবেলা বা উরুবিল্ব। সিদ্ধার্থ গৌতম এখানে বোধিবৃক্ষের নিচে বসে সাধনার মাধ্যমে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমাতে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। তখন থেকে তিনি বুদ্ধ বা গৌতমবুদ্ধ নামে পরিচিত। তাই বুদ্ধগয়া জগতের বৌদ্ধদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র ও পুণ্যময় স্থান। বুদ্ধগয়া ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত। প্রাচীন নৈরঞ্জনা নদীর কূল বেয়ে গেছে এবং সে নদীর বর্তমান নাম ফল্গু নদী। বুদ্ধগয়ার প্রধান আকর্ষণ হলো বিশাল সুউচ্চ চারকোণা বুদ্ধমন্দির এবং মন্দিরের গা ঘেঁষে বোধিবৃক্ষ ও বুদ্ধের বজ্রাসন। এ বোধিবৃক্ষ এক ঐতিহাসিক বৃক্ষ। সপ্তম শতকে হিউয়েন সাং ভারত পরিভ্রমণ করতে এসে বোধিবৃক্ষ ও বজ্রাসন দেখতে পান। এ বজ্রাসন একটি অখণ্ড পাথরে নির্মিত বলে বর্ণিত। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে যে সমস্ত স্মৃতিসৌধ আছে তার মধ্যে বুদ্ধগয়ার এ মহাবোধি মন্দিরটি সবচেয়ে প্রাচীন। সম্রাট অশোকই সর্বপ্রথম এটা বড় করে নির্মাণ করেছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে বুদ্ধগয়ার এ মহাবোধি মন্দির এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। 

চার মহাতীর্থের একটি হচ্ছে সারনাথ। সারনাথের পূর্ব নাম ছিল ইসিপতন বা 'মৃগদাব'। গৌতম বুদ্ধ গয়ার বোধিবৃক্ষমূলে বুদ্ধত্ব লাভের পর জীবগণের মুক্তিলাভের জন্য প্রথম ধর্মপ্রচার করেন এই সারনাথে। সারনাথ বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য স্থান। ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বারাণসী থেকে প্রায় ৭ কিলোমটিার দূরে বরুণা নদীর তীরে সারনাথ অবস্থিত।  বুদ্ধগয়ায় জ্ঞানলাভের পর গৌতম বুদ্ধ সর্বপ্রথম যে পাঁচ শিষ্যের কাছে ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা করেন তাঁদের পঞ্চবর্গীয় শিষ্য বলে। তাঁদের নাম হচ্ছে কৌণ্ডিন্য, বপ্প, ভদ্দীয়, মহানাম ও অশ্বজিৎ। বুদ্ধ তাদের নিকট প্রথম যে সূত্র দেশনা করেছিলেন তা ধর্মচক্র প্রবর্তন নামে খ্যাত। বুদ্ধ এখানে ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র ছাড়াও আদিচ্চ পরিযোসান সুত্ত, রথাভর সুত্ত, সচ্চবিভঙ্গ সুত্ত, পস সুত্ত, কুঠবিষ সুত্ত প্রভৃতি আরও অনেক সূত্র দেশনা করেছিলেন।

 বুদ্ধ  ভিক্ষুদের বিভিন্ন দিকে ধর্ম প্রচারের জন্য পাঠান। পরবর্তীকালে সারিপুত্র, মৌদগল্যায়ন মহাকচ্চায়ন প্রমুখ মহাশ্রাবক বাস করতেন। হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায় যে তাঁর সময় সারনাথের সঙ্ঘরাম আটভাগে বিভক্ত ছিল। বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরেই সারনাথ ধীরে ধীরে বৃহৎ সংঘরামে পরিণত হয়। অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের অব্যবহিত পরেই সারনাথ পরিদর্শন করেছিলেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সৌজন্যে খননকার্যের ফলে এ স্থানে বহু ধবংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়েছে। 'ধর্মচক্র প্রবর্তনের স্মারক হিসেবে সম্রাট অশোক এখানে একটি স্তূপ নির্মাণ করেন। স্তূপটি পাথরের তৈরি। এর উচ্চতা ছিল ১৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৯৪ ফুট। চিনা পরিব্রাজক শুয়াং জাঙ স্তূপটি দেখেছিলেন । 

 তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন কুশীনগরে। বুদ্ধের সময়কালে স্থানটি মল্ল রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বুদ্ধের জীবনের চারটি প্রধান ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলে এ চারটি স্থানকে মহাতীর্থস্থান বলে। কুশীনগর বৌদ্ধদের অন্যতম পবিত্র তীর্থভূমি। এখানে গৌতম বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। প্রাচীনকালে কুশীনগর বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন, কুশীনারা, কুশীগ্রাম, কৃপাবর্তী ইত্যাদি।  গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্তের সময় হরিবল নামক এক বৌদ্ধ দাতা এখানে দীর্ঘ ২২ হাত লম্বা একটি শায়িত বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করেন। এর মধ্যে একটি 'পরিনির্বাণ তাম্রপট' নামে তামার পাত দেখা যায়। সম্রাট অশোক এই স্থান পরিদর্শন করে বুদ্ধের পরিনির্বাণ স্থান নির্দিষ্ট করেন। চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন কুশীনগর ভ্রমণ করেন। তিনি এখানে লোকবসতি বেশি দেখেননি বলে লিখে গেছেন।

শ্রাবস্তী হচ্ছে কোশল রাজ্যের এক সমৃদ্ধশালী নগরী। প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের শুরু খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। এর আগেও যে প্রাচীন ভারতে রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল না তা নয়, তবে সেই ইতিবৃত্তটি আজও তেমন স্পষ্ট নয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে প্রাচীন ভারতে ষোলোটি স্থানীয় রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই রাজ্যগুলির নাম বৌদ্ধগ্রন্থ অঙ্গুত্তর নিকয় তে পাওয়া যায়। বৌদ্ধসাহিত্যে এই রাজ্যগুলিকে ষোড়শ মহাজনপদ বলে অবহিত করা হয়েছে। এই ষোড়শ মহাজনপদগুলি হল: 'কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বজ্জি, মল্ল, চেদি, বৎস, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস, সুরসেনা, অস্মক, অবন্তী, গান্ধার এবং কম্বোজ। গঙ্গার উত্তরে ছিল কোশল রাজ্য। এই রাজ্যেরই এক সমৃদ্ধশালী নগরী ছিল শ্রাবস্তী। পালি ভাষায় শ্রাবস্তী হল সাবত্থি। বৌদ্ধ ঐতিহ্য বলে, সাবত্থি নগরীতে সাধু সাবত্থা বাস করতেন বলেই ঐ নাম। শ্রাবস্তী নগরীর নামসংক্রান্ত আরও একটি কাহিনি আছে। যেখানে শ্রাবস্তী নগরী গড়ে উঠেছিল সেখানেই এককালে একটি অতিথিশালা ছিল। অতিথিশালায় নানা রাজ্যের বণিকেরা সমবেত হত। বণিকেরা একে অন্যকে জিজ্ঞেস করত, কিম বানডাম আত্থি? (কী আছে সঙ্গে?) উত্তরে বলা হত, সব্বং অত্তি (আমাদের সব আছে)। এই সব্বং অত্তি শব্দ দুটো থেকেই হয়তো নগরীর নাম সাবত্থি বা শ্রাবস্তী হয়েছে।

গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে শ্রাবস্তী নগরীর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। সদত্ত ছিলেন শ্রাবস্তী নগরীর একজন ধনী শ্রেষ্ঠী। সুদত্ত ব্যবসায়ের কাজে মগধের রাজধানী রাজগৃহ নগরীতে গিয়েছিলেন। ওই রাজগৃহে নগরীতেই সুদত্ত প্রথম বুদ্ধকে দেখেছিলেন। বুদ্ধের সঙ্গে কথা বলে সুদত্ত বুদ্ধের এক পরম ভক্তে পরিণত হয়। বুদ্ধকে একবার শ্রাবস্তী যাওয়ার অনুরোধ করেন সুদত্ত। বুদ্ধ রাজী হন।

কিছুকাল পরের কথা। বুদ্ধ শ্রাবস্তী আসছেন; সঙ্গে কয়েক হাজার শিষ্য। এত লোককে কোথায় থাকবার আয়োজন করা যায়। সুদত্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শ্রাবস্তী নগরীর বাইরে যুবরাজ জেত এর বিশাল একটি বাগান ছিল। সুদত্ত বাগানটি কিনতে চাইলে জেত প্রথমে রাজী হননি। পরে অবশ্য শর্তসাপেক্ষে রাজী হলেন—স্বর্ণমুদ্রায় সম্পূর্ণ বাগান ঢেকে দিতে হবে। সদুত্ত সম্মত হলেন। সুদত্ত গোশকট করে স্বর্ণমুদ্রা এনে বাগান ঢেকে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। সুদত্তর পরম বুদ্ধভক্তি দেখে জেত অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি সুদত্তকে বাগানখানি দান করলেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সুদত্ত জেত এর নামে বাগানে নাম রাখেন জেতবন

বুদ্ধ শ্রাবস্তী এলেন। ধ্যান করলেন, দান করলেন; শ্রাবস্তী নগরীকে অমর করে রাখলেন। রাজকুমার জেত অসম্ভব ধনাঢ্য ছিলেন; তিনি বুদ্ধকে আঠারো কোটি স্বর্ণ মুদ্রা দান করেন।

সুদত্ত বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সুদত্ত অনাথদেরকে অন্ন (পিণ্ডক) দিতেন বলে তাঁকে অনাথপিণ্ডিক বলা হত। অনাথপিণ্ডিক নামটি বুদ্ধই দিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

তীর্থস্থান অতীত ইতিহাসের অনন্য সাক্ষী। তাই তীর্থস্থান ভ্রমণে ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। বৌদ্ধ তীর্থস্থানসমূহ শুধু বৌদ্ধ ধর্মীয় নয় বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনারও প্রামাণ্য দলিল। বুদ্ধ এবং প্রাচীনকালের রাজন্যবর্গ, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্ম-দর্শনের নানা ঘটনা তীর্থস্থানসমূহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন, বৌদ্ধতীর্থ সপ্তপর্ণী গুহায় প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ সঙ্গীতিতে মহাকশ্যপ স্থবিরের নেতৃত্বে এবং পাঁচশত পণ্ডিত অর্থৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে প্রথম বুদ্ধবাণী সংগৃহীত হয়েছিল। জানা যায়, রাজা অজাতশত্রু প্রথম সঙ্গীতি অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। সুতরাং সপ্তপর্ণী গুহা ভ্রমণে ত্রিপিটক সংকলনের ইতিহাস জানা যায়। পণ্ডিতগণ প্রাচীন তীর্থস্থানগুলোকে অতীতের সভ্যধর্মচক্র প্রবর্তনের স্মারক হিসেবে সম্রাট অশোক এখানে একটি স্তূপ নির্মাণ করেন। স্তূপটি পাথরের তৈরি। এর উচ্চতা ছিল ১৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৯৪ ফুট। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং স্তূপটি দেখেছিলেন। তা ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে গণ্য করেন। প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারগুলো শুধু ধর্ম নয়, নানা শাস্ত্রের শিক্ষাকেন্দ্রও ছিল। বুদ্ধ শিষ্যরা ধর্ম শিক্ষার পাশাপাশি জ্যোতিষশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, গণিতশাস্ত্র, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদিও শিক্ষা দিতেন। তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, প্রভৃতি প্রাচীন যুগের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এ শিক্ষাকেন্দ্র গুলোর ইতিহাস পাঠে।

তীর্থস্থানসমূহে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির নানা উপাদান ছড়িয়ে আছে। যেমন, বিভিন্ন তীর্থস্থানের ধ্বংসাবশেষ থেকে বিহারের অবকাঠামো, স্তূপ, স্তম্ভ, ভিক্ষুদের ব্যবহারের দ্রব্যসামগ্রী, বুদ্ধ-বোধিসত্ত্ব ও বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, প্রাচীন মুদ্রা, পোড়ামাটি ও পাথরের চিত্রফলক, অনুশাসনলিপি প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব প্রত্নসামগ্রী হতে প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। যেমন: অলঙ্কৃত ইষ্টক দ্বারা নির্মিত বিহারের অবকাঠামোতে সে যুগের উন্নত নির্মাণ শৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়। আবিষ্কৃত মূর্তিগুলো মূল্যবান পাথরে নিখুঁতভাবে নির্মিত, যা প্রাচীনকালের উন্নত ভাস্কর্য শিল্পের স্বাক্ষর বহন করে। চিত্রফলকগুলোতে তৎকালীন ধর্মীয় ও সমাজজীবনের নানা কাহিনী অঙ্কিত আছে। স্তূপ ও স্তম্ভ শীর্ষে স্থাপিত অশ্ব ও সিংহ মূর্তিগুলোতে অপরূপ শৈল্পিক সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটেছে। এসব বিবেচনা করে বলা যায়, তীর্থস্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম।


একজন তীর্থযাত্রীর সঙ্গী (পবিত্র স্থানগুলিতে তীর্থযাত্রাকে উন্নত করতে বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে পাঠ) মূল লেখক ও সম্পাদক কেন এবং বিশাখা কাওয়াসাকি গ্রন্থটি অনুবাদ করা হয়েছে শ্রীলঙ্কার প্রখ্যাত ভিক্ষু লেখক সুন্দর করে রচিত হয়েছে। যতটুকু সম্ভব সহজ ও সরল ভাষায় বঙ্গানুবাদ করতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, আমার পিতা মৃত্যুর পূর্বে প্রয়াত দুলাল চন্দ্র বড়ুয়া অনুবাদ কার্য করে গিয়েছেন, আমিও অর্ধেক করেছি। প্রয়াত দুলাল চন্দ্র বড়ুয়া ২০১৫ সালে সমগ্র  বৌদ্ধ তীর্থস্থান স্বচক্ষে ও শ্রদ্ধাসম্পন্ন হয়ে দর্শন করেছেন এবং বুদ্ধ বাণী সত্যিকার নিজে সারাজীবন প্রায়োগিক বিদ্যায় অনুশীলন করেছেন। আশা করি গ্রন্থ সফলতা লাভ করবে, পাঠকবৃন্দ অজানা তথ্য জানতে পারবেন এবং নিজেদের ঋদ্ধ করবেন।  অলং ইতি বিত্থারেন।


সুমনপাল ভিক্ষু


 

মহামানব বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত জীবনী

 ভূমিকা

 

গৌতম বুদ্ধ ছিলেন একজন তপস্বী, শ্রমণ। সর্বোপরি তিনি একজন সমাজসংস্কারক মানবতাবাদী যুগপুরুষ। যাঁর উদার চিন্তাধারা এবং যাঁর যুগপোযোগী শিক্ষার ভিত্তিতে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হয়। তিনি সিদ্ধার্থ গৌতম শাক্যসিংহ বুদ্ধ বা বুদ্ধ উপাধি অনুযায়ী শুধুমাত্র বুদ্ধ নামেও পরিচিত। আনুমানিক খ্রি.পূ. ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে প্রাচীন ভারতের পূর্বাঞ্চলে আবির্ভূত হয়েছিলেন ও তাঁর উপদেশিত ধর্ম বিঘোষিত হয়েছিল।

বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী ঐতিহ্যশালী জীবনী গ্রন্থগুলি সিদ্ধার্থ গৌতমের জীবনীর উৎস। দ্বিতীয় শতাব্দীতে অশ্বঘোষ দ্বারা রচিত 'বুদ্ধচরিত' নামক মহাকাব্যটি বুদ্ধের প্রথম পূর্ণ জীবনীগ্রন্থ। যেটি শ্রীরথীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক সংস্কৃত হতে প্রথম বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। তৃতীয় শতকে রচিত 'ললিত বিস্তর' গৌতম বুদ্ধের জীবনী নিয়ে লিখিত পরবর্তী গ্রন্থ। ১৯৯১ সালে বিজয়া গোস্বামী কর্তৃক অনূদিত হয় ও সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার হতে প্রকাশিত হয়।

চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত মহাসাঙ্গিক লোকোত্তর ঐতিহ্যের মহাবস্তু গ্রন্থটি অপর একটি প্রধান জীবনীগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হয়। এই গ্রন্থটি শ্রীরাধাগোবিন্দ বসাক কর্তৃক অনূদিত হয় ও সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী হতে প্রকাশিত হয়। তৃতীয় শতক থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত ধর্মগুপ্তের ঐতিহ্যের 'অভিনিষ্ক্রমণ সূত্র' গ্রন্থটি বুদ্ধের অপর একটি জীবনী গ্রন্থ। সর্বশেষ পঞ্চম শতাব্দীতে রচিত বুদ্ধঘোষ রচিত থেরবাদ ঐতিহ্যের 'নিদান কথা' উল্লেখ্য। এই গ্রন্থটিকে ত্রিপিটকের অংশ হিসেবে জাতক, মহাপদান সূত্র, আচরিয়ভূত সূত্রে বুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ জীবনী না থাকলেও কিছু নির্বাচিত অংশ রয়েছে। এই 'নিদান কথা' গ্রন্থটি ধর্মপাল ভিক্ষু কর্তৃক অনূদিত ও বৌদ্ধ ধর্মানকার সভা হতে প্রকাশিত হয়। এবং ভিক্ষু সুমনপাল কর্তৃক দ্বিতীয়বার অনূদিত হয় কিন্তু এটি এখনো প্রকাশের অপেক্ষায়।

বুদ্ধের এই সমস্ত ঐতিহ্যশালী জীবনী গ্রন্থ সাধারণ অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত কাহিনীতে পরিপূর্ণ। মহাবস্তু প্রভৃতি গ্রন্থে বুদ্ধকে লোকোত্তর সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি জাগতিক বিশ্বের সমস্ত ভার থেকে মুক্ত। কিন্তু তা হলেও এই সমস্ত গ্রন্থ থেকে খুঁটিনাটি সাধারণ বিবরণগুলিকে একত্র করেও অলৌকিক কথাকাহিনীগুলিকে অপসারণ করে বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে আলোকপাত সম্ভব হয়েছে।

সুতরাং কোন নামটা ঠিক সেটা নিয়ে মতভেদ আছে। তাঁর 'রাহুল' নামে এক পুত্র সন্তানও জন্মে। মায়াময় জগতের দুঃখ যে সমস্ত জীবকে ঘিরে রেখেছে সেই উপলব্ধি তখন নিশ্চয়ই একটা কিছু করার সংকল্পে পরিণত করেছিল তাঁকে। সুতরাং 'গৃহত্যাগ' ছিল অবশ্যম্ভাবী।

সুত্ত নিপাতের প্রব্রজ্যা সূত্রে বলা হয়েছে কী কারণে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেছিলেন। সংসার থেকে অপার্থিব কিছু অর্জন করা খুবই কঠিন। মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে না পারলে সংসারের পঙ্কিলতাতেই এক সময় ডুবে যেতে হবে। এটা সঠিক উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। তাই সংসারের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আকুল হয়ে উঠেছিলেন সিদ্ধার্থ। 

ঊনত্রিশ বছর বয়সে, পুত্র রাহুলের জন্মের পর সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেন। নিদান কথায় বলা হয়েছে যেদিন তিনি গৃহত্যাগ করেন সেদিন রাহুলের জন্ম হয়। অট্টকথায় বলা হয়েছে রাহুলের জন্মের সপ্তম দিনে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেন। 'অরিয় পরিয়েসন সুত্তে' তিনি নজের গৃহত্যাগের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। 'সো গো অহং ভিক্খবে অপরেন সময়েন দহরো ব সমানো সুসু কালকেসো ভরেন যোব্বানেন সমন্নগতো পঠমেন বয়স অধামকানং মাতা পিতুন্নং, অসুমুখানং রুদন্তানং, কেসসম্পুং ওহারেত্বা কাসাবানি বখানি আচ্ছাদেত্বা অগারস্মা অনাগারিয়ং পব্বজিং'। 'হে ভিক্ষুগণ আমি তখন তরুণ। আমার একটি চুলও পাকেনি ও পূর্ণ যৌবনে ছিলাম। আমার মা বাবা আমাকে অনুমতি দিচ্ছিলেন না। চোখের জলে তাঁদের মুখ ভিজে গেছিল। তাঁরা অনবরত কাঁদছিলেন। তাঁদের কান্না উপেক্ষা করে কিছুকাল পরে মস্তক মুণ্ডন করে ও গোঁফ দাড়ি ইত্যাদি মুড়িয়ে, কাষায় বস্ত্র পরিধান করে গৃহত্যাগ করে আমি সন্ন্যাসী হলাম।' উক্ত নিকায় মৃত্ত গ্রন্থ হতে প্রমাণিত হয় সিদ্ধার্থ রাতের অন্ধকারে কাউকে না জানিয়ে ঘর ছাড়েননি। সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগের পর প্রথম গেলেন কোশলে 'আলাঢ় কালামের কাছে। 'অরিয় পরিয়েসন' সূত্রে তাই উল্লেখ রয়েছে। 'মঙ্গলকর পথ ও শ্রেষ্ঠ, লোকোত্তর শান্তিময় তত্ত্বের সন্ধানে আমি আলাঢ় কালামের কাছে গেলাম।'

বুদ্ধ দেহত্যাগ (মহাপরিনির্বাণ লাভ) করেছেন এখন ২৫৬৮ বছরে পতিত হয়েছে। তিনি ৬২৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ৬ এপ্রিল শুক্রবার বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে হিমালয়ের পাদদেশে শাক্যজাতির রাজা শুদ্ধোধনের ঔরসে ও রাণী মহামায়াদেবীর  গর্ভ হতে কপিলবাস্তু নগরী ও দেবদহ নগরীর মধ্যস্থলের লুম্বিনী উদ্যানে জন্ম নেন। বৈশাখ মাসে চাঁদ বিশাখা নক্ষত্রে এসে এই পূর্ণিমা ঘটায়। তখন ছিল গ্রীষ্ম ঋতু, বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি, শুক্রবারের ভোরবেলা, সিংহলগ্ন, বৃশ্চিক ও বিশাখা নক্ষত্রের সম্মিলনক্ষণ এবং এটি ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৪ অব্দ। 

সম্যক সম্বুদ্ধত্ব উপলব্ধি : সুদূর সেই ৫৮৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথির পূর্ণচন্দ্র উদীয়মান, বুধবার ৩৫ বছর বয়সে  সিদ্ধার্থ ধ্যান মগ্ন হয়ে বজ্রাসনে উপবিষ্টাবস্থায় অস্তগামী সূর্যের মত ডুবে গেলেন ধ্যানের  গভীরে। ধীরে ধীরে কাম্যবস্তু হতে, অকুশল সব হতে বিবিক্ত করে সিদ্ধার্থের চিত্ত প্রবেশ করল সবিতর্ক, সবিচার, বিবেকজ প্রীতি সুখমন্ডিত প্রথম ধ্যানে। তদনন্তর তাঁর চিত্ত গিয়ে পৌঁছলো বিতর্ক বিচার উপশমে অধ্যাত্ম স্তরে, চিত্তের একীভাব আনয়নকারী বিতর্কাতীত বিচারাতীত সমাধিজপ্রীতি সুখমন্ডিত দ্বিতীয় ধ্যানে। ক্রমে প্রীতিতেও বীতরাগ হয়ে উপেক্ষারভাবে অবস্থান করতঃ স্মৃতিমান ও সম্প্রজ্ঞাত হয়ে স্ব-চিত্তে প্রীতি নিরপেক্ষ সুখানুভব করতে করতে তিনি লীন হলেন তৃতীয় ধ্যানে। 

অতঃপর, মধ্যম মার্গ আবিষ্কার করে দেশনা করেছেন সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধির কথা। পদব্রজে ছুটে বেরিয়েছেন সারা উত্তরভারতে, শিষ্য অনুরাগীদেরও শিক্ষা দিয়েছেন নিজে সৎ থেকে অপরকে সৎ হতে উপদেশ দিতে, দেশান্তরে ছড়িয়ে যেতে। জগতকল্যাণে তাঁর সেই ছুটে চলা, আসমুদ্রহিমাচল ছাড়িয়ে, প্রাচ্য হতে প্রচীত্যে।

কুশিনগর অভিমুখে যাত্রা বৃত্তান্ত : তৎপর ভগবান আনন্দ স্থবির ও ভিক্ষুসংঘকে সঙ্গে নিয়ে কুশীনারা অভিমুখে যাত্রা করলেন। যাত্রা পথে বুদ্ধের বার বার রক্ত বাহ্য হলে তিনি অতিশয় ক্লান্ত হয়ে আনন্দকে বললেন, “আনন্দ, সংঘাটি চতুর্গুণ করে বিছাও, আমি ক্লান্ত , আমি বসব।” বুদ্ধ আসনে বসে আনন্দকে বললেন, “আনন্দ, পিপাসা লেগেছে, পানীয় জল পান করব।” 

সেদিন ছিল শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। ভগবান মহাভিক্ষুসংঘসমেত হিরণ্যবতী (বর্তমান নাম শোন মতান্তারে গন্ডক নদ) নদীর অপর তীরের কুশীনারার পূর্ব-উত্তর পাশের শালবনে উপনীত হলেন। সেখানে গিয়ে স্থবির আনন্দকে বললেন, “হে আনন্দ, তুমি আমার জন্য যমক শাল বৃক্ষের অন্তঃর্বর্তী স্থানে উত্তর শীর্ষ করে  মঞ্চ স্থাপন কর। আমি ক্লান্ত হয়েছি শয়ন করব।” স্থবির আনন্দ মঞ্চ প্রস্তুত করল। ভগবান মঞ্চে স্মৃতি ও জ্ঞানযোগে দক্ষিণ পায়ের উপর বাম পা কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম ভাবে রেখে দক্ষিণ পার্শ্ব হয়ে সিংহ শয্যায় শয়ন করলেন। পূর্বে ভগবান শয়ন করলে ‘অমুক সময় উঠব’ এই অধিষ্ঠান করে শয়ন করতেন কিন্তু এবারে তা করলেন না। এর কারণ হল এটি ভগবান তথাগতের অন্তিম শয়ন, এরপর তিনি আর এ শয়ন হতে উঠবেন না। সে সময় শালবন সর্বাংশে মুকুলিত ও পুস্পিত হল,  পুষ্পিত বৃক্ষের ফুলদল তথাগতের পূত পবিত্র অঙ্গে ঝরে পড়তে লাগল। 

বুদ্ধ ভিক্ষুদের কাছ হতে আনন্দের শোকাতুর রোরুদ্যমান অবস্থা অবগত হয়ে এক ভিক্ষুর মাধ্যমে তাঁকে ডেকে বললেন, “হে আনন্দ, তোমাদের তো আগেই বলেছি সমস্ত কিছুকেই প্রিয়জন-প্রিয়বস্তু হতে বিচ্ছিন্ন হতে হবে।  আনন্দ, তুমি কৃতপুণ্য ব্যক্তি, তোমা কর্তৃক দীর্ঘকাল তথাগত সেবা সম্পাদন হয়েছে।” 

লোকহিতকর বুদ্ধ গৌতম, যাঁর নৈতিকতা, বোধি ও মহাকরুণাবলে আসমুদ্রহিমাচল সাম্য ও শান্তির তলে ঠাঁই নিয়েছিলন। তাঁর করুণাপরশে, ঘাতক-দস্যু অঙ্গুলিমাল শান্ত-দান্ত ভিক্ষুতে রূপলাভ করেছিলেন; ঝাড়ুদার সুনীত হতে নাপিত উপালি, নগরসুন্দরী আম্রপালি, পুত্র-স্বামীহারা পটাচারা প্রমুখ জীবনের পরমার্থ খুঁজে পেয়েছিলন। 

তিনি মানবপুত্র বুদ্ধ। তিনি  মোহ হতে, দ্বেষ হতে, অন্ধতা-অজ্ঞতা হতে তিনি সদা জাগ্রত। তিনি মহাবোধসম্পন্ন সাম্যাচারী, তিনি পথের ধূলায় নেমেছিলেন রাজপ্রাসাদ হতে গণমুক্তির জন্য। ঐশ্বর্য, বিলাস, কামিনীকাঞ্চন ছেড়ে ভরা যৌবনেই তিনি প্রাসাদ ছেড়ে সাধারণের জন্য, সাধারণের কাতারে নেমে এসে করেছিলেন বহু দুষ্করচর্যা। 

কোন ভাব বা আবেগ নয়, ভয় বা লোভ নয়, কোন যুদ্ধ নয়, সঙ্ঘাত নয়, অস্ত্র নয়, নয় কোন অলৌকিক শক্তির জাদুকরী মন্ত্র। করুণা বিলিয়ে, আদর্শ দিয়ে, সচেতনতা ও কায় মনো-বাক্যের শুদ্ধিতা দিয়ে তিনি জগৎ জয়ী হয়েছেন। 

তিনিই পৃথিবীর আধুনিকতম মানব যিনি, অদৃশ্য স্বর্গের লোভ ও নরকের ভয় প্রদর্শনের চেয়ে আত্ম-পর কল্যাণের জন্য সৎ হতে বলেছেন। তাঁর শিষ্যদের প্রতি তাঁর উপদেশ ছিল অল্পেচ্ছু ও অল্পে তুষ্ট হয়ে জীবনবাহন করতে। 

শ্রী বিমল সরকার মহোদয় কতৃর্ক রচিত মহামানব  বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত  জীবনী, হলেই উপযুক্ত হবে, তিনি জাতক কাহিনী উল্লেখ করেছেন, তার তেমন পরিচিত প্রকাশ পায় নি, গ্রন্থে তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্য, তাঁর মানব হিতৈষী বাণী, বিভিন্ন কিছু তিনি প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় পরিবেশন করেছেন জনসাধারণের বোধগম্য করে। বেশ কিছু পালি শব্দ তথা বৌদ্ধ ধর্মীয় শব্দের, কিছু যথাযথ বাংলার খুব কাছাকাছি সমার্থক শব্দ মূল গ্রন্থে দিয়েছি, তিনি যেসব গ্রন্থ অধ্যয়ন করে গ্রন্থের অবতারণা করেছেন সেসব গ্রন্থে সর্বাস্তিবাদী গ্রন্থ ললিত বিস্তর গ্রন্থের তত্ব ও তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। আশা করি পাঠক সাচ্ছন্দ্তা অনুভব করবে। তিনি গ্রন্থটি রচনা করায় ধন্যবাদার্হ। প্রকাশককেও ধন্যবাদ জানাই।  অলং ইতি বিত্থারেন।


সুমনপাল ভিক্ষু

কোলকাতা

আষাঢ়ী পূর্ণিমা

২৫৬৮ বুদ্ধাব্দ 

২০২৪ ইং।

সুরাপুর বা সিরপুর বৌদ্ধ প্রত্নক্ষেত্র

 ভূমিকা

 

সিরপুর বা শিরপুর শহরের উল্লেখ করা হয়েছে খ্রিস্টীয় ৫ম থেকে ৮ম শতাব্দীর এপিগ্রাফিক এবং টেক্সচুয়াল রেকর্ডে।  শহরটি একসময় দক্ষিণ কোশল রাজ্যের শারভপুরিয়া ও সোমবংশী রাজাদের রাজধানী ছিল।  এটি ছিল দক্ষিণ কোসল রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন বসতি।  এটি ৭ তম শতাব্দীর চীনা বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী শুয়াং জাঙ পরিদর্শন করেছিলেন।  সাম্প্রতিক খননে ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ১টি জৈন বিহার, বুদ্ধ ও মহাবীরের একক মূর্তি এবং ৫টি বিষ্ণু মন্দির, শক্তি ও তান্ত্রিক মন্দির উন্মোচিত হয়েছে৷

১৮৮২ সালে ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক কর্মকর্তা আলেকজান্ডার কানিংহাম পরিদর্শন করার পর সিরপুর একটি প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হয়ে ওঠে।  সিরপুরের একটি লক্ষ্মণ (লক্ষ্মণ) মন্দিরের বিষয়ে তার প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে।  ২০ শতকের প্রথম দিকে স্থানটি বিশ্বযুদ্ধের দশকগুলিতে অবহেলিত ছিল, এবং ১৯৫৩ সালে খনন কাজ পুনরায় শুরু হয়েছিল। ১৯৯০ এর দশকে এবং তারপরে বিশেষ করে ২০০৩ এর পরে আরও খনন করা হয়েছিল যখন ১৮৪ টি ঢিবি চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং কিছু বেছে বেছে খনন করা হয়েছিল।  এই খননের ফলে এখন পর্যন্ত ৫টি বিষ্ণু মন্দির, ১০টি বুদ্ধ বিহার, ৩টি জৈন মন্দির, ৬ষ্ঠ/৭ তম শতাব্দীর একটি বাজার এবং স্নান-কুন্ড (স্নান ঘর) পাওয়া গেছে।  প্রত্নতত্ত্ব স্হলটি ব্যাপক সমন্বয়বাদ দেখায়, যেখানে বৌদ্ধ এবং জৈন মূর্তি রয়েছে।

সিরপুর শহরের ধ্বংস এবং কিসের কারণে রাজধানীর আকস্মিক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে তার দুটি তত্ত্ব রয়েছে। একজনের মতে একটি ভূমিকম্প সমগ্র অঞ্চলকে সমতল করে এবং লোকেরা রাজধানী ও রাজ্য পরিত্যাগ করে।  অন্যটি একটি বিপর্যয়কর ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন।

সিরপুর "প্রাথমিক মধ্যযুগ থেকে ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য" এর জন্য একটি প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।  গেরি হকফিল্ড মালান্দ্রের মতে, সিরপুর ছিল প্রাচীন ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য ব্রোঞ্জ ওয়ার্কশপ এবং সিরপুর থেকে খনন করা বৌদ্ধ ব্রোঞ্জের শিল্পকর্মগুলি সেই যুগের "শ্রেষ্ঠ ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য"গুলির মধ্যে একটি। সিরপুর এবং ইলোরা গুহাগুলির মধ্যেও অসাধারণ মিল রয়েছে। মালন্দ্রের মতে রত্নাগিরি, এবং এটি দুই অঞ্চলের মধ্যে ধারণা এবং শিল্পীদের প্রবাহের পরামর্শ দিতে পারে।

সিরপুর, প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ এবং শিলালিপিতে শ্রীপুর এবং শ্রীপুরা (আক্ষরিক অর্থে, "শুভ, প্রাচুর্যের শহর, লক্ষ্মী") নামেও উল্লেখ করা হয়েছে, এটি রায়পুর থেকে ৭৮ কিলোমিটার (৪৮ মাইল) পূর্বে মহানদী নদীর তীরে অবস্থিত একটি গ্রাম। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর এলাহাবাদ স্তম্ভের শিলালিপিতে সিরপুরকে শ্রীপুরা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।  খ্রিস্টীয় ১ম সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে, এটি ছিল দক্ষিণ কোসল রাজ্যের প্রধান বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য সহ রাজধানী শহর। প্রাচীনতম নথিভুক্ত প্রমাণগুলি বলে যে এটি প্রথমে শারভপুরিয়া রাজবংশের রাজধানী ছিল, তারপরে পান্ডুবংশী রাজবংশ। শরভপুরিয়া রাজবংশ ৫ম শতাব্দীর শেষের দিকের তারিখ, কিন্তু শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে এটির প্রথম রাজধানী ছিল শরভপুর, এখনও একটি অজানা স্থান।

এই অঞ্চলে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগের প্রচুর শিলালিপিতে হিন্দু শৈব রাজা তিবর্দেব এবং ৮ম শতাব্দীর রাজা শিবগুপ্ত বালার্জুন তাঁর রাজ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈনদের জন্য বিহার, মন্দির ও মঠ স্থাপনের উল্লেখ রয়েছে। চীনা তীর্থযাত্রী এবং ভ্রমণকারী শুয়াং জাঙ তাঁর স্মৃতিচারণে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে সিরপুর সফরের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে রাজা ছিলেন একজন ক্ষত্রিয় এবং বৌদ্ধদের প্রতি হৃদ্যতায় অঞ্চলটি সমৃদ্ধ ছিল।  তাঁর স্মৃতিকথা অনুসারে, প্রায় ১০,০০০ মহাযান বৌদ্ধ ভিক্ষু (ভিক্ষু) এখানে প্রায় ১০০টি বিহারে বাস করতেন এবং ১০০টিরও বেশি মন্দির ছিল।

আনন্দ প্রভু কুটি বিহার: হিন্দু রাজা শিবগুপ্ত বালার্জুনের পৃষ্ঠপোষকতায় ভিক্ষু আনন্দ প্রভু দ্বারা নির্মিত একটি মন্দির এবং ১৪ কক্ষের বিহার, যাকে কিছু শিলালিপিতে আনন্দ প্রভা বলা হয়েছে। বিহার এবং মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে রয়েছে অবলোকিতেশ্বর এবং মকরওয়াহিনী গঙ্গের একটি স্মৃতিস্তম্ভ। সিরপুর স্থানে পাওয়া একটি পাথরের শিলালিপি, সংস্কৃতে নাগরী লিপিতে লেখা এবং খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীর মাঝামাঝি বৈদিক মিটারের (অনুস্তুভ, স্রাগধারা, আর্য, বসন্ততিলক এবং অন্যান্য) মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে। শিলালিপিতে বলা হয়েছে শুভ চিহ্ন ওম এবং সিদ্ধাম দিয়ে শুরু, সুগত (বুদ্ধ) প্রশংসা করে তারপর রাজা বলার্জুনের প্রশংসা করেন। এর পরে এটি সন্ন্যাসী আনন্দপ্রভাকে উল্লেখ করেছে, যিনি বুদ্ধের প্রতি নিবেদিত মারাভারিন (মারার শত্রু) এবং পুনর্জন্ম ও মৃত্যুর চক্রের ধ্বংসকারী। শিলালিপিতে বলা হয়েছে যে রাজা একটি "বিহার কুটি" (সংঘারাম আবাসস্থল) এবং সেখানে সমস্ত ভিক্ষুদের জন্য একটি বিনামূল্যে খাওয়ানোর ভোজনশালা স্থাপন করেছিলেন যেখানে সেটিক এবং ব্যাঞ্জনা (মশলা সহ ভাতের খাবার) "যতদিন সূর্য আকাশে শোভা পায়" (চিরস্থায়ী)। তারপরে শিলালিপি কবিতাটি সন্ন্যাসীদের রাজার উপহারের চেতনা, সম্পদের অস্থিরতার কথা মনে করিয়ে দেয়, যে ধর্মই দুঃখ-ভরা জাগতিক অস্তিত্বের একমাত্র রক্ষাকারী অনুগ্রহ। শিলালিপিটি শিল্পীর স্বাক্ষরিত যিনি এটি বিহারের জন্য তৈরি করেছিলেন।

স্বস্তিকা বিহার: ১৯৫০-এর দশকে খনন করা, এই স্মৃতিস্তম্ভের বিন্যাসের বায়বীয় দৃশ্য স্বস্তিক চিহ্নের কথা মনে করিয়ে দেয়।  এই স্থানটিতে বৌদ্ধ যুগের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বুদ্ধ মূর্তি এবং ধাতব মূর্তি পাওয়া গেছে।  বুদ্ধের সঙ্গে পদ্মপানির মূর্তি ছিল একটি মাছি ঝাঁকুনি বহন করে।

তিভার দেব: দক্ষিণ কোশল যুগের একটি বিহার, এই বিহার, তিভ্রদেব নামেও পরিচিত।  বিহারটি সমন্বিত, একজন শৈব রাজা এবং তার বৌদ্ধ রাণী দ্বারা নির্মিত, এটি হিন্দু এবং বৌদ্ধ থিম দেখায়।  স্মৃতিস্তম্ভটি বৌদ্ধ ও হিন্দু শিল্পকলার সমন্বিত সংগ্রহ, কারণ এটি বুদ্ধ মূর্তি এবং বৌদ্ধ শিল্পকর্মের মিল দেখা যায়। 

যদিও রাজারা যথাক্রমে বৈষ্ণব এবং শৈব ছিলেন তবুও পান্ডুবংশী শাসকরাও বৌদ্ধধর্মের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন।  খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে  সোমবংশী রাজা তিভারদেবের সময়ে, সিরপুর গৌরবের শীর্ষে পৌঁছেছিল। শুয়াং জাঙ ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে সিরপুর সফর করেন পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে।

বৌদ্ধধর্মের মহাযান সম্প্রদায় থেকে ৭ম-৮ম শতাব্দীতে একটি যৌগিক ধর্মীয় রূপ গড়ে উঠেছিল। সিরপুর বজ্রযান ধর্ম বা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং এর উৎপত্তি তাদের নারী সমকক্ষদের সঙ্গে ধ্যানী বুদ্ধের বোধিসত্ত্বের মতবাদের ধারণার জন্য।  তারা বিভিন্ন আঙ্গিকে মূর্তি পূজার সঙ্গে যুক্ত রহস্যময় প্রভাব সহ আচারের উপর জোর দিয়েছিল। ধ্যানী বুদ্ধ, রত্নপানি, বজ্রপানি, মঞ্জুশ্রী, তারা, জাম্বল, ভৃকুটি, প্রজ্ঞাপারমিতা, বিজরাতারা, বসুধারার ছবি এবং এই বিহারের কিছু খোদাই করা ছবি স্পষ্টভাবে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রভাবকে নির্দেশ করে।

বিদিশা, উজ্জয়িন, উদয়গিরি, নাগপুর প্রভৃতি মধ্য ভারতের শিল্পকেন্দ্রের আশেপাশে সিরপুর তার শিল্প ঐতিহ্যে স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হয়েছিল। এবং তাদের পরিধি দিয়ে শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু গড়ে তুলেছে। এটি শিল্প শৈলী, বাগধারা এবং পদ্ধতিতে কমবেশি সাদৃশ্য বজায় রাখে। পেরিফেরি অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায়, গুপ্ত শিল্পের উত্তরাধিকারের যোগসূত্রের সঙ্গে যা ভাকাটক শিল্পের সঙ্গে তার পূর্ণ বিশিষ্টতার সঙ্গে একটি প্যান ইন্ডিয়ান চরিত্র অর্জন করেছে – সিরপুর তার নিজস্ব একটি স্ট্যাম্পের সাক্ষী। সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্গত পাথরের ভাস্কর্যগুলির একটি ভাল সংখ্যক তাদের আদিবাসী শৈলী প্রমাণ করে।

১৩ জানুয়ারী, ২০০৮-এ এসপিআর-৩১ (লক্ষ্মণ মন্দির থেকে প্রায় ২৫০ মিটার দূরে একটি বিহার জায়গায় একটি খনন করা পরিখা) থেকে বৌদ্ধ দেবতাদের ঊনশত্তরটি ব্রোঞ্জের মূর্তি, স্তূপের প্রতিরূপ, কাঁচামাল এবং মডেলিং যন্ত্রের একটি মজুত পাওয়া গেছে।  

আবিষ্কারটি শনাক্ত করেছে যে ৮ম শতাব্দীতে সিরপুরের নিজস্ব ধাতু খোদাই শিল্প ছিল।  গেরি হকফিল্ড মালান্দ্রের মতে, সিরপুর ছিল প্রাচীন ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য ব্রোঞ্জ ওয়ার্কশপ এবং সিরপুর থেকে খনন করা বৌদ্ধ ব্রোঞ্জ শিল্পকর্মটি সেই যুগের "উৎকৃষ্ট ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য"গুলির মধ্যে একটি। ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব, বজ্রতারা, মঞ্জুভরা, পদ্মপানি, মজুশ্রী ইত্যাদি তাদের ড্র্যাপারির চিকিৎসা এবং পুরু মোল্ডিং বা পুঁতিযুক্ত রেখা সহ বিভিন্ন প্রভামণ্ডল সূক্ষ্ম খোদাই দেখায়। মহাযান বৌদ্ধধর্ম এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের একটি ঘনিষ্ঠ সমন্বয় বৌদ্ধ মূর্তিগুলির প্রতিমায় পাওয়া যায়। মোট আশিটি ব্রোঞ্জের ছবিগুলি স্থানীয় ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে অলঙ্কার, পোশাক এবং তাদের শারীরিক অভিব্যক্তিতে একটি মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য ধারণ করে যা মানুষের জন্য শান্তি, প্রশান্তি এবং ভালবাসার অনুভূতি দেয়।

২০১৭ সালে আমি পুরো পুরাতাত্ত্বিক সাহস গুলো নিজে পরিভ্রমণ করেছি, তাতে এটাই স্পষ্ট ধারণা করা যায় য, সমগ্র বৌদ্ধ প্রত্নস্হল গুলোকে ভিন্ন ধিকে ধাবিত করা হচ্ছে এবং ভিন্ন নামকরণ করে বিভিন্ন দেবদেবীর তথা শিবলিঙ্গ স্থাপনা করা হচ্ছে, কিন্ত প্রশাসন তথা এ এস আই নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে।


সুরাপুর বা সিরপুর বৌদ্ধ প্রত্নক্ষেত্র গ্রন্থটি প্রকাশ করার জন্য ছোঁয়া প্রকাশনীর কর্ণধারকে আন্তরিক কৃতজ্ঞত ও ধন্যবাদ জানাই। ইতিপূর্বে এ জাতীয় গ্রন্থ বা সুরাপুর বা সিরপুর বৌদ্ধ প্রত্নক্ষেত্র নিয়ে কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। আশা করি পাঠক নতুন ইতিহাসের সন্ধান পাবেন এবং বৌদ্ধ স্হল সম্পর্কে অবগত হবেন। ইতিহাসবিদ ও ইতিহাসের ছাত্র ছাত্রীরাও নতুন করে গবেষণায় নিজেদের সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবেন। অলং ইতি বিত্থারেন।


সুমনপাল ভিক্ষু

কোলকাতা

আষাঢ়ী পূর্ণিমা 

২৫৬৮ বুদ্ধাব্দ 

২০২৪ ইং