Saturday, December 3, 2022

 নিববান(সং নির্বাণ)

'নি' উপসর্গের সঙ্গে  'বাণ' শব্দের সমাসে নির্বাণ পদ সিদ্ধ হয়। ' বাণ' তৃষ্ণারই নামান্তর। 'নি' উপসর্গ তৃষ্ণার অভাব বা অতিক্রম অর্থ প্রকাশ করছে। অর্থাৎ যা উপলব্দি করলে জন্মজন্মান্তরে কৃত তৃষ্ণাবন্ধন ছিন্ন করা যায় এবং রাগ-দ্বেষ-মোহাদি নির্বাপিত করতে সমর্থ, তারই নাম নির্বাণ। ভারতীয় দর্শনে ও অধ্যাত্ম সাধনায় নির্বাণ বৌদ্ধধর্মের শ্রেষ্ঠ দান। ভারতীয় তথা বিশ্বের দার্শনিক চিন্তা এতদিন যেখানে ব্যাহত ছিল,গৌতম বুদ্ধের তপস্যার উৎকর্ষতা ও অপ্রতিহত গতি সে সীমা অতিক্রম করলো। বুদ্ধ আবিষ্কার করলেন - জীব কার্যকারণ প্রবাহের স্থূল প্রতীক এবং জীবের চরম পরিণতি নির্বাণে। দুঃখ জীবের চিরসঙ্গী। তাই দুঃখের নিরবশেষ অবস্থা বা চরম দুঃখমুক্তিই জীব যুগে যুগে কামনা করে এসেছে।ভারতের মুনি-ঋষিগণ যুগে যুগে এই দুঃখমুক্তির জন্যই তপস্যা করে এসেছেন। কিন্তু কেউ সম্পূর্ণরূপে সফলকাম হননি। বুদ্ধ সফল হয়েছেন নিজের চেষ্টার দ্বারা, কঠোর তপস্যার দ্বারা। আজ আড়াই হাজার বছরেরও অধিক কাল যাবত বিশ্বের দার্শনিকগণ বুদ্ধের এই আবিষ্কারকে মেনে নিয়েছেন, স্বীকৃতি দিয়েছেন। বুদ্বের এই আবিষ্কারের সমন্তরাল বা উচ্চতর কোন আবিষ্কারের কথা অদ্যাবধি শোনা যায় নি। তাই নির্বাণধর্ম  আবিষ্কারের জন্য বুদ্ধকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মহাপুরুষরূপে এবং অধ্যাত্মবিদ্যার শ্রেষ্ঠতম শাস্তারূপে পরিগণিত করা যায়। নির্বাণ লোকোত্তর একটিঅবস্থা। তাই লৌকিক ভাষা দিয়ে নির্বাণকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বুদ্ধের সমস্ত বাণী যুক্তিসম্মত। কিন্তু তার আবিষ্কৃত নির্বাণ অতর্কাবচর। তর্ক দ্বারা ইহার উপলব্ধি সম্ভব নয়। যেহেতু তর্ক অপ্রতিষ্ঠ, একজন তার্কিকের সীমাবদ্ধ সঙ্কল্প অপরে খণ্ডন করে। নির্বাণ অকারণসম্ভূত।  তাই নির্বাণের  উৎপত্তিও নেই বিনাশও নেই। নির্বাণ কালাতীত বলে ইহা ধ্রুব। ধ্রুব বলেই  ইহা শুভ এবং ধ্রুব ও শুভ বলেই নির্বাণ হচ্ছে 'পরমং সুখং'।
পূর্বেই উক্ত হয়েছে - নির্বাণ হচ্ছে রাগ-দ্বেষ-মোহের চরম নিবৃত্তির অবস্থা। বুদ্ধ বলেছেন - এই জগত প্রজ্বলিত। রাগাগ্নির দ্বারা প্রজ্বলিত,দ্বেষাগ্নির দ্বারা প্রজ্বলিত, মোহাগ্নির দ্বারা প্রজ্বলিত। জন্ম-জরা-ব্যাধি-মৃত্যু-দুঃখ-দৌর্মনস্য-শোক-উপায়াস -অগ্নির দ্বারা প্রজ্বলিত।'                    নির্বাণকে জাগতিক ভাষা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয় বলে একথা মনে করা ভুল যে, নির্বান হচ্ছে শূণ্যাবস্থা,উচ্ছেদাবস্থা। একথা কারো বলা উচিত নয় যে, 'আলো' নেই, যেহেতু অন্ধ তা দেখতে পায় না। বিদ্যুদ্বাহী তারে আগুন দেখা যায় না বলে একথা মনে করা ভুল যে বিদ্যুতে আগুন নেই। নির্বাণও  ঠিক তদ্রূপ। নির্বাণ েমন একটি ধর্ম বা অবস্থা যা অজাত,অনুৎপন্ন, অসংস্কৃত এবং নিরাকার। তাই নির্বাণ হচ্ছে ধ্রুব, শুভ এবং সুখ।
নির্বাণ বলে কোন স্থান নেই, স্বর্গ নেই। এই দেহের উপরই নির্বাণ নির্ভরশীল।ইহা এমন একটি অবস্থা যা সর্বজন অনুভূতি গোচর। এই লোকোত্তর অবস্থাকে ইহ জন্মেই প্রত্যক্ষ করা যায়। উপলব্দি করা যায়। বৌদ্ধধর্ম একথা বলে না যে মৃত্যুর পরেি নির্বাণ লাভ করা যায়। এখানেই বৌদ্ধ নির্বাণ এবং অন্যান্য ধর্মের স্বর্গ-মোক্ষলাভের (যা কেবল মৃত্যুর পর লাভ করা যায়)বা পরমেশ্বরের সঙ্গে একাত্মভূত হওয়ার মধ্যে পার্থক্য। বুদ্ধ গয়ার বোধিবৃক্ষমূলে বুদ্ধত্বলাভ  করে এই পঞ্চস্কন্ধময় দেহ বর্তমান থাকলেও নির্বাণসুখ উপলব্ধি করেছিলেন। বৌদ্ধদের ভাষায় বুদ্ধের এই নির্বাণের নাম সোপাদিশেষ নির্বাণ। আর কুশীনগরে যখন বুদ্ধ এই পঞ্চস্কন্ধময় দেহ ত্যাগ করে চলে যান তখন তাঁর  ঐ নির্বাণের নাম অনুপাদিশেষ নির্বাণ। দুই প্রকার নির্বাণের অবস্থাই অনির্বচনীয়।

No comments:

Post a Comment