Saturday, December 3, 2022

ভিক্ষুসংঘ ও গৃহীসংঘের প্রগতি কুঞ্চিকা

ভিক্ষুসংঘ ও গৃহীসংঘের প্রগতি কুঞ্চিকা
 সুমনপাল ভিক্ষু 

 ভদন্ত কুশলায়ন মহাথের' র বর্ণাঢ্য জীবনশৈলী 


ভদন্ত কুশলায়ন মহাথের বাংলাদেশী বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘে একজন প্রগতিশীল খ্যাতিসম্পন্ন আদর্শ সাংঘিক ব্যক্তিত্ব। বৌদ্ধ দেশ মায়ানমার (বার্মার) আকিয়াব শহরের অদূরে বহু বৌদ্ধ পুরানো সুকীর্তির পীঠস্থান,  ধ্যানোদীপ্ত সাধক ত্যাগ পুরুষের জন্ম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত অরণ্য ও পাহাড়ঘেরা মামরার চাইন্তুং গ্রামে। তাঁর আবির্ভাব ১৯৬৫ নভেম্বর ২, বুধবার ; পিতা ধর্মপ্রাণ বাবু ভুলুচরণ বড়ুয়া ও মাতা রত্নগর্ভা পুণ্যশীলা শ্রীমতী কুঞ্জবালা বড়ুয়া। পরে পিতৃব্য পূরুষের নাড়ির টানে বাংলাদেশে জাগতিক ভোগ বিলাসের ক্ষণস্থায়ী দুঃখময় সংসারের মায়া মরিচিকা ত্যাগ করে 'ভোগে দুঃখ, ত্যাগেই সুখ' এ সত্যকে উপলব্ধি করে নিজের জীবনকে সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষায় সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ১৯৮৫ ডিসেম্বর ৫ বৌদ্ধ শাসনের প্রতি অনুরাগী হয়ে প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর দীক্ষা গুরু সব্যসাচী সংঘমণিষী অগ্রমহাপণ্ডিত প্রজ্ঞালোক মহাথের' র কনিষ্ঠ শিষ্য, সমাজ সংস্কারক, প্রয়াত পণ্ডিত শাসনবংশ মহাথের। পরবর্তীতে তাঁরই উপাধায়ত্বে উপসম্পদা গ্রহণ করেন ১৯৯৫ ফেব্রুয়ারী ২৪। 

পরমপূজ্য ভন্তের অনাগারিক জীবনের শুরু হতেই বিবিধ ধর্মীয়।
আদর্শের প্রতিষ্ঠা ও প্রচলন করেন এবং বুদ্ধের পথ অনুসরণ করে প্রচার বিমুখ হয়ে সদ্ধর্মের প্রচারে ও মানবতার বহুমুখী কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তাঁর জীবন চরিত বিদ্যাবত্তা,জ্ঞান গরিমা, আদর্শনিষ্টা, ত্যাগ- সহনশীলতা, পরকল্যাণ মানসিকতা, শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার যথাযথ অনুশীলন এবং মৈত্রী, করুণা, অহিংসা ও আত্নসংযম গুণাদি অনুকরণ ও শিক্ষণীয়। তিনি একাধারে একজন বহু শাস্ত্রবিদ্, ধর্ম বিনয়ে পারঙ্গম, লেখক, দেশক, প্রচারক, দক্ষ সংগঠক, সমাজ সংস্কারক ও পৃষ্ঠপোষক। এসব মহিমান্বিত গুণের যথার্থ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন এবং বুদ্ধ শাসনের চিরস্থায়ীর নিমিত্তে ২০০০ 'জ্ঞানসেন বৌদ্ধ ভিক্ষু-শ্রামণ প্রশিক্ষণ ও সাধনা কেন্দ্র' নামে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যেখানে শতাধিক ভিক্ষু - শ্রামণের অবস্থান বিদ্যমান। এই প্রতিষ্ঠান থেরবাদ বৌদ্ধদর্শের সু-শৃঙ্খল ও বিনয়ী আচার আচরণ প্রতিপালন ও সম্প্রচারণে প্রভূত ভূমিকা পালন করে আসছে। তাঁর  জীবনের অন্য আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে -আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে তাল মিলিয়ে স্বধর্ম রক্ষায় যুবক সমাজকে বুদ্ধের মহান শিক্ষায় অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে ধর্মের প্রচার ও প্রসারে প্রভাবিত করা। তাঁর গুণে বিমুগ্ধ ও অনুরাগী হয়ে বর্তমানে প্রায় অর্ধশতাধিক আধুনিক উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও ধর্ম-বিনয় সুদক্ষ ভিক্ষু সংঘ দেশ বিদেশে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
পরমপূজ্য ভন্তে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিয় ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, প্রচার বিমুখ এক দীপ্তিমান পুণ্যপূরুষ বহুদিন ধরে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন শাসন-সদ্ধর্মের শ্রীবৃদ্ধি এবং এটি বাস্তব সম্মত আদর্শ বৌদ্ধিক সমাজ গঠনে ভূমিকা রেখে চলেছেন। ধর্ম ও সমাজ দর্শন সফলতার সঙ্গে কার্যকরী করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর মধ্যে স্ব-জাতি প্রেম মৈত্রী যেমন রয়েছে তেমনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিপন্ন বিশ্ব মানবতায় সংকট মোকাবিলায় মানবতার জয়গানেও তিনি ভূমিকা রেখে চলেছেন। বৌদ্ধদের সুরক্ষা ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বেশেষে সকলের কল্যাণের জন্য একটি বিশাল অঙ্কের জাতীয় তহবিল গঠন এবং স্ব-জাতিকে আরো অর্থনৈতিক ভাবে সু-সংগঠিত করার যুগান্তকারী সিন্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তাঁর ৪৭ তম জন্মদিন ২ নভেম্বর, ২০১২  'বিশ্বজ্যোতি মিশন কল্যাণ ট্রাষ্ট' একটি ট্রাষ্ট গঠন করেন। এ ট্রাষ্টের অধীনে শাসন-সদ্ধর্ম ও জাতির বহুবিধ কল্যাণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে বৃত্তি প্রদান, মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের আর্থিক অনুদান, প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সহয়তা, অসহায় মানুষদের শীতবস্ত্র ও ঔষুধ বিতরণ, গরীব ও দুঃস্থদের আর্থিক সহায়তা, ত্রিপিটকের গ্রন্থ অনুবাদ ও ধর্মীয় গবেষণামূলক প্রকাশনা প্রকাশ, 'ত্রৈমাসিক জ্যোতি প্রত্রিকা' প্রকাশ, পুরানো জরাজীর্ণ বিহার ও তীর্থস্থান সংস্কার, দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্থ ও অসহায় নারীদের বিবাহদানে অন্যান্য মানবিক সহায়তাসহ ধর্মীয় ও আর্থসামাজিক জনহিতকর ও কল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। 

শিশুদের বিহারমুখী করে প্রতিটি বৌদ্ধ পল্লিতে ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টি ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে প্রভাতি শিশু শিক্ষা কার্যক্রম প্রচলনের লক্ষ্যে ২০০১ জানুয়ারি ১ স্বীয় গুরুদেবকে নতুন প্রজন্মের মাঝে চিরস্মরণীয় রাখার অভিপ্রায়ে 'শাসনবংশ প্রভাতী সদ্ধর্ম শিক্ষা নিকেতন' নামে একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় শিশু শিক্ষার প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে মর্নিং শিশু শিক্ষা, ধর্মীয় মেধা বৃত্তি পরীক্ষা, ধর্মীয় গাথা আবৃত্তি ও প্রতিযোগিতা, বৌদ্ধ নৈতিকতার শিক্ষা, প্রাথমিক বন্দনা-উপাসনা শিক্ষাসহ ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছেন। এতদ্ব্যতীত উত্তরবঙ্গে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান ও সুযোগ্য শিষ্যদের প্রেরণের মাধ্যমে আদিবাসী বৌদ্ধদের ব্যাপক ধর্মীয় সচেতনতা সৃষ্টি করে শিশু-যুব- বৃদ্ধদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষিত অনেক আদিবাসী ভিক্ষু ও শিক্ষার্থী বর্তমানে স্বধর্মের প্রচার ও প্রসারে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। 
 প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে পরম পূজ্য ভন্তের অসামান্য অবদান সর্বজন বিদিত। 
বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাস্থ বরইতলী নামক গ্রামে ধর্ম ও শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া উপজাতিসহ অনগ্রসর হিন্দু-বৌদ্ধ-মসুলমান জনগোষ্ঠীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার অভিপ্রায়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'রেজু বরইতলী উচ্চ বিদ্যালয়'। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি বহু গরীব ও মেধাবী সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় প্রত্যক্ষভাবে সহয়তা দিয়ে সমাজে সু-প্রতিষ্ঠিত হতে সুযোগ দান করেছেন। শৈলেরঢেবা গ্রামে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ট্রাষ্ট কর্তৃক পরিচালিত কুশলায়ন কে. জি. স্কুল, জ্ঞানসেন পালি কলেজ, কুশলায়ন প্রকাশনী পরিষদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্ম-সমাজ হিতৈষণার একনিষ্ঠ নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করে চলেছেন। 
তাঁর অপার মৈত্রী চেতনা ও শাসন হিতৈষণায় বিগত চারদশকেরও অধিক সময়ে হতে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অনগ্রসর, সমাজে গতানুগতিকতার পরিবর্তে বৌদ্ধিক শিক্ষাদর্শ ভিত্তিক সুশীল ভিক্ষু ও আদর্শ গৃহী সমাজ গঠনে তার ত্যাগ, ধৈর্য, মেধা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী চেতনায় সদ্ধর্মের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি সাধনে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেন। সদ্ধর্মের বিকাশ ও সমাজের সার্বিক জাগরণে এবং মানবতার শিক্ষায় ও সেবায় তাঁর অমূল্য অনন্য অবদানের কীর্তি ইতিমধ্যেই সকলের শ্রদ্ধা ও প্রশংসায় দীপ্যমান। তাঁর কর্মময় জীবনের সফলতার নানা শাখায়  তিনি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বহু সম্মাননা ও উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। 
ইতিমধ্যে তিনি আগামী প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষে সঙ্কল্পবদ্ধ হয়ে গৃহী-সমাজ ও ভিক্ষু সমাজের করণীয় কি হওয়া উচিত সেই দিকনির্দেশনা প্রয়োগ ও প্রতিফলন ঘটাতে গত ১৩-১৪ মার্চ ২০২০ আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রের আয়োজন করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগ ইতিহাসে কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে। যে কাজ বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার করার কথা কিংবা নামী সংগঠন বা যাঁরা যাঁরা নামকরা সংগঠক বলে দাবী করে থাকেন তাঁদের আজ থেকে  ৫০ বছর আগে ভাবা উচিত ছিল। ভন্তের এই শুভ উদ্যোগ সাধুবাদ যোগ্য। 
আগামী শতকের বৌদ্ধধর্মকে বিভিন্ন ভাবে আরো উজ্জীবিত ও প্রাণবন্ত রাখতে সমকালীন সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম এই পথিকৃৎ প্রোজ্জ্বল সাংঘিক ব্যক্তিত্ব আরো দীপ্তিমান, কূর্তিমান ও মহীয়ান হয়ে পরমপূজ্য ভন্তে সদ্ধর্মের আলোক বর্তিকা হয়ে শতায়ু হোক। 

ভিক্ষুসংঘ ও গৃহীসংঘের প্রগতি কুঞ্চিকা
 সুমনপাল ভিক্ষু 

বঙ্গীয় ভূখণ্ডে (পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গে) বৌদ্ধধর্ম পালন তথা অনুসরণকারীর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। এর কারণ অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের  অনেকটাই পেছনের দিকে হাঁটতে হবে। বৌদ্ধধর্মের মূল দর্শন কালের গতিধারায় দুইটি ভাগে বিভক্ত হওয়ার পর (থেরবাদী এবং মহাসাংঘিক বা মহাযান দর্শন) পরবর্তী সময়ে এই দুইটি সম্প্রদায় অনেকগুলি শাখা উপশাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে মূল বৌদ্ধদর্শন ক্রমশই দেবত্ববাদের পক্ষে নিমজ্জিত হয়ে ভারতবর্ষের ইতিহাস হতে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
বঙ্গদেশে একসময় যেভাবে বৌদ্ধ পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিলো  তা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতাপে পালযুগের অবসানের পর অন্তঃসার শূন্য হয়ে দাঁড়ায়। 
সেনযুগের সূচনাপর্ব হলো বঙ্গদেশে হিন্দুভাবাদর্শের উত্থান এবং বৌদ্ধধর্মের বিলুপ্তির সাধন। এর কারণ ছিলো বহুবিধ এবং ব্যাপক। প্রথমত,পালযুগে বৌদ্ধধর্ম দেবত্ববাদের রূপ পরিগ্রহ করার ফলে (মন্ত্রযান, তন্ত্রযান,  কালচক্রযান, বজ্রযান এবং সহজযান) মূলস্বার্থে এক অর্থে অলীকবাদে পর্যবসিত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, সেই সময় সমগ্র ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের কিরূপ অবস্থা ছিল তা সুস্পষ্ট নয়। সম্ভবত, পালি সাহিত্যের  ইতিহাসের প্রগাঢ় মৌলিকতা এই সময় হয়তো সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয়ত, নানাবিধ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বর্হিবিশ্বের বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলির সঙ্গে (সিংহল, থাইল্যাণ্ড, ভিয়েতনাম, মায়ানমার ও চীন ইত্যাদি) ভারতবর্ষের যোগসূত্রে সম্পূর্ণভাবে বিছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে বৌদ্ধ সাহিত্যের আদান পর্ব এই সময়কালে দেখতে পাওয়া যায় না। চতুর্থত, সম্রাট অশোক প্রমুখ দূরদর্শী রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম-দর্শন যেভাবে বহির্বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করে এক আন্তর্জাতিক ধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, তার পরবর্তী সময়কালে (শুঙ্গযুগ হতে চোলযুগ) তা দেখতে পাওয়া যায় নিই। সম্ভবত, ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থান ছিল এর মূল কারণ। পঞ্চমত, নানাবিধ শাখা- উপশাখায় বিভক্ত হওয়ার ফলে বৌদ্ধধর্ম একসময় কেন্দ্রীভূত স্থান হতে চ্যুত হয়ে অন্যান্য ধর্মের নেতিবাচক আঙ্গিকগুলিকে গ্রহণ করতে থাকে, ফলে তার আদর্শ এবং স্বতন্ত্রতা বিনষ্ট হয়ে (পূজা পাঠ, তন্ত্রপাঠ, মারণ-উচাটন ইত্যাদি) কার্যত পৌনপুনিক আবেশে জড়িয়ে পড়ে। যদিও এই ইতিহাস রচনার প্রয়াস এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। তবে এই ইতিহাসের রূপদান বঙ্গীয় বৌদ্ধসমাজের অনুলিখনের প্রয়াসমাত্র। 

ভিক্ষু এবং গৃহী (বৌদ্ধ উপাসক ও উপাসিকা) উভয়ই সঙ্ঘের সমন্বয়ে বৌদ্ধসমাজ বৌদ্ধত্তোরকাল হতে একে অপরের পরিপূরক রূপে বুদ্ধশাসন, এবং সমাজের কল্যাণ সাধন করে চলেছে। এ প্রসঙ্গে পালি বৌদ্ধসাহিত্যে বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের বিনয় নিয়ম এবং গৃহীগণের জীবনচর্যা সম্পর্কিত যে সকল উপদেশ রয়েছে, তাঁর দ্বারা উভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের বহুবিধ উপাদান পরিলক্ষিত হয়। তবে বৌদ্ধযুগের সঙ্গে বর্তমানকে তুলনা করা সমীচীন নয়। কারণ বুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে বৌদ্ধপ্রধান দেশে বা অঞ্চলগুলিকে নানাবিধ বৌদ্ধ ঐতিহ্য গড়ে তোলার সুবিপুল প্রয়াস পরিলক্ষিত হলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে বঙ্গীয় বৌদ্ধগণের মধ্যে কোন সুনির্দিষ্ট স্বকীয় আদর্শগত বৌদ্ধ পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি বা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রয়াস আজও পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় নিই।

 ফলে স্বকীয় বৌদ্ধঐতিহ্য নিয়ে গৌরবের কোন বিষয়ই বঙ্গীয় বৌদ্ধসমাজে নেই। সুতরাং আক্ষরিক অর্থে বঙ্গীয় বৌদ্ধগণকে নানাবিধ বিচ্যুতির শিকার হতে দেখা যায়। এই বিষয়টি বৌদ্ধভিক্ষু পরিচালনার ক্ষেত্রেও দেখতে পাওয়া যায়।

আধুনিক বাংলাদেশে ভিক্ষু ও গৃহী উভয়ের মধ্যে সমাজসংঘ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছুটা সমন্বয় থাকলেও সেখানেও পরিচালনার প্রশ্নে নানাবিধ অসামঞ্জস্য রয়েছে। অপরদিকে ভারতবর্ষে তথা পশ্চিমবঙ্গে ভিক্ষু ও গৃহীদের মধ্যে সমন্বয়ের প্রশ্ন রয়েছে সুবিশাল বিচ্যুতি। এর মূলগত কারণ হল বৌদ্ধ আদর্শ সম্পর্কিত অজ্ঞাতা এবং অবস্থানগত দূরত্ব। 

বর্তমান সময়ে বৌদ্ধধর্ম ক্রমশই এক অদ্ভুত আঁধারের সম্মুখীন। প্রকৃত বুদ্ধ শাসন গ্রহণ এবং তা অনুশীলন করার পরিবর্তে বলে বিভিন্ন অবৌদ্ধচিত রীতিনীতি পদ্ধতি বৌদ্ধসমাজে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাঁর মধ্যে অন্যতম হল গুরুবাদী চিন্তা। এই চিন্তা ভিক্ষু ও গৃহী, উভয়ইকে ক্রমশই অবৌদ্ধোচিত করে তুলেছে। এই প্রসঙ্গে ভগবান বুদ্ধের একটি গাথা বিশেষভাবে উল্লেখেনীয়।

"যো সাসনং অরহতং, অরিয়ানং ধম্মজীবিনং, পটিক্কোসতি দুম্মেধো, দিটি্ঠং নিস্সায় পসিকং, ফলানি কট্ঠকসে্সব, অত্তঘাতায় ফল্লতি"- ধম্মপদ ১৬৪।
(যে নির্বোধ ব্যক্তি নিজ পাপদৃষ্টির বশবর্তী হয়ে আর্য্য ও ধার্মিক অহং তাদের ধর্মোপদেশের প্রতি আক্রোশ পরায়ণ হন, বাঁশের ফলোদ্গমে বাঁশ বংশনাশের ন্যায় দুষ্কর্মীর কৃতকর্মও তাকে নির্মূল করে)।

উত্তরপূর্ব ভারত তথা বঙ্গদেশে দ্বাদশ শতকের ক্ষয়িষ্ণু বৌদ্ধধর্ম নানা বিবর্তনের হাত ধরে দীর্ঘ সাতশত বছর অতিক্রম করার সময়কালে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও ইসলামধর্মের আগ্রাসনে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। সেই সময় অধিকাংশ বৌদ্ধ হয় মৃত্যুবরণ করেছিল নতুবা এই সকল অন্য ধর্মমত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। অপরদিকে কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ সমগ্র চট্রগ্রাম, নোয়াখালী এবং ত্রিপুরা অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত থাকলেও তারা বাস্তবিক অর্থে অবৌদ্ধ ধর্ম আচরণকেই কেন্দ্র করে কাল যাপন করতেন।

'রাউলী পুরোহিত' নামক এক প্রকার গার্হস্থ্য পুরোহিত (তান্ত্রিক সিদ্ধাচার্যের উত্তরসূরী) এই সকল তথাকথিত বৌদ্ধদের ধর্মীয় কর্ম সম্পাদন করতেন। সেই সময় তাদের মধ্যে শ্মশানিক দেবদেবীর পূজা, পশুবলি, শনিপূজা, শীতলাপূজা, মনসাপূজা, নদী- স্বরস্বতী ইত্যাদি হিন্দুপূজা গুলিও ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিলো। এছাড়া তদানীন্তন তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী  জনগণ আশ্বিন - কার্তিক মাসে নানাবিধ লোকায়ত ধর্মীয়ব্রতও পালন করতেন এই সকল মিথ্যাদৃষ্টিধারী রাউলীগণ কোন কোন অঞ্চলে 
'পুংগী, আপ্পি-পুংগী, মোরপ্পাবা ঠাউর( ঠাকুর) নামে পরিচিত ছিল। অপরদিকে গৃহী বৌদ্ধগণ বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের বিকৃত উচ্চারণ করে "ফরা' 'তারা' ' চংকা' বলতেন। আক্ষরিক অর্থে রাউলী পুরোহিতগণ ছিলেন তদানীন্তন ক্ষীণপ্রভ বিকৃত বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক।

উনিশ শতক এবং বাংলার নবজাগরিত বৌদ্ধধর্ম :

১৮৬৪ খ্রি. হল বাঙ্গালী বৌদ্ধদের জন্য এক সুবর্ণময় অধ্যায়। এই সময় তদানীন্তন অবিভক্ত বঙ্গদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাঙ্গালী বৌদ্ধগণের পুরাতন 
'রাউলী' সংস্কৃতিকে সমূলে উচ্ছেদের প্রয়াসে এবং স্বার্থে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরাকান হতে বিখ্যাত বৌদ্ধপণ্ডিত সংঘরাজ সারমেধ মহাথের পদার্পণ করলেন। বৌদ্ধধর্ম ও সমাজকে নবপর্যায়ে সংগঠিত এবং বাঙ্গালী বৌদ্ধগণকে কুসংস্কার হতে মুক্ত করার প্রশ্নে  সারমেধ মহাথের সহ সমকালীন বেশকিছু স্বার্থে প্রাণ ভিক্ষু পুনঃ উপসম্পদা গ্রহণ করে ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। শুরু হল পুনঃ বৌদ্ধ নবজাগরণ। 

সদ্ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সেই সময় সারমেধ মহাথের সহ অন্যান্য ভিক্ষুদের প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কারণ দীর্ঘদিন ধরে যে বিকৃত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন তথাকথিত তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম (তন্ত্রযান) চট্রগ্রাম ও তাঁর পাশ্ববর্তী অঞ্চলের জনগণের মধ্যে প্রোথিত ছিল তা অচিরেই দূরীভূত করা সম্ভবপর ছিল না।তবু তারা ভীত হননি বা পিছু হটেননি। ধৈর্য্যধারণ করে চলতে থাকেন। সেই মৃতব্যক্তির আত্মতুষ্টির উদ্দেশ্য রাউলী পুরোহিতগণ মোচা তোলার প্রচলন করেন। যা এখনও বাঙ্গালী বৌদ্ধসমাজ হতে দূরীভূত হয়নি। মোচা বা মাচা তোলাকে প্রেতপূজাও বলা হয়। এই সংস্কার মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন এবং অবৌদ্ধ চিন্তামণ্ডিত। এই সংস্কার ধরে রাখলে চেতনার অবনমন হয় এবং পুণ্যচেতনা বিনষ্ট হয়। যারা মৃত্যুবরণ করেন তারা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব কর্ম বিপাকে উদ্দিষ্ট স্থানে জন্মান্তর পরিগ্রহ করে। ফলে তাদের কেন্দ্র করে শোক, পরিতাপ না করে সেই সকল মানুষদের কল্যাণার্থে  কুশল মানসিকতা নিয়ে পুণ্যকর্ম সম্পাদন দ্বারা অর্জিত পুণ্যরাশি দান করাই হল প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন।

অতএব বৌদ্ধধর্মের নানাবিধ সংস্কার আন্দোলনের পরিণাম স্বরূপ বাংলায় সংঘরাজ নিকায়ের জন্ম হয় এবং সেই নিকায়ের মামকরণ করা হয়  "সঙ্ঘ সম্মিলনী"। ১৯৪০ খ্রি. প্রতিষ্ঠা লাভ করে 'সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা'।

ভিক্ষুগণের একচল্লিশ প্রকার অপরিহাণীয় ধর্ম :

তথাগতের অন্তিমবচন (মহাপরিনির্বাণসূত্র হতে সংকলিত)
১.  যতদিন ভিক্ষুগণ সর্বদা সম্মিলিত হবে, সর্বদা সম্মিলিত হতে সঙ্কোচন করবেন না, ততদিন ভিক্ষুগণের শীলবিনয়ে শ্রীবৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২.  যতদিন ভিক্ষুগণ একতাবাদ হয়ে নিয়ত সম্মিলিত হবে ও একমত হয়ে একসঙ্গে আসন ত্যাগ করবে এবং একমত হয়ে সকল সংঘ কর্তব্য সম্পাদন করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৩.  যতদিন ভিক্ষুগণ তথাগত কর্তৃক অপজ্ঞাপ্ত শিক্ষাপদ প্রজ্ঞাপ্ত করবে না (প্রজ্ঞাপ্ত শিক্ষাপদের বশবর্তী হয়ে চলবে), ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৪.  যতদিন ভিক্ষুগণ যেসকল স্থবির বহুরাত্রিজ্ঞ, বহুদিনের প্রব্রজিতে, সঙ্ঘপিতা, সঙ্ঘনেতা তাদেরকে সৎকার করবে গৌরব করবে, সম্মান ও পূজা করবে এবং তাদের হিতোপদেশ মেনে চলা উচিত মনে করবে ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৫.  যতদিন ভিক্ষুগণ অরণ্যস্থিত শয্যাসনের প্রতি সাপেক্ষ ( অরণ্যে বসবাসের একান্ত পক্ষপাতি), ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৬.  যতদিন ভিক্ষুগণ পুর্নজন্মদায়ক উৎপন্ন তৃষ্ণার বশবর্তী না হয়, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৭.  যতদিন ভিক্ষুগণ প্রত্যেকে নিজ নিজ অন্তরে এইরূপ স্মৃতি জাগ্রত করবে যে কিরূপে আমার নিকট অনাগত প্রিয়শীল (শীলবান) সব্রহ্মচারী আসবেন। এবং আগত শীলবান সব্রহ্মচারী সুখে স্বাচ্ছন্দে বাস করতে পারবেন, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৮.  যতদিন ভিক্ষুগণ বর্তমান ( কর্মপ্রিয়) না হবে, কর্মরত ও কর্মপ্রিয়তায় অনুরক্ত না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৯.  যতদিন ভিক্ষুগণ সারহীন আলাপপ্রিয় না হবে, সারহীন আলাপরত এবং সারহীন আলাপে অনুরক্ত না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১০.  যতদিন ভিক্ষুগণ নিদ্রারাম, নিদ্রালু, নিদ্রারামতায় অনুরক্ত না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১১.  যতদিন ভিক্ষুগণ জনসঙ্গারাম, জনসঙ্গরত, জনসঙ্গারামতায়, অনুরক্ত না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১২.  যতদিন ভিক্ষুগণ পাপেচ্ছানুযায়ী, পাপেচ্ছার বশবর্তী না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৩.  যতদিন ভিক্ষুগণ পাপমিত্র, পাপসহায়, পাপপ্রবণ, পাপকুটিল না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৪.  যতদিন ভিক্ষুগণ সামান্য মাত্র ( স্রোতাপত্তি ফল) লাভ না করে, বা লাভের পূর্বে "আমার কর্তব্য শেষ হল" বলে উৎসাহ
 ত্যাগ করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৫.  যতদিন ভিক্ষুগণ শ্রদ্ধাসম্পন্ন হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৬.  যতদিন ভিক্ষুগণ হ্রীমান ( পাপকর্ম সম্পাদনে লজ্জিত) হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৭.  যতদিন ভিক্ষুগণ (পাপে ভয়দর্শী) হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৮.  যতদিন ভিক্ষুগণ বহুশ্রুত ( পিটকবিশারদ) হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৯.  যতদিন ভিক্ষুগণ কায়িক ও চৈতসিক আরদ্ধবীর্য সম্পন্ন হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২০.  যতদিন ভিক্ষুগণ স্মৃতিসম্পন্ন হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৭.  যতদিন ভিক্ষুগণ প্রত্যেকে নিজ নিজ অন্তরে এইরূপ স্মৃতি জাগ্রত করবে যে কিরূপে আমার নিকট অনাগত প্রিয়শীল (শীলবান) সব্রক্ষচারী আসবেন। এবং আগত শীলবান সব্রক্ষচারী সুখে স্বাচ্ছন্দে বাস করতে পারবেন, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৮.  যতদিন ভিক্ষুগণ বর্তমান ( কর্মপ্রিয়) না হবে, কর্মরত ও কর্মপ্রিয়তায় অনুরক্ত না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৯.  যতদিন ভিক্ষুগণ সারহীন আলাপপ্রিয় না হবে, সারহীন আলাপরত এবং সারহীন আলাপে অনুরক্ত না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১০.  যতদিন ভিক্ষুগণ নিদ্রারাম, নিদ্রালু, নিদ্রারামতায় অনুরক্ত না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১১.  যতদিন ভিক্ষুগণ জনঙ্গারাম, জনসঙ্গরত, জনসঙ্গারামতায়, অনুরক্ত না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১২.  যতদিন ভিক্ষুগণ পাপেচ্ছানুযায়ী, পাপেচ্ছার বশবর্তী না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৩.  যতদিন ভিক্ষুগণ পাপমিত্র, পাপসহায়, পাপপ্রবণ, পাপকুটিল না হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৪.  যতদিন ভিক্ষুগণ সামান্য মাত্র ( স্রোতাপত্তি ফল) লাভ না করে,  বা লাভের পূর্বে " আমার কর্তব্য শেষ হল" বলে উৎসাহ
 ত্যাগ করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৫.  যতদিন ভিক্ষুগণ শ্রদ্ধাসম্পন্ন হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৬.  যতদিন ভিক্ষুগণ হ্রীমান ( পাপকর্ম সম্পাদনে লজ্জিত) হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৭.  যতদিন ভিক্ষুগণ (পাপে ভয়দর্শী) হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৮.  যতদিন ভিক্ষুগণ বহুশ্রুত ( পিটকবিশারদ) হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
১৯.  যতদিন ভিক্ষুগণ কায়িক ও চৈতসিক আরদ্ধবীর্য সম্পন্ন হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২০.  যতদিন ভিক্ষুগণ স্মৃতিসম্পন্ন হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২১.  যতদিন ভিক্ষুগণ পঞ্চস্কন্ধের উদয়ব্যয় পরিগৃহীত প্রজ্ঞাসমন্নাগত হবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২২.  যতদিন ভিক্ষুগণ চারপ্রকারের স্মৃতি স্মৃতিসম্বোধ্যঙ্গ উৎপাদন করে তা বর্ধিত (ভাবনা) করবে,  ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২৩.  যতদিন ভিক্ষুগণ ছয়প্রকারে ধর্মবিষয় সম্বোধ্যঙ্গ উৎপাদন করে তা বর্ধিত ( ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২৪.  যতদিন ভিক্ষুগণ নয় প্রকারে বীর্য সম্বোধ্যঙ্গ উৎপাদন করে তা বর্ধিত (ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২৫.  যতদিন ভিক্ষুগণ দশ প্রকারে প্রীতি সম্বোধ্যঙ্গ উৎপাদন করে তা বর্ধিত (ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২৬.  যতদিন ভিক্ষুগণ সাত প্রকারে প্রশ্রদ্ধি সম্বোধ্যঙ্গ উৎপাদন করে তা বর্ধিত (ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২৭.  যতদিন ভিক্ষুগণ দশপ্রকারে সমাধি সম্বোধ্যঙ্গ উৎপাদন করে তা বর্ধিত (ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২৮.  যতদিন ভিক্ষুগণ পাঁচ প্রকারে উপেক্ষা সম্বোধ্যঙ্গ উৎপাদন করে তা বর্ধিত ( ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
২৯.  যতদিন ভিক্ষুগণ অনিত্যানুদর্শনে উৎপন্ন সংজ্ঞা বর্ধিত (ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৩০.  যতদিন ভিক্ষুগণ অনাত্মানুদর্শনে উৎপন্ন সংজ্ঞা বর্ধিত (ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৩১.  যতদিন ভিক্ষুগণ অশুভানুদর্শনে উৎপন্ন সংজ্ঞা বর্ধিত (ভাবনা) করবে, ততোদিনে ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৩২.  যতদিন ভিক্ষুগণের আদীনবানুদর্শনে উৎপন্ন সংজ্ঞা বর্ধিত (ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৩৩.  যতদিন ভিক্ষুগণ ত্যাগানুদর্শনে উৎপন্ন সংজ্ঞা  বর্ধিত (ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী পরিহানী হবে না।
৩৪.  যতদিন ভিক্ষুগণ বিরাগানুদর্শনে উৎপন্ন সংজ্ঞা বর্ধিত (ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
 ৩৫.  যতদিন ভিক্ষুগণ নিরোধানুদর্শনে উৎপন্ন সংজ্ঞা বর্ধিত (ভাবনা) করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৩৬.  যতদিন ভিক্ষুগণ সব্রহ্মচারীগণের সম্মুখে এবং পরোক্ষে তাঁদের প্রতি  কায়িক কর্ম মৈত্রীপূর্ণ চিত্তে উৎপাদন করবে,  ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৩৭.  যতদিন ভিক্ষুগণ সব্রহ্মচারীগণের সম্মুখে এবং পরোক্ষে তাঁদের প্রতি বাচনিক কর্ম মৈত্রীপূর্ণ চিত্তে উৎপাদন করবে, ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।
৩৮.  যতদিন ভিক্ষুগণ সব্রহ্মচারীগণের সম্মুখে এবং পরোক্ষে তাঁদের প্রতি মনঃককর্ম মৈত্রীপূর্ণ চিত্তে উৎপাদন করবে,  ততদিন ভিক্ষুগণের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, পরিহানী হবে না।

গৃহী উপাসকগণের পরিহাণীয় ধর্ম :
 ভগবান বুদ্ধ তার অন্তিমবদানে পাটলী গ্রামের গৃহী উপাসকগণের প্রতি যে দেশনা প্রদান করেছিলেন তা আজও অমলিনতা লাভ করেনি বরং তা আজও বৌদ্ধ উপাসকগণের জীবনচর্যার ক্ষেত্রে অত্যন্ত পরীক্ষিত তথা যুক্তিপূর্ণ বলে গৃহীত হয়ে আসছে। ভগবান সেই সময়কালে যে দেশনাগুলি প্রদান করেছিলেন তা হল এইরূপ-

১.  হে গৃহপতিগণ, শীল বিপত্তি হেতু দুঃশীল ব্যক্তির (যে পঞ্চশীলাদি লঙ্ঘন করে অর্থাৎ প্রাণাতিপাত, চুরি, ব্যভিচার, মিথ্যা প্রয়োগ করেও নেশা পান করে ইত্যাদি) পাঁচটি অনর্থ ঘটে। সেই পাঁচটি অনর্থ কি কি?

১) বর্তমানে যে দুঃশীল, পঞ্চশীলাদি ভঙ্গ করে তার মহাভোগ সম্পত্তি থাকলেও প্রমাদবশতঃ তা বিনাশ হয়ে যায় (ব্যবসা বাণিজ্য এমনকি কৃষিকর্মেও উন্নতি করতে পারে না, মূলধন পর্যন্ত বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রব্রজিত দুঃশীল শীলভঙ্গকারী'র এইটি হল প্রথম অনর্থ (আদীনব)।
২. হে গৃহপতিগণ, দুঃশীল শীলভঙ্গকারীর, পাপ কীর্তিশদ্ধ (অযশ অকীর্ত) সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এইটি দুঃশীল শীলভঙ্গকারীর দ্বিতীয় আদীনব (অনর্থ)।
৩. হে গৃহপতিগণ, দুঃশীল শীলভঙ্গকারীর (শীলবিপন্ন ব্যক্তি) সে ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, গৃহপতি ও শ্রমণ- এই চার প্রকারের যে কোন সভায় উপস্থিত হোক না কেন, উদ্বিগ্ন চিত্ত ও অপ্রতিহতভাবে (সভয়ে সসঙ্কোচে) যায়। এইটি দুঃশীল শীলভঙ্গকারীর তৃতীয় আদিনব।
৪. হে গৃহপতিগণ, দুঃশীল শীলবিপন্ন ব্যক্তি মৃত্যুকালে মূর্চ্ছাপ্রাপ্ত হয়ে অজ্ঞানেই দেহত্যাগ করে। এইটি দুঃশীল শীলভঙ্গকারীর চতুর্থ আদীনব।
৫.  হে গৃহপতিগণ, দুঃশীল শীল বিপন্ন ব্যক্তি মৃত্যুর পর অসায় দুর্গতি অধঃগত দুর্গতিপ্রাপ্ত হয়, দুঃশীল শীলভঙ্গকারীর এইটি পঞ্চম আদীনব।

হে গৃহপতিগণ, দুঃশীল শীলভঙ্গকারীর এই পাঁচটি অনর্থ বা আদীনব হয়ে থাকে।

গৃহী উপাসকগণের পাঁচটি আনিশংস লাভ :

১. হে গৃহপতিগণ, শীল পালনে হেতু শীলবানের (প্রাণাতিপাত, চুরি, ব্যভিচার, মিথ্যা প্রয়োগ ও নেশাপান হতে বিরত) পাঁচটি অনিশংস (সুফল) লাভ হয়ে থাকে।

সেই পাঁচটি আনিশংস কি কি?

হে গৃহপতিগণ, ইহলোকে শীলবান শীলসম্পন্ন ব্যক্তি, অপ্রমত্ততার দ্বারা মহাভোগ সম্পত্তি লাভ করে থাকে, ( ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষি যে কাজ করুক না কেন তাতে উন্নতি হয়ে থাকে, সুশীল, প্রব্রজিত, শীল ধনে, বুদ্ধবচন, ধ্যান এবং সপ্ত আর্য্যধনে ধনী হয়ে থাকেন) এইটি শীলবানের শীল পালনের প্রথম পুরস্কার।

২.  হে গৃহপতিগণ, শীলবান ব্যাক্তির কল্যাণ কীর্ত্তীশব্দ (যশসুখ্যাতি) সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়, এইটি শীলবান ব্যক্তির শীলপালনের দ্বিতীয় পুরস্কার।
৩. হে গৃহপতিগণ, শীলবান ব্যক্তি, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, গৃহপতি ও শ্রমণ এই চারি জাতি যে কোন পরিষদে যাক মা কেন, বিশারদ হয়ে নিঃসঙ্কোচে উপস্থিত হয়, এইটি শীলপালনের তৃতীয় পুরস্কার।
৪. হে গৃহপতিগণ, শীলবান ব্যাক্তি সজ্ঞানে দেহত্যাগ করে। এইটি শীলবানের চতুর্থ পুরস্কার।
৫. হে গৃহপতি, শীলবান ব্যক্তি কায় ভেদ, মৃত্যুর পর সুগতি লোকে উৎপন্ন হয়, এইটি শীলবানের পঞ্চম পুরস্কার।

হে গৃহপতিগণ শীলবানের শীল পালনের এই পাঁচটি আনিশংস লাভ করে, সর্বোপরি ভগবান বুদ্ধ গৃহী উপাসকগণের পক্ষে মৈত্রীচিত্ত কায়িক বাচনিক কর্ম সম্পাদনে দেশনাও প্রদান করেছিলেন।

যেগুলি হল এইরূপ :
গৃহীগণের পক্ষে চৈত্য ও বন্দনার্থে গমন, ভিক্ষু পিণ্ডাচারণে উপস্থিত হলে প্রত্যুদগমন, পাত্র প্রতিগ্রহণ ও আসন প্রদান এবং অনুগমণ ইত্যাদি হল মৈত্রীকায় কর্ম।

গৃহীগণের পক্ষে মৈত্রী বাচনিক কর্ম হল চৈত্য ও বোধি বন্দনার্থে গমন করব, ধর্ম শ্রবণ ও দ্বীপ-ধূপ পূজা করব, ত্রিবিধ সুচরিত শীল গ্রহণ পূর্বক পালন করব। অন্ন বস্ত্রাদি চতুর্থপ্রত্যয় ভিক্ষুসংঘকে দান করব, সংঘ নিমন্ত্রণপূর্বক খাদ্য ভোজ্যাদি দান, পানিয়াদি দান, সংঘকে প্রত্যুদগমণ করে আনায়ন, আপন প্রদান, উৎসাহের সঙ্গে পরিচর্যা ইত্যাদি। 

বৌদ্ধিক প্রগতি সাধনের লক্ষ্যে আদর্শ নাীতিমালা :

বিজ্ঞানের নিয়ম হল প্রয়োগ ও ত্বত্ত্বের সংমিশ্রণ। অর্থাৎ উভয় উভয়েরই পরিপূরক। উভয়ের মধ্যে কোন একটির অভাবে বিজ্ঞান অন্তঃসার শূন্য হয়ে গড়ে। বৌদ্ধধর্ম দর্শনের ক্ষেত্রেও এই বিষয় প্রযোজ্য।  অর্থাৎ বৌদ্ধিক প্রগতি সাধনে বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘই হল মূল অক্ষশক্তি। 

বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ হল 'সিম্ফনি অফ ফ্রিডম'। এর অর্থ হল প্রকৃত অর্থে সত্ত্বা প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ ব্যতীত বৌদ্ধধর্ম দর্শন এক অর্থে মৃত বৃক্ষের ন্যায় সারগর্ভহীন। যার অর্থ হল কোনকিছুই নেই।

বর্তমানে বৌদ্ধজাতির উপরে ঘনায়মান সংকট বিদ্যমান। ভারতীয় উপমহাদেশে স্বার্থরক্ষার প্রতি নিদারুণ সময়ের অভাব দেখতে পাওয়া যায়। এর মূলগত কারণ বহুবিধ।  তবে এই স্থানে তার কিয়দংশ আলোচনা করা হল।

ভিক্ষুজীবন : 

ভগবান বুদ্ধ প্রবর্তিত সাংঘিক জীবনের সভ্যভুক্ত হওয়ার অর্থই হল ভিক্ষুজীবন। কোন ব্যাধিগ্রস্থ ব্যক্তি ভিক্ষু জীবন গ্রহণ করতে পারে না। এমনকি ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, দণ্ডভোগী এবং যোদ্ধা, ব্যবসায়ী ভিক্ষুজীবনের উপযুক্ত নয়।
ভিক্ষু জীবনে আচার্যের দায়দায়িত্ব অনিবার্যভাবেই বর্তায়। আচার্যের আশ্রয়মুক্ত দক্ষ, সক্ষম ভিক্ষুর জীবনকে স্ব-স্ব কর্মসংস্কার অনুযায়ী গঠন এর ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যেমন : 

ক. শীলবান বা বিনয়ধর ভিক্ষু, খ. সাধক ভিক্ষু, গ. ধুতাঙ্গ ভিক্ষু, ঘ. লেখক ভিক্ষু, ঙ. আচার্য ভিক্ষু, চ. প্রতিষ্ঠান পরিচালক ভিক্ষু, ছ. দেশক ভিক্ষু, জ. সংগঠক ও কর্মী ভিক্ষু, ঝ. অনাগরিক ও অনাগরিকা।

বর্তমানে এইরূপ পর্যায়গত ভিক্ষুর ক্রমশই অভাব প্রকট হতে প্রকটতর হয়ে উঠেছে। ফলে ভিক্ষুসংঘের পরিকাঠামো এবং গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন হচ্ছে। সৎ, উদ্যমী এবং পরিশ্রমী ভিক্ষুগণ নানাভাবে অবহেলিত এবং অনাদৃত হওয়ার ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় ভিক্ষুসংঘের পুনঃমূল্যায়ন অনিবার্য। নতুবা সদ্ধর্মের পতন অনিবার্য।

গৃহী উপাসক- উপাসিকা :

গৃহী উপাসক বা উপাসিকাগণের মধ্যে অবৌদ্ধচিত আচরণ বর্তমানকালে দেখতে পাওয়া যায়। যেমন বুদ্ধশাসনের প্রতি অশ্রদ্ধাভাব পোষণ, ভিক্ষুসংঘের প্রতি গুরুত্ব প্রদান না করা, মিথ্যাদৃষ্টিধারী অন্যধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া, পিতা মাতা তথা আত্মীয় পরিজনের প্রতি শ্রদ্ধাভাব পোষণ না করা , গুরুবাদের প্রতি ভক্তি পোষণ করা ইত্যাদি। এই সকল অবৌদ্ধচিত কারণে বর্তমানে বৌদ্ধচেতনারও অভাব ঘটেছে। সর্বোপরি ব্রাহ্মণ্যবাদের ন্যায় জাতিগত বৌদ্ধ এবং অন্যধর্ম হতে আগত নব্য বৌদ্ধদের মধ্যেও চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে এক সুবিপুল পার্থক্য, যা বৌদ্ধপাসকগণের পক্ষে সমীচিন
নয়। কারণ ভগবান বুদ্ধ 
যেখানে জাত, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদির পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন না। অথচ তার প্রবর্তিত ধর্মে এইরূপ চিন্তামাত্রই বিস্ময়কর। ভিক্ষুসংঘ এই উপাসক উপাসিকার মন হতে এখনও পর্যন্ত দূরীভূত করতে পারেননি। ফলে বৌদ্ধদের মনে হীনমন্যতা প্রকট হচ্ছে। 

ধর্মের প্রচার এবং প্রসারের সমস্যা :  

বৌদ্ধধর্মের প্রচার এবং প্রসারের ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের বৌদ্ধগণের মধ্যে তীব্র অনিচ্ছা দেখতে পাওয়া যায়। অপরদিকে বিশেষ দুইটি আন্তর্জাতিক ধর্ম নিজেদের অঞ্চলগুলিতে উপাসনালয় ব্যতীত গড়ে তুলেছে  ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।  তাঁরা শিশু কিশোরদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষাকে সামাজিকভাবে বাধ্যতামূলক করেছে অসাধারণ দূরদর্শীতার সঙ্গে। ফলে বিশ্বব্যাপী উভয়ধর্মের মিশনারীগণের একই বিধিব্যবস্থার ফলশ্রুতিতে আজ সমগ্র বিশ্বের খ্রিস্টান ও মুসলিম সমাজ ধর্মের গভীর সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে পরিণত হয়েছে একটিমাত্র খ্রিষ্টিয় ও ইসলামিক পরিবারের সদস্যে।

অপরদিকে বৌদ্ধধর্ম আন্তর্জাতিক ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় উপমহাদেশে (ভারত ও বাংলাদেশ) তার অস্তিত্ব সংকট দেখতে পাওয়া যায়।

ভারত ও বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় এদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১ভাগও নন। পরিতাপের বিষয় এই যে একদা এই ভূখণ্ডের সুবিশাল জনগোষ্ঠী ভগবান বুদ্ধের মহান শিক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে অবৌদ্ধ কৃষ্টি সংস্কৃতি ও আচারবিচারে বিশ্বাসী হয়ে এক দিকভ্রান্ত-পথভ্রষ্ট লঘুতম সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। এর মূলগত কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে ধর্মের প্রতি গভীর ভালবাসার অভাবে বৌদ্ধ জনমানস এখনও ধর্মানুভূতিকে,  ধর্মশিক্ষা ও অনুশীলনকে তেমনভাবে গুরুত্ব প্রদান করতে আগ্রহী নয়।

সর্বোপরি বাঙ্গালী বৌদ্ধ ধর্মালম্বীগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগত স্বার্থগুলিকে নিয়ে এত বেশী ব্যস্ত যে তারা ধর্মশিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন এবং অন্য ধর্মের গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেদের সম্পৃক্ত করে ফেলেছে। এছাড়া রয়েছে আধুনিক ভোগ সর্বস্ব শিক্ষার অনুশীলন। ফলে 'পদবী' টিকে আছে, এছাড়া তাদের ভেতরে কোন বৌদ্ধসত্তা কাজ করে না। সুতরাং অনুশীলন এবং অনুগমন উভয় ক্ষেত্রেই জড়তা এবং সীমাবদ্ধতার কারণে এই সমস্যা এক মহিরূহে পরিণত হয়েছে। 

গৃহী উপাসক এবং ভিক্ষুদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব:

বৌদ্ধভিক্ষু এবং গৃহী উপাসকগণের মধ্যে সমন্বয়সাধনের অভাব দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবীর বহু ধর্ম সম্প্রদায় নিজেদের দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বার্ষিক উপার্জনের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ  
ধর্মের বিকাশ তথা উন্নতি কল্পে নিয়মিতভাবে দান করে থাকেন। এই সকল দানের মাধ্যমে তারা গড়ে তুলেছে অসংখ্য সেবা ও জনকল্যাণ মূলক প্রতিষ্ঠান। অথচ বাঙ্গালী বৌদ্ধগণ বিশ্বের কথা তো দূরে থাক, নিজ গৃহে বা বৌদ্ধ সমাজের কল্যাণে দান প্রদানের তীব্র অনীহা দেখতে পাওয়া যায়।

অপরদিকে ভগবান বুদ্ধ ভিক্ষুজীবনকে আত্মকল্যাণ ও পরকল্যাণের এক প্রচণ্ড শক্তির উৎসে পরিণত করার লক্ষ্যেই নিঃস্বার্থ ও পরনির্ভর জীবিকার (পরপটিবন্ধামে জীবিকাতি) অনুশীলন করতে বলেছিলেন। স্বেচ্ছাসেবী জীবন জীবিকা একটি পর্যায়ে খুবই হীন নেশায় পরিণত হয়, যখন ব্যক্তিগত সুখ ও লাভ ক্ষতি প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। বুদ্ধ তাই পরনির্ভরশীল ভিক্ষুজীবনকে ভোগ বিলাস বর্জিত ক্ষান্তি, সংযম ও শীলগুণ সম্পন্ন নিঃস্বার্থ পরকল্যাণমুখী এক অনুপম ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

যে ভিক্ষু শীলবান ও পরকল্যাণকামী, তিনি অতি সহজেই অপরের শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম, গৌরব লাভে সক্ষম হন।

যুগে যুগে এমনকি বুদ্ধের সময়কাল হতে লক্ষ্য করা যায় যত উন্নত সমৃদ্ধ ভিক্ষুসংঘ এবং সুযোগ্য গৃহী উপাসক একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু বর্তমানে বৌদ্ধসমাজে কোনরূপ বাধ্যতামূলক বিধিনিয়ম প্রজ্ঞাপ্ত না হওয়ার ফলে ভিক্ষু গৃহী উভয়ক্ষেত্রে সংঘশক্তি এখন এক মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন। সদ্ধর্মের বিষয় এই উদাসীনতার ফলে ভগবান বুদ্ধের নীতিমালা হতে গৃহী উপাসকগণ অনেক দূরে চলে গিয়ে পরধর্মের প্রতি লালায়িত হয়ে পড়েছে। অতএব সাধু সাবধান!

বুদ্ধের নীতি আদর্শকে সমৃদ্ধ করার উপায়: 

১. চিন্তাশীল ভিক্ষু এবং দায়কের একটি যৌথ শক্তিশালী কার্যকরী উদ্যোগ এখন একান্ত প্রয়োজন। কোন একক প্রচেষ্টার দ্বারা এই সমৃদ্ধকরণ একান্তভাবে অসম্ভব। 
২. উদ্যােক্তাগণকে ত্রিপিটকে সংকলিত বুদ্ধবচনগুলিকে বর্তমানে যুগোপযোগী করে স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনায় বিরাজমান পরিস্থিতির মোকাবিলায় ভিক্ষু, গৃহী উভয় সংঘের নিমিত্তে রূপরেখা তৈরি করা একান্তভাবে অপরিহার্য। 
৩.  এই রূপ রেখার মূলভিত্তি হবে চারি আর্য সত্যজ্ঞান এবং প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি জ্ঞান। সামগ্রিক লক্ষ্য হবে আসবক্ষয় জ্ঞান অধিগত করা।

৪.  আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথে গৃহীদের নিমিত্তে দানশীল ও ভাবনাক্রম এবং অনাগরিকগণের নিমিত্তে শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলন।
৫.  রূপরেখার বাস্তবায়নে ভিক্ষু- গৃহীর সমন্বিত স্থানীয়, আঞ্চলিক  ও পরিষদ গঠন।
৬.  কেন্দ্রীয় পরিষদের মূলগত ( বার্ষিক বা ষান্মাষিক) নিয়মিতভাবে প্রকাশ এবং বিপনন।
৭.  নিয়মিতভাবে বৌদ্ধ গ্রন্থাদি, পঞ্জিকা ইত্যাদি প্রকাশের রূপরেখা গঠন।
৮.  সংঘের নিমিত্তে বড় অঙ্কের অর্থ তহবিল নির্মাণের উদ্যােগ গ্রহণ এবং তার বাস্তবায়নে বিবিধ প্রদক্ষেপ গ্রহণ।
৯.  বিদর্শনচর্চার অনুশীলন ( ভিক্ষু- গৃহীর উভয়ের ক্ষেত্রে)  বাধ্যতামূলক করা।
১০.  পালি ভাষাচর্চার বিকাশ সাধনে পালি বিদ্যালয় স্থাপন ও অনুশীলন।
১১.  স্বার্থ বিকাশের প্রশ্নে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ব্যবহার ও শিক্ষণ।
১২.  অপেক্ষাকৃত বৌদ্ধ অসচ্ছ্বল পরিবারগুলিকে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং বুদ্ধ বিধান অনুযায়ী ব্যবসা বাণিজ্যে সম্পৃক্তকরণ।

বৌদ্ধ  সমাজ কাঠামো:

বৌদ্ধ সমাজ কাঠামো বলতে ভগবান বুদ্ধ দ্বারা প্রদর্শিত যে শিক্ষা, উপদেশ ও জীবনদর্শন - অর্থাৎ সেই দর্শনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা 'বুদ্ধশাসন' নামক সমাজ। ভগবান বুদ্ধের ভাষায় বৌদ্ধ তথা বৌদ্ধিক সমাজ কাঠামো বলতে বোঝায় বুদ্ধশাসন তথা বুদ্ধ পরিষদ।
 
এক্ষেত্রে পরিষদ চার ভাগে বিভক্ত। যেমন -১.ভিক্ষু পরিষদ,২.ভিক্ষুণী পরিষদ,৩.উপাসক পরিষদ, এবং ৪. উপাসিকা পরিষদ।
এই বিভাজন প্রক্রিয়াকে আবার দুটি ভাগের মধ্যেও নেওয়া যায়। যেমন-

১.  লৌকিক বা গৃহী জীবনের উপযোগী উপাসক ও উপাসিকাগণ এবং ২. লোকোত্তর তথা পরমার্থিক জীবনের উপযোগী ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীগণ।

ভগবান বুদ্ধ উল্লেখিত উপাসক ও উপাসিকা পরিষদদ্বয়কে আমরা সংক্ষেপে গৃহীসমাজ রূপে চিহ্নিত করতে পারি। এ সমাজ জীবনকে সামগ্রিকভাবে চারভাগে বিভক্ত করা হয়। যেমন-

১.শিক্ষার্থী জীবন,২. জীবিকা জীবন, ৩. বৈবাহিক জীবন, ৪. অবসরকালীন জীবন।

বৌদ্ধসমাজের পরিকাঠামোর উন্নতি বিধানে যে সকল পদক্ষেপগুলি স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা উচিত, সেগুলি হল এইরূপ-

১. শিশু শিক্ষা অবশ্যই ৩-৫ বৎসরের মধ্যে প্রারম্ভ করতে হবে। সর্বোপরি বৌদ্ধ মাতা-পিতা ও জ্ঞাতিবর্গ সন্তানের জন্মতিথিকে স্মরনীয় করার প্রশ্নে বুদ্ধপূজা, শীলগ্রহণ, সংঘদান বা ভিক্ষুসংঘকে ব্যবহারিক দ্রব্য ও ভোজ্যদান ইত্যাদির মাধ্যমে জন্মোৎসব উদযাপন করা উচিৎ। 
২.  বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে প্রতিটি বিহারে সর্বজনীনভাবে শিশু বিদ্যারম্ভ আয়োজন করা উচিৎ।
৩.  এই শিক্ষার প্রশ্নে বৌদ্ধ অভিভাবকগণ কৃত্য একটি স্থায়ী তহবিল গঠন। অথবা বিহারভিত্তিক স্থায়ী তহবিলের মাধ্যমে বিহার সংশ্লিষ্ট দায়কগণের সন্তানদের সুশিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিৎ। 
৪.  বিহার কর্তৃক উচ্চমানের এবং স্থায়ী তহবিলের মাধ্যমে পুস্তক এবং অন্যান্য শিক্ষার উপযোগী বস্তুসমূহ বিতরণ করা বাঞ্ছনীয়। 
৫.  প্রতি সপ্তাহের প্রথম দিবসে বৌদ্ধ পিতা মাতা, সন্তান এবং আত্মীয় পরিজন একটি নিদিষ্ট সময়ে বিহারে উপস্থিত হয়ে ভিক্ষুর নির্ঘণ্ট হতে ধর্মকথা শ্রবণ-আলোচনা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণে নিয়মিতভাবে সম্পাদন করতে হবে।
৬.  বৌদ্ধশিশু ও তার পরিবারবর্গ মুক্ত চিন্তা প্রতিপালন করবে এবং মিথ্যাদৃষ্টি মূলক কোনরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না এবং সবিনয়ে তা প্রত্যাখান করে।
৭.  একজন বৌদ্ধশিশুকে ভবিষ্যৎ নাগরিক হওয়ার প্রশ্নে তার যাবতীয় আচার- আচরণ বৌদ্ধধর্মমুখী করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে তার ধর্মকে সে যুক্তি-বুদ্ধির মাধ্যমে রক্ষা করতে পারে এর ফলে তার উচ্চশিক্ষার পথও সুগম হবে।

জীবিকা অর্জন:

শিক্ষার্থী জীবনের কোন পরিসমাপ্তি হয় না। তবুও পরিবারের প্রতি সুনির্দিষ্ট দায়বদ্ধতার কারণে শিক্ষার্থীকে একটি সময়ের পর জীবিকা অর্জনের প্রতি আত্মনিয়োগ করা উচিৎ। কারণ কর্মহীন জীবন অপরাধ এবং পাপ প্রবণতার জন্ম দেয়। 

যদি কোন সুনির্দিষ্ট সদুপায়মূলক জীবিকা লাভ সম্ভব না হয় তাহলে ক্ষুদ্র ব্যবসা অথবা উৎপাদনমূলক কর্মে আত্মনিয়োগ করা কর্তব্য। 

তবে একজন বৌদ্ধোপাসক কখনই কোন ঘৃণ্য বা হীনবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না।
যেমন- অস্ত্র, বিষ, মদ্য, মাংস ও প্রাণী সংশ্লিষ্ট ব্যবসা।

সহজ, সরল, অনাড়ম্বর জীবন সহ কঠোর পরিশ্রমই হল জীবন নির্বাহের আসল চালিকা শক্তি। এই বিষয়টিও মনে রাখা প্রয়োজন। 

জীবন বিষয়ে কতকগুলি সংকল্প একজন বৌদ্ধোপাসককে অবশ্যই দৃঢ়তার সঙ্গে বাস্তবায়িত  করতে হবে। সেগুলি হল এইরূপ- 

ক.  নিজের ও পরিবারের নিত্য এবং জরুরী প্রয়োজনে মোট আয় এর ৫০% বা অর্ধাংশ।
খ.  সন্তানদের শিক্ষা খাতে ১০%।
গ.  চিকিৎসা, বিনোদন, অতিথি ও জ্ঞাতি স্বজন আপ্যায়নে ১০%।
ঘ.  দান ধর্মাদি কুশল কর্মে ১০%।
ঙ.  সঞ্চয় ২০%।

বৈবাহিক জীবন:

প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন যে সদ্ধর্মের অনুশীলনের মাধ্যমে উপাসক-উপাসিকার বৈবাহিক জীবন সুখপ্রদ হয়। বর্তমানে বৌদ্ধ পরিবারগুলির মধ্যে এই অনুশীলনের অভাব থাকার কারণে অপর ধর্মের নারী-পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হওয়ার বাঙ্গালী ক্রমশই সংকুচিত হয়ে পড়েছে।  ফলে এই অসম বিবাহের পরিণাম স্বরূপ মানসিক অবসাদ এবং নির্যাতন তথা আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখতে পাওয়া যায়।

সুতরাং বৌদ্ধ পরিবারগুলির ভাঙ্গন তথা বৈবাহিক জীবনসমূহকে সুখপ্রদ করার প্রশ্নে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ অথচ দৃঢ় প্রদক্ষেপ গ্রহণ অবশ্যই জরুরী। যেগুলি হল এইরূপ-

১.  প্রতিটি বৌদ্ধ পরিবারের অবশ্য কর্তব্য যে তারা যেন তথাকথিত স্বাধীন চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজ স্বার্থকে বিসর্জন না করেন।
২.  অপর ধর্মে বিবাহ সম্পর্কে সদ্ধর্মের আদর্শ বিচ্যুত হয়। ফলে সদ্ধর্মের আদর্শ রক্ষার্থে এই প্রকার অবাঞ্ছনীয় কর্ম হতে বিরত থাকাই শ্রেয়।
৩.  যদি কেউ স্বেচ্ছায় ( নারী- পুরুষ) এইরূপ কর্ম সম্পাদন করে স্বার্থ ত্যাগ করে তাহলে তার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। 
৪.  বিবাহ সম্পর্কিত রীতি পদ্ধতি  বৌদ্ধ নিয়মানুসারেই সম্পন্ন হওয়াই শ্রেয়। অপর বিবাহ আইনে বৌদ্ধবিবাহ সমীচিন নয়।
৫.  আবেগপ্রবণ কর্মকাণ্ডের ফলে বৈবাহিক সম্পর্ক চিরস্থায়ী হয় না। সুতরাং অদৃষ্ট নির্ভর জীবন নয়, ভগবান বুদ্ধের প্রদর্শিত পথেই বৈবাহিক জীবন পরিচালনা করাই শ্রেয়।

বিবাহিত নরনারীর স্বীয় জীবনকে ভগবান বুদ্ধ আবিষ্কৃত সম্যক জীবন দর্শনে ভাবিত করতে পারলে আসক্তির বিষময় পরিণাম হতে মুক্তিলাভ করে সুন্দর এবং সংযমী জীবনচর্যা সম্ভবপর হয়।

আদর্শ জীবন গঠনে অভিলাষী প্রত্যেক বৌদ্ধ নরনারীকে সম্যক জীবন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সংযম কৌশল আয়ত্ব করতে হলে ১৫-২৫ বৎসর সীমা পর্যন্ত অখণ্ড অষ্টাঙ্গ উপোসথ শীল নামক 'গৃহী ব্রহ্মচর্য জীবন' পালন অত্যন্ত আবশ্যক। 

বিবাহিত জীবনের পূর্ণাঙ্গ সার্থকতা নির্ভর করে সন্তানের জীবন গঠনে আদর্শ মাতা-পিতার ভূমিকা পালনে। এই মহান দায়িত্ব পালনে উভয়কে প্রথমে সৎ, পবিত্র, ধর্মগারবতা সম্পন্ন তথা বিবেক- বুদ্ধিপরায়ণ মানসিকতা সম্পন্ন রূপে গড়ে তুলতে হবে।

"নিজে আচরি ধর্ম অপরকে শেখাও" এই বুদ্ধ শিক্ষার অনুশীলন কোথায়? বিবাহিত জীবনে কুসন্তান বা নিঃসন্তান  দম্পতি অজ্ঞানী হলে পরিতাপের  সীমা থাকে না। অথচ সদ্ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা-বিশ্বাস থাকলে এই পরিতাপ মুক্ত হওয়া সম্ভব।

যে ব্যক্তির ত্যাগ কেবল পরিবার ও সন্তান সন্ততির মধ্যে সীমাবদ্ধ তিনি সেই পরিবারের নিকট স্মরণীয়। কিন্তু তার ত্যাগের ব্যক্তি যদি বুদ্ধ শাসনে নিবেদিত হয় তখন তার ত্যাগের ব্যাপ্তি গৌরবনীয় হতে থাকে। সুতরাং ত্যাগময় পবিত্র জীবন যাপনের উদ্দেশ্য ভগবান বুদ্ধের কর্মময় শিক্ষাকে গ্রহণ করাই শ্রেয়। 

ভগবান বুদ্ধের শিক্ষা হল কর্ম সম্পাদন কর সাময়িক প্রয়োজন  কিন্তু অনাসক্ত হও প্রতিটি কর্ম সম্পাদনকালে সৃষ্ট অসংখ্য চিত্ত উৎপত্তিতে। সুতরাং ভোগাকাঙ্ক্ষা হতে বিবাহিত জীবনকে মুক্ত করতে পারলে প্রজ্ঞালোকের উজ্জ্বল আলোকে পূর্ণ হয়ে উঠবে এই জীবন এবং সুখী হবে পরিবার।
বৌদ্ধিক সমাজ বিভাগ:

গৃহী জীবনকে একটি অখণ্ড সামাজিক ও জাতীয় ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করার প্রশ্নে পেশা ও মেধাভিত্তিক কিছু কর্ম পরিকল্পনা একান্তভাবে প্রয়োজন। যেমন-
১.গৃহস্থালি, ২. শিক্ষাজীবি, ৩. কৃষিজীবী, ৪. ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ৫. বৃহৎ ব্যবসায়ী, ৬. চিকিৎসাজীবী, ৭. প্রকৌশলী, ৮.  কারিগর, ৯. সেবা বা চাকুরীজীবি, ১০. স্বেচ্ছাসেবী বা ধর্ম সমাজ কল্যাণকর্মী ইত্যাদি। 
উপরিউক্ত পেশার ক্ষেত্রে একথা বলা যায় যে সদ্ধর্মের বিকাশ সাধন ও কল্যাণে যদি এই পেশাগুলি নিয়োজিত না হয় তা সামগ্রিকভাবে এইগুলি হয়ে ওঠে  অকল্যাণদায়ী ও অদূরদর্শীতাময়।

অবসরকালীন জীবন:

ষাট হতে সত্তর বৎসরকাল হল  অবসরকালীন জীবন অতিবাহিত হওয়ার সময়কাল। এই সময়কালে স্বার্থে দীক্ষা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। এর সাথে সাথে সদ্ধর্ম ও সদ্ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমাজ কল্যাণমূলক কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করে অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করার অর্থই হল মহাশক্তিময় নির্বাণ।

মহান বুদ্ধ প্রজ্ঞাপিত মহাসতিপট্ঠান ভাবনা পদ্ধতি অবসরকালীন জীবনে অনুসরণ করার অর্থ হল ইন্দ্রিয় সংযমতার অনুশীলন। এই অনুশীলন দ্বারা লাভ হবে নবজন্ম। আর এই নবজন্ম নব্য যুবশক্তিকে অনুপ্রেরণা দানের মাধ্যমে নির্মিত হবে বৌদ্ধিক অনুপম সমাজ মণ্ডল।

বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের বিনয়শিক্ষা:

বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ সদ্ধর্মের বিকাশ সাধন তথা গৃহী উপাসক - উপাসিকাগণের প্রতি ধর্মশিক্ষা প্রদানের মূল চালিকা শক্তি। ভিক্ষু সংঘ ব্যতীত সদ্ধর্মের উন্নতি তথা প্রচার অসম্ভব। 

সদ্ধর্মের উন্নতি বিধানে ভগবান বুদ্ধ প্রদত্ত বিনয় শিক্ষাগুলি নিয়মিতভাবে অনুশীলন করা উচিৎ। যেমন- ভিক্ষুগণ সর্বদা একত্রিত হলে, কোন ভিক্ষু কিভাবে চলাফেরা করছেন তা জানা যায়। দেশনা উপোসথাদি কার্য্যত যথা নিয়মে সম্পাদিত হয়। কোন ভিক্ষু অন্যায়ভাবে আচরণ করতে সাহস পান না। ভিক্ষুসংঘ অপ্রমত্ত আছেন, ফলে পাপী ভিক্ষুগণ পলায়ন করেন। সর্বদা একত্রিত না হলে যথা সময়ে কিছু অবগত হওয়া যায় না ও অন্যায়ের প্রতিকার হয় না।

সংঘ স্বশিক্ষিত হওয়ার সত্বেও লাভ করে কোন ভিক্ষু আমার অমুক কাজ আছে বলে নিক্ষেপ না করে যথাসময়ে সকলের উপস্থিত হওয়া কর্তব্য। 

একজন ভিক্ষু রোগ, দুঃখ, অভাবাদি সকলে অভিন্ন হৃদয়ে তার প্রতি সাহায্য করা বাঞ্ছনীয়। কেউই আল্যাভিভূত হবেন না।

বিনয় বহির্ভূত কতিকাব্রত বা শিক্ষাপদ ব্যবস্থাপিত না করা। ভগবান কতৃক প্রজ্ঞাপ্ত শিক্ষাপদ সমূহের সমুচ্ছেদ না করা এবং ক্ষুদ্রাণুক্ষুদ্র শিক্ষাপদও অতিক্রম না করা।

যে সকল ভিক্ষু আচার্য উপাধ্যায়গণের সেবায় উপগত নন, তারা যথাবিধি উপদেশাভাবে আর্য্যধন ও শীলাদি গুণ হতে বঞ্চিত হতে থাকেন।

চতুর্প্রত্যয়ের ( চীবর, পিণ্ডপাত, শয়নাসন ও ভৈষজ্য)  জন্যও দায়কের পদানুবর্তী হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

গ্রামস্থ বিহারে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকা অপেক্ষা অরণ্য বিহারে নিদ্রাগত হওয়া শ্রেয়। কারণ গ্রাম্য বিহারে স্ত্রী - পুরুষ ও কুমারীদিগের শব্দে বা দর্শনে ধ্যানচ্যুতির আশঙ্কা আছে।

ভিক্ষুগণ চীবর সেলাই, অংশ বন্ধন, কায়বন্ধন, পাত্রের থলে সূচীঘর নির্মাণ প্রভৃতি কর্ম সম্পাদন কার্যে দিবারাত্র ব্যাপৃত থাকতে নেই। উপরোক্ত কর্মসমূহ সম্পাদন করেও যথাসময়কালে অধ্যয়ন অধ্যাপনা, আবৃত্তি, ধ্যান- ধারণাদি করা উচিত।
তাহলে তা কর্ম্মারাম হয় না।

ধর্মালোচনায় দিবারাত্র অতিবাহিত করতে নিষেধ নেই। ভিক্ষুগণ সম্মিলিত হয়ে নিম্নোক্ত দুইটির মধ্যে একটি করণীয়, ধর্মালাপ অথবা আর্যতুষ্ণীভাব।

যে সকল ভিক্ষু শয়ন, উপবেশন, গমন ও চঙ্ক্রমনে একাকী আরামবোধ করেন না, একাকী হতে দ্বিতীয় ব্যক্তি অন্বেষণ করেন, দুইজন হতে তৃতীয়, তিনজন হতে চতুর্থ ব্যক্তি অন্বেষণ করেন, তাহারাই জনসঈারাম,বা জনসঙ্ঘরত হন।

লাভ সৎকারাদি প্রাপ্ত হওয়ার নিমিত্তে, যে ভিক্ষু দুঃশীল হয়েও সুশীল, অথবা ধ্যান মার্গফলাদি লাভ না করেও করেছেন বলে প্রকাশ করে থাকেন, তিনি পাপেচ্ছা হন।

ভিক্ষুগণ ভিক্ষাচরণে উৎকৃষ্ট ভোজন লাভ করলেও তা একাকী পরিভোগ করা ন্যায় সঙ্গত নয়। আরও লাভের আশায় গৃহীকেও প্রদান করা উচিৎও  নয়। ভিক্ষুগণকে সমবেত করে সমান অংশে পরিভোগ বাঞ্ছনীয় ভিক্ষুগণ প্রত্যুষকালে শয্যাত্যাগ করে শরীরকৃত্যাদি সম্পাদন করতঃ বিহার সম্মার্জননাদি নিত্যকর্ম সম্পাদন করে নির্জনে উপবেশন করতঃ মৈত্রী মনোকর্ম সম্পাদন করা উচিত।

বয়োকনিষ্ঠ সব্রহ্মচারিগণের কার্যের সাহায্য করলে এবং বয়োজ্যেষ্ঠগণের পরিচর্যাদি করলে, সম্মুখ মৈত্রীকায় কর্ম সম্পাদন হয় 

ভিক্ষুগণের পক্ষে বিনীত আচার ব্যবহার, শিক্ষাপদ, কর্মস্থান, বুদ্ধবচন শিক্ষাদান ও ধর্মদেশনা ইত্যাদি হল মৈত্রী বাচনিক কর্ম। উক্ত কর্ম সম্পাদনে বিচ্যুতি হলে ভিক্ষু দুঃশীল পরায়ণ হয়।

সপ্ত আপত্তি স্কন্ধের আদি বা অন্তের শিক্ষাপদ ভঙ্গ হলে খণ্ড, মধ্যের শিক্ষাপদ ভঙ্গ হলে ছিন্দ্র, ক্রমান্বয়ে ২/৩ টি শিক্ষাপদ ভঙ্গ শবল, অন্তরে ভঙ্গ হলে কল্মাষ নামে কথিত হয়। যার কোন শিক্ষাপদ ভঙ্গ হয়নি তাঁর শীল অখণ্ড অচ্ছিদ্র অশবল অকল্মাষ বলা হয়।

উপরিউক্ত শিক্ষাগুলি অনুশীলন দ্বারা ভিক্ষুসংঘ সদ্ধর্মকে ছিদ্রাদ্বেষীর হাত হতে রক্ষা তথা সংরক্ষণ করতে পারবেন। বর্তমানে সদ্ধর্ম রক্ষার্থে উপযুক্ত ভিক্ষুর অভাব প্রায়শই প্রকট হতে প্রকটতর হচ্ছে। গৃহী উপাসকগণ আধুনিক ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে তাদের পরিবারের কোন সন্তানকে ভিক্ষুসংঘকে প্রেরণ করার প্রশ্নে অনীহা বোধ করেন। ভিক্ষুসংঘও এই সমস্যার সমাধানকল্পে গৃহী উপাসকগণের প্রতিও উৎসাহ প্রদান করতে সক্ষম হয়নি। এই সমস্যার সমাধান হেতু এইরূপ গৃহীত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে। যেগুলি হল এইরূপ-

১.  ভিক্ষুসংঘে সংগঠক ও কর্মী ভিক্ষু তৈরি করতে হবে। এই সংগঠক তথা কর্মী ভিক্ষুর কাজ হবে ভিক্ষুসংঘ এবং গৃহী সংঘকে সংগঠিত করে ধর্ম ও সমাজ উন্নয়নে বিভিন্ন কল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ।
২.  ধ্যানী ভিক্ষুদের ধ্যানের, শীলবান ভিক্ষুদের শীলপালনের, লেখক ও গবেষক ভিক্ষুদের লেখা ও গবেষণায়, শিক্ষার্থী ভিক্ষুদের শিক্ষালাভে, দেশক ও ধর্মপ্রচারক ভিক্ষুদের ধর্ম প্রচার কাজে এবং পত্র-পত্রিকা, ক্যাসেট, ভিড়িও এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে ধর্মপ্রচার করতে হবে।
৩. গৃহী সমাজকে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে যাতে তার পরিবারের অন্তত একজন সন্তান (পুত্র - কন্যা)  সে ভিক্ষুসংঘে যোগান করেন।
৪.  বিহারগুলিতে ধর্মবিষয়ক পুস্তক সংরক্ষণ ও শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য পাঠাগার নির্মাণ, নিয়মিত সদস্য সংগ্রহ তথা কম্পিউটার বিভাগ গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ভিক্ষু সংঘ ও গৃহী উপাসক- উপাসিকাগণকে সম্পৃক্ত হতে হবে।
৫. বিহারগুলিতে শিক্ষা উন্নয়ন তহবিল এবং ধর্ম- সমাজ উন্নয়ন তহবিল গঠনের মাধ্যমে বৌদ্ধসমাজকে উন্নত করার প্রশ্নে ভিক্ষুসংঘকে নিয়োজিত হতে হবে।
৬.  বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সচিত্র পরিচয় পত্রের প্রচলন এবং গৃহী উপাসক - উপাসিকাগণের মিলিত সংঘ গঠনে ভিক্ষুসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে।
৭.  ভিক্ষুসংঘের পরিচালনায় গড়ে তুলতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয় এবং কারিগরি শিক্ষা বিভাগ।
৮.  পালি শিক্ষার প্রাধান্য, পালি বোর্ড গঠন ইত্যাদির মাধ্যমে বুদ্ধচর্চার বিকাশ তথা প্রসার করতে হবে।

বাঙ্গালী বৌদ্ধসমাজে বৌদ্ধবিবাহ আইন, বৌদ্ধসম্পত্তি আইন এবং স্বতন্ত্র শিক্ষা বোর্ড ইত্যাদি কিছুই নেই। ফলে বৌদ্ধ সমাজ অপর ধর্মের আগ্রাসী ভূমিকার নিকট নতজানু প্রায়। এই অবস্থার নিরসন হেতু ভিক্ষুসমাজ একত্রিতভাবে এই সকল বিষয়গুলি ধর্মবিধান অনুসারে যদি গঠন করে তাহলে বৌদ্ধসমাজের ভাঙ্গন রোধ করতে পারবে। তবে এই বিষয়ে গৃহী বৌদ্ধদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

ভিক্ষুসংঘ এবং দায়কগণ যদি সচেষ্ট হন তাহলে এই সমস্যাগুলি দূরীভূত করা সম্ভব। অর্থাৎ এই বিষয়ে যদি কঠোরভাবে বিধান নিয়ম লিপিবদ্ধ করা যায় এবং তা যদি রাষ্ট্রের নিকট হতে দাবী আদায়ের মাধ্যমে অর্জন করা যায় তাহলে নির্মিত হবে অনুশাসন প্রসঙ্গত, মনে রাখা প্রয়োজন যে বৌদ্ধসমাজ এবং স্বার্থকে রক্ষার প্রশ্নে যদি কঠোর এবং সংযমী মতাদর্শ নির্মাণ না করা যায় তাহলে বুদ্ধশাসনকে রক্ষা করা কার্যত সম্ভব হবে না। যে ভিক্ষু এবং উপাসক উপাসিকা নিজেদের লাভ, সৎকার, সম্মানের আশায় অসাধু, দুঃশীল, অবিনয়ী ভিক্ষুদের আশ্রয় দেয় তারাও বুদ্ধশাসন ধ্বংসের জন্য সমদোষে দোষী।

বিত্তশালী গৃহী উপাসকদের কর্তব্য: 

দেশে সম্পদশালী, উদ্যোগপতি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বৌদ্ধসমাজ রক্ষার বৌদ্ধ-তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানের জন্য অগ্রণী রাখতে হবে নচেৎ অচিরেই বাঙ্গালী বৌদ্ধদের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। গরীব, দিনমজুর, কৃষক, স্বল্প আয়ের বৌদ্ধ জনসাধারণ অর্থনৈতিক যাঁতাকালে নিয়ম হয়ে জায়গা- জমি-সম্পত্তি হারিয়ে ফেলছে যা আমাদের জাতীয় জীবনে উত্তর প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে -
অতএব সাধু সাবধান সকলকে সচেতন হতে হবে।

বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ যেসকল আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন সেগুলি হল-

১.  যাঁরা কলকারখানা বা পোশাক শিল্পের মালিক আছেন তাঁদের কারখানায় বৌদ্ধ যুবক যুবতীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
২.  যাঁরা বিত্তশালী তাঁরা ক্লিনিক বা উন্নত চিকিৎসালয় স্থাপন করে সেখানে বৌদ্ধ ডাক্তার বা নার্স, টেকনিশিয়ানের মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেন।
৩.  বিভিন্ন অবহেলিত বৌদ্ধপল্লীতে এম্বুলেন্স ব্যবস্থা করলে বিনা চিকিৎসায় কেউ মৃত্যু মুখে পতিত হবে না এবং সেখানেও চালক এবং হেল্পার হিসেবে বৌদ্ধ যুবকদের কর্মসংস্থান হবে।
৪.  বিত্তশালী যাঁরা আছেন তাঁরা বঙ্গীয় বৌদ্ধ শিল্প, ভাস্কর্যের আদলে বুদ্ধমূর্তি বা অন্যান্য ভাস্কর্য শিল্প কারখানা সৃষ্টি করলে বৌদ্ধ যুবক যুবতীদের কর্মসংস্থান হবে এবং আমাদের দেশের সঙ্গে বৌদ্ধ দেশসমূহে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক, সৌভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন সৃষ্টি হবে এবং সংস্কৃতির আদান প্রদান হবে এবং বিভিন্ন দেশ হতে বুদ্ধমূর্তি আমদানিতে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বা কষ্টার্জিত মুদ্রা ব্যয় হয় তা বিনষ্ট হবে না।
৫.  বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন বৌদ্ধপল্লীতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ কর্মশালা কারিগরি প্রশিক্ষণশালা সৃষ্টি করতে পারেন সেখানেও বৌদ্ধ যুবক- যুবতীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
৬.   বিভিন্ন গ্রামে গ্রন্থাগার স্থাপন করলে সেখানেও বৌদ্ধ যুবক- যুবতীরা গ্রন্থাগারিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে এবং আমাদের সমাজের ছেলেমেয়েরা গ্রন্থাগারে বসে সাহিত্য - সংস্কৃতির চর্চায় সুযোগ পাবে। অবহেলা সময় নষ্ট হবে না। সুন্দর, রুচিশীল, প্রগতিশীল নাগরিকের ভূমিকা পালন করতে পারবে।

এই সব কর্মসংস্থান যদি সৃষ্টি করতে এগিয়ে আসা যায় তাহলে আমাদের মুষ্টিমেয় বৌদ্ধসমাজের তরুণ -তরুণীদের দেশের সরকার কিংবা বিদেশমুখী হতে হবে না। বিদেশমুখী হতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যা ও অসাধুতার পথ অবলম্বন করতে হবে না। অসাধুতার পথে পরিবার সমাজ অতল জলে তলিয়ে যাবে না, সম্মান হানিও হবে না। তদুপরি বিদেশ মুখাপেক্ষীহীনতা হলে ক্ষুদ্র বৌদ্ধ সমাজের তরুণ তরুণীরা স্বদেশ স্বভূমিতে অবস্থান করে নিজের আত্মীয় স্বজন পিতা, মাতা, সমাজ- স্বধর্মের তথা সদ্ধর্মের উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে এবং একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়ে ভাঙ্গন সৃষ্টি হবে না। বিদেশমুখী হতে গিয়ে অনেক বৌদ্ধপল্লীতে তাঁদের পূর্বপুরুষদের কষ্টার্জিত সম্পত্তি বিক্রি করে ফেলছে এবং ভূমিহীন হয়ে পড়ছে তাতে করে আমাদের সমূহ বিপদ ঘনিয়ে আসছে। এবং বিদেশমুখী হওয়ার ফলে বৌদ্ধরা উচ্চশিক্ষার হারে পিছিয়ে পড়ছে এবং ভবিষ্যতে সাহিত্য সংস্কৃতে আমাদের অবস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে। এমন কি বড়ুয়ারা বেশি লাভের আশায় স্বজাতি- সমাজের লোককে বিক্রি বা হস্তান্তর না করে অন্য সম্প্রদায়ের কাছে বিক্রি করছে এতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম - জাতি- সমুদয় সমূহ বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। আত্মার আত্মীয়তার বন্ধন একে একে ভুলতে বসেছে। এতে যদি বিত্তশালীরা সেগুলি ক্রয় করে নিতে পারেন তাহলেও কিছুটা রক্ষা পাবে নচেৎ অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ছিন্নমূল ও ভূমিহীন অবস্থায় কালযাপন করতে হবে এবং আমাদের জাতীয় সত্ত্বার অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে অচিরেই বিনষ্ট হয়ে যাবো। অনেকে হয়তো উত্তরে বলতে পারেন বিদেশমুখী হয়ে আমাদের যুবকরা ধর্ম ও সমাজের জন্য অর্থ ব্যয় করছেন  বড় বড় বিহার নির্মাণ করছে। ভিক্ষুদের দান দক্ষিণা দিচ্ছে। কিন্তু তাতে করে কি লাভ হবে বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ করে যদি সেগুলি রক্ষাণাবেক্ষণ করা না যায় এবং উপযুক্ত উত্তরসূরী সৃষ্টি করা না যায়। তাহলে তার মূল্য কি দাঁড়ায়? কিংবা মৈত্রী করুণা বা উদারতা প্রসার হচ্ছে কতটুকু? এমন অনেক বৌদ্ধ পল্লীতে দেখা যায়, যারা বিদেশ গমন করে অর্থশালী হয় কিন্তু আত্মীয় পরিজন পাড়া প্রতিবেশি যারা নানাভাবে অবহেলিত তাদের সামান্য দান দিতেও কার্পণ্যতা করে, তাহলে দেখা যাচ্ছে এই বিত্ত বা বিদেশ গমণের কি যৌক্তিকতা।

আদর্শ সাংঘিক সমাজ সৃজনে ভিক্ষু- শ্রমণ প্রশিক্ষণের গুরুত্ব: 

বৌদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা দুটি পরিকাঠামোর উপর নির্ভরশীল। এক, ভিক্ষুসংঘ এবং দুই, গৃহী সংঘ। এই দুটি সত্তার সমন্বয়ে বৌদ্ধসমাজ ব্যবস্থা এগিয়ে চলে। প্রত্যেকটি সৃজনশীল সমাজে আদর্শ তথা মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গৃহী এবং সাংঘিক পরিকাঠামো সৃষ্টিতে শীল ও নৈতিকতা একান্তভাবে অপরিহার্য। আদর্শ সংঘের অর্থ বলতে কি বোঝায়? বেশ আমরা আদর্শবান হব, না হতে হবে তা দেখা প্রয়োজন। আদর্শ - অ+√দৃশ+অ( ঘঞ)-বি বৈদিক, সেই অর্থে আদর্শ। এক কথায় দর্শন বা আরশি।

আদর্শ সাংঘিক সমাজ সৃজনে যে বিষয়টি এখানে অবতারণা করা প্রয়োজন তা হল- আমরা সংঘ বলতে কোন সংস্থা বা সংগঠনকে বুঝি।

কিন্ত তাত্ত্বিক অর্থে সংঘ শব্দের মূলগত অর্থ হল- ' শেকড়'। সংঘ- (সং,সম+হিন+ আ) সংঘ।বৌদ্ধ অর্থে সংঘ কথাটির মূলগত অর্থ হল সমগ্র অকুশল সমূহের ছেদন। আর সামগ্রিক অর্থে সংঘ হল এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার তলে একত্রিত হয়ে বসবাস করা অর্থাৎ শ্রেণীহীন প্রতিষ্ঠান যার মধ্যে কোন রূপ ভেদ- বিভেদ নেই।

ভগবান বুদ্ধ এই দৃষ্টিকোণ থেকেই সংঘ সৃষ্টি করেছিলেন। বুদ্ধের সংঘ সৃষ্টির আরও অনেক অর্থ বা তাৎপর্য রয়েছে। যেমন বুদ্ধ মূলত সংঘ সৃষ্টির দ্বারা জাগতিক দুঃখের অবসান চেয়েছেন। সমগ্রভাবে গমণ করে বলে সংঘ। " সমগ্গতো গচ্ছতীতি সংঘো" গণ সমূহার্থ বাচক। " সং সমত্ততো হনতীতি পি সংঘো।" সকল প্রকার অকুশলকর্মের নিমূর্লিকরণ।

সংঘের উন্নতির প্রয়োজনীয়তা: 

একাকী জীবন অতিবাহিতকরণ সম্ভবপর নয়। সুখ লাভ করতে হলে সামগ্রিক অর্থে সকলের মঙ্গল কামনা অত্যন্ত আবশ্যক। কৃপণ, স্বার্থপর ব্যক্তি সকলের দ্বারা নিন্দিত হয়। জ্ঞানী ব্যক্তি যদি স্বীয় জ্ঞান আত্মপর উভয়ের হিতার্থে প্রয়োগ না করে আত্মস্বার্থ ও পরমর্দ্দমাত্রে পর্যবসিত করেন তবে তার জ্ঞান বহুজনের অহিতের জন্য ও অসুখের জন্যই হয়ে থাকে। অপরদিকে আত্মপর সকলের হিতাভিলাষী ব্যক্তিকে জনসংঘের উন্নতির নিমিত্তে বিশেষ লক্ষ্য - চেষ্টা করতে হয়।

সংঘের সফলতা :-

সংঘের সফলতা নির্ভর করে উদ্যোগ এবং উৎসাহের উপর। তবে ছিদ্রান্বেষী ব্যক্তিবর্গ বৌদ্ধ সংঘের পক্ষে অনিষ্টকর ও অকল্যাণময়। যদি উভয় সংঘ যথাসাধ্য স্বার্থ ত্যাগ করে তা হলে নিশ্চয়ই সমবেত সংঘের শক্তি দ্বারা সমাজের বহু কল্যাণ সাধিত হয়।

অবনতির কারণঃ-
'বহবো যত্থ নেত্তারো সব্বে পণ্ডিত মানিনো,
সব্বে মহত্তমিচ্ছতি কম্মং তেসং বিনস্সতি।'

 অর্থাৎ যেখানে বহু নেতা থাকলেই পণ্ডিতগামী, সকলেই উচ্চ প্রশংসার নিমিত্তে লালায়িত, তাদের কর্ম বিনষ্ট হয়। আমরা যদি সকলেই নেতা হতে ইচ্ছা করি, সকলেই পণ্ডিতাভিমানী হই, এবং কর্ম সম্পাদন ব্যতীতই যশস্বী হতে চাই তাহলে আমাদের স্বল্প কর্ম অচিরেই বিনষ্ট হবে।

আমাদের গৃহী ও ভিক্ষুসংঘের মধ্যে এমন কর্মী প্রয়োজন, যারা ফলবান বৃক্ষের ন্যায় অবনত শিরে পরহিতকর কর্ম সম্পাদন করতে পারেন।

যারা ধরণীর ন্যায় আপনার শরীর দ্বারা অপরের হিতার্থে কর্ম- সম্পাদন করেন। তিনিই হলেন সুপুরুষ। 

ভগবান বুদ্ধ দানকেই ত্রাণ বলেছেন। " দানং তানং মনুস্সানং" এবং এইটি হল মানবের বন্ধু  ও পরম গতি।

আমরা জানি যে ধর্ম ব্যতিত কেন জাতি সত্তার উন্নতি বিধান সম্ভবপর নয়। তবে আমাদের অর্থাৎ বাঙ্গালী বৌদ্ধগণের এই সদিচ্ছার অভাব হেতু বুদ্ধ গুণের শ্রীবৃদ্ধি সাধিত হচ্ছে না। সদ্ধর্মের কল্যাণে। ধর্মদান, সংঘদান এবং অর্থদান ব্যতীত সদ্ধর্ম রক্ষা সম্ভব নয়।

সংঘের উন্নতির উপায় :

সংঘের উন্নতির একমাত্র উপায় হল ধর্ম। সংঘ ধর্মেই  স্থিত আছে। ধর্ম ব্যতীত জীব সংঘ অর্থহীন। সংঘের অপায় চতুষ্টয়ে নিমজ্জিত হতে না দিয়ে ধারণ করে বলেই দান- শীল ইত্যাদি নাম হল ধর্ম। এই জীবনে সাদৃশ্য ধর্মে যদি বৌদ্ধ সাধারণ অনভিজ্ঞ থাকেন, তবে তারা হলেন প্রাণহীন নির্জীব তুল্য। গৃহী ও ভিক্ষু - উভকেই এই বিষয়কে দূরীভূত করতে হবে।

সংঘ হল বর্ণোজ্জ্বল সূর্যালোকের ন্যায় উদ্ভাসিত এবং অপরদিকে তমসাচ্ছন্নতা হল অবিদ্যা। অবিদ্যা প্রকোপ বেশি হলে সংঘ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। আমি আমার আমিত্ব ইত্যাদি অহং বোধগুলি দূরীভূত করলে ধর্মমতি উৎপন্ন হয় এবং সংঘ সবল হয়।

ধর্মই আমাদের শ্রেষ্ঠ মাতাপিতা ধর্মত্রাতা, ধর্মই শরণ ও প্রতিষ্ঠা। 

'ধম্ম বিনা নথি পিতা চ মাতা;
তমেব তাণং সরণং পতিট্ঠ।'

অতএব নিজেকে স্বয়ং ভালোবাসলে, নিজেকে প্রিয় মনে করলে সাংসারিক কর্ম হতে ক্ষণিক অবসরগ্রহণের মাধ্যমে সাংঘিক কর্ম সম্পাদন সম্ভব। 

ভিক্ষু ও গৃহী উভয় পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ না করে থাকলে মিলিতভাবে যদি সামান্য স্বার্থ ত্যাগ করেন, তাহলে এই অন্ধকার সম ভিক্ষুসংঘে জ্ঞানের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হবে।

সৃজনশীল ভিক্ষুসংঘ প্রজন্ম ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা:

বৌদ্ধ পুরাতন প্রজন্মের হাত ধরে সৃজনশীল নব্য প্রজন্মের উন্মেষ। এই নব্য প্রজন্মের নিকট আমাদের আশা আকাঙ্কা অনেক।কারণ তারা এই ডিজিটাল প্রজন্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

এই প্রসঙ্গে দুই প্রকার পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে সেগুলি হল-

১.  প্রকৃত জ্ঞানী, সংযমী ও বিনয়ধর ত্যাগী ভিক্ষুর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় শূন্য। অর্থ্যাৎ পুরাতন কাঠামো বর্তমানে নেই।
 
২.  পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের অবশিষ্ট রেখে পনের লক্ষ সাধারণ বৌদ্ধর প্রয়োজন মেটানোর নিরিখে সহস্রাধিক ভিক্ষু রয়েছে (?)। যদিও সেই সংখ্যা নগণ্য অপরদিকে মূল স্রোতের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে পূর্বকার ন্যায় ভিক্ষু - শ্রমণ।

এখন প্রসঙ্গ সূত্র অনুসারে এই বিষয়গুলি ক্রমবিকাশভাবে আলোচনা করা হয়। সেইরূপে সৃজনশীল প্রজন্মকে আধুনিক যান্ত্রিকতাময় পরিবেশ হতে মুক্ত থাকার তাই সংবেগ জনক ধর্ম চিন্তা প্রয়োজন। যেমন -

১.প্রসবকালে জন্মের দুঃখ।
২. বৃদ্ধকালে জরা দুঃখ।
৩. অন্তিমকালে বিষম স্মরণাতঙ্ক।
৪. অনেক সময় রোগ যন্ত্রণা। 
৫. অতীত দুঃখ।
৬. সংসারবর্ত দুঃখ। 
৭. অনাগত দুঃখ। 
৮. আহারান্বেষণ দুঃখ। 

তবে মূল বিষয় হল অনেক দায়ক- ভিক্ষু, ইউরোপ এবং এশিয়ার উন্নত দেশগুলিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও বঙ্গীয় ভিক্ষু এবং উপাসকগণের বিকাশের প্রশ্নে তীব্র অনীহাভাব পোষণ করে। সুতরাং আগামী প্রজন্মের ভিক্ষু মহাসভার হাত শক্তিশালী করতে হলে নিন্মলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করতে হবে। যেমন-

১. ভিক্ষু সংঘের কর্মপদ্ধতি অনাবাসী বৌদ্ধ দায়কগণের হাত ধরে আর্থিক ও সাংঘিকভাবে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।  দেশজ দায়কদের হাতকেও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। 
২. সংঘের সদস্যগণের নিমিত্তে আচরণ বিধি তৈরি করতে হবে বিনয়ের ভিত্তিতে। 
৩. দরিদ্র শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা-দীক্ষার উপকরণ সরবরাহ করতে হবে এবং পোশাক পরিচ্ছদ দান করতে হবে।
৪.  শহরে-বন্দরে রাজধানীতে পাঠরত মহিলা এবং কর্মরত মহিলাদের হোস্টেল নির্মাণের দায়িত্ব নিতে হবে।
৫.  জাতীয় ওয়েব নির্মাণ ও সদ্ধর্ম প্রচার।
৬.  সংঘ সম্পত্তি বোর্ড নির্মাণ। 
৭.  নিয়মিত সেমিনার আয়োজন ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশ।
৮.  ডিজিটাল ও গ্লোবাল ইনফরমেশন প্রযুক্তির ব্যবহার।
৯.  ইংরেজি ও পালি শিক্ষার প্রচার।
১০.  প্রচার, পুস্তিকা প্রকাশ ( কেন্দ্রীভূত ভাবে)।

ভিক্ষু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ধর্মীয় শিক্ষা:

অতি প্রাচীনকাল হতে বৌদ্ধ সংঘারাম সমূহ শিক্ষা ও সংস্কৃতির মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বৌদ্ধসংঘ শিক্ষাবিস্তারে কতদূর অগ্রণী ছিল তা নালন্দা, তক্ষশিলা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন শক্তি ও পরিকাঠামো হতেই উপলব্ধি করা যায়।

বর্তমানে সদ্ধর্মচর্চার অভাবের কারণে ভিক্ষু শ্রমণদের ধর্মশিক্ষা অর্জনের প্রয়োজনে বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলিতে গমণ করতে হচ্ছে।

বৃহৎ বঙ্গে বিহার ও ভিক্ষু শ্রমণের অভাব না থাকলেও উপযুক্ত বিদ্যাচর্চার অভাবে বিহারগুলি ক্রমশঃ ঐতিহ্য নষ্ট করে ফেলেছে। যেমন- বন্দনা গাথা ও সকলই ছিল বিহারভিত্তিক আজ সেই ব্যবস্থা নেই। ফলে বৌদ্ধবিহার ও ভিক্ষুসংঘের প্রতি বর্তমান সময়ে আনুগত্য প্রকাশও সামান্য। 

শিশু অবস্থায় ধর্মচর্চার মাধ্যমে জাগ্রত হয় নীতিবোধ, গুরুভক্তি, মাতাপিতার প্রতি কর্তব্যবোধ ইত্যাদি। বৌদ্ধশাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে শিষ্যরা গুরুর অধীনে কমপক্ষে পাঁচবছর ধর্মশিক্ষা করবেন।

সদ্ধর্মচর্চার গবেষণার প্রাণকেন্দ্র বিহার বৌদ্ধসম্প্রদায় রূপে পরিচয়দানের সহজ মাধ্যম। তবে বর্তমানে সেই ব্যবস্থা অস্তমিত প্রায়।

ভিক্ষুসংঘ এবং দায়কদের মধ্যেকার সমন্বয়ের অভাব, ভিক্ষুদের মধ্যে আচার্যবাদের ভাবনা না থাকার ফলে বিহারগুলিতে প্রশিক্ষণের অভাব প্রকট হয়েছে।

তবে উপযুক্ত কিছু প্রদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই সমস্যাগুলি দূরীভূত করা সম্ভব। যেমন -

১. সংঘভুক্ত ভিক্ষুগণের সমষ্টিগতভাবে জীবনযাপন ও আত্মনির্ভরতার বিকাশ সাধন।
২.  বিনয় শিক্ষা দান, পর্যালোচনা এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ।
৩.  ভিক্ষু প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক সম্পাদনের নিমিত্তে আলাপ ও বর্তমান সময়ের সঙ্গে বুদ্ধ শিক্ষার সম্পৃক্তকরণ।

ভিক্ষু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রাসঙ্গিকতা কেন (?):

বৌদ্ধসমাজের অভ্যন্তরে বর্তমানেও বিবিধ মিথ্যাদৃষ্টি বিদ্যমান। সেই সকল মিথ্যাদৃষ্টি কেবলমাত্র ভিক্ষু দ্বারাই পরিশোধিত করা সম্ভব। যদি ভিক্ষু প্রশিক্ষিত হন তাহলে তিনি ক্রমান্বয়ে এই সমস্যাগুলি নিরীক্ষণ করতে সংকল্প হবেন।

আদর্শ মূলত ভিক্ষু দ্বারাই রক্ষিত হয়। একটি উৎকৃষ্ট এবং প্রশিক্ষিত ভিক্ষুসংঘের দ্বারাই বুদ্ধশাসন চিরস্থায়ী হতে পারে। বর্তমান প্রজন্ম উচ্চবিলাসী হওয়ার কারণে তারা সদ্ধর্মের প্রয়োজন অনুভব করে না, ফলে প্রশিক্ষিতের অভাব থেকেই গেছে।
বৌদ্ধ ধর্মাচরণের প্রথম এবং পূর্ণাঙ্গ শর্ত হল একাগ্রতা এবং নীরবময় পরিবেশ। বর্তমানে সামান্য সংখ্যক স্থানে অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান থাকলেও প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ ধর্মলোচনার পরিবেশ নেই বললেই চলে। ফলে অজ্ঞতা প্রকট হয়েছে।

এমন মহান ধর্মে জন্মগ্রহণের পরও বর্তমান প্রজন্মের বৌদ্ধ কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী বৌদ্ধ ধর্মাচরণ পদ্ধতি এবং শিষ্টাচার সম্পর্কে অবগত হননি। এর মূলগত কারণ হল বিহারমুখী শিক্ষার অপ্রতুলতা। বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলির পরিবার পরিজনের বিহারমুখী শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং সেক্ষেত্রেও ভিক্ষু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং প্রশিক্ষিত ভিক্ষু তথা আচার্যের প্রাচুর্যতা রয়েছে। অথচ বঙ্গে এই ব্যবস্থার কোন বিধি নিয়ম নেই। ফলে সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত ভিক্ষু তথা সদ্ধর্মের বিকাশে আগ্রহী নয়।

বৌদ্ধ বিহারভিত্তিক কর্মসূচি ও পরিচালনায় ভিক্ষু নেতৃত্ব :

বৌদ্ধবিহার হল শান্তি এবং পবিত্রতার স্থান তথা ধর্মচর্চা. বিদর্শনের স্থান। সুতরাং বৌদ্ধ আদর্শের পরিপন্থী কোন অনুষ্ঠান বিহারে অনুষ্ঠিত না হওয়াই শ্রেয়।

ভিক্ষু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলি বয়োজ্যেষ্ঠ বিনয়শীল ভিক্ষুদের দ্বারা পরিচালিত হওয়াই শ্রেয়। এই বিষয়ে গৃহী উপাসক- উপাসিকাগণের হস্তক্ষেপ প্রযুক্ত নয়। এছাড়া এ প্রশ্নে ভগবান বুদ্ধের বিনয় নিয়মসমূহকে আত্মস্থ করতে না পারলে উপযুক্ত ভিক্ষু অভাব থাকবেই।

অনেক স্থানে বৌদ্ধ সংগঠনগুলি নানাবিধ সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও ভিক্ষু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনীহা প্রকাশ করে। অথচ তাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে ভিক্ষু প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সমাজের মলিনতা, ক্ষোভ, দ্বেষ, হিংসা, মোহ বিষয়গুলিকে প্রশমনে সহায়তা করে। সুতরাং বৌদ্ধ সমাজের সামাজিক উন্নতি বিধানে এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। 

বুদ্ধের নীতি আদর্শ পালনে ভিক্ষু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা একান্ত অপরিহার্য -

বর্তমানে ভোগবিলাস এবং আধুনিক প্রযুক্তিগত জীবনে বৌদ্ধ যুবকরা বিহারমুখী নয়/হচ্ছে না, এবং বিহারমুখী হলেও অতি নগণ্য। বিহারমুখী হয়ে কিছু যুবকরা হয়তো শ্রমণ হয় কিংবা পিতামাতার ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে প্রব্রজিত হয়। প্রব্রজ্যা জীবন লাভ করে পড়াশুনা করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে সকলের স্বাচ্ছন্দ এবং অবাধ বিচরণ ঘটছে। এতে করে মূল বিনয় শিক্ষা হতে আদর্শচ্যুত হয়ে বিপরীত দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা বাংলায় বাঙ্গালী বড়ুয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায় মুষ্টিমেয় সংখ্যক অবস্থান। তাঁর মধ্যেও কিছু যুবক ভিক্ষু বা শ্রামণ হচ্ছে তা কিন্তু কম কিছু নয়। যারা প্রব্রজ্যা জীবন লাভ করছে আমরা সবাই আধুনিক শিক্ষা লাভ করেছি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি এবং যেতেও হবে। কিন্তু তার মধ্যে বুদ্ধের বিনয় শিক্ষার প্রতিও গারবতা থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। বিশ্ব যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেই গতি আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে, জ্ঞান বিজ্ঞানে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রযুক্তিশীল হতে হবে। নতুন বিশ্বের কাছে নতুন প্রজন্মের কাছে বুদ্ধের বিশ্বমানবতাবাদ ও মানববাদী সদ্ধর্ম প্রচার প্রচারণায় ভিক্ষুসংঘকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে নিঃসন্দেহে। নতুন প্রজন্ম কি চায় এবং তাদের কীভাবে বিহারমুখী এবং মানবতাবাদী ও মানববাদী হয়ে বৌদ্ধিক আচার আচরণ সম্পন্ন হয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হবে সেই দিকনির্দেশনা এবং ভূমিকা ভিক্ষুসংঘকে হাতে নিতে হবে এবং জানতে হবে। যে কথাটা না বললেই নয়, কিংবা অনুক্ত থেকে যাবে, সেটা হল আদর্শ সাংঘিক সমাজ সৃজনে ভিক্ষু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে ও নির্দেশনাসমূহ-

১. বুদ্ধের বিনয় শিক্ষা যথার্থ জানতে, অনুধাবন করতে এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রায়োগিক আচার সম্পন্ন হতে হয় তার সঠিক এবং বিনয়গত ধারণা দিতে হবে।
২. উদারশীল, উন্নতমননশীলতা সম্পন্ন হতে ভিক্ষু, শ্রামণকে যথার্থ শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
৩.  বৌদ্ধধর্মের প্রচারশীল ও প্রচারমুখীতা কিভাবে হওয়া যায় তার সঠিক বিনয় শিক্ষা দিতে হবে। যেমন- বুদ্ধের সেই উদারবাণী বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়, বুদ্ধ বাণীর যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। (বহুজন হিতায় বলতে বুদ্ধ বুঝাতে চেয়েছেন, একজন ব্যক্তি মানুষের সামগ্রিক স্বাচ্ছন্দতা এবং বহুজন সুখায় বলতে বোঝাতে চেয়েছেন ব্যক্তি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সুখানুভূতি)।
৪. শান্ত সমাহিত এবং বিনয়ী ও সুভাষিত আচরণ সম্পন্ন হতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। 
৫.  ধ্যান ও প্রজ্ঞার অনুশীলন করে তার প্রয়োগ কি করে করতে হবে, তা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
৬.  বুদ্ধের বাণীকে অন্যান্য জনসমাজে ছড়িয়ে দিতে এবং কিভাবে গ্রহণযোগ্য করা যায়, তার বাস্তবভিত্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
৭.  ভিক্ষু-শ্রামণকে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান প্রদান করতে হবে। এবং আধুনিক প্রযুক্তির অপব্যবহার বর্জন করতে হবে। এবং আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সৃজনশীল এবং সম্যকধারণা রাখতে প্রশিক্ষিত করতে হবে।
৮.  সময়ানুবর্তিতা, সুশৃঙ্খল ও রুচিশীল জীবন গঠন করার শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
৯.  সমাজ সদ্ধর্মের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল ও দায়িত্বসম্পন্ন হয়ে কিভাবে সাংঘিক ও সামাজিক দায়িত্ব প্রতিপালন করবে তার শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
১০.  অনাগত তরুণ ভিক্ষুদের কিভাবে সদ্ধর্মের প্রতি আরো অনুরাগী করা যায়, সে সম্পর্কে যথার্থ প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
১১.  বর্তমান বিশ্বের ধাবমান গতির সাথে তাল মিলিয়ে সমাজ সদ্ধর্মের কোন বিষয়টা কোন ভিক্ষুর দ্বারা রক্ষিত হবে। তা বিবেচনা করে,তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে।
১২.  যে ভিক্ষু যেরূপ মেধাসম্পন্ন  বা যেরূপ যোগ্যতা তাকে সেই দায়িত্ব সম্পন্ন করে তুলতে হবে। যেমন -

(ক) সাধক ভিক্ষু সমাজের এবং সদ্ধর্মের আধ্যাত্মিক বিষয় সমূহ স্বয়ং অনুশীলন করবেন এবং অন্যান্য ভিক্ষু সংঘকে অনুশীলিত করবেন এবং আধ্যাত্মিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করবেন।
(খ) আচার্য ভিক্ষু; বিহার, প্রভাতী বিদ্যালয়, সাধারণ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা দান করবেন। কারণ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুদ্ধের মানবতাবাদী ও মানববাদী শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা এবং বুদ্ধের উন্মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার কথা তুলে ধরতে যথাযথ প্রচেষ্টা চালাবেন।
(গ)  সামাজিক ও সংগঠক ভিক্ষু; বিহার ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাছে এবং সমাজ সদ্ধর্মের কাজে, কর্মযজ্ঞ চালাবেন। সাংগঠনিক কাজ করে কিভাবে নিজের দেশ, সমাজ সদ্ধর্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে তার প্রশিক্ষণও দিতে হবে।
(ঘ)  প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন ভিক্ষু; আধুনিক ও নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ ও ব্যবহার ঘটিয়ে সমাজ সদ্ধর্মের প্রচারের দায়িত্ব প্রতিপালন করবেন। 
(ঙ)  গবেষক ভিক্ষু; বুদ্ধের ধর্ম জনসমক্ষে প্রচার ও আধুনিক জীবনের সাথে বুদ্ধের ধর্মের যে বাস্তব প্রয়োগ তা গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরবেন। 
(চ)  দেশক ভিক্ষু ও তার্কিক ভিক্ষু; বুদ্ধের ধর্মের সারতত্ত্ব সহজ সরল ভাষায় এবং রুচিশীল ভাষায় এবং নানা উপমার সাথে সহজবোধ্যভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরবেন বা পরিবেশন করবেন এবং তার্কিক ভিক্ষু বিভিন্ন পাণ্ডিত্যপূর্ণ সভা সমাবেশে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন যুক্তিতর্কের মাধ্যমে বুদ্ধের মানবতার বাণী ও উদারবাণী প্রচার করবেন।
১৩.  নিজ দেশ ও বহির্বিশ্বের ইতিহাস, বৌদ্ধধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের ইতিহাস, ভৌগোলিক জ্ঞান ও ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে ধারণা লাভের মাধ্যমে নিজেকে গঠন ও প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
১৪.  নতুন প্রজন্ম ভিক্ষু সংঘকে গৃহীরা যে দানাদি দেন সেগুলো কি করে সু-সম বন্টন করা যায় বা করতে হবে তার প্রশিক্ষণও দিতে হবে।
১৫.  বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও পুরাতাত্ত্বিক বিষয়ে সম্যক জ্ঞানার্জন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
১৬.  বৌদ্ধ চিকিৎসা পদ্ধতি ও আধুনিক চিকিৎসা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে মত প্রশিক্ষিত করতে হবে। কারণ সাংঘিক ব্যক্তিত্বদের চিকিৎসা এবং সাধারণ জনসাধারণের চিকিৎসা সুফলতা দান করতে সক্ষম হবে।
১৭.  ত্রিপিটক এবং ত্রিপিটক বহির্ভূত অন্যান্য গ্রন্থ অনুবাদ কার্য কিভাবে নিয়োজিত করবে এবং কিভাবে অনুবাদ কার্য করতে হয়। সেই সম্পর্কে প্রশিক্ষন প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান ও অনুবাদ কার্যে নিয়োগ করতে হবে।
১৮.  ভিক্ষু - শ্রামণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অনূদিত গ্রন্থ ও অন্যান্য গ্রন্থ ছাপানো ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে কিভাবে প্রেস পরিচালনা করতে হবে ও প্রেস প্রতিষ্ঠা করতে হয় সে সম্পর্কে যথাযথ প্রশিক্ষন প্রদান করতে হবে।
১৯.  বহির্বিশ্বে সদ্ধর্ম প্রচার প্রসার কিভাবে করতে হবে, সেই দক্ষতা অর্জন করার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। নিজ মাতৃভাষা এবং অন্যান্য আধুনিক সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা এবং পালি, সংস্কৃত ও অন্যান্য প্রাচীন ভাষা সম্পর্কে ধারণা ও জ্ঞান অর্জন করতে হবে। নচেৎ বর্হিবিশ্বে বুদ্ধের সদ্ধর্ম বাণী ছড়িয়ে দিতে অক্ষম হবে। বুদ্ধ সবসময় প্রথমে নিজের মাতৃভাষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং স্ব-স্ব মাতৃভাষার মাধ্যমে সদ্ধর্ম অনুশীলন করতে বা বুদ্ধবাণী জানতে এবং প্রচার করতে আদেশ দিয়েছিলেন। 
২০.  শিল্প, সাহিত্য ও ভাস্কর্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রচারের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ ভিক্ষু সংঘ যদি শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য সম্পর্কে যদি সম্যক ধারণা লাভ করে তাহলে আমাদের দেশে অন্যান্য দেশ থেকে বুদ্ধমূর্তি বুদ্ধ শিল্প, ভাস্কর্য আমদানী করতে হবে না। বুদ্ধমূর্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা হলে বৌদ্ধশিল্প ও ভাস্কর্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক  সমৃদ্ধ হবে এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বা সৌহার্দ্যের বন্ধন দৃঢ় হবে। সর্বোপরি আমাদের দেশের মুষ্টিমেয় জনসাধারণের যে স্বল্প আয় হয় সেগুলি বুদ্ধমূর্তি আনয়নে ব্যয় হয়, তা রক্ষিত হবে।
২১.  বিহার তৈরিতে যে শ্রমিক ও প্রযুক্তি দরকার হয় বিহার কাঠামো তৈরি করতে নকশা প্রয়োজন হয় সেই প্রশিক্ষণও প্রদান করতে হবে।
২২.  গ্রন্থাগার, পাঠাগার সংরক্ষণ কিভাবে করতে হয় তার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
২৩.  ভিক্ষু সংঘকে প্রতিটি সদস্য এক একজনকে একটি নিকায় ভাণক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন- জাতক ভাণক, ধম্মপদট্ঠ ভাণক, অভিধর্ম ভাণক, দীর্ঘ ভাণক, মজ্ঝিম ভাণক ইত্যাদি। 
২৪.  শৈল্পিক মনমানসিকতা সম্পন্ন হতে হবে। শিল্প সৃষ্টি করতে হবে আমরা আমাদের অতীত শিল্পকর্মও যেমন অজন্তা-ইলোরা নিয়ে গর্ববোধ করি সেগুলি নতুনভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই সব শিল্প বৌদ্ধভিক্ষুরাই করেছিলেন। যদিও সেগুলো সৃষ্টিতে সর্বাস্তিবাদী বা মহাসাংঘিক ভিক্ষুদের দ্বারা সৃষ্ট হলেও পর সেগুলো ভিক্ষুদের দ্বারা সম্পাদিত হয়েছিল।  সেই প্রশিক্ষণও দিতে হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের ভিক্ষুসংঘকে।

সর্বোপরি সমাজে ভিক্ষু নেতৃত্ব আশু প্রয়োজন রয়েছে।  ভিক্ষু নেতৃত্ব কোন কাজ যথাযথভাবে সম্পাদিত হতে পারে না। তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আজকের আয়োজিত এই সংঘ সম্মেলন ভিক্ষু নেতৃত্ব বলেই আজকের মহতি কার্য সম্পাদন করতে পারছে। অন্যান্য সম্প্রদায় তাদের স্ব-স্ব ধর্ম গুরুদের  এবং বৌদ্ধদেশগুলিতে ভিক্ষু নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা থেরবাদ বৌদ্ধদেশ কিংবা মহাযান অধ্যুষিত দেশগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়। আমরা কিংবা আমাদের দেশে ভিক্ষু নেতৃত্ব নেই বলে সদ্ধর্মের উন্নতি সাধন হচ্ছে না এবং শাসন সদ্ধর্মে বৌদ্ধ কুলপুত্ররা প্রব্রজিত হলেও দক্ষ ভিক্ষু নেতৃত্বের অভাবে দায়কদের প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে আগত ও অনাগত ভিক্ষুরা স্থায়ী হচ্ছে না এবং নেতৃত্বের অবহেলাজনিত কারণে সাংঘিক জীবন ত্যাগ করে গৃহে ফিরে যাচ্ছে এবং সদ্ধর্মের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে এতে করে আলোকিত সংঘ মণীষা সৃষ্টি হচ্ছে না। এটা আমাদের ভেবে দেখা একান্ত অপরিহার্য। তাছাড়া যাদের একটিমাত্র সন্তান তারা তাঁদের সন্তানকে প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষা দিচ্ছেন তাদের জীবনে বা পরিবারে এমন আর্থিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে যে তাঁরা পিতামাতার ভরণপোষণের তহবিল গঠন করেন তাহলে সে সমস্ত নবপ্রজন্মের ভিক্ষুরা চীবর ত্যাগ করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করবে না। ভিক্ষু সংঘ ও গৃহী সংঘ যদি রুগ্ন, বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত ভিক্ষুসংঘের চিকিৎসার ব্যয়ভার গ্রহণ করে তহবিল গঠন করে তাহলেও নবপ্রজন্মের ভিক্ষুরা গৃহাভিমুখী হবে না। আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে ভিক্ষু যতদিন কর্মক্ষম থাকে ততদিন তাদের কদর থাকে যখন বৃদ্ধ হয় তখন তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণের কোন প্রদক্ষেপই গ্রহণ করে না অথচ মৃত্যুর পর ঘটা করে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কোটি টাকা ব্যয়ে অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করে, এতে করে সমাজের কি লাভ হচ্ছে?  জীবিতাবস্থায় যদি যথাযথ পূজা সম্মান করে তাঁদের স্মৃতিতে চিরজাগরুক রাখার জন্য ট্রাস্ট করে, তাহলে সমাজ সদ্ধর্ম-আলোকোজ্জ্বল হবে এবং আমাদের কষ্টার্জিত ধন সম্পত্তি অন্য সম্প্রদায়ের কাছে যাবে না। আমাদের স্বল্প আয় সমাজ সদ্ধর্মের উন্নতিতে ব্যয়িত হবে।

সর্বশেষ নবপ্রজন্মের ভিক্ষুদের উদ্দেশ্য বিনীত আবেদন রাখবো, তাদের আজ নানা অসুবিধা অভিযোগ আছে সমাজের প্রতিটি; একটু যদি চিন্তা করি আমাদের যাঁরা প্রাতঃস্মরণীয় ছিলেন তাঁরা কতো প্রতিকূল পরিস্থিতি বা আয়াস স্বীকার করে আমাদের মতো অনুন্নত সমাজ-জাতি- সম্প্রদায়কে ধরে রাখতে সাংঘাতিক পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করছেন সমাজকে কিছুটা হলে আলোর বর্তিকা দেখাতে পেরেছেন। তা না হলে আমরা আজকে যেই অবস্থায় আছি সেই অবস্থায় উপনীত হতে পারতাম না।

এটা বলা যেতে পারে, অভাব-অভিযোগ-অবহেলা প্রত্যেকটা সমাজব্যবস্থায় কম বেশী আছে; আর আছে বলেই আমাদের আরো অন্যরকমভাবে ভাবতে হবে সমাজ-জাতি সদ্ধর্মের তাগিদে না হয় আমাদের ইতিহাস- ঐতিহ্য অচিরেই হারিয়ে কালের গহ্বরে নিমজ্জিত হব।

অনেক উদীয়মান ভিক্ষুরা আক্ষেপ করেন আমাদের  উপেক্ষা করেন গৃহীসংঘ এবং নেতৃত্ববৃন্দ। সেই উপেক্ষার উত্তরণ আমাদেরই ঘটাতে হবে।আমরা যদি শীলাচরণ সম্পন্ন উচ্চশিক্ষায় সুবিনিত হতে পারি তাহলে সেই উপেক্ষার মোক্ষম প্রত্ত্যুত্তর দেওয়া সম্ভব হবে। নচেৎ সেই উপেক্ষা আরো কৃষ্ণগহ্বরে রূপায়িত হবে। সুতরাং আমাদের ভাবা উচিত নতুন করে কিভাবে সমাজ সদ্ধর্মকে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। আর একটি কথা ভাবতে হবে সেটা হল যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানের সংঘদান ইত্যাদি আমাদের দেশনাকে যুগোপযোগীভাবে প্রদান করতে হবে। নতুন প্রজন্ম কিভাবে ধর্মকে দেখতে চায়। আমরা অতীত প্রাতঃস্মরণীয় মহাস্থবিরদের দেশনা করে যাচ্ছি। তারা যেগুলি বলেছিলেন সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে তাঁরা কিছুটা সক্ষমও হয়েছেন। কিন্তু আমাদের আর একটু উত্তরণ ঘটাতে হবে বলে মনে করি।

সমাজে আমাদের বসবাস- সমাজকে বাদ দিয়ে চলা যাবে না। জানি সমাজের অনেক ভুলত্রুটি আছে, অভাব অভিযোগ আছে সেগুলি উপেক্ষা করে এবং সংশোধনের মধ্যে দিয়ে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

উপাসক-উপাসিকাদের প্রতি আবেদন আপনারা আর একটু উদারভাবে ভাবতে চেষ্টা করুন, না হয় আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে আমাদের যা অবস্থা হয়েছিল তার থেকে দ্বিগুণ অস্ত্বিত্বের সংকটে পড়ব। সেই সময় উপযুক্ত সাংঘিক পরিকাঠামো ছিল না বলেই আমরা তলিয়ে গেছি। সেই পরিস্থিতি পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে এবং বাঁচার রসদ ফিরে পেতে হবে।
                      - সমাপ্ত -

অনুলিখন - ভিক্ষু ধর্মমিত্র।

No comments:

Post a Comment