Sunday, July 20, 2014

শিশুদের জন্য বৌদ্ধ শিক্ষা

-সুমনপাল ভিক্ষু

কোন কোন বিশেষ সময় পর্ব আছে যা বিকাশের বিভিন্ন দক্ষতা লাভের পক্ষে সবচেয়ে বেশী সহায়ক। কখনও কখনও এই পর্বকে বলা হয়, “সংকট পর্ব” কারণ বিকাশের দক্ষতায় যদি এই পর্বের মধ্যে দক্ষতালাভ করা না যায় তাহলে আন্য কোন সময়ে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। এই গুরুত্বপূর্ণ পর্বে বৌদ্ধ অভিজ্ঞতা দানের মাধ্যমে বৌদ্ধ শিক্ষা তাকে পরিণত বৌদ্ধধর্ম বিশ্বাসীর গুণাবলী অর্জন করতে সাহায্য করে, তাকে বৌদ্ধ জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে, এবং শেষ পর্যন্ত তিনি এক আদর্শ বৌদ্ধ চরিত্রে পরিণত হন যিনি আধ্যাত্মিক বিকাশ লাভ করেছেন।
     আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বৈত সত্তার এই পৃথিবীতে একটি সঠিক দিক নির্দেশ করতে ব্যর্থ হয় যা দৈনন্দিন জীবনে বোধকে অভ্যাসে পরিণত করতে পারে না। এই নিবন্ধটি বৌদ্ধ শিশু শিক্ষাকে একটি আধ্যাত্মিক ও শিক্ষামূলক মানদণ্ড হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে যা বোধ ও জীবনকে শিশু শিক্ষা বিষয়ক বৌদ্ধ আদর্শকে পরীক্ষার মাধ্যমে একত্রিত করবে।
বুদ্ধের শিক্ষায় শিশু শিক্ষায় শিক্ষণ পদ্ধতিঃ  
      বৌদ্ধ শিক্ষা শিশু শিক্ষাকে নিশ্চিতভাবে শিশুর বিকাশের পর্যায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব গড়ে তুলতেই হবে। শিশুর ধর্মীয় প্রকৃতি বা তাদের মূল্যবোধ গড়ে তোলা হল এমন এক লক্ষ্য যাকে তাদের বিকাশের পর্যায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পনা ও রূপায়ণ করতে হবে। প্রকৃতিগত ভাবে শিশুরা বৌদ্ধ ধারনা ও তত্ত্বগুলিকে স্মৃতিতে রাখতে কঠিন বোধ করে এই কারণে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতে হবে। শিশুদের উপর বিমূর্ত ধারনা ও পরিভাষা চাপিয়ে দিলে তাদের ধর্ম কি সে সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা জন্মাবে এবং এমন একটা পর্যায়ে তাদের ধর্মীয় বিকাশকে বিঘ্নিত করবে যখন তারা পুরোপুরি পরিণত নয়। উপরন্তু, খুব তাড়াতাড়ি এবং অতিমাত্রায় শিশুদের ধর্মীয় ধারনার সামনে উন্মোচিত করলে তাদের সমালোচনামূলক ভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যায় এবং তাদের ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলতে পারে। পরবর্তীকালে ধর্মীয় বিষয়গুলি সম্পর্কে উচ্চতর চিন্তাভাবনার বিকাশে এটি বিঘ্ন ঘটতে পারে।
      বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষাকে অবশ্যই কোন অসাধারণ শিক্ষাক্রমের দিকে লক্ষ্য না রেখে দৈনন্দিন শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে কারণ শিশুরা দার্শনিক চিন্তাভাবনা বা বিভিন্ন তত্ত্ব ব্যাখ্যার থেকে দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে দৃশ্য শ্রাব্য চেতনার থেকে বেশী শেখে। বৌদ্ধ শিক্ষার এই ধরণের নিরবিচ্ছিন্ন এবং সুসংহত শিক্ষাক্রমের পরিকল্পনা করা শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধ নীতি প্রতীত্যসমুৎপদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষাকে অবশ্যই বৌদ্ধ নীতির উপর নির্ভরশীল হতে হবে। যখন বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষার পাঠক্রমকে শিশুর বিকাশের পর্যায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে এবং তা অনুসরণ করার পক্ষে সহজ হবে। এটি সর্বোপরি বৌদ্ধ রচনাগুলিকে শিক্ষার প্রধান উপাদান হিসাবে ব্যবহার করতে হবে, কারণ কোন মতাদর্শ ভিত্তিক ব্যাখ্যা বা শিক্ষার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি শিশুর দৃষ্টিভঙ্গিকে সীমায়িত করতে পারে। বৌদ্ধ শিক্ষা শিশুদের মধ্যে একটি সঠিক ধর্মচেতনা প্রতিষ্ঠা করতে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় তাদের বৌদ্ধ ধারনা ও অভ্যাসের দিক নির্দেশ দিয়ে এবং একই সঙ্গে তাদের অন্তর্নিহিত ও সামাজিক প্রকৃতিকে উৎসাহিত করে যাতে তারা পৃথিবীর একটি স্বাধীন ও সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করতে পারে। অসংখ্য বৌদ্ধ তত্ত্বের মধ্যে শিশু শিক্ষার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত হল আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, সামাজিক আচরণের চারটি নীতি, দশ পারমী এবং তিনপ্রকার প্রশিক্ষণ। নিম্নোক্ত তালিকাটি হল বিস্তারিত অভ্যাস অনুশীলনের একটি দৃষ্টান্ত যার ভিত্তি হল আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্যতম সম্যক কর্ম।
সম্যক কর্মঃ
কুশল শারিরীক কর্ম অর্থাৎ সর্বদা কুশলকর গতিবিধি বজায় রাখা। যে কর্ম নিজের বা অপরের ক্ষতি করে না অর্থাৎ শরীরের দ্বারা কুশল কর্ম সম্পাদন, অকুশল কর্ম থেকে বিরত থাকা যথা প্রাণীহত্যা এবং চুরি করা, জীবনকে শ্রদ্ধা করা এবং দয়া অনুশীলন করা।

স্বাস্থ্য
সামাজিক কর্ম
প্রকাশ
বাক্য
অনুসন্ধান
শয়ন ধ্যান অনুশীলন
শিশুদের জন্য পঞ্চশীল অনুশীলন করা
মনঃসংযোগ ও ধ্যানের মাধ্যমে অনুভূতির সৃজনশীল প্রকাশ
কথা বলার  সঠিক ভঙ্গিমা
প্রাকৃতিক ঘটনায় আগ্রহের প্রকাশ
সঠিক হাঁটার ভঙ্গিমা
আবেগ ও আকাঙক্ষার নিয়ন্ত্রণ করা



সঠিক খাদ্যাভাস





    বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষাতে অতি অবশ্যই শিশুদের আগ্রহ জাগাতে হবে এবং শিক্ষাকে ক্রীড়ার সঙ্গে যোগ করতে হবে। প্রথম এবং সর্বপ্রধান হল বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষার সমস্ত উপাদানের অতি অবশ্যই শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যোগ থাকতে হবে এবং শিশুদের স্বেচ্ছাকৃত কর্ম এবং অপরের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে নতুন ধারনা অর্জন করতে সাহায্য করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, বোধিসত্ত্ব চিত্তের মূল বৌদ্ধ ধারনা – করুণা এবং অপরের উপকার করে মানুষ নিজের উপকার করে এই বিশ্বাস- শিশুদের একথা বুঝতে সাহায্য করে যে ব্যক্তি সমাজের অংশ, তাই তারা যা শিক্ষা করে তার সম্পর্কে আন্তরিকভাবে আগ্রহী হয় এবং সেই শিক্ষাকে সংহত করে।
     শিশুদের বৌদ্ধ ধারনা গ্রহণ করতে সাহায্য করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল পরিবেশের বিষয়টি। ধর্মীয় মূল্যবোধকে শিশুর মধ্যে প্রবেশ করানো হয় কৃত্রিম নয় পরিচিত পরিবেশের মধ্যে আনন্দময় কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে। শিক্ষায় বর্তমান প্রবণতা যা আরো বেশী করে ‘খেলো ও শেখো, শেখো ও খেলো’ এই ধারনার উপর আরো বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, বৌদ্ধ ধর্মে শিশুর ক্রীড়ার একটি প্রতীকী অর্থ রয়েছে, এটি হল জীবনে আদর্শ বৌদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ার একটি অংশ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনের প্রজ্ঞায় আলোকিত করে। শেষে, খেলাধুলার মাধ্যমেই শিশুরা উত্তম চরিত্রযুক্ত মনোরম সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বে পরিণতি লাভ করে।
     বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষার কার্যক্রমগুলিকে অতি অবশ্যই সাধারণ পাঠক্রম, সমন্বয় সাধনকারী ধর্ম ও শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে হবে যাতে করে এরা পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে। বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষায় নিয়োজিত শিক্ষকদের একটি সমীক্ষায়, অধিকাংশ এই মত প্রকাশ করেছেন যে তারা এমন একটি বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষার পাঠক্রম দেখতে চাইবেন যা সাধারণ এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং বৌদ্ধ ধর্মকে শিক্ষার পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং বৌদ্ধ ধর্মকে শিক্ষার থেকে পৃথক না করে। সমীক্ষা থেকে আরো জানা যায় যে, শিশুদের মধ্যে কারো বৌদ্ধ প্রকৃতিকে পালন করার জন্য বিস্তারিত বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষার পাঠ্যক্রমে ধর্ম ও শিক্ষাকে পরস্পরের পরিপূরক ও যুক্তিসংগত হতেই হবে। এ ধরনের পাঠ্যক্রমকে অবশ্যই বর্তমান পাঠ্যসূচী, যার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ, সামাজিক কাজকর্ম, প্রকাশ, বাক্য, এবং অনুসন্ধিৎসা ইত্যাদি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষার পাঠ্যক্রমঃ   
    বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষার শিক্ষণ পদ্ধতি বৌদ্ধ নীতির উপর ভিত্তি করে রচিত। বৌদ্ধ নীতির কেন্দ্রে রয়েছে এই বিশ্বাস যে প্রত্যেকেই বোধিসত্ত্ব হতে পারে কেননা প্রত্যেকের মধ্যেই বুদ্ধের প্রকৃতি রয়েছে। অন্য কথায় বলতে গেলে পরম শিক্ষণ বলতে কিছুই নেই। যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল এই স্বভাবকে সচ্চরিত্র হিসেবে প্রকাশ হতে অনুপ্রাণিত করা।
     নিম্নে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, দশ প্রকার পারমী এবং পঞ্চশীলকে বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষায় শিশুদের জন্য কি ভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে তার একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করা হল, এদের প্রতিটি শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত বৌদ্ধতত্ত্ব। একটি উপযুক্ত শিক্ষণ পদ্ধতি হল জীবনের পদ্ধতির কর্মসূচী সম্পর্কে শ্রদ্ধা। বৌদ্ধ শিক্ষণ শুধুমাত্র মানুষের জীবনকেই মূল্যবান মনে করে না, বিশ্বের সমস্ত প্রাণীর জীবনকেই মূল্যবান মনে করে। অতএব এটি মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর সহাবস্থানকেই উৎসাহিত করে। এ প্রসঙ্গে মানুষ এবং প্রকৃতি মূলত দুই নয় এক, এই বৌদ্ধধর্ম বিশ্বাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষামূলক মূল্য রয়েছে। প্রকৃতির সংস্পর্শে আসা, তাতে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া এবং তার সঙ্গে আদানপ্রদান করা এগুলিকেই বৌদ্ধধর্ম বিকাশের আদর্শ প্রক্রিয়া বলে মনে করে। চারপাশের পরিবেশের অন্যান্য সমস্ত ধারনা থেকে জীবনকে পৃথক করা যায় না। জীবনের কর্মসূচী সম্পর্কে শ্রদ্ধা (Respect for Life Programme) শিশুদের পক্ষে জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ শিক্ষ পাওয়ার ক্ষেত্রে এক অমূল্য সুযোগ।
আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ
গুণাবলী
নির্দিষ্ট অভ্যাসের দিকনির্দেশ
বিকাশের পর্যায়
সম্যক ব্যায়াম
সম্যক ব্যায়াম হল আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রধান কারণ এটি জীবন ও জগৎ যেমন তেমন করে উল্লেখ করে যার দ্বারা কোন একজন বস্তুর প্রকৃতি বুঝতে পারে।
সামাজিক বিকাশ দৈহিক বিকাশ
সম্যক চিন্তা
আমাদের কর্ম সম্পাদন করার পূর্বে সম্যক চিন্তা। সম্যক চিন্তা সেই মানসিক প্রক্রিয়ার কথা বলে যা আমাদের বৌদ্ধ নীতির সম্পর্কে সঠিক অনুমান ও তা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
ঞ্জান সম্বন্বীয় বিকাশ
সম্যক বাক্য
সম্যক বাক্যের অর্থ হল আত্মপ্রেম বা সত্যবাক্যের দ্বারা অপরের সঙ্গে সহযোগিতা এবং তাদের সাহায্য করা। এর মধ্যে রয়েছে মিথ্যা ভাষণ থেকে বিরত হওয়া এবং কেবলমাত্র সত্য কথা বলা। বৌদ্ধধর্ম সম্যক বাক্যকে চারটি ভাগে ভাগ করেছে – সত্য বাক্য, করুণা বাক্য, প্রশংসা বাক্য ও সমর্থন বাক্য।   
সামাজিক ও দৈহিক বিকাশ
সম্যক আজীব (জীবিকা)
সম্যক জীবিকার অর্থ যে মানুষকে ন্যায় সঙ্গত পথে জীবিকা অর্জন করতে হবে এবং সম্পদ আইন সম্মত উপায়ে লাভ করা উচিত। শিশুদের শিক্ষা দানের সময় এই ধারনাটিকে সরল করে এই অর্থ দান করা যেতে পারে যে তাদের প্রাণীহত্যা করা, চুরি করা, দুর্বলকে উত্যক্ত করা, মিথ্যা কথা বলা, অপরকে প্রবঞ্চনা করা, বন্ধুদের সঙ্গে লড়াই করা, রাগান্বিত হওয়া এবং অভিসম্পাত দেওয়া উচিত নয়।
সামাজিক ও দৈহিক বিকাশ
সম্যক প্রচেষ্টা
সম্যক প্রচেষ্টার আক্ষরিক অর্থ হল ন্যায়সঙ্গত পথে প্রচেষ্টা করাশিশুদের তাদের আচরণ সম্পর্কে চিন্তা করে অনুতপ্ত হওয়া, পরিস্কার মনে প্রচেষ্টা করা, কুআচরন বন্ধ করা, দরিদ্রদের সাহায্য করা, কষ্ট সহ্য করা এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা ইত্যাদির কথা বলে এই ধারনাটিকে ব্যাখ্যা করা যায়।
জ্ঞান সম্বন্ধীয় বিকাশ
সম্যক স্মৃতি

অন্তর্মুখী বিকাশ
সম্যক সমাধি
সম্যক সমাধি হল জীবনের একটি পথ যার দ্বারা বৌদ্ধরা তাঁদের মনকে শান্ত করেন, তাঁদের শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং ধ্যান করেন, এর অর্থ একটি নিখুঁত চরিত্র তৈরী করে মন ও ইচ্ছাকে কেন্দ্রীভূত করে মন ও আত্মাকে শান্ত করা।                                
অন্তর্মুখী বিকাশ

প্রাক্‌ শিশু শ্রেণীতে বৌদ্ধধর্ম ভিত্তিক সুসংহত পাঠ্যক্রমঃ
      বৌদ্ধধর্ম ভিত্তিক সুসংহত পাঠ্যক্রম হল শিক্ষার একটি নির্দিষ্ট সরঞ্জাম যার উদ্দেশ্য হল কু-আচরনযুক্ত শিশুদের তাদের বৌদ্ধ প্রকৃতি উপলব্ধি ও প্রকাশ করতে সাহায্য করা। শিক্ষায় সুসংহত হওয়ার ধারণা আসে সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যা সমস্ত মানুষকে একটি সুসংহত সমগ্র হিসাবে দেখে এবং কখন ও কখন ও মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বর্ণনায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জন ডিউই বলেন যে অভিজ্ঞতা হল প্রাণী ও তার পরিবেশের মধ্যে অবিভক্ত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, যখন ফ্রয়েবেল ঈশ্বর, প্রকৃতি ও মানবতার ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে সংহতির ধারণাকে শিশু শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। এই পাঠ্যক্রমের লক্ষ্য হল ধর্ম নিরপেক্ষ পাঠ্যক্রম ও ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ্যক্রমকে সংযুক্ত করা যাতে করে শিশুদের বৌদ্ধিক জগৎ অনুসন্ধান করতে ও জীবনের মূল্যবোধকে শিক্ষা করতে সাহায্য করা যায়। সরল ভাবে বলতে গেলে, এটি হল সাধারণ ঞ্জান ও বিশ্ব সম্পর্কে বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়।
বৌদ্ধ অনুসন্ধান ও ভ্রমণের মাধ্যমে শিক্ষাঃ  
     বৌদ্ধ ঘটনাগুলিতে শিক্ষামূলক সক্রিয়তা শিশুদের বুদ্ধের শিক্ষার সঙ্গে অধিকতর পরিচিত হতে এবং বৌদ্ধ হিসেবে তাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করে। এই ঘটনাগুলি প্রচারিত জটিল বার্তা দ্বারা অভিভূত না হয়ে বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে শিশুরা তাদের অভিজ্ঞতাকে স্পষ্ট ভাবে মনে রাখতে পারে, এবং যা তারা শিক্ষা করছে তা দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করার জন্য পরিপাক করতে পারে।
    বৌদ্ধদের চারটি প্রধান উৎসবের দিন রয়েছে, বুদ্ধের জন্মদিন, মহাভিনিষ্ক্রমনের দিন, বোধিজ্ঞান লাভ করার দিন এবং পরিনির্বাণের দিন। এই দিনগুলি শিশুদের বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ হতে পারে।

বৌদ্ধ উৎসবের দিনগুলি
বুদ্ধের জন্মদিন
ভাবনাঃ বুদ্ধের জন্মদিবস পালন, বৌদ্ধ ধারণাঃ কর্ম সাদৃশ্য, ছয় প্রকার নিবেদন (চা, ধূপ, মোমবাতি, ফুল, ফল, খাদ্য) 
মহাভিনিষ্ক্রমণের দিন
ভাবনাঃ বৌদ্ধ পরিচয়ের উপর পুনরায় গুরুত্ব আরোপ করাঃ বৌদ্ধ ভিক্ষু/ভিক্ষুণীদের অনুশীলনের উপায়, শিশুদের জন্য পঞ্চশীল শিক্ষা ইত্যাদি  
বুদ্ধের বোধিলাভের দিন
ভাবনাঃ বুদ্ধ হওয়া, বৌদ্ধ ধারণাঃ বোধিলাভের অর্থ, বোধিসত্ত্ব আদর্শ, ধ্যান, দশ পারমী
বুদ্ধের পরিনির্বাণের দিন
ভাবনাঃ অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম উপলব্ধি করা, নির্বাণ, পুর্ণজন্মের চক্র

চার দেওয়ালের বাইরে কাজের দ্বারা শিশুরা বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠানের উপাদানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও মূর্ত সংযোগের দ্বারা শিশুরা মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। এই ধরণের অভিজ্ঞতা বিশেষ ধরণের কারণ এগুলি শিশুদের বুদ্ধ প্রকৃতিকে অধিকতর গুরুত্ব দান করে, শ্রেণীকক্ষের বাইরের পরিবেশে। শিশুরা বিমূর্ত চিন্তা ও কর্মের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে বুদ্ধ মূর্তি, মন্দির, ঘন্টা প্রত্যক্ষ করে ও বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।
শিক্ষণ পদ্ধতিঃ নির্দেশমূলক মাধ্যম এবং শিক্ষার পরিবেশঃ
    নির্দেশমূলক মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে শিক্ষার পরিবেশের সমস্ত উপাদান যার মধ্যে রয়েছে সমস্ত ধরণের শিক্ষা / শিক্ষণের বস্তু, শিক্ষদানের কলা কৌশল ও শিক্ষণ পরিবেশ। বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষায় নির্দেশমূলক মাধ্যমের ধারণা শিশুর চিন্তা পদ্ধতির বিবেচনার মাধ্যমে শিশুর হৃদয়ে প্রধাণ বৌদ্ধ ধারণাগুলিকে প্রোথিত করার এক কার্যকারী উপায়। এটি বৌদ্ধ শিক্ষার সমস্ত উপাদানের যোগ্য সমন্বয় সাধনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
     শিক্ষা সংক্রান্ত কাজকর্মে অনেক মাধ্যম শিক্ষার বিকাশে ব্যবহৃত হয়। এই মাধ্যমগুলিকে সাধারণ ভাবে শিক্ষার উপাদান বলা হয়। এগুলিকে শিক্ষণের উপাদান, শিক্ষার যন্ত্র ইত্যাদিও বলা হয়। বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষায় ফলপ্রসূ নির্দেশমূলক মাধ্যম ব্যবহার করে শিশুদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযুক্ত ভাবে বুদ্ধের শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করা যায়। অন্য কথায় বলতে গেলে নির্দেশমূলক মাধ্যম শিশুদের জটিল সূত্র ও গভীর বৌদ্ধ ধারণাগুলিকে বুঝতে সাহায্য করে।
পরিবেশের মাধ্যমে শিক্ষাঃ  
    সফলভাবে শিক্ষা পদ্ধতি চালু রাখার পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। একইভাবে একটি বৌদ্ধ পরিবেশ হল বৌদ্ধ শিক্ষণ শিশু শিক্ষার এক অপরিহার্য উপাদান। যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বৌদ্ধ মন্দিরের অভ্যন্তরে বা নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত হয় তাহলে শিশুরা সহজে বৌদ্ধ পরিবেশ লাভ করতে পারে। বৌদ্ধ পরিবেশের সহজ লভ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তি শৈশবেই গঠিত হয় এবং ঐ সময়ের ধর্মীয় ছাপ ও প্রভাব পরিণত বয়সেও জারী থকে। একটি কৃত্রিম বৌদ্ধ পরিবেশ তৈরী করা যেতে পারে প্রতিটি শ্রেণীকক্ষের প্রবেশ পথে এবং বিশাল কক্ষগুলিতে বুদ্ধমূর্তি বা শিশু বুদ্ধমূর্তি স্থাপনের মাধ্যমে, এবং বুদ্ধের প্রতিমূর্তির আলোক চিত্র দেওয়ালে টাঙিয়ে। অপর উপায় হল বুলেটিন বোর্ড ও জানলাগুলিকে বোধিসত্তের মূর্তি, পদ্ম ফুল, শিশু হাতী ও ধর্ম্মচক্র দ্বারা সজ্জিত করা। শিশুদের সঙ্গে পদ্ম লন্ঠণ তৈরী করা এবং শ্রেণীকক্ষের ছাদ ও অভ্যন্তরের দেওয়াল অপর একটি বিকল্প হতে পারে।
উপসংহারঃ
     ফলপ্রদ বৌদ্ধ শিক্ষার জন্য প্রয়োজন হল যে শিক্ষকদের বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। শিক্ষকরা যেন কখনই শিক্ষাদানকে একটি অভ্যাসগত কর্ম বলে মনে না করেন। তাঁদের জ্ঞান সম্পর্কে অহংকারী না হয়ে তাঁদের অবশ্যই শিক্ষা লাভের বাসনা ও কঠিন পরিশ্রম করার ইচ্ছা নিয়ে শিশুদের কাছে বৌদ্ধ শিক্ষার সুফল পৌঁছে দেবার জন্য শিক্ষার গভীরে নিয়ে গিয়ে পথ খুঁজতে হবে। বৌদ্ধধর্ম ভিত্তিক একটি সুসংহত পাঠ্যক্রমজীবন পাঠ্যক্রমের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি একটি সর্বাঙ্গীন ব্যক্তির বিকাশকে নিশ্চিত করবে। এই পাঠ্যক্রম শিশুদের মধ্যে জীবনের প্রতি শ্রদ্ধার বিকাশে সহায়ক হবে যাতে করে তারা মানব জীবনের অর্থ বুঝতে পারে এবং মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে পারে। নির্দেশমূলক মাধ্যম ও সহায়ক শিক্ষণ পরিবেশের মাধ্যমে শিক্ষাকে জ্ঞানের স্থানান্তরণ ছাড়াও শিশুর সৃজনশীল চিন্তার বিকাশের দিকে অবশ্যই লক্ষ্য দিতে হবে।

      সর্বোপরি, বৌদ্ধ শিক্ষার শিক্ষকদের পরিবর্তনের ঢেউকে বোঝা ও তার সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করতে সক্ষম হতে হবে। উপরে উল্লেখিত পাঠক্রম ও নির্দেশমূলক মাধ্যমকে বুদ্ধি বিভিন্নতার তত্ত্ব (Multiple Intelligence Theory) এর মধ্যে প্রোথিত থাকতে হবে যা বিভিন্নতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকেই সমতার তুলনায় বেশী পৃষ্ঠপোষকতা করবে তথ্যের এই নতুন যুগে শিক্ষকেরা বৌদ্ধ শিক্ষার কাজে এবং বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে নতুন প্রযুক্তির সহায়তাও নিতে পারেন। শিক্ষার লক্ষ্য যাই হোক না কেন, পরিকল্পনা কর, কাজ কর এবং দেখ এই পদ্ধতি শিক্ষার প্রকৃত ফলপ্রদ উপায় হতে পারে যা প্রগতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। 

No comments:

Post a Comment