সুমনপাল ভিক্ষু
অতিথি অধ্যাপক, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
'স্বামী বিবেকানন্দের প্রেরণায় আমূল পরিবর্তন হয়েছিল ভগিনী নিবেদিতার জীবনে। স্বামীজি মিস্ মার্গারেট নোব্ল থেকে তৈরি করেছিলেন ভারত উপাসিকা নিবেদিতাকে।
ব্রহ্মচর্যব্রতে দীক্ষিত করে নাম দিয়েছিলেন 'নিবেদিতা'। বিবেকানন্দের প্রতি তাঁর আত্মনিবেদন
এক বিরল দৃষ্টান্ত। বিবেকানন্দ
ছিলেন তাঁর কাছে গুরু, পিতা স্বয়ং ঈশ্বরস্বরূপ। স্বামীজির
চিন্তায় ও চেতনায় সদা মগ্ন থাকতেন। মান, প্রতিষ্ঠা,
এবং স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে নিবেদিতা গুরুর ডাকে পাড়ি দিলেন এক অজানা, অচেনা পরাধীন দেশে। ১৯০০ সালে কোলকাতা থেকে মিস ম্যাকলাউডকে
লিখেছিলেন- "মনে কর সে সময়ে স্বামীজি যদি লন্ডনে না আসতেন! এ জীবনটাই তাহলে একটা স্বপ্ন হয়ে থাকত। কিন্তু আমি জানতাম কারও ডাক শুনতে পাবই, তার জন্য একটা নিরন্তর প্রতীক্ষা আমার ছিল, ডাক এলো সত্যি...।"
স্বামীজি নিবেদিতাকে দিলেন ভারতকে আপন করে ভারতীয়দের
বিশেষত নারীদের জাগাবার ব্রত। স্বামীজী নিবেদিকাকে
চেনালেন ভারত পুণ্যভূমি এবং কোথায় ভারতের মহিমা। নিজের আদর্শ সম্বন্ধে স্বামীজি বলেছিলেন আমার আদর্শকে বস্তুত অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করা চলে তা এই মানুষের অর্ন্তনিহিত
দেবত্ব তার সত্যস্বরূপ, চিৎস্বরূপের
প্রতি তিনি এমন প্রবলভাবে
সমর্পিত ছিলেন, যে বাইরের স্থূল দেহ বা আবরণকে ছাপিয়ে যা তীব্রভাবে প্রকাশ পেত তা তাঁর আত্মতোজ। এই আত্মনিবেদন
এতই খাঁটি এবং আন্তরিক ছিল যে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন তাঁর আশৈশব ইউরোপীয় ধ্যান ধারণা। নিবেদিতা নিজে ভারতের ভাবনায়, ভারতের দুঃখ ও কষ্ট নিবারণ করার জন্য নিজের দুঃখ ভুলে গিয়েছিলেন। নিজেকে তিনি নিরন্তর ভারতবাসীর দুঃখে একাত্মতা অনুভব করেছিলেন। তাঁর জীবন ছিল আত্মদানমূলক সেবা ও তপস্যার জীবন। বাইরের জয়ঢাক তিনি পেটাননি। একেবারে নীরবে গোপনে সেবা করেছিলেন।
গভীর শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে নিবেদিতা ভারতকে দেখতেন ও নিজেকে তিনি ভারতের দীন সেবিকা ভাবতেন।) নিবেদিতা ১৯৯৮ সালে ১২ মার্চ স্টার থিয়েটারে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, "আপনাদের জাতি বিশ্বের সর্বোত্তম অধ্যাত্ম সম্পদগুলিকে এতকাল ধরে অবিকৃতভাবে
রক্ষা করতে পেরেছে, এই জন্যই আমি ভারতবর্ষে এসেছি জ্বলন্ত আগ্রহে তার সেবা করব বলে।... এমন একদিন আসবে যখন ঐশ্বর্যের ভারে ক্লান্ত ভ্রান্ত প্রতীচ্য অন্তরের শান্তির প্রত্যাশায়
আকুল হয়ে তাকাবে। সেদিন ভারতের অনাড়ম্বর দারিদ্রকে সে ঈর্ষা করবে। এদেশের শাশ্বত অধ্যাত্ম সম্পদের মূল্য সেদিন সে নতুন করে বুঝবে..."। সত্যিই নিবেদিতার সেই ভাষণ আজকে আমরা উপলব্ধি করছি। পাশ্চাত্য
ছুটে আসছে দীন ভারতের দ্বারে। শান্তির আশায় আধ্যাত্মিক
সুখের আহরণে পাশ্চাত্য সত্যিই আজ ভারতাত্মার
মুখাপেক্ষী।
নিবেদিতার
কার্যকুশলতা, উচ্চআদর্শ
ও মহাপ্রাণতা
দেখে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ
তাঁকে 'লোকমাতা' বলে সম্বোধন করেছেন। শ্রী অরবিন্দের 'শিখাময়ী' নিবেদিতা ভিতরে যে কি আগুন বহন করতেন তা দেখব ১৯০৪ সালে কোলকাতা থেকে লেখা একটি চিঠিতে। তিনি লিখেছেন
"... ভিতরে আমার আগুন জ্বলতো, কিন্তু প্রকাশের ভাষা ছিল না। কতদিন হয়েছে কলম হাতে নিয়ে বসেছি অন্তরের দাহকে রূপ দেব বলে কিন্তু কথা জোটেনি, আর আজ আমার কথা বলে শেষ করতে পারি না। এই দুনিয়ায় আমি যেন আমার ঠিক জায়গাটা খুঁজে পেয়েছি। দুনিয়া তেমনই আমারই অপেক্ষায় তৈরি হয়ে বসেছিল যে, এবার তা এসে লেগেছে ধনুর ছিলায়।
স্বামীজি নিবেদিতা সম্বন্ধে বলেছিলেন নিবেদিতা ভারতের জন্য প্রাণ দিতে এসেছে, গুরুগিরি করতে আসেনি। দীক্ষা ও ব্রহ্মচর্য দিয়ে স্বামীজি তাঁকে আর্শীবাদ করেছিলেন বৃদ্ধের মতো আত্মোৎসর্গ করতে। বলেছিলেন ভারতের প্রতিটি সন্তানের জন্য একাধারে মাতা, ভগিনী ও সেবিকা হতে। নিবেদিতা শুধু স্বামীজির
অনুপ্রেরণায় বেদান্তী হয়ে উঠলেন তা নয়। ভারতবর্ষের নানা দার্শনিক সম্প্রদায়
নিয়েও তিনি চর্চা করেছেন। তাঁর বয়স যখন আঠার বছর তখন থেকেই তাঁর মনে প্রশ্ন উঠে ধর্ম নিয়ে। বিশেষ করে খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসন্ধানের
যৌক্তিকতা নিয়ে। তারপর বিজ্ঞানের
প্রতি তাঁর ঝোঁক বাড়ল। আর তখনই এলো বৌদ্ধধর্ম
বিষয়ে একটা বই।
নিবেদিতার
মনে হল, বৌদ্ধ ধর্মই সত্যের অনুসারী, তিন বছর বিজ্ঞান ও বৌদ্ধধর্মের চর্চায় কাটালেন তিনি।) (কর্মী কর্মী থেকে কর্মযোগী হলেন নিবেদিতা,
বিবেকানন্দের শক্তিই যে তাঁর মধ্য দিয়ে প্রবহমান তা অনুভব করে লিখলেন যে, সবরকম উপাসনারই শুধু নয়, সবরকম কাজ, সকল সংগ্রাম, সব সৃষ্টিমূলক
ক্রিয়া হবে সত্য উপলব্ধির পথ। এখন থেকে পারত্রিক ও লৌকিক কোনো প্রভেদ নাই। পরিশ্রম করাই 'প্রার্থনা',
জয় করা হবে 'ত্যাগ', জীবনটাই হবে 'ধর্ম'। এখানে দেখা যায় ধর্মপদের অমৃতবাণী তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তনে ভূমিকা নিয়েছে।
নিবেদিতার জীবনে বিকশিত হয়েছে কর্মজীবনের পদক্ষেপগুলি।
পারিবারিক
ও সামাজিক ক্ষেত্রে সদর্থক গুণগুলি সত্যনিষ্ঠা,
আত্মবিশ্বাস, দেশাত্মবোধ,
নানান বিষয়ে জ্ঞানস্পৃহা ধরে রেখেও তাঁর মধ্যে প্রশ্ন জেগেছিল ধর্মীয় ও সামাজিক নীতিগুলিকে। পূর্বেই বলা হয়েছে খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে সন্দেহ। এবং সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল প্রকৃতি বিজ্ঞান ও বৌদ্ধধর্মের
দিকে। নিজেই পথ খুঁজেছেন তিনি। এখানে বুদ্ধবাণীর প্রতিধ্বনি
শুনতে পেয়েছিলেন
'অশ্বতরো তথাগতো' মন্ত্রে। বিবেকানন্দের পথকে ভাল লাগলেও বিনাপ্রশ্নে বা যুক্তিতে তিনি মেনে নেননি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা,
যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সেগুলির কার্যকারিতা
দেখেছেন। হয়তো সেজন্যই বিবেকানন্দ
তাঁকে বুদ্ধের শরণে যেতে বলেছিলোন। তাঁর এই পরীক্ষা-মধ্যেও বুদ্ধবাণী
অমৃতবারি পান করেছিলেন। বুদ্ধ বলেছেন "আমি বুদ্ধ, বা মহাপুরুষ বলছি বলে, শাস্ত্রে লেখা আছে বলে, পূর্ব পুরুষরা। বিধান দিয়েছেন বলে অযাচিত মেনে নেবে না। তুমি তাই গ্রহণ করবে যেটা তোমার পার্থিব ও পারমার্থিক জীবনে প্রয়োগের মাধ্যমে তোমাকে স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখ প্রদান করবে। আত্মকল্যাণ,
এবং পরকল্যাণে
নিজেকে নিয়োজিত করে গ্রহণ করবে। অন্ধবিশ্বাসে পরিচালিত হয়ে কিছু গ্রহণ করবে না।"-এটাই নিবেদিতা উপলব্ধি করেছিলেন।
'বহুজনহিতায় -বহুজনসুখায়' বজ্রনির্ঘোষে উচ্চারিত সে আহ্বানে মার্গারেটের সমগ্র সত্তা সাড়া না দিয়ে পারল না। তাঁর ভিতরকার মহাপ্রাণ ব্যক্তিগত
সর্বপ্রকার সুখ উপেক্ষা করে ত্যাগ, প্রেম ও করুণার মূর্তি স্বামী বিবেকানন্দের কার্যে আত্মোৎসর্গের মন্ত্রে দীক্ষিত হল। সেদিন সেই শুভক্ষণ ২৫শে মার্চ মার্গারেটকে
শিবপূজা করিয়ে ব্রহ্মচর্যে মন্ত্র দীক্ষা দিলেন। এখানে একটা উপলব্ধি করার বিষয় 'বহুজনহিতায়
বহুজনসুখায়' মন্ত্রে বুদ্ধ সমগ্র জগৎবাসীকে মুক্তিবাণী
শুনিয়েছিলেন। তাই হয়তো সেদিনের দীক্ষা দিলেন স্বামীজি নিবেদিতাকে
বুদ্ধের চরণে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করিয়ে। শপথ করে শুভ দীক্ষা অনুষ্ঠান সমাপ্ত করেছিলেন।
স্বামীজি আবেগপূর্ণ
কণ্ঠে বলেছিলেন-"যাও, যিনি বুদ্ধত্বলাভের পূর্বে পাঁচশত বার অপরের জন্য জন্মগ্রহণ ও প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, সেই বুদ্ধকে অনুসরণ-অনুধ্যান কর।"
এখানেও কিন্তু স্বামীজি যেভাবে বুদ্ধকে দেখেছিলেন,
বুদ্ধকে অনুসরণ করে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন ঠিক তদ্রূপ তাঁর শিষ্যকে বুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। শুভ ও অশুভের বৈপরীত্যে ভরা এই জগৎরূপী পরম-অনুরাগীর দৃষ্টিলাভ, একই সঙ্গে প্রতিটি জীবের প্রতি বুদ্ধের অনন্ত অনুকম্পা হৃদয়ে সযত্নে পোষণ এই সাধন, এই সাধ্য। চিরকালের মতো তিনি ভগবৎ পাদপদ্মে সর্মপিতা হলেন।
ভারতীয় সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে
নিবেদিতার ঝোঁক ছিল তুলনামূলক
ধর্ম বা Comparative
religion-এর দিকে। বিভিন ধর্মমতের মধ্যে তিনি একটি যোগসূত্র খুঁজে বেড়িয়েছেন।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে স্বামীজির
সঙ্গে সাক্ষাতের
অব্যবহিত পূর্বে তাঁর হাতে এসেছিল বুদ্ধের জীবনী Light of Asia এবং তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়নে। স্বামীজিকে দেখে, তাঁর কথা শুনে নিবেদিতার
মনে হয়েছিল তিনি যেন স্বয়ং বুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে দুজনেরই আধ্যাত্মিক বার্তার অভিমুখ ছিল জীবনের দিকে, দৈনন্দিন জীবনের জীবনযাত্রার দিকে। বস্তুত নিবেদিতার
বুদ্ধ সম্পর্কে আগ্রহ ও অনুরাগের পিছনে ছিল স্বামীজির
গভীর প্রভাব ও জাতক কাহিনীর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করার মত।
স্বামীজি বহুবার বুদ্ধের হৃদয়ের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর চিঠিপত্র ও বক্তৃতায়।
স্বামীজি লিখেছেন-"When I
meditate upon Buddha, I became Buddha"-সুতরাং এটা স্বাভাবিক যে নিবেদিতাও বুদ্ধকে সম্মান করবেন। ১৮৮৭ সালে 'যিশু খৃষ্ট' নামে এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন
'নীলাস' ছদ্মনামে-সেই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-'...তাঁর মধুর জীবনকাহিনী
যতই পড়ি ততই প্রাচীন ভারতের বুদ্ধদেবের
কথা মনে না করে পারি না। বহু শতাব্দী আগে তিনিও মায়ের পরীক্ষা আর প্রলোভন জয় করে লোকোত্তর পুরুষ বলে গণ্য হয়েছিলেন। মনে পড়ে সক্রেটিসের
কথা; তাঁর জীবনেও সেই কঠোর সত্যনিষ্ঠা,
সেই সঙ্গে মন কেড়ে নেওয়া নম্রতা আর মাধুর্য। বুদ্ধ আর সক্রেটিসকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না।- অথবা মানব মনের একই উৎস হতে উদ্ভব বলেই তাঁদের সম্ভাবে এত মিল কিনা বলবে?"
এতেই বোঝা যায় ভারতবর্ষ তাঁর কাছে অধরা নয় এবং ভারতীয় ধর্ম-দর্শন সম্পর্কে কত গভীরতা ছিল।
১৯০৪ সালের ১ ডিসেম্বর মিস ম্যাক্লাউডকে তিনি লিখেছিলেন, 'আমরা বজ্রকে জাতীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছি। ফরাসিরা যেমন নেপোলিয়ান বোঝাতে কেবল L'Momme (The man) বলে তেমনি পুরাকালে বুদ্ধ না লিখে বজ্র বললেই চলে যেত। এই বজ্র প্রতীক গ্রহণ যোগ্যতার ব্যাখ্যা হিসেবে ২৫শে জুলাই ১৯০৬ লিখেছেন-'আমি বজ্রকে ভারতের প্রতীক করতে চাই, তা তুমি জানো, ওটি বুদ্ধের চিহ্ন...।" এতেই বোঝা যায় নিবেদিতা বুদ্ধকে কিভাবে ধারণ করতে চেয়েছেন মনেপ্রাণে। বর্হিবিশ্বে
বুদ্ধগয়া যে প্রেরণারা উৎস, সে শুধু বুদ্ধনামের গুণ। নিবেদিতার আমন্ত্রণে
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে বুদ্ধগয়া গেলেন। ১৯০৪ সালের গোড়ার দিকে নিবেদিতা প্রথমবার স্বামী ব্রহ্মানন্দের আশীর্বাদ নিয়ে বুদ্ধগয়ায়
গিয়েছিলেন। দলে ছিলেন নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ
ছাড়া জগদীশ চন্দ্র বসু, অবলাবসু, স্বামী সদানন্দ, ব্রহ্মচারী
অমূল্য, সিস্টার ক্রিস্টিন, মি. ও মিসেস র্যাটক্লিক, ত্রিপুরার
রাজকুমার, রথীন্দ্রনাথ
ঠাকুর, ইন্দ্রনাথ
নন্দী, চন্দ্রকুমার
দে প্রমুখ সহ প্রায় কুড়িজন।
রথীন্দ্রনাথের 'পিতৃস্মৃতি' বইতে বুদ্ধগয়ায়
থাকবার দিনগুলোর স্মৃতি অসামান্য হয়ে আছে। বুদ্ধমন্দির, বোধিবৃক্ষ,
বৌদ্ধদের ধর্মীয় বাতাবরণ রথীন্দ্রনাথের লেখায় চমৎকার ফুটে ওঠে 'মন্দির দেখা হলে আমরা মন্দিরের পিছনের দিকে বোধিদ্রুমের নিকটে গায়ে বসলুম। তখনও অন্ধকার হয়ে এসেছে, মন্দিরের গায়ে গবাক্ষগুলিতে প্রদীপ জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। তার দিকে নিস্তব্ধ,
তার মধ্যে কানে এল 'ওঁম মনিপদ্মে হুঁ'-বৌদ্ধমন্ত্রে মৃদুগম্ভীর ধ্বনির আবর্তন কয়েকটি জাপানী তীর্থযাত্রী এই মন্ত্র আবৃত্তি করতে করতে মন্দির প্রদক্ষিণ
করছেন; আর প্রতি পদক্ষেপে একটি করে ধূপ জ্বেলে রেখে দিয়ে যাচ্ছেন, কী শান্ত তাঁদের মূর্তি, কী গভীর তাঁদের ভক্তি, ইষ্টপূজার
কী অনাড়ম্বর প্রণালী। অনতিপূর্বে
মন্দিরের ভিতরের বুদ্ধমূর্তির সামনে মোহান্তের পুরোহিতদের
কর্কশ ঢাক ঢোল বাজিয়ে আরতি দেখে এসেছিলুম। আমাদের মনে এই কথাটা জাগল, ভগবান এঁদের মধ্যে কার পুজো খুশি হয়ে গ্রহণ করলেন?... অনেকরাত পর্যন্ত জগদীশচন্দ্র,
ভগিনী নিবেদিতা ও পিতৃদেব বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধ ইতিহাস নিয়ে নিবিষ্ট মনে আলোচনা করতেন। নিবেদিতা এক একটি তর্ক তোলেন আর রবীন্দ্রনাথ
চেষ্টা করতেন তার যথাযোগ্য সমাধানে পৌঁছতে।...
আমার বিশ্বাস, এই বুদ্ধগয়া সন্দর্শনের ফলে উত্তরকালে বৌদ্ধর্ম ও সাহিত্যে পিতৃদেবের অন্তরের আকর্ষণ প্রগাঢ় গভীর হয়ে উঠেছিল। পালি পড়াও শুরু হল এবং পিতারই আদেশক্রমে
অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত
তর্জমার দুঃসাহসে প্রবৃত্ত হলুম।”
মাত্র চারদিন নিবেদিতা-রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ ভ্রমণসঙ্গিগণসহ ছিলেন বুদ্ধগয়ায়। ধর্ম সংস্কৃতি ও নানা বৌদ্ধগ্রন্থ
পাঠ করতেন। কখনো নিবেদিতা,
কখনো বা রবীন্দ্রনাথ। এক বিকেলে গেলেন বিখ্যাত উরবিল্ব গ্রামে। এই গ্রামেরই কন্যা ছিলেন সুজাতা। যাঁর হাতে তৈরি পায়সান্ন খেয়ে বুদ্ধ তাঁর পরম বোধিজ্ঞান লাভ করেছিলেন। নিবেদিতার
সেই বুদ্ধগয়া ভ্রমণের একটা তাৎপর্য ছিল সেই সময়ে অর্থাৎ বুদ্ধগয়ার
সাম্প্রতিক ব্যাপারটা
অত্যন্ত জটিল। ভাবভক্তির সূক্ষ্ম প্রশ্নও জড়িয়ে আছে তার সঙ্গে। নিবেদিতা চেয়েছিলেন একটা সমন্বয়ের সূত্র খুঁজে বার করতে। এই পুণ্যতীর্থ হতে বৌদ্ধরা যুগে যুগে পেয়েছেন প্রেরণা, প্রখ্যাত প্রচারকেরা এখান থেকেই যাত্রা করেছেন চীন, জাপান, ব্রহ্মদেশ,
সিংহল ও তিব্বতে। সেই বুদ্ধগয়া কি ধ্বংসস্তূপ হয় পড়ে থাকবে, ছেয়ে যাবে আফিমফুলে? ভাবতেও অধীর হয়ে ওঠেন নিবেদিতা।
একটা জাত ধ্বংস হতে চলেছে, তার মধ্যে এ-অপরাধই যে হবে সবচেয়ে ভয়ানক। নিবেদিতার
অন্তরাত্মা সেদিন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল বুদ্ধভূমি
তথা বোধিআকাশ মুক্ত করতে। তাঁর বুদ্ধগয়া ভ্রমণে আরো জানা যায়-তিনি লিখেছেন-'সুজাতার ভিটেবাড়িটা
দেখবার আকাঙ্ক্ষা
ছিল, জায়গাটা আজও আছে। সেখানে গিয়ে সুজাতার জীবনী পড়লাম। বোধিলাভের
পূর্বক্ষণে সেই প্রভু বুদ্ধকে দিয়েছিল পরমান্ন। কোলে তার শিশু-সন্তান, বুদ্ধদেব সে-শিশুকে আশীর্বাদ করেছিলেন। বুদ্ধগয়ার
মন্দির আর বোধিদ্রুম দেখা হলে মোহন্তের অতিথি হলাম। বুদ্ধগয়াই ভবিষৎ যুগের হৃৎপিণ্ড,
রাজনীতিক দৃষ্টিতে ভারতের প্রসিদ্ধতম
স্থান...'।
যদুনাথ সরকার প্রবুদ্ধ ভারত পত্রিকায় এই ভ্রমণে নিবেদিতা আর রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি কী অসামান্য তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছিল তার বর্ণনা করেছেন। বোধিবৃক্ষ, নৈরঞ্জনা নদী, উরুবিল্ব গ্রাম সব দেখতে দেখতে, ভোরে উঠে প্রতিদিন বোধিবৃক্ষের
তলায় বসে ধ্যান করা আর বৌদ্ধধর্ম
সম্পর্কে এই দুই মনস্বীর আলোচনায় যেন সবাইকে এই দুটি মানুষের কাছ থেকে শুনতেন, এমন অনাবিল আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠেছিল এই বুদ্ধগয়া ভ্রমণ।
বৌদ্ধধর্মের
প্রতি অগাধ ভক্তি আর বিশ্বাস নিয়ে নিবেদিতা তাঁর ভ্রমণ সঙ্গীদের বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন যে ভিন্ন নাম হলেও আদতে বৌদ্ধধর্ম আর হিন্দুধর্মের মধ্যে কোন মূলগত পার্থক্য নেই। রবীন্দ্রনাথের দিক থেকে নিবেদিতার
তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য
হয়নি। দু'জনের দৃষ্টিভঙ্গি
ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। এদিক থেকে নিবেদিতার
বুদ্ধগয়ার ভ্রমণের উদ্দেশ্য কিছুটা হোঁচট খায়। তারপরও বলা যায় নিবেদিতা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বুদ্ধগয়া ভ্রমণ করেছিলেন ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখতে তথা ঐক্য ধরে রাখতে এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য।
অনতিকাল পর নিবেদিতাও বুঝে যান এবং তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়-বুদ্ধগয়া ভ্রমণের তাঁর সব উদ্দেশ্যই
মূলত ব্যর্থ হয়েছে, কারণ নিবেদিতা একপক্ষকে সমর্থন করে বসেন বিশেষ করে শৈব মোহান্তদের। অবশ্য এই ব্যর্থতার
পেছনে আর একটা কারণ ছিল রবীন্দ্রনাথের বৌদ্ধধর্মের প্রতি গভীর আবেগ ভক্তি কিছুটা অনুঘটকের কারণ হয়ে উঠেছিল।
বুদ্ধগয়ায়
নিবেদিতার সহযাত্রী রবীন্দ্রনাথ 'ফুজি' নামে গরীব জাপানি ছেলেটির মুখে প্রতি সন্ধ্যায় বোধিদ্রুমমূলে যে আবৃতি শুনতেন :
"নমো নমো বুদ্ধ দিবাকরায়, নমো নমো গোতম চন্দিমায়।
নমো নমো অনন্তগুণন্নবায়, নমো নমো সকিয় নন্দনায়।।"
পরবর্তীকালে
রবীন্দ্রনাথ নটীর পূজায় যে শ্লোকটি সার্থকভাবে
প্রয়োগ করেছেন। শুধু ফুজিয় আবৃত্তি নয়। তার পাশাপাশি নিবেদিতার বুদ্ধ ও ভারতের প্রতি আত্মনিবেদিনও রবীন্দ্রনাথের অন্তরের রসলোকে শ্রীমতীর আত্মনিবেদনের গানে পরিণত হয় বলা যায়।
"বন্দনা মোর ভঙ্গীতে আজ সংগীতে বাজে।” রবীন্দ্রনাথ
শ্রীমতীর ওই অনন্যশরণ সাধনার বাস্তব প্রতিরূপ নিবেদিতার জীবনেই দেখেছিলেন।
নিবেদিতার
কিছু বাণীর মধ্যেও বুদ্ধচেতনার
আদর্শ পরিলক্ষিত
হয়। যেমন-
"প্রত্যেক সুশিক্ষিত নরনারী-তার জাতির পক্ষে, সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ স্তম্ভস্বরূপ।” এই বাণীটি বুদ্ধ বাণীর প্রতিধ্বনি।
বুদ্ধ বৈশালীর লিচ্ছবীদের সাত অপরিহার্য ধর্মের উপদেশ দিয়েছিলেন
মধ্যে একটি হলো-যে পরিবার, জাতি, সমাজ, রাষ্ট্র তাদের কুলকুমারী,
কুলনারীদের সম্মান রক্ষা করবেন, সম্ভ্রমহানি করবেন না, সেই পরিবার, জাতি, সমাজ রাষ্ট্রের
উত্থান ব্যতীত পতন হবে না। কিংবা বুদ্ধ রাজা প্রসেনজিৎকে মল্লিকা রাণীর গর্ভে কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সেই কন্যাকে উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিবেশ দিয়ে রক্ষা ও সুশিক্ষিত
করতে বলেছেন। নিবেদিতা বুদ্ধবাণীর
সার্থক উত্তরাধিকারী, বুদ্ধবাণীকে স্বামীজির অনুপ্রেরণায়,
আদর্শে, আজীবন ধারণ ও লালন করেছেন এবং অনুধ্যান করেছিলেন। আজ সার্ধশতবর্ষে নিবেদিতার
আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতের প্রতিটি নারীর দেশ-সেবা ব্রত একান্ত অপরিহার্য। এবং প্রতিটি ভারবাসীর ও প্রত্যেক মাতৃজাতির প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা উচিত। অলং ইতি বিখারেণ।
আকরসূচী:
১। ধ্রুপদী-এষণা, ভগিনী নিবেদিতা জন্মসার্ধশত বার্ষিকী সংখ্যা, সম্পাদনা-
সৌরেন মজুমদার, পরিবেশক, দে'জ পাবলিশিং,
জুন, ২৯১৭কোলকাতা।
২। প্রমিথিউসের পথে, নিবেদিতা সংখা, প্রয়াণ শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ, সম্পাদনা,
শংকর ঘোষ, পঞ্চমবর্ষ, প্রথম সংখ্যা, মার্চ-মে, ২০১২ কোলকাতা।
৩। সাহিত্য-অঙ্গন, লোকমাতা নিবেদিতা সার্ধশতবর্ষ সংখ্যা, সম্পাদক-সুজত দাস, অষ্টমবর্ষ,
১ম সংখ্যা, জানুয়ারি, ২০১৭, কোলকাতা।
৪। শতভিক্ষা, সার্ধশতবর্ষে ভগিনী নিবেদিতা, সম্পাদক চিরন্তন মুখোপাধ্যায়,
দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জুন, ২০১৭, কোলকাতা।
৫। ভারতকন্যা নিবেদিতা,
লিজেল রেম, (অনুবাদ), নারায়ণীদেবী,
সোমলতা প্রকাশন, কোলকাতা ২০১৫।
No comments:
Post a Comment