Friday, July 18, 2025

প্রাচীন তাম্রলিপ্ত ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাব


 শুভেচ্ছা বাণী

প্রাচীন তাম্রলিপ্ত ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাব

 সুমনপাল ভিক্ষু

 

হিমালয় নাম মাত্র

আামাদের সমুদ্র কোথায়?

টিমটিম করে শুধু খেলো দুটি বন্দরের বাতি

সমুদ্রের দুঃসাহসী জাহাজ ভেড়ে না সেথা;

-তাম্রলিপ্তি সকরুন স্মৃতি।

                                              -ভৌগোলিক- পেমেন্দ্র মিত্র।

 

বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম নগর তাম্রলিপ্তির বাণিজ্যিক পরিচিতি তথা সমৃদ্ধির কাহিনী সুপরিচিত। এইরূপ মনে করা হয় যে রূপনারায়ন নদীর পশ্চিম তটে স্থিত বর্তমান তমলুক' প্রাচীন তাম্রলিপ্তিক নগর। দশকুমারচরিত্ গ্রন্থে তাম্রলিপ্ত অথবা দামলিপ্ত নরগরকে 'সুহ্ম' জনপদে অবস্থিত বলা হয়েছে কিন্তু মহাভারতে আবার তাম্রলিপ্তি এবং সুহ্ম অঞ্চল ভিন্ন -ভিন্ন জনপদ রূপে দেখা যায়। সর্বোপরি বিভিন্ন পুরাণ সহ অন্যান্য গ্রন্থ এই জনপদকে (তাম্রলিপ্তি, তাম্রলিপ্ত, তাম্রলিপ্তক, তমালিকা, তমোলিত্তি, টামালিটেস, টালকটেই এবং তম্বুলক) বিভিন্ন নামে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন পাল যুগ অবসানের পূর্ণ সময় পর্যন্ত এই নগরের সামুদ্রিক বন্দরের খ্যাতি অক্ষুন্ন ছিল। টলেমি এই সামুদ্রিক বন্দর নগরটির অবস্থান গঙ্গানদীর অনতিদূরেই নির্দেশ করেছেন।কথাসরিৎ সাগরে তাম্রলিপ্তিকা'কে পূর্বাম্বুধির অদূরস্থ একটি নগরী বলা হয়েছে। বৌদ্ধ দর্শনের গ্রন্থ 'মৈত্রেয় ব্যাকরণ' এর পাণ্ডুলিপি'তে তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। পাল রাজা গোবিন্দপালের গয়া অভিলেখ'তে (১১৭৫ খ্রীঃ) উল্লেখ রয়েছে সে এই নগর ভুক্তি-বিভাগের শাসনাধিষ্ঠান ছিল। শুয়াং জাঙ্ তার যাত্রা বিবরণে তাম্রলিপ্তির নগর প্রসঙ্গে বলেছেন, 'সমুদ্রতটে অবস্থিত হওয়ার কারণে এই রাজ্য জল এবং স্হল পথের দ্বারা গমনাগনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ছিল। রাজধানীর নিকটে একটি অশোক স্তুপ স্তম্ভ ছিল। স্তুপের নিকটে ৪টি পূর্ব বুদ্ধের আসন এবং চঙ্ক্রমনের ভগ্নাবশেষ বিদ্যমান ছিল। এই রাজ্যে ১০ এর অধিক সংঘারাম এবং হাজার ভিক্ষু বাস করতেন।' নীহার রঞ্জন রায়ের মতে, পুরাতন সরস্বতী বা গঙ্গার অন্য কোনও শাখানদীর উপর প্রাচীন তাম্রলিপ্তির অবস্থিতি ছিল, সেই নাদীর খাত শুকিয়ে যাওয়ার ফলে তাম্রলিপ্তির বানিজ্য সমৃদ্ধি বিনষ্ট হয়ে যায়।' মহাবংশের একটি কাহিনীতে উল্লেখ রয়েছে, ধর্মাশোক সিংহলী কয়েকজন দূতকে বিদায়-সংবর্ধনা প্রদানের নিমিত্তে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত উপস্থিত হয়েছিলেন। বৃহৎ ব্যবসা বানিজ্য কেন্দ্র ব্যতীত তাম্রলিপ্তির শিক্ষা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। স্হলপথে এই নগরীর সঙ্গে রাজগৃহ, শ্রাবস্তী, গয়া বারানসীর সঙ্গে এই নগরীর যে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ছিল; তা জাতকের কাহিনীতে বারংবার উঠে এসেছে। পঞ্চম শতকে ফা-শিয়েন সপ্তম শতকে ইৎ-সিং এই নগরে সংস্কৃত শিক্ষা এবং বৌদ্ধবিদ্যা অধ্যয়ন করেছিলেন। বর্তমানে এই নগরীর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কালের বিবর্তনের এর সম্পূর্ণটাই বিস্মৃতির অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। লেখক এইভাবেই তাম্রলিপ্তির ইতিহাস পাঠকের নিকট তুলে ধরেছেন। ইতিহাসের বিষয়টি বাদ দিলেও, ভাষা এবং সাহিত্যের দিক হতে সম্পূর্ণ বাংলা ভাষা সাহিত্যে লেখকের এই গ্রন্থটি একটি অনন্যপূর্ণ গ্রন্থ। ঐতিহাসিক বিষয়ে গবেষণার   অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে, তাঁরাই একমাত্র উপলব্ধি করতে পারবের এই সুকঠিন বিষয় বস্তু রচনার প্রশ্নে কীরূপ নিষ্ঠা, শ্রমশীলতা ধৈর্য শক্তি প্রয়োজন। লেখক এক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে সফলতা লাভ করেছেন।তার এই গ্রন্থে কোনরূপ কাল্পনিক বিষয় উল্লেখিত হয়নি। সর্বপ্রেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, তিনি গ্রন্থের সর্বত্রই পূর্ববর্তী লেখক-ঐতিহাসিকদের মতামত অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন, নতুন যুক্তি এবং সকল প্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে, অতঃপর নিজের সিদ্ধান্ত পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপণ করেছেন। এর ফলে তাঁর প্রচেষ্টা অসামান্য সার্থকতা লাভ করেছে। এই গ্রন্থটি আমাদের একটি নতুন জিনিস প্রদান করেছে, তাহল তাম্রলিপ্তির ইতিহাস সম্পর্কিত যুক্তিপূর্ণ তথ্য। ফলে লেখকের গভীর চিন্তা অন্তর্দৃষ্টির বিষয়গুলি প্রকাশ্য দিবালোকের ন্যায় উদ্ভাসিত হয়েছে। তার এই বৈশিষ্ট্যের ফলে গ্রন্থটি হয়ে উঠছে ইতিহাস চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর গ্রন্থ। তার এই অনবদ্য প্রয়াস বিষয়টিকে একজন মৃৎশিল্পির প্রতিমা নির্মাণের কৌশলরূপে গ্রহণ করতে পারি। মৃৎশিল্পি যেমন পরতে পরতে প্রতিমা নির্মাণ সম্পূর্ন করেন, ঠিক তেমন ভাবেই লেখক তার গ্রন্থে বিষয় বস্তুকে পরতে পরতে নির্মাণ করেছেন। আর এই কারনেই লেখক, পি শাশ্বতি'এর সার্থকতা পাঠকের তৃপ্তি এবং ইতিহাস গবেষণার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক সর্বাঙ্গ চিত্রটি উজ্জ্বল হয়েছে।

 


 

 


No comments:

Post a Comment