Sunday, August 4, 2024

চিত্ত ও সমাধি

 চিত্ত  ও সমাধি

চিত্ত হল চিতি ধাতু নিষ্পন্ন শব্দের অর্থ চিন্তা করা। এখানে “ চিন্তা করে ” অর্থ আলম্বন গ্রহণ করে , আলম্বন জানে, আলম্বন অবগত হয়। অর্থকথা অনুসারে চিত্ত হল যা বিষয়কে জানে বা অবগত হয় (চিন্তেতি, বিজানাতি) । অভিধর্ম অনুসারে চিত্তের উত্তম সংজ্ঞা হল- বিষয়কে জানা বা অবগত হওয়া কারণ বিষয়কে জানার জন্য আত্মারূপে কোন জ্ঞাতা নেই ।

চিত্তের অপর নাম মন, চেত, চিত্তুপ্পাদ, নাম, বিঞ্ঞান(বিজ্ঞান) প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই অভিধর্মে চিত্ত এবং মনকে পৃথক করে দেখানো হয়নি। বস্তুত, চিত্ত ও মন এক অর্থে ব্যবহৃত হয়। চিত্ত, মন, বিজ্ঞান এক অর্থবোধক, এদের লক্ষণ যথাক্রমে চিন্তন, মনন ও বিজানন এরাও একার্থবোধক। আলম্বন বিজানন চিত্তের স্বভাব। অর্থাৎ মনন ইন্দ্রিয় দ্বারা যা চিন্তা করা হয় তাই চিত্ত। মনন ইন্দ্রিয় কি চিন্তা করে বলা হলে তা হলে বলতে হয় চেতসা চিন্তেতি অর্থাৎ অনুভূতিতে উপলব্ধি বিষয় বা আলম্বনকে চিন্তা করে, আলম্বনকে জানে, আলম্বনকে অবগত হয়। 

চিত্ত কোন প্রকার উপকরণ ব্যতীত একা উৎপন্ন হতে পারেনা এবং কোন ক্রিয়াও সম্পন্ন করতে পারেনা। চিত্তের উপকরণ হল চিত্তবৃত্তি (চৈতসিক)। আবার চিত্তের উৎপত্তিতে আলম্বন অপরিহার্য। আলম্বন শব্দের অর্থ অবলম্বন। মাটি না হলে শস্য যেমন উৎপন্ন হতে পারেনা, তেমনি আলম্বন হল চিত্ত ও চৈতসিকের কার্যক্ষেত্র।

চিত্তের উৎপত্তিতে আলম্বনের মত বস্তু একান্ত অপরিহার্য যা চিত্তের আশ্রয়স্থল। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা, কায় ও হৃদয়কে বলা হয় চিত্ত ও চিত্তবৃত্তির বস্তু (বস্তু বলতে বোঝায় আধার, আশ্রয়স্থল)। কারণ এগুলোকে আশ্রয় করেই চিত্ত ও চিত্তবৃত্তির ক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে। জন্মের প্রত্যুষে চিত্ত বা মনের প্রথম উদয়কে বলা হয় প্রতিসন্ধি চিত্ত। এর পরেই ভবাঙ্গ চিত্ত (মনের অবচেতন স্তর) বা ভবাঙ্গ প্রবাহ। ভবাঙ্গ হচ্ছে স্থির নিস্তরঙ্গ নির্মল চিত্তপ্রবাহ। যখন রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ এ পঞ্চ আলম্বনের (বিষয়ের) সঙ্গে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা এবং ত্বক এ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হয়, তখন ভবাঙ্গ (স্থির, নিস্তরঙ্গ, নির্মল চিত্তপ্রবাহ) চিত্তের অবচেতন স্তর (নিস্তরঙ্গ) ভেদ করে নদীর ঢেউয়ের মত চিত্তকে তরঙ্গায়িত করে। একেই বলা হয় চিত্তের উৎপত্তি ।

অভিধর্ম অনুসারে চিত্তের সংখ্যা ৮৯ প্রকার। কিন্তু ৪০ প্রকার লোকোত্তর চিত্ত সংযুক্ত হয়ে ৮৯ প্রকার চিত্ত ১২১ প্রকার হয়। 

এখন জ্ঞান বা প্রজ্ঞা (সচেতনতা), এটি এমন একটি ধর্ম (বিষয়বস্তু) যা মানসিক ক্রিয়া-কলাপের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়, কিছু জানার বা সচেতন হওয়ার মানসিক ক্রিয়াকলাপ। এর সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্যগুলি হল: ১) স্পষ্টতা বা প্রভাস্বর, যার অর্থ হল স্বরূপ নির্মাণ, ২) প্রজ্ঞা (সচেতনতা) কোন কিছুর বিষয়ে সচেতনতা বা কোন কিছুর জ্ঞান, এবং ৩) কিছু অনুভব করার সময় বিভিন্ন ধরণের সকারাত্মক বা নকারাত্মক আবেগ থাকে কিন্তু তবুও মানসিক ক্রিয়াকলাপের স্বভাব নিজের দিক থেকে নিরপেক্ষ থাকে। একটি মানসিক ক্রিয়াকলাপ সহায়ক বা ক্ষতিকারক কিনা সেটা নির্ভর করে চেতসিকের উপর, মানসিক ক্রিয়াকলাপরূপী চেতসিকের মূল স্বভাবের উপর নয়।

উদাহরণ স্বরূপ, ক্রোধ চিত্তের মূল স্বভাবের অংশ নয়। পরিবর্তে ক্রোধ উদ্ভূত হওয়ার জন্য হেতু এবং প্রত্যয়ের উপর নির্ভর করে। (অন্যদিকে কোন কিছুর মূল স্বভাব বিরতিহীন নয় এবং উদ্ভূত ও উপস্থিত হওয়ার জন্য হেতু এবং প্রত্যয়ের উপর নির্ভর করে না। এটি উদ্ভূত হয় এবং নিরন্তর উপস্থিত থাকে।) এরপর কিছু নির্দিষ্ট চেতসিক যেমন- ক্রোধ, হেতু এবং প্রত্যয়ের উপর ভিত্তি ক’রে উৎপন্ন হয় আর সেটা শুধুমাত্র তখনই প্রভাবশালী হয়।

চেতসা চিন্তেতি” অর্থাৎ অনুভূতিতে উপলব্ধ বিষয় বা অবলম্বন (জড় বা অজড় বস্তু যাকে আলম্বন বা অবলম্বন করে চিত্ত উৎপন্ন হয় তাই চিত্তের “বিষয় বা আলম্বন বা অবলম্বন বা আরম্মন”।   “চিন্তা করে” অর্থ আলম্বন গ্রহণ করে (অবলম্বন করে)। আলম্বনকে জানে, আলম্বনকে অবগত হয়। “চিত্ত, মন, বিজ্ঞান” শব্দত্রয় একার্থবাচক; এদের যে কোন একটি অন্য দুইটির প্রতিশব্দ জ্ঞাপক। এদের লক্ষণ যথাক্রমে চিন্তন, মনন ও বিজানন; এগুলোও একার্থবোধক আলম্বন বিজানন চিত্তের স্বভাব। “চিন্তেতি” ক্রিয়াপদে দুইটি প্রধান অবলম্বন অর্থে ঘনিষ্ঠরূপে সন্ধিবদ্ধ এবং প্রায়শ অবিচ্ছেদ্য, যেমন—“চিৎ” এবং “ চেৎ” অর্থাৎ “চিত্ত” এবং “চেতস” ; (তুলনীয়) তুমি “চেতো” দ্বারা “চিত্ত” কে দমন-সংযত-শান্ত করা দরকার (মধ্যম নিকায়); (তুলনীয়) অত্তনা চোদয অত্তানং (স্ত্রীলিঙ্গে); (তুলনীয়) চেতসা চিত্তং, সমন্নেসতি (সংযুক্ত নিকায়)। সাধারণ ব্যবহারে “চিত্ত” এবং “চেতস” শব্দদ্বয়ের মধ্যে অর্থের কোন পার্থক্য দেখা যায় না। চিত্তেন নীযতি লোকো; উপক্কিলিট্ঠ চিত্তেন; অসল্লীনেন চিত্তেন (সংযুক্ত নিকায়)। চিত্তেসু (অঙ্গুত্তর নিকায়) সমাহিতে চিত্তে; চিত্তে ব্যাপন্নে কাযকম্মং পি হোতি; (সংযুক্ত নিকায়) চিত্তম্হি (চিত্তস্মিং) ব্যাপন্নে কাযকম্মং পি হোতি। “চিত্ত” এবং “চেতস” শব্দের পাঁচমিশালী বা এলোমেলো ব্যবহার:—“চিত্ত” সাধারণত মনকেই বুঝায়, আর “চেতস” সাধারণত চিত্তের অবস্থান স্থান হৃদয়কেই বুঝায়। (“চিত্ত” এবং “চেতো” শব্দের যৌগিকে ব্যবহার) চিত্ত-সমাধি = চেতো-সমাধি। পক্ষান্তরে “চেতোখিল” এবং “চেতো-ৰিমুত্তি” , কিন্তু “চিত্ত” এর সহিত “ৰিমুত্ত-চিত্ত” , “উপক্কিলেস” শব্দের সঙ্গে “চিত্ত” এর সংযোগ সীমাবদ্ধ ইত্যাদি। নিম্নোক্ত বাক্যসমূহে তা বর্ণিত হয়েছে—(সংযুক্ত নিকায়) ৰিৰটেন চেতসা সপ্পভাসং চিত্তং ভাৰেতি—খোলা মনে সে আনন্দোজ্জ্বল ভাবনায় ধ্যান করছে; চেতসা চিত্তং সমন্নেসতি ৰিপ্পমুত্তং—সে মনে মনে তাঁদের নিষ্পাপ মনকে সম্যক অনুসন্ধান বা তদন্ত করছে। (দীর্ঘ নিকায়) “ৰিগতাভিজ্ঝেন চেতসা” অনুসরণে “অভিজ্জায চিত্তং পরিসোধেতি”।

অঙ্গুত্তর নিকায়) অনুপারম্ভচিত্তো ভব্বো চেতসো ৰিক্খেপং পহাতুং “চেতসো ৰূপসমো” অনুকরণে “ৰূপসন্ত-চিন্তো’। (দীর্ঘ নিকায়) “সমাহিতে চিত্তে” অনুকরণে “চেতাসমাধি। (অঙ্গুত্তর নিকায়) “চিত্তং পদুট্ঠং” অনুকরণে “চেতেপদোস”। (সংযুক্ত নিকায়) চেতসো ততো চিত্তং নিৰারযে—আন্তরিক ইচ্ছা—ওটি হতে মনকে নিবারণ কর। অন্যান্য বিষয়ে মানসিক কার্যধারা সম্পর্কে “চিত্ত” এর সম্বন্ধ:—“চিত্ত” অর্থে “হৃদয়” অর্থাৎ মানুষের ব্যক্তিত্ব সংযোগে হৃদয়—(সংযুক্ত নিকায়) হদযং ফলেয্য, চিত্তৰিক্খেপং পাপুণেয্য—হৃদয় বিদীর্ণ হবে, চিত্তবিক্ষেপ ঘটবে; = চিত্তং তে খিপিস্সামি, হদযং তে ফালেস্সামি (সংযুক্ত নিকায়)। (সংযুক্ত নিকায়) কামরাগেন চিত্তং মে পরিডয্হতি (বৈষম্য অর্থবাচক) নিব্বাপেহি মে হদয পরিল়াহং—আমার হৃদয়-অগ্নি নির্বাপিত করো (মিলিন্দ প্রশ্ন); (তুলনীয়) অভি-নিব্বুতাত্তো (সূত্রনিপাত); = অপরিডয্হমান—চিত্তো (সূত্র নিপাত অর্থকথা)। (দীর্ঘ নিকায় অর্থকথা) চিত্তং অধিট্ঠহতি—হৃদয় বা মন বসানো, ইচ্ছা করা। “চিত্ত” শব্দ মানসিক অবস্থায়— শারীরিক অবস্থার সহিত বৈষম্য প্রকাশে:—” চিত্ত” (বিপরীত) “কায” অর্থাৎ “কিলন্ত কায—চিত্ত”—অবসন্ন শরীর ও মন (দীর্ঘ নিকায়)। (সংযুক্ত নিকায়) আতুর কায-চিত্ত। (অঙ্গুত্তর নিকায়) নিকট্ঠকায—চিত্ত। (সংযুক্ত নিকায়) ঠিত কায-চিত্ত—স্থির দেহ ও মন; (তুলনীয়) ঠিতত্ত। (সংযুক্ত নিকায়) পস্সদ্ধি কায-চিত্ত—দেহমনের শান্তি। অর্থকথাচার্য “সঙ্খারাক্খন্ধ” অথবা চৈতসিক সমূহকে ছয় যুগ্মভাবে পৃথক করে দেখিয়েছেন, যেমন—” ৰিঞ্ঞাণক্খন্ধ” এতে “চিত্ত কায পস্সদ্ধি” (মন ও দেহের প্রশান্ত ভাব), চিত্ত-কায লহুতা (মন ও দেহের লঘুতা) ইত্যাদি; অন্য তিনটি মানসিক “খন্ধ” , যাকে “নাম-কায” রূপে গ্রহণ করা হয়েছে (ধর্মসঙ্গণী এবং ধর্মসঙ্গণী অর্থকথা)। (দীর্ঘ নিকায়) পস্সদ্ধ নাম-কায়। জ্ঞানালোক প্রাপ্ত বা সদবুদ্ধি সম্পন্ন অবস্থা:—” চিত্ত” (মন); বৈষম্যে “মনস” (মনের ভাব বা চিন্তাধারা এবং “ৰিঞ্ঞাণ” (বুদ্ধি, জ্ঞান, যথার্থ অনুভব, বোধ)। এই তিনটি মনের অভিব্যক্তির অন্য নামে অদৃশ্যভাবে শরীরের কর্মশক্তি গঠিত করে থাকে, যঞ্চ ৰুচ্চতি “চিত্ত’তি ৰা “মনোতি” ৰা “বিঞ্ঞণং’তি” ৰা; (দীর্ঘ নিকায়) অযং অত্তা নিচ্চো ধুৰো ইত্যাদি,  (সংযুক্ত নিকায়) তত্র’স্সুত বা পুথুজ্জনো নালং নিব্বিন্দিতুং ইত্যাদি,  তং রত্তিযা চ দিৰসস্স চ অঞ্ঞ-দ-এৰ উপ্পজ্জতি অঞ্ঞং নিরুজ্ঝতি (সংযুক্ত নিকায়)। “আদেসনা পাটিহারিয” (পরচিত্ত বিজ্ঞান-জ্ঞান) এতে:—এৰং পি তে মনো ইত্থম্পি তে মনো ইতি পি তে চিত্তং—এতাদৃশ আপনার চিন্তাশক্তি এবং এতাদৃশ আপনার মন অর্থাৎ চিন্তার স্বভাব (দীর্ঘ নিকায়)। (সংযুক্ত নিকায়) নিচ্চং ইদং চিত্তং নিচ্চং ইদং মনো; চিত্তেন নীযতি লোকো—চিত্ত বা চিন্তা দ্বারা সংসার পরিচালিত হয়ে থাকে; অপতিট্ঠিত—চিত্তো আদীন-মনসো অব্যাপন্ন চেতসো; ব্যাপন্ন-চিত্তো পদুট্ঠ মনসনকপ্পো। পদুট্ঠ-চিত্তো = পদুট্ঠ মনসো (পেতৰত্থু অর্থকথা)। আবেগময় বা ভাবোদ্দীপক ধারা বুঝালে:—কর্মবাচ্যে অভিপ্রায় বা সঙ্কল্প অর্থে হয়ে থাকে। বৈষম্য বুঝালে:—ইচ্ছাবৃত্তি বা অভিলাষ অর্থ হয়ে থাকে। চিত্ত” এখানে চারটি “সমাধি” এর মধ্যে একটি। চারটি সমাধি, যথা—ছন্দ সমাধি, বিরিযসমাধি, চিত্ত সমাধি, ৰীমংসা সমাধি (দীর্ঘ নিকায়)। কার্য অর্থে “চিত্ত” ও “কম্ম” এর উৎসম্বরূপ, যেমন—(অঙ্গুত্তর নিকায়) চিত্তে ব্যাপন্নে কাযকম্মং পি ব্যাপন্নং হোতি—অভিপ্রায় (অর্থাৎ মনের অভিপ্রায়) যখন অসৎ হয় তখন শারীরিক কর্মও অসৎ হয়ে থাকে চিত্তং অপ্পমাণং যং কিঞ্চি পমাণকতং কম্পং ইত্যাদি। সংযুক্ত নিকায় বর্ণনায় “চিত্ত” “ কায” এবং “ৰাচা” এই দুটির বৈষম্য, তিনটি একত্রে “কাযেন (কার্যে), “ৰাচায” (কথায়), “চিত্তেন” অথবা “মনসা” (অভিলাষে বা ইচ্ছায় বা চিত্তবৃত্তিতে)। সেরূপ সংযুক্ত নিকায়ে বলা হয়েছে—তং ৰাচং অপ্পহায (চিত্তং অপ্পহায, দিট্ঠিং অপ্পহায।” চিত্ত” ত্রিবিধ “দক্খিণেয্য সম্পত্তি” এর মধ্যে একটি; ত্রিবিধ “দক্খিণেয্য সম্পত্তি” যথা—খেত্তসম্পত্তি (দান গ্রহীত), চিত্ত সম্পত্তি (সদিচ্ছা), পযোগসম্পত্তি (উপায়) (ৰিমানৰত্থু অর্থকথা)।  “চিত্ত” তিন প্রকার “ভাবনা” এর মধ্যে একটি তিন প্রকার “ভাবনা” , যথা—(দীর্ঘ নিকায়) কাযভাৰনা, চিত্তভাৰনা, পঞ্ঞভাৰনা। “চিত্ত” চতুর্বিধ “সতিপট্ঠান” এর মধ্যে একটি চতুর্বিধ “সতিপট্ঠান” , যথা—(দীর্ঘ নিকায়) কাযৰেদনা ধম্মা, চিত্তৰেদনা ধম্মা ইত্যাদি।” চিত্ত” বিনয়ের “অধিসীল” ইত্যাদিতে (সীল—নীতিতত্ত্ব, পঞ্ঞ—প্রজ্ঞা সহকারে) “সীলক্খন্ধ” এর অংশ স্বরূপ। (তুলনীয়) তিস্সো সম্পদ, যথা—সীলসম্পদা, চিত্তসম্পদা, দিট্ঠিসম্পদা ( = সীল এবং তুলনীয়—চেতনা, চেতসিক) (অঙ্গুত্তর নিকায়)। (সংযুক্ত নিকায়) “চিত্ত” এবং “পঞ্ঞা” এই শব্দ দুইটিও একত্র বিন্যাস হয়ে থাকে। (অঙ্গুত্তরনিকায়) অনুভূতি অর্থে “চিত্ত” শব্দ “সঞ্ঞা, চিত্ত, দিট্ঠি” সমবায়ে বুদ্ধিবৃত্তির প্রক্রিয়ার সঙ্গে বৈষম্য হয়ে থাকে। সোজা বা ইঙ্গিতে “চিত্ত” সম্বন্ধে বর্ণনা:—(ধর্মপদ অর্থকথা) চিত্তং’তি ৰিঞ্ঞাণং ভূমিকৰত্থু আরম্মণ কিরিযাদি—চিত্ততায পনেতং চিত্তং’তি ৰুত্তং। (খুদ্দকপাঠ অর্থকথা) চিত্তং’তি মনো মানসং। (নেত্তি) চিত্তং মনোৰিঞ্ঞাণং’তি চিত্তস্স এতং ৰেৰচনং। (ধর্মসঙ্গণী) যং চিত্তং মনো মানসং হদযং পণ্ডরং ইত্যাদি। মনিন্দ্রিয়। যেমন—“রপাবচর চিত্ত” (বিশুদ্ধিমার্গ)। “চিত্ত” এর সমপ্রয়োগের শ্রেণীতে অর্থ:—মন, হৃদয়, ইচ্ছা, বিজ্ঞান, অভিপ্রায়, সঙ্কল্প ইত্যাদি। হৃদয় সংবেদজ আবেগময় অথবা বোধশক্তি সম্বন্ধীয় ভাবোদ্দীপক সত্তার সাধারণ অবস্থাস্বরূপ, ইদ্রিয়সমূহে (ইন্দ্রিযানি) এটির সম্পর্ক। স্থির সঙ্কল্প ও অপ্রতিভ হৃদয় গভীর আবেগময় সাম্যাবস্থার লক্ষণ, ইহা ইন্দ্রিয়সমূহ দমনের কারণস্বরূপ বলে গ্রহণ করা হয়। (সংযুক্ত নিকায়) সমাদহংসু চিত্তং অত্তনো উজুকং অকংসু, সারথী ৰ নেত্তানি গহেত্বা ইন্দ্রিযানি রক্খন্তি পণ্ডিতা। (অঙ্গুত্তর নিকায়) উজুগতো—চিত্তো অরিযসাৰকো। (সংযুক্ত নিকায়) ঠিত চিত্ত। (অঙ্গুত্তর নিকায়) ঠিত চিত্ত আনেজ্জপ্পত্ত। (সূত্র নিপাত) চিত্তং ন কম্পতি। (সংযুক্তনিকায়) চিত্তং ন ৰিকম্পতে; (বিপ) চপলং চিত্তং (ধর্মপদ)। (অঙ্গুত্তর নিকায়) খিত্ত চিত্ত ৰিসঞ্ঞিন; চিত্তং রক্খিতং মহতো অত্থায সংৰত্ততি—সুরক্ষিত চিত্ত মহালাভের দিকে প্রবর্তিত হয়। সমার্থবাচক শব্দ:—চিত্তং দন্তং চিত্তং গুত্তং, চিত্তং সংৰুতং। (ধর্মপদ) চিত্তং রক্খেত মেধাৰী চিত্তং গুত্তং সুখাৰহং। (সংযুক্তনিকায়) চক্খুন্দ্রিযং অসংৰুতস্স ৰিহরতো চিত্তং ব্যাসিঞ্চতি রূপেসু। (ধর্মপদ) যে চিত্তং সঞ্ঞমেস্সন্তি মোক্খন্তি মারবন্ধনা—যারা চিত্তকে সংযম করতে পেরেছেন তাঁরা মারের বন্ধন হতে মুক্ত হয়েছেন; পাপা চিত্তং নিৰারযে। (সংযুক্ত নিকায়) ভিক্খুনো চিত্তং কুলেসু ন সজ্জতি, গয্হতি, ৰজ্ঝতি। কাম (বিসয়াসক্ত), রাগ (তীব্র আকাঙ্ক্ষাযুক্ত) সংস্পর্শে:- কামা (সূত্র নিপাত) কামা মথেন্তি চিত্তং। (সংযুক্ত নিকায়) কামরাগেন ডয্হামি। (সূত্র নিপাত) কামে নাপেক্খতে চিত্তং। (ধর্মপদ) মা তে কামগুণে ভমস্সু চিত্তং। (সংযুক্ত নিকায়) মনুস্সকেহি কামেহি চিত্তং ৰুট্ঠপেত্বা। (অঙ্গুত্তর নিকায়) ন উল়ারেসু কামণ্ডণেসু ভোগায চিত্তং নমতি; কামাসৰা পি চিত্তং ৰিমুচ্চতি। (দীর্ঘ নিকায়) কামেসু চিত্তং ন পক্খন্দতি নপ্পসীদতি ন সংতিট্ঠতি—আমার মন কাম সমূহে বা তীব্র আকাঙ্ক্ষায় উল্লম্ফন করে না, বসে না অথবা স্থিত হয় না। (সংযুক্ত নিকায়) কামেসু তিব্বসা রাগো ব্যাপন্নচিত্তো। (পেতৰত্থু অর্থকথা) কামামিসে লগ্গচিত্তো। রাগা—(সংযুক্ত নিকায়) রাগো চিত্তং অনুদ্ধংসেতি—রাগ বা ভ্রষ্টতা চিত্তকে ক্রমে ধ্বংস বা ক্লান্ত করে থাকে। (অঙ্গুত্তর নিকায়) রাগপরিযুট্ঠিতং চিত্তং হোতি। (সংযুক্ত নিকায়) সারত্ত চিত্তো; ৰিরত্তচিত্তো। বিবিধরূপে ব্যবহার:—(অঙ্গুত্তর নিকায়) পটিবদ্ধ চিত্ত; পরিযাদিন্নচিত্ত লাভেন অভিভূত (সংযুক্ত নিকায়) উপক্কিলিট্ঠ চিত্ত—উপক্লিষ্ট চিত্ত; (অঙ্গুত্তর নিকায়) ওতিন্ন চিত্ত—প্রেমে পতিত মন। শান্ত চিত্ত, একাগ্র চিত্ত, মীমাংসিত চিত্ত, আত্মদমিত বা বশীভূত চিত্ত, সুনিপুণ চিত্ত, অপ্রতিভ চিত্ত অর্থে:— (সংযুক্ত নিকায়) চিত্ত পসীদতি—মন আনন্দিত হয়; = পসন্নচিত্ত (অঙ্গুত্তর নিকায়)। (সংযুক্ত নিকায়) ৰিপ্পসন্ন চিত্ত। চিত্ত সংতিট্ঠতি। একজাতীয় শব্দে—সংতিট্ঠতি, সন্নিসীদতি, একোদি হোতি, সমাধিযতি (তুলনীয়) চেতসো একোদিভাৰ। চিত্ত সমাধিযতি—চিত্ত সমাধিস্থ বা ধ্যানস্থ হয়; = সমাহিত চিত্ত। চেতো সমাধি। সুপতিট্ঠিত চিত্ত; (মূলে আছে) চতূসু সতিপট্ঠানেসু সুপতি্টঠিত চিত্ত। (সংযুক্ত নিকায়) সুসন্ঠিত চিত্ত; ৰসীভূত চিত্ত। (ধর্মপদ) দন্তচিত্ত। মনের উদ্দেশ্যজনিত অর্থে: মন লাগানো, কিছু পাইবার জন্য পুনঃপুন চেষ্টা, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, ইত্যাদি। চিত্তং নমতি—মন নমিত হয়; (একত্রে) চিত্তং অপ্পোস্সুক্কতায নমতি; চিত্তং নেক্খম্ম-নিন্ন নমতি (সংযুক্ত নিকায়); (ধর্মপদ) ৰিৰেক চিত্তং নমতি। চিত্তং পদহতি— ছন্দং জনেতি ৰাযমতি ৰিরিযং আরব্ভতি চিত্তং পগ্গণ্হাতি পদহতি (দীর্ঘ নিকায়)। প-নি-দহতি (পণিধি, পণিহিত—নত অর্থে); (তুলনীয়) চেতো পণিধি (সংযুক্ত নিকায়); তত্থ চিত্তং পনিদহতি; চিত্তং দুপ্পনিদহতি; চিত্তং সম্মাপনিদহতি (ধর্মপদ)। অসৎ চিত্ত বুঝালে:—পদুট্ঠ চিত্ত (তুলনীয়) চেতোপদোস; (বিপ) পসন্ন চিত্ত। ব্যাপন্ন চিত্ত। চিত্তে ব্যাপন্নে কাযকম্মং পি ব্যাপন্নং হোতি (অঙ্গুত্তর নিকায়)। সমোহ চিত্ত। (দীর্ঘ নিকায়) সমোহ চিত্ত সরাগচিত্ত ইত্যাদি। পবিত্রতায় পূর্ণ মন অর্থে:—পবিত্র চিত্ত, পরিষ্কার চিত্ত, শোধিত চিত্ত, মুত্ত চিত্ত, নিরপেক্ষ বা নির্লিপ্ত চিত্ত ইত্যাদি। মুত্ত চিত্ত, ৰিমুত্ত চিত্ত ইত্যাদি; (তুলনীয়) চেতসো ৰিমোক্খা, চেতো ৰিমুত্তি, মুত্তেন চেতসা; আসৰেহি চিত্তানি মুচ্চিংসু (সংযুক্ত নিকায়)। এখানে “ৰিমুত্ত চিত্ত” অর্থে “ৰিমুত্ত সুভাৰিত চিত্ত, ৰিমুত্ত ৰিরত্তচিত্ত, রাগা ৰিমুত্ত চিত্ত, ৰিমুত্ত সুদন্ত চিত্ত”। “সুৰিমুত্ত চিত্ত” অর্থে “সুৰিমুত্ত সতিমা চিত্ত”। (মধ্যম নিকায়) চিত্তং পরিসোধেতি। (সংযুক্ত নিকায়) অলীন চিত্ত। মেত্তচিত্তং ভাৰেতি—মনে মনে মৈত্রীচিন্তা করে অর্থাৎ সদিচ্ছা পোষণ করে বা মঙ্গল কামনা করে (দীর্ঘ নিকায়)। মেত্তা-সহগতেন চেতসা। ভাৰিত চিত্ত। ভাৰিত সুসমাহিত চিত্ত। সদ্ধা-পরিভাৰিত চিত্ত। ভাৰিত বহুলীকত চিত্ত। শান্ত, উপশমিত, নির্লিপ্ত চিত্ত অর্থে:—সন্তচিত্ত, উপসন্ত চিত্ত। পরিচালনীয় বা সহজে নড়ানো চড়ানো যায় এরূপ চিত্ত অর্থাৎ সত্য লাভের জন্য উৎসুক এবং প্রস্তুত, খোলা বা মুক্ত এবং নিজ নিজ মন অর্থে:—কল্লচিত্ত, মুদুচিত্ত, উদগ্গচিত্ত, পসন্নচিত্ত, লহুচিত্ত, লহুক মুদিত চিত্ত। বিবিধ বিশেষ ভাষায় ব্যক্ত:—(সংযুক্ত নিকায়) অব্ভুত—চিত্তজাতা—আশ্চর্যে পরিপূর্ণ চিত্ত; এৰং চিত্তো—এইরূপ মন, মনের এই অবস্থায় চিত্তেন মে গোতমো জানাতি—গৌতম আমার চিত্ত—সম্বন্ধে জ্ঞাত আছেন। (বিনয়) থেয্যচিত্তো—চুরি করবার চিত্ত (মধ্যম নিকায়) আরদ্ধ চিত্তো। (সংযুক্ত নিকায়) অঞ্ঞচিত্তং উপট্ঠাপেতি। (জাতক) নানাচিত্ত। (পেতৰত্থু অর্থকথা) নিহীনচিত্তো। (অঙ্গুত্তর নিকায়) নিকট্ঠচিত্তো আহটচিত্তো। (সংযুক্ত নিকায়) সুপহত চিত্ত। (ধর্মপদ) ৰিসঙ্খারগত চিত্ত। (সূত্রনিপাত) সম্পন্নচিত্ত। (সংযুক্ত নিকায়) ৰিব্ভন্তচিত্ত। চিন্তা বা ভাবনা অর্থে:—(সংযুক্ত নিকায়) মা পাপকং অকুসলং চিত্তং চিন্তেয্যথ—কোনরূপ পাপ চিন্তা করিও না। (পেতৰত্থু অর্থকথা) ন চিত্তমত্তংপি—(এখানে চিত্তোৎপত্তির ক্ষণ নির্দেশ করে বলা হচ্ছে) এমন কি একমাত্র চিত্তক্ষণও নয়; মম চিত্তং ভৰেয্য—আমার চিন্তা করা উচিত। বিশুদ্ধিমার্গে চিত্তকে বানরের স্বভাবের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

সমাধি' শব্দটি 'সম-আ-ধ' শিকড় থেকে এসেছে, যার অর্থ 'সংগ্রহ করা' বা 'একত্র করা', এবং এইভাবে এটি প্রায়শই 'ঘনিষ্ঠতা' বা 'মনের একীকরণ' হিসাবে অনুবাদ করা হয়। প্রথম দিকের বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে, সমাধি  শব্দটি সমাথা (শান্ত থাকা) এর সঙ্গেও যুক্ত। সমাধি কে একাগ্রতা, এক-বিন্দু মনের হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

সমাধি দুটি সংস্কৃত শব্দ ' সাম ' এবং ' ধি ' দ্বারা গঠিত যার অর্থ যথাক্রমে 'সম' এবং 'বুদ্ধি' বা 'বুদ্ধি'। সুতরাং, যে অবস্থায় একজন ব্যক্তি তার বুদ্ধির সমস্ত স্তরে সমতা আনয়ন করে তাকে সমাধি বলে।

সমাধিকে মনের অবস্থা হিসাবে বোঝা যায় যখন এটি সম্পূর্ণরূপে একটি চিন্তার মধ্যে বা নিজের মধ্যে শোষিত হয় যাতে সেই চিন্তার "পরিমাণ" এবং "গুণ" এর সমতা থাকে। আমাদের মন যখন কোনো চিন্তা, বস্তু বা ধারণার উপর সম্পূর্ণরূপে শোষণ করে, এমনকি অল্প সময়ের জন্যও, তখন তা সমাধিতে বলা যায়।

সমাধি শব্দের আরেকটি অর্থ হল 'সম্পূর্ণতা'। যেমন একটি সমস্যার সমাপ্তি বলা হয় তখনই যখন আমরা তার "সমাধান" পাই, সমাধিকে একটি চিন্তার সম্পূর্ণ সমাপ্তি হিসাবে অনুবাদ করা হয়। 

সমাধি শব্দের আরও একটি অর্থ হল 'একত্র করা।' এইভাবে, যে অবস্থায় বিষয় (ধ্যানকারী), বস্তুর ধ্যান ও জ্ঞান বস্তুর মিলনে মিলিত হয়, সেই অবস্থা হল সমাধি। এখানে, যে ব্যক্তি ধ্যান করছেন তিনি নিজেই ধ্যানের প্রক্রিয়ার সাথে একত্রিত হন।

সমাধি ও ধ্যান

অষ্টাঙ্গিক মার্গের আটটি উপাদানের মধ্যে সমাধি হল শেষ। এটিকে প্রায়শই ধ্যান (পালি: ঝানা) উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করা হয়, কিন্তু সূত্তের সমাধি ও ধ্যান একই নয়। যখন সমাধি এক-বিন্দুযুক্ত ঘনত্ব, ধ্যানে এই সমাধিটি প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবহার করা হয়, সমতা ও মননশীলতার পথ দেখায়। ধ্যানের অভ্যাস ইন্দ্রিয়- গভীর  অনুভূতি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াগুলিকে এড়িয়ে মননশীল উপায়ে ইন্দ্রিয়গুলিতে সমতা রাখা সম্ভব করে তোলে। দ্বিতীয় রূপ-ধ্যানের সময় সমাধি (সমাধি-জি, "সমাধি থেকে জন্ম" যা বিতর্ক-বিকার (আলোচনামূলক চিন্তা) থেকে মুক্ত এবং অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি প্রদান করে।

বুদ্ধঘোষ সমাধি কে সংজ্ঞায়িত করে "চেতনা ও চেতনার কেন্দ্রীকরণ একক বস্তুর উপর সমানভাবে ও সঠিকভাবে সহযোগে যে অবস্থার গুণে চেতনা ও এর সহগামীগুলি সমানভাবে এবং সঠিকভাবে একক বস্তুতে থাকে, বিক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত"। বুদ্ধঘোষের মতে, থেরবাদ পালি গ্রন্থে সমাধির চারটি প্রাপ্তির উল্লেখ রয়েছে: ক্ষণিক একাগ্রতা (খণিকসমাধি): মানসিক স্থিতিশীলতা যা সমথ ধ্যানের সময় উদ্ভূত হয়।

প্রাথমিক একাগ্রতা (পরিকম্ম সমাধি): ধ্যানকারীর ধ্যান বস্তুর উপর ফোকাস করার প্রাথমিক প্রচেষ্টা থেকে উদ্ভূত হয়।

প্রবেশের একাগ্রতা (উপাচার সমাধি): যখন পাঁচটি বাধা দূর হয়, যখন ঝানা উপস্থিত হয়, এবং উপস্থিতির সাথে 'প্রতিভাগ চিহ্ন' (পতিভগনিমিত্ত) দেখা দেয়।

শোষণ ঘনত্ব (আপন সমাধি): বস্তুর ধ্যানের উপর মনের সম্পূর্ণ নিমগ্নতা এবং চারটি ঝাঁসের স্থিরকরণ।

বুদ্ধঘোষের মতে, তার প্রভাবশালী আদর্শ-কর্ম বিসুদ্ধিমগ্গে, সমাধি হল প্রজ্ঞা লাভের "আনুমানিক কারণ"। বিসুদ্ধিমগ্গ ধ্যানের জন্য ৪০টি বিভিন্ন বস্তুর বর্ণনা করে, যেগুলি পালি ধর্মশাস্ত্র জুড়ে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু স্পষ্টভাবে বিসুদ্ধিমগ্গে গণনা করা হয়েছে, যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের মননশীলতা (আনাপানসতি) ও মৈত্রীময় দয়া (মেত্তা)।

বৌদ্ধ পালি গ্রন্থে তিন ধরনের সমাধি বর্ণনা করা হয়েছে যেটিকে ভাষ্যমূলক ঐতিহ্য 'মুক্তির দরজা' (বিমোক্ষমুখ) বা চীনা বৌদ্ধ ঐতিহ্যে 'মুক্তির তিনটি দরজা'  শূন্যতা-ঘনিষ্ঠতা (সূর্যত: শূন্যতা-সমাধি) (পালি: সুঞ্ঞত সমাধি) চিহ্নহীনতা-ঘনিষ্ঠতা (সূর্যত: অনিমিত্ত-সমাধি) (পালি: অনিমিত্ত সমাধি) বা নিদর্শন-ঘনিষ্ঠতা (সূর্যত: অলক্ষণ-সমাধি) লক্ষ্যহীনতা-ঘনিষ্ঠতা (সূর্যত: অপ্রনিহিত-সমাধি) (পালি: অপনিহিতো সমাধি)।

এই তিনটি সবসময় একই ক্রমে উদ্ধৃত হয় না। নাগার্জুন, একজন মধ্যমাক বৌদ্ধ পণ্ডিত, তার মহা-প্রজ্ঞাপারমিতা-শাস্ত্রে, এই "তিন সমাধি" সম্পর্কে তার প্রথম ব্যাখ্যায় অনিমিতার আগে অপ্রণিহিতকে তালিকাভুক্ত করেছেন। কিন্তু পরবর্তী তালিকায় এবং একই কাজের ব্যাখ্যাগুলি আরও সাধারণ ক্রমে ফিরে আসে। অন্যান্য, যেমন থিচ নাত হ্যান, থিয়েন বৌদ্ধ ভিক্ষু, শূন্যতা ও  অনিমিতার পর তৃতীয় হিসেবে অপ্রাণহিতাকে তালিকাভুক্ত করেন। নাগার্জুন এই তিন ধরনের সমাধিকে প্রকৃত জ্ঞানপ্রাপ্তদের (বোধিসত্ত্ব) গুণাবলীর মধ্যে তালিকাভুক্ত করেছেন।

নাগার্জুনের মতে, 'শূন্যতা'-এর উপর একাগ্রতা হল সমাধি যেখানে কেউ স্বীকার করে যে সমস্ত ধর্মের প্রকৃত প্রকৃতি একেবারেই শূন্য (অত্যন্তশূন্য), এবং যে পাঁচটি সমষ্টি স্ব (অনাত্ম্য) নয়, স্ব (অনাত্ম্য) এর অন্তর্গত নয় এবং স্ব-প্রকৃতি ব্যতীত শূন্য।

সংকেতহীনতার উপর মনোযোগ নাগার্জুনের মতে, 'সঙ্কেতহীনতা'-এর উপর একাগ্রতা হল সমাধি যেখানে কেউ স্বীকার করে যে সমস্ত ধর্ম লক্ষণমুক্ত (অনিমিত্ত)। থিচ নাত হ্যান-এর মতে, "লক্ষণগুলি" চেহারা বা ফর্মকে বোঝায়, চিহ্নহীনতার উপর একাগ্রতাকে চেহারা দ্বারা বোকা না বানানোর সঙ্গে তুলনা করে, যেমন সত্তা এবং অ-সত্তার দ্বিধাবিভক্তি।

মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন যে মনের কাজ - চিত্তবৃত্তি - মুক্তির যৌগিক পথে বাধা। যদি ব্যক্তি চূড়ান্ত সত্য অর্জন করতে চায় তবে এই ৫টি বৃত্তিগুলি দূর করতে হবে।

ভারতীয় শাস্ত্রে বিভিন্ন পদ দ্বারা সমাধির অবস্থা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পতঞ্জলি যাকে সমাধি বা কৈবল্য বলেছেন তাকে বুদ্ধ কর্তৃক নির্বাণ বলা হয়েছে। এই সমস্ত শর্তগুলি মূলত চিন্তাহীনতা, আকাঙ্ক্ষাহীনতা এবং অ-আসক্তির একই অবস্থা প্রকাশ করে।

সমাধির পর্যায় অর্জন করা খুবই কঠিন। মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন দুটি অনুশীলন ধ্যানকারীকে যোগিক পথে উন্নীত করতে পারে- অধ্যয়ন (আত্ম-অধ্যয়ন) এবং বৈরাগ্য (অ-আসক্তি)। এই দুটির ধারাবাহিক অনুশীলনের ফলে উচ্চ স্তরের উপলব্ধি হতে পারে এবং যোগী সমাধি অবস্থায় পৌঁছাতে পারে।

যখন আমরা দৈহিক আনন্দ, আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি পাই এবং নিজেদেরকে বোঝার দিকে এগিয়ে যাই, তখন আমরা বৃহত্তর পরিচয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কাছাকাছি চলে যাই। কখনও কখনও, বৈষয়িক বস্তু, অনুভূতি, আমাদের চিত্তবৃত্তি আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সমাধি অর্জনের জন্য আমাদের অগ্রগতির অবনতি ঘটাতে পারে। 

দীর্ঘনিকায়ের “সুভ সুত্তন্তু”—এতে এটি “সমাধি-খন্ধ” (একাগ্রতায় বিভাগ বা অংশবিশেষ) সংজ্ঞা বা নাম দেওয়া হয়েছে, অন্য প্রকারে এর নাম “চিত্ত সম্পদা” যাহা “ সমণ” জীবন হতে পুণ্যফল রূপে উৎপন্ন হওয়ার ( “সামঞ্ঞফল সুত্তন্তু”) ঊর্ধ্বগতি (আরোহণ) ক্রমে “সীল সম্পদা” এবং “পুঞ্ঞ সম্পদা”—এতদুভয়ের মধ্যে দাঁড়ায়। “অম্বট্ঠ সুত্ত”—এতে অনুরূপ পদসমূহ হলো “সীল, চরণ, ৰিজ্জা” (দীর্ঘ নিকায়)। এরূপে “সমাধি” নিম্নোক্ত বিষয়সমূহে অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যথা— ইন্দ্রিয় সমূহের রক্ষণ অর্থাৎ “ইন্দ্রিযেসু গুত্তাদ্বার”,  আত্ম—অধিকার বা স্থৈর্য বা প্রশান্তি অর্থাৎ “সতিসম্পজঞ্ঞ”, সন্তুষ্টি অর্থাৎ “সন্তুট্ঠি”,  পঞ্চবাধা (নীৰরনানি) হতে মুক্তি, চতুর্বিধ ধ্যান অর্থাৎ “ঝান”। এবম্বিধ উপায়ে আমরা দেখতে পাই যে “সমাধি” সুবিন্যস্ত “সম্পদা” সমূহের মধ্যে একটি, যেমন অঙ্গুত্তর নিকায়ে বলা হয়েছে—“সীলসম্পদ, সমাধিসম্পদ, পঞ্ঞাসম্পদ, ৰিমুত্তিসম্পদ” দীর্ঘ নিকায়ে সুবিন্যস্ত “খন্ধ” সমূহের মধ্যে যেমন বলা হয়েছে- “সীলক্খন্ধ, সমাধিক্খন্ধ, পঞ্ঞাক্খন্ধ, ৰিমুত্তিক্খন্ধ; চুল্লনিদ্দেসে যেমন বলা হয়েছে “সমাধি, ৰিমুত্তি, সীল”। মধ্যম নিকায়ে “সমাধি”—এর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে—“চিত্তস্স একগ্গতা”; ধর্মসঙ্গণীতে “চিত্তস্স অৰিক্খেপ” এবং “সমথ”—এর সঙ্গে অনন্যতা প্রতিপাদন করা হয়েছে। দীর্ঘ নিকায়ে বলা হয়েছে—“সম্মাসমাধি অষ্টবিধ আর্যমার্গের (অরিয-মগ্গ) মধ্যে একটি। “অরিয” (দীর্ঘ নিকায়), “সমথ-ৰিপস্সনা, সমাধি ৰিপ্ফারা ইদ্ধি (বিশুদ্ধিমার্গ) এর বর্ণনাও দ্রষ্টব্য। “সমাধি”—এর বর্ণনা এবং বিশেষ গুণ দ্বারা বর্ণনা:—এর চতুর্বিধ “নিমিত্ত” (নিদর্শন বা প্রমাণ) হলো চতুর্বিধ “সতিপট্ঠান” (মধ্যম নিকায়), ষড়বিধ অবস্থা এবং ষড়বিধ বাধা (অঙ্গুত্তর নিকায়), অন্যান্য বাধাসমূহ (মধ্যম নিকায়)। “সমাধি” হতে দ্বিতীয় ধ্যান (ঝান) উৎপন্ন হয় (দীর্ঘ নিকায়)। “কুসলা ধম্মা” লাভের মধ্যে “সমাধি” একটি অবস্থা-বিশেষ (অঙ্গুত্তর নিকায়); “সমাধি” অন্তর্দৃষ্টি বা পরিজ্ঞানের সহায়ক (অঙ্গুত্তর নিকায়), স্বর্গীয় দৃশ্যসমূহ দর্শনের সহায়ক ইত্যাদি (দীর্ঘ নিকায়), পাহাড় পর্বতাদি অপসারণের সহায়ক (অঙ্গুত্তর নিকায়); “সমাধি” নিজের ভ্রান্তিসমূহ বিদূরিত করে (অঙ্গুত্তর নিকায়), অর্হত্ত্বে নীত করে (অঙ্গুত্তর নিকায়); আনন্তরিক সমাধি (সূত্রনিপাত); (দীর্ঘ নিকায়) চেতোসমাধি (মনের উল্লাস বা মহানন্দ); (নেত্তি) চিত্তসমাধি; (সংযুক্ত নিকায়) ধম্মসমাধি। (দীর্ঘনিকায় অর্থকথা) “সমাধি” দ্বিবিধ ক্রম বা পদবিশিষ্ট, যথা—উপাচার সমাধি (প্রাথমিক সমাহরণ বা একাগ্রতা), অপ্পনা সমাধি (সমাহরণ বা একাগ্রতা লাভ); এখানে পরবর্তীটি “ঝান”-এর ফল-বিশেষ (বিশুদ্ধিমার্গ) এই দুইটির তৃতীয় ক্রম বা পদযুক্ত হয়েছে “খণিখ সমাধি (ক্ষণিক সমাধি বা একাগ্রতা)। (অঙ্গুত্তর নিকায়) “সমাধি”-এর তিন প্রকার বিশিষ্ট, যথা—সুঞ্ঞত (শূন্যময়), অপ্পনিহিত (লক্ষ্যহীন বা উদ্দেশ্যহীন), অনিমিত্ত (নিমিত্তহীন বা নিদর্শনহীন)। (দীর্ঘ নিকায়) “সমাধি (তযো সমাধি)” “সৰিতক্ক সৰিচার, “অৰিতক্ক ৰিচারমন্ত” অথবা “অৰিত অবিচার হয়ে থাকে। (দীর্ঘ নিকায়) “সমাধি চার প্রকার, যথা—ছন্দসমাধি, ৰিরিয সমাধি, চিত্ত সমাধি, ৰীমংসা সমাধি; অন্য প্রকারেও চতুর্বিধ, যথা—হানভাগি সমাধি, ঠিতিভাগিয সমাধি, ৰিসেসভাগিয সমাধি, নিব্বেধভাগিয সমাধি; অন্যত্র দুই হয় “ধম্মা দুপ্পটিৰিজ্ঝা” স্বরূপ।

 চিত্ত ও সমাধি গ্রন্থটি স্বল্প পরিসরে আমি প্রণয়ন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। হয়তো পাঠকদের কোথাও কোথাও অসংলগ্ন লাগতে পারে। একটু সমাধি সম্পন্ন হয়ে দৃষ্টি সহকারে পাঠ করেন তাহলে মনোশংকা বিদূরিত হবে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এই ক্ষুদ্র পুস্তিকাটি প্রকাশ করার জন্য আমি পালি প্রকাশনকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। অলং ইতি বিত্থারেন।


সুমনপাল ভিক্ষু 

চেয়ারম্যান, বোধ-নিধি সোস্যাল ওয়েলফেয়ার কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন। 

 

 

No comments:

Post a Comment