Sunday, August 10, 2025

স্যার কে যেমন দেখা আমার

 স্যার কে যেমন দেখা আমার 

সুমনপাল ভিক্ষু

প্রফেসর ড. রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭। এম.এ (ট্রিপল), এম. ফিল, পিএইচ.ডি., সূত্রপিটক তীর্থ ভারতের অন্যতম বিদগ্ধ দার্শনিক-সমালোচক। একজন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত লেখক এবং চিন্তাবিদ, তার জীবনযাপনের পদ্ধতি প্রমাণ করেছে যে প্রকৃত জ্ঞান একজন ব্যক্তিকে নম্রতা দেয়। তিনি একজন অসামান্য শিক্ষক ছিলেন যিনি যেকোনো বিষয়ে যে কোনো জায়গায় পড়াতে পারতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ব্যক্তি। অনেকের কাছে তিনি সত্যিই ‘স্যার বা ‘মাস্টারমশাই’ ছিলেন। তিনি বিবি কলেজ আসানসোলের ইংরেজির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন। তাঁর প্রপিতামহ (মাতৃত্বকালীন) ছিলেন বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ সংস্কৃত পণ্ডিত হর প্রসাদ শাস্ত্রী এবং তিনি ডক্টর বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের নাতি ছিলেন একজন বৌদ্ধ মূর্তিতত্ত্বের উপর। তিনি তাঁর দাদু কে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন। দাদুর বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা ও চর্যা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেটি নিজ মুখে উচ্চারণ করেছিলেন। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি বৌদ্ধ সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। 
   
ড. রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় অবিকল মহান অন্তর্দৃষ্টি, বুদ্ধিমত্তা, প্রতিভা এবং মানবিক মূল্যবোধ সহ বহুমুখী প্রতিভা ছিলেন।  তিনি একজন বহুভাষী কবি (ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত এবং পালি ভাষায় দক্ষ), প্রশংসিত সম্পাদক, পণ্ডিত বুদ্ধিজীবী, উল্লেখযোগ্য গল্প লেখক, অনেক অজানা এবং অজ্ঞাত ব্যক্তিত্বের জীবনীকার, সমৃদ্ধ কণ্ঠের বিখ্যাত বক্তা এবং অনন্য চিন্তাবিদ ছিলেন।  তিনি আধুনিক নাটকের উপর তাঁর গ্রন্থের জন্য আশুতোষ মুখার্জি স্বর্ণপদক প্রাপক ছিলেন।  তিনি সাহিত্য, সাহিত্যের সমালোচনামূলক অনুমান, দর্শন, পুরাণ, ইতিহাস, ধর্ম, বৌদ্ধ অধ্যয়ন, সমাজতাত্ত্বিক দিক, শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, নগর অধ্যয়ন, রাজনীতি, নারীবাদ, নাটক ও সিনেমার মতো বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় একশত বই লিখেছেন এবং প্রকাশ করেছেন।  শত শত সমালোচনামূলক নিবন্ধ এবং কবিতা।  তিনি ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অঙ্গনে উত্তর-আধুনিকতার অগ্রগামী লেখকদের একজন। তাঁর এম.ফিল.  প্রবন্ধটি মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে রামায়ণ অধ্যয়নের উপর, যখন তার ডক্টরেট থিসিসটি নন্দনতত্ত্বের আলোকে জাতক কাহিনীর উপর। এই কথাটি উপরে উল্লেখ করেছি, স্যার কে যখনই বৌদ্ধ বিষয়ক লিখতে অনুরোধ করতাম স্যার দ্বিতীয়বার চিন্তা করতেন না। বাংলাদেশে স্যারের দুখানা প্রবন্ধ ছাপানো হয়েছিল। স্যারের খুব ইচ্ছে ছিল একবার ঘুরে আসবে তা হয়ে ওঠেনি। 

আচার্য স্যার রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে আমি প্রথম দেখি ২০০৩ সালে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামী ফনীভূষণ দাশ প্রয়াত হন তখন। ফনীভূষণ দাশ'র স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, তাঁরই সহোদরা ডক্টর আশা দাশ'র আহ্বানে সেখানে উপস্থিত হয়েই স্যারের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। স্যারের সম্পর্কে অনেক শুনেছি ডক্টর আশা দি কাছে, তিনি আমার মাতৃসমা। তিনি জানতেন কি করে সন্তানকে বড় করতে হয়। সন্তান বা ছাত্রকে এগিয়ে দেওয়ার সেই কাজ তিনি অনলস ভাবে সম্পাদন করেছেন। তাঁরই কাছ থেকে স্যার রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পেয়েছেন। বলতে গেলে তাঁর কাছেও সেই ছাত্র তৈরির আর উত্তর প্রজন্ম তৈরি করতে হয় সেই নিপুণতা আর অদম্য প্রেরণা লাভে বঞ্চিত হইনি কেউই। 

হোমিওপ্যাথির ডিগ্রী (ডিএমএস)ও তার কৃতিত্ব ছিল। তিনি আমাকে হোমিওপ্যাথি প্রেসক্রাইভ করতেন সেভাবেই  সেবন করে আমি আরোগ্য লাভ করতাম। তাঁর কোনও বিষয়ে কোনও কমতি ছিল না। 
আইন বিষয়েও তার গভীর জ্ঞান ছিল। তাছাড়া তিনি একজন জ্যোতিষীও ছিলেন। জ্যোতিষী শাস্ত্র বিষয়েও অনেককে আমি স্যারের কাছে নিয়ে যেতাম। তাতে তাদের অনেক ফলপ্রসূ হয়েছিল। আমার মাসি মনির আয়ুষ্কাল নিয়ে যেতেন তথ্য তিনি সেটার অন্যতা হয়নি। এতো নিখুঁত ভাবে তিনি বলতেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

রমেশ স্যার ছিলেন বাংলার আন্ডারগ্রাউন্ড লিটারেচার মুভমেন্টের অগ্রগামী নেতা এবং একজন নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক। স্যার আন্ডারগ্রাউন্ড সম্পর্কে আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। কিভাবে অন্ত্যজ শ্রেণী থেকে সাহিত্য তথা লেখকদের তৈরি করতে হয় সেটা তৈরি করে দিয়েছেন। ভূগর্ভস্থ সাহিত্য (সাহিত্য) একটি শক্তিশালী দর্শন যা 'ভাষা আগে আসে এবং ধারণা পরবর্তী' নীতির উপর ভিত্তি করে।  এই আন্দোলন বাংলায় একটি নতুন সাহিত্য সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল এবং প্রত্যেকের জন্য, বিশেষ করে বাংলার গ্রাম ও ছোট শহর উভয়ের অজানা কবিদের জন্য একটি সৃজনশীল স্থান তৈরি করেছিল। তিনি দ্বিভাষিক জার্নাল প্ল্যাটফর্মের সম্পাদক ছিলেন। আমার মতো একজন নগন্য মানুষকে তিনি প্ল্যাটফর্মের সহকারী সম্পাদক হওয়ার সুযোগ তিনি দিয়েছেন। তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আবদ্ধ রাখবো চিরকাল।

এছাড়াও তিনি সাহিত্য সম্পর্কিত কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে একটি Google গ্রুপ সেফিরাহ-এর নেতৃস্থানীয় আত্মা ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেফিরাহ গ্রুপে আমাকে লেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।  তিনি বলতেন তুমি লেখ ভুল হলে শিখতে পারবে আর আমি আছি। এই আমি আছি বলার লোভ আমি সব হাঁড়িয়ে ফেলছি। তাঁর কথামতো দু একটা লিখেছিলাম। তাতে দেখছি অনেক পণ্ডিত আর বিদ্ধান ব্যক্তিবর্গের লেখা সেখানে আমাকে মানায় না। তাই সরিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে।

তারপর কেটে যায় অনেকটা বছর প্রায় চার চারটা বছর। নিজে বেড়ে ওটার অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি তাঁর থেকে দূরে থেকে। আবার ২০০৭ সালে তাঁকে খুব কাছ থেকে পাই। তাতেও সাঁকোর ভূমিকায় ছিলেন সেই আমার মাতৃসমা আশা দি। তখন ২০০৭ আমি পি এইচ ডি গবেষণার এনরোল্টমেন্ট করি, কাজ কিছুটা করে নিয়ে দিদির কাছে যাই সংশোধন করাতে। দিদি দেখে দেন অনেকটা, তারপর দিদি হটাৎ অসুস্থ হলেন। আবার কিছুটা করি দিদি তখন আমার সামনে স্যারকে ফোনালাপে বললেন আমি একজন ভিক্ষুকে পাঠাবো। স্যার তখনই বিনা বাক্য ব্যয়ে সম্মতি দিয়ে দিলেন। 

তাঁর বাসস্থান ছিল পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার বেলুড় মঠের কাছে বেলুড়ে। তিনি প্রেমের সাথে একজন হাঁটা বিশ্বকোষ এবং বিদ্যার দেবীর আশীর্বাদপুত্র হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন অসীম শক্তির ফোয়ারা এবং যে কাউকে করুণাময় হাতের প্রয়োজনে একজন পথপ্রদর্শক আত্মা। ভৌত জগৎ থেকে তাঁর চলে যাওয়া আমাদের সাহিত্য পরিবার ও সাহিত্যের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন তাঁরা তাঁকে একজন আলোকিত আত্মা হিসেবে দেখতে পান। তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক কিছু বলার আছে, তা সল্প পরিসরে এখানে বলে শেষ করা যাবে না। তাই তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে শেষ করছি। তাঁর আনাপান বায়ু স্তিমিত হয় ৪ আগস্ট ২০২৪, তাঁর নৈর্বাণিক সুখ উপলব্ধি হোক কামনা করি।

No comments:

Post a Comment