Saturday, October 28, 2023

মহাসিন্ধুর প্রহরী ড. বি. আর. আম্বেদকর


সুমনপাল ভিক্ষু

আম্বেদকর এর জম্ম তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের (মধ্যভারত) একটি মফস্বল শহর ‘মউ' এর একটি অস্পৃশ্য পরিবারে ১৪ এপ্রিল ১৮৯১ হয়েছিল। তাঁর পরিবার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্তর্ভূক্ত ছিল । তাঁরা মহার বা মাহার নামক একটি অস্পৃশ্য জাতির সদস্য ছিল। আম্বেদকরের জন্মের কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পরেই তাঁর পরিবার রত্নাগিরি জেলার ডমোলী নামক স্থানে স্থানান্তরিত হন এবং ১৮৯৪ সালে 'সতারা' নামক অঞ্চলে বসাবাস শুরু করেন। এই সময় রামজী সংকপাল নির্মান বিভাগের স্টোর কীপার পদে আসীন হন। ১৯০০ সালে আম্বেদকর সরকারি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে ভীমরাও রামজী আম্বেদকর নামে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন। তাঁর এই ‘আম্বেদকর' নামকরণের পিছনে একটি বিশেষ কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। কথিত আছে যে সরকারি বিদ্যালয়ে এক ব্রাহ্মণ শিক্ষক বালক আম্বেদকরের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন, তিনি তার পদবী (আম্বেদকর) তাঁকে প্রদান করেছিলেন। ১৯২৭ যখন আম্বেদকর'এর সঙ্গে যখন সেই শিক্ষক এর সাক্ষাত হয়েছিল, তখন তিনি সেই শিক্ষক কে ‘গুরুদেব' রূপে সম্মানিত করেছিলেন। এইভাবে আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসে এই লোকপ্রিয় নাম এমন একজন শিক্ষকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, যিনি একজন মহান তথা সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন।

১৯০৫ খ্রী. আম্বেদকর উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। সেই সময় একজন অস্পৃশ্যর ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত গর্বের ছিল। ১৯১৩ তিনি ‘এলসিংস্টন কলেজ' হতে ইংরাজী তথা ফার্সী ভাষাতে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এই বৎসরের জানুয়ারীতে তিনি বরোদার মহারাজ্যের রাজ্য কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে চলে যান। কিন্তু এ সময় গুজরাতে জাতিগত বৈষম্যের কারণে সেখানে তিনি কোনরূপ স্থায়ী কর্মের সন্ধান না পেয়ে পুনঃ বোম্বাই ফিরে আসেন। এই সময় আম্বেদকরের পিতার মৃত্যু হয়েছিল। ১৯১৩ তিনি বরোদার মহারাজার আর্থিক সহায়তা তথা অনুপ্রেরণা ফলে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (আমেরিকা) এই উচ্চ শিক্ষা অর্জনে উদ্দেশ্য গমন করেন। ১৯১৫ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বনামধন্য অধ্যাপক এডওয়ার্ড সেলিগমেন 'এর তত্ত্বাবধানে আম্বেদকর অর্থ শাস্ত্রে এম. এ. করেন। তিনি পিএইচডি'র ক্ষেত্রে গবেষণাপত্র ১৯১৬ সালে প্রস্তুত করেছিলেন। ১৯১৬ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষা সম্পূর্ণ করে তিনি 'লন্ডন স্কুল অফ্ ইকোনমিকস্ অ্যাণ্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স' এ এম. এস. সি (ইকোনমিকস্ তথা 'ডক্টরেট ইন ইকোনমিকস্ ' এর অধ্যয়নার্থে ভর্তি হন।

১৯১৬ 'দ্যা জার্নাল অফ্ ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকিত্তচী' হতে তাঁর বৃহৎ গবেষণা মূলক নিবন্ধ (‘কাষ্ট ইন ইন্ডিয়া দেয়ার মেকানিজম, জিমেস্সি অ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট ') প্রকাশিত হয়। ১৯২৭  এই নিবন্ধ টি মুনঃ ‘দ্য ইভল্যুশন্ অফ্ প্রভিন্সিয়াল ফাইন্যান্স ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া' শীর্ষক নামে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২৭ আম্বেদকর ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং গুজরাতের বরোদা রাজ্যর উর্ধ্বতন কর্মচারী রূপে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেন কিন্তু কর্মক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ তথা অন্য উপবর্ণের কর্মচারীদের জাতিগত বর্ণ - বৈষম্যতার কারণে তিনি বরোদা শাসকের ‘সৈনিক সেক্রেটারি' পদ হতে ইস্তফা দেন এবং ১৭ নভেম্বর, ১৯২৭ রাজ্য  ত্যাগ করেন। আম্বেদকর উক্ত পদে মাত্র ৯ মাস অবধি কর্মরত ছিলেন।

১৯১৮ - ১৯২০ সালে ১১ মার্চ পর্যন্ত তিনি একটি কলেজে অধ্যাপনার কার্যে নিযুক্ত ছিলেন। ঐ বৎসরেই আম্বেদকর তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি সম্পূর্ণ করার অভিপ্রায় গ্রহণ ক'রে পুনঃ লন্ডন চলে যান। ১৯৩০ তাঁর পত্নী দেহত্যাগ করেন। ১৯২৩ তিনি 'দ্য প্রবলেম অফ্ দ্য রুপী' শীর্ষক গবেষণা পত্র প্রস্তুত করেন এবং ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯২৩ এপ্রিল মাসে তিনি বোম্বাই ফিরে আসেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর পুনঃ আর্থিক অসঙ্গতির কারণে আম্বেদকর বোম্বাই হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। কিন্তু জাতিগত বৈষম্যের কারণে উচ্চ বর্ণের হিন্দু এবং পার্সী'রা তাঁর থেকে শত হাত দূরে থাকতে অতএব তিনি বাণিজ্যিক আইনের শিক্ষকতা তথা বোমবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা খাতা পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করেন। তাঁর একটি বদঅভ্যাস ছিল পুস্তক ক্রয় এবং এই কারণে গৃহে অভাব ছিল নিত্যনৈমিত্য বিষয়।

সেই সময় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের দ্বিমেরুকরণ সম্পূর্ণ হয়েছিল। প্রথমটি ছিল সশস্ত্র আন্দোলন এবং দ্বিতীয়টি ছিল মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত ( সামন্তবাদী অর্থনীতি মাদতপুষ্ট) অহিংস - সত্যাগ্রহ আন্দোলন। এই উভয় আন্দোলনের মধ্যে অস্পৃশ্য তথা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ভারতীয় জনগণের মুক্তি সংগ্রামের বীজ নিহিত ছিল। আম্বেদকরের সাম্রাজ্যবাদ - সামন্তবাদ বিরোধী চিন্তা ভারতে এক নতুন আন্দোলন পটভূমি তৈরি করল।

উনবিংশ শতাব্দীর অন্তিম লগ্নে সমগ্র ভারতবর্ষে দলিত আন্দোলন প্রবলভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল সামাজিক ন্যায় বিচার, সাম্য এবং স্বাধীনতার অর্জন। এই দলিত মুক্তিসংগ্রামে যুক্ত হয়েছিল অ্যানি বেসান্ত প্রতিষ্ঠিত 'হোমরুল লীগ' এবং বেশ কিছু র‍্যাডিক্যাল খ্রীষ্টান সংগঠন। তবে ১৮৭৫ খ্রীঃ মহারাষ্ট্রে ‘ফুলে’ দ্বারা স্থাপিত ‘সত্যশোধক সমাজ' উনিশ শতকের পুনঃ সংগঠিত হলে দলিত আন্দোলন বোম্বাই, পুনা ও নাগপুরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায়।

১৯১০ পর মহারাষ্ট্রে ‘সত্যশোধক সমাজ' শহর এবং গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কোলাপুরের মহারাজা এই ‘সমাজ' এর পূর্ণ সমর্থক ছিলেন। ১৯১০ - ১৯২০ বোম্বাই এবং মাদ্রাজ শ্রেণিভেদী অঞ্চলে তা- ব্রাহ্মণ আন্দোলন 'এর প্রভাব জাস্টিস পার্টি তথা মহারাষ্ট্রে তা- ব্রাহ্মণ রাজনৈতিক দল ভারতীয় রাজনীতির আঙ্গিনায় এসে দাঁড়ায়।

১৯২২-১৯২৩ রামজী শিণ্ডের সঙ্গে আম্বেদকরের রাজনৈতিক মতাদর্শগত মত পার্থক্যের কারণে ৯ মার্চ ১৯২৪ — বহিস্কৃত হিতকারিণী সভা' গঠিত হয়। এই সংগঠনের অন্যতম সদস্য ছিলেন চিমনলাল, কে. এল. নরীমন প্রমুখ বিজ্ঞজন। ১৯২৭ আম্বেদকরের উদ্যোগে 'বহিস্কৃত ভারত' নামক একটি দ্বি-মাসিক পত্রিকা শুরু হয়। এই পত্রিকাটি অনতিবিলম্বে দলিত আন্দোলনে মুখপাত্র হয়ে ওঠে। ‘ধর্ম - পরিবর্তন ' প্রসঙ্গে আম্বেদকরের মন্তব্য ছিল, “আমাদের এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে হিন্দু ধর্ম আমাদের অথবা নয়”। (বহিষ্কৃত ভারত, ২৯ জুলাই ১৯২৭) সর্বোপরি আম্বেদকরের অভিমত ছিল যে ‘তাঁর আন্দোলন ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রাহ্মণ্যবাদী- ধর্মের বিরুদ্ধে। অপরদিকে তাঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপক্ষে নয়, ব্রাহ্মণদের বিপক্ষে। আম্বেদকরের এই বক্তব্য গান্ধীবাদ প্রতি ইঙ্গিত করে। কারণ গান্ধীবাদ প্রকৃত অর্থে সামন্তবাদী মতাদর্শের প্রতিনিধি ছিল। আম্বেদকরের সবথেকে উল্লেখ্যনীয় কর্মসূচি হলো ‘মনুস্মৃতি” (মনু- সংহিতা') দহন। এই গ্রন্থে ব্রাহ্মণ্যবাদী ঘৃণ্য মতাদর্শ নিহিত আছে। ১৯২৬ আম্বেদকর এবং গুজরাতী অস্পৃশ্য নেতা ড. পীজী সোলাভকী বোম্বাই বিধান পরিসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৭ সেপ্টেম্বর'এ আম্বেদকর 'সমতা সমাজ সংঘ' গঠন করেন। এই সংগঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল 'অসবর্ণ বিবাহ ব্যবস্থা এবং সকল সম্প্রদায়' একত্রিত ভাবে ভোজন করা ইত্যাদি। কিন্তু আম্বেদকরের এই প্রচেষ্টা সফল হয় নি।

১৯২০ কংগ্রেস সাইমন কমিশন বয়কট করে। তবে আম্বেদকর এবং অন্যান্য দলিত নেতৃবৃন্দ উক্ত কমিশনে তাঁদের অভিমত পেশ করেন। তাঁর দাবী ছিল মুসলমান, অস্পৃশ্য, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান তথা তা- ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের জনগণকে বিশেষ সংরক্ষণ প্রদান করা। এই সময় তাঁর দ্বারা প্রস্তুত জ্ঞাপন'কে 'ম্যানিফেস্টো অফ্ দলিত হিউম্যান রাইটস্' বলা হয়েছিল।

আম্বেদকরের কংগ্রেসের প্রতি নেতিবাচক ভূমিকার মুখ্য কেন্দ্র বিন্দু ছিল মহাত্মা গান্ধী। ১৯৩০ প্রথম গোল টেবিল বৈঠক সম্পন্ন হয়। এই সম্মেলনে গান্ধীজী অস্পৃশ্যদের পৃথক ভোটাধিকার এর তীব্র বিরোধিতা করেন। এবং 'রেমস্ ম্যাকডোনাল্ড আওয়ার্ড' এর প্রতি বিরোধ প্রদর্শনার্থে অনশন ও করেছিলেন। এই সময় কংগ্রেসের একটি শাখা সংগঠন রাখে 'হরিজন সেবক সংঘ' গঠিত হয়। আম্বেদকরের মতে এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসের সামন্তবাদী চিন্তাকে পুষ্ট করা এবং দলিত আন্দোলনের গতি পথ কে রুদ্ধ করা।

দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের পরে গান্ধী এবং আম্বেদকরের মধ্যে তীব্র মতাদর্শগত মহাবির্তক উপস্থিত হয়। কারণ ১৯৩০ এই সময় কালে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় -আন্তর্জাতিক আন্দোলনের গৌরবের প্রতীক রূপে খ্যাত হয়েছিলেন। অপরদিকে উভয় ছিলেন ভারত অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলন বাস্তবিক প্রতিনিধি। আম্বেদকর সম্পর্কে গান্ধীজীর অভিমত ছিল এইরূপে :

“অস্পৃশ্যদের প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কিত অন্য দাবী আমার ক্ষেত্রে চরমতম আঘাত ব্যতীত আর কিছুই নয়। এই দাবী অত্যন্ত অবৈধ..... আমি অস্পৃশ্যদের বৃহৎ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বে দাবী করছি।... ড. আম্বেদকরের ভারতে সমস্ত অস্পৃশ্যদের প্রতিনিধিত্বের দাবী যুক্তি সংগত নয়। এর ফলে হিন্দুরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়বে। যা আমি চাই না......... যিনি অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলেন সে হিন্দুস্থান কে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি, সে ভারতীয় সমাজ নির্মাণ হতে সম্পূর্ণভাবে অনভিজ্ঞতা (আম্বেদকর, ১৯৮২, ২: ৬৬৩-৬৪) অপরদিকে আম্বেদকর গান্ধীজীকে কখনই ‘সমাজ সংস্কারক' রুপে স্বীকৃতি প্রদান করেননি, উপরন্তু তাঁকে জাতিবাদের পৃষ্টপোষক হিন্দুধর্মের সমর্থক বলে মনে করেছেন। ১৯৩৯ ‘ফাউন্ডেশন অফ্‌ ফ্রিডম্' বিষয়ক ব্যাখ্যান'এ তিনি বলেছেন, “আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যে গান্ধীর যুগ হল ভারতের ক্ষেত্রে অন্ধকার যুগ। এই যুগে ভবিষ্যৎ' এর আদর্শ লাভের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনগনকে পুরাতন যুগে মান্যতার প্রতি ঠেলে দেওয়া হচ্ছে” (আম্বেদকর, ১৯৭৯, ১:৫৫২)

১৯৪৭ সালে ভারত দ্বি-খন্ডিত হ'য়ে (দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে) ভারত এবং পাকিস্তান নামক দু'টি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। এই বিষয়টি আম্বেদকর কে অত্যন্ত ব্যথিত করে তুলেছিল। তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী রুপে তার কার্যবার শুরু করেন। আম্বেদকর 'হিন্দু উত্তরাধিকারী' আইনের সংশোধন এবং হিন্দু নারীদের সমান অধিকার এর প্রশ্নে ১৯৪৮ ‘হিন্দুকোড বিল’ উত্থাপন করলে ‘হিন্দু মহাসভা’, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী তথা “জনসংঘ' এর ঘোর বিরোধিতা শুরু করেন। এই বিষয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহেরু তা সহযোগীতা করলে তিনি ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫১  তাঁর ত্যাগপত্র পেশ করেন। ১০ অক্টোবর ১৯৫১ সংসদে তাঁর অন্তিম ভাষণে বলেন যে স্বাধীন সরকার অনগ্রসর জাতি- উপজাতিকে সতত উপেক্ষা করে চলেছেন। ১৯৫৬ আম্বেদকর 'মার্কসবাদ বনাম বৌদ্ধদর্শন' বিষয়ে কাটমন্ডু (মেসাল)'তে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব বৌদ্ধ সম্মেলন' একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষন দেন। (আম্বেদকর, ১৯৮৭, ৩: ৪৪১-৬২)।

আম্বেদকরের অধ্যয়নের পূর্ণকেন্দ্র বিন্দু ছিল বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন। তিনি শব্দকোষ’এর সহায়তায় পালি শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৫০-এ  তিনি ‘জার্নাল অফ্ দ্য মহাবোধি সোসাইটি' তে ‘দ্য বুদ্ধ অ্যান্ড দ্য ফিউচার অফ্ হিজ রিলিজিয়ন' শীর্ষক নিবন্ধ প্রকাশ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯৫১-এ ‘ভারতীয় বৌদ্ধ জনসংঘ' স্থাপিত হয় এবং উক্ত সংগঠন ১৯৫৫ সালে ‘ভারতীয় বৌদ্ধ মহাসভা পরিচিতি লাভ করে। বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে তাঁর অভিমত ছিল, “যদি নামে সর্বত্র নতুন পৃথিবী পুরাতন পৃথিবী হতে ভিন্ন হয় তাহলে নতুন পৃথিবী পুরাতন পৃথিবী হতে অধিক ধর্মের প্রয়োজন রয়েছে আর সেই ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মই হতে পারে।” (সংঘরক্ষিত, ১৯৮৬, ৭১) ১৯৫৪ বার্মা'তে বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক একটি সম্মেলনে আম্বেদকর ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত অভিযানের নিমিত্তে অনুরোধ জানান। কিন্তু বার্মা (মায়ানমার) হতে কোন রুপে ইতিবাচক সহায়তা না আসার কারণে তিনি স্বয়ং এই কার্য সম্পাদনের নির্ণয় গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ ১৪ অক্টোবর আম্বেদকর এবং তাঁর ২ লক্ষ অনুগামী নাগপুরে'র দীক্ষা ভূমিতে ২২ প্রতিজ্ঞা সহ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উপস্থিতিতে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।

১৯৫৬ ৬ ডিসেম্বর আম্বেদকর দেহত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যু ভারতের ইতিহাসে এক দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়। এখনও এদেশে দলিত শ্রেণীর প্রকৃত অধিকার অর্জনের লড়াই চলছে। আজও তাঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারে জর্জরিত। আম্বেদকর প্রতিষ্ঠিত-রাজনৈতিক দল স্বার্থান্বেষী তথা সুবিধা ভোগীদের হাতে পরে বহুধা বিভক্ত এবং তাদের কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র মহারাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। ফলে তাঁর স্বপ্ন প্রকৃত অর্থে আজও বাস্তবায়িত হয় নি। আম্বেদকরের ভাষায় বলতে হয় যে ‘গোবিষ্ঠার স্তূপে অট্টালিকা নির্মাণ'। এই কথাটির বুৎপত্তি গত অর্থ হল বর্ণাশ্রম ধর্ম হতে উদ্ভুত সংস্কৃতি এবং তাঁর অর্থ - সামাজিক পরিকাঠামো। এর বিপরীত তাঁর সংঘর্ষ স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র তথা ভ্রাতৃত্বের প্রশ্নে ছিল। যা আজ শুধু প্রতিকী শব্দে পরিণত হয়েছে।

No comments:

Post a Comment