Tuesday, September 19, 2023

অনাগারিক ধর্মপাল-এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক

 সুমনপাল ভিক্ষু

 

প্রাক কথন:

অনাগারিক ধর্মপালের আবির্ভাব সেই সময়কালে হয়েছিল যখন শ্রীলংকা ইউরোপীয় সংস্কৃতির নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সেখানকার জনগণ ইউরোপীয় বেশভুষা, ভাষা, ধর্ম, এবং সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে শুরু করেছিল তথা নিজেদের সংস্কৃতি ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছিল। সেই সময় শ্রীলংকার শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ধনী সম্প্রদায় তাদের সন্তানদিকে খ্রিস্টান মিশনারী বিদ্যালয়ে আসীন হওয়াতে গর্ব অনুভব করত। ঔপনিবেশিক বাতাবরণে এক সম্পন্ন ব্যবসায়ীর গৃহে অনাগারিক ধর্মপাল এর জন্ম হয়েছিল।

অনাগারিক ধর্মপালের জন্ম এবং শিক্ষা জীবন:

১৮৬৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কলম্বো’র এক সম্পন্ন ব্যবসায়ী হেবাবিতরণ ডন কেরোলিসের গৃহে অনাগারিক ধর্মপাল জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেই সময় কলম্বোতে কোন বৌদ্ধ বিহারের অস্তিত্ব ছিল না এবং পূর্ণিমার দিন উপোসথ হেতু বৌদ্ধ মতাবলম্বীদের সেখান হতে ১৬ কি.মি. দূরে ‘কেল্লীয়’ শহরের বৌদ্ধবিহারে যেতে হতো। অপরদিকে শ্রীলংকা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে সেখানে চার্চের প্রভাব ছিল নিরঙ্কুশ। ফলে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পরিবারের শিশুদের চার্চে নিয়ে যাওয়া অনিবার্য ছিল, সেখানে পাদরী শিশুদের জন্মতিথি এবং তাদের অভিভাবকদের নাম লিপিবদ্ধ করতেন এবং খ্রিস্টান মতানুসারে তাদের নামকরণও করতেন। সেই সময় এই বিষয়টি ছিল শ্রীলংকার একটি সামাজিক বিধিনিয়ম। ফলে তার নাম হয় ‘ডন ডেভিড’। বালক ডেভিড হেবারিতরন পরম্পারাগত সিংহলী পরিবারে বেড়ে ওঠেন। প্রতিদিন তিনি তার পিতা মাতার সঙ্গে প্রাতঃকালে বৌদ্ধবিহারে যেতেন। ফলে এই শিক্ষা বালক ডেভিড-এর মনে গভীর প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। পাঁচ বৎসর বয়সকালে তিনি একটি মিশনারী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরের বছর উক্ত বিদ্যালয় ত্যাগ করে ভর্তি হন সেন্ট মেরী বিদ্যালয়ে। শিশুকাল হতেই তিনি ছিলেন কুশাগ্র বুদ্ধিসম্পন্ন। খ্রিস্টধর্মের পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।

১৮৭২-১৮৭৪ সালের মধ্যে ডেভিড এক সিংহলী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন সেখানে কেবল সিংহলী ভাষা পড়ানো হত, যা পরবর্তীকালে তার অত্যন্ত উপযোগী হয়েছিল বলে জানা যায়।

১৮৭৩ সালের ২৬ আগস্ট হল শ্রীলংকার জনগণের নিকট এক মহান ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। ঐ দিন ঐতিহাসিক ‘পৈনাদুরা বিতর্ক’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পৈনাদুরার রনকোট বৌদ্ধবিহারের সন্নিকটে এক ‘ধর্ম বিবাদ’ আলোচনা চলে। বৌদ্ধদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বৌদ্ধভিক্ষু ‘মেগত্তুবতে গুনানন্দ’ থের এবং খ্রিস্টানদের পক্ষে ছিলেন ‘রেভারেণ্ড ডেবিড ডি সিলভা’। উক্ত বিবাদে খ্রিস্টানদের পরাজয় তৎকালীন সিংহলী পত্রিকা এবং ইউরোপীয় পত্রিকাতেও বেশ ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিল। এই ঘটনার পর শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্মের পুনরুত্থান সম্ভব হয়েছিল।

১৮৭৪ সালে ডেভিড ‘সেন্ট বেণ্ডিক্ট’ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেই বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষক ছিলেন ব্রাদার অগস্ত, ব্রাদার ড্যানিয়েল, ব্রাদার জোসুআ, ব্রাদার কেশিয়ন এবং একজন সিংহলী ক্যাথলিক। এখানে তিনি সুন্দরভাবে ফুল সাজানোর ব্রত শিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। নয়বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতার উৎসাহে ২৪ ঘন্টার জন্য ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করেছিলেন।

১৮৭৬ সালে কিশোর ডেভিড কলম্বো হতে ছয়-সাত মাইল দূরে কোট্টে শহরের এক গোঁড়া ক্যাথলিক বিদ্যালয় ‘এঙ্গলিকন মিশনারী বোডিং’-এ ভর্তি হন। এই বিদ্যালয়ের পরিবেশ ভিন্ন ধর্মালম্বীদের নিকট এক প্রকার নরক পূর্ণ ছিল। সেখানে বাইবেল পাঠ, প্রার্থনা সভায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি ছিল অনিবার্য। সর্বোপরি মদ্যপ বোডিং সুপারিন্টেন্ড এর বর্বর পূর্ণ ব্যবহার তাকে এক প্রকার হতাশ করেছিল। একটি ছোট ঘটনা কিশোর ডেভিডের মনকে আরও বিদ্রোহপূর্ণ করে তুলেছিল। ঘটনাটি ছিল এইরূপ — একবার তাঁর এক সহপাঠীর মৃত্যু হলে বোডিং সুপারিন্টেন্ড সকল ছাত্রকে উক্ত ছাত্রের মৃতদেহের সামনে সমবেত প্রার্থনার আদেশ দেন। উক্ত আদেশে সকল ছাত্র ভয়ভীত হয়ে পড়লে ডেভিড তা অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে মোকাবিলা করে তাদের প্রার্থনা সভায় নিয়ে আসেন। এই ঘটনায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন।

দীর্ঘদিন বাইবেল অধ্যয়ন করে ক্যাথলিক ধর্মের বিচ্যুতিগুলি তার সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করতে থাকলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিদ্যালয় হতে বহিষ্কৃত করার আদেশ দেন। ডেভিড-এর এই বিদ্রোহী মনোভাব পরবর্তীকালে তার লেখনীর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্যালয় ত্যাগ করে ‘সেন্ট থমাস কলেজিয়েট বিদ্যালয়’-এ ভর্তি হন।

এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কিছু দিন পরে তাঁকে ধর্মীয় চিন্তা ধারা পরিস্ফুটনের কারণে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হন। কারণ এই বিদ্যালয়ের নিয়ম ছিল অত্যন্ত কঠোর। একবার তিনি তাঁর গৃহে বৌদ্ধধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে ছুটি প্রার্থনা করলে বিদ্যালয়ের ওয়ার্ডেন মিলার তা নামঞ্জুর করে দেন। এই ঘটনায় তিনি মর্মাহত হয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন।

অনাগারিক ধর্মপালের বিদ্রোহী জীবন:

অনাগারিক ধর্মপাল তথা ডেভিড হেবাবিতরণ বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি মহামানব গৌতম বুদ্ধের জীবন দর্শন এবং খ্রিস্ট ধর্মের দুই গোষ্ঠীর (ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্ট) বাইবেল অধ্যয়ন করতে থাকেন। এছাড়া বিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠীদের সঙ্গে শাস্ত্রালাপ করার জন্য একটি গোষ্ঠী তৈরি করেন। উক্ত গোষ্ঠী প্রতি রবিবার একটি নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হয়ে শাস্ত্রালাপ করতেন।

এই বয়সে তিনি ‘কোটাহেনা’ বৌদ্ধবিহারের প্রধান স্থবিরের সংস্পর্শে আসেন এবং বৌদ্ধদর্শন অধ্যয়নের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হন। সর্বোপরি তিনি ‘থিওসোফিক্যাল সোসাইটি'র মুখ্য সংস্থাপক কর্ণেল আলকট এবং ম্যাডাম ব্লাবটস্কির সান্নিধ্যে এসে পালি ভাষা চর্চা করতে থাকেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। এই সময়কালে তিনি সেন্ট থমাস বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতেন।

১৮৮৩ সালে কোটাহেনা'র সেন্ট লেসিয়া চার্চের সন্নিকটে একটি শোভাযাত্রার উপর ক্যাথলিকদের আক্রমণের ফলে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে বেশকিছু লোক নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। এই ঘটনার ফলে ডেভিডের পিতা তাকে খ্রিস্টান বিদ্যালয় হতে অব্যাহতি দেন। অতঃপর তিনি পেটা'র একটি লাইব্রেরিতে অধ্যয়নের কাজে তিনি নিমগ্ন থাকেন। সেই সময় তিনি নীতি শাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, কীটস্ ও শেলীর কবিতার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন।

অনাগারিক ধর্মপাল এবং থিওসোফিক্যাল সোসাইটি:

১৮৮৪ সালে থিওসোফিক্যাল সোসাইটির প্রমুখ কর্ণেল অলকট শ্রীলংকাতে একটি বিশেষ প্রয়োজনে উপস্থিত হলে ডেভিড তথা ধর্মপাল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায়ে একটি পত্র প্রেরণ করে সোসাইটির সদস্যপদ গ্রহণের প্রার্থনা জানান। অলকট তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতা করার পর তাকে সোসাইটির শ্রীলংকা শাখার সদস্যপদ প্রদানে রাজি হন। সোসাইটির সদস্যপদ লাভের পর তিনি ‘পরাবিদ্যা’তে নিপুনতা অর্জনের অভিপ্রায়ে ম্যাডাম ব্লাবটস্কির সঙ্গে ‘অভ্য়ার’ আসেন। কিন্তু তিনি কিশোর ডেভিডকে পরবিদ্যা চর্চার পরিবর্তে পালি অধ্যয়ন করতে উৎসাহ প্রদান করেন। ম্যাডাম ব্লাবটস্কির প্রচেষ্টায় তাঁর পালি অধ্যয়ন শুরু হয়। এদিকে মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) মিশনারীদের ভয় ছিল যে কর্ণেল অলকটের শ্রীলংকা আগমন দক্ষিণ ভারতে খ্রিস্টানদের ধর্মপ্রচারে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। এই কারণে তারা সর্বপ্রথম চক্রান্ত করে ম্যাডাম ব্লাবটস্কির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে শুরু করেন। এই পরিণাম স্বরূপ সোসাইটি তাকে সমস্ত পদ হতে সরিয়ে দেন। অপমানিত হয়ে ম্যাডাম ব্লাবটস্কি স্বদেশে ফিরে গেলে সোসাইটির শ্রীলংকার শাখা একটি নিয়মতান্ত্রিক সংস্থায় পরিণত হয়।

অনাগারিক ধর্মপাল এবং বৌদ্ধধর্ম:

ম্যাডাম ব্লাবটস্কির শ্রীলংকা ত্যাগের পর ডেভিড তথা অনাগারিক ধর্মপাল তাঁর পিতার নিকট হতে গৃহত্যাগের অনুমতি চান। তাঁর এই ভাবনার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মের সেবা করা। কিন্তু তাঁর পিতা তাকে এই অনুমতি প্রদানে অস্বীকৃত হন। তবে ধর্মপালের দৃঢ় চেতনাসম্পন্ন মানসিকতায় তাঁকে অনুমতি প্রদান করেন।

১৮৮৪ সালে তিনি শিক্ষা-বিভাগে ‘লিপিকর’ পদে নিযুক্ত হন। তবে এই কাজে তিনি মনোনিবেশ করতে পারেননি। ১৮৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কর্ণেল অলকট, সী. ডব্লিউ. লেডবিটর প্রমুখ বৌদ্ধ শিক্ষাকোষ প্রকাশের তাগিদে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে শ্রীলংকা উপস্থিত হন। এই কার্য সম্পাদনের প্রশ্নে তিনি সমগ্র শ্রীলংকা পরিভ্রমণ করার প্রশ্নে একজন বৌদ্ধ অনুবাদকের সহযোগিতা আশা করতে থাকেন কিন্তু উপযুক্ত ব্যক্তি না পেয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। এইরূপ সংকটময় পরিস্থিতিতে ধর্মপাল এগিয়ে আসেন তাদের সহযোগিতা করতে এবং তিনি শিক্ষা-নির্দেশনায় হতে তিন মাসের ছুটি মঞ্জুর করে তাঁদের সঙ্গে শ্রীলংকার বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত নানাবিধ তথ্য সংগ্রহ করেন। এই সময় তিনি ‘ডেভিড হেবাবিতরন' নাম পরিত্যাগ করে ‘ধর্মপাল’ নাম গ্রহণ করেন।

১৮৮৭ সালে তিনি জাপান সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ পড়ে জাপান যাত্রায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ১৮৮৯ সালে কর্ণেল অলকটের আমন্ত্রণে জাপান উপস্থিত হন। জাপানে উপস্থিত হয়ে তিনি মহাযানী বৌদ্ধ মতাদর্শের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেন। এই সময় তিনি জাপানের কোবে হতে কিয়োটো আসেন কিন্তু প্রচণ্ড শীতের কারণে রোগগ্রস্থ হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হন। জাপান হতে জাহাজ যোগে ফিরে আসার সময় জাহাজের ক্যাপ্টেন হতে অবগত হন যে তিনি ম্যাডাম ব্লাবটস্কির বন্ধুস্থানীয়, তখন ধর্মপাল তার নিকট হতে মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) ক্যাথলিকদের ষড়যন্ত্রের কথা অবগত হন। এই সংবাদে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত এবং মর্মাহত হয়ে পড়েন।

১৮৮৯ সালের জুন মাসে অলকট পুনঃ শ্রীলংকাতে উপস্থিত হলে তিনি এবং ধর্মপাল বৌদ্ধধর্মের কার্য সম্পাদনের প্রশ্নে শ্রীলংকার বিভিন্ন প্রান্তে পরিভ্রমণ করতে থাকেন। কখনও কখনও অলকটের অনুপস্থিতিতে তিনিই একাই এই কার্য সম্পাদন করেছিলেন।

অনাগারিক ধর্মপালের ভারত আগমন:

১৮৯০ সালের ১২ জানুয়ারি এক জাপানী বৌদ্ধভিক্ষু কোজেন গুণরত্নের সঙ্গে বোম্বাই (মুম্বই) উপস্থিত এবং ২০ জানুয়ারি উত্তর প্রদেশের বেনারসে পৌঁছান।

বুদ্ধগয়ার মূল বিহারের ইতিহাস এবং অনাগারিক ধর্মপাল:

বুদ্ধগয়ার মূল বিহারটির প্রাচীনতার প্রশ্নে এখনও পর্যন্ত কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি, ফলে এই বিহারটি কোন শতাব্দীতে নির্মাণ হয়েছিল তা এখনও পর্যন্ত রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। তবে মহামতি অশোকের শিলালেখ সংখ্যা ৮-এ বর্ণিত আছে যে তাঁর রাজ্যাভিষেকের ১০ম বর্ষে তিনি সম্বোধি (বুদ্ধগয়া) যাত্রা করেছিলেন এবং সেই সময় এই স্থান বৌদ্ধতীর্থ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। অশোক দ্বারা সম্বোধি যাত্রার বর্ণনা আমরা মহাবংস'², দিব্যাবদান ইত্যাদি গ্রন্থেও পাই। তবে এই স্থানে অশোক দ্বারা নির্মিত বিহার নির্মাণের প্রমাণকে চৈনিক ভিক্ষু ‘চ্যাঙ হসিয়া’র ১০২১ খ্রিস্টাব্দে এক লেখায় পাওয়া যায়।শুয়াং জাঙের বর্ণনা অনুসারে জানা যায় যে সম্রাট অশোক বোধিবৃক্ষের চতুর্দিকে প্রস্তর দ্বারা প্রাচীর নির্মাণ করে দিয়েছিলেন, যা শুয়াং জাঙ্-এর আগমন কালেও অক্ষুন্ন ছিল। সুতরাং এই বিহারের নির্মাণ কৃতিত্ব সম্রাট অশোকের প্রাপ্য নয়। ড. বেণীমাধব বড়ুয়ার মতে এই বিহারের নির্মাণকাল ফা-হিয়েনের পরে এবং হিউয়েন সাঙের আগমনের আগেই নির্মিত হয়েছিল। অপর একটি অভিলেখ দ্বারা হিন্দুত্ববাদীরা দাবি করে থাকেন বৌদ্ধগয়ার বিহারের নির্মাণ ৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্বে অমরকোষ এর রচনা কার ‘অমর দেব’ (?) করেছিলেন কিন্তু পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উক্ত অভিলেখটি ‘জাল’ (নকল) প্রমাণিত হলে হিন্দুত্ববাদীদের দাবি নস্যাৎ হয়ে যায়। ঐতিহাসিক রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতানুসারে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই বিহারের অস্তিত্ব ছিল, যদি বিহারের আয়ু ১০০ বছর মেনে নেওয়া যায় তাহলে বিহারের নির্মাণ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী স্বীকার করে নিতে হবে এবং বিহারের নির্মাণের পূর্বে উক্ত স্থানে সম্রাট অশোক দ্বারা নির্মিত সংরচনা অবশ্যই ছিল। যদি সংরচনার আয়ু ১৫০ বছর ধরে নেওয়া যায় তাহলে উক্ত বিহারটির আনুমানিক তিথি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী হতে খ্রিস্টাব্দে প্রথম শতাব্দী কালের মধ্যবর্তী সময়কে গ্রহণ করতেই হবে।

বর্তমান বুদ্ধগয়া বিহারের প্রাচীরের দক্ষিণ দ্বারের সমীপে এক লঘু বিহার'এর মেঝে তথা চাতাল হতে প্রাপ্ত একটি বুদ্ধমূর্তিতে ৬৪ সম্বৎ খোদিত আছে। সুতরাং এই মূর্তি নির্মাণের সময়কাল খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় শতাব্দী হওয়াটাই স্বাভাবিক। অত্যাধিক বিকৃত হওয়ার কারণে এই বিহারের নির্মাতার নাম জানা সম্ভব হয়নি। তবে সেখান হতে প্রাপ্ত বেশকিছু রৌপ্যমুদ্রাতে কুষাণ সম্রাট ছবিষ্কের নাম পাওয়া যায়। অতঃএব এই বিহারটির নির্মাণ হয়তো হুবিস্কের শাসনকালেই হয়েছিল। 

আরো বেশ কিছু অভিলেখ উক্ত স্থান হতে পাওয়া গেছে এবং সেগুলির উপর ভিত্তি করে বুদ্ধগয়া বিহার নির্মাণের তিথি সুনিশ্চিত করা যেতে পারে। যেমন ভগ্নপ্রাচীরের ১৫তম স্তম্ভে কুরঙ্গীর ১৫ অভিলেখ, একটি খণ্ডিত স্তম্ভে সিরিমা’র অভিলেখ, অন্য একটি স্তম্ভে নাগদেবীর অভিলেখ ইত্যাদি বিহার বিকাশের প্রথম অধ্যায় সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। কুরঙ্গীর সকল অভিলেখতে একজন নারীকে ‘আর্যা’ রূপে সম্বোধন করা হয়েছে। সম্ভবত তিনি কোন সম্মানিত বৌদ্ধ রমণী ছিলেন। অপর একটি অভিলেখতে তাকে কৌসীকী পুত্র ইন্দ্রাঙ্গিনী মিত্রের রাজমহলকে দানকলী রূপে গণ্য করা হয়েছে। অধ্যাপক বেণীমাধব বড়ুয়ার মতে এই বিহারটির নির্মাণ মহাবোধি সংঘারামের পূর্বেই সম্পন্ন হয়েছিল। মহাবোধি সংঘারামের নির্মাণ সমুদ্রগুপ্তের সমকালীন শ্রীলংকার রাজা মেঘবর্মন করেছিলেন। নাগদেবী অভিলেখতে তাঁকে রাজা ব্রহ্মমিত্রের শাসনকালে বোধিবৃক্ষ এবং বজ্রাসনের চতুর্দিকে প্রাচীর নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। হতে পারে যে রাজা ব্রহ্মমিত্র ইন্দ্রাঙ্গিনী মিত্রের উত্তরাধিকারী ছিলেন। বজ্রাসনের উপরে প্রাপ্ত একটি অভিলেখ আংশিক পাঠোদ্বার করে ঐতিহাসিক কানিংহাম অভিমত প্রকাশ করেছেন যে এটি শক অথবা প্রারম্ভিক গুপ্তযুগের সময়কাল হতে পারে।

বুদ্ধগয়া বিহারের নির্মাণকাল যদিও বিবাদপূর্ণ তথাপি শুয়াং জাঙের আগমনের সময়কাল পর্যন্ত এর খ্যাতি বৌদ্ধ ধর্মীয় কেন্দ্র রূপে বিকশিত হয়েছিল। সম্ভবত চৈনিক পর্যটক ইৎ-সিঙ, যিনি ৬৭১-৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ মধ্যবর্তী সময়ে এই স্থানে এসেছিলেন— এবং তিনি মহাবোধি বিহারের বর্ণনা করেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন যে শ্রীলংকার রাজা বোধিবৃক্ষের সমীপে একটি মহাবিহার নির্মাণ করেছিলেন। এই স্থান হতে প্রাপ্ত কিছু অভিলেখ হতে জানা যায় যে সে এই সময়কাল হতেই বৌদ্ধধর্ম পতনোন্মুখ হয়ে পড়েছিল।

রাজা ধর্মপালের (অষ্টম শতাব্দী, খ্রিস্টাব্দে) সময়কালের একটি অভিলেখতে বুদ্ধগয়াতে চতুর্মুখ এক দেবতার মূর্তি স্থাপনের বর্ণনা পাওয়া যায়। বৌদ্ধধর্ম বিকাশের দ্বিতীয় অবস্থা খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দী হতে শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় গোপালের শাসনকালে শত্রুসেনের একটি অভিলেখতে বুদ্ধমূর্তি নির্মাণের উল্লেখ মেলে। পুনঃ পঞ্চপাণ্ডবের মূর্তির পাদপিঠিকাছার উপরে উল্লিখিত মহীপালের একটি অভিলেখতে তাঁর শাসনকালের ১১ বর্ষে বুদ্ধমূর্তি নির্মাণের বর্ণনা রয়েছে আবার রাজা জয়চন্দ্রের একটি অভিলেখতে বুদ্ধগয়াতে একটি বিহার নির্মাণের বিবরণ রয়েছে।

তুঙ্গ নামক কোন এক রাষ্ট্রকুট শাসকের অভিলেখতে গন্ধকুটি নির্মাণের উল্লেখ পাওয়া  যায়। কানিংহাম এই অভিলেখটিকে ১০-১১ শতাব্দী বলে বর্ণনা করেছেন। এই সময় সেখানে বার্মার একালে বৌদ্ধভিক্ষর আগমনের সংবাদও পাওয়া যায়। এই অভিলেখতে বুদ্ধগয়া বিহারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। এখান হতে প্রাপ্ত বেশ কয়েকটি অভিলেখতে শ্রীলংকা হতে আগত বেশ কিছু বৌদ্ধভিক্ষুর নাম রয়েছে। সুতরাং বুদ্ধগয়ার মহাবোধি বিহার খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী হতে ভারতে মুসলিম আক্রমণের সূচনাপর্ব পর্যন্ত নিরন্তর বৌদ্ধ নিয়ন্ত্রণে ছিল। সর্বোপরি নির্মাণ এবং পুনঃনির্মাণ তথা সংস্কারের কাজ শুধুমাত্র ভাবতীয় বৌদ্ধদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, শ্রীলংকা ইত্যাদি বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলি দ্বারা এই কার্য সম্পাদিত হয়েছিল।

বুদ্ধবিহার দখলের ইতিহাস এবং পর্যালোচনা:

এক কিংবদন্তী অনুসারে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে (মুঘল যুগে) গোসাঁই ঘমণ্ডীগিরী নামক এক যাযাবর শৈব মোহন্ত বুদ্ধগয়া গ্রামের নিকটে উপস্থিত হন। তিনি উক্ত বৌদ্ধবিহারের ভগ্নাবশেষ হতে অনতিদূরে একটি কুটির নির্মাণ করে তাঁর কিছু অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। ধীরে ধীরে ওই অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকলে পরবর্তী সময়ে সেই বিহারটিকে তাঁরা কুক্ষিগত করে নেন। অতঃপর শৈব মোহন্ত লালগিরির সময়কালে।

দিল্লীর মুঘল শাসক তাঁকে মস্তিপুর এবং তারাডীহ গ্রাম সঁপে দেন। এই আদেশবলে সুচতুর মোহন্ত লালগিরি বুদ্ধগয়াস্থিত বৌদ্ধবিহার এবং এর সংলগ্ন বেশকিছু অঞ্চল দখল করেন। ইতিমধ্যে আরও একটি অতিকথন উঠে আসে যে চৈতন্যের উত্তরাধিকারী মহাদেব মহাবোধি বিহারের সম্মুখে ‘মহাদেবীর’ উপাসনা করে উক্ত দেবীর কৃপায় এই সবিশাল মন্দির নির্মাণ (?) করেছিলেন। অতঃপর মুঘল সম্রাট শাহ আলম এক ফরমান জারি করে মহাদেবকে সেখানে তাঁর অনুগামীদের অবস্থানের জন্য বেশ কিছু গৃহনির্মাণও করেন। লালগিরির পর নাকি বুদ্ধগয়ার বিহারটি দান করেছিলেন। মহাদেবের পর লালগিরি মোহন্ত হন। তিনি দেহত্যাগ করলে শিবগিরি মোহন্ত হন। শিবগিরি হতে বিহারের উত্তরাধিকারী হন মোহন্ত হেমনাথ গিরি। কিন্তু জেনারেল কানিংহামের প্রথম রিপোর্টে এই তথ্য পাওয়া যায় না। কানিংহামের দ্বিতীয় রিপোর্টে মহাদেবকে প্রথম মোহন্ত বলা হয়েছে। চৈতন্যকে চৈতমল নামে মহাদেবের উত্তরাধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এই সময় উক্ত স্থানে বৌদ্ধধর্ম পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গয়া (বর্তমান বিহার) কালেক্‌টেডের রেকর্ডে কেবল গোপাল গিরি মোহন্তের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে বার্মা (মায়ানমার) হতে একদল বৌদ্ধভিক্ষু বুদ্ধগয়া এসেছিলেন কেন? যেখানে উক্ত স্থানের বৌদ্ধ চিহ্নগুলিকে ক্রমশই হিন্দু চিহ্নে পরিবর্তন করে প্রদর্শিত করার প্রক্রিয়াকরণ চলেছিল।

১৮১০ খ্রিস্টাব্দে বার্মার অলোম্প্র রাজবংশের শাসক বোদপায়া একদল বৌদ্ধভিক্ষুকে এই অঞ্চলে প্রেরণ করেছিলেন। সম্ভবত বোদপায়া স্বয়ং এখানে এসেছিলেন। কারণ কানিংহাম বুদ্ধগয়ার এক জরাজীর্ণ বিহার হতে তিনটি ইঁট পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন যে তাতে বর্মি লিপিতে ‘আবা’ শব্দটি উৎকীর্ণ আছে। অবশিষ্ট ইটগুলিতে বাংলা লিপিতে ক্রমশ ‘গোপাল এবং ধর্মসিংহ’ উৎকীর্ণ আছে। এই তথ্য হতে প্রমাণিত হয় যে উক্ত ব্যক্তিদ্বয়কে বাংলা হতে বিহারের জীর্ণদ্বার সংস্কারের জন্য আনয়ন করা হয়েছিল। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে বার্মার শাসক পুনঃ বুদ্ধগয়ায় উপস্থিত হন। অতঃপর আবার (বার্মা) শাসক দুইজন বৌদ্ধকে সেখানে প্রেরণ করেন। তাঁরা উক্ত স্থানটি পরিদর্শন করে বৌদ্ধ অঞ্চল রূপে চিহ্নিত করেছিলেন। এই সময় নেপাল হতে মহাযান সম্প্রদায়ের একদল বৌদ্ধভিক্ষু এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে হেমিলটন বুদ্ধগয়া পরিদর্শনে আসেন। সেই সময় মহাবোধি বিহারটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। তিনি সেই সময় বৌদ্ধ শাসকদের বেশ কিছু অভিলেখ খুঁজে পান। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা বেগিদা বেশ কয়েকজন বৌদ্ধকে সেখানে পাঠালে তারা হিন্দু মোহন্ত এবং তার অনুগামীদের নিকট হতে বাধা প্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসেন।

১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার তৎকালীন শাসক মিনডনমিন ব্রিটিশ-ভারত সরকারের নিকট একজন দূত প্রেরণ করে বুদ্ধগয়া বিহারে পূজা অর্চনা করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ১৪ আগস্ট বার্মার বিদেশমন্ত্রী তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেলর নিকট পত্র দ্বারা উক্ত বিহারের সংস্কার সাধনের অনুমতি চান। ফলে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সংস্কারের কাজও শুরু হয়। কিন্তু বিহার প্রশাসনের অঙ্গুলি হেলনে উক্ত বিহারের নিয়ন্ত্রন সম্পূর্ণরূপে শৈব মোহন্তের হাতে চলে যায়। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ৬ মে তৎকালীন জেলা জজ এ. গ্রিয়ারসন পাটনা কমিশনকে একটি পত্র দ্বারা শৈব মোহন্ত এবং তার অনুগামীদের উক্ত জমির উপর অবৈধ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অবগত করান।১০

১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রসিদ্ধ ইংরেজ কবি স্যার এডুইন আর্নল্ড ব্রিটিশ সরকার এবং বৃটিশ ভারত সরকারের নিকট বুদ্ধগয়া বিহার সহ তার আশপাশের জমি বৌদ্ধদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দাবি জানান।১১ অপরদিকে অনাগারিক ধর্মপাল ভারতীয় বৌদ্ধ, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দে'র সহায়তায় উক্ত বৌদ্ধবিহারটি উদ্ধারের জন্য ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে মহাবোধি সোসাইটি গঠন করেন। ঐ বছরের ২১ জানুয়ারি তিনি বুদ্ধগয়ায় এসে বৌদ্ধবিহারটির অবস্থা প্রত্যক্ষ করে অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে পড়েন।১২ তিনি বৌদ্ধভিক্ষু (বর্মী) কোজেন নিকট হতে উক্ত বিহার উদ্ধারের সহযোগিতা প্রার্থনা করলে ভিক্ষু কোজেন সহমত পোষণ করেন। তখন ধর্মপাল উক্ত স্থানে ততদিন পর্যন্ত অবস্থানের সংকল্প নেন, যতদিন না অন্য কোন ভিক্ষু উক্ত স্থানের উত্তরদায়িত্ব না পান। তিনি শ্রীলংকা, ভারত, বার্মা এবং অন্যান্য বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলিতে পত্র প্রেরণ করে ভারতবর্ষে বুদ্ধশাসন পুনঃরুত্থানের প্রশ্নে সহযোগিতা প্রার্থনা করলে কোন প্রকার উৎসাহপূর্ণ সহায়তা পেলেন না। অপর দিকে তাঁর অর্থাভাব প্রবল হয়ে উঠল। তবুও তিনি বুদ্ধগয়া পুনঃরুদ্ধারের ব্রত ত্যাগ করেননি। ইতিমধ্যে তিনি বিভিন্ন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নিকট হতে অর্থ এবং সহযোগিতার আশ্বাস পেতে থাকেন। কিন্তু তিনি এও উপলব্ধি করেন যে বৌদ্ধবিহার উদ্ধারের বিষয়টি এত সহজে মীমাংসিত হবে না। তবুও তিনি হত্যেদম না হয়ে গয়ার তৎকালীন কালেকটর জী. এ. গ্রিয়ারসন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে জানতে পারেন যে বিহার এবং তার সংলগ্ন ভূমি মোহত্তের অধীনস্থ সম্পত্তিরূপে সরকারি রেকর্ডে নথিভূক্ত হয়ে আছে।১৩ তিনি তখন পুরাতন দস্তাবেজ সংগ্রহের উদ্দেশ্য কোলকাতা উপস্থিত হন এবং নীলকমল মুখোপাধ্যায় নামে একজন থিয়োসোফিস্ট এর নিকট অবস্থান করে তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সচেষ্ট হন।

এই সময় তিনি বিদ্বান শরৎচন্দ্র দাস এবং ইণ্ডিয়ান মিরর পত্রিকার সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন, স্টেট্সম্যান পত্রিকার সম্পাদক রবার্ট নাইট এবং সুলেখক কে. টী. টেলেঙ্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর রেঙ্গুনে উপস্থিত হয়ে থিওসফিস্ট মাউন্ট পালাহিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু সেখান হতে আশানুরূপ সহযোগিতা না পেয়ে কলম্বো চলে আসেন। সেখানে হিকড্ডবে সুমঙ্গল মহাথেরের অধ্যক্ষতায় ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ৩১মে ধর্মপাল এক সুবিশাল ধর্মসভা আহ্বান করেন। এই জনসভাতেই মহাবোধি সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার ভিত্তিমূল স্থাপিত হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে আগামী আষাঢ়ী পূর্ণিমা (ধর্মচক্রপ্রবর্তন দিবস) বুদ্ধগয়াতে সুবিশাল করে পালিত হবে। এই সময় তিনি চারজন সিংহলী বৌদ্ধভিক্ষু দনবিয়চন্দ্র জ্যোতি, মাতলে সুমঙ্গল, পেমানন্দ এবং গৈলিসুদর্শনের সহযোগিতা লাভ করেন।

অনাগারিক ধর্মপালের সংগ্রাম:

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ১০ জুলাই অনাগারিক ধর্মপাল এবং তাঁর সহযোগী বৌদ্ধভিক্ষুগণ পুনঃ বুদ্ধগয়া উপস্থিত হয়ে মোহন্তের নিকট হতে সামান্য কিছু জমি ক্রয় করিতে চাইলে মোহস্ত প্রথমে তা প্রদান করতে স্বীকৃত হলেও পরে অসহমত পোষণ করেন। এই সময় হতে। বুদ্ধগয়ায় শৈব মোহন্তের সঙ্গে অনাগারিক ধর্মপালের ভবিষ্যৎ সংঘর্ষের পটভূমি রচিত হতে থাকে। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ৩১ অক্টোবর তিনি বিশ্বের সকল বৌদ্ধদের একটি সম্মেলন আহ্বান করলে বাংলার তৎকালীন গভর্নরও এই সম্মেলনে সামিল হন। উক্ত সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে একটি বৌদ্ধ প্রতিনিধি মণ্ডল শৈব মোহত্তের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবে। অতঃপর ধর্মপাল বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষের সম্মুখে বৌদ্ধ পতাকা উড্ডীন করেন। ইতিমধ্যে এশিয়াতে রুশ-জাপান সংকট চরম পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়। অপর দিকে জাপানী বৌদ্ধ প্রতিনিধি মণ্ডলের বুদ্ধগয়া আগমন ব্রিটিশ-ভারত সরকার ভালো চোখে নেন না। ফলে বাংলার লেফটেনেন্ট গভর্নর ধর্মপাল এবং তার সহযোগীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা বন্ধ করে দেন।

গয়ার কালেকটর গ্রিয়ারসন অনাগারিক ধর্মপালকে জানান যে বুদ্ধগয়া বিহারের বাস্তবিক অধিকার শৈব মোহন্তের ফলে উক্ত স্থানে বৌদ্ধদের নিয়ন্ত্রণের কোন বিষয়েই ব্রিটিশ-ভারতীয় সরকার কোনরূপ সহায়তা করতে পারবেন না। ইতিমধ্যে বৌদ্ধ-হিন্দু বিবাদের আভাস পেয়ে বড়লাট কার্জন একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন। অপরদিকে এই বিকট পরিস্থিতিতে ও ধর্মপাল মোহন্ত হতে বিশ্রাম গৃহ নির্মাণের প্রশ্নে একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ড লাভ করেন। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ৪ ফেব্রুয়ারি অসুস্থতা জনিত কারণে মোহন্তের মৃত্যু হলে কৃষ্ণদয়াল গিরি নামক এক কট্টরপন্থী শৈব উক্ত স্থানের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত হন। তিনি প্রথম থেকেই বৌদ্ধদের প্রতি আক্রমণকারী প্রতিপন্ন হন। এই সময় ধর্মপাল কোলকাতায় চলে আসেন।

ইতিমধ্যে বুদ্ধগয়াতে একটি ঘটনা ঘটে। দয়ালগিরি মোহন্ত ও তার অনুগামীরা সেই স্থানে অবস্থানরত দুইজন বৌদ্ধভিক্ষুর উপর প্রাণঘাতী হামলা চালান। সংযোগবশত এই সময় কর্ণেল অলকট কলকাতায় এসে উপস্থিত হন এবং ধর্মপালের সঙ্গে বুদ্ধগয়া পৌঁছান। সেখানে ভন্তে চন্দ্ৰজ্যোতি তাদের সমস্ত ঘটনা অবগত করলে ধর্মপাল উক্ত মোহন্ত এবং তার অনুগামীদের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সর্বোপরি ধর্মপাল অবগত হন যে বুদ্ধগয়া বৌদ্ধবিহারের উপর মোহান্তের অধিকার সমাপ্ত হয়ে গেছে এবং তিনি পুনঃ অধিকার লাভের আশায় সচেষ্ট হয়েছেন। ধর্মপাল এই জমিটিকে ক্রয় করার উদ্দেশ্য অর্থ সংগ্রহের প্রশ্নে বার্মায় (১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মে) উপস্থিত হন কিন্তু উপযুক্ত সহায়তা না পেয়ে নিরাশ হন।

ধর্মপাল বার্মা হতে ফিরে এসে গয়ায় নব নিযুক্ত কালেক্টর মেক্‌ফার্সনকে বিহার সংক্রান্ত বিবাদের বিষয়টি অবগত করান এবং এই সময়কালে ধর্মপাল বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদানের জন্য শিকাগো চলে যান। সেখানে যাওয়ার সময়ে ইংল্যান্ডে উপস্থিত হয়ে এডুইন আরনল্ড নামক দার্শনিক এবং ইংল্যান্ডের রাজা সচিব লর্ড কিম্বলের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুদ্ধগয়ার বিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেন। লর্ড কিম্বলে তাকে সম্পূর্ণ সহায়তাসপ্রদানের আশ্বাস দিলে ধর্মপাল ধর্মসম্মেলন সম্পূর্ণ করে টোকিও উপস্থিত হন। সেখানে তিনি। সমস্যাটি উত্থাপন করলে কোনরূপ উল্লেখযোগ্য সহায়তা না পেয়ে থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুর হয়ে ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ১১ এপ্রিল শ্রীলংকাতে আসেন ঐ বছরেই জাপান হতে প্রাপ্ত একটি বুদ্ধমূর্তি নিয়ে তিনি বুদ্ধগয়া উপস্থিত হলে মোহস্ত কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কলকাতা ফিরে এসে মূর্তিটিকে ধর্মরাজিক বিহারে স্থাপন করে দেন। কিন্তু জাপানীদের ইচ্ছা ছিল বুদ্ধমূর্তিটি যেন বুদ্ধগয়া বিহারে স্থাপিত হয়। অতপর ধর্মপাল গয়ার কালেক্টরকে বিষয়টি অবগত করলে তিনি মোহন্তের সঙ্গে মন্ত্রণা করেন এবং মোহন্তের অসম্মতির কথা ধর্মপালকে বলেন। থেফার্সন ধর্মপালকে ব্রাহ্মণ বিদ্বান সমাজের সহানুভূতি লাভের কথা বললে ধর্মপাল বারাণসীতে এসে ব্রাহ্মণ সমাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তারা ধর্মপালের প্রস্তাব সরাসরিভাবে নাকচ করে দেন এবং বুদ্ধগয়া বিহারটিকে হিন্দু বিহার রূপে প্রতিপন্ন করেন। অপরদিকে শৈব মোহন্ত ধর্মপালকে প্রতিহত করার অভিপ্রায়ে সকল প্রকার প্রচেষ্টা করতে তৎপর হয়ে ওঠেন।

১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি অনাগারিক ধর্মপাল এই সকল সমস্যাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করে মহাবোধি বিহারের উপরিতলে বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করেন। মোহন্তের অনুগামীরা ধর্মপালকে মূর্তি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভয় দেখালে গয়ার কালেকটর সংবাদ পেয়ে স্বয়ং ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং ধর্মপালও তার সহযোগীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেন।১৫ সেই দিনই মোহন্ত এবং তার অনুগামীরা ধর্মপাল এবং বেশ কয়েকজন ভিক্ষুর উপরে প্রাণঘাতী হামলা করলে ধর্মপাল ও ভিক্ষুগণ ভীষণভাবে আহত হন। এই ঘটনা বুদ্ধগয়া বিহার বিবাদের আগুনকে দাবানলে পরিণত করে দেয়। মোহন্তের অনুগামীদের মোকদ্দমা চলতে থাকে। অতঃপর বেশ কিছু অনুগামীর সাজা হয়। মোহন্ত আদালতে আপীল করলে তা নাকচ হয়ে যায়। 

শৈব মোহন্তের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা এবং রাজনৈতিক বিতর্ক:

বৌদ্ধভিক্ষু এবং ধর্মপালের উপর আক্রমণ শৈব মোহান্তের বিপক্ষে চলে যায়। গয়া জেলার জজ এক আদেশ নামায়  জানান- ১. এই বিহারটি বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের দ্বারা সদা সর্বদা বৌদ্ধ পূজাস্থল রূপে প্রযুক্ত হয়ে আসছে। ২. এই বিহারের সঙ্গে হিন্দুপূজার রীতিনীতি পদ্ধতির কোনো প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়নি। ৩. এই বৌদ্ধবিহারটিকে হিন্দু মোহান্ত দখল করে মুখ্য গর্ভগৃহে রক্ষিত বুদ্ধমূর্তিটিকে হিন্দুরূপ প্রদানের প্রচেষ্টা করে চলেছেন, তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ৪. বিহারের অভ্যন্তরে মোহন্ত এবং তার অনুগামীদের কোনদিনই পূজা অর্চনা করতে দেখা যায়নি। ধর্মপাল দ্বারা জাপানি বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু পদ্ধতিতে পূজা শুরু হয়।

কোলকাতা হাইকোর্টের দুইজন জজ একটি রিপোর্টে মহাবোধি মন্দিরকে বৌদ্ধমন্দির রূপে ঘোষণা করে রায় দেন।১৭

ভিক্ষুদের উপর আক্রমণ এবং মোহস্তের হাত থেকে উক্ত বিহার এবং জমি বৌদ্ধদের হাতে চলে যেতে দেখে মোহন্ত গয়া জেলার তৎকালীন কালেক্টরকে বিপুল উৎকোচ দিয়ে মহাবোধি সোসাইটির বিপক্ষে পরিচালনা করতে থাকেন। উক্ত কালেক্টর সোসাইটিকে বুদ্ধমূর্তি সরিয়ে নিতে বলেন কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি তার আদেশ প্রত্যাহার করে নেন। ইতিমধ্যে এই সকল ঘটনাগুলি ভারতবর্ষে এবং ইংল্যান্ড আমেরিকা সহ ইউরোপের বিভিন্ন সংবাদ পত্রে নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হতে থাকলে ঘটনাটি রাজনৈতিক মোড় নেয়।

অপরদিকে জমিদার সভা বৃটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারের নিকট এক প্রতিনিধিমণ্ডল প্রেরণ করে বৌদ্ধবিহারটিকে হিন্দুবিহার বলে দাবি করতে থাকেন। কিন্তু ব্রিটিশ-ভারত সরকার উক্ত বিহারটিকে পূর্ণরূপে হিন্দুবিহার রূপে স্বীকৃতি প্রদান করতে অস্বীকার করেন।

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে অনাগারিক ধর্মপালের ভারত আগমন, ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে মহাবোধি জার্নাল প্রকাশ তথা ১৮৯৪-১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে মহাবোধি বিহার বিবাদের কারণে বাংলা প্রদেশে বৌদ্ধদের প্রতি সহানুভূতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। অনাগারিক ধর্মপালও উপলব্ধি করতে থাকেন যে একদিন বৌদ্ধবিহার বিধর্মীদের হাত থেকে উদ্ধার নিশ্চিতরূপেই সম্ভব হবে।

১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন টাইমস লেখেন যে অতি প্রাচীন কাল হতে বুদ্ধগয়া বৌদ্ধদের পবিত্র তীর্থভূমি। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে টোকিওর একজন গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধভিক্ষু অনাগারিক ধর্মপালকে একটি সুন্দর বুদ্ধমূর্তি বুদ্ধগয়ার পবিত্র বিহারে প্রতিস্থাপনের জন্য দিয়েছিলেন। লন্ডন টাইমস আরও জানান যে বুদ্ধ গয়ার বিহার বৌদ্ধদের হাতে সঁপে দিয়ে বিশ্ব ইংল্যান্ড তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করুক।১৮

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ধর্মপাল স্যার এডুইন আর্নল্ডকে বুদ্ধগয়া বিহার বিবাদে হস্তক্ষেপের জন্য পত্র প্রেরণ করেন কিন্তু ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আর্নল্ড দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে দেহত্যাগ করেন। স্যার আর্নল্ডের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধগয়া বিহার বিবাদের প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত হয়।

বুদ্ধগয়া বিহার বিবাদের দ্বিতীয় অধ্যায়:

বুদ্ধগয়া বিহার বিবাদের দ্বিতীয় অধ্যায় ভিক্ষু ওকাকুরা শুরু করেন। তিনি সর্বপ্রথম বিবেকানন্দের সঙ্গে এবং পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সেখানে গিয়ে জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ওকাকুরার উদ্দেশ্য ছিল মহাযান বৌদ্ধবিহার স্থাপন। কিন্তু মোহন্তের তৎপরতায় তার উদ্দেশবিফল হয়। ইতিমধ্যে ইন্ডিয়ান মিরর বুদ্ধগয়া সম্পর্কিত বিষয়গুলি নিয়মিতভাবে প্রকাশ করতে শুরু করেন। তবে ওকাকুরার আগমন ধর্মপালের বিপক্ষে চলে যায়। বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষে জাপানীদের আগমনে সন্দিহান হয়ে ওঠেন এবং সরকার বৌদ্ধ বিরোধী হয়ে ওঠে। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে পাটনার কমিশনারের একটি আদেশনামা হিন্দু মোহান্তের পথে চলে যায়। ধর্মপাল এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে হাইকোর্টে আপীল করলে উচ্চ আদালত কমিশনারের আদেশনামা নাকচ করে দেয় কিন্তু বিহারের হস্তান্তরের প্রশ্নটিও ধর্মপালের বিপক্ষে যায়।১ অগত্যা তিনি জনগণের নিকট বিষয়টি তুলে ধরার জন্য সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কলম ধরতে শুরু করেন। ধর্মপালের এই অভিযান বৃটিশ লেখক চার্লস দূর এই প্রসঙ্গে বলেন— “কোন পরিস্থিতিতেই ভারতবর্ষের কোন বৌদ্ধবিহারকে হিন্দুদের হাতে তুলে দেওয়া এবং তা হিন্দু বিহারে রূপান্তরের ঘৃণ্য হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করতে হবে কারণ বৌদ্ধরা কোনভাবেই হিন্দুধর্মভুক্ত নন।২০

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ১৮ নভেম্বর মহান দার্শনিক প্রফেসর ড. সিলভা লেভি বলেন- ''বৌদ্ধধর্মের প্রতি উপেক্ষা হল মহান দার্শনিক গৌতম বুদ্ধকে অপমান। সুতরাং আমি মনে করি কোন সুসভ্য জাতির পক্ষে একজন দার্শনিক এবং তাঁর আদর্শকে উপেক্ষা করার অর্থ হল নিজেকে অসভ্য বলে প্রতিপন্ন করা।"২১ অপরদিকে বুদ্ধগয়ার বিহারকে হিন্দুবিহারে পরিণত করার জন্য মোহন্ত বৌদ্ধমূর্তিগুলিকে বিকৃত করা শুরু করে দেন এবং কিছু বৌদ্ধমূর্তিকে হিন্দু দেবতার ন্যায় পোশাক দিয়ে আবৃত করে দিতে থাকেন তথা কিছু মূর্তিকে সুরকি-চুনের মিশ্রণ দ্বারা ভরাট করে দেন। ধর্মপাল তখন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ১৬ ডিসেম্বর গয়াতে আহূত বিহার প্রান্তীয় কংগ্রেস কমিটির সম্মেলনে ভদন্তকে শ্রী নিবাস খরে মহাবোধি সোসাইটির প্রতিনিধি রূপে সন্মেলনে যোগদান করেন। উক্ত সম্মেলনে বাবা রামোদর দাস ও (রাহুল সাংকৃত্যায়ন) উপস্থিত ছিলেন। তিনি সোসাইটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সর্বতোভাবে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।

সম্মেলনে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে বুদ্ধগয়া বিহার উদ্ধার হেত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি সমর্থন প্রদান করবে। সর্বোপরি বিবাদ নিবারণ হেতু একটি কমিটি গঠিত হয় এবং উক্ত কমিটিতে ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং ধর্মপাল যুক্ত হন। বাবা রামোদর দাস এবং স্বামী সত্যদেবের প্রচেষ্টায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি বিহারপ্রদেশ কংগ্রেস কমিটি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদকে বুদ্ধগয়া বিহার বৌদ্ধদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য একটি রিপোর্ট তৈরি করতে বলেন এবং তিনি ধর্মপালকে তাঁর সহযোগী রূপে কমিটিতে স্থান দেন। কিন্তু কোন কারণে এই কাজ অসামপ্তই থেকে যায়। পুনঃ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে বেলগাঁও (কেলগ্রাম) কংগ্রেস এই সমস্যাটি বিষয় সমিতির সম্মুখে উত্থাপন করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি ড. প্রসাদকে পুনঃ রিপোর্ট তৈরি করতে বলেন। ঐ বছরেই বর্মি বৌদ্ধ অ্যাসোসিয়েশনও বুদ্ধগয়া বিহার সমিতি নির্মাণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধগয়া বিহার ও তার ভূমিতে বৌদ্ধদের অধিকার সুনিশ্চিত করা।২২

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীলংকার সিলোন অনারেরি চিপন্স অ্যাসোসিয়েশন লর্ড রিভিঙকে একটি পত্রে বৌদ্ধদের এই প্রাচীন বিহার বৌদ্ধদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। অপরটিকে রাজেন্দ্র প্রসাদ সমিতির বৈঠকে ধর্মপালকেও আমন্ত্রণ জানানো হয় কিন্তু তিনি এই সময় ইংল্যান্ড চলে যান। অতঃপর দেবপ্রিয় বলিসিহ এবং সি. জয়বর্ধন সেই বৈঠকে যোগ দেন। বলিসিংহের আগ্রহ ছিল যে বুদ্ধগয়া বিহার সম্পূর্ণরূপে বৌদ্ধদের হাতে আসুক কিন্তু সমিতি বিহারের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ৪ জন বৌদ্ধ এবং ৪ জন হিন্দু দ্বারা কমিটি গঠনের পক্ষে মত দেন এবং তা সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিও স্বীকার করে নেয়। এই সময় ধর্মপাল বিহার বিবাদের প্রশ্নটি মহাত্মা গান্ধীর সামনে তুলে ধরেন। মহাত্মা গান্ধী ধর্মপালকে জানান— “আমি আপনাকে সহযোগিতা করতে চাই, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, যদি ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে তাহলে এই সমস্যা এক লহমায় সমাধান হয়ে যাবে।”

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে উ-রোক-কিয় (বার্মা) ভারতের গভর্নর জেনারেলকে ভারতীয় বিধানসভার গ্রীষ্মকালীন অধিবেশনে বুদ্ধগয়া বিহার সংক্রান্ত বিল পেশ করতে অনুরোধ জানান এবং গভর্নর জেনারেল তাকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাসও দেন কিন্তু এই সময় বার্মা ভারতবর্ষ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এই বিল পেশ রদ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে অত্যাধিক পরিশ্রমের ফলে অনাগারিক ধর্মপাল ক্রমশই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২৯ এপ্রিল সারনাথে নির্বাণ লাভ করেন। বুদ্ধগয়া বিহার উদ্ধার তাঁর জীবনকালে সম্পূর্ণ হয়নি। কিন্তু তাঁর এই আন্দোলন পরবর্তীকালে আরও গতিমান হয়েছিল।

আকর কুঞ্চিকা:

১। গিরনার শিলালেখ, ৮।

২। মহাবংশ, ১০, ১।

৩। বুদ্ধগয়া টেম্পল— ইট্স হিস্ট্রি, ডি. কে. বড়ুয়া, পৃ. ১১।

৪। রাজেন্দ্র লাল মিত্র, বুদ্ধগয়া-এ দ্য গ্রেট বুড্ডিষ্ট টেম্পল দ্য হার্মিটেজ অফ শাক্যমুনি, পৃ.-২৪১-২৪২।

৫। ইন্ডিয়ান হিস্ট্রোরিাক্যাল কোয়ার্টারলি, ১৯৩০, পৃ. ২৬।

৬। বুদ্ধগয়া টেম্পল— ইট্স হিস্ট্রি, ডি. কে. বড়ুয়া, পৃ. ৪৭।

৭। গৌড় লেখমালা, পৃ. ৮৯।

৮। বুদ্ধগয়া টেম্পল— ইট্স হিস্ট্রি, ডি. কে. বড়ুয়া, পৃ. ৫৭।

৯। প্রাগুক্ত, পৃ. ৭২।

১০। দ্য মহাবোধি অ্যান্ড দ্য ইউনাইটেড বুড্ডিস্ট ওয়ার্ল্ড, খণ্ড ২৯ পৃঃ- ৩২৭।

১১। উইলিয়াম এডুউইন আর্নল্ড, ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অফ হিজ লাইক অ্যান্ড কনট্রিবিউশন টু বুড্ডিজম,

পৃ. ৫০।

১২। ভিক্ষু সংঘরক্ষিত, অনাগারিক ধর্মপাল, পৃ. ৮৫।

১৩। বুদ্ধগয়া টেম্পল— ইট্স হিস্ট্রি, পৃ. ৮৭।

১৪। প্রাগুক্ত, পৃ. ১২।

১৫। ভিক্ষু সংঘরক্ষিত, অনাগারিক ধর্মপাল, পৃ. ৫৯-৬২।

১৬। এ গাইড অফ বুদ্ধগয়া, ভি. দেবপ্রিয়, পৃ. ৫৮-৬০।

১৭। লন্ডন টাইমস, (১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ)।

১৮। প্রাগুক্ত।

১৯। এ. কানিংহাম, মহাবোধি প্রস্তাবনা, পৃ. ১১।

২০। আর কি. লাল, বুদ্ধগয়া পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট, পৃঃ ১৪।

২১। সিলভা লেবী, হিস্ট্রি অফ গ্রেট মহাবোধি টেম্পল অ্যান্ড বুদ্ধগয়া, খণ্ড ২০, নং-৯, পৃ. ২২৭/

২২। বুদ্ধগয়া টেম্পল– ইট্স হিস্ট্রি, ডি. কে. বড়ুয়া, পৃ. ১০৯।

 

No comments:

Post a Comment