Thursday, February 23, 2023

শতাব্দীর সূর্য: সুনীতিকুমার পাঠক


 সুমনপাল ভিক্ষু 

মহামান্য আচার্য, শতাব্দীর সমান বয়সী। ভগবান বুদ্ধের প্রদর্শিত মার্গের তিনি অক্লান্ত পান্থ। দেবী সরস্বতীর কাব্যবনে তাঁর অবাধ গতায়াত– পরমহংস। জীবনমন্থনজাত বিষ নিজে পান করে নিত্য জগতজনের জন্য তিনি করুণার অমৃতধারা বর্ষণ করে চলেছেন। তাঁর ক্ষণিক সান্নিধ্য যাঁরা পেয়েছেন তাঁদের হৃদয়ে যে তাঁর আসন চিরস্থায়ী পাতা হয়ে রয়েছে। সদা-জাগ্রত স্মৃতিমান অবদূতকল্প জীবনচর্যার সঙ্গেই অন্বিত ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রবাহিত বুধমণ্ডলীর বোধিচর্চার ধারা যা অধ্যাপক পাঠক উত্তর সাধকরূপে চিহ্নিত করেছে। সকলের বোধিলাভের জন্য যে নিত্য অপেক্ষা তা বোধিসত্ত্বচর্যার আভাস দেয়। মৈত্রী, করুণা, মুদিতা আর উপেক্ষার সমন্বয়ে আপনার উজ্জ্বল দৃষ্টি জ্যোর্তিময়লোকে প্রসারিত। জীবনের কান্না-হাসির দোলার মধ্যে নিবাত নিষ্কম্প্র শিখার মতোই আত্মদীপ ও আত্মদ্বীপ হয়ে থাকা। সাধকের জীবন অনুরক্তির দুর্লভ মেলবন্ধনে গড়া তাঁর মানসলোক। অধ্যাপক পাঠকের গবেষণার ক্ষেত্র বহুমুখী। তার ফলে দেশে-বিদেশে নানা বিষয়ের পণ্ডিতদের ভিতর তিনি সুপরিচিত। তিব্বতী ভাষায় রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি কবিতার অনুবাদ দিল্লির সাহিত্য আকাদেমি থেকে কবির শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান বর্ষে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের বহু সংখ্যক বাংলা কবিতা তিনি তিব্বতী ভাষায় রূপান্তর করেন। তিব্বতী সাহিত্য—তিব্বতী সাহিত্যের দুটি মূল শাখা : (১) অনুবাদ সাহিত্য। (২) স্বকীয় তিব্বতী সাহিত্যে। উপরোক্ত সাহিত্য সাধারণত বুদ্ধবচন (কাঞ্জুর ও তাঞ্জুর) এবং বুদ্ধশিষ্য ও বৌদ্ধশাস্ত্রকারদের রচিত গ্রন্থ। বুদ্ধবচন সংকলনে প্রায় সাত হাজার বৌদ্ধ গ্রন্থের অনুবাদ মেলে। অন্যদিকে তিব্বতের বিদ্বানদের রচিত স্বকীয় বৌদ্ধ সাহিত্যের সংখ্যাও অনেক। অধ্যাপক পাঠকের তিব্বতী সাহিত্যের গবেষণায় দু'ধরনের সাহিত্যের উপর যেমন অসামান্য পরিচয় মেলে তেমনি বিশেষ বিশেষ গ্রন্থের উপর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অনেকগুলি নিবন্ধ আছে।হিমালয়ে বৌদ্ধদের আধুনিক সাহিত্য বিষয়ে তিনি বিশেষ আলোকপাত করেন। তিব্বতী স্রোতের ভারতীয় পণ্ডিতদের জীবনকথা ও কৃতিত্বের কথা বাংলা ভাষায় ভাবানুবাদ করেছেন তিনি। বৌদ্ধবিদ্যা ও বুদ্ধপ্রসঙ্গ : অধ্যাপক পাঠকের বৌদ্ধবিদ্যায় প্রবেশের কথা তিনি প্রায়ই বলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি বিভাগে এম.এ. পড়ার আগে থেকেই ভারতীয় ভাষা ও বৌদ্ধ বিদ্যার উপর অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁর জীবনে প্রথম বাংলায় ছাপার অক্ষরে নিবন্ধ ‘প্রাকৃত ভাষা ও সংস্কৃত ভাষা’ ১৯২৩ সালে কৃষ্ণনগর লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত। পরে বুদ্ধ প্রসঙ্গে ও বৌদ্ধ বিষয়ে বাংলায় নানা আকারে প্রকাশিত নিবন্ধ সংখ্যা প্রায় ৫০টি। বিস্তারিতভাবে তা আর উল্লেখ করা হল না। তার ভিতর গবেষণামূলক লেখা জগজ্জ্যোতি, নালন্দা প্রভৃতি বৌদ্ধ পত্রিকায় অনেকগুলি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। জীবন হল পথ চলা, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি এই চলা উপনিষদের ভাষায় চরৈবের্তী চরৈবের্তী— এগিয়ে চল এগিয়ে চল। অধ্যাপক পাঠকের সান্নিধ্যে কত মানুষ এসেছেন কত ছাত্র-ছাত্রী এসেছেন, দেশ-বিদেশের কত মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় তা অন্যত্র আলোচনার বিষয়। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে প্রায় ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Ph.D. উপাধি লাভ করেন। ভারতের বহু শিক্ষা সংস্থানের সঙ্গে তাঁর আজও নিবিড় সম্পর্ক কোথাওবা প্রশাসনিক পরামর্শদাতা হিসেবে, কোথাওবা অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার উপদেষ্টা, কোথাওবা পরিসংবাদ গোষ্ঠীর অংশগ্রহণকারী প্রবক্তা। এই তালিকা অনেক বড়। কোলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সোমা ডি কোরস্ প্রফেসর হিসেবে পদমর্যাদা লাভ করেন। তাঁর বিদেশ ভ্রমণের তালিকাও অনেক বড়। একদিকে যেমন ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিব্বতী অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার সর্বক্ষণের সুযোগ তাঁর মিলেছে, তেমনি বৌদ্ধ বিদ্যার আধুনিক স্থিতি প্রত্যক্ষভাবে জানারও সুযোগ তার ঘটেছে। আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তিনি যাত্রা করেছেন। তাঁর একনিষ্ঠতা সবাইকে আকৃষ্ট করে।অধ্যাপক পাঠক একদিকে বাংলা হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় বৌদ্ধতন্ত্রের উপর আলোচনা করেছেন, অন্যদিকে আধুনিক পরিবেশ বিজ্ঞান ও বৌদ্ধমত ও পথের উপর নিবন্ধ লিখেছেন। একটি বিশালগাছ মাথা যার আকাশে ঠেকেছে । সুনীতিকুমার পাঠক। বৌদ্ধ জ্ঞানের সংরক্ষণ সংস্কৃতি কিরকম ? কিভাবে তা স্মৃতি থেকে অক্ষরবদ্ধ করা হয়েছে ? পুথির পাতায় লিপিবদ্ধ সেই জ্ঞান মোনাস্ট্রির গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারে জমা পড়েছে । কিভাবে তা শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে জ্ঞানার্থীদের তৃষ্ণা নিবারণ করেছে। যা হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তা কিভাবে দেশে দেশান্তরে রূপে রূপান্তরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। শ্লোকের পর শ্লোক ,শাস্ত্রের পর শাস্ত্র। তিনি জ্ঞানবৃদ্ধ জ্ঞানের পরিমাপে ও বয়ঃক্রমে । মানসিক ও শারীরিক সাসামর্থ্যে তরুণ আজও। ধরণীর ধূলিতলে কতো মানব সন্তান আসে, কতো চলে যায়। এই যাওয়া আসার তাঁর জ্ঞানসাধনা এতই প্রভূত ও প্রোজ্জ্বল যে তাঁর জ্ঞানদ্যুতি ছড়িয়ে রয়েছে বাংলা, তিব্বত, পালি, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষার রচনায়। তাঁর জ্ঞানস্পৃহা এই শতাব্দীর দ্বার প্রান্তেও আমাপর প্রেরণা যুগিয়ে চলেছে যে বয়স একটি সংখ্যামাত্র মহার্ঘ জ্ঞানভূমির মহাতপস্বী তিনি। নির্লিপ্ততা ও ঔদার্য, নিষ্ঠা ও সারল্য, স্নেহ ও গাম্ভীর্যতা একজন প্রকৃত ঋষিরই জঙ্গম অবয়ব তুল্য। তিনি প্রাচার্য-আচার্য। শিক্ষা বিভায় কতো কতো শিক্ষানবীশ যে শিক্ষার আলোর ঝরণাধারায় স্নাত হয়েছে তা তুলনাতীত। তাঁর শিক্ষাদ্যুতিতে কতো কতো মানবের মনের কালিমা মুছে জ্ঞান-জোছ্নায় সিক্ত-পরিসিক্ত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! শিক্ষাচার্য রূপে তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম্। প্রফেসর পাঠক মহোদয় এক বিশাল মহিরুহ, তার সান্নিধ্যে না গেলেই বুঝতে পারতাম না তিনি যে কত উদার প্রকৃতির ও ছাত্র বাৎসল। তাঁর কাছে যখনই গেছি তিনি উদার করে দিয়েছেন তাঁর বিদ্যার ভান্ডার এক কথায় অবারিত দ্বার। তাঁকে যতই দেখি আর দেখেছি বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়েছি মহাসমুদ্রের মত অতলান্ত জ্ঞানের গভীরতা। তিনি এইটুকু ক্লান্তির অবসাদ দেখিনি কিংবা কোন কার্পণ্যতা পরিলক্ষিত হয়নি। আমাকে তিনি পুত্রসম স্নেহ আর করেন আরো পেয়েছি মাসি'মার থেকেও। স্যারকে জিজ্ঞেস করেই বা তাঁর পরামর্শ নিয়েই অনেকট পথ পারি দিতে পারছি। সেটা লেখালেখি হোক, প্রকাশনা হোক, সম্পাদনা হোক আর সেমিনার হোক তাঁর দেখানো তথা নির্দেশিত মার্গেই নিষ্কন্টক হয়েছে সর্ব শাখায়। মহাকালের কাছে প্রার্থনা এবং তাঁর আলো স্বভাবতই প্রকাশমান, সেই আলো আমাদের দরযানী দৃষ্টি প্রদান করবে আমরা সেই আলোর গানের সঙ্গে মহাকবি রবীন্দ্রনাথের জীবনদৃষ্টি আমাদের ছুঁয়ে থাকুক– “ধরণীর পরে শিথিল-বাঁধন ঝলমল প্রাণ করিস্‌ যাপন, ছুঁয়ে থেকে দুলে শিশির যেমন শিরীষ ফুলের অলকে! মর্ম্মর টানে ভরে’ ওঠ্‌ গানে ধু অকারণ পুলকে!” আপন উদ্দেশে বিস্ময়বিমুগ্ধ মৈত্রী নিবেদন ছাড়া আর কীই বা করার আছে। তিনি শতবর্ষের আলিঙ্গনে এবং শতাব্দীর সূর্য হয়ে সদা বিরাজমান থাকুক।

No comments:

Post a Comment