Thursday, January 13, 2022

সূর্যের পবিত্র সূর্যাস্ত

 ভিক্ষু সুমনপাল 

ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম সূর্যসেন, এক মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী। সূর্যকুমার সেন মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত। ভারত উপমহাদেশে যে মানুষটি প্রথম ব্রিটিশদের দাম্ভিকতায় প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছিলেন এবং পরাধীন ভারতে চট্টগ্রাম সশস্ত্র অভ্যুত্থান, স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন, ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ইণ্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগীর নাম।

ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাস্টারদা পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া এই বাঙালি বিপ্লবী ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের ঘটনার জন্য তিনি ইতিহাস খ্যাত। এমনকি তাঁকে স্বাধীন ভারতের ভিত্তি বললেও অত্যুক্তি হবে না।

সূর্য সেনের অন্যতম সঙ্গী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায় "কে জানতো যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে?  ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ ! কে জানতো সেই শীর্ণ বাহু ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে - তার সমস্ত ক্ষমতাকে উপহাস করে বৎসরের পর বৎসর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?" তাঁকে ধরিয়ে দেবার জন্যে ব্রিটিশরা হাজার হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেও কেউ তাঁকে ধরিয়ে দিতে চায়নি। চট্টগ্রামের জনসাধারণ বলত টাকা দিয়ে সূর্য সেনকে ধরা যায় না যদিও নেত্র সেন পুরস্কারের লোভে মাস্টারদাকে ধরিয়ে দিয়েছিল  

সূর্য সেন এমন এক জাতীয় আন্তর্জাতিক যুগসন্ধিক্ষণে অবর্তীর্ণ হয়েছিলেন, যার দরুণ বিপ্লবী ভাবধারায় দীক্ষিত সূর্য সেন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকে একমাত্র তপস্যা হিসেবে নিয়েছিলেন। তখন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত রক্ষা আইন ১৯১৬, রাউলাট আইন ১৯১৯-এর মতো কালাকানুন তৈরি করে স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছে। রাউলাট আইনের প্রতিবাদে গণবিক্ষোভে গুলি চালিয়েছে, জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, হাজার হাজার কর্মীকে কারারুদ্ধ করেছে, কিন্তু আন্দোলন স্তব্ধ হওয়ার পরিবর্তে আরো ব্যাপক তীব্র রূপ নিয়েছে। 

১৯১৮ সালে চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের সঙ্গে মিলে সূর্য সেন যুগান্তর দলকে সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ব্যক্তিগত হত্যা, প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন ব্রিটিশকে হত্যা করলে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে; কিন্তু ভারতবাসীকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো যাবে না। আবার অহিংস পথে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না। প্রচণ্ড আন্দোলনের চাপ সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমেই কেবল স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব। কারণে ধৈর্য আর যত্ন নিয়ে সংগঠন গড়ে তুলেছেন তিনি। ব্রিটিশ সরকার সব বিপ্লবী নেতা কর্মীদের বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করতে থাকলে সূর্য সেন দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকেন।

১৯২৪ সেপ্টেম্বর  চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় একটি অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় মাস্টারদার নাম শোনা যায়। এই কারণে নং বেঙ্গল অর্ডিনেন্স ঘোষণা করে সারা বাংলায় বিপ্লবীদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার করা হয়। শুধু ২৫ অক্টোবর তারিখেই বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২০০ বিপ্লবী কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময় গ্রেফতার হন নেতাজী সুভাষ, অনিলবরণ রায় প্রমুখ নেতারাও। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে মাষ্টারদা কোলকাতা শোভাবাজার আশ্রয় নেন। ওই সময় তাঁরা কোলকাতার দক্ষিণেশ্বরে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিতেন।

১৯২৫ নভেম্বর ১০ সেখানে পুলিশ হানা দেয়। সূর্যসেন গায়ের জামা খুলে খালি গায়ে একটা অপরিষ্কার ময়লা গামছা কাঁধে ফেলে চায়ের কেতলি হাতে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসেন। পুলিশ তাঁকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সাদাসিদাভাবে বলেন, বাবুলোকদের জন্য চা আনতে যাচ্ছেন। পুলিশের দারোগা কিছুক্ষণ জেরা করার পর সন্দেহ করার মতো কোনো কিছু না পেয়ে তাঁকে ছেড়ে দেন।

১৯২৬ সালে সূর্য সেন পলাতক অবস্থায় কোলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রীটের এক মেসে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। প্রথমে মেদিনীপুর, তারপর মোম্বাইয়ের রত্নগিরি বেলগাঁও জেলে রাখা হয়। মাস্টারদা যখন রত্নগিরি জেলে আটক, তখন তাঁর সহধর্মীনির কঠিন টাইফয়েড রোগ হয়েছিল দেওয়ান বাজারের যে বাড়ি থেকে মাস্টারদা পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর সহধর্মীনি সেখানে তখন মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। পুলিশ পাহারায় রত্নগিরি জেল থেকে ছুটিতে চট্টগ্রাম আনা হয় মূমুর্ষু সহধর্মীনিকে দেখার জন্য, তাঁর সহধর্মীনির আয়ু নিঃশেষিত প্রায়। সূর্য সেনের সহধর্মীনি বিপ্লবী কাজ-কর্মে তাঁকে নেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে বয়োকনিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছে অনু্যোগ করতেন। স্বামীর কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা পুষ্প দত্ত। 

১৯২৮ সালে বন্দিজীবন অতিবাহিত করে মাস্টারদা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। কংগ্রেসের কোলকাতা অধিবেশনে সুভাষ চন্দ্র বোসের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি আর গান্ধী নেহরুর Dominion status বা ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিকে কেন্দ্র করে তীব্র মতবিরোধ, বিপ্লবী নেতাদের সুভাষ চন্দ্রের প্রতি সমর্থন। সূর্য সেন তখন চট্টগ্রাম কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। 

১৯২৯ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর লাহোর জেলে একটানা ৬৩ দিন অনশন করে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মারা যান। বিক্ষোভ মিছিল সভায় নেতা সূর্য সেন বিপ্লবের পরবর্তী কার্যক্রমের পরিকল্পনা সদস্যদের সামনে তুলে ধরেন।

১৯৩০ সালের ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রকাশ্য রাস্তায় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সূর্য সেন স্বাক্ষরিত ইশতেহার ছড়ানো হলো।দেশের দিকে দিকে স্বাধীনতার তুর্য ধ্বনি শোনা যাইতেছে, সর্বত্র আইন অমান্য সংগ্রামের আরম্ভ হইয়াছে। ১৯২১ সালে যেই চট্টগ্রাম ছিল সবার পুরোভাগে, আজ সেই চট্টগ্রাম পশ্চাতে পড়িয়া থাকিবে, ইহা ক্ষোভ লজ্জার কথা কালবিলম্ব না করিয়া আমরাও ২২ এপ্রিল হইতে আইন অমান্য করিব স্থির করিয়াছি। ইহার জন্য সর্বসাধারণের সহানুভূতি চাই, সত্যাগ্রহী সেনা চাই, লোক টাকা চাই। ইশতেহার ছিল সূর্য সেনের ব্রিটিশ সরকারকে বিভ্রান্ত করার এক কৌশল। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তিনি ধীরে ধীরে যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম বিদ্রোহ, অস্ত্রাগার দখলের, তার তারিখ ঠিক করে রেখেছিলেন ১৮ এপ্রিল।

সূর্য সেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। তিনি তাঁর ঘোষণায় বলেন: "The great task of revolution in India has fallen on the Indian Republican Army. We in Chittagong have the honour to achieve this patriotic task of revolution for fulfilling the aspiration and urge of our nation. It is a matter of great glory that today our forces have seized the strongholds of Government in Chittagong. The oppressive foreign Government has closed to exist. The National Flag is flying high. It is our duty to defend it with our life and blood".

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটেছিল। মাস্টারদা এই অভ্যুত্থানের অবিসংবাদী নেতা। প্রশস্ত কপাল, শীর্ণকায় অতি সাধারণ এক নিরীহ শিক্ষক, চোখে পড়ার মতো কিছুই নয়, অতি সাধারণ চেহারার এই অসাধারণ মানুষটি একদল অসামান্য দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বিপ্লবী তৈরি করেছিলেন। নির্মল সেন, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, অপূর্ব, অনন্ত সিংহ, প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তের মতো অসংখ্য মানব স্ফুলিঙ্গ তাঁর হাতে গড়া।

২২ এপ্রিল ১৯৩০ সালে বিপ্লবীরা  যখন জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাদের আক্রমণ করে দুই ঘণ্টার প্রচণ্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী  বাহিনীর ১২ জন শহীদ হন। জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধের পর মাস্টারদা গেরিলা পদ্ধতিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় কোলকাতা থেকে প্রখ্যাত ব্যারিস্টার শরৎ বোস বিপ্লবীদের পক্ষে মামলা পরিচালন করতে ছুটে এসেছিলেন চট্টগ্রামে। তিনি মাস্টারদার কাছে গিয়ে বললেন যে তিনি মাষ্টারদাকে এমন জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পারেন যেখানে তিনি ইংরেজদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে পারেন। প্রতিউত্তরে মাস্টারদা বললেন চট্টগ্রাম তিনি এক মুহূর্তের জন্যেও ছাড়তে পারবেন না। তিনি চিরবিদ্রোহী, বিপ্লব তার রক্তে। দেশের জন্যে তিনি প্রাণ দিতে পারেন কিন্তু চট্টগ্রাম তিনি ছাড়তে পারবেন না। মৃত্যুর আগে বিপ্লবী সূর্য সেনকে পিটিয়ে শরীরের সমস্ত হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো ভারী কিছু দিয়ে সাংঘাতিক আঘাত করে ভেঙে ফেলা হয়েছিলো বিপ্লবীর দাঁত উপড়ে ফেলা হয়েছিলো হাত পা এর সমস্ত নখ তৎকালীন বৃটিশ সরকার বর্বর আচরণ করেছিলো তাঁর সাথে মাস্টারদার নেতৃত্বেই চট্টগ্রামে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে 'চট্টগ্রাম স্বাধীন জাতীয় সরকার' প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করা হয়। হতে পারে তিন/চার দিনের জন্য, তবু মাস্টারদা তাঁর সহযোগীরা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, মাস্টারদার বিস্ময়ে থমকে গিয়েছিল ভারতবর্ষ |

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের দিন) অন্যতম একটি পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ কিন্তু গুড ফ্রাইডে থাকায় সেদিন ক্লাবে কেউ ছিল না।

অম্বিকা চক্রবর্তী এবং সেসময় গ্রেপ্তার হওয়া অন্য বিপ্লবীদের নিয়েদ্বিতীয় অস্ত্রাগার লুন্ঠন (দখলের) মামলাশুরু হয়। প্রায় ১৯ মাস বিচারের পর ১৯৩২ সালের মার্চঅস্ত্রাগার লুন্ঠন (দখলের) মামলাররায়ে অনন্ত সিং, লোকনাথ বল এবং গনেশ ঘোষসহ ১২ জনকে দ্বীপান্তর বাসের আদেশ দেয়া হয়।

মাস্টারদাই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন যে দেশের মেয়েরাও স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিতে পারে মাস্টারদাকে প্রীতিলতা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘মেয়েদের আপনারা দলে নিতে চাইতেন না কেন দাদা ? তাঁরা কি দেশসেবার যোগ্য নন ?’’ মাস্টারদা জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘না, দেশসেবার কঠিন কর্তব্য থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা চলে না। দেশসেবায় নরনারী ভেদ নেই।

মাস্টারদা সূর্য সেন স্থির করেন ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ ইউরোপীয় ক্লাবে প্রীতিলতার নেতৃত্বে হামলা করা হবে। প্রসঙ্গে মাস্টারদা লিখেছেন :- "বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপোল পর্যন্ত এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই- আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পেছনে নেই

সূর্য সেন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গোর্খা সৈন্যরা স্থানটি ঘিরে ফেলে। ব্রজেন সেনের সহোদর পুরস্কারের লোভে নেত্র সেন বিশ্বাসঘাতকতা করে সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়। সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। পরবর্তীতে সেই নেত্র সেনের আর অর্থ পুরস্কার পাওয়া হয়নি কারণ মাস্টারদার অনুগামী এক বিপ্লবী তাকে হত্যা করে। সূর্যসেন ধরা পড়েন। ১৯৩৩ সালে সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তের বিশেষ আদালতে বিচার হয়। ১৪ আগস্ট সূর্যসেনের ফাঁসির রায় হয়।

ঐতিহাসিক নথি ঘেঁটে দেখা যায়, আলীপুর কারাগার থেকে আসা কয়েদি শিবু রাগাদি জল্লাদ হিসেবে সূর্যসেন তারকেশ্বরের ফাঁসি কার্যকর করেন। ফাঁসির পর বিপ্লবীদের মরদেহ তাঁদের স্বজনদের কাছে দেওয়া হয়নি।

১৯৩৩ সালে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করা হয়েছিল বিপ্লবীদের। এই ট্রাইব্যুনালের সভাপতি ছিলেন ডব্লিউ ম্যাকশ। রায় বাহাদুর রাজকুমার ঘোষ খন্দকার আলী তৈয়ব ট্রাইব্যুনালের সদস্য ছিলেন। রায়ের আদেশে সূর্যসেন তারকেশ্বরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কল্পনা দত্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

এক বছর জেলহাজতে অমানুষিক নির্যাতন শেষে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল মাস্টারদার। ক্ষত-বিক্ষত সোনালী স্বপ্নের সেই পাথর বুকে নিয়ে বঙ্গোপসাগরের সলিল সমাধিতে ঘুমিয়ে আছেন সূর্য সেন সমাজে সূর্যোদয় করিয়ে  জাতির ইতিহাসে শহীদ সূর্যসেন অমর অক্ষয়। অবিভক্ত বাংলার মুক্তির বিপ্লবের ইতিহাসে আজও তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী বীর।

মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

আমার শেষ বাণীআদর্শ একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো আমার সাধনার সময়। এই তো আমার বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময়, হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ করার এই তো সময়।

কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমরা ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্রহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা বন্ধুরাএগিয়ে চল, এগিয়ে চলকখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন।

১৯৩০ এপ্রিলের ১৮ চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনো দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলদা, চন্দননগর ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।

আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসেএই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে।

চট্টগ্রাম কারাগার                                                                                            বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক

১১ জানুয়ারি, ১৯৩৪,                                                                                       বন্দেমাতরম                            সকাল ৭টা।                                        

এটা এক মহান বিপ্লবীর শেষ বাণীএটা সাহিত্যের পাতা থেকে তুলে আনা চিঠি নয়। এই চিঠি যুগপুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেনের। শতবর্ষের পরাধীনতার অন্ধকার বিদীর্ণ করে সূর্যের মতোই উদিত হয়েছিলেন তিনি ভারতের পূর্বদিগন্তে। তাঁর তীব্র তেজে ক্ষণিকের জন্যে হলেও শুধু যে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকের দম্ভ চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল তাই নয়, ভেঙে গিয়েছিল পরাধীন ভারতবাসীর প্রায় দু বছরের বিরামহীন নিদ্রাও। বর্তমানে আমরা ভারতবর্ষের তথা উভয় বঙ্গের নতুন প্রজন্ম কি করছে কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে তা ভাবনার বিষয়। কিংবা আমাদের পূর্ব অভিভাবকরা তাদের সন্তান-সন্ততি উত্তর প্রজন্মকে কোনদিকে ঠেলে দিচ্ছেন।  দেখি শুধুই স্বার্থপরতা আর সংকীর্ণতা। আসুন আলোকিত হই সেই মহজীবন মাস্টারদার মহান আত্মাহুতিদানের আলোয়।

 

 আকর কুঞ্চিকা :

 

১.  অনন্ত সিংহ। অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম। কোলকাতা: বিদ্যোদয় লাইব্রেরি।

. পাল, রুপময় (১৯৮৬) সূর্য সেনের সোনালি স্বপ্ন। কোলকাতা: দীপায়ন।

. দস্তিদার, পূর্ণেন্দু (২০০৯) স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম। কোলকাতা: অনুপম প্রকাশনী।

. সৌমেন্দ্র কুমার গুপ্ত, সূর্যসেন স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৯৯৫) বহরমপুরে মাস্টারদা: কিছু  জিজ্ঞাসা।

     বহরমপুর: সূর্যসেনা প্রকাশনী।

আমি সুভাষ বলছি। প্রথম খণ্ড শৈলেশ দে। বিশ্ববাণী প্রকাশনী। কোলকাতা। অগ্রহায়ণ, ১৩৭৫।

. চারুবিকাশ দত্ত, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, কোলকাতা

. অলকা নন্দিতা, শতবর্ষের সন্ত বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী, ২০১০, বাতিঘর, চট্টগ্রাম 

.  এস এম কে জাহাঙ্গীরপটিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্য, ১৯৯৮, চট্টগ্রাম

  Manini Chatterjee, DO AND DIE: The Chittagong Uprising : 1930-34,   1999, Penguin Books, 

      India.

১০. Dr. Suniti Bhushan Qanungo, THE CHITTAGONG REVOLT 1930-34, 1994, Kanungopara,

      Chittagong.

 

 

 

 

No comments:

Post a Comment