Thursday, July 21, 2016

জাতকে ব্যবসাবাণিজ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পথ পরিচিতি



শুভাশিস বড়ুয়া 
বিশ্বের প্রাচীনতম  সভ্যতার মধ্যে ভারতীয় সভ্যতার নিজস্ব মহত্ব পরিলক্ষিত হয় ভারতীয় সভ্যতার এই প্রচার প্রসারের কারন হল স্বর্ণ প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা এবং বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে নিজ মাতৃভূমির সীমানা পেড়িয়ে দূরবর্তী ও অনাবিষ্কৃত দেশ সমূহকে বাণিজ্যিক ক্ষেত্র রূপে পরিণত করেছিল প্রাচীনকাল থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ সমূহ সুবর্ণভূমি এবং সুবর্ণদ্বীপ নামে পরিচিত এবং নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতার জন্য ভারতীয় বণিকদের আকর্ষণে ক্ষেত্ররূপে পরিগণিত হয়েছিল সে সমস্ত দেশ প্রথম শতাব্দী থেকে শুরু করে পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ভারতীয় সংস্কৃতির প্রমুখ কেন্দ্ররূপে পরিচিত ছিল
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সমূহের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া খ্রীষ্ট জন্মের পূর্বেই শুরু হয়েছিল জাতক, কথাকোষ এবং বৃহৎকথা সঙ্গে বৌদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির আদান প্রদানও সুবর্ণ ভূমি ও সুবর্ণদ্বীপ গুলিতে সর্বাধিক মহত্বপূর্ণ অবদান বা অভিযানও উল্লেখ করা যেতে পারে যা থেকে স্পষ্ট উল্লেখ করা যেতে পারে ভারতীয়দের সে সব দেশ সম্পর্কে বেশ অবহিত ছিল ভারতীয় বণিকরা নিজেদের সাহসিক প্রয়াস এবং আন্তরিক সহযোগিতা মূলক ব্যবহার দ্বারা নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি, মিশর, রোম, থেকে শুরু করে চীন তথা তুর্কিস্থান পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং অন্যান্য দেশেও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই সফলতার সূত্র ধরে বণিকরা এবং ধর্ম প্রচারকগণও আয়াস স্বীকার করে নিজেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বীজ বপন করেছিলেন।
জাতককালীন ভারতীয় সংস্কৃতি ছিল বেশ সমুন্নত। এই সময় সুদৃঢ় আর্থিক সংগতির প্রধান ক্ষেত্র ছিল বাণিজ্যে। জাতকের আলোচনা থেকে জানা যায় যে, ৫০০ শকট নিয়ে বণিকরা বাণিজ্য করতে যেতেন। খুরপ্প জাতক, গুম্বিয় জাতক, মহাজনক জাতক ইত্যাদি জাতকে এর স্পষ্ট উল্লেখ পাই। তাদের যাত্রাপথ ছিলো অনেক কষ্টপ্রদ সেই চিত্রও বর্ণিত আছে। এছাড়া মহাজনক জাতকে কিছু যাত্রাপথকে সহজ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা সমুদ্রতট দিয়ে নিজেদের যাত্রা করত ব্যবসার উদ্দেশ্য। শঙ্খ জাতকের বর্ণনা অনুসারে শঙ্খ নামক এক ধনশালী ব্যক্তি ব্রাহ্মণ দরিদ্রদের দানধ্যানের জন্য সুবর্ণভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। যাত্রার সপ্তম দিনে জাহাজের নিম্মাংশে ছিদ্র হয়ে যাওয়ার কারনে তিনি খুবই সমস্যায় পড়েছিলেন। এই জাতকে আরো জানা যায় যে অনেকে বেনারস থেকেও সুবর্ণ ভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন। সুস্সোন্দি জাতকে সগ্গ নামক এক ব্যবসায়ী ভরুকচ্ছ মতান্তরে (মরুকচ্ছ) থেকে সুবর্ণ ভূমিতে যাত্রার বর্ণনা পাই। যাত্রাকালীন তার যাত্রার জাহাজ ভেঙ্গে যায় এবং একটি কাঠের সাহায্য নাগদ্বীপে পৌঁছায়, যেখানে বেনারসের রাজা তম্বের রাণী সুস্সোন্দি বন্দি ছিলেন। এই প্রকারে সুপ্পারক জাতকে ভরুকচ্ছ থেকে সুবর্ণভূমিতে যাত্রা সম্পর্কে বণিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়। সুপ্পারক নামক এক অন্ধ্র নাবিক সাতশ বণিকদের নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে এক বিশাল জাহাজে সুবর্ণভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। যাত্রার সাতদিন পর তারা তাদের যাত্রা পথ ভুলে গিয়ে চার মাস ব্যাপী অকুল সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়।
এরকম আরো অনেক জাতকের গাথায় উল্লেখ আছে যার থেকে স্পষ্ট হওয়া যায় যে সুবর্ণভুমি এবং সুবর্ণ দ্বীপের সমুদ্র যাত্রার দুঃসহ কষ্টের মধ্যে পড়তো তবুও ভারতীয় বণিকরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করত। বৌদ্ধ গ্রন্থ নিদ্দেশ ২৮টি স্থান ও ১০টি নতুন যাত্রা পথ ভারতীয় বণিকরা অবগত ছিলেন। যথাঃ- গুম্ব, তক্কোলা, তক্ষশীলা, কালমুখ, সরনপার, বেসুংগ, বেরাপথ, জাবা, তমলী, বঙ্গ, এলবরন, সুবন্নকুট, সুবন্নভুমি, তম্বপন্নী, সুপ্পারক, ভরুকচ্ছ, সুরট্ঠ, অঙ্গনেক, গণ্ডান, পরমগণ্ডান, যোন, পরমযোন, অল্লসন্দ, করুকস্তার, এবং দশ প্রকার পথ গুলো হল জন্নুপথ, অজপথ, মেন্ডপথ, শঙ্কুপথ, ছত্থপথ, বংসপথ, শকুনপথ, মুসিকপথ, দরিপথ, এবং বেত্তাধার ইত্যাদি।
বর্ণিত চৌত্রিশটি স্থান গুলি ব্যবসায়ীদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। মিঃ সিলভা লেডী এবং ভূগোল বেত্তা টলেমীও এই বাণিজ্য কেন্দ্র গুলির উল্লেখ করেছেন। এই সকল স্থান গুলিতে স্থলপথ ও জল পথ দিয়েই যেতে হত এবং এই যাত্রা পথ অত্যন্ত কষ্টসাধ্যও ছিল। এই দশটি পথের উল্লেখ বিমানবত্থু জাতক (৫৪১), মিলিন্দ প্রশ্ন, বায়ু পুরান (৪৭/৪/৫৪), মৎস্য পুরান (১২১/৫/৫৬) ইত্যাদি গ্রন্থে পাই।
নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, জাতক কালীন ভারতীয় সংস্কৃতি অত্যন্ত উন্নত ছিল এবং বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে ভারতীয় বণিকরা নিজেদের মহত্ব দ্বারা দেশের আর্থিক স্থিতি ও সমৃদ্ধিকে তুলে এনেছেন।৫ মহাবানিজ্য জাতকের গাথা থেকে জানা যায় যে, ভারত এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মেল বন্ধন হয়।৬ বহু সংখ্যক বণিকরা এক সাথে যাত্রা করতেন। তারা এক সাথে তাদের বাণিজ্যে যাত্রার পথে মনোরঞ্জনও করতেন।  ভারতীয় বণিকরা অদম্য উৎসাহী ছিলেন। তারা সমুদ্র যাত্রা ভালোভাবে উপভোগ করতেন, দিক নির্দেশনাও জানতেন এবং মৌসুমী বায়ু সম্পর্কে অবগত হয়ে তাদের সমুদ্র যাত্রা করতেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, বণিকরা স্থল পথ ও জল পথ উভয় পথেই যাত্রা করতেন।
ভারত ও চীনের মধ্যে ক্রমশ আসাম, উত্তর বার্মা এবং আনাম পর্যন্ত যাতায়তের পথ ছিল। চীনা ঐতিহ্য স্ত্রোত্র অনুসারে খৃঃ পুঃ ২য় শতাব্দীতে বণিকরা চীন থেকে তাদের যাত্রা শুরু করে সম্পূর্ণ উত্তর ভারত এবং আফগানিস্থান হয়ে ব্যাক্ট্রিয়া পর্যন্ত যেতেন। এই পথ দিয়ে উত্তর বর্মাকে প্রভাবিত করে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রাচ্য দেশ সমূহে পৌছাতেন। এই পথে চীনা পরিব্রাজক ইৎসিও গমন করেছিলেন। প্রধান স্থলপথ এবং এই সমুদ্র পথে অন্যান্য কেন্দ্র থেকে বার্মা এবং ইন্দোচীন প্রদেশে যাওয়ার সুবিধা ছিল। ভারত এবং বার্মার মধ্য দিয়ে আরাকান হয়ে অন্যান্য স্থলপথও ছিল। বার্মা থেকে ভারতীয় বণিকরা ক্রমশ থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশে যেতেন তারা দক্ষিণ বার্মা থেকে উত্তর মালয় দ্বীপও যেতেন। স্থলপথ ছাড়াও বেশীর ভাগ ভারতীয় বণিকরা জলপথে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ সমূহে আসা যাওয়া করতেন। ভারতীয় বনিকদের সমুদ্র পথ সম্পর্কে বেশি অভিজ্ঞ ছিলেন।  ভারতীয় বণিকরা পশ্চিম ও পূর্ব সমুদ্র উপকূলবর্তী বন্দর থেকে ভিন্ন ভিন্ন সমুদ্র পথে নিজেদের যাত্রা শুরু করতেন। জাতক, সংস্কৃত কথা সাহিত্য, বৌদ্ধ সাহিত্য ইত্যাদি থেকে অনেক উদাহরণ পাই। যেখানে ভারতীয় বন্দর সমূহ থেকে সুবর্ণভূমি তথা সুবর্ণ দ্বীপের সমুদ্র যাত্রার কথা বেশী জানা যায়।
ভারতের পূর্ব সমুদ্রতট বাংলার খাড়ি মোহনা তাম্রলিপ্তি (তমলুক) বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মিদনাপুর জেলায় অবস্থিত। এবং পশ্চিমে আরব সাগরের মরু কচ্ছ বা ভৃগু কচ্ছ প্রমুখ বন্দর ছিল। যেখান থেকে বণিকরা তাদের যাত্রা পথে গমন করতেন।
পেরিপ্লাস অফ দি ইরিস্ত্রিয়ান সী (যুনানী গ্রস্থ) থেকে জানা যায় যে, পূর্বতীর কমার (সম্ভবত বর্তমান কাবেরী পট্টনম) পোডুকে (বর্তমান পন্ডিচেরী) এবং শোপত্ম পলোরা ও (উড়িষ্যার গোপালপুর)সেই সময়ে মহত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। এই সব বন্দর থেকেও ছোট-বড় জাহাজ দূর-প্রাচ্য দেশ সমূহে যেতেন। ছোট জাহাজ গুলোকে সাগর এবং বড় জাহাজ গুলোকে কোলংদিয়া বলা হতো।১১ ভারত থেকে ফিরে যাওয়ার পর সময় ফা–হিয়েন এবং ইৎসিং তাম্রলিপ্ত থেকেই তাদের যাত্রা শুরু করেছিলেন। ক্ষেমেন্দ্র রচিত ‘রামায়ন’ মঞ্জরী তে ভারতীয়দের দ্বারা সমুদ্র দ্বীপে (সুমাত্রা) যাত্রার বর্ণনা পাই তথা জৈন গ্রন্থে সমরা ইচ্চ কথা হতে মহাকটাহের যাত্রার বর্নার থেকে জানা যায় যে, এই প্রদেশ গুলো থেকে বাণিজ্যের কম বেশী সময় পর্যন্ত চলেছিল।
সমরাইচ্চ কহার অন্য এক গাথা থেকে ও অবগত হওয়া যায় যে, সুবর্ণ ভূমির মতো ভারতীয় বণিকরা সুবর্ণ দ্বীপেও বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন। বৃহৎকথা শ্লোক সংগ্রহ এবং কথাকোষ থেকে এই কাহিনী কথা অনেক আছে। এই প্রকারে সুবর্ণদ্বীপ ও রত্নদ্বীপের কথাও জানা যায়। কথাসরিৎসাগর, এরূপ অনেক কল্প কথা আছে। যার থেকে ভারতীয়রা সুবর্ণদ্বীপ এবং কটাহ যাওয়ার উল্লেখযোগ্য সূত্র পাওয়া যায়। এসব কল্প কথার মধ্যে একটি কথা এতই মহত্বপূর্ণ যে এক দুঃখী পিতা যে নিজের হারিয়ে যাওয়া সন্তান ও ছোট বোনের খোঁজে এক ব্যবসায়ীর সাথে নারিকেলদ্বীপ, কটাহদ্বীপ, কপুরদ্বীপ, সুবর্ণদ্বীপ এবং সিংহলদ্বীপে যাত্রা করেছিলেন। এই প্রকার বিভিন্ন সাহিত্যে অনেক উদাহরণ এবং কল্পকথা থেকে অবগত হওয়া যায় যে, ভারতীয় বণিকরা অনেক সময়কাল পর্যন্ত সুবর্ণদ্বীপ এবং সুবর্ণ ভূমির দেশ সমূহে বাণিজ্যকে ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলেছেন। এইরূপে তারা স্থলপথের সাথে সাথে জলপথেরও সাহায্য নিয়েছিল। চীনা ঐতিহ্য থেকে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, ভারতীয় বণিকরা স্থলপথ অপেক্ষা জলপথকে অধিক বেশী স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন।
উত্তর ভারতের বিশেষ করে বেনারস এবং চম্পার ( ভাগলপুর) ব্যবসায়ীরা গঙ্গা নদীর জলপথে এবং স্থলপথে তাম্রলিপ্তিতে পৌছাতেন এবং সেই বন্দর থেকে সুবর্ণ ভূমি যাওয়ার জন্য সেখানকার বিভিন্ন বন্দরে পৌছে যেতেন। অতপর তিন প্যাগোডার পর্বত বেষ্টীত পথ দিয়ে মনামের মোহনায় পৌছোতেন১৭ এই পোন্ডতুক এবং প্র-প্রথোম নামক প্রাচীন কেন্দ্র ছিল। তাম্রলিপ্তি থেকে বার্মা যাওয়ার জাহাজ সামুদ্রিক তুফানের ভয় থাকতনা, কেনো কি সমুদ্র তটবর্তী পথে জাহাজ চালাতেন। বার্মার প্রধান নদী ইরাবতী এবং চিন্দবিনের মোহনায় তবো ইত্যাদি বন্দরে জাহাজের মালামাল নামাতেন এবং স্থলপথে বার্মার বিভিন্ন প্রদেশের- শ্যাম, কম্বোজ এবং চম্পা পর্যন্ত পৌঁছে যেতেন। বণিকরা কখনো কখনো তাম্রলিপ্তি অথবা পলোরা থেকে সোজা বঙ্গোপসাগর খাড়ি হয়ে গহীন সমুদ্রে হয়ে আন্দামান দ্বীপ থেকে উত্তর অথবা আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপ সমূহের মধ্যদিয়ে মালয় দ্বীপের পশ্চিম তীরে অবস্থিত বন্দর তফুআপা পৌঁছাতেনসেখান থেকে স্থলপথে মালয়ের পূর্বে স্থিত ছৈয়া বন্দর পৌঁছে আবার প্রয়োজনানুসারে ইন্দো-চীনের দেশ সমূহে এবং সুবর্ণ দ্বীপের দেশ সমূহেও যেতেন। এই পথ অত্যন্ত দীর্ঘ এবং কষ্টপ্রদ ছিল। এবং যাত্রীরা কখনো কখনো ভারতের পূর্ব তটের মধ্যে স্থিত বন্দর কমার বা পোন্ডুক থেকে নিজেদের যাত্রা শুরু করে গহীন সমুদ্র হয়ে আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপগুলোর মধ্য দিয়ে বা আন্দামানের উত্তর থেকে তফুআপা বন্দরে পৌঁছে যেতেন। এখানেও মালপত্র খালাস করতেন। পরবর্তী মর্জি মতো স্থলপথ হয়ে পূর্বে স্থিত ছৈয়া বন্দরে পৌঁছাতেনএই সব জায়গায় প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রি দ্বারা সেই সব প্রদেশের প্রাচীন আভাস পাওয়া যায়। তকু আপা থেকে ছৈয়া বন্দরে পৌছে দক্ষিণে বৈন্ডো, পটলুগ, সিগনোরা, কেডাহ বন্দরে অবস্থান করে দক্ষিণ চীন সাগর কেন্দ্র জাবা, সুমাত্রা, বোর্ণীও এবং বালী দ্বীপ পৌছাতেন। এই প্রকারে ছৈয়া থেকে উত্তরে ক্রমশ শ্যাম, কম্বোজ, এবং চম্পার উদ্দেশ্যে যাত্রা বণিকরা জলপথেই করতেন। ছৈয়া থেকে দক্ষিন সুবর্ণভূমির দেশ সমূহে সমুদ্র যাত্রা সহজ ও সরল ছিল। দক্ষিণ ভারতীয় বনিকরাও সুবর্ণ ভূমি যাওয়ার জন্য বঙ্গোপসাগর খাড়ী থেকে তটবর্তী স্থান হয়ে দীর্ঘ যাত্রা করার জন্য আবশ্যকতা ছিল না। তথাপি, তারা কমার বা পোন্ডুকে থেকে গহীন সমুদ্র হয়ে আন্দামান নিকোবর দ্বীপ সমূহের মধ্য দিয়ে তকুআপা পৌঁছে তাদের যাত্রায় অগ্রসর হতেন
এই প্রকারে ভারতীয়রা স্থল এবং জলপথে উভয় পথের যাত্রা তথা সদিয়ো পর্যন্ত তারা এই পথ সমূহের নিজেদের যাত্রা অভিযানের রূপরেখা তৈরী করে রাখতেন। মহাবাণিজ্য জাতক থেকে জানা যায় যে, বণিকরা বিদেশে ক্রমে ভারতীয়রা অন্য দেশের ব্যবসায়িদের সাথে মিলেমিশে এক সাথে যাত্রা করতেনএই তথ্য প্রাচীনকালেও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তথা সদভাবের মহত্বতা প্রকাশ পায়। জাতকে এরূপ অনেক গাথা পাই যার থেকে এও ধারনা করা যায় যে, বণিকরা তাদের যাত্রা একক ভাবে না করে অনেক সংখ্যক বণিক এক সাথে বাণিজ্য যাত্রা করতেন। সম্ভবত বাণিজ্য যাত্রার কষ্টকর দিকের দিকে লক্ষ্য রেখে এরূপ করতেন বলে মনে হয়।  কেন কি সামগ্রিকতা বা একতাবদ্ধতার মনোবল দৃঢ় হতো। জাতক থেকে জানা যায় যে, ভারতীয়রা সুবর্ণ দ্বীপ এবং সুবর্ণ ভূমি হয়ে বেবীলন, সিংহল দ্বীপ ইত্যাদি যাত্রাও করতেন। সামগ্রিকভাবে যাওয়ার বাণিজ্য যাত্রার একজন প্রধানও থাকতেন, যেমন সুপ্পারক জাতক থেকে স্পষ্ট জানা যায়। এই বাণিজ্য যাত্রার প্রধান অত্যন্ত বিচক্ষণ হতেন। চুল্লক সেটিঠজাতকের গাথায় বলা হয়েছে সমুদ্র যাত্রার উদ্দেশ্যে জাহাজের আগমন সূচী দেওয়ার জন্য দক্ষ লোকও নিযুক্ত হতো বন্দরে আসার এবং বন্দর থেকে প্রস্থান করার সূচনাও দিতেন জাতকে এরূপ পথ প্রদর্শকের কথাও জানা যায় যে স্থলপথের মরু ভূমিতে তথা জলপথের সমুদ্র পথের ভুলে যাওয়া পথিকের সঠিক পথের নির্দেশনা দিতেন এই কাজের জন্য বণিকদের পক্ষ থেকে তাঁকে পারিশ্রমিকও দিতেন এঁকেদিশাকাকবলা হত২১ কিন্তু এরূপ উদাহারণ খুব কমই পাই খুব সামান্য দলের অধিপতিরা দক্ষ ছিলেন ভারতীয় কৌশলী নাবিক ছিলেন তাঁরা বড় বড় জাহাজ নির্মাণেও পারদর্শী ছিলেন এঁরা জঙ্গল থেকে সংগৃহীত সবচেয়ে বড় এবং শক্তপোক্ত ঝড়ে-জলে নষ্ট না হয় মতো কাঠ দিয়ে জাহাজ বানাতেন জাহাজ তৈরীতে অনেক সংখ্যক দক্ষ লোকরা এক সাথে কাজ করতেন এই সব জাহাজ অনেক বড়বড় হতো শঙ্খ জাতক থেকেও এই তথ্যের উদাহরণ মিলে আরো স্পষ্ট ভাবে বলা যায় যে, জাতককালীন ভারতীয়রা নিজেদের ব্যবসায়িক কৌশল, নাবিক কৌশল এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার কেবল মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে নিজেদের বাণিজ্যের প্রমুখ কেন্দ্র তৈরী করে নিয়েছিলেন। বাণিজ্যের এই ক্রম কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত চলেছিল। এই পৃষ্ঠভূমি ভারতীয়রা যেখানে ভারতীয় কলোনি গড়ে তোলেন এবং কালক্রমে সমগ্র সুবর্ণ ভূমি এবং সুবর্ণ দ্বীপের দেশ গুলোতে ভারতীয় সংস্কৃতির উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল।
আকড় সূচীঃ 
১। আর,সি, মজুমদার, দ্যা হিন্দু কলোনীজ ইন দ্যা ফার ইষ্ট, পৃ-৮
২। মহাজনক- জাতক, ৫৩৯
৩। সুপ্পারক- জাতক, ৪৬৩
৪। স্টুডিএ এশিয়াটিক, খন্ড-২, পৃ ১-৫৫
৫। জে, এন, সমাদ্দার, দ্যা ইকোনমিক কন্ডিশন অফ এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া, পৃ,গ ১৩৯, অপন্ন জাতক
৬। বিদ্ধান উপাধ্যায়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস, পৃ, ২০-২৭,ই। 
৭। সুরপ্প জাতক, গুম্ভীয় জাতক, গুঠিটল জাতক ইত্যাদি
৮। চেডেস দ্যা ইন্ডিয়ানাইজড স্টেঠস অফ সাউথ ইষ্ট এশিয়া, পৃ, ২৯
মহাজনক জাতক ৫৩৯, শঙ্খ জাতক ৪৪২, আদি; কথাসরিৎসাগর, বৃহৎকথা মঞ্জুরী, নিদ্দেস ইত্যাদি এই সকল বন্দরের উল্লেখ করা হয়মজুমদার, এশিয়ান্ট-ইন্ডিয়ান কলোনাইজেশন ইন সাউথ ইস্ট এশিয়া, পৃ, ৪
১০। দ্যা ইন্ডিয়ানাইজড স্টেটস অফ সা, ই, এ, পৃ, ২৯, কে এ নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী দ্যা চীনাজ,খন্ড, ২, পৃ, ৯৬-৯৯।
১১। প্রাগুক্ত। 
১২। আর, সি, মজুমদার, সুবর্ণ দ্বীপ, খন্ড, ১, পৃ, ৫৪-৫৫
১৩। বৃহৎশ্লোক সমগ্র, ১৮/৪২৮
১৪। কথাকোষ, পৃ, ২৯
১৫। আর, সি, মজুমদার, সুবর্ণ দ্বীপ, খন্ড, ১, পৃ, ৩৭-৩৮-৫১-৫২।
১৬। লালনজী গোপাল, ইকোনোমিক লাইফ অফ ইন্ডিয়া, পৃ, ১০৮, চাও জু-কুয়া, পৃ, ২০১-২০২
১৭। শঙ্খ জাতক, সং, ৪৪২, মহাজনক জাতক, সংখ্যা, ৫৩৯
১৮। টুয়ারডস অংগকোর, এস, জী, ক্যু, বিলস, পৃ, ১১১
১৯। চেডেস, দ্যা ইন্ডিয়ানাইজড স্টেটস অফ সা, ই, এ, পৃ ৮
২০। বাভেরু জাতক, জে, এন, সামাদ্দার, দ্যা ইকোনমিক কন্ডিশন অফ এশিয়ান্ট ইন্ডিয়া, পৃ, ১৪৩-১৪৪
২১। প্রাগুক্ত, পৃ, ১৪৬-১৪৭, লোসক জাতক, পাটঠান জাতক ইত্যাদি।
২২। মহাউম্মাগ জাতক, সংখ্যা, ৫৪৬।


No comments:

Post a Comment