Sunday, June 2, 2024

মাতৃত্ব বিভিন্ন ধর্মে

 

                                                                                                                            সুমনপাল ভিক্ষু

বৌদ্ধ ধর্মে মাতৃত্ব:

বৌদ্ধধর্মে মাতৃত্বকে অতি শ্রদ্ধার ও দায়িত্বের আসনে বসানো হয়েছে। যদি একজন নারী একজন মা হিসেবে তার উপর অর্পিত দায়িত্বকে পারিবারিক জীবনে সঠিকভাবে নির্বাহ করতে পারে তাহলে সে সেই দায়িত্ব পালনে যে আন্তরিকতা প্রদর্শন করবে সেই অনুপাতে সে শ্রদ্ধা ও সম্মান দাবী করতে পারবে। সন্তানের মা হিসেবে একজন নারীর দায়িত্বপূর্ণ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ অবস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বুদ্ধ সমাজে নারীর মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছেন। মা যদি তাঁর ভূমিকা ভালোভাবে ও সঠিকভাবে পালন করে থাকেন তাহলে একজন মানুষের কাছে তাঁর নিজের মায়ের তুল্য শ্রদ্ধেয় ও সম্মানীয় কেউ হন না। এমন মা এবং মাতৃভূমিকে স্বর্গের জীবনের থেকেও বেশী মূল্য দেওয়া হয়েছে। (জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী)।
যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হল এই যে বৌদ্ধধর্মে যখন মাতাপিতাকে একসঙ্গে বোঝান হয়েছে তখন মাতাকেই প্রথম উল্লেখ করা হয়েছে। এই মর্যাদা পিতাকে দেওয়া হয়নি কারণ সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে পিতার ভূমিকা অপ্রধান। এর থেকে মাতৃত্বের উচ্চ মূল্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন ভালো মায়ের একজন ভালো স্ত্রী হওয়াও প্রয়োজন। যদি স্বামী তাঁর কর্তব্য পালন না করেন তাহলে হয়তো তিনি অসহায় হয়ে পড়বেন কিন্তু প্রায়ই একজন ভালো ও যোগ্য স্ত্রী তাঁকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে ও সক্ষম হবেন কিছু অসংশোধনীয় ব্যতিক্রম ছাড়া।

এটি হল একজন নারীর প্রধান অস্ত্র। এই অস্ত্রটি তিনি লাভ করতে পারেন একজন মা হিসেবে তাঁর সহজাত নিবৃত্তি ক্ষমতা থেকে, কিন্তু তার জন্য যথাযথ অনুশীলন প্রয়োজন। (কিন্তু এটি হল মাতৃত্ব (ও পিতৃত্ব) এর প্রধান দায়িত্ব এটি হল এমন কাঠামো যার উপর অবশিষ্টগুলি নির্ভরশীল)। তাঁর উপদেশগুলির মধ্যে দিয়ে বুদ্ধ মা ও তার ঘনিষ্ট সম্পর্কের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই অর্থে মাকে শ্রেষ্ঠ বন্ধু, শ্রেষ্ঠ আত্মীয় শ্রেষ্ঠ গুরুজন বলা হয়েছে। (ধর্মপদ গাথা ৪৩, সুত্তনিপাত গাথা ২৯৬ ইত্যাদি)।

মায়ের রক্ষাকবচ না থাকলে সন্তানের জীবন নানাভাবে বিপন্ন হয়ে পড়বে কারণ অন্য কেউই সন্তানকে মায়ের ভালোবাসা দিতে পারবে না। একথা খুব ভালোভাবে জেনে বুদ্ধ মেত্তা সুত্তে তাঁর সুপরিচিত উপমাটি ব্যবহার করেছেন, “সেই মায়ের মত যিনি নিজের প্রাণের বিনিময়েও তাঁর একমাত্র সন্তানের জীবন রক্ষা করেন – মাতা যথা নিয়ং পুস্তং আর্যুগা একপুপ্ত অনুরাখে, (সুত্তনিপাত- গাথা-১৪৯)। জাতক কাহিনী (Cowel's Eng Tr. 5 p. 45 ) তে নিম্নলিখিত পঙক্তিগুলি পাওয়া যায়. “একজন মা তাঁর শিশু সন্তানের দিকে তাকিয়ে পবিত্র আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন”।

বুদ্ধ মাতৃত্বকে এই অনন্য মর্যদা দান করেছেন কারণ মানবিক সম্পর্কগুলি সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ও বোধ ছিল। একবার একজন দেবতা তাঁর কাছে এসে নিম্নলিখিত প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করলেন, পরিবারে শ্রেষ্ঠ বন্ধু কে? - “কিং সু মিত্তং সকে ঘরে?” অত্যন্ত দ্বিধাহীনভাবে বুদ্ধ উত্তর দিলেন, “মা হলেন পরিবারে সবচেয়ে বড় বন্ধু”- মাতা মিত্তং সকে ঘরে, (সংযুক্ত নিকায়, ১, পৃ-৩৭)। এই বিবৃতির মধ্যে সমস্ত দর্শন নিহিত রয়েছে।

এই পর্যন্ত এই আলোচনায় মাতৃত্বের সদর্থক ও বাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, এটি হল একটি সাধারণ অবস্থান যা একজন মায়ের কাছ থেকে আশা করা হয়। কিন্তু যখন একজন মা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাঁর এই কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হন তাহলে তা তাঁর ধ্বংসের কারণ হবে কারণ এই পৃথিবীতে আর কেউই এই ক্ষেত্রে মাতার বিকল্প হতে পারে না। আজকের যুগে মাতৃত্বের এই অন্ধকার দিকটি বিরল নয়।

এর ফলে মায়ের দ্বারা একজন সন্তানের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। প্রথমত শিষ্যটি তার প্রধান শিক্ষক ও রক্ষককে হারাবে। আধুনিক সমাজে মানবিক মূল্যবোধ কমে যাওয়ার ফলে যে অবনতি ঘটেছে তাতে এই দুঃখজনক পরিস্থিতি মোটেই কাম্য নয়। পবিত্র মাতৃত্বও নিষ্কলঙ্ক থাকতে পারেনি। যখন একজন শিশু তার মায়ের অবহেলা এবং দুর্ব্যবহারের শিকার হয় তখন তার পক্ষে আর কোন কিছুই এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হতে পারে না। প্রায়শই যে তার নিজের পিতাসহ অন্যান্য সমস্ত মানুষের কাছ থেকে একই আচরণ পেয়ে থাকে।

শিক্ষার যদি দুর্বল চরিত্রের হয় তাহলে সে নির্বোধও সমাজের কাছে বোঝা হবে আর সে যদি দৃঢ় চরিত্রের হয় তাহলে সে বিদ্রোহী এমনকি অপরাধী হবে, সর্বত্র সে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চাইবে এবং সকলের সমস্যা তৈরী করবে। সে সমাজে সঠিকভাবে মানিয়ে নিতে পারবে না এবং উপযুক্ত বোধ ও সাহসের সঙ্গে জীবনের সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবে না। তার প্রতিভা বিনষ্ট হবে যেহেতু তাদের বিকাশের সুযোগ হারিয়ে যাবে। তার জীবন দুঃখময় হয়ে উঠবে। এই সমস্ত কিছুর কারণ হল মাতৃত্ব সমাজ ও পরিবারের প্রতি তার কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে । যদিও বাবা সাধারণত প্রধান উপার্জনকারী কিন্তু সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুর পরিপূর্ণ ও সুস্থ বিকাশ পরিবারিক শাস্তি, পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সহযোগিতা প্রধানতঃ মায়ের দক্ষতার উপর নির্ভর করে। এই কারণে তাঁর-প্রধান মনোযোগ থাকা উচিত পবিত্র মাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে তাঁর অবস্থানকে সুরক্ষিত রাখা। সিংহলী গ্রামবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় একটি প্রবাদে বলা হয়েছে, “যদি না ভালো হয় তাহলে মেয়ে অবশ্যই ভালো হবে ঠিক যেভাবে পেষক যন্ত্রটি ভালো অবস্থায় থাকলে হলুদ গুঁড়ো তার গুণ বজায় রাখে।”
অন্য একটি লোক প্রবাদে বলা হয়েছে, “যদি মা হারিয়ে যায় তাহলে বাবার কাছ থেকে কি আশা করা যায়? এখানে দেখা যাবে যে কেমন করে ঐতিহ্যশালী লোক প্রজ্ঞা বুদ্ধের বাস্তবধর্মী প্রজ্ঞার সঙ্গে মেলে। খারাপ মায়েদের হাতে অবাঞ্ছিত সন্তান এর সমস্যা ছাড়াও আরও কিছু মা রয়েছে যারা নিজের সন্তানদের মধ্যেই কোন বিশেষ এক জনকে প্রিয় বলে মনে করেন। এতে সকলেরই সমস্যা হয় বিশেষ করে অন্যান্য ভাই বোনদের। এটি অনৈক্যের একটি সাধারণ উৎস যা সকলের পক্ষেই ক্ষতিকর, এতে কারোরই মঙ্গল হয় না। একজন মায়ের ভালবাসা সমস্ত সন্তানদের জন্যই সমান হওয়া উচিত। উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুদ্ধের মাতৃত্বকে উচ্চ আসনে স্থাপনের যথার্থতা সহজেই প্রমাণিত হয় এবং এই কারণেই তিনি সমস্ত মায়েদের একত্রে শ্রদ্ধার সঙ্গে ‘মাতৃগাম' বলে সম্বোধন করেছেন।

হিন্দুধর্মে মা:

হিন্দুধর্ম অনুসারে ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংস করেন কিন্তু যে ক্ষমতার দ্বারা এই কাজগুলি করা হয় তাকে বলা হয় শক্তি, বা স্বর্গীয় মা। এটি মাতৃপূজার উৎস এবং এর অর্থ হল মানুষরূপী মা-ও স্বর্গীয় মায়ের মত শ্রদ্ধা ও পূজার যোগ্য। 'মাতৃদেব ভব' প্রবাদটি সেই নীতির কথা বলে যা পার্থিব বা জৈবিক মায়ের দৃশ্যতঃ অসীম ক্ষমতার কথা বলে, এটি হল সেই ক্ষমতা যা ঈশ্বরত্বের সঙ্গে সমান।

হিন্দুধর্মে, মা হলেন এমন চরিত্র যিনি সবচেয়ে বেশী মর্যাদাপূর্ণ এবং যাঁকে সবচেয়ে বেশী শ্রদ্ধা ও সেবার যোগ্য বলে মনে করা হয়। ধর্ম শাস্ত্র অনুসারে তিনি পূজার যোগ্য পাঁচজন মায়ের অন্যতম। অসংখ্য স্তোত্র ও গাথায় নিজের সন্তানের প্রতি তাঁর ভালবাসাকে প্রশংসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে মা হলেন সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, ত্যাগ, সহ্যশক্তি এবং নিঃস্বার্থ সেবার প্রতি মূর্তি।

যুগে যুগে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের পৃষ্ঠাগুলিতে মায়েদের অসাধারণ যে উদাহরণ পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে নারী বিশেষতঃ মাকে বিভিন্ন ধরণের সম্পর্কের মধ্যে একটি অতি উচ্চ আসন দেওয়া হয়েছে। কেন না, একজন শিশু, তরুণ, বিবাহিত গৃহী ব্যাক্তি এমনকি রাজা হিসেবে মায়ের আচরণ মা-ই প্রথম গুরু এই প্রবাদটিকে মান্যতা দান করে। নিঃসন্দেহে তিনিই হলেন প্রথম ঈশ্বর। দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তিনি শিখিয়েছিলেন মায়ের আশীর্বাদ-সাফল্য লাভের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। সকালে উঠেই তাঁর প্রথম কাজ ছিল মায়ের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা। মঙ্গলে যাওয়ার আগে তাঁর মায়ের শুভকামনা ও আশীর্বাদের প্রয়োজন ছিল। নির্বাসন থেকে ফিরে এসে তাঁর প্রথম কাজটি ছিল তাঁর মায়েদের চরণ বন্দনা করা। মায়ের সামান্য উপস্থিতি সন্তানকে সুরক্ষা দান করে; বিপরীতটি ঘটলে সে পরিপূর্ণতা থেকে বঞ্চিত হয়। সত্যিই মনুষ্যরূপী ভগবান রামের দৃষ্টান্ত পৃথিবীকে এই শিক্ষা দেয় যে শান্তির ও আশীর্বাদের উৎস হল মায়ের চরণতল। যেহেতু মায়ের গর্ভে থাকাকালীনই সে ভগবান বিষ্ণুর ভক্ত হয়ে উঠেছিল। মহা শিবপুরাণে বলা হয়েছে কেমন করে ভগবান শিব অভিমন্যু নামে এক শিশুর অনুরোধ রেখেছিলেন যাকে তার মা ‘পঞ্চক্ষর মন্ত্র' দ্বারা ভক্তি শিক্ষা দিয়েছিলেন। ধর্মশাস্ত্রগুলিতে এমন অনেক ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে সন্তানের প্রতিপালনে মায়ের কার্যকরী ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। তাঁর স্থান কেউই গ্রহণ করতে পারবে না। ধর্মশাস্ত্র থেকে নেওয়া নিম্নলিখিত উদ্ধৃতিটিতে শিক্ষক হিসেবে মায়ের ভূমিকাকে যথার্থভাবে তুলে ধরে হয়েছেঃ “প্রাপ্য শ্রদ্ধার ভিত্তিতে বিচার করলে একজন শিক্ষক একজন বক্তৃতা কারকের থেকে দশগুণ বেশী শ্রদ্ধেয় একজন পিতা একজন শিক্ষকের থেকে একশ গুণ বেশী শ্রদ্ধেয়, একজন মাতা একজন পিতার থেকে হাজার গুণ বেশী শ্রদ্ধেয়”।

যেহেতু মাতৃ দিবস পার্থিব মাকে এই মাসে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তাই মায়ের অবদান নিয়ে চিন্তা করা যথেষ্ট প্রয়োজন যেহেতু সাতজন্মে কেউই তার পিতামাতার ঋণ পরিশোধ করতে পারে না ।

ইসলাম ধর্মে মাতৃত্ব:

ইসলাম ধর্মে নারীকে বেশী ক্ষমতা দান করা হয়েছে এবং তাদের অধিকারও পুরুষদের তুলনায় বেশী। মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন যেহেতু ইসলাম ধর্মে মায়ের অত্যন্ত মূল্যবান ও মর্যাদাপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাদের অবদানকে প্রশংসা করা হয়েছে এবং স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একবার একজন ব্যক্তি পয়গম্বর মহম্মদকে মায়ের মর্যাদা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন ‘মায়ের পদতলে স্বর্গ রয়েছে।'

অন্য কথায় বলতে গেলে যারা মাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে তাদের জন্য স্বর্গের দ্বার উন্মুক্ত হয়। সমগ্র পরিবারেই মা অত্যন্ত শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কথা মান্য করতে হবে। পবিত্র কোরানে এমন অনেক গাথা/আয়াত রয়েছে যেখানে মায়ের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। পবিত্র পয়গম্বর মায়ের উপর ভালোত্ব অর্পণ করেছেন। একজন মানুষ কার সঙ্গে ভালো আচরণ করা উচিত এই প্রশ্ন নিয়ে পয়গম্বরের কাছে এলে তিনি তাকে মায়ের প্রতি ভালো হওয়ার ও আচরণ করার পরামর্শ দিলেন। লোকটি তিনবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে পয়গম্বর তাকে একই উত্তর দিলেন। চতুর্থবার পয়গম্বর তাঁকে বাবার প্রতি ভালো আচরণ করতে বললেন। এতে ইসলাম ধর্মে মায়ের মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ঈশ্বরের পয়গম্বর মন্তব্য করেছেন, “একজন ব্যক্তি তার বাবা-মাকে আঘাত দিলে তা হবে সবচেয়ে ভয়ানক পাপগুলির অন্যতম"।

মায়ের সম্পর্কে পবিত্র কোরান:

আল্লাহ পবিত্র কোরানে মাত্র দুজন মহিলার নামোল্লেখ করেছেন; হযরত ঈশার মা মরিয়ম ও হযরত মুসার মা।পবিত্র কোরানে উল্লেখ রয়েছে যে ঈশার জন্মের পর মানুষ মরিয়মকে কুকথা বলেছিল। এক সময়ে তিনি মরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে দুঃখ করতে বারণ করেছিলেন। তারপর তাঁকে খেজুর ও জল দেওয়া হয়েছিল। তবে তাঁকে পরপর তিনদিন কথা না বলে থাকতে বলা হয়েছিল। তিনদিন পর শিশুটি কথা বলতে শুরু করলে প্রমাণিত হল যে হযরত ঈশা এক অলৌকিক শিশু। (১৯: ২৩-২৬)।
অপর ঘটনাটি হযরত মুসার মায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত যিনি তাঁর সন্তানকে নদীতে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন যদিও তাঁকে একই সঙ্গে নিশ্চয়তা দান করা হয়েছিল যে তাঁর সন্তান তাঁর কাছেই ফিরে আসবে। ফিরওয়ানের স্ত্রী শিশুটিকে নদী থেকে তুলেছিল কিন্তু শিশুটি তার পালিতা মায়ের স্তন্য পান করতে চায়নি। তাই হযরত মুসার বোন তাকে পরামর্শ দিল তার মাকে দিয়ে চেষ্টা করতে। এর ফলে মা ও সন্তানের পুনর্মিলন ঘটল। (সুরা তাহা ৩৭-৪০, ও সুরাহ কাসাস ৭-১৩)। নীচে পিতামাতা (মা) সম্পর্কে পবিত্র কোরানের গাথা(আয়াত)গুলি উল্লেখ করা হল।

“পিতামাতার প্রতি করুণা প্রদর্শন করুন; যদি তাঁদের কেউ বৃদ্ধ হন তাহলে কখনও তাঁদের সামনে উফ্‌ বলবেন না, সর্বদা দয়ালু বাক্যই বলবেন। তাদের নম্রতা ও কোমলতার সঙ্গে যত্ন করবেন। কখনও তাঁদের বকবেন না। প্রার্থনা করবেন, 'ঈশ্বর' এঁদের প্রতি দয়ালু হোল, ঠিক যেভাবে তাঁরা আমার শৈশবে আমাকে দয়া ও স্নেহের সঙ্গে আমাকে বড় করেছেন।” (সুরা বণী ঈসরায়েল ২৩-২৪)।

মায়ের গুণ:

সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা অতুলনীয়। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা অতুলনীয়। সন্তান বাধ্য বা অবাধ্য, বৃদ্ধ বা যুবক, অসুস্থ বা স্বাস্থ্যবান যেমনই হোক না কেন মায়ের ভালোবাসা সবসময় সমান থাকে। একজন মা বিভিন্নভাবে সন্তানের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে প্রকাশ করেন, কখনও কখনও তিনি তাঁর সন্তানকে বকেন এবং তা শুধু এই কারণে তিনি তাঁর সন্তানের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল এবং তিনি চান না যে তারা কোন বিশৃঙ্খল কাজকর্মের মধ্যে জড়িয়ে পরুক। তবে, এই কারণে সন্তানরা মায়ের কারণে বাড়িতে থাকতে পছন্দ করে। পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে, “ঈশ্বরকে পূজা কর এবং পিতামাতার প্রতি দয়ালু হও।”

অন্য কথায় বলা যায় পিতামাতা যদি বকেন বা মারেনও তাহলেও আমাদের তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যাবহার করা উচিত নয়। অনেক সন্তান তাদের নিজেদের আনন্দকে মায়ের সুখের চেয়ে উপরে স্থান দেয়। এত কষ্ট ও ত্যাগের পর এই তাঁদের পুরস্কার! আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠা সন্তানের জন্য মায়ের আত্মত্যাগ অতুলনীয়; সন্তানকে ঠিকমত রাখার জন্য তিনি তাঁর নিদ্রাও ত্যাগ করেন। একজন ভালো মা তাঁর সন্তানের শারীরিক ও মানসিক প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের উপরে স্থান দেন। অন্য কোন সম্পর্কের মানুষই মায়ের মত সন্তানের শান্তির জন্য নিজের শান্তিকে বিসর্জন দেয় না। এই কারণে ইসলাম ধর্মে নারীদের বাড়িতে থেকে সন্তান প্রতিপালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে, “মানুষকে বলেছি পিতামাতার প্রতি দয়ালু হতে; মা অনেক কষ্ট করে তাকে জন্ম দিয়েছেন ও দু'বছর ধরে স্তন্য দান করেছেন। আমার প্রতি ও পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আমিই হলাম অন্তিম গন্তব্য।” [পবিত্র কোরান ৩১:১৪] তবে এই গাথাটি সম্পর্কে শেখ আবদুর রহমান আস-সাদের বক্তব্য নিম্নরূপ —
“পিতামাতার প্রতি দয়ালু হও; তাঁদের জন্য ভালোবাসা, স্নেহ ও ভক্তি কর কাজে ও কথায়, তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ কর এবং কখনও মৌখিক বা শারীরিকভাবে তাদের আঘাত কোরো না। তারপর আল্লাহ ব্যাখ্যা করলেন কেন আমাদের পিতামাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা উচিত। তিনি বলেন, ‘গর্ভে সন্তানের নড়াচড়ার প্রথম মুহূর্তগুলি থেকে প্রসবের সময়কার তীব্র যন্ত্রনা ভোগ করা পর্যন্ত একজন মা অবিরত কষ্ট ও দুর্দশা অনুভব করে থাকেন। দু'বছর বয়সে পর্যন্ত স্তন্যপান করানো সময়ে মা তাঁর সন্তানের যত্ন করে থাকেন। তাহলে মা এই এত বছর দুঃখ, কষ্ট সহ্য করার পর ভালোবাসা ও যত্ন দেওয়ার পর আমরা কি মা আমাদের জন্য যা করেছেন তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে পারি না বা তাঁদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারি না" ?

জীবনে মায়ের ভূমিকা:

যদি একটি শিশু জন্মায় তখন সে বাইরের পৃথিবীর সম্পর্কে অচেতন থাকে। তাকে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মা একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। সন্তানের জীবন সম্পূর্ণভাবে তার মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকে। তার মতামত, তার আচরণ, ধর্ম ও অন্যান্য বিষয়ে তার ধারণা, তার লক্ষ্য সবই তার মায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। পরে পরিণত হবার পর তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয় কিন্তু প্রথমে সে যা শিখেছিল তা তার মনে গভীর ছাপ ফেলে যায়।

একজন মানুষ পয়গম্বরের কাছে এসে প্রশ্ন করল, “ও ঈশ্বরের বার্তাবাহক। মানুষের মধ্যে কে আমার ভালো ব্যবহারের যোগ্য? তখন পয়গম্বর উত্তর দিলেন, তোমার মা। তখন লোকটি জিজ্ঞাসা করল, “তারপর কে?” পয়গম্বর উত্তর দিলেন, তোমার মা। লোকটি আবার প্রশ্ন করল, ‘তারপর কে?' পয়গম্বর উত্তর দিলেন, “তারপর তোমার মা। (বুখারি, মুসলিম)এই হাদিসে পয়গম্বর ‘তোমার মা' কথাটি তিনবার বলে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে বাবার চেয়ে মায়ের গুরুত্ব বেশী।

সন্তানের পক্ষে দৃষ্টান্ত স্বরূপ:

মা যেহেতু সন্তানের বড় হওয়ায় একটি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন তাই তিনি প্রভূত সম্মান লাভ করেন। তাঁর অভ্যাস, আচরণ, জীবনযাপন এবং তাঁর থেকে সন্তান যা লক্ষ্য করে তার সবকিছুই সন্তানের উপর প্রভাব ফেলে। একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে, ‘একজন মা একশজন শিক্ষকের থেকেও ভালো, এর অর্থ হল এই সন্তানের উপর মায়েদের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। এই কারণে মায়েদের উপর সন্তানদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। কখনও কখনও এটি মায়েদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
ইসলাম মাতৃত্ব কতটা শ্রদ্ধা করে এবং সন্তান প্রতিপালনে মায়ের ভূমিকা কতখানি। সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি মা হল সম্পূর্ণ পরিবারের অভিভাবক। তাই সন্তানের কর্তব্য মাকে শ্রদ্ধা করা। তাই আল্লাহর বার্তাবাহকের হাদিসে বলা হয়েছে, তোমার মায়ের প্রতি দয়ালু হও।

বাইবেলে মাতৃত্ব:

বাইবেলের সর্ব মাতৃত্বকে অত্যন্ত মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শিশুদের সর্বদা একটি আশীর্বাদ ‘ঈশ্বরের ঐতিহ্য --তাঁর কাছ থেকে পাওয়া” পুরস্কার হিসেবে দেখা হয়েছে।” (উপদেশ ১১৩ : ৫-৯)” i)” মাতৃত্বকেও একটি আশীর্বাদ স্বরূপ দেখা হয়েছে—যদিও একটি মঞ্জুর করার অধিকার একমাত্র ঈশ্বরেরই রয়েছে। এই আশীর্বাদের মধ্যে অনেক দায়িত্বও নিহিত থাকে। এর উদ্দেশ্য হল সুখ নিয়ে আসা (উপদেশ ১১৩ : ৫-৯)।
বাইবেল এই শিক্ষাদান করে যে ঈশ্বরই হলেন সেই সত্তা যিনি শিশুদের পরিবারের মধ্যে নিয়ে আসেন (উপদেশ ১১৩ : ৫-৯)। ঈশ্বর প্রায়শই অপ্রত্যাশিত প্রার্থীদের মাতৃত্বদান করেন এবং তাঁর করুণার বিস্ময়কর প্রকৃতি প্রমাণ করেন। যীশুর বংশের অনেক স্থানে ঈশ্বর হস্তক্ষেপ করে বন্ধ্যা রমণীকেও সন্তান দান করেছেন। যেমন আব্রাহামের স্ত্রী সারাহ, আইজ্যাকের স্ত্রী রেবেকা, স্যামুয়েলের মা হানা, জনের মা এলিজাবেথ এবং অবশ্যই যীশুর কুমারী মা মেরি।

বাইবেলে মায়েদের জন্য উপদেশ:

মাতৃত্ব হল একটি দায়িত্ব ও ঈশ্বরের আহ্বান তাঁকে মহিমান্বিত করার ও তাঁর সেবা করার অন্যতম উপায়। বাইবেল এই শিক্ষাদান করে যে মায়েদের ঈশ্বরে বিশ্বাসী হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন কারণ তাঁরাই সন্তানদের ঈশ্বরকে ভালোবাসতে শেখান। এতে সেই সমস্ত মায়েদের দৃষ্টান্ত রয়েছে যারা তাদের সন্তানদের উপর দু'রকম প্রভাবই রেখেছেন এবং এটি নির্ভর করে মায়ের জীবনযাপন শৈলী ও সন্তান প্রতিপালন পদ্ধতির উপর। ধর্মগ্রন্থগুলি থেকে জানা যায় যে, মায়ের সন্তানদের যীশুর দিকে চালিত করেন তাদের জন্য প্রার্থনা করে বিশ্বাস ও চরিত্র তৈরী করে, এবং তাঁদের প্রজ্ঞার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে (Proverbs 1:9, 29:15)।

ঈশ্বর প্রতীম মাতৃত্ব যা অর্জন করতে পারে সে বিষয়ে বাইবেল অনেক আশা দেখিয়েছে, তার কারণ হল এই যে চরিত্রবান সন্তানেরা সমাজ ও ঈশ্বরের রাজত্বের সম্পদে পরিণত হয়। Proverbs 22:6 এ সাধারণ নীতিটি বলা হয়েছে যে, “যদি আমরা আমাদের সন্তানদের কোন পথে যাওয়া উচিত সে বিষয়ে শিক্ষাদান করি তাহলে বৃদ্ধ হলেও তারা কখনও সে পথ থেকে বিচ্যুত হবে না।”

ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তগুলির বিবেচনা:

লোইস ও ইউরিনস (2 Tim 1:5) পল বলেছেন যে টিমথির যে আন্তরিক বিশ্বাস ছিল সেটি সে পেয়েছিল তার দিমি লোইস ও মা ইউনিসের কাছ থেকে। মনে হয় যে যদিও ঈশ্বর তুল্য মানুষদের টিমথিকে যেভাবে মানুষ করা হয়েছিল তার ঘাটতি ছিল, এই সমস্ত মহিলাদের প্রভাব তাকে ধর্মপ্রচারক ও নেতা হতে সাহায্য করেছিল যা সমগ্র প্রাচীন গীর্জারই উপকারে এসেছিল। মনিকা (৩৩১ খ্রী:৩৮৭ খ্রী:)র তাঁর ছেলে অগাস্টিনের জীবনের উপর গভীর প্রভাব ছিল। একথা বলা থাকে যে স্বামীর সমর্থন ছাড়াই মনিকার উদাহরণ ও তাঁর প্রার্থনা শেষ পর্যন্ত অগাস্টিনকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি তাঁর মাকে বলেছিলেন, "অন্যান্য মায়েরা তাদের ছেলের পার্থিব মৃত্যুর জন্য যে চোখের জল ফেলে আমার আধ্যাত্মিক মৃত্যুর জন্য তার থেকে বেশী চোখের জল ফেলো। হিপ্পোর অগাস্টিন প্রাচীন গীর্জার অন্যতম অগ্রগণ্য ঈশ্বরতত্ত্ববিদ হয়েছিলেন।

বাইবেল অনুসারে একজন খ্রীষ্টান মায়ের কেমন হওয়া উচিত? বাইবেলে প্রথম যে মায়ের উল্লেখ পাওয়া যায় তিনি অবশ্যই হলেন ইভ। Genesis 3:20 -এ বলা হয়েছে, “মানুষ তার স্ত্রীর নাম ইভ রেখেছিল, কারণ সে হবে সমস্ত জীবিত প্রাণীর মা।” ‘ইভ' শব্দর অর্থ হল জীবন বা জীবিত; 'মা' হল হিব্রু 'em'। ওল্ড টেস্টামেন্টে 'em' কে মা অনুবাদ করা হয়েছে ২১৮ বার। কিন্তু এর সঙ্গে বিভাগ বা বিচ্ছেদের ইঙ্গিতও রয়েছে। (দেখুন Ezekiel এ বিচ্ছেদ 21:21 ) । এটি বোঝায় একটি পরিচর্যাকারী উৎস যেখান থেকে একই ধরণের চরিত্ররা উৎপন্ন হয়। ইংরাজীতে এটি দেখা যায়। ‘মাতৃভূমি’ ‘মাতৃত্ব’ ইত্যাদি শব্দের মধ্যে।
বাইবেলের বিশ্ব দর্শনে পিতামাতার উদ্দেশ্য হল সন্তানদের এমনভাবে বড় করা যাতে তারা ঈশ্বরকে অনুসরণ করে । এই উদ্দেশ্যে ঈশ্বর পরিবারকেই প্রাথমিক একক হিসেবে তৈরী করেছেন যেখানে সন্তানরা যত্ন, ভালোবাসা, শিক্ষা এবং ক্ষমতা পায়। এর জন্য দয়া ও শৃঙ্খলা দুটিরই প্রয়োজন হয়। স্ত্রী এবং মা হওয়ার মধ্যে অনেক উদ্বেগ লুকিয়ে থাকে। তাঁকে দয়ালু হতে হবে আবার একই সঙ্গে বাইবেলের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে এবং তাঁকে অবশ্যই জানতে কখন তাঁর সন্তানদের স্বাবলম্বী হবার সুযোগ দিতে হবে।
অধিকাংশ খ্রীষ্টান মা-ই এই বিষয়ে একমত হবেন যে সন্তানকে রক্ষা করার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এবং তাকে সাবালকত্বে পৌঁছতে সাহায্য করা এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন কাজ। মায়েদের তাঁদের সন্তানদের প্রতি ভালোবাসার কথা (Times 2: 4 ) তাদের প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করা তাদের অনুমোদন করা এবং তাদের প্রতি করুণার মনোভাব বজায় রাখার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মায়েদের তাদের সন্তানদের এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যাতে করে তারা ঈশ্বরের মত জীবন ( Psalm 78: 5-6 ) যাপন করতে পারে এবং কেমন ব্যক্তিগতভাবে তারা ঈশ্বরের রাজত্বে (Pranerb 22:6) অবদান রাখতে পারে তা শিখতে পারে।

শিশুরা সর্বদা এই কাজটি সহজ করে দেয় না। Deuteronomy 1 : 18-21 বলেছেন যে যদি একজন ইজরায়েলি শিশু তার বাবা মায়ের বিরুদ্ধে এমন বিদ্রোহী হয় যাতে করে তাদের নিজেদের এবং অন্যান্যদের জীবন বিপন্ন হয় তাহলে বাবা মায়ের দায়িত্ব হল তাকে কর্তৃপক্ষের কাছে সমর্পণ করা।
যদি তার অপরাধ অত্যন্ত গুরুতর হয় তাহলে দেশের শাসক তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিব্য করতে পারে। এই আইন নিঃসন্দেহে অবিশ্বাস্য রকম কঠিন যেহেতু একজন মায়ের প্রাথমিক প্রবৃত্তিই হল তার সন্তানকে রক্ষা করা এবং এমন কোন দৃষ্টান্ত নেই যে স্থানে। দেখা গিয়েছে এই আইনটি কখনও ব্যবহৃত হয়েছে। যীশু লুক ১৩ : ৩৪ এ মাতৃ সুলভ মনোবেদনার কথা বলেছেন যখন তিনি মন্তব্য করেছেন, জেরুযালেম ও জেরুসালেম। যে নগর ঈশ্বরের বার্তাবাহকদের হত্যা করে এবং যাদের এখানে পাঠানো হয় তাদের উদ্দেশ্যে পাথর ছোঁড়ে। কতবারই না আমি তোমার সন্তানদের রক্ষা করেছি যেমন করে একটি মুরগী তার সন্তানদের তা ডানার তলায় রক্ষা করে। “একজন খ্রীষ্টান মায়ের দায়িত্বের অংশ হল সন্তানরা না চাইলেও ঈশ্বরের পবিত্রতার ও চরিত্রের মূর্ত প্রতীক হওয়া এবং তা ব্যাখ্যা করা। (Deuteronomy ৬ : ৪-৭)। এটা জানা অত্যন্ত সত্যিই যীশুখ্রীষ্টকে বিদ্রোহী শিশুদের সামলাতে হয়েছিল। খ্রীষ্টান মাতৃত্বের অপর একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হল মা একই সঙ্গে জীবনদাত্রী এবং বিচ্ছেদের স্থান। Genesis 3 : 20এ প্রথম মা ইভকে জীবনের উৎস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। জেনেসিস ১৭ : ১৬এ ঈশ্বর আব্রাহামের কাছে শপথ করেছিলেন যে ইভের সন্তানেরা পৃথিবীকে পূর্ণ করবে যার জন্য তাদের প্রয়োজন হবে তাকে ত্যাগ করার এবং সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত হবে সকলে যারা যীশুকে অনুসরণ করে নিঃসন্দেহে একটি বৈচিত্রপূর্ণ ও বিশাল গোষ্ঠী। একইভাবে, মায়েদের একথা মনে রাখতে হবে যে, মাতৃত্বের উদ্দেশ্য হল শক্তিশালী ও স্বাধীন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বিনাশ ঘটান (জেনেসিস ২:২৪)। যদি পূর্ণবয়স্ক সন্তান মায়ের কাছাকাছিও বাস করে তাহলেও মাকে সেই সন্তানকে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে বাঁচার সুযোগ দিতে হবে। তিনি তাঁর মায়ের প্রজ্ঞাকে মর্যাদা দেবেন (Proverbs 31:2) কিন্তু একই সঙ্গে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবেন—এমনকি সেই সিদ্ধান্তগুলিও যেগুলি তাঁর মা বুঝবেন না বা একমত হবেন না। (Mark 3:20- 21,31)
ঈশ্বর আশা করেন যে মাতৃত্বের উদ্বেগ মোকাবিলার জন্য খ্রীষ্টান মায়েদের দুটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকবে। প্রথমটি অনুমান করা হয়েছে Proverb ১ : ৮-৯এর আমার পুত্র, তোমার বাবার নির্দেশ শোনো এবং মায়ের শিক্ষাকে পরিত্যাগ কোরো না, কারণ তারা তোমার মাথার জন্য একটি সুন্দর মালা এবং গলার জন্য হার। সন্তানকে মায়ের প্রজ্ঞার উপর বিশ্বাস করতে হলে মাকে প্রকৃতই জ্ঞানী হতে হবে। মায়েদের ঈশ্বরকে অনুসরণ করার প্রয়োজন আছে এবং পিটার ১ : ৩ এর উপর বিশ্বাস করতে হবে যেখানে বলা হয়েছে” তাঁর স্বর্গীয় ক্ষমতা আমাদের সেই সমস্ত জিনিস দিয়েছে যা জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, তার জ্ঞানের মাধ্যমে যারা আমাদের তাদের নিজেদের মাহাত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছে। কিন্তু খ্রীষ্টান মায়েদের এঁফেসিয়ান্স ( ৬ : ৪) দ্বন্দ্ব মনে রাখতে হবে; পিতারা, আপনাদের সন্তানদের ক্রুদ্ধ করবেন না বরং তাদের শৃঙ্খলা পরায়ন করুন এবং ঈশ্বর নির্দেশ মানতে শেখান। যখন স্নেহ ও শ্রদ্ধা ছাড়া কোন কিছু দেওয়া হয় তখন শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ অত্যন্ত অবহেলিত হয়। এই দুটি যোগ করুন এবং আপনি এঁফেসিয়ান্স ৪ : ১৫ কে পাবেন যিনি ভালোবাসায় সত্য কথা বলবেন।

বাইবেল শুধুমাত্র জন্মদাত্রী মায়ের জন্যই মাতৃত্বকে সংরক্ষণ করে রাখেনি। Judges 5:7 পয়গম্বর, এবং বিচারক জেবারকে ইজরায়েল মা' হিসেবে সনাক্ত করছে আবার একইসঙ্গে তিনি ‘ইজরায়েলেরও মা'। তিনি প্রজ্ঞাদান করেছিলেন (Judges 4 : 5 ) এবং ঈশ্বরের নেতৃত্বে ইজরায়েলকে দেখিয়েছিলেন তার কোন পথে যাবে (গাথা ৬)। তিনি তাঁর ‘সাবালক সন্তানকে তাঁর সর্বদা উপস্থিতি ছাড়া নিজে থেকে ঈশ্বরকে অনুসরণ করতে শিখিয়েছিলেন (গাথা ৮-৯)। ডেবোরার প্রজ্ঞা ও পথনির্দেশের ফলে ইজরায়েল শাস্তি একটি বিরল পর্ব লাভ করেছিল (Judges 5:31 ) । সমস্ত নারীই ডেবোরার উৎসাহ ও পরিচর্যার দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করতে পারেন এবং তাঁদের চারপাশে যাঁরা রয়েছেন তাদের একটি পরিণত, ফলপ্রদ ও ঈশ্বরকে সম্মান করা জীবনযাপন করতে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন।

তবে একজন নারীর একমাত্র দায়িত্ব মাতৃত্ব নয়। তিনি ঈশ্বরেরও সন্তান (রোমানস ৮-১৪), সম্ভবত একজন শ্রদ্ধাশীল নারী (এফাসিয়েন্স ৫ : ৩৩), এবং স্থানীয় গীর্জার একটি অপরিহার্য অংশ (১ কেরিন্থিয়ান ১২ : ৪-৩১)। এই সমস্ত সম্পর্কের প্রতিটির ক্ষেত্রে একজন মহিলা সহায়তা প্রশিক্ষণ ও অপরের ক্ষমতায়নের মধ্যে দিয়ে খ্রীষ্টীয় মাতৃত্বকে প্রদর্শন করতে পারেন যাতে করে ঈশ্বরের রাজত্বে তারা নিজস্ব অবদান রাখতে পারে।

ইহুদী ধর্মে মাতৃত্ব:

জোনাথন স্যাক্স (জন্ম ১৯৪৭) হলেন একজন রক্ষণশীল ইহুদী কবির যিনি কেম্ব্রিজে নীতি বিজ্ঞান পড়েছিলেন এবং পরে সেখানেও অক্সফোর্ডের নিউ কলেজে গবেষণা করেছিলেন। তিনি মিডলসেন্স পলিটেকনিকে ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত নীতি দর্শন বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে গিয়ে এবং ইহলৌকিক অতীন্দ্রিয়বাদী গোষ্ঠী লুবাভিচ হাসিডিমের সাক্ষাৎ করে তিনি একজন রাব্বি হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে জিউম কলেজে তিনি রাব্বি হিসেবে মনোনীত হন এবং তারপর থেকে তিনি সেখানে মনোনীত হন এবং তারপর থেকে তিনি সেখানে অধ্যাপনা করে আসছেন। গত এগার বছর ধরে তিনি অবিরাম ইহুদী ছাত্রজীবনের সঙ্গে যুক্ত আছেন।

নারীর বা পুরুষের একটি ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গেলে আধুনিককালে প্রতিক্রিয়াশীল বলে মনে হয়। আমরা জানি যে ভূমিকা নামক বস্তু আছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত আছে কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা। আমরা মেনে নিই যে একজন রাজনৈতিক নেতা, একজন ডাক্তার একজন বিজ্ঞানী বা একজন ধর্মীয় নেতার নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে এবং এই কারণে তাদের একটি নির্দিষ্ট সামারিক পরিস্থিতিতে একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেটি আশ্চর্যজনক এবং ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন তা হল এই যে একজন পুরুষকে পুরুষের ভূমিকা এবং একজন নারীকে নারীর ভূমিকা পালন করতে হবে পারে। এর মধ্যে অদ্ভুত বিষয়টি কোথায় ?

অদ্ভুত বিষয়টি নিহিত রয়েছে এই ধারনার মধ্যে যে ভূমিকা পছন্দ করে নেওয়া যেতে পারে। সম্ভবতঃ এই বিষয়টি যে সমস্ত বিষয় বিংশ শতাব্দীর নৈতিক বিপ্লবের বৈশিষ্ঠ্য তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষের স্বাধীনতা বিস্তৃত হয় সেই স্বাধীনতার মধ্যে যা হল আমাদের দায়বদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা। অল্প কথায় আমাদের ভূমিকা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতায়। যেহেতু আমরা পুরুষ হব না নারী হব তা নির্বাচনে আমাদের কোন স্বাধীনতা ছিল না তাহলে আমাদের এদের মধ্যে কোনটি হওয়ার মধ্যে কেন নৈতিক ও ধর্মীয় তাৎপৰ্য্য লুকিয়ে থাকবে।
অবশ্যই চেতনা উপকারী এবং অনেক দিক থেকে মুক্তিদানকারী। বিশেষত জাতিগত সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে এটি একটি মৌলিক সত্যকে উন্মোচন করেছে। একজন মানুষ কালো না ফর্সা হবে তা ঠিক করার বিষয়ে তার কোন স্বাধীনতা নেই। তাহলে কেন তার রং বা দেশ নৈতিক পার্থক্য তৈরী করবে? সঠিকভাবেই আমরা এই সিদ্ধান্ত উপনীত হই যে এটি কোন পার্থক্য করে না।

কিন্তু একটি নির্দিষ্ট স্থানে এসে এই যুক্তিগুলি ভেঙে যায় অথবা আমাদের অন্তত কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে। একটি শিশু জন্ম নেবে কিনা তা স্থির করার ক্ষমতা শিশুটির থাকে না। অতএব যুক্তি সঙ্গতভাবে বাবা মায়ের প্রতি তার বিশেষ কোন কর্তব্য নেই। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক দুর্ঘটনা প্রসূত, তার নিজের তৈরী নয় তাই এই সম্পর্ক তার উপর বিশেষ কোন দাবী করতে পারে না। একথা স্বীকার করতেই হবে যে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা এই যুক্তিটিকে বহুদূর নিয়ে যাবে এবং দাবী করবে যে পরিবার হল একটি স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং শিশুদের মুক্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু অনেকের কাছেই এটি হবে এমন কিছুকে অস্বীকার করা যাকে আমরা অত্যন্ত মূল্যবান বলে মনে করি- মানুষের ভালোবাসা ও পারস্পরিক দায়বদ্ধতার কেন্দ্র হিসেবে পরিবারের অবস্থান, যেখানে একটি শিশু বিশ্বাস করতে, সাড়া দিতে শেখে এবং নৈতিক দায়ি দায়িত্বশীল একটি মানুষ হয়ে ওঠে।

ইহুদী ধর্ম, বিশ্বাস করেছে এবং বিশ্বাস করে চলেছে ধর্মীয় জীবনের মধ্যে নারী ও পুরুষের সুস্পষ্ট ও পৃথক ভূমিকা রয়েছে। সমানভাবে একটি আধুনিক ও বহুত্ববাদী সমাজের একজন সম্পূর্ণ অংশগ্রহণকারী হিসেবে একজন ইহুদী অনুভব করে যে তাকে তার সময়ের নৈতিক চেতনার প্রতিটি আন্দোলনেই সাড়া দিতে হবে। তাকে অবশ্যই প্রতিটি অগ্রগতিকে স্বাগত জানাতে হবে, প্রতিটি পশ্চাদমুখীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এবং সে যেটাকে বিভ্রান্তি বলে মনে করে তা নির্ণয়ের জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে। তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য তাকে নৈতিক বিতর্কের এক সমৃদ্ধশালী উৎস দান করে যা এক সহস্রাব্দ পিছিয়ে চলে যায়। একইভাবে এগুলি তার মধ্যে মোকাবিলা থেকে পিছিয়ে আসার এক অনিচ্ছার জন্ম দেয়, তা নিজের থেকেই হোক বা বৃহত্তর সমাজের থেকেই হোক।

তাই সে নারীর ভূমিকার বর্ণনার ক্ষেত্রে যে প্রশ্নচিহ্ন থাকে তার থেকে মুক্ত হতে পারে না এবং প্রকৃতপক্ষে এটি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইহুদী সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ব্যাপক আত্ম অনুসন্ধানের জন্ম দিয়েছে। এই অনুসন্ধানের ইহুদী ধর্ম জীবনের বিষয়গুলির মধ্যে দিয়ে তার দায়বদ্ধতার কেন্দ্র পর্যন্ত একটি পথ গ্রহণের প্রয়োজন আছে। এটি একটি যাত্রা যেখানে থেকে অনেক ইহুদি তাদের বিশ্বাসের এক নতুন বোধ নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন এবং এই বিশ্বাসটি এখানে গ্রহণ করা উচিত।

No comments:

Post a Comment