সুমনপাল ভিক্ষু
"যা চেয়মমধ্যমা প্রতিপদা আত্মকায়কলপথানুযোগো দুঃশোহনর্পো প্রসংহিতো দৃষ্টধর্মদুঃশশ্চায়ত্যাং চ দুঃখবিপাক :। এতো চ ভিক্ষবো দ্বাবত্তাবপুপগম্য মধ্যময়ৈব প্রতিপদা তথাগতো ধর্ম দেশয়তি।"
- ললিতবিস্তর,পৃঃ ৩৩৩।
যখন একজন বুদ্ধ শাসনে নিযুক্ত হন,তখন তিনি এই পৃথিবীকে আলোকিত করেন,যেমনভাবে তমসাচ্ছন্ন মেঘ হতেমুক্ত চাঁদ আলোকিত হয়।এই নিবন্ধে বিংশ শতাব্দীর এমন এক ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুর সম্পর্কে আলোচনা করতে চলেছি,যিনি অমাগারিক ধর্মপাশ,মহাপন্ডিত রাহুল সায়ংকৃত্যায়ন এবং ভান্তে আনন্দ কৌশল্যায়নের দ্বারা বুদ্ধ শাসনকে পুঃনপ্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।তিনি ভগবান বুদ্ধের দেশনা কে (ত্রিপিটক) মূল পালি ভাষায় নাগরী অক্ষরে লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি পালি থেকে হিন্দি অনুবাদ, হিন্দিতে পালি ব্যাকরণ প্রস্তুত করা,স্বাধীনভাবে বিভিন্ন নতুন পাঠ্যক্রম নির্মাণ এবং নব নালন্দা মহাবিহারের ন্যায় (বিশ্ববিদ্যালয়) একটি উদীয়মান আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।
১৯০৭ খ্রীঃ ২ মে,ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ তদানিন্তন বৃটিশ শাসিত ভারতের রাঁচী শহরে(বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্তর্গত) জন্মগ্রহণ করেছিলেন।তাঁর পিতা শ্যাম নারায়ণ ছিলেন রাঁচী আদালতের একজন কর্মচারী, তিনি তার নাম রাখেন 'জগদীশ নারায়ণ'। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা রাঁচীতে সম্পন্ন হয়।তিনি ১৯২৯ খ্রীঃ পাটনা কলেজ হতে বি.এ., বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় হতে(১৯৩১খ্রীঃ) দর্শন শাস্ত্র অধ্যয়নের পরে ১৯৩২ খ্রীঃ সংস্কৃত এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন।
বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভের সময়কালে তিনি রাহুল সাংকৃত্যায়নের সংস্পর্শে আসেন এবং বৌদ্ধধর্ম দর্শনের প্রতি জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠেন।জগদীশ নারায়ণের মূল স্বপ্ন তথা অভিপ্রায় ছিল পালি ভাষা শিক্ষা গ্রহণ এবং সদ্ধর্মের প্রতি স্বয়ং সমর্পিত হওয়া।তবে তাঁর পিতা-মাতা চেয়েছিলেন যে জগদীশ আর পাঁচটি সাধারণ মানুষের ন্যায় গার্হস্থ্য জীবন(সংসার জীবন) অতিবাহিত করুক।কিন্তু তাঁর মধ্যে এমন এক বোধিচিত্তের ---- হয়েছিল যে যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল সদ্ধর্ম কে হিন্দি ভাষার মাধ্যমে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতে পুঃন প্রচার, ফলে তিনি কোন রূপে তথাকথিত বন্ধনে আবদ্ধ হতে প্রস্তুত ছিলেন না।
বৌদ্ধ ধর্ম দর্শন তথা পালি ভাষা শিখনের অভিপ্রায়ে জগদীশ নারায়ণ রাহুল সাংকৃত্যায়ন এবং শ্রী কাশী প্রসাদ জয়সওয়ালের সহায়তায় শ্রীলঙ্কার বিদ্যালংকার গিরিভেনে গিয়েছিলেন।বিদ্যালংকার গিরিভেন সেই সময়ে পালি ভাষা ও ত্রিপিটক অধ্যয়নের এক বৃহত্তম কেন্দ্র ছিল,যা পরবর্তী সময়ে কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল।সেখানে তিনি ভিক্ষু ধম্মানন্দ মহাথেরোর নিকট হতে গভীরভাবে পালি ভাষা অধ্যয়ন করেন।
১৯৩৪ খ্রীঃ সদ্ধর্মের প্রতি গভীর আকর্ষণের কারণে ভিক্ষু ধম্মানন্দ মহাথেরোর নিকট হতে উপ-সম্পদা লাভ করেন এবং ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ নামে পরিচিত হন।
"ধম্মারমো ধম্মারতো,ধম্ম অনুচিন্তায়ম।
ধম্ম অনুসারম ভিক্ষু, সদম্মো ন পরিহারতি।।"
- ধম্মপদ,গাথা ৩৬৪।
অর্থাৎ,একজন ভিক্ষু এমন হওয়া উচিত যিনি ধম্মে আনন্দিত হন,এমন একজন হওয়া উচিত যিনি ধম্মকে অনুসরণ করেন এবং তার কখনই সদ্ধম্ম ত্যাগ করা উচিত নয়।ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ ছিলেন অত্যন্ত মৃদুভাষী এবং নম্র ভিক্ষু।
"ন তেন হোতি ধম্মাট ঠো যেন তমং সহসা নয়ে।
যো চ অতমং অনতমং চ উভৌ নিচ্ছেয্য পন্ডিতো।।
আসহসেন ধম্মেন সমেন নয়তো পরে।
ধম্মসস গুত্তো মেধাবী ধম্মটঠো তি সবুব্বতি।।"
-ধম্মপদ
- পুনঃ
"পে কেবি ওসধা লোকে বিজ্জন্তি বিবিধা বহু।
ধম্মোপধপমং পতিপ এবং সিবপ ভিক্খবো।।"
-ধম্মপদ।
ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপের মন বুদ্ধ,ধম্ম ও সংঘের পুনরুত্থানের প্রশ্নে পদ্ম-দলের ন্যায় প্রস্ফুটিত হয়েছিল ।
তিনি শ্রীলঙ্কার বিদ্যালংকার গিরিভেনা হতে ত্রিপিটকাচার্য উপাধি লাভ করেন।অতঃ ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরে তিনি রাহুল সাংকৃত্যায়নের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং রাহুল মহাশয় সেই সময় তিব্বত হতে সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্যের পান্ডুলিপির প্রতিলিপি সংগ্রহ করে এনেছিলেন।ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ এগুলি অবলোকন করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুনরুদ্ধার এর বিষয়টিতে দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করেন।
১৯৩৬ খ্রীঃ তিনি রাহুল সাংকৃত্যায়নের সঙ্গে জাপান ভ্রমণে যান।সেই সময় ভারতে বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরাধে পথিমধ্যে মালয়েশিয়ার পেনাং শহরে ধৃত হন এবং তাঁকে পেনাং কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়।বন্দীবাস কালে তিনি পালিগ্রন্থ দীঘনিকায় এবং মিলিন্দ পঞহো গ্রন্থদ্বয় এর হিন্দি অনুবাদ করেছিলেন। পেনাং এ ১ বৎসর কারাবাস কালে তিনি চীনা ভাষা শিখেছিলেন এবং এই সময় বৌদ্ধ পন্ডিত রূপে তাঁর খ্যাতি সর্বত্র প্রসারিত হয়েছিল। ১৯৩৭ খ্রীঃ তিনি মালয়েশিয়ায় বন্দীজীবন সম্পূর্ণ করে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বেনারসের সারনাথে নিজের কর্মভূমি গড়ে তোলেন।এই সময় তিনি বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগে বৌদ্ধ বিদ্যা অধ্যয়ন শুরু করেন।সারনাথে অবস্থান কালে তিনি মহাবোধি সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া'র সাধারণ সম্পাদক দেবপ্রিয় বালিসিংহ'র সংস্পর্শে আসেন এবং অস্পৃশ্য শিশুদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে সারনাথে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৪০ খ্রীঃ পালি শিক্ষা প্রচার-প্রসারে মোগগল্লান পালি ব্যাকরণের ভিত্তিতে "পালি মহাব্যাকরণ" নামক একটি দীর্ঘ ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেন।তিনি পালি ব্যাকরণ ব্যতীত সংযুক্ত নিকায় সহ অন্যান্য বৌদ্ধ গ্রন্থের হিন্দি অনুবাদ ও সম্পূর্ণ করেছিলেন।
বৌদ্ধ ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। অতঃ তাঁর কর্মপদ্ধতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামপুরের এক মুসলিম জমিদার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ১১ একর জমি নিঃশর্তে দান করেছিলেন।১৯৫১ খ্রীঃ ২০ নভেম্বর স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড.রাজেন্দ্র প্রসাদ মহাশয় নব নালন্দা মহাবিহারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।অতিবিলম্বে নালন্দায় পুনঃ পালি ও বৌদ্ধ ধর্ম দর্শন অধ্যয়ন শুরু হয়।একসময় ভিক্ষু শীলভদ্র প্রমুখ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ বিংশ শতাব্দীতে ঐ একই কার্য সম্পাদন করেছিলেন।আর এভাবেই বিধর্মীদের অজ্ঞতার কারণে বিনষ্ট হওয়া নালন্দার পরিচয় পুনঃ বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আচার্য শীলভদ্র 'র যোগ্য উত্তরসূরী রূপে ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপের এই অবদান বাস্তবিক অর্থে অনস্বীকার্য।
ভগবান বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের ২৫০০ তম বার্ষিকীতে ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ সমস্ত ত্রিপিটক গুলিকে নাগরী লিপিতে প্রকাশ করার একটি প্রকল্প রূপে ভারত সরকারের নিকট হতে আর্থিক অনুমোদন লাভ করেছিলেন।১৯৫৬-৬১ খ্রীঃ'র সময়কালে ৫ বৎসর কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি নব নালন্দা মহাবিহার হতে ৪১ খন্ডে সম্পূর্ণ ত্রিপিটক সাহিত্য প্রকাশ করেন।ত্রিপিটকের এই নাগরী লিপি সংস্করণ 'নালন্দা সংস্করণ' নামে বিশ্ব নন্দিত হয়েছে।
মহান ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ ১৯৭৬ খ্রীঃ ২৮ জানুয়ারি রাজগীরে জাপানি ফুজি গুরু দ্বারা নির্মিত শান্তি স্তুপে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।নালন্দায় তাকে দাহ করা হয়।ত্রিরত্ন বৌদ্ধ ফেডারেশনের প্রধান আচার্য সংঘ রক্ষিত তাঁর আট গুরুর মধ্যে ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপকে তাঁর শিক্ষক রূপে গ্রহণ করেছেন।
বিংশ শতাব্দীর যে সকল ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু তথা পন্ডিত ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের নবজাগরণের প্রশ্নে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন, তাদের মধ্যে জগদীশ কাশ্যপ অন্যতম।যিনি নালন্দার হৃত গৌরবকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন এবং সম্পূর্ণ ত্রিপিটকসহ পালি সাহিত্যকে আমাদের প্রতি সমর্পণ করেছিলেন।তাঁর এই মহান অবদানের কথা স্মরণ করে ধম্মপদের এই গাথা তথা অভিধর্ম কোশের(৪,১,পৃ:৮৫) এই কথাটি অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে
"কর্মজং লোকবৈচিত্র্যং,চেতনাতৎকৃতং চ তত।
চেতনা মানসং কর্ম,তজ্জে বাককায়কর্মনি।।"
No comments:
Post a Comment