সুমনপাল ভিক্ষু
“প্রকৃতিপ্রভাস্বরাধর্মাঃ সুবিশুদ্ধাঃ নমঃ সভাঃ।
ন বোধির্নাভিসময়মিদং বোধিনয়ং হৃঢ়ম্।
অহো বুদ্ধ অহোধর্ম অহোসভস্য দেশনা।
শুদ্ধতত্ত্বার্থ শুদ্ধার্থ বোধিচিত্তনমোহস্তুতে।।
ধর্ম নৈরাত্ম্যসমভূত বুদ্ধবোধিপ্রপূরক।
নির্বিকল্প নিরালমব বোধিচিত্ত নমোহস্তুতে।।
সমন্তভদ্রসত্ত্বার্থ বোধিচিত্তপ্রবর্ত্তক।
বোধিচর্প মহাবজ্র বোধিচিত্ত নমোহস্তুতে।।
চিত্তং তথাগতং শুদ্ধ কায়বাক্চিত্তবজ্রধৃক।
বুদ্ধবোধিপ্রদাতা চ বোধিচিত্ত নমোহস্তুতে।।”
-গুহ্যসমাজতন্ত্রম্, পটল-৩, পৃঃ ৮-১০।
পুনঃ “মা কুলপুত্রা ইমাং হীনসংজ্ঞাং জুগুপ্সিতসংজ্ঞাং চোঃপাদয়াথা তত্ কস্মাদ্দেতোঃ। রাগচর্যা কুলপুত্রা যদুত বোধিসত্ত্বার্যা যদুত অগ্রচর্যাত্ দ্যথা অপি নাথ কুলপুত্রা আকাশং সর্বত্রানুগতথাকাশানুগতানি সর্বধর্মানি। তানি ন কামধাতুস্থিতানি ন রূপধাতুস্থিতানি নারূপধাতুস্থিতানি ন চতুর্থহাভূতস্থিতানি। এবমেব কুলপুত্রাঃ সবধর্মা অনুগন্তব্যাঃ। ...এবমেব কুলপুত্রা সর্বতথাগতবজ্রসময়াঅনুগন্তব্যাঃ। গমনাগমনাদ্যৈরিতি।” -গুহ্যসমাজততন্ত্রম্, পৃঃ৩।
মহাযানবাদের পরবর্তী বিকাশকে বৌদ্ধ আচার্যগণ আলোচনা তথা ব্যাখ্যা করেছেন। ‘অদয়বজ্রসংগ্রহ’তে সংগ্রহীত তত্ত্বরত্নাবলীতে মহাযানকে ২ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে – পারমিতানয় এবং মন্ত্রনয়। মন্ত্রনয় বা মন্ত্রযান সাধারণ ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে অত্যধিক কঠিন, গম্ভীর এবং রহস্যপূর্ণ ছিল। মন্ত্রযান’কে শুধুমাত্র উন্নত সাধক, তীক্ষেন্দ্রিয়াধিকারসম্পন্ন সাধকের ক্ষেত্রেই উপযুক্ত বলা হয়েছে। “মহাযানং চ দিবিধং পারমিতানয়ো মন্ত্রণয়শ্চেতি; ‘মন্র্রণয়স্তু অস্মাদি (মৈ) রিহাতিগম্ভীরবাদ গম্ভীরণয়াধিমুক্তিক পুরুষ বিষয়ৎবাদ চতুর্মুদ্রাধিসাধন প্রকাশন – বিস্তারৎবাচ্চ গ ব্যাক্রিয়তে।” তথা চ-একার্থৎবহস্যসংমোহাত্ বহুপায়োদদুষ্করাত্। তীক্ষ্নেন্দ্রিয়াধিকারচ্চ মন্ত্রশাস্ত্রং বিশিষ্যতে।” -অদয়বজ্রসংগ্রহ, পৃঃ ১৪, ২১।
এই মন্ত্র নয়’ হতে পরবর্তী বজ্রযান, কাশচক্রযানাদি বিকসিত হয়েছিল। এর দ্বারা স্পষ্টতর হয় যে অদয়বজ্রের এই বিভাজন বিকাশ, সাধনাবস্থা এবং সাধনভেদ (এই তিনটি বিষয়) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই রূপেই বিদ্বানগণ একে স্বীকার করেছিলেন। প্রসঙ্গত কারণে বলা যায় যে বোধিসত্ত্বপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পারমিতা সাধন এবং মন্ত্রসাধন উভয়ই প্রচলিত ছিল। তবে তান্ত্রিক তত্ত্বে মন্ত্র, মুদ্রা, মদ্য, মৈথুন, মাংস ইত্যাদি তত্ত্বের প্রয়োগ প্রারম্ভ’র প্রশ্নে কোন ব্যক্তি অথবা গ্রন্থ উত্তরদায়ী ছিল, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
মহাযান ধর্মে ও মৈথুন শব্দটি বারংবার ব্যবহত হয়েছে। এই তত্ত্ব মহাযানে কিভাবে উদভূত হয়েছে, তা আলোচনা করার পূর্বে মহাযানের উদ্ভবকাল সম্পর্কে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়। মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন ‘অন্ধক’ সম্প্রদায়ের প্রতি পর্যাপ্ত গুরুত্ব প্রাবেন করেছিলেন এবং এর অন্তর্গত বৈপুল্য, পূর্বশৈলীয়, অপরশৈলীর, রাজগিরিক এবং সিদ্দার্থক নিকায়ের গননা করা হয়। এইভাবে আচার্য নাগার্জুন হতে এদের সম্পর্ক প্রতীত হয়। কথাবত্তু (কথাবতথু) তে মোগ্গলিপুত্ত তিস্স’ এদের যে সিদ্দান্তের খন্ডন করেছিলেন, তার দ্বারা প্রতীত হয় যে বৈপুল্যবাদী এইটি স্বীকার করতেন যে ১. সংহ না তো দান গ্রহণ করে, না তাকে পরিশুদ্ধ করে তথা উপভোগ করে, না তো সংঘকে প্রদান করলে মহাফল হয়। ২. বুদ্ধকে দান প্রদান করলে না তো মহাফল হয়, না তো বুদ্ধ লোকে অবস্থান করেন আর না তো বুদ্ধ ধর্মোপদেশ করেছেন। ৩. বিশেষ প্রয়োজনে (একাভিপ্রায়েন) মৈথুন’এর সেবন করা যেতে পারে। এর মধ্যে ঐতিহাসিক বুদ্ধের অস্বীকৃতি তথা মৈথুনের অনুজ্ঞা ইত্যাদি ২টি বিষয় প্রাচীন বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে অত্যাধিক উদ্যোগজনক ছিল। মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন চার ‘অন্ধক’ নিকায়ের উৎপত্তি খ্রীঃ পূর্ব প্রথম শতাব্দী অনুমান করেছেন। বৈপুল্যবাদের প্রচারকগণের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থান আচার্য নাগার্জুনের ছিল এবং তার বাসস্থান শ্রীথবর্ত এবং ধান্যকটক ছিল। এর দ্বারা মৈথুন সমবলিত ধর্ম প্রচারকগনের মধ্যে নাগার্জুন’এর মহত্ত্ব স্থাপিত হয়।
এই রূপ ধর্মসাধনার আদ্য আচার্য রূপে অথবা তান্ত্রিক মহাযান ধর্মের প্রারম্ভিক চরণের পুরসতর্ক রূপে কিছু বিদ্বান আচার্য অসঙ্গকে প্রতিষ্ঠিত করে থাকেন। মহাযান সূত্রালংকারে পঞ্চপরাবৃত্তি (পঞ্চেন্দ্রিয় পরাবৃত্তি, মানস পরাবৃত্তি, সসার্থোদ্গ্রহ পরাবৃত্তি, বিকল্প পরাবৃত্তি, প্রতিষ্ঠাপরাবৃত্তি এবং মৈথুনপরাবৃত্তি) দ্বারা বিভূত্ব প্রাপ্তি বলা হয়েছে। মৈথুন এবং পরাবৃত্তি শব্দ অত্যন্ত বিবাদাস্পদ মনে হয়েছে। এই বিষয়ে সিল্ভা লেবী, ড. উইন্টরনিৎস এবং সুজুকি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন। ড. উইন্টরনিৎস’এর মতে বিষয়টি ভোগ-বিলাস হতে বিরতি হবে হয়ত। দ. বাক্চী এই বিষয়ে বলেছেন ‘মৈথুনস্য পরাবৃত্তৌ’র অর্থ হল মৈথুন হতে বিরতি বা বিরাগ না হয়ে ‘মৈথুন জনিত আনন্দের সমান সুখ উপভোগ করা’। এই অর্থটি ড. উইন্টরনিৎস’এর মন্তব্যের প্রায় সমার্থক হয়।
ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য অসঙ্গ’কে আদ্য তান্ত্রিক আচার্য রূপে সিদ্দ করার প্রশ্নে তাকে গুহ্যসমাজতন্ত্রের রচয়িতা বলেছেন যেখানে ষট্কর্ম, পঞ্চমকার তথা সিদ্দি বিষয়ক বিস্তৃত উপদেশ প্রাপ্ত হয়।
“চিত্তবজ্রধরোরাজা সর্বাগ্রূয়ো ভূবনেশ্বরঃ।
ধর্মচর্যাগ্রূয়ধর্মার্থং ভাষাতে চর্যলফশম্।।
নির্বিকল্পার্থসম্ভথতাং রাগদ্বেষমহাকুলাম্।
সাধয়েত্ প্রবরাং সিদ্ধিসগ্রযানেহ্যনিত্তরে।।
চন্ডালবেনুকারাদ্যা মারনার্থার্থচিন্তকাঃ।
সিস্ধমন্ত্যগ্রূয়মানেহস্মি্ন মহাযানে হ্যনুত্তরে।।
আনন্ততর্যপ্রভূতয়ঃ মহাথাপকৃতোহপি।।
সিদ্ধমন্তে বুদ্ধযানেহস্মিন্ মহাযানমহোদধৌ।।”
-গুহ্যসমাজতন্ত্রম্, পঞ্চম পটল, পৃঃ ১৫
বৌদ্ধধর্মে শক্তি তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা, এর (গুহ্যসমাজতন্ত্র) সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য। এর সাথে এতে পঞ্চধ্যানী বুদ্ধ এবং তার শক্তিকেও কল্পনা করা হয়েছে। মঞ্জুশ্রীমূলকল্প এর পরবর্তী অর্থাৎ ৭ম শতাব্দীর রচনা, অপরদিকে এই গুহ্যসমাজতন্ত্র অসঙ্গকালীন, অর্থাৎ ৩য় খ্রীষ্টিয় শতাব্দীর গ্রন্থ। সাধনমালার ‘প্রজ্ঞাপারমিতা সাধন’কেও তিনি অসঙ্গকৃত বলেছেন। তবে ড. উইন্টরনিৎস বিস্তারিত ভাবে ড. ভট্টাচার্যের মতকে খন্ডন করেছেন। তিনি তান্ত্রিক নাগার্জুন এর সময় ৭ম শতাব্দী বলেছেন এবং যিনি মাধ্যমিক মতের প্রতিষ্ঠাপক আর্য নাগার্জুন হতে সম্পূর্ণ অর্থ ভিন্ন ছিলেন। এর প্রতি ভিত্তি করে ড. উইন্টরনিৎস বৌদ্ধধর্মে ৭ম শতাব্দীর পূর্বে তন্ত্র প্রচারকে স্বীকার করেননি। তিব্বতী পরম্পরা অনুসারে নাগার্জুনের জীবনাবধি ৬০০ বর্ষ স্বীকার করা হয়েছে এবং পুনঃ তাঁকে মাধ্যমিক শাস্ত্র এবং গুহ্যসমাজ পদ্ধতি উভয়ের সঙ্গে সমবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গুহ্যাত্মক মহাযান ধর্মের তান্ত্রিকতা’র মান্যতা তথা ধারণী হতে বিকসিত হওয়া মন্ত্রতত্ত্বকে পন্ডিতগণ বিশেষরূপে ব্যাখ্যান করেছেন। মহাসাংঘিকগণ একটি বিদ্যাধরপিটক তথা ধারণীপিটক সংগ্রহ করেছিলেন। ললিতবিস্তর, সদ্ধর্মপুন্ডরীক সূত্র এবং লংকাবতার সূত্রও ধারণী হতে পরিচিত ছিল। সদ্দর্মপুন্ডরীক’এ ধারণীমন্ত্রপদের পর্যাপ্ত পরিচয় পাওয়া যায়।
দিব্যাবদানে ‘ওম্ মনিপদেম্ হুম্’ ইত্যাদি প্রসিদ্ধ মন্ত্র অবলোকিত’এর ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছে। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য ধারণী দ্বারা মন্ত্রের বিকাশকে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা কালে অষ্টবাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার বিকাশ প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয়ে সূত্র, প্রজ্ঞাপারমিতা ধারণী, প্রজ্ঞাপারমিতা মন্ত্রের ক্রমানুসারে ‘প্রং’ নামক বীজাক্ষর বলেছেন। এইটি প্রজ্ঞাপারমিতার প্রতীক। এইভাবে মন্ত্রযানের প্রাচীনতা সিদ্ধ করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থের উদ্ধারকর্তা এবং প্রজ্ঞাপারমিতাস্তব’এর রচয়িতা নাগার্জুনের মহাপ্রজ্ঞাপারমিতা শাস্ত্র হতে তথা ধারণী হতে (মন্ত্রের বিকাশ ক্রমকে পর্যালোচনা করলে) এই সত্যে উপনীত হওয়া যায় যে বস্তুতঃ পারমিতা যানের ধারণা বা সাধনা হল মন্ত্রযান’এরই সাধনা। প্রজ্ঞা হল স্বয়ং শক্তি। এর প্রতি ভিত্তি করে বলা হয় যে এইটি একপ্রকার ‘শক্তি সাধনা’। অতএব নাগার্জুনকে তান্ত্রিক মহাযান ধর্মের আদ্য আচার্য রূপে স্বীকার করা যেতেই পারে। অপর দিকে মৈত্রেয়নাথ এবং অসঙ্গকে যা ইতিপূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে, মৈথুনপরক রহস্যবাদের সঙ্গে সম্পদ করা হয়েছে। যদি নাগার্জুনকে আদ্য আচার্য রূপে স্বীকার করা হয় তাহলে প্রজ্ঞার অভ্যুদয়’এর কারণ তান্ত্রিক মহাযান ধর্মের উদয় খ্রীঃ পূর্ব ১ম শতাব্দী নয় অধিকিন্তু তারও পূর্বে স্বীকার করতে হবে। মঞ্জুশ্রীমূলকল্পকে যদিও কিছু বিদ্বান ২য় শতাব্দীর রচনা বলে স্বীকার করেছেন কিন্তু তা ৮ম শতাব্দীর হওয়া উচিত। অতঃ বিদ্বানগন পর্যাপ্ত প্রমাণ প্রদান পূর্বক এইটি প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে ৭ম শতাব্দীর পূর্বেই মহাযান ধর্মে তন্ত্রের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ হয়েছিল। এইভাবে ড. উইন্টরনিৎস’এর অভিমতকে খন্ডন করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
তিব্বতী বৌদ্ধ ঐতিহাসিক লামা তারানাথ (তারনাথ)’এর অভিমতকে পাথেয় করে বিদ্বানগন বলেছেন যে তান্ত্রিক সাধনা অত্যন্ত গুপ্ত রূপে গুরু শিষ্য পরম্পরানুসারে অসঙ্গ হতে ধর্মনীতির সময়কাল পর্যন্ত জীবিত ছিল। এই রহস্য সাধনা উত্তরকালে জনসামান্য’তে প্রচলিত হয় এবং দীক্ষা প্রদানের মাধ্যমে রহস্যোপদেশ এবং সাধনা ৪র্থ শতাব্দী হতে প্রায় ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত জীবিত ছিল বলে মনে হয়। তবে নাগার্জুন (প্রথম শতাব্দী) হতে শুরু করে প্রায় ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত এইরূপে প্রচলিত থাকার না তো কোন প্রমাণ পাওয়া যায় আর না তো বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। সাধক এবং সাধ্য উভয়ক্ষেত্রে ‘শক্তি’র কল্পনা নিশ্চয়ই পরবর্তী সময়ের, কিন্তু এও নিশ্চিত যে তন্ত্র-মন্ত্র-মন্ডল ইত্যাদি পূর্বেই লিখিত গ্রন্থে স্থান লাভ করেছিল এবং এও হতে পারে যে শক্তির কল্পনা ও গুরু-শিষ্য পরম্পরা অনুসারে দীর্ঘকাল পর্যন্ত হয়ত জীবিত ছিল তথাপি গুহ্যসমাজতন্ত্র, হে বজ্রতন্ত্র ইত্যাদি গ্রন্থের পূর্বে এর ব্যবস্থিত বিবরণ পাওয়া যায় না। সর্বোপরি প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ সঙ্গীতি এবং পালি গ্রন্থ সমূহে (ত্রিপিটক, অটঠ্কথা সাহিত্য ইত্যাদি) তন্ত্র তথা গুহ্য সাধনার কোন রূপ উল্লেখ পাওয়া যায় না। এই অর্থে বৌদ্ধতন্ত্রের প্রাচীনতা প্রতিষ্ঠিত হয় না।
উপর্যুক্ত বিবরণ হতে এইটি স্পষ্টতর হয় যে প্রায় ১ম শতাব্দী হতে ৪র্থ শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধের পরম দেবত্ব রূপ, অমিতাভ, বোধিসত্ত্ব, অবলোকিতেশ্বর, পঞ্চধ্যাণী বুদ্ধ, মঞ্জুশ্রী ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হয়েছিল। এদের পূজা-প্রার্থনার প্রশ্নে অনেক স্ত্রোত্র, ধারণী এবং মন্ত্রের নির্মাণ ও বোধিসত্বের ক্ষেত্রে করুণা-প্রসার এবং প্রজ্ঞার উপলব্দি দ্বারা অভিন্ন স্বীকার করা হয়েছিল। নাগার্জুনের মাধ্যমিক মত অথবা শূন্যবাদ সেখানে দার্শনিক ভূমিকা বিচারনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সেখানে যোগাচার মত যোগ এবং আচারকেও প্রতিষ্ঠিত করেছিল। প্রজ্ঞাপারমিতা সাধনা নাগার্জুনের সৎপ্রযত্ন দ্বারা শক্তি সাধনার বীজ রোপন করেছিল এবং এর বিকাশ যান্ত্রিক প্রয়োগের প্রজ্ঞাপারমিতার সাধন রূপে হয়েছিল। বিজ্ঞানবাদ অধবা যোগাচার মতের আচার্য মৈত্রেয় এবং অসঙ্গ মৈথুনপরক সাধনার ঔপম্যাবিধানপরক স্বরূপ প্রস্তুত করেছিলেন এবং সাথে বিজ্ঞানতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠাপূর্বক চিত্তকেই এই সম্পূণফ সংসারের উৎপত্তি ও প্রাণাশের মূল বলেছেন।
বোধিচিত্তোপাদের ক্রমনিবিষ্ট প্রক্রিয়াতে সময়ের অপব্যয় তথা শ্রঘ্র প্রজ্ঞোপলব্দি বা প্রত্যাত্মগতিকে প্রাপ্তির ভাবনা দ্বারা ধারনী এবং মন্ত্রকে অত্যধিক গুরিত্ব প্রদান করা হয়েছিল। এই ধারণী ও মন্ত্র দ্বারা অর্জিত শক্তির সহায়তা দ্বারা প্রাণীমাত্র দুঃখের সমুদ্ধরণের প্রক্রিয়াতে সদৈব লীন হওয়া বোধিসত্ত্বের অভ্যুদয় বহুলতা পূর্বক শুরু হল। মূর্ত্তি এবং সেই সকল দেবতার প্রতীক সমূহের ও বিস্তার হতে লাগল। মূর্ত্তি-নির্মাণ এবং তাদের পূজা-বিধানের প্রতি পর্যাপ্ত সময় প্রদান তথা এদের মাহাত্ম্য তথা গুণ-কীর্ত্তন অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে সম্পাদন শুরু হল। এইভাবে ধার্মিক, সাধনাত্মক এবং দার্শনিক পরিস্থিতিতে মন্ত্রযান হতে বজ্রযানের উদ্ভব হল।
মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন মান্ত্রিক সাধনা অথবা মন্ত্রযানের অবধি ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বলেছেন। যদি ধর্মকীর্তির সমব ৭ম শতাব্দীর উত্তরার্দ্ধ স্বীকার করা হয়, যেমনটি এইচ.কর্ণ (ম্যানুয়েল অর্ বুড্ডিজম্) বলেছেন, তাহলে উপর্যুক্ত পারম্পরিক বিশ্বাসের প্রতি ভিত্তি করে কথা বলা যায় যে উত্তরকালে এখন অনেক সিদ্ধাচার্য উৎপন্ন হয়েছিলেন যারা উপর্যুক্ত প্রকারের গুপ্ত পরম্পরা দ্বারা প্রচলিত সাধনা পদ্ধতিকে অপেক্ষাকৃত অধিক ব্যাপক, ব্যবস্থিত এবং প্রকাশিত রূপে প্রচারিত করা আরম্ভ করেছিলেন। এর এক অর্থ এও হতে পারে যদিও মন্ত্র-তন্ত্রের প্রচার তো জনসামান্য’তে অবশ্যই ছিল কিন্তু শক্তি তত্ত্ এবং পঞ্চমকার (মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন, মাংস এবং মদ্য) এর সাধনা অত্যন্ত গুপ্ত, সীমিত এবং দীক্ষিত মন্ডলীতে’ই প্রচলিত ছিল। অতঃ এই তত্ত্ব সমন্বিত সাধনা সাধারণ জনগনের মধ্যে প্রচার ৭ম শতাব্দীর পরবর্তী সময়ে হয়েছিল, এই অনুমান করা যায়। যদিও ৭ম শতাব্দীর পূর্বে এইরূপ কোন তন্ত্রগ্রন্থ পাওয়া যায়নি যেখানে ‘পঞ্চমকার’এর বিবরণ রয়েছে তবুই অশ্বকোষ, নাগার্জুন এবং কুমারজীবন’এর সমকালীন এবং নাগার্জুনের শিষ্য আর্যদেবের ‘চিত্তবিশুদ্ধিপ্রকরণ’কে দ্বিতীয় শতাব্দীর উত্তরাদ্ধের গ্রন্থ ঘোষিত করে তাকে উপর্যুক্ত তত্ত্ব দ্বারা সমন্বিত রূপে স্বীকার করা হয়েছে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্র্রসাদ শাস্ত্রী এইরূপে অভিমতকে স্বীকার তথা গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য এই গ্রন্থের লেখক’কে ৭ম শতাব্দীর আর্যদেব বলেছেন। শ্রী পি.ভি. প্যাটেল (চিত্তবিশুদ্ধি প্রকরণ অফ্ অর্যদেব) উক্ত গ্রন্থের সম্পাদন কালে এর ভূমিকাতে প্রভূত প্রমাণের প্রতি ভিত্তি করে এইটি প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্ঠা করেছেন যে এই গ্রন্থের রচয়িতা আর্যদেব রাহুল ভদ্র অথবা সরহের শিষ্য নাগার্জুনের সমকালীন ছিলেন। অন্য প্রমান হতে এইটি প্রতিষ্ঠিত হয় যে এর রচয়িতা আর্যদেব পালবংশীয় শাসক গোপাল’এর সমকালীন শাক্যমিত্রের পূর্ববর্তী অথবা ৮ম শতাব্দীর প্রারম্ভিক সময়ের কিছু পূর্বে বিদ্যমান ছিলেন। তবে ৭ম শতাব্দীর পূর্বের কোনোরূপ লিখিত প্রমান এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এখন আমরা মন্ত্রযানের পরবর্তী তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধনা (তন্ত্রযান), ধর্ম এবং দর্শনের বিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
অনেকযান এবং আচার ত্রয়
ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য পরবর্তী বৌদ্ধমতের বিভাজন বজ্রযান, কাল-চক্রযান এবং সহজযান ইত্যাদি করেছেন। এর অতিরিক্ত কিছু অন্যযানেরও বিবরণ পাওয়া যায় এবং যাদের সম্পর্ক এই তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেমন- তন্ত্রযান, মন্ত্রযান এবং ভদ্রযান ইত্যাদি। সংক্ষেপে সম্প্রদায়-বিভাজন’এর মতকে এইরূপে প্রস্তুত করা যেতে পারে। যেমন –
১. কে. দবাসম্ দুপ (শ্রী চক্রসম্ভার তন্ত্র তান্ত্রিক টেক্সট)।
মন্ত্রযান
ক্রিয়াতন্ত্রযান চর্যাতন্ত্রযান যোগতন্ত্রযান
মহাযোগতন্ত্রযান অনুত্তরযোগতন্ত্রযান অতিযোগতন্ত্রযান
২. ড. শশীভূষণ দাশগুপ্ত (আবস্ক্যোর রেলিজাস্ কাল্টস্)।
মন্ত্রযান ক্রিয়াতন্ত্রযান চর্যাতন্ত্রযান যোগতন্ত্রযান অনুত্তরযোগতন্ত্রযান নিম্নতন্ত্র, অনেক প্রকার বিধি-বিধান দ্বারা যুক্ত, উত্তমন্ত্রতা, পরমসত্যের সাক্ষাৎকার সম্পাদনের দেবী-দেবতার পূজা এবং অন্য বাহ্য পূজা-বিধান নিমিত্তে যৌগিক সাধনার প্রধানতা, পরম সত্যের দ্বারা যুক্ত প্রকৃতি প্রতি পর্যালোচনা অতিযোগতন্ত্রকে’ই কে দবাসম দুম মহাশয় সর্বোত্তম যান বলেছেন। তাই তন্ত্র মূলতঃ অদ্বৈতবাদী এবং শুণ্যবাদী ছিল। সংসার এবং নির্বাণের অদ্বৈততা কেই সাধক চরম সিদ্ধিলাভ রূপে স্বীকার করেছেন। ড. দাশগুপ্ত দ্বারা প্রস্তুত বিভাজনে অনুত্তর যোগতন্ত্রযান অন্তিম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ; কিন্তু তারানাথের প্রমাণের প্রতি ভিত্তি করে এইচ. কর্ণ অনুত্তরযোগতন্ত্রযানকে পরবর্তী সময়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা বলেছেন। ইতিপূর্বে বিভাজনে যে নিম্নতন্ত্র এবং উত্তমতন্ত্রের উল্লেখ হয়েছে, তার দ্বারা উভয় ক্ষেত্রেই বাহ্য এবং অন্তস্সাধনার পার্থক্যটি স্পষ্টতর হয়। অনুত্তরযোগ সাধনার পূর্ণ প্রকৃষ্ট রূপ সহজযান রূপে বিকসিত প্রতীত ্য়, যাকে অতিযোগ তন্ত্রযান বলা হয়েছে। এই দুই যানের অতিরিক্ত কালচক্রযানের ও উল্লেখ করা হয়। সম্ভবত কালচক্রযান পূর্বে স্বতন্ত্র মত ছিল কিন্তু উত্তরকালে তান্ত্রিক বৌদ্ধ সমাজ দ্বারা সম্মিলিত করা হয়েছিল। তবে ড. ভট্টাচার্য কালচক্রযানকে বজ্রযানের পরে স্থান প্রদান করেছেন। ড. বেভেল বজ্রযানের পূর্বে কালচক্রযানের উৎপত্তি বলেছেন। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’র মতে বেডেলের এই ধারণা সম্পূর্ণ অর্থে অযৌত্তিক। কারণ শ্রীকালচক্র মূলতন্ত্রের বিবরণ ‘অভিনিশ্রয়ণসূত্র’তে পাওয়া যায়। কাস্মা ডে কারাস অনুসারে ভারতে এর প্রবর্তন সম্ভবত ৯৬৬ খ্রীঃ হয়েছিল।
ইতিপূর্বে সম্প্রদায়’এর যে বিভাজন প্রস্তুত করা হয়েছিল, তাতে স্পষ্ট অর্থেই অধিকার ভেদের সিদ্ধান্ত নিবিষ্ট রূপে দৃষ্ট হয়। অধিকারভেদেবাদ হল তন্ত্রের প্রিয় বিষয়। ফলে ক্রিয়াতন্ত্র, চর্যাতন্ত্র ইত্যাদির বিভাজন এই সিদ্ধান্তের প্রতি ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেই মনে হয়। ড. ভট্টাচার্য এই বিষয়টি সিদ্ধ করছেন, যেভাবে হিন্দুতন্ত্রের দক্ষিনাচার এবং বামাচার নামক দুটি বিভাজন স্বীকৃত ঠিক সেইভাবে বৌদ্ধতন্ত্রের ক্রিয়াতন্ত্র এবং চর্যাতন্ত্রকে দক্ষিনাচারে তথা যোগতন্ত্র এবং অনুত্তর যোগতন্ত্রকে বামাচারের অন্তর্গত গননা করা হয়। দক্ষিনাচারে পূর্ণ কঠোর ব্রহমষর্য, নিয়মিত ভোজন, নিয়মিত যান এবং নৈতিক আচার মুখ্যরূপে গণ্যকরা হয়। যখন সাধক এই আচারে পূর্ণতা লাভ করেন তখন তিনি বামাচারে দীক্ষিত হওয়ার অধিকারী হন। এই বামাচারে বামা বা শক্তি বা নারীকে আচার সাধনের অনিবার্য উপকরণ রূপে স্বীকার করা হয়েছে। উপরে যে বিবরণ প্রস্তুত করা হয়েছে, তার প্রতি ভিত্তি করে বলা যায় যে প্রায় ৭ম শতাব্দীর পূর্বে যেরূপ সাধনা প্রচলিত ছিল, যার প্রাথমিক বিবরণ মহাযান সূত্র এবং অন্যান্য সংসখরত বৌদ্ধ গ্রন্থে পাওয়া যায়, তা মূলঅর্থে দক্ষিনাচার’ই ছিল। অর্থাৎ সেই সময় ক্রিয়াতন্ত্র এবং যোগতন্ত্রের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হোত।
যদি বামাচারের কোন সাধনা সেই সময় প্রচলিত থাকত তাহলে তার প্রমান এই সময় দৃষ্ট হয় না। ৭ম শতাব্দীর গ্রন্থ বামাচারের প্রমকার সমন্বিত সাধনার প্রতি ইঙ্গিত করে কিন্তু বীদ্ধ দিদ্ধাচার্যগনের লোকভাষার প্রতি সহজসিদ্ধান্তের প্রতিমাদক রচনাসমূহ ভাব সাধনা বা দিব্য সাধনা’র প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে।
প্রায় ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত সাহিত্য এবং সাধনের যে বিবরণ প্রস্তুত করা হয়েছে, তার প্রতি ভিত্তি করে একথা বলা যেতে পারে এই কাল বস্তুতঃ এবং প্রমুখতঃ আচার্যের কাল ছিল। অতঃ বিদ্ধাচার্য কাল’এর আরম্ভ বলা যেতে পারে। এই সিদ্ধাচার্য অধবা মহাসিদ্ধ ৮৪ সংখ্যাতে প্রখ্যাত ছিল এবং বিভিন্ন প্রাচীন সংস্কৃত বৌদ্ধ গ্রন্থে এদের বিবরণ পাওয়া যায়। এদের অধিকতর বিস্তারকাল ১২ শতাব্দী স্বীকার করা হয়। প্রমুখ সিদ্ধের বর্তমানতা ৭-৯ শতাব্দী পর্যন্ত বলা যেতে পারে। এই শতাব্দীতে বজ্রযান বিপূল প্রচার-প্রসার লাভ করেছিল প্রথম সিদ্ধ অথবা আদি সিদ্ধরূপে প্রায়ঃ সরহপাদ বা রাহুলভদ্র’র নাম উঠে আসে। এদের বজ্রযানের আদ্য আচার্য রূপে স্বীকার করা হয়। এদের সময়কাল ৮ম শতাব্দী কিন্তু ড. ভট্টাচার্য সরহপাদের সময় ৬৩৩ খ্রীঃ বলেছেন। মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ণ সরহপাদ’কে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন এবং অনেকে প্রমাণের প্রতি ভিত্তি করে এই আচার্যের সময়কাল ৭৬৮-৮০৯ খ্রীঃ স্বীকার করেছেন। এই সরহপাদ তাঁর রচনার দ্বারা বিচিত্র রীতি-পদ্ধতি তথা যোগ ক্রিয়া দ্বারা বজ্রযানকে এক সর্বজনীন ধর্মে রূপান্তরিত করেছিলেন। সর্বোপরি হেবজ্রন্ত্রের যে তান্ত্রিক পরম্পরাতে জলন্ধরপাদ এবং কৃষ্ঞপাদের উল্লেখ পাওয়া যায়, তার প্রবর্তক এবং প্রচারকরূপে সরহপাদের নাম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বস্তুতঃ বজ্রযানের আরম্ভ বজ্রভাবনার প্রতিষ্ঠার সাথেই স্বীকার করা উচিৎ। দেবী-দেবতার কল্পনা, তাদের বৈশিষ্ট্য, চিহ্ন, অস্ত্র-শস্ত্র, আভূষণ, বেশ-ভূষা, সকল ক্ষেত্রেই মহান পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। তাই যানের নেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিছু মুখ্যগ্রন্থ হল এইরূপ- আদিকর্মপ্রদীপ, অষ্টমী ব্রতবিধান, সাধনমালা, সাধন সমুচ্চয়, পঞ্চক্রম, গুহ্যসমাজ অথবা তথাগতগুহ্যক, মঞ্জুতশ্রীমূলকল্প, জ্ঞানসিদ্ধি, অদ্বৈতসিদ্ধি, চন্ডমহারোষতন্ত্র, চক্রসম্ভার তন্ত্র, অদয়বজ্র সংগ্রহ এবং হে বজ্রতন্ত্র ইত্যাদি। তান্ত্রিক মহাযানের পূর্বোক্ত উথ্থান অনুসারেই বজ্রযান সাহিত্যের ও বিভাজন দৃষ্ট হয়। ক্রিয়াতন্ত্রে মন্দির-নির্মাণ, দেবমূর্ত্তি-স্থাপনা ইত্যাদি ধার্মিক বিধির আলোচন দৃষ্ট হয়। চর্যাতন্ত্রে ব্যবহারিক আচার সম্পর্কিত বিধান প্রযুক্ত হয়েছে। যোগতন্ত্রে যোগাভ্যাস তথা অনুত্তরযোগতন্ত্রের উচ্চতর রহস্যবাদ ব্যাখ্যাত হয়েছে। প্রথম বিভাগে আদি কর্মপ্রদীপ, অষ্টমী ব্রত বিধান, সাধনমালা, সাধন সমুচ্চয় ইত্যাদি গ্রন্থের গননা করা হয়। পঞ্চক্রম অনুত্তরযোগতন্ত্রের গ্রন্থ এবং মঞ্জুশ্রমূলকল্পের গননা এই বিভাবে করা হয়। আদিকর্মপ্রদীল্পে’এর পদ্ধতি হল গুহ্যসুত্রের যেখানে প্রতিদিনের ক্রিয়াতন্ত্র ইত্যাদি বিধি-পদ্ধতি পাওয়া যায়। অষ্টমী ব্রত বিধান এ ব্রত, মুদ্রা এবং যন্ত্র-তন্ত্র-মন্ত্র সহ প্রার্থনা (সেমন হুং হুং ফট্ফট্ স্বাহা ইত্যাদি)র প্রয়োগ বুদ্ধ এবং বোধিসত্বের ক্ষেত্রেই নয় অন্যান্য দেবতার ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়েছে। এতঢ সিদ্ধি প্রবৃত্তি’র সঙ্গে অঙ্গুলির মুদ্রা বিধান ও রয়েছে। এইরূপ গ্রন্থে দেব-দেবীর উচিৎ রূপ, আকার, বর্ণ ইত্যাদির পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সাধনমালা এবং সাধন সমুচ্চয় গ্রন্থদ্বয় অতীব গুরত্বপূর্ণ। উক্তগ্রন্থ সমূহে যে সকল দেবী ও দেবতা সমূহের পূজা-পদ্ধতি তথা মন্ত্রাদির বিধান দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে মুখ্য হল – ধ্যানী বুদ্ধ বা পঞ্চধ্যানী বুদ্ধ, তাদের কুল, দেবী তারার বিভিন্ন রূপ। সাধনমালা (খন্ড-১)’এ বিষয়টি এইভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। যেমন –
“মাতৃমন্ডলমধ্যস্থাং তারাদেবীং বিভাবয়েত্।
অষ্টবাহুং চতুর্বক্রাং সর্ব্বালঙ্কার ভূষিতাম্।।
কনকবর্ণানিভাং ভব্যা কুমারীলক্ষনোজ্জ্বলাম্।
বিশ্বপদ্মবসামাসীন চন্দ্রাসনসুসংস্থিতাম্।।
থীতকৃষ্ঞাসিত রক্ত সব্যাবর্ত্তচতুর্মুখাম্।
প্রতিমুখং ত্রিনেত্রাং চ বজ্রপর্য্যঙ্কসংস্থিতাম্।।”
-সাধনমালা, খন্ড-১, বজ্রতারাসাধনম্।
বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী’র অবতার তথা বজ্রানঙ্গ’র বিবরণ সাধনমালার সাধন ৪৯-৬০’এ পাওয়া যায়। যদিও এই সাধনের মূলতত্ত্ব ভূতবিদ্যা এবং সিদ্ধি লাভ, তথাপি তাতে (যোগসাধনা, পূজা-উপসনা ইত্যাদিরও বিবরণ রয়েছে। এই গ্রন্থের ৩১২ সাধনের লেখকগণ- তান্ত্রিক অসঙ্গ নাগার্জুন, ইন্দ্রভূতি, পদ্মব্রজ, লক্ষীকরা, সহজযোগীনী চিন্তা, রত্নাকরগুপ্ত, অদ্বয়বজ্র, সহরপাদ, রত্নাকরশান্তি, শ্রীধর ইত্যাদি।
উত্তমতন্ত্রের মধ্যে গুহ্যসমাজতন্ত্র অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত একটি তন্ত্রযান গ্রন্থ। এই গ্রন্থটিকে বৌদ্তন্ত্রের সর্বাধিক প্রাচীন গ্রন্থ বলা হয়। এতে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম অথবা বজ্রযানের বিবিধ-পক্ষীয় আলোচনা দৃষ্ট হয়। এর বৈশিষ্ট্য হল এই যে এখানে শক্তিতত্ত্বের বিভিন্ন রূপকে ব্যক্ত করা হয়েছে। গুহ্যসমাজতন্ত্রে সামান্য সিদ্ধি (অন্তার্দ্ধান, অনিমা, লঘিমা ইত্যাদি), উত্তম সিদ্ধি (বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি), এই জন্মে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি, ষড়ঙ্গযোগে নিষ্ঞাত হওয়ার পরে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি, ইচ্ছাভোগ দ্বারা বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি, শক্তিতত্ত্বপ্রতিষ্ঠা, প্রত্যেক ধ্যানী বুদ্ধের সাথে এক-এক শক্তির কল্পনা, প্রত্যেক সাধকের সঙ্গে শক্তির প্রয়োজনীয়তা, প্রজ্ঞাভিষেক, মদ্য-মাংস-মৈথুন-মৎস্যের মুক্ত উপযোগ, হয়-হস্তি-শ্বান-মাংসের অতিরিক্ত মহামাংস পর্যন্ত বিধান, পবিত্র গ্রন্থপাঠ, মন্ডল-নির্মান, রত্নপূজা ইত্যাদি সর্বপ্রথম ব্যাখ্যাত হয়েছে। গুহ্যসমাজ তন্ত্রের দৃষ্টকোন অনুসারে সাধকের ক্ষেত্রে সামাজিক নিয়ম এবং মর্যাদা ব্যবহার্য নয়। সে এগুলিকে উল্লঙ্ঘন করতে পারেন। তাতে অসত্য ভাষণ, জীবহিংসা, পরদ্রব্যহরণ ইত্যাদি অনৈতিক কার্য হতে বিরত হতে হবে। একেি বজ্রমার্গ বলা হয়। শূন্যতার সাক্ষাতকাতী ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংসার হল নাতক এবং এর কোনোরূপ অস্তিত্বই নেই। এই গ্রন্থে ৪ প্রকার উপায়, ২ প্রকার সেবা – ষড়ঙ্গযোগ এবং হট্যোগ ইত্যাদির উপদেশ ও পাওয়া যায়।
বলা হয়েছে যে উত্তম সিদ্ধির সাধনা প্রারম্ভ করার পূর্বে সাধক’কে হঠযোগে পূর্ণ নিপূণ হওয়া প্রয়োজন। সামান্য চমৎকারিক সিদ্ধির বিষয়েও পূর্ণ নির্দেশ পাওয়া যায়। যট্কর্ম (মারণ, মোহন, উচ্চাটন, বশীকরণ, স্তম্ভন, বিদ্বেষন, আকর্ষন, শান্তিক ইত্যাদি)’র বিধানও নির্দেশিত হয়েছে। বোধিসত্ত্ব তথা তাঁর উৎপাদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় তথা বজ্রমার্গের অনুসরণ দ্বারা পতিততম অথবা অনৈতিকত ব্যক্তি ও নির্বাণ লা্য করতে পারেন বলা হয়েছে। দেবতা বিবেচন’এর দৃষ্টকোন অনুসারে ও এইগ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রন্থে সর্বপ্রথম ধ্যানী বুদ্ধের ব্যবস্থিত বিবরণ দৃষ্ট হয়। এই ধ্যানী বুদ্ধ – অক্ষোভ্য, অনিতাভ, বৈরোচন, অমোঘসিদ্থি এবং রত্নসম্ভব তথা এদের শক্তি সমূহ – লোচনা, মামকী, তারা, পান্ডরা এবং সময়তারা। চার চার রক্ষক – প্রজ্ঞান্তক, পদ্মান্তক, সমান্তক, বিঘ্নান্তক। অচল, টক্কিরাজ, নীলান্ডে, মহাবল নামক চার দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়। যারা মঞ্জুতশ্রী’র সাথে অবস্থান করেন অথবা উষ্ঞীষ বিজয়া’র সাথে। ভূতাধিপতি, অপরাজিত, জম্ভল, মঞ্জুতবজ্র, অবলোকিতেশ্বর’এর ও বিবরণ রয়েছে। এইগ্রন্থে বজ্রধর এবং বজ্রসত্ব পরস্পর মিশ্রিত হয়ে গেছে এবং পরবর্তী সময়ে বজ্রসত্ব হয়েছেন ষষ্ঠধ্যানী বুদ্ধ এবং বজ্রধর পরমোদ দেবতা রূপে পরিগণিত হয়েছেন। গুহ্যসমাজে বজ্রসত্ব বৌদ্ধ দেবতার অধিদেব রূপে প্রস্তুত করা হয়েছে।
“স্বচ্ছং চ তত্স্বভাবং চ নানারূপং সমন্ততঃ।
বুদ্ধমগ্নি সমাকীর্ণং সফুলিভগগনজ্বলম্।
স্বচ্ছাদিমন্ডলৈর্যুক্তং সর্বতথাগতং পুরম।।১।।
অহো হি সর্ববুদ্ধানাং বোধিচিত্তপ্রবর্তণম্।
সর্বতথাগতং গুহ্যং অপ্রতর্ক্যমণাবিলম্।।২।। ইতি।।
ভাষস্ব ভগবন্ তত্ত্বং বজ্রসারসমুচ্চয়ং।
সর্বতথাগতং গুহ্যং সমাজং গুহ্যসম্ভবম্।।৩।।ইতি।।” -গুহ্যসমাজতন্ত্রম্, সর্বতথাগত সমাধিমন্ডলাধিষ্ঠানপটল : প্রথম :
অন্য গ্রন্থ সমূহের মধ্যে প্রজ্ঞোপায়বিনিশ্চয়সিদ্ধি, জ্ঞানসিদ্ধি, অদ্বয়বজ্রসংগ্রহ ইত্যাদি গণনা করা যেতে পারে। প্রথম ২টি গ্রন্থে প্রজ্ঞোপায়, সংসারনিধান, তত্ত্বচর্যা, গুরুশিষ্যবাদ, দীক্ষা, মুদ্রা, বজ্রাচর্যপূজা ইত্যাদি অনেক দার্শনিক এবং সাধনাত্মক বিষয় আলোচিত হয়েছে। অদ্বয়বজ্রসংগ্রহ’তে দার্শনিক সিদ্ধান্ত ও রয়েছে। এতে অন্য বিষয়গুলি বজ্রযান গ্রন্থের সমান।
এই সম্পূর্ণ আলোচচনার তাৎপর্য এই যে তান্ত্রিক মহাযান ধর্মে সাধনা উপাসনার দৃ্ষ্টিতে তিনটি স্তরে বিভক্ত। তাকে আমরা আম্নায় ও বলতে পারি। প্রথমতঃ সাধকের একটি অংশ এইরূপে ছিল, যারা মন্ত্র–মন্ডল, অঙ্গুলির মুদ্রা, দেবী-দেবতার তান্ত্রিক বিধি-বিধান যুক্ত পূজা-উপাসনা ইত্যাদি বিশ্বাস করতেন এবং এর অনুসরণ পূর্বক সিদ্ধি, ভৌতিক-সাংসারিক উপলব্দি, ব্যাধিনাশ, ষট্কর্ম ফল ইত্যাদি প্রাপ্ত করতেন। এক্ষেত্রে সংযম, সদাচার, শীল ইত্যাদি পালনের ও বিধান ছিল। দ্বিতীয় অংশ শুদ্ধ এবং শক্তি সম্পন্ন হয়ে তান্ত্রিক বিধি অনুসারে প্রজ্ঞা সাধনাতে প্রবৃত্ত হতেন ও পঞ্চমকার, পঞ্চপবিত্র সেবনাদিতে পূর্ণ স্বচ্ছন্দতার আচরণ করতেন। তৃতীয় সাধক বর্গের কিছু সংকেত উপর্যুক্ত গ্রন্থে পাওয়া যায়, যারা এই সকল বাহ্যাচার (প্রথম এবং দ্বিতীয়, উভয়ই) খন্ডন পূর্বক পরমমহাসুখ’এর অনুভব অন্তসাধনা দ্বারা সম্পন্ন করতেন।
মন্ত্রযান এবং বজ্রযান ব্যতীত কালচক্রযান এবং সহজযান এবং সহজযানের কথা বিদ্বানগণ আলোচনা করেছেন। কালচক্রযান মূলতঃ আদিবুদ্ধ সিদ্ধান্ত। একে বৌদ্ধধর্মের ঈশ্বরবাদী রূপও বলা যেতে পারে যার প্রচার তিব্বতে কালচক্রযান রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই যানকেও মহাযানী সিদ্ধান্তের স্বাভাবিক বিকাশ বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে পঞ্চধ্যানী বুদ্ধ কেও এক আদিম বু্দ্ধের প্রকাশন অথবা অবতার রূপে কল্পনা করা হয়েছে। যদিও এই সম্প্রদাবের উল্লেখ কালচক্রযানী সাহিত্য উদ্ভবের পূর্বে কোন নিশ্চিত উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে আদিবুদ্ধ সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা করন্ডব্যুহ ইত্যাদি মহাযান সূত্রে পাওয়া যায়।
তিব্বতে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বিকাশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বঙ্গীয় বৌদ্ধ আচার্য অতীশ দীপঙ্কর অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। বিদ্বানগণের মতানুসারে ১০২৫ খ্রীঃ তিব্বতে কালচক্রযানের সূত্রপাত হয়। সআর চালর্স এলিয়টের মতে শাক্যমুনি কালচক্র সিদ্ধান্ত উড়িষ্যার ধ্যান্যকন্টক স্থানে করেছিলেন। অতঃ শম্ভল নামক শাসক সুচন্দ্র অত্যন্ত অলৌকিক ভাবে এই উপদেশ প্রাপ্ত করেন এবং কালচক্রতন্ত্রের স্ফূর্ত রচনা করেছিলেন, যদিও এর প্রকাশন ৯৬৬ খ্রীঃ হয়েছিল। তবে এলিয়টের এই তথ্য সমর্থন যোগ্য নয়।
মহামহাপোধ্যায় হয়প্রসাদ শাস্ত্রী অনুসারে কাল অর্থ মৃতা এবং বিনাশ। কালচক্রের অর্থ হল নাশচক্রের অর্থ হল নাশচক্র এবং এর সঙ্গে যান সংযুক্ত হওয়ার ফলে এর অর্থ হবে – কাল বা বিনাশের চক্র হতে রক্ষাকারী মার্গ। তবে সেকোদ্দেশে টীকাতে এর অর্থ ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে এবং এই অনুসারে ‘কা’ এর অর্থ শান্ত কারণ, ‘ল’-এ অর্থ হল ‘লয়’, ‘চ’এর অর্থ চঞ্চলচিত্ত তথা ‘ক্র’এর অর্থ ‘ক্রমবর্ধন’।
“দানং গোময়মম্বুনা চ সহিতং শীলং চ সম্মার্জনং
ক্ষান্তিঃ ক্ষুদ্রপিপীলিকাপনয়নং বীর্য্যং ক্রিয়াস্থাপণম্।
ধ্যানং তৎক্ষণমেকচিত্তকরণং প্রজ্ঞা সুরেখোজ্জ্বলা (ঃ)
রুতাঃ পারমিতাঃ ষভেব লভতে কৃত্বা মুনের্মন্ডলম্।।”
“ভবতি কণকবর্ণ সর্ব্বরোগৈর্বিমুক্ত:
সুরমনুজবিশিষ্টশ্চন্দ্র [৪ক] বদ্দীপ্তকান্তিঃ।
ঘনকনসমৃদ্ধো জায়তে রাজবংশ সুগতবরগৃহে হস্মিন্ কায়কম্মাণি কৃত্বা।।” -অদ্দয়বজ্রসংগ্রহ, মন্ডলপূজাবিধিঃ, পৃঃ ১০।
সাংসারিক বিষয় দ্বারা চঞ্চল চিত্তের সাথে পরম শান্ত কারণ (আদিবুদ্ধ)’এ প্রাণের লয়কে ‘কালচক্র’ বলা হয়।
“ককারাৎকারণে শান্তে লকারাল্লয়ো অত্র বৈ। চকারাচ্চলচিত্তস্যক্রকারাৎ ক্রমবন্ধনৈঃ।” -সেকোদ্দেশটীকা, পৃঃ ৮।
আদিবুদ্ধের কল্পনা করুনা এবং শূন্যতার মূর্ত্তি রূপে করা হয়েছে। এরই সংজ্ঞা হল কাল। তার শক্তি সংবৃতিরূপীনি হয়। অর্থাৎ জগতের এই ব্যবহারিক রূপ (সংবৃতি) এর শক্তি। চক্র সতত্ পরিবর্তনশীল বিশ্বের প্রতিনিধি। অর্থাৎ সক্তি দ্বারা সম্বলিত রূপই হল কালচক্র। এই অদ্বয় (দুই হয়েও এক) তথা সে নিত্য অবিনশ্বর তথা অক্ষর।
“করুণাশূন্যতামূর্তিঃ কাল সংবৃত্তিরূপীনী। শূন্যতা চক্রমিত্যুক্তং কালচক্রোহদ্বয়োকরঃ।।” -বৌদ্ধদর্শন মীমাংসা, পৃঃ ৪৫৭।
কালচক্রতন্ত্রম্’এ বলা হয়েছে-
“আদৌ সন্তাভিষেকো যো বালানামবতারনম্।
ত্রবিধৌ শোকসংবৃত্যা চতুর্থঃ পরমার্থতঃ।।১।।
সত্যাদয়েন ধর্মানাং দেশনা বজ্রিনো মম।
লোকসংবৃতিসত্যেন সত্যেন পরমার্থতঃ।।২।।
উদকং মুকুটঃ পট্টো বজ্রঘন্টা মহাব্রতম্।
নামানুজ্ঞাসমাযুক্তঃ সেকঃ সপ্তবিধ নৃপ।।৩।। -দীক্ষাপ্রকরণম্, পৃঃ৪৩
এইযানের মূলগ্রন্থ হল- শ্রীকালচক্রমূলতন্ত্র, সেকোদ্দেশটীকা, বিমলপ্রভা এবং পরমার্থ সেবা। পিন্ডব্রহমান্ডবাদ ইত্যাদি সিদ্ধান্তকে এই মান পুর্ণরূপে স্বীকার করে প্রাণাপাননিয়ন্ত্রণকে সর্বোত্তম সাধন বলেছেন। এই তথ্যের প্রতি ভিত্তি করে ড. দাশগুপ্ত উভয়যানের মধ্যে কোনরূপ মৌলিক পার্থক্য খুঁজে পাননি। পন্ডিত বলদেব উপধ্যায়ের মতে পিন্ডব্রহমান্ডবাদকে মূলরূপে গ্রহন পূর্বক তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায় কালচক্রপানের ন্যায় নবীন যান প্রবর্তন করেছিলেন। তবে সম্প্রদায় রূপে এর পৃথক সত্তা স্বীকার করার বিষয়টি বিবাদাস্পদ হয়ে রয়েছে।
সহজযানের নামকরণ এবং তার স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকারের প্রশ্নটি অত্যন্ত বিবাদ পূর্ণ বিষয়। মন্ত্রযান অথবা মন্ত্রমার্গের অবান্তর বিষয়গুলিকে পর্যালোচনা করে পন্ডিত গোপীনাথ কবিরাজ বজ্রযান, কালচক্রযান তথা সহজযানকে ক্রমশঃ মন্ত্রমার্গ হতে আবিভূত বলেছেন। তার মতে এদের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও বহুক্ষেত্রেই সাদৃশ্য রয়েছে। বস্তুতঃ সকলই মন্ত্রমার্গের প্রকার ভেদ। তবে বাস্তবিক অর্থেই কোন মতাদর্শগত পার্থক্য নেই। মনে হয়, একই সাধনধারা বিভক্ত হয়ে ভাবকে গৌণ এবং প্রধান ভাব হতে বিভিন্ন রূপে ব্যাপ্ত হয়েছে। ...মন্ত্রনয়’এর তিন ধারা পরস্পর একত্রীভূত হয়েছে। বস্তুতঃ এই হল বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্ম বা বৌদ্ধতন্ত্র। ড. বলদেব উপাধ্যায় সহজযান’কে বজ্রযানের আরও একটি নাম বলেছেন। সহজযানকে সেই তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের পরবর্তী শাখা রূপে দৃষ্ট হয়; কিন্তু এইরূপ কালচক্রযান, সহজযান ইত্যাদি রূপে বিভাজনকে তিনি দোষপূর্ণ বলেছেন কারণ উভয় যানই বজ্রযানের অন্তর্গত বলেই মনে হয়।
ড. দাশগুপ্ত ‘সহজযান’ শব্দটিকে ২টি কারণে বিশিষ্ট রূপে স্বীকার করেছেন। আত্মা(?)র পরম সহজা প্রকৃতির সাক্ষাৎকারকে লক্ষ্যরূপে স্বীকার করার কারণ তথা ধর্ম বা পদার্থের সহজ প্রকৃতির জ্ঞানকে লক্ষ্য রূপে স্বীকার করার কারণে সহজযান নামটি স্বার্থকতা লাভ করেছে। অপর অর্থে, মনুষ্যের সহজ প্রকৃতির প্রতি অনাবশ্যক চাপ প্রদানের স্থানে এই মার্গ বা যান ব্যক্তিকে পরম সত্যের সর্বাধিক স্বাভাবিক মার্গ দ্বারা সাক্ষাৎকার করার অবসর প্রদান করে। এটি সেই মার্গের প্রতি অণুসরণ করার ছাড় প্রদান করে যেখানে মানব প্রকৃতি তাকে নিয়ে যায়। ড. দাশগুপ্ত সম্পুটিকা হতে উদাহরণ প্রদান পূর্বক এইটি স্পষ্ট করেছেন যে মন্মথ তো প্রত্যুৎপন্ন হয় এবং তা স্বভাবেরই অঙ্গ। মানব স্বভাব তো দুরতিক্রম হয়।
“অসৌহি ভগবান্ যোগঃ স্থির-শাশ্বত পরমঃ। মন্মথতঃ প্রত্যুৎপন্নঃ (সদা চৈব) স্বভাবো দুরতিক্রমঃ।।” -অদ্ধয়সিদ্ধি, তৃতীয় পটল, পৃঃ ৫৭।
সহজ অথবা বোধিচিত্তের সক্ষাৎকার অথবা তার উপলব্দি যদি একবার সম্পূর্ণ হয়, তাহলে সকল বিষয়ের’ই উপলব্দি হয়ে যায়। তাহলে মন্ত্র–তন্ত্র, হোম, মন্ডল তথা মন্ডল ক্রিয়ার কোনরূপ প্রয়োজনই থাকে না। মহাসুখ রূপে সহজ অথবা বোধিচিত্ত, মন্ত্র, তপ ইত্যাদি একত্রীভূত হয়ে যায়। এরদ্বারা স্পষ্টতর হয় যে ড. দাসগুপ্ত সহজমানকে বজ্রযানের অন্তর্গত একই অম্নায় রূপে মান্যতা প্রদান করেছেন সেখানে চরমাবস্থা প্রাপ্ত করলে বাহ্যাচারের কোন প্রয়োজনীয়তা থাকে না।
ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য তান্ত্রিক বীদ্ধ সাহিত্যের বিভাজন পরবর্তী বৌদ্ধ মত বজ্রযান, সহজযান এবং কালচক্রযানের নামানুসারেই স্বীকার করেছেন। যদিও তিনি তন্ত্রযান, মন্ত্রযান এবং ভদ্রযান ইত্যাদি কিছু লঘুযানের চর্চাও করেছেন, যা উদয় বজ্রযান হতে উদভূত হয়েছে। সহজিয়া সিদ্বান্ত ও বজ্রযানের একটি শাখা। কিন্তু সহজযানের কোন পৃথক সাহিত্য নেই এবং পদও দোহাকে সহজিয়া কবি তাদের প্রামান্য গ্রন্থরূপে স্বীকার করেছেন। সহজিয়ার প্রবর্তক নিজেদের সম্পূর্ণ আগ্রহ জীবন এবং ধর্মের আড়ম্বর ও ঔপচারিকতার বিরোধ ব্যক্ত করেছেন। সত্যের উপলব্দি না তো কখনও তথ, কৃচ্ছসাধন ইত্যাদি দ্বারা হতে পারে আর না তো পাঠ, দর্শন, ব্রত, স্নান, মূর্তি-পূজা অথবা বজ্রযানে প্রতিপাদিত কর্মকান্ড দ্বারা হতে পারে। এর স্বয়ংবেদন সর্বথা পরম্পরাবিরুদ্ধ পদ্ধতি দ্বারা তত্ত্বদীক্ষা তথা যোগাভ্যাস দ্বারাই হতে পারে। এই বৈশিষ্ট্য দ্বারা সহজিয়া মতের পৃথক সত্তা সামান্যতয়া বজ্রযানী হতে স্পষ্ট ভাসিত হয়। এই সহজকায় হল সেই চতুর্থকায় যা ধর্মকায়’এর উর্দ্ধে স্থিত। এই যান বজ্রযানে প্রচলিত মহাযানী বোধিচিত্তের সংস্কার করেছে এবং এইরূপ মহাসুখ ও নির্বাণে অভিন্নতা স্থাপন করেছে। মহাযানী বোধি চিত্তোৎপাদের ধারণাকে সহজযানী যৌনযৌগিক সাধনা দ্বারা উৎপন্ন সঘন আনন্দের ব্যবস্থাতে রূপান্তর হয়ে গেছে। বজ্রযানে বোধিচিত্তকে কখনও কখনও শক্রের পর্যায় রূপে ব্যক্ত করা হয়েছে কিন্তু সহজযানে সর্বদা এর ব্যবহার শুক্র রূপেই হয়েছে। এই তথ্যের পপতি ভিত্তি করে ড. শশীভূষণ দাশগুপ্ত সহজযানের পৃথকতা প্রতিপাদিত করেছেন। “ন মন্ত্রজানো ন তপো ন হোমো ন মন্ডলেয়ম্ ন চ মন্ডলং চ। স মন্ত্রজানঃ স তমঃ স হোমঃ স মন্ডলেয়ম্ তন্মন্ডলং চ।।” -হেবজ্রতন্ত্র, পৃঃ ৫৩।
বজ্রযানের কর্মকান্ড প্রধাণতা তথা বাহ্যাভমবর’এর প্রচুরতা সময়সাধ্য এবং বিশিষ্টজনসাধ্য ছিল। তার প্রতিক্রিয়াতে এই সহজ পদ্ধতি বিশেষ একটি পৃথক যান রূপে বিকশিত হয়েছিল। মহাপন্ডিত রাহুলসাংকৃত্যায়ন যদিও বজ্রযান এবং সহজযানের স্পষ্ট ভেদ তত্ত্বের বিষয়ে কিছুই বলেননি তবুও প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বলা যায় যে সরহ (সরহপাদ) দ্বারা প্রবর্তিত (সহজ-) যান বজ্রযানীদের নিজেদের প্রতি আকর্ষিত করতে সচেষ্ট হয়েছিল। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে লুইপাদ ৯তম শতাব্দী সহজপাদ মত প্রচার করেছিলেন এবং ৯-১৩ শতাব্দী পর্যন্ত এই অত্যাধিক বিকশিত হয়েছিল। ড. উইন্টরনিৎস’এর মতানুসারে ‘লক্ষমীঙ্করা’ অদ্বয়সিদ্ধি নামক গ্রন্থ হতে নবীন অদ্বৈতবাদী মত সহজযানের প্রবর্তন করেছিলেন, যা আজও বঙ্গদেশে বাউল সম্প্রদায়’এর মধ্যে জীবিত রয়েছে। লক্মীঙকা সিদ্ধাচার্য ইন্দ্রভূতির ভগিনী ছিলেন। তিনি সন্ন্যাস, ধর্মীয় শিষ্টাচার, মূর্ত্তিপূজা ইত্যাদির পরিবর্তে সকল দেবতার আশ্রয় একমাত্র শরীরের প্রতি বল (ধ্যান) প্রদান করতে বলেছিলেন। লক্ষমীঙ্করা নারীর প্রতি ঘূণাভাব কে নিন্দা করেছেন, কারণ তাঁর মতে সকল নারীর’ই হল প্রজ্ঞার অবতার। ড. ভট্টাচার্য লক্ষমীঙকরা’র সময় ৮ম শতাব্দী পূর্বাদ্ধ বলেছেন। “ন কষ্ট কল্পনাং কুর্যাত্ নোপবাসী ন চ ক্রিয়াম্। স্নানং শৌচং ন চৈবাত্র গ্রামধর্মবিবর্জনম্।। ন চাপি গাম্যগম্য-বিকল্প তু ভক্ষ্যাভক্ষ্যং তথৈব চ। ...সর্ববর্ণসমুদ্ভুতা জুগুপ্সা নৈব ঘোষিতঃ। সৈব ভগবতী প্রজ্ঞা সমবৃত্যা রূপমাশ্রিতা।” -অদ্বয়সিদ্বি, পৃঃ ১৭, শ্লোক ১৪।
ড. ভট্টাচার্য লক্ষমীঙকরা কে অদ্বয়সিদ্বি’র রচয়িতা এবং সহজিয়া মতের প্রবর্তিকা বলে মনে করেছেন কিন্তু অদ্বায়সিদ্ধি’র যে রূপ এইসময় প্রাপ্ত হয় তাতে কোথাও সহজ শব্দের প্রয়োগ দৃষ্ট হয় না কিন্তু উক্ত গ্রন্থ হতে এই তথ্য পাওয়া যায় যে প্রাণযোগ অথবা বায়ুযোগ’এর প্রয়োগের দ্বারা ক্রমশঃ অন্তস্সাধনা’তে অগ্রসর হয়ে সাধক স্বাধিষ্ঠানক্রম’ এর সাধন পূর্বক অন্ততঃ মুগনাদক্রম পর্যন্ত উন্নীত হন।
বঙ্গদেশে সহজিয়া সম্প্রদায়’এর উদয় এবং বিকাশকে অনুসন্ধান পূর্বক বিদ্বানগন সহজজানকে ব্যাখ্যা করেছেন। এক্ষেত্রে বজ্রযানের অন্তিম বিকাশ হল সহজযান এবং যেখানে রাগ অথবা প্রিতিকে বিশষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বজ্রযান এবং সহজযানের ভেদক তত্ত্বকে তথা সহজযানের বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান পূর্বক এই বিষয়টি স্পষ্টতর করেছেন যে এই যান পদ্ম এবং বজ্রের পরস্পর সংযোগ হতে উদিত হওয়া সহজানন্দের প্রতি বিশ্বাস করে। এই যান ঈশ্বরাদি’র অস্তিত্বকে স্বীকার করেনি কিন্তু তান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য (তন্ত্রযান) তথা ডাকার্ণবতন্ত্রে বর্ণিত নাড়ী, চক্র, যোগিনী ইত্যাদিকে স্বীকার অর্থাৎ গ্রহন করেছে। আধ্যাত্মিক যাত্রার সফলতার প্রশ্নে গুরতত্ত্বকেও স্বীকার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রমাণ রূপে ‘হেবজ্রতন্ত্র’ অনুসারে (পৃঃ ১০) বলা যায় – “তস্মাত্ সহজং জগৎসর্ব সহজং স্বরূপমুচ্যতে। স্বরূপমেব নির্বানং বিশুদ্ধকার চেতসাঃ (?)।। ‘তথা স্বভাবং সহজং ইত্যুক্তং সর্বকারিক সংবরম্’। এবং দেহস্থোহপি ন দেহজঃ।”
মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন’এর মতানুসারে বৌদ্ধ তান্ত্রিক আচার্য পরম্পরা এই রূপ হতে পারে। যেমন –
১. জালন্ধরিপাদ বা জালন্ধরপাদ – মৎসয়েন্দ্র (মৎসেন্দ্র), গোরক্ষ (?) আচার্য কমকল, গোপীচন্দ্র, ময়নামতী, ভর্তৃহরি, জ্ঞানগুপ্ত, বিভূতিচন্দ্র, ভগবতী লক্ষমীঙকরা, ইন্দ্রভূতি, কচ্পাদ, ধর্মপাল।
২. কৃষ্ঞপাদ – গোবিন্দপাদ, জালন্ধরপাদ, গোপীচন্দ্র, দেবপাল, তান্তিপা, ইন্দ্রভূতি, গোরক্ষনাথ (?)।
ড. শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে জালন্ধরপাদ পালশাসক ধর্মপালের সমকালীন ছিলেন। তিনি স্বয়ং কৃষ্ঞপাদকে উপদেশ প্রদান কালে নিজের দেশের শাসকের নাম ধর্মপাল বলেছিলেন। ধর্মপালের রাজ্যারোহন ৭৭০ খ্রীঃ হয়েছিল এবং তিনি প্রায় ৮১০ খ্রীঃ পর্যন্ত শাসনকার্য করেছিলেন। বৌদ্ধধর্ম, সাহিত্য এবং তর্কশাস্ত্রতে ধর্মকীর্তি নামক ২ বৌদ্ধচার্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এক ধর্মকীর্তি ন্যায়বিন্দু’র রচয়িতা (প্রায় ৬৩৫ খ্রীঃ) এবং সৌত্রান্তিক দার্শনিক ছিলেন। ড. সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ‘এ হিস্ট্রি অফ্ ইন্ডিয়ান ফিলোসফি’ গ্রন্থে এই দার্শনিক সময়কাল ৬৫০ খ্রীঃ বলেছেন। আচার্য নরেন্দ্র দেব’এর মতে ধর্মকীর্তি’র সময় ৬৫০-৭০০ খ্রীঃ পর্যন্ত বলেছেন।
অপর একজন তান্ত্রিক টীকাকার ধর্মকীর্তি’র ও উল্লেখ পাওয়া যায় এবং এর সময়কাল ৯তম শতাব্দী ছিল। রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রথম ধর্মকীর্তি সময়কাল ৬তম শতাব্দী বলেছেন কিন্তু দ্বিতীয় ধর্মকীর্তি সম্পর্কে কোনোরূপ আলোচনা তিনি করেননি। তান্ত্রিক ধর্মকীর্তি হেবজ্রতন্ত্র টীকা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ’এর সময়কালীন ছিলেন। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান’এর সময়কাল প্রায় ১০ম শতাব্দী বলা হয়। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে সরহপাদ ধর্মকীর্তি (৬০০-৬৫০ খ্রীঃ)র সময়কালীন ছিলেন। সিদ্ধাচার্য কমবলাম্বরপাদ, কমবল বা কমরিপা ঘন্টাপাদের শিষ্য ছিলেন। ঘন্টাপা দেবপালের (৮০৯-৮৪৯ খ্রীঃ) সময়কালীন ছিলেন। এই অর্থে কমবলামবপাদ দেবপালের কণিষ্ঠ সমকালীন এবং জালন্ধরের চতুর্থ সমকালীন ছিলেন ইন্দ্রভূতি। ভগবতী লক্ষমীঙ্করা ইন্দ্রভূতি ভগিণী ছিলেন। লামা তারানাথ (তারানাথ) ইন্দ্রভূতি নামক ২-৩ জন সিদ্ধাচার্যের উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে এক ইন্দ্রভূতি উদ্যান (উড্ডিয়ান) এর রাজা ছিলেন এবং মহাপদ্মবজ্রের গুরু ছিলেন। অপর ইন্দ্রভূতি সরোহ এবঢ কমবলের শিষ্য ছিলেন। যাই হোক, আমরা উপরিউক্ত তথ্যের প্রতি ভিত্তি করে কালনির্নয়ের বিষয়টিকে এইভাবে প্রস্তুত করলাম –
ধর্মপাল : ৭০০-৮১০ খ্রীঃ (৮ম শতকের শেষ এবং ৯ শতকের সূচনা)
ধর্মকীর্তি (দার্শনিক) : ৭ম শতাব্দী (খ্রীঃ)
ধর্মকীর্তি (তান্ত্রিক সিদ্ধাচার্য) : ৯ শতাব্দী
কমবলাম্বরপাদ : ৯ শতাব্দী
দেবপাল : ৯ শতাব্দী
ইন্দ্রভূতি এবং
লক্ষমীঙ্করা : ৯ শতাব্দী
ড. হাজারীপ্রসাদ মহাশয় সিদ্ধাচার্য’দের গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে এইভাবে একত্রিত করেছেন। যেমন-
১. জালন্ধরপাদ – কৃষ্ঞপাদ, বুদ্ধজ্ঞানপাদ, ভর্তৃহরি, কনিষ্ট বিরুপ, গোপীচন্দ্র, তান্তিয়া, মৎস্যেন্দ্র।
২. ঘন্টাপাদ – কূর্মপাদ, জালন্ধরপাদ
৩. আদিনাথ – জালন্ধরপাদ, মৎস্যেন্দ্রনাথ
৪. আচার্য কমবল – জালন্ধরপাদ
৫. ইন্দ্রভূতি – কৃষ্ঞপাদ
এই সূচনার প্রতি ভিত্তি করে জালন্ধরপাদের ৩ গুরু তথা আচার্যের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন-
১. আচার্য কমবল - > জালন্ধরপাদ
২. আদিনাথ -> জালন্ধরপাদ
৩. ঘন্টাপাদ -> কুর্মপাদ -> জালন্ধরপাদ
এর মধ্যে প্রথম এবং তৃতীয়টি তিব্বতী বৌদ্ধ পরম্পরা হতে প্রাপ্ত। অর্থাৎ জালন্ধরপাদের ২টি গুরু ছিলেন – আচার্য কমবল এবং কূর্মপাদ। এই অর্থে কৃষ্ঞপাদের ও ২ গুরু জালন্ধরপাদ ও ইন্দ্রভূতি। ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য ২ টি তিব্বতী স্রোত হতে ২টি পরম্পরার উল্লেখ করেছেন।
১. পদ্ম বজ্র -> অনঙ্গবজ্র -> ইন্দ্রভূতি -> ভগবতী পক্ষমীঙ্করা -> লীলাবজ্র -> দারিকাপা -> সহজযোগিনী চিন্তা -> ভোমবী হেরুক।
(থৈগ-সাম-জান-জৈন নামক তিব্বতী বৌদ্ধ গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত। রচনা কাল ১৯৪৭ খ্রীঃ)।
২. সরহ- নাগার্জুন – শবরীপা –লুইপা – বজ্রঘন্টাপা – কচ্ছপা – জালন্ধরীপা – কৃষ্ঞাপাদ – গুহ্যপা – বিজয়াথা – তৈলোচপা – নারেপা। (কাজী দবাসম্ দুপ দ্বারা লিখিত ‘চক্রসংবরতন্ত্র’র ভূমিকাতে উল্লিখিত পরম্পরা)।
এই তথ্য অনুসারে (তিব্বতী পরম্পরা) জালন্ধরীপা (জালন্ধরপাদ)’র তিনজন ভিন্ন-ভিন্ন গুরুর নাম পাওয়া যায় – লুইপা, বজ্রঘন্টাপা এবং কচ্ছপা। আবার কিছু অন্য তিব্বতী ধারা অনুসারে জালন্ধরপাদ’এর তিন মুখ্য আচার্য ছিলেন – কথবলামবরপাদ, কুর্মপাদ এবং কচ্ছপা।
মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন ‘স-স্ব্য-ব্কং-বুম্’ (১০৯২-১২৭৯ খ্রীঃ) নামক তিব্বতী গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে নিম্নলিখিত ভাবে প্রস্তুত করেছেন –
১. সরহ
নাগার্জুন শবরপা
কর্ণরীপা পঙ্কজপা নাগবোধিপা
উধালপা
জোগীপা লুইপা সর্বভক্ষপা
দারিকাপা ভোম্বীপা ভেঙ্গিপা
২. জালন্ধরীপা
কন্হপা অন্তিপা মীনাপা মৎস্যেন্ত্র
কনখলাপা মহীপা ভদ্রপা কন্থালীপা মেখলাপা ধর্মপা
বীনাপা
গৌরক্ষপা চৌরঙ্গীপা
৩. খঙ্গমা
চর্পটীপা----
মীন পা(?)
৪. তিলোপা – নারোপা
৫. মণিভদ্রা
কুকরীপা –
মীনপা
৬. কর্মারিপা
অবধূতিপা –
চেলুকপা
৭. থনগপা – শান্তি – কুদ্দর্লিপা
৮. লীলাপা – গুন্ডরীপা
৯. ভুসুকুপা – সর্বভক্ষপা
১০. অনঙ্গবজ্র
ইন্দ্রভূতি
কমবলপা
এইভাবে রাহুল সাংকৃত্যায়ন দ্বারা ১০ স্বন্তন্ত্র সিদ্ধাচার্যের বংশপরম্পরার তথ্য পাওয়া যায়। তবে এদের মূল অর্থাৎ আদি গুরু সম্পর্কিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ফলে রাহুল সাংকৃত্যায়নের তথ্য হতে জালন্ধরীপা’র গুরু পরম্পরার কোন সঠিক তথ্য উদ্ভূত হয় না। যদি পূর্বোল্লিখিত বংশ পরম্পরা এবং এই বংশ পরম্পতার সংযোজন করা যায় যেতে পারে –
সরহ – নাগার্জুন – শবরীপা – বজ্রঘন্টাপা – কচ্ছপা ->
জালন্ধরীপা
কন্থপা তান্তিপা মীনপা মৎস্যেন্দ্র
গুহ্যপা কনখলাপা মহীপা ভদ্রপা কন্থলীপ মেখলাপা ধর্মপা
গোরক্ষাপা চৌরঙ্গীপা
বিজয়পা বীনাপা
তৈলোপা
নারোপা
বৌদ্ধ মূর্ত্তি শাস্ত্রের ভিত্তি মূলতঃ তান্ত্রিক বৌদ্ধ গ্রন্থের উপর প্রতিষ্ঠিত। তান্ত্রিক বৌদ্ধ গ্রন্থ সমূহের মধ্ষে সর্বাপেক্ষা উল্লেখ্যনীয় হল সাধনমালা, গুহ্যসমাজ তন্ত্র, অদ্বয় বজ্রসংগ্রহ, তত্ত্বসংগ্রহ এবং নিষ্পন্নযোগাবলী। সাধনমালায় ৩১২ টি সাধনার অগনিত দেবদেবীর বর্ণনা, মূর্ত্তির ধ্যান, পূজা পদ্ধতি, মন্ত্র এবং মন্ত্রপ্রয়োগাদি’র বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। এই গ্রন্থটি ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য দ্বারা গায়কোয়াড়্ ওরিয়েন্টাল সিরিজ (বরোদা, গুজরাত) হতে ২ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমানে এই মূল্যবান পুস্তক দ্বয় নিঃশষেইত এবং দুষ্প্রাপ্যও বটে। নিষ্পন্নযোগাবলী বৌদ্ধ তন্ত্রের আরও একটি মূল্যবান গ্রন্থ। এ পুস্তকটি প্রনয়ণ করেছিলেন বাঙালি বৌদ্ধপন্ডিত অভয়াকর গুপ্ত (১১৩০ খ্রীঃ)। এই গ্রন্থে প্রায় ৬শত দেবদেবীর বিবরণ এবং সাধন পদ্ধতি বর্নিত হয়েছে। এই গ্রন্থটিও বর্তমান দুষ্প্রাপ্য।
তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মূল দেবতা আদিবুদ্ধ। আদি বুদ্ধ মূল অর্থে শূন্যতার’ই রূপকল্পনা। আদি বুদ্ধ হতে পঞ্চধ্যানী বুদ্ধের উদ্ভব। পঞ্চধ্যানী বুদ্ধ ৫টি সকন্ধের অধিষ্ঠাতা। আদি বুদ্ধ যখন দেবতাকারে কল্পিত হন, তখন তাঁর নাম হয় বজ্রধর। বজ্রধরের মূর্ত্তি আবার দুই প্রকারে কল্পিত হয়ে থাকে – একটি একক মূর্ত্তি এবং অপরটি যুগবদ্ধ মূর্ত্তি। ধ্যানী বুদ্ধ ৫ট – বৈরোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, অপোঘসিদ্ধিও অক্ষোভ্য। কখনও কখনও আবার ষষ্ঠ ধ্যানী বুদ্ধের মূর্ত্তির বিবরণও প্রদত্ত হয়। এই ধ্যানী বুদ্ধের নাম বজ্রসত্ত্ব। বজ্রসত্ত্ব বিগ্রহ আবার ২ প্রকারের হয় – একক এবং যুগনাদ্দ।
প্রত্যেক ধ্যানী বুদ্ধের এক-একটি করে বিভিন্ন শক্তি কল্পিত হয়েছে। এদের পূর্ণ বিবরণ সর্বপ্রথম গুহ্যসমাজতন্ত্রে দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে তাদের নাম বিভিন্ন প্রকারের। যেমন- “স্ববিম্বানি স্ত্রীবিম্বান্যভিনির্মায় গভবতো বৈরোচনস্য কায়দ ভিনিষ্ক্রান্তা অভূবন্। তত্র কেচিত্ বুদ্ধলোচনাকারেন কেচিত্ মামক্যাকারেন কেচিৎমান্ডরবাসন্যকারেন, কেচিত্ সময়তারাকারেন সংস্থিতা অভূবন্।” -গুহ্যসমাজতন্ত্রম্, পৃঃ ২।
এখানে কলেবর বৃদ্ধির কারণে বৌদ্ধতন্ত্রের বিষয় তথা তান্ত্রিক দেবদেবীর বিষয়টি ও অতিসংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা হল। সর্বোপরি গুহ্যসমাজতন্ত্রে বর্ণিত ‘সর্বতথাগতসমাধিমন্ডলাধিষ্ঠান’ নামক প্রথম পটলের মন্দলটি ব্যক্ত করা হল –
বিঘ্নাত্মক
অমোঘসিদ্ধি
প্রজ্ঞান্তক
“...তে সর্বতথাগতাস্তে চ বোধিসত্ত্বা মহাসত্ত্বা স্বকায়বাক্চিত্তবজ্রেষু বিহরন্তং কায়বাক্চিত্তবজ্রস্য কায়বাক্চিত্তং স্বকায়বাক্চিত্তেনালমব্য তূষ্ঞীমভূবন্ ।।
সহায়ক গ্রন্থসূচী :-
১. গুহ্যসমাজতন্ত্র, সম্পাদনা – ড. এস. বাক্চী, মিথিলা বিদ্যাপীঠ, দ্বারভাঙ্গা, বিহার, ১৯৬৫।
২. সাধনমালা, ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য, খন্ড-০১, বরোদা, গুজরাত (গায়কোয়াড ওরিয়েন্টাল সিরিজ), ১৯২৫।
৩. অদ্বয়বজ্রসংগ্রহ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, গায়কোয়াড ওরিয়েন্টাল সিরিজ, বরোদা, গুজরাত, ১৯২৭।
৪. অদ্বয়সিদ্ধি, স্বামী দ্বারিকাদাস শাস্ত্রী, বৌদ্ধ ভারতী, বেনারস, ১৯৮১।
৫. সদ্ধর্মপুন্ডরীক্, ড. রামমোহন দাস, বিহার রাষ্ট্রভাষা পরিষদ, পাটনা, ২০০০।
৬. সেকোদ্দেশ টীকা, এম. ই. কেরেল্লী, গায়কোয়াড ওরিয়েন্টাল সিরিজ, বরোদা, গজরাত, ১৯৪২।
৭. বৌদ্ধ দর্শন মীমাংসা, ড. বলদেব উপাধ্যায়, হিন্দি সাহিত্য সম্মেলন, প্রয়াগ, ১৯৯০।
৮. দীক্ষাপ্রকরণম্, ড. গোপীনাথ কবিরাজ, বৌদ্ধ ভারতী, বেনারস, ১৯৯৮। (কালচক্রতন্ত্রের খন্ডিত অংশ)*
৯. হেবজ্রতন্ত্র, কাশীনাথ নৌপান্যে, ইন্ডিয়ান মাইন্ড, নিউ দিল্লী, ২০২০।
১০. তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধনা ও সাহিত্য, ড. নাগেন্দ্রনাথ উপাধ্যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী, বেনারস, ১৯৮৭।
১১. ভারতীয় সংস্কৃতি ও সাধনা, ড. গোপীনাথ কবিরাজ, বিহার রাষ্ট্রভাষা পরিষদ, পাটনা, ১৯৯০।
১২. মহাযানসূত্রালঙ্কার, স্বামী দ্বারিকাদাস শাস্ত্রী, বৌদ্ধ ভারতী, বেনারস, ১৯৯০।
No comments:
Post a Comment