সুমনপাল ভিক্ষু
সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ ভগবান বুদ্ধের আবির্ভাব তিথি অর্থাৎ বুদ্ধ পূর্ণিমা উদযাপন করে (এই পবিত্র তিথি বুদ্ধ জয়ন্তী নামেও পরিচিত, যা বৈশাখী অর্থাৎ বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়)। এই তিথিতে শাক্য বংশের রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে লোক কল্যাণের অভিপ্রায় গ্রহণ করে সম্যক সম্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক তত্বই হল 'বৌদ্ধধর্ম'।
'জয়ন্তী' শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ জন্ম তিথি বা জন্মদিবস। যারা 'বোধি' বা লোক জ্ঞান অর্জন করেন, তাঁরা বুদ্ধ নামে পরিচিত হন। সেই অর্থে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম মার বিজয় সম্পূর্ণ করে বোধি জ্ঞান লাভ করেছিলেন।
বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিকে সমগ্র বৌদ্ধ বিশ্ব একটি অত্যন্ত পবিত্রতৃ দিন রূপে বিবেচনা করন কারণ এই তিথি মহান বুদ্ধের জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে চিহ্নিত করে, যেমন তাঁর জন্ম, বোধিলাভ এবং মহাপরিনির্বাণ। বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে লুম্বিনী উদ্যানে (বর্তমানে নেপালে অবস্হিত) মায়াদেবীর কুক্ষি হতে আজ হতে ২৭৭৫ বৎসর পূর্বে বোধিসত্ত্ব রাজকুমার সিদ্ধার্থ রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
যৌবন কালে তিনি জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুর ভয়াবহ বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করে এই অনন্ত দুঃখ হতে মুক্তি লাভের সন্ধানে সংসার ধর্মকে ত্যাগ পূর্বক একসময়ে বর্তমান বুদ্ধগয়ার নৈরঞ্জনা নদীর অনতিদূরে বোধিবৃক্ষ মূলে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করেছিলেন। সেই ত্রুটি হাসিক ঘটনাও বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সংঘঠিত হয়েছিল। অবশেষে ৮০ বৎসর বয়সে তিনি উপাসক চুন্দের নিকট হতে অন্তিম অন্ন গ্রহণ করে কুশীনারা'র নিকট বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে ভিক্ষু সংঘকে সম্বোধিত পূর্বক শালবৃক্ষ তলে 'মহাপরিণর্বাণ' লাভ করেছিলেন।
নিঃসন্দেহে মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রেম ও শান্তির প্রথম দূত রূপে মহামানব বুদ্ধ এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন। তার মূল শিক্ষা হলো কামনা বাসনাই হল মনুষ্য জীবনের সকল দুঃখের মূল কারণ এবং এই সকল অমূলক বিষয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করলেই আমরা শান্তি লাভ করতে পারি। বর্তমান বিশ্ববায়নের যুগে মনুষ্যের জীবন জীবিকা ক্রমশই তার বোধ বুদ্ধির বিরুদ্ধে খাতে বইতে শুরু করেছে। ফলে পৃথিবী হয়ে উঠেছে 'যুদ্ধভূমি'। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্য করা প্রয়োজন বুদ্ধ যে সময়কালে পৃথিবীর বুকে যে দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেই সময় সমাজ জীবন ছিল আরো বেশি নিষ্ঠুর এবং কার্যে। সুতরাং বাস্তবিক অর্থে বুদ্ধ তাঁর সময়কালে অনেক বেশি আধুনিক তথা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী ছিলেন।
অহিংসা ,জীবনের প্রতি সম্মান এবং নারীদের প্রতি আরো সমান মর্যাদার প্রতি জোর দেওয়ার কারণে বৌদ্ধ ধর্ম দর্শন অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর ফলে এশিয়ার অনেক দেশ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে নিজেদের দেশকে বিকশিত করে তুলেছে। বৌদ্ধ ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মের মধ্যে মূলগত পার্থক্য হল এই যে বৌদ্ধ ধর্ম অদৃষ্টবাদ বা কোনরূপ অতিপ্রাকৃত শক্তি অর্থাৎ তথাকথিত ঈশ্বরতত্ত্বের প্রতি বিশ্বাসী নয়।
বিদর্শন অর্থাৎ বুদ্ধ দ্বারা প্রদর্শিত ধ্যান চর্চা হল দৈনন্দিন জীবনের চাপ এবং উদ্বেগ হতে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায়। এই কারণে, বিদর্শন চর্চা আমেরিকা তথা প্রাশ্চাত্য দেশগুলিতে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তবে এর জন্য একজনকে কঠোর সময়সূচী অনুসরণ করতে হবে না ,তার দৈনন্দিন সময়ানুসারে তা( বিদর্শন) পালন করা যেতে পারে।
বুদ্ধ আমাদের এই শিক্ষা প্রদান করেছেন দুর্বল দারিদ্রদের প্রতি শ্রদ্ধা তথা যতনশীল হ'তে এবং অসহায় পশুদের আশ্রয় বা বৃদ্ধাশ্রম-এর ন্যায় যে কোন মানবিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করতে পারি যে অন্যের মঙ্গলের প্রতি আমরা কতটা উদ্বিগ্ন তথা দায়বদ্ধ।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে শ্রীলংকার কলম্বোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বৌদ্ধ প্রথম সম্মেলনে মে মাসের পূর্ণিমা তিথিকে বুদ্ধ পূর্ণিমা দিবস রূপে ঘোষণা করা হয়।
উদাহরণ স্বরূপে শ্রীলঙ্কায় ভেসাক বা বৈশাখ রূপে, নেপালে সোয়ান্যা,মায়ানমারের কাসন, মালয়েশিয়াতে হরি ওয়েসাক, তিব্বতে সাগা দাওয়া, ইন্দোনেশিয়াতে হরি রায়া ওয়াইসাক্ ভিয়েতনামে ভ্যান ও লাওসে ভিক্সাখা বক্সার রূপে এই উৎসব পালিত হয়।
চীনে এই উৎসব ফো-দান এবং ইউ-ফোজি নামেও পরিচিত।জাপানে একে বলা হয় হানা-মাস্তুরী। এই উৎসবটি সেদেশে সৌর ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে ৮ এপ্রিল পালিত হয়।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জনগণ অত্যন্ত আড়ম্বর সহকারে বুদ্ধ পূর্ণিমা দিবস পালন করেন।ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ প্রাতঃকালে বৌদ্ধবিহারে সমবেত হয়ে বৌদ্ধ পতাকা উত্তোলন এবং ত্রিশরন-পঞ্চশীল ইত্যাদি পাঠ করেন। এই দিনে বুদ্ধের প্রতি সম্মান জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা এবং বহু সংখ্যক পশু পাখিকে বন্দী দশা হতে মুক্তি দানের প্রথা প্রচলিত আছে।
তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে ভারতীয় উপমহাদেশে বুদ্ধ এবং তার ধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদী তথা অন্য ধর্মের অত্যাচারে তার ন্যায্য মর্যাদা হতে বঞ্চিত হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ বৌদ্ধ ধর্মকে বিলীন করার অভিপ্রায়ে বুদ্ধকে তথাকথিত অবতারবাদের পঙেক নিমজ্জিত করেছে। এমনটি অনেক বৌদ্ধ বিহার এবং বুদ্ধমূর্তিকে হিন্দু মন্দির বা দেবী দেবতায় পরিণত করে বৌদ্ধ ধর্মকে বিনষ্ট করে দিয়েছে।
বর্তমানে আম্বেদকর প্রভাবিত নব বৌদ্ধ আন্দোলন মহারাষ্ট্র ,উত্তরপ্রদেশ ,ছত্তিশগড় ,ঝাড়খন্ড ইত্যাদি রাজ্যের যথেষ্ট সফলতা অর্জন করলেও প্রাদেশিকতার প্রভাব হতে মুক্ত হতে পারেনি।
শেষে আমরা বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর নামক গ্রামে (পূর্বস্থলী থানার অন্তর্গত) এক অদ্ভুত উচ্ছবের কথা আলোচনা করবো।
উক্ত দিনে দেবতার উদ্দেশ্যে 'পশু বলি' প্রথা প্রচলিত রয়েছে । যদিও উৎসবটি বৌদ্ধ উৎসব নয় তথাপি বৌদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে কেন পালিত হয় তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া সম্ভব হলো না । কারণ বৌদ্ধ উৎসবে প্রাণী হত্যা সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধ শাসন বিরোধী এবং অবিবেচনাহীন ও বটে। অপরদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই দিনে গুরু পূর্ণিমা উৎসব ও পালন করে সম্ভবতঃ মহান বুদ্ধের ধর্ম দর্শনকে বিকৃত করার উদ্দেশ্যে বেদব্যাসের কল্পিত কাহিনী প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু এই ধরনের অসামঞ্জস্যহীন আচার- অনুষ্ঠান সত্ত্বেও 'বুদ্ধ পূর্ণিমা' আজও তার মহান গরিমাকে বহন করে চলেছে।
"..... কহিল যে করজোড়ে,দয়া করে ক্ষমা মোরে-
এ ফুল বেচিতে নাহি মন।
এত বলি ছুটিল সে যথা রয়েছেন বসে
বুদ্ধদেব উজলি কানন।
বসেছেন পদমাসনে প্রসন্ন প্রশান্ত মনে,
নিরঞ্জন আনন্দমুরতি।
দৃষ্টি হতে শান্তি ঝরে, সফুরিছে অধর-পরে
করুনার সুধাহাস্যজ্যোতি।
সুদাস রহিল চাহি-নয়নে নিমেষ নাহি,
মুখে তার বাক্য নাহি সরে।
সহসা ভূতলে পরি পদম টি রাখিল ধরি
প্রভুর চরণ পদ্ম পরে।
বরষি অমৃতরাশি বুদ্ধ শুধালেন হাসি,
'কহো বৎস্য, কি তব প্রার্থনা।
ব্যাকুল সুদাস কহে, 'প্রভু, আর কিছু নহে,
চরণের ধূলি এককণা। '
অবদানশতক ' অবলম্বনে
-মূল্যপ্রাপ্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২৬.০৪.২০২৩
ReplyForward |
No comments:
Post a Comment