Sunday, June 2, 2024

মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন

                                                                     সুমনপাল ভিক্ষু


মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার বিরল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। দেশ ও কালের সীমানা অতিক্রম করে তাঁর মহান পান্ডিত্যের খ্যাতি চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। অন্তরে সঞ্চারিত জ্ঞান তৃষ্ঞার তৃপ্তি সাধনের উদ্দেশ্যে সুদীর্ঘ এবং কঠোর শ্রম সাপেক্ষ ভ্রমণ তিনি মাথা পেতে গ্রহণ করেছিলেন। কখনও তিনি দুর্গম গিরি, কখনও কান্তার মরু অতিক্রম করেছেন কিন্তু কখনও কোনো ক্লান্তি তাঁর যাত্রা পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেনি। তিনি বৌদ্ধ পূর্বসুরীদের সেই পথেই অগ্রসর হয়েছিলেন যে পথে জ্ঞানের সন্ধানে আচার্য কোন্ডিয় গিয়েছিলেন চম্পা (দঃ পূর্ব এশিয়া), আচার্য কুমার জীব গিয়েছিলেন সুদুর চীন এবং আচার্য অতীশ দীপঙ্কর গিয়েছিলেন ভোট (তিব্বত) দেশো বস্তুতঃ তিনি ছিলেন একজন মহান জ্ঞান তাপস এবং বিশ্ব নাগরিক। এই পৃথিবীতে যেন তাঁর জন্ম হয়েছিল দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণের জন্য এবং সেই সঙ্গে জ্ঞান তৃষ্ঞা পূরণের জন্য।

পারিবারিক ঐতিয্য

১৮৯৩ খ্রীঃ ৯ এপ্রিল তিনি অর্থাৎ রাহুল সাংকৃত্যায়ণ এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার প্রদত্ত নাম ছিল কেদারনাথ পান্ডে। তাঁর পিতার নাম ছিল গোবর্ধন পান্ডে এবং মাতা কুলবন্তী দেবী। উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত আজীমগড় জেলার পান্ধা গ্রামের মাতামহের গৃহে তাঁর জন্ম হয়। তবে যে গ্রামে তাঁর মাতা-পিতা বসবাস করতেন সেই গ্রামের নাম ছিল কনাইলা। তিনি তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু করেন ‘রাতী কী সরাই’ নামক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে তিনি নিজামবাদ উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। এই বিদ্যালয়ের প্রধান ভাষা ছিল উর্দু। অতঃ তিনি কাশীতে সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্যসহ দর্শন শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও ৩০টি ভাষা, বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র এবং সাহিত্যে বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছিলেন।

 

জ্ঞানার্জনের প্রতি তাঁর অতৃপ্ত তাঁর অতৃপ্ত বাসনা তাঁকে স্রোতের টানে নিয়ে হাজির করেছিলেন গুনীজনের সান্নিধ্যে। এদের মধ্যে ছিলেন আচার্য ধর্মপাল, স্বামী ভারতীকৃষ্ঞ তীর্থ প্রমুখ গুণীজন। অবাক করার বিষয় এই যে, রাহুল সাংসৃত্যায়নের অভ্যন্তরে নিহিত ছিল বিশেষ গুণের সমাহার।

একদিকে যেমন পর্যটন স্পৃহা তাঁর দেহের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয়েছিল অপরদিকে জ্ঞানান্বেষণ তাঁর সমগ্র অন্তর জুড়ে ক্ষুধা-তৃষ্ঞাসম বিরাজমান ছিল। বস্তুতঃ তাঁকে দুই অর্থে পর্যটক নামে অভিহিত করা যেতে পারে, প্রথমতঃ তিনি ভ্রমণ করতেন মনোজগতে; দ্বিতীয়ত, পার্থিব জগতে।

পর্যটনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি হিমালয় অজ্ঞালের বিভিন্ন অংশে পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি মনে করতেন হিমালয়’এর মহত্ব তাঁর জীবনের সকল প্রেরণার একমাত্র উৎসস্থল। হিমালয়ের মায়া তিনি কখনই পরিত্যাগ করতে পারেননি। হিমালয় তাঁকে বারংবার আহ্বান করেছে। বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে হিমালয়ের ন্যায় তাঁর জীবন ছিল মহান এবং গভীর জ্ঞান ভান্ডারে সমৃদ্ধ।

মাত্র ১১ বৎসর বয়সে কেদারনাথ পান্ডে ওরফে রাহুল সাংকৃত্যায়ন পরিনয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। যদিও এই বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক পুতিগন্ধময় প্রথাকে তিনি কোনভাবেই সমর্থন করেননি। পরবর্তীকালে তাঁকে এই সকল সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করতে বাধ্য করেছিল।

অধ্যাত্ম সাধনা

কেদারনাথ কাশী ভ্রমণের অভিপ্রায়ে প্রথম গৃহত্যাগ করলেও তাঁর এই যাত্রা কোনভাবেই ফলাদায়ী হয়নি ফলে একপর্যায় কপর্দক শূণ্য হয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়ে তিনি পুনঃ স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। এই ঘটনার কিছু দিন পরে তিনি পুণঃ গৃহত্যাগ করে কোলকাতার উদ্দেশ্যে মাত্রা করেন। এ মাত্রায় তিনি কোলকাতায় কিছু দিন অবস্থান করার পরে হরিদ্বার, হৃষিকেশ, গঙ্গোত্রী, যমুণেত্রী, কেদারনাথ, গৌরীকুন্ড প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করে অবশেষে কাশী উপস্থিত হন।

এখানে তিনি সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে সংস্কৃত ভাষা চর্চার প্রতি গভীর ভাবে মনোনিবেশ করেন। ১৯১৩ খ্রীঃ তিনি পুরী দর্শন করে রামেশ্বরম, তিরুপতি, পুনা, মুম্বাই, নাসিক সহ দক্ষিন ভারত, পূর্ব ভারত ও পশ্চিম ভারতের নগর সমূহ পরিভ্রমণ করেন। এই সময় কেদারনাথের জীবনে এক অদ্ভূত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এখন তাঁর অভ্যন্তরে ধ্বনিত হতে থাকে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ। এই সময়ে তিনি ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার প্রাচীন বিধি বিধানের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামী-কুসংস্কার’এর বিরুদ্ধে, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।

একসময় তিনি বৈষ্ঞব মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উক্ত ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করলে তাঁর পূর্ব নাম কেদারনাথ পান্ডের পরিবর্তে রামোদর দাস নাম গ্রহণ করেন। অতঃ তিনি একসময় আর্য সমাজ প্রচারক রূপে খ্যাত হন। প্রচারক হিসাবে তিনি লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন ও পরিভ্রমণ করেন। এই সময়ে বৌদ্ধ দর্শন এবং জীবনে বৌদ্ধদর্শনের বাস্তব প্রয়োগ তাঁকে ভয়ানক ভাবে আকৃষ্ট করলে তিনি তখন হৃদয়ের গভীর নিষ্ঠা নিয়ে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃ তাঁর নতুন নামকরণ হয় ‘রাহুল সাংকৃত্যায়ন’। পরবর্তীকালে তিনি এই নামে পরিচিত হন ও খ্যাতি লাভ করেন।

এত্বদ সত্বেও তিনি তাঁর মনের উদ্বেগ কাটিয়ে উঠতে পারেন নি কারণ ভারতীয় সমাজের সামাজিক পরিকাঠামো তাঁকে প্রবলভাবে পীড়া দিয়েছিল। এক সময় তিনি একজন একনিষ্ট মার্কসবাদী ভক্তে পরিণত হন। তিনি এ কথা স্বীকার করেছিলেন যে নতুন পরিস্থিতিতে নতুন ভাবনাকে তিনি অন্তর দ্বারা গ্রহণ করেছিলেন। তবে একথা বলা কঠিন যে এই সময় তাঁর সমতা গ্রহন বাস্তবিক অর্থে সঠিক ছিল কিনা তা মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তবে যে কথাটি দ্বিধাহীন কন্ঠে উচ্চারণ করা যেতে পারে তিনি ছিলেন যথার্থই একজন সত্যসন্ধানী পরিব্রাজক।

স্বাধীনতা সংগ্রামী

১৯১৯ খ্রীঃ তৎকালীন ইংরেজ সরকার লাহোরে সামরিক আইন জারী করলে তিনি ভারতের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন। ফলে তিনি রাজনৈতিক বন্দী রূপে বক্সার জেলে আটক হন। মহান অক্টোবর বিপ্লব তাঁর মনে অসীম সাহসের সঞ্চার করেছিল এবং সেই সময় তাঁর মনের চিন্তাধারা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হতে থাকলে তিনি কার্ল মাক্সের মতবাদের প্রতি প্রবল ভাবে আকৃষ্ট হয়ে ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির পার্টিজান কর্মীরূপে বিহার, উত্তরপ্রদেশের গ্রামাঞ্চলে পরিভ্রমণ করতে থাকেন। অতঃ তিনি বন্দী দশা মুক্তি লাভ করে বিহারের হাপড়া জেলার কংগ্রেস কমিটির সম্পাদকপদে আসীন হন।

বেশ কিছুদিন পরে তিনি ঐ কমিটির সম্পাদকের পদ পরিত্যাগ পূর্বক নেপালে গমন এবং সে দেশে কিছুকাল অবস্থান করেন। সেই সময় তিনি সেখানে বেশ কিছু লামার সান্নিধ্য লাভ করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মহাবুন্ডায় অবস্থিত কতিশয় চীনা লামাও। সেই সময় রাহুল সাংকৃত্যায়ন অতীন্দ্রিয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তের পর ইংরেজ সরকার কর্তৃক তাঁকে রাজদ্রোহের অভিযোগে আটক করে হাজারিবাগ জেলে বন্দী করে রাখা হয়। কারণ তিনি একসময় কংগ্রেস পরিষদীয় দলের সম্পাদকের পদে আসীন ছিলেন। এখানেই তাঁর সঙ্গে স্বামী ভারতী কৃষ্ঞতীর্থের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ইত্যবৎসরে তিনি বীজগণিত এবং আলোক বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং জ্যোর্তিবিদ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেন।

জেলজীবন অতিবাহিত হওয়ার পরে তিনি হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য সাধনের কাজে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এছাড়াও তিনি সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণের কাজেও নিজেকে সমর্থন করেছিলেন। ১৯২৬ খ্রীঃ তাঁর সঙ্গে ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদের সাক্ষাত্ ঘটে। ড. প্রসাদ তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত ইত্যাদি পাঠ করে এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি উক্ত বক্তৃতামালা মুদ্রিত আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন।

কৃষক আন্দোলন

১৯৩৪ খ্রীঃ বিহারে সমাজবাদী পার্টি গঠিত হয়। তিনি এই সংগঠনের সম্পাদকপদে যুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি বিহার কিষাণ সভা ও বিহার কমিউনিষ্ট পার্টি গঠন করেন। কমিউনিষ্ট পার্টি গঠনের মূল কারণ ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে মতাদর্শগত মতবিরোধ। ১৯৪৭ খ্রীঃ পর্যন্ত তিনি একান্ত ভাবে কমিউনিষ্ট সংগঠনের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন।

১৯৩৯ খ্রীঃ তিনি কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী সঙ্গে একত্রিত হয়ে কৃষ্ঞান সভার পতাকাতলে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করেন। সেই বছরেই তিনি আড়াই বৎসরকাল ব্যাপী কারাবাস ভোগ করেন। কারাবাসের সময়কালে তুলনামূলক দর্শন (Comparative Philosophy) ‘দর্শন দিগ্‌দর্শন’ নামক এক অসামান্য গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর জীবনের মহানব্রত ছিল দেশবাসীর উন্নয়ন। তিনি মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন যে ভারতবর্ষকে যথার্থ ভাবে উন্নত করার একমাত্র পথ হল এই দেশকে পরাধীনতার শৃংখল হতে মুক্ত করা। আর এরজন্য প্রবোজন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।

 

শ্রীলংকা এবং তিব্বত পর্যটন

১৯২৭ খ্রীঃ রাহুল সাংকৃত্যায়ন শ্রীলংকা গমন করেন। এই দেশে কিছুকাল অবস্থান কালে তিনি গভীর উৎসাহের সঙ্গে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং উক্ত দেশ হতে তিনি ত্রিপিটকাচার্য উপাধি লাভ করেন। অতঃ তিনি ভিক্ষুধর্মে দীক্ষিত হয়ে আচার্যের নিকট হতে রাহুল সাংকৃত্যায়ন নামে ভূষিত হন। পরবর্তীকালে তিনি বহুবার শ্রীলংকা গমন করেছিলেন।

তিনি বেশ কয়েক বৎসর তিব্বত ভ্রমণ করেন। প্রথমবার তিনি তিব্বতে যান ১৯২৯ খ্রীঃ, দ্বিতীয়বার ১৯৩৪ খ্রীঃ, তৃতীয়বার ১৯২৬ খ্রীঃ এবং অন্তিম সময় ১৯৩৮ খ্রীঃ। তিনি তিব্বত যাত্রাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে মূল্যায়ণ করেছিলেন। তাঁর মতে এই দেশ ভ্রমণ অত্যন্ত জটিল তথাপি ফলপ্রসু। তিনি তাঁর তিব্বত যাত্রা হতে প্রত্যাবর্তন কালে অতি মূল্যবান তথা দুষ্প্রাপ্য পুঁথি ভারতে আনয়ন করেছিলেন। এই সকল পুঁথিপত্র বর্তমানে নেপাল ও নালন্দায় সংরক্ষিত রয়েছে। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন যে ৭ম শতাব্দীতে পৃথীবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ‘নালন্দা’ বখতিয়ার খলজি নামক তুর্কী মুসলমান শাসক দ্বারা সম্পূর্ণ ভাবে বিনষ্ট হয়েছিল।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৩১-১৯৩৮ খ্রীঃ সময়কালে এশিয়া এবং ইউরোপের বহুদেশ ভ্রমণ করেছিলেন।

 

রুশদেশ ভ্রমণ

১৯৩৫ খ্রীঃ রাহুল সাংকৃত্যায়ন সর্বপ্রধম রূশদেশ (তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন) গমন করেন। পুনঃরায় ২ বৎসর পরে তিনি রুশদেশে যান। এই সময় তিনি লেনিনগ্রাভ শহরে ২ বৎসর অবস্থানরত ছিলেন। লেনিনগ্রাভ শহরে অবস্থানকালে তিনি ‘ওরিয়েন্টাল ইনষ্টিটিউটে’ সংস্কৃত ভাষার শিক্ষকরূপে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় ‘ইলেনা নরভার টোভনা’ নামক এক রুশ মহিলা ‘ইন্দো-টিবেটান ষ্টাডিজ’এর সেক্রেটারী পদে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৩৮ খ্রীঃ তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর নামকরণ করা হয় ‘লগোর’। তিনি সেই বৎসর’ই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। নবজাতকশিশু এবং মাতা রুশদেশেই থেকে যান।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৪৫ খ্রীঃ পুনঃ রুশদেশে গমন করেন। তিনি এই সময় লেনিনগ্রাভের কোন এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনাকার্যে যুক্ত ছিলেন। তথায় তাঁর সঙ্গে বহু মনীষী এবং দার্শনিকের সাক্ষাৎ ঘটেছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন সারভেসিক, বারনিকোভ এবং কলিয়ানোভ প্রমুখ। সেই সময় মস্কো শহরে ড. টলস্টোভ নামক এক প্রখ্যাত ঐতিহাসিকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে এবং তাঁর অনুপ্রেরণায় তিনি এশিয়া সোভিয়েত বিষয় সম্পর্কিত গবেষণাধর্মী অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি উক্ত গবেষনার পরিনাম রূপে ‘মধ্য এশিয়ার ইতিহাস’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন এবং ‘সাহিত্য আকাডেমী’ পুরস্কার লাভ করে ছিলেন। বস্তুতঃ তিনি এই সময়কালে ভারতবর্ষ ও তার পার্শ্ববর্তী বহু দেশের ভূগোল এবং ইতিহাস সম্পর্কিত অনেক সৃজনশীল গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

তিনি ১৯৪৭ খ্রীঃ’র জুলাই মাসে শেষবারের ন্যায় রুশদেশ ত্যাগ করে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। এই সময় তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী-পুত্রের বিচ্ছেদ ঘটে যদিও এরপরেও তিনি মস্কো শহরে চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেছিলেন কিন্তু তাদের সঙ্গে আর তাঁর সাক্ষাৎ সম্ভব হয় নি।

স্বদেশে প্রত্যাবর্তন

যখন তিনি স্বাধীন ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন তখন তিনি দেখতে পান সমগ্রদেশে সাম্প্রদায়িক নাগপাশে জর্জরিত। তিনি তখন সাম্প্রদায়িক মিলনের পথের সন্ধানে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৭ খ্রীঃ তিনি মুম্বাই শহরে অনুষ্ঠিত হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতির আসন অলংকৃত করে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির আহ্বান জানান। কিন্তু এক সময় মতাদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে তিনি সক্রিয় রাজনীতি হতে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এরপর তাঁর জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। শুরু হয় এক নতুন পথে হাঁটা।

জীবনের সিংহভাগ সময় তিনি অতিবাহিত করেন কখনও দেশ পর্যটন করে আবার কখনও নেপাল, চীন, শ্রীলংকায় শিক্ষকতা বরত্তির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। অতঃ জীবনের অবশিষ্ট অংশ তিনি পুরোপুরি ব্যয় করেন কখনও বা ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থ প্রকাশ করে আবার কখনও বা ঐতিহাসিক ও ভারত সংস্কৃতি মূলক নিবন্ধগ্রন্থ ইত্যাদি রচনা করেন। এক সময় ভারতীয় সংবিধানকে হিন্দি ভাষায় রূপদানের প্রশ্নে তাঁর প্রতি ভার ন্যাস্ত করা হয় এবং সেই কাজ তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন।

হিমালয়ের প্রতি অকৃত্তিম ভালোবাসা তাঁকে কালিম্পং টেনে নিয়ে আসে। এখানে তাঁর বহুকালের বন্ধু জর্জ বোরিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে এবং কমলা নামক রমণীর সঙ্গে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন। কমলা ছিলেন তাঁর তৃতীয় পত্নী।

১৯৫০ খ্রীঃ তিনি মৌসুরীর ‘হ্যাপি ভ্যালি’ তে একটি গৃহ ক্রয় করেন। এখানে তিনি ভীষণভাবে লেখা’র কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। তাঁর কন্যা জয়া ১৯৫৩ খ্রীঃ জন্মগ্রহন করেন এবং পুত্র হেতা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৫ খ্রীঃ। রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৫৬ খ্রীঃ সপরিবারে নেপাল ভ্রমণ করেন। ১৯৫৮ খ্রীঃ তিনি গণতান্ত্রিক চীন গমন করেন এবং সেখানেই তিনি প্রথমবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৫৯ খ্রীঃ শ্রীলংকার বিদ্যালংকার পরিবেন এর দর্শন বিভাগের বিভাগীয় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। শ্রীলংকা গমনের পূর্বে তিনি তাঁর স্ত্রী-পুত্র এবং কন্যাকে কালিম্পং এর গৃহে স্থানান্তরিত করে যান।

১৯৬১ খ্রীঃ তিনি শ্রীলংকায় পুনঃ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতঃ তিনি সরাসরি শ্রীলংকা হতে দার্জিলিং চলে আসেন। তাঁর ক্লান্তিহীন অবিরাম পরিশ্রম তাঁর শরীর আর গ্রহণ করতে পারল না। সেই বৎসর ডিসেম্বর মাসে তিনি পুণঃ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তখন তাঁকে চিকিৎসার নিমিত্তে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে মস্কো নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু এত্বদ স্বত্ত্বেও সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল এবং তাকে আর কোন ভাবেই সুস্থ করা সম্ভব হল না। ১৯৬৩ খ্রীঃ মার্চ’এ তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ১৯৬৩ খ্রীঃ ১৪ এপ্রিল তিনি তাঁর প্রিয় শহর কালিম্পং’এ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

সাহিত্যে সৃজনশীল অবদান :

যদিও তিনি সর্বদা পর্যটন কার্যে নিয়োজিত ছিলেন তথাপি তিনি কোন না কোন ভাবে লেখালেখির কার্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ১৯২০- ১৯৬১ খ্রীঃ পর্যন্ত তিনি সাহিত্য চর্চার কাজে মগ্ন ছিলেন। যতদিন না তিনি স্মৃতিভ্রম ব্যাধিতে আক্রান্ত না হয়েছেন ততদিন তিনি কোন না কোনো রচনাকার্যে ব্যপৃত থেকেছেন। এই কাল খন্ডের মধ্যে তিনি রচনা করেছেন একশত খন্ড পুস্তক। এই পুস্তক সমূহের মধ্যে ছিল উপন্যাস, ছোটগল্প, তাঁর নিজের জীবনী সহ অন্যজনের জীবনী। জীবনী গ্রন্থের সংখ্যা ছিল সুবৃহৎ ৫ খন্ড; ২০টির অধিক ভ্রমণ বৃন্তান্ত, ৮ খন্ড রচনা সংগ্রহ ভোজপুরী ভাষায় ৮টি নাটক এবং ৩টি দর্শন শাস্ত্র বিষয়ক নিবন্ধ। তাঁর রচিত উপন্যাস সমূহের মধ্যে ‘সিংহ সেনাপতি’ এবং ‘জয় মৌধেয়’ উল্লেখ্যনীয়। ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ এই কালজয়ী গল্প সমূহের সময়কাল বৈদিক পূর্বযুগ হতে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। এই গ্রন্থটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন কর্তৃক রচিত গ্রন্থপুঞ্জ কেবলমাত্র মৌলিক রচনার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তদুপরি তাঁর রচনার ধারাকে তিনি ব্যাপ্ত করে দিয়েছেন বৈচিত্রের মধ্যে। এই বৈচিত্রময় সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, ভাষা, ভ্রমণ কাহিনী, ভারততত্ত্ব, শিল্প-বিজ্ঞান, অভিধান, বৌদ্ধসাহিত্য, লোকসাহিত্য এবং আরও বহু বিভিন্ন ধর্মী রচনা।

ভারতীয় সাহিত্যে রাহুল সাংকৃত্যায়ন’এর উল্লেখনীয় অবদান হল সহজবোধ্য হিন্দি ভাষায় প্রাচীন সাহিত্যের সহজ সরল অনুবাদ। চিরায়ত পালি ভাষায় রচিত প্রাচীন বৌদ্ধ পুঁথি, সিংহলী এবং তিব্বতী গ্রন্থ তিনি উৎসুক পাঠক সমাজ ও গবেষকের কাছে সহজলভ্য এবং সহজবোধ্য করে দিয়েছেন। এই সকল রচনা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। সর্বোপরি তাঁর রচনার ভাষা ছিল সহজ ও সরল। সাহিত্যের এমন কোন অঙ্গন নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। সুতরাং এই অর্থে রাহুল সাংকৃত্যায়ন হলেন বিশ্ব নাগরিক এবং যার মূল্যায়ন কোনো অর্থেই সম্ভব নয়।

 ১২.০২.২০২৪

 

No comments:

Post a Comment