সুমনপাল ভিক্ষু
আজ্ঞাপ্য ব্যবধূতভিম্বভমরাম্ একাতপত্রাং মহীং
উৎপাটচ প্রতিগর্বিতামরিগনান্ আশ্বাস্য দীনাতুরান।
ভ্রষ্টাহস্থাহসতনো ন ভাতি কৃপনঃ সংপ্রত্যশোকো নৃপশ্
ছিন্নম্লানবিশীর্ণপত্রকুসুমঃ শুষ্যত্যশোকো যথা।।
পুণঃ একচ্ছত্রসমুচ্ছয়াং বসুমতীমাজ্ঞাথয়ত যঃ পুরা
লোকং তাথয়তি স্ম মধ্যদিবস প্রাপ্তো দিবা ভাস্কর।
‘ভাগ্যচ্ছিদ্রমবেক্ষ্য সোহদ্য নৃপতিঃ স্বৈঃ কর্মভির্বঞ্চিতঃ
সংপ্রাপ্তে দিবসফয়ে রবিরিব ভ্রষ্টপ্রভাবঃ স্থিতঃ।।
-অশোকাবদানং, পৃঃ ১৩০।
“আমি প্রকাশ্যে একজন বৌদ্ধ”।
সুমি পাকাসা (সা) কে (ই)।
“আমি প্রকাশ্যে শাক্য”।
রূপনাথ মাইনর রক্, এভিক্ট-ভ’এ অশোক।
মহামতি অশোকের বুদ্ধধম্মোর উপস্থাপনাঃ
অশোকের মাইনর রক্ এভিক্ট এবং অশোক প্রস্তাবিত প্রামাণিক গ্রন্থসূচী রাজস্থানে পাওয়া গেছে। অশোকের ধম্মলিপি’তে ৭টি গ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে। সর্বোপরি তাঁর ধম্মলিপি’তে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের প্রতি সম্বোধন করা হয়েছে।
ধম্মলিপির’র আদেশটি নিম্নরূপ:
আদেশের শুরু :
মগদের রাজা প্রিয়দর্শী সংঘকে অভিবাদন জ্ঞাপন পূর্বক তাদের সুস্বাস্থ্য এবং সুখী জীবনযাপনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
এটা আপনি অবগত আছেন, হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, বুদ্ধ, ধম্ম এবং সংঘের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস কতটা মহান। যাই হোক না কেন, শ্রদ্ধেয় মহাশয়, আশীবার্দ পুষ্ট বুদ্ধের দ্বারা বলা ভাল। তবুও হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, আমি ভাবতে পারি যে এইভাবে ধম্ম চিরকাল স্থায়ী হবে এবং আমি তা করার অধিকারী। এগুলি হল, হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, ধম্মের গ্রন্থ (ধম্মাথালিয়া)।
১. বিনয়সমুকস্ (বিনয় সমর শ্রেষ্ঠত্ব)
২. অলিয়বসানি (আরিয়াভাসা : নোবেল লিভিং)
৩. অনাগতভয় (ভবিষৎ’এ ভয়)
৪. মুনিগাথা (মুনির গাথা/বুদ্ধের দেশনা)
৫. অর্থসূত্তা (মুনির উপর সুত্ত)
৬. উপতিস্পসিন (সারিপুত্তের প্রশ্ন)
৭. লাঘুলোবাদ (রাহুলকে নির্দেশাবলী)
ধম্মের এই গ্রন্থসমূহ আমি কামনা করি।
কেন?
কারণ অসংখ্য মানুষ, যাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভিক্ষু। সেইসাথে ভিক্ষুগণ প্রায়শই তাদের কথা শ্রবণ এবং উপলব্দি করতে পারেন। এই কারণে হে শ্রদ্ধেয় মহাশয়, আমি এটি খোদাই করে দিয়েছি, যাতে তাঁরা আমার উদ্দেশ্য অবগত করতে পারি।
আদেশের সমাপ্তি।
মহামতি অসোকের বুদ্ধ এবং তাঁর ধম্মের পাঠ:
অশোকের উল্লেখিত ৭ টি গ্রন্থ এবং ভিক্ষুগণকে সম্বোধনের বিষয়টি তাঁর মনের নীল নকশা প্রদান করবে। পন্ডিতগণ ত্রিপিটকে তাঁর শ্রাস্ত্রীয় উপস্থিতির সন্ধান পেয়েছেন।
৭’ টি গ্রন্থের তালিকা :
১. বিনয়সমুকস্ (বিনয়অমর শ্রেষ্ঠতা)।।
১.১ মধ্যপন্থা অনুশীলন
১.২ চারি আর্যসত্য উপলব্দি
২. অলিয়বসানি (আরিয়াভাসা : নোবেল লিভিং)।।
২.১ পঞ্চপ্রতিবন্ধকতা হতে মুক্তি লাভ (পঞ্চ নিবারণ)
২.২ ৬ ইন্দ্রিয় বস্তুতে লিপ্ত হওয়া হ’তে বিরত থাকা
২.৩ মননশীলতার সঙ্গে মনকে রক্ষা করা
২.৪ ৪টি পরিশ্রম
২.৫ মতবাদ প্রত্যাখ্যান
২.৬ তনহা পরিত্যাগ (তৃষ্ঞা)
২.৭ বিশুদ্ধ মনের কর্ষন
২.৮ সমম ও বিদর্শন কর্ষন করা
২.৯ রাগ, দোষ ও মোহ বর্জন
২.১০ মনের মুক্তি
পঞ্চ বিষাদ পরিতাজ্য করা উচিত :
৩.১ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষন না করে উচ্চতর আদেশ প্রদান করবেন না।
৩.২ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষণ না ক’রে অন্যদের সমর্থন করবেন না।
৩.৩ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষণ না ক’রে অন্যান্য বিষয়ের আলোচনায় প্রবেশ করবেন না।
৩.৪ ভিক্ষুগণ তাদের দেহ, শীল, মন এবং প্রজ্ঞার কর্ষণ না ক’রে গভীর ধম্ম অধ্যয়ন করবেন না এবং তা উপযোগী মনে করবেন না।
৩.৫ ভিক্ষুগণ সুন্দর স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্নসহ কথা বলে আনন্দিত হবেন।
৪. মুনিগাথা (বুদ্ধ দেশনা)।।
এটি মিনিগাথায় পালিত, মুনির আদর্শ যা মিনির গুণাবলী এবং একজন মুনির জীবনযাপনের সঙ্গে গৃহস্থ জীবন যাপনের তুলনা করে।
৫. মুনিসুত্ত (অর্থসুত্তা)।।
যা দুঃখ-কষ্টের দিকে টেনে নিয়ে যায়, তা থেকে কীভাবে দুরত্ব বজায় রাখা যায়, একথায় কায়, বাক্ এবং চিত্ত (মন) কে সংযত করা।
৫.১ শরীরের নিস্তব্দতা :
জীবন নেওয়া (হত্যা ইত্যাদি) থেকে বিরত থাকুন।
অদত্ত বস্তু গ্রহণ অর্থাৎ যা প্রদান যোগ্য নয় তা গ্রহণ হতে বিরত থাকুন। যৌন অসদাচরণ হতে বিরত থাকুন।
৫.২ বক্তব্যের নীরবতা :
মিথ্যা বাক্য হতে বিরত থাকুন।
অপবাদ হতে বিরত থাকুন।
কটু (কু-বাক্য) এবং কর্কশ বাক্য হতে বিরত থাকুন।
অলসতা’ হতে বিরত থাকুন।
৫.৩ মনের নীরবতা :
আবেগের বিলোপ সাধন।
আবেগ মু্ক্ত অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করা।
৬. উপতিসপসিন (বারিপুত্তের প্রশ্ন) ।।
৬.১ নির্ভীকতার কর্ষণ করা।
৬.২ সকলের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা পোষন করা।
৬.৩ তৃপ্তি এবং সংযম চাষ করা।
৬.৪ মননশীলতা চাষ করা।
৬.৫ ধৈর্য্য চাষ করা।
৬.৬ বিশুদ্ধতা চাষ করা।
৬.৭ মনের স্বাধীনতা চাষ করা।
৭. লাঘুলোবাদ (রাহুলকে নির্দেশাবলী) ।।
৭.১ ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবাক্য ব্যক্ত করার প্রশ্নে লজ্জিত হন।
৭.২ কর্মসম্পাদনের পূর্বে চিন্তা করা। অর্থাৎ যে কর্মটি নিজের তথা অপরের ক্ষেত্রে মন্দ, তা উভয়ের ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনবে কিনা।
৭.৩ এই প্রতিফলন অবশ্যই শারীরীক ক্রিয়া, বক্তব্য এবং চিন্তার প্রশ্নে করা উচিৎ (শরীর, বক্তব্য এবং মনের ক্রিয়া)।
উপসংহার :
এইভাবে, অশোকের ধম্মের উপস্থাপনা যা তিনি উল্লেখ করেছেন তা ৭টি প্রামানিক গ্রন্থে এইভাবে ব্যক্ত করেছেন।
মহামতি অশোক বুদ্ধের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগুলি অনুশীলনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং বুদ্ধের উদাহরণকে সামনে রেখে ভবিষৎ’এর বিপদ এড়াতে তথা উৎকৃষ্ট ‘মনচাষা’ হয়ে মহৎ জীবনকে ধারণ করতে বলেছিলেন।
মহামতি ধম্মাশোক : ভারতীয় ইতিহাস এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।।
ভারতীয় ইতিহাসের একটি মিথ্যাদৃষ্ট মূলক অধ্যায় ব্রাহ্মণবাদী কল্পনা দ্বারা রচিত হয়েছে। এই ইতিহাসের সম্পূর্ণ অংশই হল অভিসন্ধি মূলক এবং সামন্তবাদী। ভারতীয় উপমহাদেশ হতে বুদ্ধ শাসন এবং তাঁর একনিষ্ট উপাসক সম্রাট অশোক’কে মুছে বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করলে এটি আরও স্পষ্টতর হয়ে উঠবে।
যথা হি চোরঃ স তথা হি বুদ্ধস্তথাগতং নাস্তিকমন্ত্র বিদ্ধি।
তস্মাদি যঃ শঙ্ক্যতমঃ প্রজাণাম্ ন নাস্তিকেনাভিমুখো বুধঃ স্যাত্।।
-বাল্মিকী রামায়ণ, ২.১০৯.৩৪।
ইতিহাসবিদ চার্লস্ অ্যালেনের মতে, অশোক ভারতের প্রতিষ্ঠাতা। ভারতীয় ইতিহাস তাই অশোকের নথি হতে অধ্যয়ন করা আবশ্যক। মৌখিক তথ্যের বিপরীতে, অশোকের তথ্যগুলি পাথরে খোদাই করা এবং সেগুলি (শিলালিপি) সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান। ভারতের ইতিহাস রচনার প্রামানিক তথ্য রূপে অশোকের অভিলেখ গুলিই হবে একমাত্র প্রামানিক দলিল। এর বিপরীতে অন্যান্য সমস্ত তথ্য সমূহকে অনুমানমূলক রূপে গ্রহণ করা উচিৎ।
প্রাচীন ভারত সম্পর্কিত একজন মহান ইতিহাসবিদ এবং অশোক গবেষনার একজন প্রসিদ্ধ নাম, অধ্যাপক প্যাট্রিক অলিভেলে অশোকের শিলালিপি গুলিকে যথার্থ অর্থে অশোকের লেখা বলে অভিহিত করেছেন।
অশোকের লেখা অধ্যয়নের পরে তার উপসংহারও চমকপ্রদ। তিনি অশোকের নীরবতাকে উল্লেখ করেছেন যা প্রাচীন ভারতে ‘বিশিশ্থ’ রূপে পরিগণিত হয়। অশোকের লেখায় প্রাচীন ভারতে যা জোর দেওয়া হয়েছে তার অনুপস্থিতি ভারতের সমগ্র ইতিহাস পর্যালোচনার একটি মঞ্চ নির্মান করে।
অশোকের অভিলেখ’তে এগুলি অনুপস্থিত :
১. বর্ণ ব্যবস্থা
২. পুর্নজন্ম এবং কর্মবাদ (শ্রম)
৩. বৈদিক শ্রেণী রূপে গৃহস্থ সমাজ
৪. দ্বি-জন্মের ধারণা
যদিও আমরা ৩নং পয়েন্টের আলোচনাকে একপাশে সরিয়ে রেখে অবশিষ্ট পয়েন্ট নিয়ে ও আলোচনা করি (প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অধ্যয়নের প্রশ্নে) এবং তা সঠিক রেকর্ড স্থাপনের ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হবে।
এখন অধ্যয়ণগুলি দেখায় যে বর্ণাশ্রম ধর্ম’ হল বৌদ্ধধর্মের পরবর্তী বিকাশ এবং এই অর্থে ব্রাহ্মণ্যবাদী সাহিত্যের বেশিরভাগই উত্তর-বৌদ্ধ যুগেই রচিত হয়েছে। সেই সময় ভারতে এক শ্রেণীর ধর্মীয় গোষ্ঠী (বৌদ্ধ মতে অন্য তীর্থিক) রূপে ব্রাহ্মণদে অস্তিত্ব ছিল। এটি ‘দল’ বা গোষ্ঠী ছিল না যেমনটি আজ ইতিহাস বইতে পড়ানো হয়। মনে হয় যে সেই সময় ভারতীয় সমাজে বর্ণ ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ ভাবে গঠিত হয়নি এবং বধিত ভাবে সেখানে কোনরূপ জাতি ভেদও ছিল না। যা এখন আমরা প্রত্যক্ষ করছি।
অশোকের লেখায় পুনর্জন্ম এবং কর্মবাদের অনুপস্থিতি অর্থাৎ দ্বিতীয় পয়েন্টটিও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় মন কর্মফল এবং পুণর্জন্মের অনুমানে আচ্ছন্ন। বুদ্ধের মূল শিক্ষা হতে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ অর্থে ভিন্ন। ব্রাহ্মণ পরিকল্পনায় কর্মফল এবং পুনর্জন্ম বর্ণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। এই অর্থে কর্ম (শ্রম) হল বণফের ন্যায্যতা।
চতুর্থ অনুপস্থিতি যা দ্বিগুন জন্ম (দ্বিজ) ধারণারে এক উল্লেখ্যণীয় প্রমাণ এবং যা এই সত্যটিকে নির্দেশ করে যে তৎকালীন বৌদ্ধ ভারত ছিল বাস্তবিক অর্থে সমাজতান্ত্রিক সমাজ। এটি অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর ন্যায় ব্রাহ্মণদের শুধুমাত্র একটি শ্রেণীরূপেই গ্রহণ করেছিল। সেই ব্রাহ্মণরা ছিল একটি পেরিফেরাল শ্রেণী এবং সেই অর্থে বর্ণ ব্যবস্থার পরিকাঠামো ও তখন নির্মিত হয়নি।
ড. আম্বেদকর যেভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন তা এই আলোচনাতেই স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।
১. ভারতীয় অস্পৃশ্যরা বিচারাধীন বৌদ্ধ
২. বর্তমান যাদেরকে শুদ্ররূপে প্রতিপন্ন করা হয় তারা ব্রাহ্মণীয় কল্পনার শ্রেণীবদ্ধ কাঠামোর শুদ্র নয়। বিগত ২০০ বৎসরের ব্রাহ্মণ্য প্রচারের কারণে বর্তমান ভারতীয়দের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে ইচ্ছাকৃত ভাবে (শোষন করার অভিপ্রায়ে) শুদ্র বলা হয়।
যদি সেই অর্থে ভারতীয় ইতিহাসের একটি পরিস্কার ছবি পেতে হয় তাহলে ড. আম্বেদকরের লেখার সঙ্গে মহামতি অশোকের অভিলেখগুলিকেও সমান্তরাল ভাবে অনিশীলন করা উচিত।
অধ্যাপক অ্যালফ্ হিলটেবিটেল বৌদ্ধ ও বৈদিক শাস্ত্রে ধম্ম/ধর্মের বিভিন্ন অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। এই সুবিশাল গ্রন্থটি ধম্ম/ধর্ম শব্দের নানাবিধ অর্থ সম্পর্কিত তথ্যের একটি সমৃদ্ধ উৎস এবং ভারতীয় ইতিহাসের যে কোন ছাত্রের জন্য অপরিহার্য। যাই হোক, এই বিষয় টি অশোকের ধম্ম কে উপলব্দি করার বিষয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে তথা যেমনটি স্পষ্ট অর্থে অধ্যাপক হিলটেবিটেল দ্বারা ব্যাখ্যাত হয়েছে, যা পরে আম্বেদকরের ধম্মের আলোচনার সঙ্গে তুলনা করা হবে। ভারতীয় ইতিহাসের এই দুই মহান ব্যক্তিত্বকে উপলব্দি করা এই মুহূর্তে কতটা জরুরি যখন ভারত সামন্তবাদ তথা কর্তৃত্ববাদী শাসনের মুখোমুখি।
চালর্স অ্যালেন মহামতি অশোককে বৃহত্তর ভরতের প্রতিষ্ঠাতা পিতা রূপে উল্লেখ করেছেন এবং ড. আম্বেদকর ভারতকে একটি গণ-প্রজাতন্ত্রের পরিণত করার প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ভূমিকা পালন করেছেন। অশোক এবং আম্বেদকর, উভয়েরই মার্গপ্রদর্শক হলেন মহান বুদ্ধ। শাক্যমুনি বুদ্ধকে উল্লেখ করার সময় অশোক তাকে ‘আমাদের বুদ্ধ’ রূপে উল্লেখ করার সময় আম্বেদকর তাকে “আমার বুদ্ধ’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের এই সম্বোধন বুদ্ধের প্রতি গভীর ভালবাসা এবং বিশ্বাস প্রদর্শন করে।
অশোক বিষয়ক পন্ডিত হ্যারিফক্ একটি আর্কষণীয় অনুমানের প্রতি ঈঙ্গিত করেছেন যে অশোক সম্ভবত স্বয়ং ধম্মলিপির আবিস্কারক এবং যে শাস্ত্রটি সমস্ত ভারতীয় লিপির জননী হয়ে উঠেছে। তিনি আরও মনে করেন যে অশোক গ্রীক বর্ণমালার উপর তার লেখ্যগুলি তৈরী করেছিলেন। তবে একথা উল্লেখ্যনীয় যে ধম্মলিপি গ্রীক লিপি হতে সম্পূর্ণ অর্থেই ভিন্ন।
প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতায় বর্ণমালার প্রচলন ছিল কিন্তু তা এখনও পাঠোদ্বার সম্ভব হয়নি। অশোক প্রবর্তিত শিলালিপি এবং স্তম্ভের আদেশ সেই অর্থে প্রথম প্রমাণ গঠন করে এবং তাই ধম্ম/ধর্ম শব্দের অনুসন্ধান।
মহামতি অশোক তাঁর আদেশে প্রায় ১১১ বার ধম্ম শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি তাঁর আদেশকে ধম্মলিপি রূপে ঘোষণা করেছিলেন। অশোক প্রদত্ত ‘ধম্ম’ শব্দের অর্থ হল ধর্মপরায়ণতা রাজা এবং পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সত্য পক্ষ অবলম্বন। তিনি ধম্মের প্রচারার্থে ধম্মযাত্রা পরিচালনা এবং সদ্ধর্মকে রক্ষার প্রশ্নে সদা সচেষ্ট ছিলেন। এখন আমরা ক্রমানুসারে অশোকের জীবনগন বিন্যাসের নানাবিধ বিষয়গুলি আলোচনা করতে পারি।
অশোক তাঁর রাজত্বের মধ্যবর্তী সময়কালে সদ্ধর্মকে একটি সুদৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করেছিলেন। এই ধম্মের মূলভিত্তি ছিল ‘ধম্মানুশাসন’।
এই ধম্মের মূল ছিল মাতা ও পিতার প্রতি আনুগত্য, বন্ধুদের প্রতি উদারতা, পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, অন্বেষণকারীর প্রতি সহমর্মিতা পোষন, জীবন হত্যা না করা এবং ব্যয়-সম্পদের সংযম। তিনি একইভাবে শীলচর্চাকেও উৎসাহিত করতেন। তিনি জনগনকে যে কোন অপকর্ম হতে বিরত থাকতে বলেছেন।
অশোকের সদধম্ম শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত আকর্ষনীয়। অশোকের শাসনের মূলনীতি ছিল কোনো শ্রেণী বা গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য না করা। তিনি সমতা প্রচার করেছিলেন। ধম্মাশোক এইভাবে ধম্ম শব্দটিকে একটি সমতাবাদী এবং সর্বজনীন স্তরে উথ্থাপন করেছিলেন যা এটিকে ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সমস্ত ধরণের অন্যান্য ধারণাগুলির কার্যকারিতা বিচারের দৃষ্টিকোন রূপে নির্মাণ করে। অশোকের ধর্ম সেই অর্থে সর্বজনীন তথা অসাম্প্রদায়িক। তাঁর ধম্ম কূল, বর্ণ, এমন কি রাজধর্মেরও উর্দ্ধে।
পন্ডিতবর্গের অভিমত অনুসারে সম্রাট অশোক ধম্ম শব্দটি অভিধমীয় উপায়ে ধ্যানমূলক আত্ম-পরীক্ষা রূপে ব্যবহার করেছিলেন। ‘ধম্ম’ শব্দের এই ব্যাখ্যা হিংসা, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা, অলসতা এবং ক্লান্তির ন্যায় প্রবণতা হতে মনকে রক্ষা করে নিরপেক্ষতার অনুশীলন অর্থে বোঝায়। তিনি ধম্মকে সমবেদনা (দয়া), ভাগ করা (দান), সত্য (সাককা) এবং মনের বিশুদ্ধতা (সোকায়ে) রূপে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এই বিষয়টি ধ্যানমূলক স্ব-অনুসন্ধানের সাথে অনুশীলন করা হয়। অশোক ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি দুটি উপায়ে ধম্মে অগ্রগতি অর্জন করেছেন। (এটি প্রসারে) ধম্ম নিয়ামেন (ধম্মের আইন দ্বারা) এবং নিজ্জাত্তি (ধ্যান অনুশীলন)।
অশোকের ধম্মে আরও অনেক উল্লেখ্যণীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে কিন্তু উপরোক্ত আলোচনাই তাঁর ধম্মকে সর্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক, অ-বৈষম্যহীন, সর্বকালের জন্য, সমস্ত জীবনকূলের উপকারের জন্য অনুশীলনের মাধ্যমে স্পষ্ট ভাবে আলোকপাত করার পক্ষে যথেষ্ট। বিশ্বে দ্বন্ধের উৎসগুলি সম্পর্কে অনুশীলন, নিজের মনকে রক্ষা করা এবং নিরপেক্ষ মনোভাব অর্জনের প্রশ্নে অশোকের ধম্মানুশাসন অত্যন্ত জরুরি। সুতরাং এই অর্থে বলা যায় যে অশোকের ধম্ম রাষ্ট্র পরিকল্পনা আজও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার প্রশ্নে সমান অর্থে প্রাসঙ্গিক।
আধুনিক বিশ্বে ড. আম্বেদকরের আবির্ভাব একটি উল্লেখ্যনীয় ঘটনা। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষিত হওয়া এবং ভারতবর্ষে অন্ধকার বর্ণপ্রথার অন্ধকূপ হতে মুক্তি প্রদানের অভিপ্রায়ে লক্ষ লক্ষ জনগনকে নেতৃত্ব দেওয়া তথা ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য, ভাতৃত্ব, মর্যাদা এবং অখন্ডতার মূল্যবোধের প্রতি ভিত্তি করে গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে ভারতকে একটি সুদৃঢ় ভিত প্রদান করা’র বিষয়টি সম্রাট অশোকের সিদ্ধান্তের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।
তবে এক্ষেত্রে বলতে ্য় যে ধম্ম্রপচারের জন্য অশোকের নিকট সম্পদ ছিল কিন্তু আম্বেদকরকে ধম্মপ্রচারের প্রয়োজনে সম্পদ তৈরী করতে হয়েছিল। তাকে মানুষকে শিক্ষিত করতে হয়েছে এবং একই সাথে লড়াই ও করতে হয়েছে বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তাঁর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হ’ল ‘বুদ্ধ এবং তাঁর ধম্ম’ নামক উল্লেখ্যনীয় গ্রন্থ রচনা। সর্বোপরি তিনি যে বৈপ্লবিক কর্মটি সম্পাদন করেছিলেন তাহ’ল বুদ্ধের ধম্মকে ভারতের নতুন প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি রূপে স্থাপন করেছিলেন। ফলে স্বাধীন ভারতের সংবিধান আইনগত ভাবে সব ধরণের বৈষম্যদূর করেছে এবং বর্ণপ্রথাকে বেআইনি ঘোষণা করেছে।
সম্রাট অশোক হয়ত তেমন ভাবে বর্ণবাদী সমাজ ব্যবস্থার মুখোমুখি হননি। তবে তাঁর সমতাবাদী এবং মানবিক শাসন পরজীবী পুরোহিত শ্রেণীকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। ফলে উত্তরকালে তারা অশোকের মূল্যবোধ এবং ধারণাগুলিকে দেবত্ববাদ তথা অদৃষ্টবাদের মাধ্যমে মুছে ফেলেছিল। আম্বেদকর ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের সাথে সাথে সামন্তবাদী এবং অধিকতর সংগঠিত ব্রাহ্মণ্যবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে মূল অর্থে মনুবাদের পুষ্টপোষক ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রবলভাবে আম্বেদকর বিরোধী এবং ধম্মকে বিকৃত করার প্রচেষ্টায় ক্রমাগত ঘৃণার বাতাবরণ তৈরী করে চলেছে।
সম্রাট অশোক এবং ভারত নির্মাণ ।।
কিছু সূত্র অনুসারে জানা যায় যে ১৪ এপ্রিল মহান সম্রাট অশোকের জন্মদিন। যদিও অশোকের সঠিক জন্মতিথি নির্ণয় করা কঠিন, তবুও সত্য যে তিনি কোনো পৌরানিক বা কাল্পনিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না।
অশোকের নাম এবং গৌরব মহানদী হতে ভোলগা পর্যন্ত অনুরণিত হয়েছিল, যেমনটি মহান ইতিহাসবিদ এইচ.জি.ওয়েলস্ বলেছিলেন। সম্রাট অশোক সম্পর্কে আজ আমরা যেভাবে জানি, সম্ভবত অন্য কোন উদারনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন সম্রাটের ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায় না।
ভারত পৌরাণিকতা এবং বর্ণাশ্রমের কবলে পড়ে অশোককে সম্পূর্ণ অর্থেই ভূলে গিয়েছিল। এক অর্থে অশোক এবং বুদ্ধের ধম্মকে যারা অপছন্দ করতেন তারা অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেদের মনগজ ইতিহাসের আড়ালে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তাঁর শিলালেখ বা অভিলেখ গুলি আবিস্কৃত হওয়ার ফলে আমরা অশোক এবং তাঁর ধম্মনীতি সম্পর্কে জানতে পারি।
আধুনিক ভারত সেই অর্থে অশোকের কাছে ঋণী। স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকায় যে চক্র প্রতীক রয়েছে তা মূলতঃ ধম্মচক্র বা অশোক চক্র নামে পরিচিত। ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীকে যে সিংহ চিহ্ন রয়েছে তাও অশোকের রাজকীয় প্রতীক হতে গৃহীত।
অশোক মানবতাবাদী এবং জনকল্যানকামী ছিলেন। তিনি জনগনের সুবিধার্থে চিকিৎসালয়, বিশ্রামাগার, জলাশয় এবং কূপ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি নারী সুরক্ষার প্রশ্নেও সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর রাজনীতি ছিল সদ্ধর্ম ভিত্তিক। এমনকি তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হওয়ার পূর্বে নিজেকে শাক্য রূপে ঘোষণা করে ছিলেন।
অশোকের শাস্ত্র, চীনা পর্যটক (শুয়াং জ্যাঙ্প্রমুখ) দের ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কিত ভ্রমণ বৃতান্ত এবং প্রাচ্যের ইতিহাসবিদ’দের আবিস্কার না হলে ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত ইতিহাস ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নির্মিত মিথের কুয়াশায় বিলীন হয়ে যেত।
অশোক এবং বৌদ্ধ ধর্মের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদী আক্রমণ এখন সর্বজন বিদিত। বৌদ্ধ আদর্শ গঠিত মৌর্য সাম্রাজ্য তথা অহিংসা-শান্তির ভারতকে ধ্বংস করার প্রশ্নে ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্টপোষক শুঙ্গবংশ (পুষ্যমিত্র শুঙ্গ) হিংসা, মিথ্যাচার এবং কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
অশোক অনেক নীতির চর্চা এবং প্রচার করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ হল ‘সমবায়-সাধু’। ইংরাজীতে যার অর্থ হয় ‘হারমনি ইজ দ্য বেষ্ট’। সমাজে সম্প্রীতি হল সর্বোত্তম নীতি। কারণ সমাজ ধর্ম, ভাষা, বর্ণ এবং জাতি দ্বারা বিভক্ত হয়। যখন একটি’র বৈষম্য দেখা দেয়, তখন সমাজ অত্যন্ত দুর্গতির পঙ্কে নিমজ্জিত হয় এবং তাই সমাজের সর্বোত্তম নীতি হল সম্প্রীতি বজায় রাখা।
দ্বিতীয় নীতিটি হল রাষ্ট্রের প্রশাসন বা যে কোন প্রকল্পের ক্ষেত্রে ‘মধ্যম মার্গ’ ব্যবহার করা। এটিকে স্থির পদক্ষেপ রূপে গ্রহণ করা উপযোগী হতে পারে।
অবিচলিত কর্ম এবং কোন হঠকারিতা নয়।
অশোকের এই নীতি আজ আমাদের প্রয়োজন। কারণ হঠকারি বা তাড়াহুড়ো করে যা কিছু করা হয় তা হবে আমনোযোগী এবং এইটি ধ্বংসাত্মকও হতে পারে। সুতরাং সমাজ বিকাশের স্বার্থে চিন্তার বিকাশ করুণ, শিক্ষার প্রসার ঘটান এবং মানুষকে নিজের বিকাশের প্রশ্নে চিন্তা করতে দিন। এই বিষয়টিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, ‘অনিভিক্ষি’। এর অর্থ হল চিন্তার সংস্কৃতি, স্পষ্টভাবে এবং সৃজনশীল ভাবে চিন্তা করা। সেই সময় অশোকের অনুসরণে প্রাচীন ভারতে শিল্প-বিজ্ঞান দ্রুত অগ্রসর হয়েছিল এবং ভারত পৃথিবীতে পপধম শিক্ষার বিকাশে নালন্দা, তক্ষশীলা ও বিক্রমশীলা ও বিক্রমশীলার ন্যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
অশোক দ্বারা প্রচারিত নীতি সমূহ।।
১. সম্প্রীতি সর্বিত্তম এবং সর্বোচ্চ।
২. হঠকারীতা ব্যতীত অবিচলিত কম।
৩. সকলের মঙ্গলার্থে চিন্তা ও জ্ঞানের সংস্কৃতি।
ধম্মাশোক দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন ড. আম্বেদকর, যিনি স্বয়ং শিক্ষা-সংস্কৃতির (অনভিক্ষি) প্রচার করেছিলেন এবং সংগঠিত করেছিলেন সমাজের ব্রাত্যজনকে। অপর অর্থে বলা যায় তিনি অশোকের নীতি শিক্ষা এবং সমাজ বিকাশের ভাবনাকে আন্দোলন-সংগঠনের মাধ্যমে তাঁর সময়ের সমাজকে পরিবর্তন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।
১২.০৪.২০২৩
No comments:
Post a Comment