Sunday, June 2, 2024

বড়ুয়া বেকারির গড়ে ওঠার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত

 

                                                                                                                                  ভিক্ষু সুমনপাল 

১৯২৭- ২৮ সাল।  কোলকাতায় তখন গ্রেট ইস্টার্ন খ্যাতির মধ্যগগনে। চৌরঙ্গির উপর ফারপো'স সারাদিন ভাল খাবারের শেষ কথা। পার্কস্ট্রিটে মি. ফ্লুরির টি রুমে লোকের ভিড়। কেকে- পাউরুটি এতদিনে ঢুকে পড়েছে বাঙালির আনন্দমহলে, বলতে হয় চাহিদা গগনচুম্বী। ঠিক এই সময়ে মনোরঞ্জন বড়ুয়া খুললেন বেকারি, সম্ভবত প্রথম বাঙালি বেকারি।

চট্টগ্রাম থেকে আসার পর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মনোরঞ্জন বড়ুয়া পাড়ায় পাড়ায় টিনের ট্রাকে করে কেক বিক্রি করতেন। কিছুদিন পরে পয়সা জমিয়ে নিজেই খুললেন বেকারি, বৌবাজারের কাছে গোকুল বড়াল স্ট্রিট-এ। এর বছর কয়েকের মধ্যেই কেকের চাহিদা বাড়াতে প্রয়োজন হল বড় জায়গার, বড় বেকারির। নতুন বেকারি হল মৌলালির কাছে ১২৩এ ধর্মতলা স্ট্রিট-এ (এখনকার লেলিন সরণি)। প্রথমে তৈরি হত পাউরুটি, প্যাটিস আর নানারকম ফ্রুট কেক। পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি হতে লাগল বড়ুয়ার টিফিন কেক। মহামেডান স্পোর্টিং বাদে ময়দানের সব ক্লাবের ক্যান্টিনে পাওয়া যেত বড়ুয়ার কেক। এছাড়াও ছিল মিলিটারিতে আর নানা হাসপাতালে সাপ্লাই। এইসময় বড়ুয়ার কেক হয়ে ওঠে মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনের অঙ্গ। মনোরঞ্জন বড়ুয়া ১৯৮৭- তে মারা গেলেও তার ছেলেরা ও ভ্রাতুষ্পুত্ররা, নাতিরা আজও বেকারি চালিয়ে যাচ্ছেন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড়ুয়া বেকারি আজও রয়েছে বড়ুয়ার পাউরুটি ও ফ্রুট কেকের চাহিদা। বিদেশিদের আধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে আসে বড়দিন ও ক্রিসমাসের উৎসব। বিদেশিরা যেমন মেতে ওঠে বাঙালির দূর্গোৎসবে, বাঙালিরা তেমনি আপন করে নেয় বিদেশি ক্রিসমাস।

শুরু হয় হয় বাঙালির যিশুপূজো। ক্রিসমাসে সেজে উঠত কোলকাতা আর দোকানে দোকানে ভরে উঠত কেক, মাফিনের স্টক। নিউমার্কেট বা সাহেব পাড়ায় দোকান তো ছিলই, বাঙালি পাড়ায় টিনের ট্রাঙ্কে ফেরিওয়ালার মাথায় কিংবা চায়ের দোকানে  ছড়িয়ে পড়ল সাহেবের কেক। এতদিনে কেকে, মাফিন, প্যাটিস, ব্রাউনি ইত্যাদি আর পাউরুটির নেশা ধরে ফেলেছে আপামর কোলকাতাবাসী - বাঙালি অবাঙালি সবাই। ছোট ছোট অসংখ্য বেকারি গজিয়ে উঠতে লাগল চারিদিকে। বড়ুয়া, ফেরাজিনি, ফেরিনি, এরিয়ান, ফিলিপস - এর কেক ঢুকে পড় বাঙালির আনন্দমহলে।  ৬০-এর  দশকে বন্ধ হল ফারাপো' স আর ফ্লুরি'স এর হল হাতবদল।

বড়ুয়া বেকারীর কর্ণধারগণ: শ্রী হরিধন বড়ুয়া কৃষিবিদ্যাকে জীবন জীবিকার প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করে পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদার যোগান দিয়েছিলেন। বড় পরিবার বলে আশানুরূপ সুখস্বাচ্ছন্দ্য আনয়নের কষ্ট দেখে জ্যেষ্ঠ পুত্র লালন বড়ুয়ার কর্মজীবনের সন্ধানে মায়ানমার পাড়ি জমায়। সেখান থেকে তিনি পিতামাতাকে সাহায্য করতে থাকেন। দ্বিতীয় পুত্র মনোরঞ্জন বড়ুয়া পারিবারিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য জন্মভূমি ছেড়ে কোলকাতা যাত্রা করেন। কোলকাতা তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের প্রধান নগরী হিসেবে খ্যাত ছিল। বিশাল নগরীতে এসে তিনি তাঁর নিজস্ব বুদ্ধি এবং দূরদৃষ্টি দ্বারা কর্মজীবনে চাকুরীকে প্রাধান্য না দিয়ে ব্যবসা জীবনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে     'বড়ুয়া বেকারি প্রাইভেট লিমিটেড নামক' একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেন। বাঙালি বৌদ্ধ সমাজের মধ্যে এটিই সর্বপ্রথম বেকারী শিল্প। কারখানার গোড়াপত্তন হয় কোলকাতার ৭নং শাঁখারি টোলায়।  ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ধর্মতলা স্ট্রীটে (বর্তমান লেলিন সরণি) বেকারী স্থানান্তরিত করা হয়। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনোরঞ্জন বড়ুয়া বেকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পাটনায় 'বড়ুয়া ডেইরী' এবং বরাহনগরে 'বেঙ্গল কাটারী' নামক দুটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তিনিই প্রতিষ্ঠানই তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত এবং বড়ুয়া বেকারী প্রধান। তখনকার দিনে বাঙালি বৌদ্ধদের মধ্যে কয়েকটি বেকারী ছিল অবিভক্ত ভারতে এটি ছিল প্রধান। ভাল রুটি এবং কেক বলতে বড়ুয়া বেকারী'র রুটি এবং কেক বোঝাত। এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে। নির্ভেজাল ও রুচিশীল রুটি এবং কেক তৈরির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। চাহিদা বেড়ে যায়। শিল্পীর সেই গৃহকোণের কিশলয় মহীরুহে পরিণত হতে লাগল। তখন প্রয়োজন ছিল সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, বিশ্বাসী এবং সুদক্ষ পরিচালক। শ্রী মনোরঞ্জন বড়ুয়ার একার পক্ষে অতবড় বেকারীর কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভবপর হচ্ছে না দেখে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনোরঞ্জন বড়ুয়া আপন কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রিয়দর্শী বড়ুয়াকে আহ্বান জানালেন। তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার আহ্বান উপেক্ষা করতে না পেরে জন্মভূমির মায়া ছেড়ে ছুটে গেলেন বিশাল ‘বড়ুয়া বেকারী'র কর্মকাণ্ডে। প্রিয়দর্শী বড়ুয়া বেকারীর সকল কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পরিকল্পনাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন বলে তিনি তাঁর অতি প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন। কয়েক বছর পরে অন্যান্য ভ্রাতাদের মধ্যে শ্রী অবনীরঞ্জন বড়ুয়া এবং শ্রী প্রিয়ব্রত বড়ুয়াও যোগদান করেন বেকারী'র কার্যক্রমে। সেখানে নতুন প্রতিষ্ঠান করা হয় 'বড়ুয়া আর্ট প্রেস' নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। শ্রী অবনীরঞ্জন বড়ুয়া ছিলেন এর প্রধান পরিচালক। তিনি তা দেখাশুনা করতেন। সময়ে সময়ে বেকারীর কাজকর্মও দেখাশুনা করতেন। অগ্গমহাপণ্ডিত প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘প্রজ্ঞালোক প্রকাশনা'র বহু অমূল্য গ্রন্থ এই প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এদিকে তরুণ কর্মী প্রিয়ব্রত বড়ুয়া ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতা বিদ্যাসগর কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বি.এ. পাশ করে বেকারীর দায়দায়িত্বে নিজেকে উৎসর্গীকৃত করেছিলেন। যদিও তিনি সর্বকনিষ্ঠ কিন্তু এই বেকারীর সার্বিক উন্নতির পিছনে তাঁর শ্রম ও অবদান ছিল সর্বজন স্বীকৃত। তিনি যতদিন কর্মক্ষম ছিলেন তাঁর কল্যাণস্পর্শে বড়ুয়া বেকারী ধন্য হয়েছে। সকলের আগে এসে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ থেকে আরম্ভ করে উৎপাদনের কার্যক্রমের তদারক করা ছিল তাঁর দৈনন্দিন কর্মসূচি। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য শারীরিক, মানসিক সবদিক থেকে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই কর্মনিষ্ঠার কথা বেকারীর অন্যান্য পরিবারের সদস্যগণ অকপটে স্বীকার করে থাকেন। প্রিয়দর্শী বড়ুয়া হিসাবাদি দেখাশুনা করতেন, ব্যাঙ্কে দৈনিক টাকা পয়সা আনা নেওয়া তিনি করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টাকা পয়সার লেনদেন করা - প্রিয়দর্শী বড়ুয়া সেই কঠিন দায়িত্ব পালন করতেন। সংরক্ষণের ব্যাপারেও তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। অশীতিপর বয়সেও তিনি রীতিমত বেকারীতে আসা যাওয়া করতেন। বাঙালি বৌদ্ধ সমাজের তৎকালীন একমাত্র ঠিকানা ছিল বড়ুয়া বেকারী। তাঁর এই সৃষ্টির পিছনে ছিল নিরলস সাধনা ও পরিশ্রম। একজন শিল্পী তার তুলি ও রঙের সাহায্যে বহু শিল্পকর্মকে রূপ দেয়। আর বেকারীর শিল্পীরা বেকারীজাত জিনিস- কেক, পেস্ট্রি প্রভৃতিতে কি অপূর্ব রূপায়িত করতেন- তা সত্যই বিস্ময়কর। শিল্পীরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কত সুন্দর শিল্পকর্ম করতেন- কোনও কেকে দেখা যায় সাহেব-মেম নৃত্যরত, কোনটায় দেখা যায় পিয়ানো, ফুটবল মাঠ ইত্যাদি। যাঁরা একখণ্ড কেকের উপর এই সব শিল্পকর্ম করে থাকেন সত্যই শিল্পী হিসেবে নমস্য (স্মারকগ্রন্থ, কলিকাতা ২০০৫, পৃ. ১০-১১) শৈল্পিক চেতনা বড়ুয়া বেকারীকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে সক্ষম হয়েছিল যার প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ তৎকালীন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বুলগানিন বড়ুয়া বেকারীর কেক খেয়ে এতই প্রীত হয়েছিলেন যে তিনি বেকারীর কেক এর প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন। স্বাস্থ্যসম্মত রুটি এবং কেক তৈরির জন্যে উন্নত ধরনের নানারকম সরঞ্জাম তিনি Germany, Holland, England প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানী করে বেকারীকে নবরূপে সাজিয়ে তোলেন। তখন থেকে হাতে তৈরির পরিবর্তে, কাঠের আগুনে রুটি Bake করবে পরিবর্তে steam এর দ্বারা তৈরি করা হত। বেকারী শিল্পের উন্নতির জন্য তাঁদের নব নব পদক্ষেপ সত্যই প্রশংসার দাবী রাখে। যতদিন কাজ করার মতন ক্ষমতা ছিল অবনীরঞ্জন বড়ুয়া, প্রিয়দর্শী বড়ুয়া এবং প্রিয়ব্রত বড়ুয়া এই বেকারীর উন্নতির জন্যে যথেষ্ট ত্যাগ এবং পরিশ্রম করেছেন। তৎকালীন Fort William এর Colonel কিংবা Medical College এর Super তথা সরকারী বেসরকারী অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল। রোগী এবং সৈনিকদের জন্যে বেকারী থেকে রুটি বরাদ্দ ছিল। বর্তমান নিজ সন্তান এবং ভ্রাতুষ্পুত্ররা, নাতিরা বেকারীর হাল ধরে রেখেছেন। যেকোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তিন প্রজন্ম ধরে চলমান থাকলে সেটা সফল প্রতিষ্ঠান এবং কুশলী কর্ণধারগণের দূরদৃষ্টিতা অনস্বীকার্য। বাঙালি বৌদ্ধদের অনেক আশ্রয়হীন তরুণ, স্বদেশ থেকে কর্মজীবনের সন্ধানে কোলকাতা মহানগরীতে ছুটে এসেছে--সবার একমাত্র ঠিকানা এবং আশ্রয়স্থল ছিল ‘বড়ুয়া বেকারী'। অনেককে দিয়েছেন কর্মসংস্থান, অনেক জ্ঞানান্বেষী ছাত্রদেরকে দিয়েছেন উচ্চ শিক্ষার সহায়তা এবং অনেকে বেকারীতে থেকে শিল্পকর্মের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিজেরাই পরবর্তী সময়ে বিশালাকার বেকারী প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন যেমন লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ী প্রিন্স বেকারীর স্বত্বাধিকারী শ্রী অর্জুন দাশ গুপ্ত অন্যতম। শতাব্দীকাল বাঙালি বৌদ্ধদের ঐতিহ্য সুনাম এবং সুখ্যাতির অন্যতম প্রতিষ্ঠান বড়ুয়া বেকারী আরো সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাক এটাই আন্তরিক প্রত্যাশা। ভারত-বাংলায় এখনও সর্বসাধারণের সবচেয়ে পরিচিত একটি নাম ‘বড়ুয়া বেকারী'।

-
সূত্র : সরকারী আর্কাইভ ও বিভিন্ন  পত্র পত্রিকা থেকে তত্ত্ব-উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রণীত ক্ষুদ্র নিবন্ধ। 

No comments:

Post a Comment