কথামুখ
বড়ুয়া জাতির ইতিবৃত্ত, বাংলার প্রাচীন সাহিত্যে রাউল নামে একটি পুরোহিত সম্প্রদায়ের কথা জানা যায়। চাকমা বৌদ্ধ সমাজে এই সম্প্রদায় এখনো বত´মান। অপরদিকে বড়ুয়া হল আসাম প্রদেশের ব্রাহ্মণদের উপাধি। আবার সেখানে বৈদ্য বড়ুয়া ও কায়স্থ বড়ুয়াদেরও সন্ধান পাওয়া যায়। ত্রিপুরার রাজমালাতেও বড়ুয়া জাতির উল্লেখ
মেলে। বড়ুয়া জাতির উৎপত্তি সম্পকে´ বিভিন্ন মত আছে। কেউ কেউ মনে করেন বড়ুয়ারা আরাকান জাতি থেকে উৎপন্ন, তবে এই ধারণা ভ্রান্ত বলে মনে হয়। ড: বেণীমাধব বড়ুয়ার মতে বৈশালী ও মগধের ক্ষত্রিয় বৌদ্ধগণ বৃজি থেকে চট্টগ্রামে আগমন করেছিলেন এবং বজ্জি শব্দ থেকেই বড়ুয়া শব্দের উদ্ভব। কয় বড়ুয়া ও আরাকানী বৌদ্ধদের বিবাহের ফলে তারা একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। যে সমস্ত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রাণ ও মান রক্ষা জন্য মগধ ত্যাগ করে এসেছিলেন তাঁরা সঙ্গে করে কোন ধম´গ্রন্থ আনতে পারেননি। তাই তাঁরা ধমে´ সার কথা জানতেন না । তাঁদের স্মৃতির উপর ভিত্তি করেই তাঁরা ধমী´য় কাযা´দি চালাতেন এবং ধমে´র সারকথা তাঁদের জানা ছিল না। আবার সেই একই সময়ে বড়ুয়ারা দুগা´, লক্ষ্মী, শীতলা ইত্যাদি দেবদেবীদের পূজা করতে শুরু করলেন। .এইভাবে বৌদ্ধরা ক্রমশ তাদের স্বাতণ্ত্র্য হারিয়ে ফেললেন। ক্রমশ দশ´নের জটিল তত্ত্ব পরিত্যাগ করে তারা তণ্ত্রমণ্ত্রের চচা´ করতে শুরু করলেন। বিভিন্ন্ বৌদ্ধবিহার ধ্বংসের ফলে অধিকাংশ বৌদ্ধ ধম´গুরুরা হয় আত্মোপন করলেন নয়ত নিহত হলেন এবং এর ফলে কাণ্ডারিহীন বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণদের আধিপত্য স্বীকার করতে বাধ্য হল। এছাড়াও স্থানীয় বৌদ্ধদের ইসলাম ধমে´ দীক্ষিত করার পর পূব´বঙ্গের বিভিন্ন স্থানের বিহারগুলিতে বুদ্ধমূতি´ অপসারিত করে ইসলাম ধমে´র উপাসনা শুরু হয়। এরপর ভারতবষে´ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে কিছু বৌদ্ধ আথি´ক সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় খ্রীষ্টধম´গ্রহণ করে। অবশিষ্ট বৌদ্ধরা কোনক্রমে বৌদ্ধ হিসেবে তাদের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখলেন। রাউলিরাই তাদের ধম´জীবনের তত্ত্বাবধান করতেন।
এছাড়া কুমারিল ভট্ট গৌহাটিতে তাঁর অনুচরদের মাধ্যমে বেশ কিছু বৌদ্ধকে পুনরায় হিন্দুধমে´ দীক্ষিত করেন। সম্ভবত তারাই আসামী বড়ুয়া। ধম´ ও সমাজ, সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিনয়পিটক থেকে প্রমাণ
পাওয়া যায় যে মৌয´ শাসনের পূবে´
পূব´বাংলায় বৌদ্ধধমে´র অস্তিত্ব ছিল। দুজন প্রখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাং বাংলায় এসে বৌদ্ধধমে´র
অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। পরবতী´কালে যে সমস্ত রাজবংশ বৌদ্ধধমে´র পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন তাঁরা হলেন খাড়িয়া রাজন্যবগ´( খ্রীষ্টীয় সপ্তম থেকে অষ্টম শতক), পান রাজন্যবগ´ (খ্রীষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক), চন্দ্রবংশীয় রাজন্যবগ´ ( দশম থেকে একাদশ খ্রীষ্টাব্দ), দেবরাজগণ ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পট্টিকেরা শাসকগণ দশম থেকে একাদশ শতক)। খ্রীষ্টীয়
একাদশ থেকে দ্বাদশ শতকে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যধমে´র অভ্যূদয় ঘটে এবং দ্বাদশ শতকের শেষভাগে তুকী´সেনাপতি বক্তিয়ার খলজির আক্রমণে বাংলায় মুসলমান অধিকার কায়েম হয় এবং এর ফলস্বরূপ
বাংলাদেশে বৌদ্ধধমে´র পতন ঘটে যদিও বাংলার এক কোণ চট্টগ্রামে এই ধম´ টিমটিম করে জ্বলতে থাকে। পরবতী´কালে বাংলার কিছু তরুণ ভিক্ষু ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি বৌদ্ধপ্রধান দেশে গিয়ে এই ধম´ সম্বন্ধে
শিক্ষালাভ করে সেই প্রাচীন ধম´কে প্রচার ও লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন। তাঁদের প্রদশি´ত পথেই বাংলায় বৌদ্ধধম´ তার পুনরুজ্জীবিত রূপটি লাভ করেছে। এই বিষয়ে আরাকানের সংঘরাজ ভদন্ত ভদন্ত সারমেধ মহাথেরর নাম বিশেষভবে উল্লেখযোগ্য।
অন্যান্য সম্প্রদায় থেকেও বিভিন্ন মানুষ বৌদ্ধধম´ গ্রহণ করে বড়ুয়াদের সংখ্যাবৃদ্ধি করেছিল। বড়ুয়া সমাজে জাতিভেদ ও কৌলিন্যপ্রথা নেই। তবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে
স্বাতণ্ত্র্য রয়েছে। বত´মানে চট্টগ্রামের বড়ুয়ারা শিক্ষিত এবং আথি´ক দিক থেকে স্বচ্ছল। রাজনীতির আঙিনায় বড়ুয়াদের পদচারণা অপেক্ষাকৃত কম হলেও অনেকেই ইঞ্জিনিয়র ডাক্তার, অফিসার, অধ্যাপক ইত্যাদি পেশায় নিয়ুক্ত আছেন। সৈন্যবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতেও তাঁরা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন। তবে তাঁদের বৃজি থেকে চলে আসা
পূব´পুরুষদের গৌরব তাঁরা এখনো পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।
বৌদ্ধধম´ শিক্ষা:
ত্রিরত্ন কাকে বলে?
বুদ্ধ রত্ন ধম´ রত্ন আর সংঘ রত্নের সমষ্টিকে ত্রিরত্ন বলে।
বুদ্ধের নয়গুণ কি কি?
সম্যকসম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণসম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ,অতুলনীয়, শ্রেষ্ঠ সারথি, দেবতা ও মানুষের
শাস্তা বা শিক্ষক,এবং ভগবান।
ধমে´র ছয় গুণ কি কি?
১. এই ধম´ সুব্যাখাত বা সুপ্রকাশিত
২. এই ধম´ স্বয়ং দ্রষ্টব্য বা নিজে দেখার যোগ্য
৩ এই ধম´ কালাকালবিহীন। যখনই এই ধম´ পালন করা হয় তখনই
৪. এই ধম´ এসে দেখা বা নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে বিবেচনার যোগ্য
৫ এই ধম´ নিবা´ণ প্রাপক বা নিবা´ণে উপনীতকরে
৬. এই ধম´ বিদ্বানগণ কতৃ´ক প্রত্যক্ষও জ্ঞাতব্য
সংঘের নয়টি গুণ কি কি?
১. বুদ্ধের শ্রাবক সংঘ সুপথে প্রতিপন্ন
২. ঋজু আয´ অষ্টাঙ্গিক মাগে´ প্রতিপন্ন
৩. ন্যায়বা নিবা´ণ পথ প্রতিপন্ন
৪. যথাথ´
৫. উত্তম ও উপযুক্ত পথ প্রতিপন্ন
৬. ভগবানের শ্রাবক সংঘ যুগ্ম হিসাবে চারি যুগ্ম এবং
পুদ্গল হিসেবে আট আয´ পুদ্গলই চারি প্রত্যয় দান-
আহুতি লাভের যোগ্য
৭ . দূর দেশ থেকে আগত অতি আদরের কুটুম্বের মত খাদ্য ভোজ্য দ্বারা সেবার যোগ্য
৮. অঞ্জলিপুটে নতশিরে বন্দনা করবার যোগ্য।.
৯. সমস্ত দেব নরের সব´শ্রেষ্ঠ পূণ্যক্ষেত্র।
ত্রিরত্ন বন্দনা:
১. যিনি শ্রেষ্ঠ বোধিমূলে উপবিষ্ট হয়ে মহাপরাক্রমশীল
মারকে পরাজিত করে সম্বোধি লাভ করেছেন সেই অনন্তজ্ঞানী বুদ্ধকে বন্দনা করছি।
২ অষ্টাঙ্গবিশিষ্ট,আয´পথ, জনগণের মোক্ষপুরী প্রবেশের সোজা রাস্তাস্বরূপ,শান্তিকর, শ্রেষ্ঠ যে ধম´ নিবা´ণে নিয়ে যায় সেই ধম´কে বন্দনা করছি।
৩. যে বিশুদ্ধ সংঘ দান গ্রহণের উত্তম পাত্র, শান্তেন্দ্রিয়
সব´পাপমুক্ত, বহুগুণে সমন্বিত ও তৃষ্ণাক্ষয়কারী সেই সংঘকে বন্দনা করছি।
শীল
পঞ্চশীল কাকে বলে ?
ভগবান তথাগতের প্রকাশিত গৃহীদিগের নিত্যপ্রতিপাল্য পঞ্চসারনীতিকে পঞ্চশীল বলা হয়।
পঞ্চশীল প্রাথ´না কিভাবে করতে হয়?
বুদ্ধ বন্দনা করে ভিক্ষুর সামনে গিয়ে তাঁকে বন্দনা করে পঞ্চশীল প্রাথ´না করতে হয়।
পঞ্চশীল
১( আমি) প্রাণীহত্যা থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ লাভ করিতেছি।
২. অদত্ত দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ লাভ করছি।.
৩. অবৈধ কামাাচার থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ
লাভ করছি।
৪ মিথ্যাভাষণ থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ লাভ.করছি।
৫ সুরামেরেয় মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকব
এই শিক্ষাপদ লাভ করছি।
পঞ্চশীল ও অষ্টশীলের পাথ´ক্য:
পঞ্চশীলের তৃতীয় শীল-- অবৈধ কামাচার থেকে বিরত থাকব। অষ্টশীলের তৃতীয় শীল ব্রহ্মচয´ পালন করব এই শিক্ষাপদ লাভ করছি।
অষ্টশীলের অতিরিক্ত ৩ টি শীল নিম্নরূপ:
৬. বিকালে ভোজন থেকে বিরত থাকব.
৭. নৃত্যগীত, বাদ্যযণ্ত্র ,তামাশাদশ´ন ইত্যাদি থেকে বিরতি
৮. মালাগন্ধ, বিলেপন, ধারণ,মণ্ডন,বিভূষণাদি ইত্যাদি
থেকে বিরতি
দশশীলের অতিরক্ত দুটি শীল নিম্নরূপ:
৯. উচ্চাসন,মহাশয়ন থেকে বিরতি
১০. স্বণ´ রৌপাদি গ্রহণ থেকে বিরতি
বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের পাথ´ক্য:
বুদ্ধ হলেন সব´জ্ঞ, সব´দশী´, জন্ম মৃত্যুর উদ্ঘাটক, এবং সব´তৃষ্ণা ক্ষয়কারী অহ´ৎ।
বোধিসত্ত্ব হলেন ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবার একান্ত বাসনায় জন্ম জন্মান্তরের সাধনা ও সুষ্ঠু কম´ নিয়ণ্ত্রণের উৎকৃষ্ট পন্থা অবলম্বনকারী।
কম´বাদ কাকে বলে?
কম´ই হল বৌদ্ধধমে´র মূল ভিত্তি। যে যেমন কম´ করবে তাকে তেমন ফল ভোগ করতে হবে। এটিই হল কম´বাদ।
চতুরায´সত্য:
চারটি আয´সত্য হল (১) দু:খ আয´সত্য (২) দু:খ সমুদয় আয´সত্য (৩) দু:খ নিরোধ আয´সত্য (৪) দু:খ
নিরোধের উপায় আয´সত্য।
আয´ অষ্টাঙ্গিক মাগ´ বলতে কি বোঝায়?
আয´ অষ্টাঙ্গিক মাগ´ হল দু:খ মুক্তির উপায়। এগুলির
মধ্যে রয়েছে সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক আজীব, সম্যক বাক্য, সম্যক কম্মা´ন্ত, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি।.
নিবা´ণ কাকে বলে?
বৌদ্ধ ধমে´র চরম লক্ষ্য নিবা´ণ। নিবা´ণ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অথ´ হল নিবা´পিত হওয়া। যে ধম´ প্রত্যক্ষ করলে মানুষের স্বকীয় তৃষ্ণা বন্ধন একেবারে
ছিন্ন হয় তাকে নিবা´ণ বলে।
উপোসথ শব্দের অথ´ কি?
পব´দিন অথা´ৎ অমাবস্যা, পূণি´মা ও অষ্টমী তিথিতে উপোসথ গ্রহণ বৌদ্ধদের একটা প্রচলিত নীতি।
,,,,,,
,,,,,,,,
সুমনপাল ভিক্ষু
বিদর্শন শিক্ষা কেন্দ্র
কোলকাতা
No comments:
Post a Comment