সুমনপাল ভিক্ষু
Sunday, June 2, 2024
ধম্মাশোকানুস্মৃতি (মহামতি অশোকের প্রতিফলিত স্মরণ)
একটি সত্যবাদিতার প্রতিভাস সম্পর্কে আমার অন্তিম বাণীl
মাষ্টার শিং য়ুন
ফো-কুয়াং শান মোনাষ্ট্রি
অনুবাদ: সুমনপাল ভিক্ষু
আমি আমার দেহ ও মনকে উৎসর্গ করেছি বৌদ্ধধর্মের জন্য এবং আমার জীবনের পরিস্থিতি অনুযায়ী জীবনযাপন করেছি। প্রিয় ধর্মরক্ষক, বন্ধু ও শিষ্যগণ আমি আপনাদের সকলের কাছে একটি সৎ উন্মোচন করতে চলেছি। আমার সমস্ত জীবনে অনেকে আমাকে ধনী মনে করেছে, কিন্তু সত্যি কথা হল দরিদ্র থাকাটা সবসময় আমার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল। আমি একটি দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছি, কিন্তু কখনই নিজেকে দরিদ্র বলে মনে করিনি কারণ আমি অন্তরে সবসময়ই নিজেকে ধনী বলে মনে করেছি। আমি বয়স্ক হয়ে যাওয়ার পরও অনেকে আমাকে ধনী বলে, কারণ তাদের বিশ্বাস আমি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রকাশনা সংস্থা ইত্যাদির মালিক। তবে আমি কখনও মনে করিনি যে আমি কোন কিছুর মালিক, কারণ সেগুলি সাধারণ মানুষের, আমার নয়। যদিও আমি এই পৃথিবীতে অনেক বিহার নির্মাণ করেছি, এই ভবনগুলি এমনকি এগুলির কোন আসবাবও আমার নয়। আমার মাথার উপর একটি টালি বা আমার পায়ের তলায় আবর্জনার একটি ছোট ঢিবিও আমার নয়। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত কিছুই সমস্ত পৃথিবীর, তাই সেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকে কেমন করে? তবু, আমার মনে মনে আমি অনুভব করি যে সমস্ত পৃথিবীটাই আমার। আমার কখনও নিজস্ব দেরাজ বা ডেস্ক ছিল না। যদিও আমার শিষ্যরা আমার জন্য এগুলি তৈরী করে দিয়েছে, আমি কখনও এগুলি ব্যবহার করিনি। আমার জীবনে আমি খুব কম দোকানে কেনাকাটা করতে গিয়েছি, আমার কখনও কোন সঞ্চয় ছিল না। আমার যা কিছু আছে তার সবই সাধারণ মানুষের ফো-কুয়াং শান সংঘের বা বিহারের। একইভাবে আমার সমস্ত শিষ্যের উচিত একই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বৌদ্ধধর্মকে তাদের শরীর ও দান করা এবং নিজের জীবনের পরিস্থিতি অনুযায়ী জীবনযাপন করা।
আমার সমস্ত জীবনে অনেক মানুষ আমাকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে ভেবেছি যে সভা সমিতি আয়োজন অত্যন্ত একা কারণ এমন কেউ নেই যাকে আমি আমিত্বের অনুপস্থিতি—একজন অবনমিত ভিক্ষুর উপদেশবাণী আমার সবচেয়ে প্রিয় বা সবচেয়ে অগ্রিম ব্যক্তি বলে মনে করি। অন্য অনেকে ভাবতে পারে আমার অনেক শিষ্য ও ভক্ত রয়েছে, কিন্তু আমি কখনই তাদের আমার নিজের বলে মনে করিনি, কারণ তাদের জন্য আমার ইচ্ছা শুধুমাত্র এই যে তারা বৌদ্ধধর্মে তাদের নিজেদের খুঁজে পাক। আপনাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার মত আমার কোন সম্পত্তি যেমন অর্থ জমি ইত্যাদি নেই। যদি আপনি কিছু চান তাহলে স্মৃতি হিসেবে আমার অনেকগুলি বইয়ের একটি রেখে দিন। যদি আপনি কিছুই না চান তাহলে আমার উপদেশ বাকা আপনার কোন কাজে লাগবে না। আমার দেওয়ার মত কিছু যা কিছু রয়েছে তা হল মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম যার থেকে আপনি শিখতে পারবেন এবং বিহার যাকে আপনি সাহায্য করতে পারবেন। আমি কাউকে অনুগ্রহ করি না। সংঘের একটি ব্যবস্থা এবং পদমর্যাদা নির্ধারণের একটি পদ্ধতি রয়েছে। তবুও নিরপেক্ষতা রক্ষা করা সহজ নয়। পদোন্নতি নির্ভর করে একটি বিশেষ পদে একজনের কাজকর্ম, তার শিক্ষা, আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং সাফল্যের উপর এবং এগুলির ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে পার্থক্য হয়। সাফল্য, পদমর্যাদা এবং স্বীকৃতি সমস্ত কিছু একজন ব্যক্তির নিজস্ব সদগুণের উপর নির্ভর করে অতএব ব্যক্তিগতভাবে আমি একথা বলতে পারি না যে কোন ব্যক্তিবিশেষের পদোন্নতি হওয়া উচিত কি উচিত নয়। আমি আমার শিষ্যদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি এই কারণে যে আমি তাদের কারও সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে প্রশংসা করে তাদের খুশি করতে পারি না। তবে এটিকে তারা নিরপেক্ষতার একটি শিক্ষা বলে মনে। করতে পারে। পরিচালন সমিতির আপনার পদোন্নতি বা পদাবনতি নির্ধারণের অধিকার রয়েছে, এবং একজন ভিক্ষু হিসেবে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে আপনার সাফল্য নির্ধারিত হবে ধর্মের মাপকাঠিতে। এক্ষেত্রে কোন পার্থিব নিয়ম আপনার মূল্যায়ন করতে পারবে না। ভবিষ্যতের যা নিয়ে আমি চিন্তিত তা হল আমার শিষ্যদের কর্মের স্থানান্তরণ। যদিও ফো-কুয়াং শান কোন সরকার নয় তা সত্ত্বেও এতে অসংখ্য বিভাগ ও কর্ম স্থানান্তরণ ব্যবস্থা রয়েছে। সংঘের পরিচালন ব্যবস্থা প্রতিটি পদে উপযুক্ত ব্যক্তিকে বসাতে চেষ্টা করবে। যে পদে কোন ব্যক্তিকে বসান হবে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আগ্রহ বা ধারণার কোন পার্থক্য হলে তাকে সমাধান করতে হবে। এই পৃথিবীতে সমতাকে মাপা খুব কঠিন, তাই কেমন করে আমরা শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবনযাপন করতে পারব তা নির্ধারিত হয় সমতার সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের সংজ্ঞার দ্বারা।
আমার সমস্ত জীবনে অনেক ভেবেছে যে আমি এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে তুলতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল এই যে বিষয়টি আমার পক্ষে অত্যন্ত সহজ সরল ছিল কারণ সমবেত প্রচেষ্টায় আমি দলের অংশ ছিলাম মাত্র। আমি এই লক্ষ্য পূরণের সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছি এবং বাকীটা রেখে দিয়েছি বাহ্যিক পরিস্থিতির জন্য। অনেকে মনে করে আমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ; কিন্তু প্রকৃত সত্য হল এই যে আমি শুধুমাত্র বিশ্বাস করি নিয়ন্ত্রণে কোন চেষ্টা না করাতে। আমি সকলকে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ জানাই কারণ শীল ও নিয়ম ছাড়া আমাদের অপরকে শৃঙ্খলা শিক্ষা দেওয়ার কোন অধিকার নেই। এই পৃথিবীতে কোন কিছুকে আসতে দেখে আনন্দিত হবার বা কোন কিছুকে চলে যেতে দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই। কোন না কোনভাবে আমাদের সকলের মুক্ত হওয়ার অধিকার আছে এবং সহজ হওয়ার অধিকার আছে যখন আমরা পরিস্থিতি অনুযায়ী চলি। ধর্মের পথকে অনুসরণ করে চললে আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হব। আমার সমস্ত জীবনে আমি দানের দর্শনকে অনুসরণ করেছি। আমি সবসময় অপরের প্রশংসা করেছি, তাদের ইচ্ছাকে পূর্ণ করেছি। এর গুরুত্ব সম্পর্কে পরিপূর্ণ সচেতন থেকে আমি যেখানেই যাই সেখানেই ধর্মের বীজ ছড়ানোর চেষ্টা করি। এই কারণে Buddha Light-এর সদস্যদের জীবনের মূলমন্ত্র আমি প্রতিষ্ঠা করেছি : 'অপরকে বিশ্বাস জোগাও, আনন্দ দাও, আশা দাও এবং সুবিধা দাও।” আমার অনেকগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পিছনে উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করেছে আমার কখনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পাওয়া। এর ফলে আমি বুঝতে পেরেছি শুধুমাত্র শিক্ষাই আত্মবিকাশ ও চরিত্রের পরিবর্তনে সাহায্য করতে পারে। আমি লেখালিখিতেও সময় দিয়েছি কারণ বুদ্ধের কাছ থেকে ধর্মের যে ধারা আমি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছি তা যেন আত্মার নিজের হৃদয় থেকে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তেই থাকে। আমার সমস্ত জীবন আমি নিম্নলিখিত নীতিগুলি মেনে চলেছি “এগিয়ে যাওয়ার জন্য পিছিয়ে যাওয়া জনতাকে নিজের মত মনে করা; কিছু পাওয়ার জন্য কিছু না থাকা; শূন্যতার মধ্যে আনন্দলাভ করা। আমার সমস্ত সন্ন্যাসী শিষ্যের উচিত সমস্ত কিছুকে অতিক্রম করে যাওয়ার মন নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, এবং অতিক্রম করে যাওয়ার মানসিকতা নিয়ে পার্থিব কাজকর্ম অংশগ্রহণ করা।” এছাড়াও তার মিতব্যয়ীতার মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাবে এবং কোন পার্থিব সম্পদ সঞ্চয় করবে না। বুদ্ধের সময় থেকে চলে আসা কেবল তিন পোশাক ও একটি পাত্র রাখার নিয়ম এবং একজন ব্রহ্মচর্য অনুশীলনকারীর মাত্র আঠেরোটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি আমিত্বের অনুপস্থিতি—–—একজন অবনমিত ভিক্ষুর উপদেশবাণী রাখার নিয়ম শুধুমাত্র যে বিনয় অনুসারী তাই নয়, এগুলি সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবা উচিত এবং মনে রাখা উচিত। ফো-কুয়াং শানের শিষ্যরা কখনও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে তহবিল সংগ্রহ করবে না, সঞ্চয় করবে না, বিহার নির্মাণ করবে না বা ভক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। যদি সকলে এই নিয়ম মেনে চলে তাহলে ফো-কুয়াং শান পরম্পরায় গৌরব অন্তহীন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।
সকলকে “গৌরব যুদ্ধের, সাফল্য সমাজের, সুফল বিহারের এবং পুণ্য ভক্তের এই কথাটি মেনে চলা উচিত। একজনের অবশ্যই জানা উচিত ‘বুদ্ধের পথ বিশাল শূন্যতাকে পূরণ করে; এই সত্যটি ধর্ম জগতের সর্বত্র উপস্থিত থাকে।” এই ধর্ম জগতের সমস্ত কিছু আমার; কিন্তু অস্থায়ীত্বের ঘটনা আমাকে বলে কোন কিছুই আমার নয়। পার্থিব বিষয়ে অতিরিক্ত আসক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই, মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের অনুশীলনকারীকে অবশ্যই পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে, কিন্তু ফুল ও পাখিদের উপর নজর রাখা একজন কাকতাড়ুয়ার মত আমাদের খুব বেশি উদ্যোগী হওয়া উচিত নয়। আমার সমস্ত শিষ্যদের ধর্ম ছাড়া আর আর কিছু থাকা উচিত নয়। সমস্ত কিছু যেমন অর্থ এবং পার্থিব জিনিসপত্র যখনই সম্ভব হবে তখনই দান করে দেওয়া কারণ তারা হল সেই সম্পদ যার মালিক হল এই পৃথিবী। বিহারের সমস্ত সম্পত্তি জনগণের সমস্ত হওয়া উচিত কারণ আমাদের যা কিছু আছে বিহার তার সবগুলিই সরবরাহ করে। অতএব সেগুলি নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকা বা তর্ক করার কোন প্রয়োজন নেই। যতদিন আমরা একটি ন্যায়সঙ্গত বিশ্বাসকে প্রচার করছি ততদিন আমাদের মূল প্রয়োজনগুলি নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। এছাড়া আমার ইচ্ছা এই যে আমার শিষ্যরা যেন দৈনন্দিন প্রয়োজনের সমস্যাগুলি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত না হয় কারণ এগুলি তুচ্ছ বিষয়। আমি বিশ্বাস করি বিহার তার সমস্তbউপার্জনকে সৎ কাজে ব্যয় করবে। কোন অর্থ না রাখাই হল ফো-কুয়াং শানের শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
বিহারের দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়াও যে কোন অর্থ সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক, বা দাতব্য প্রচেষ্টায় ব্যয় করা উচিত। ফো-কুয়াং শান সকলের কাছ থেকে অর্থ পায়, সেই জন্য তার উচিত সকলকে অর্থ দান করা, আমাদের অবশ্যই জরুরী ভিত্তিক ত্রাণ, নিঃসহায় মানুষদের যত্ন, এবং দরিদ্রদের দান করতে হবে। বিপর্যয় ও দুর্ভাগ্য এই দুটি পৃথিবীর দুর্ভাগ্য, তাই আমাদের ত্রাণকার্যে অবদান রাখা উচিত। ফো-কুয়াং শান, বুদ্ধ মেমোরিয়াল সেন্টার এবং সমস্ত পাখা বিহারের জমি রাষ্ট্রের অধিকারে নয় বা লিজ নেওয়া নয়। এই সমস্ত জমি কেনা হয়েছিল ভক্তদের দেওয়া দানের অর্থ দিয়ে। একমাত্র তাই-চুং-এর ন্যাশনাল ব্রডকাস্ট নেটওয়ার্ক ছাড়া এই সমস্ত সম্পত্তির মালিক হল ফৌ-কুয়াং শানের ভিক্ষু ও গৃহী ভক্ত সম্প্রদায়। এই সম্পত্তির কোনটিই যৌথ মালিকানার অধীনে বা অন্য কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়। ফো-কুয়াং শানের প্রতিষ্ঠার পর থেকে জমি কেনা বা গৃহ নির্মাণের জন্য কোন অর্থ ঋণ করা হয়নি।
ভক্তদের আরও ভাল পরিবেশ দেওয়ার জন্য শাখা বিহারগুলিকে সাহায্য করতে হবে এবং সেগুলিকে সংস্কার করতে হবে। যদি কোন একটি শাখা চালান কঠিন হয়ে পড়ে তাহলে স্থানীয় ভক্তদের সম্পত্তি নিয়ে সেটিকে বন্ধ করে দিতে হবে এবং সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক, শিক্ষামূলক এবং দাতব্য কাজকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে। কোন কিছুকেই ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অন্য কোন বৌদ্ধ সংগঠন বা কোন ব্যক্তির সঙ্গে কখনই কোন এড়িয়ে চলার জন্য কোন ঋণ নেওয়া যাবে না। আমি আমার সমস্ত জীবন বুদ্ধকে উৎসর্গ করেছি এবং তাঁকে আমার শিক্ষক ও বৌদ্ধধর্মকে আমার পথ হিসেবে গ্রহণ করেছি। অতএব আমাদের ভবিষ্যতের অনুশীলনে আমাদের উচিত বুদ্ধ ও তাঁর দশ শিষ্যকে আদর্শ হিসেবে এবং অন্যান্য বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা। বৌদ্ধধর্ম প্রচারে সমস্ত পৃথিবীর শাখা বিহারগুলির উচিত স্থানীয়করণের জন্য চেষ্টা করে স্থানীয় ব্যক্তিদের বিহার হিসেবে নিয়োগ করা। মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে আমার সমস্ত শিক্ষাই প্রতিটি পরিবার ও সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিত আমার সমস্ত জীবন আমি মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে চেষ্টা করেছি। যা কিছু বুদ্ধ স্বয়ং শিখিয়েছেন, তা মানুষের প্রয়োজন, তা বিশুদ্ধ, তা পূর্ণশীল ও সুন্দর, যে কোন শিক্ষা যা মানবতা সুখকে বৃদ্ধি করে তাকে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম বলে মনে করা হয়। এছাড়াও আমাদের দুঃখকে সেই শর্ত হিসেবে মনে করা উচিত যা আমাদের শক্তিশালী করে। ক্ষণস্থায়ীত্বের অর্থ হল এই যে কোনকিছুই স্থির নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎকে পরিবর্তন করতে পারে এবং জীবনকে উন্নত করতে পারে। শূন্যতার অর্থ ‘নাস্তিত্ব’ নয়, বরং এটি অস্তিত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। একমাত্র শূন্যতা থাকলে তবেই অস্তিত্ব থাকতে পারে। আমার নিজের জীবনে আমি কখনও কোন কিছুর মালিক ছিলাম না; এটি কি প্রকৃত শূন্যতা থেকে জেগে ওঠা বিস্ময়কর অস্তিত্বের ধারণা নয়? আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা মানুষের জন্য ভবিষ্যতে দিক নির্দেশকারী আলোকরশ্মি হতে চলেছে। ভাল কথা বলা সত্যবাদিতা, ভাল কাজ করা পুণ্যশীল, ভাল চিন্তা করা সুন্দর। ভালত্বের তিনটি কাজ করার মাধ্যমে আমাদের অতি অবশ্যই সত্য, সত্য ও সুন্দরকে আমাদের সমাজের গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ দিতে হবে। জ্ঞান হল প্রজ্ঞা, উদারতা হল করুণা এবং সাহস হল বোধিজ্ঞান। আমাদের অতি অবশ্যই এগুলিকে অর্জনের জন্য চেষ্টা করতে হবে যাতে করে আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য বোধিসত্ত্ব পথ অনুশীলন করে নৈতিকথা, মনঃসংযোগ এবং প্রজ্ঞাযুক্ত একটি মনের বিকাশ ঘটাতে পারি।
মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের বুদ্ধের থেকে উৎপন্ন হয়ে বর্তমানে বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। তবে, মতভেদের উপর গুরুত্ব দেওয়ার ফলে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে স্থবিরবাদ ও মহাসাংঘিক সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছে এবং পরবর্তীকালে চীনদেশে আটটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছে। এগুলির মধ্যে দর্শন ও আচার অনুষ্ঠানের পার্থক্য বোধগম্য, কিন্তু আমরা যদি কে ভুল কে ঠিক তা নিয়ে চিন্তা করি তাহলে আমরা বুদ্ধের মন থেকে আরও দূরে সরে যাব। এই কারণে ফো-কুয়াং শান ও বুদ্ধাস লাইট ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের বিকাশ নিঃসন্দেহে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সমন্বয়কারী বৌদ্ধ সংগঠনগুলির অন্যতম হবে। যদি আমাদের মধ্যে কেউ ফো-কুয়াং শানের ভিক্ষু ও গৃহী সম্প্রদায়ের সম্ভাবনা রক্ষায় আগ্রহী হন তাহলে তিনি একটি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রাচীন ভিক্ষুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পাবেন। যাই হোক একটি নতুন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে পরবর্তী প্রজন্মের প্রচেষ্টা ও অর্জিত সাফল্যের উপর। যারা মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের প্রচেষ্টার সঙ্গে চোখে চোখ মেলাতে পারেন না। তাঁদের জন্য এই প্রবাদটি উদ্ধৃত করতে পারি, যদি কেউ ইতিমধ্যেই আত্মার প্রতি আসক্তিকে দূর করতে পারে; ধর্মের প্রতি আসক্তিকে দূর করা কঠিন। যদি কেউ তাদের নিজেদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমাদের খোলা মনে। সেই শাখাটিকে ফো-কুয়াং শান পরিবারের অংশরূপে গ্রহণ করতে হবে। যতক্ষণ না সেই প্রতিষ্ঠানটি ফো-কুয়াং শানের বিরোধী কোন কাজ করছে বা তাকে বিকৃত করছে ততক্ষণ সেটিকে আমাদের সহ্য করতেই হবে। আমাদের লক্ষ্য আমাদের ব্যক্তিগত সাফল্যের উপর নিবদ্ধ নয়, বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উপর নিবদ্ধ। বুদ্ধের আলোর মহান পথে ভিক্ষু ও গৃহী সম্প্রদায়ের চারটি সভার ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত ভূমিকা রয়েছে।
ফো-কুয়াং শানের ভিক্ষু, ভিক্ষুণীদের বৌদ্ধধর্ম প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত, এবং BLIA-এর উপাসক-উপাসিকাদের উচিত তাদের ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা। আমাদের শক্তি, সাধারণ বোধ এবং সম্ভাবনাকে একত্রিত করে আমরা সমবেতভাবে BLIA-কে এগিয়ে নিয়ে যাব, যাতে করে বুদ্ধের আলো সর্বত্র ঝলমল করে এবং ধর্মের প্রবাহ বইতেই থাকে। BLIA-এর সদস্যদের এমন একটি জীবিকা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করতে হবে যা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমাদের উচিত পরস্পরকে সাহায্য করা যাতে আমরা একত্রে উন্নতি করতে পারি।
যদিও BLIA ফো-কুয়াং শানের সংঘের অধীনস্থ একটি সংস্থা, ভিক্ষু ও গৃহী ব্যক্তি উভয়ই কোনরকম বিতর্ক বা দ্বন্দ্ব ছাড়াই মিলেমিশে থাকতে পারে ঠিক যেভাবে অস্তিত্ব ও শূন্যতা একই মুদ্রার দুটি পিঠ। ফো-কুয়াং শানে ইতিমধ্যেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে; অতএব ফো-কুয়াং শান ও BLIA-এর নেতাদের একমত হয়ে স্বীকৃত মাপকাঠিকে মেনে চলতে হবে এবং জনমতের কথাও মনে রাখতে হবে। সাম্যের একজন প্রবক্তা হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে নারী পুরুষ, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই সমান। সমস্ত জীবিত প্রাণীর মধ্যে বুদ্ধ প্রকৃতি রয়েছে এবং তারা সকলেই নির্বাক লাভ করতে পারে। অতএব আমি ‘মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাও ‘জীবনের প্রতি অধিকার’ এই বিশ্বাসের মাধ্যমে ‘সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে সমতা’ ও এই মন্ত্রকে কার্যে পরিণত করতে আশা করি। ফো-কুয়াং শানে আমাদের প্রতিটি গাছ ও ফুলকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে হয়, প্রতিবেশীদের যত্ন করতে হয়, শিশু আবাসে তরুণদের উৎসাহ দিতে হয়, বৃদ্ধাবাসে বয়স্কদের জন্য দুশ্চিন্তা প্রকাশ করতে হয় এবং সংঘ সম্প্রদায়ে বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হয়। আমি আশা করি যে, আমি মানবতার জন্য উত্তম কারণ ও শর্ত, আমার অনুগামীদের জন্য ধর্মের আবেগ, নিজের জন্য বিশ্বাসের বীজ এবং বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জন্য অতুলনীয় গৌরব রেখে যাব। সমস্ত পৃথিবী কার্য কারণ নিয়ম শর্ত, ফল ইত্যাদিতে বিশ্বাস করুক। আমি আশা করি যে প্রত্যেক করুণা, দয়া, আনন্দ ও ক্ষান্তি অনুশীলন করবে এবং পৃথিবীর জন্য তাদের শুভকামনা রেখে যাবে। মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, টেলিভিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্র প্রকাশনা, প্রকাশনা সংস্থা, মেঘ ও জল ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার, বৃদ্ধাবাস, শিশু আবাস এবং সমাজের মঙ্গলের জন্য সেবা ইত্যাদিকে অবিরাম সাহায্য করে যেতেই হবে। ওয়াটার ড্রপ ট্রি হাউসগুলিকে ‘এক বিন্দু জলের জন্য কৃতজ্ঞতা’র ধারণাকে আরও বেশি করে গুরুত্ব দিতে হবে। যদি আমাদের সুযোগ হয় আমাদের ফো-কুয়াং শানের ভূতপূর্ব বিহার দর্শন করতে হবে যেটি হল চীনদেশের যি-শিং-এর তা-জুয়ে বিহার। আমি সর্বদা সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক এবং সেবামূলক কাজকর্মের সম্মান করে এসেছি; অতএব আমি সম্মানীয় মাস্টার শিঙ য়ুন পাব্লিক এডুকেশন ট্রাস্ট ফাণ্ড স্থাপন করেছি যা এখনও পর্যন্ত একশ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থসংগ্রহ করেছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ভক্তের অর্থ সাহায্য ছাড়া এর বেশিরভাগ তহবিলই এসেছে আমার ক্যালিগ্র্যাফি এবং আমার বই থেকে প্রাপ্ত রয়্যালিটি থেকে। ভবিষ্যতে এই প্রচেষ্টাগুলি সহায়তা লাভ করতে পারে ফো-কুয়াং শানের প্রবীনদের কাছ থেকে এবং সেই সমস্ত বৌদ্ধদের কাছ থেকে যাঁরা তাঁদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থকে ট্রাস্টের ফাণ্ডে জমা রাখবেন এবং সমাজের মঙ্গল ও দেশের উন্নতিতে সুদৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। পুরস্কার, যেমন সত্যবাদিতা, ধার্মিকতা ও সুন্দর মিডিয়া পুরস্কার, Three Acts of Goodness Schools Global Chinese Literature Award, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে যতক্ষণ তহবিলে অর্থ থাকবে। সমাজের প্রগতিতে সাহায্য করা প্রতিটি বৌদ্ধের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হওয়া উচিত। শিক্ষার ক্ষেত্রে বিহারের অর্থের সবচেয়ে বেশী অংশে ব্যয় করা হয় অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে। যতদিন সঠিক পরিস্থিতি বর্তমান রয়েছে সেই সমস্ত বিদ্যালয়ের পরিচালন ব্যবস্থা যতদিন তাদের কেনা বা বিক্রি নাbহয় সেই সমস্ত ব্যক্তির শর্তহীনভাবে তুলে দেওয়া যেতে পারে, যাদের এই বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। যদি বিদ্যালয়গুলি বিক্রি হয়ে যায় তাহলে তহবিল সংগ্রহে যাঁরা অবদান রেখেছিলেন তাঁদের কাছে আমরা কী জবাবদিহি করব? এটি ফো-কুয়াং শানের সুনামের পক্ষে উপকারী হবে না এবং এর ফলে আমাদের জনগণের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে। যে কোন গোষ্ঠী যা ফো-কুয়াং শানের সাংস্কৃতিকখ ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখে তাকে তার ব্যয় করা অর্থ শোধ করে দিতে হবে, যাতে করে যাদের উদ্দীপনা ও উৎসাহ রয়েছে তারা আরও ঘনিষ্ঠভাবে একত্রিত হতে পারে গঠনমূলক মন্তব্য এমনকি সমালোচনাকেও বাতিল করা উচিত নয়, আমাদের ‘নিজেদের ভুল ধরিয়ে দিলে আনন্দ পাওয়া’র মত উদার হতে হবে। আমাদের সকলের মতামতকে স্বীকার করতে হবে যাতে করে তা আরও বেশি করে আমাদের সমর্থন করে। প্রায়শই আমি ভিক্ষু শিষ্যদের আগাছা নির্মূল করতে ও ফুল ছাঁটতে দেখেছি। আমি আরও দেখেছি পরিবেশ যত্ন বিভাগের সহ অনুশীলনকারীরা বিভিন্ন বস্তুরbপুনঃব্যবহার করছে, নির্মাণ বিভাগ মেরামত এবং তত্ত্বাবধানের কাজ করছে, স্বদেশ ও বিদেশের কর্মসমিতি তাদের কাজ করে চলেছে, বিহারের কর্মচারী ও তার প্রধান বিহার দেখাশোনা করে চলেছে। তাদের প্রচেষ্টা ও দায়িত্ব গ্রহণের ইচ্ছা ফো-কুয়াং শানের সাফল্যের অন্তরালের প্রকৃত শক্তি; আমি এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি এবং এর জন্য সাধুবাদ জানিয়েছি। কারও শপথ ছাড়া ফো-কুয়াং শান আজকে যেখানে আছে সেখানে কেমনভাবে পৌঁছত? আজকে থেকে অতিথি আপ্যায়ন, ভক্তদের যত্ন, এবং স্বেচ্ছাসেবকদের যোগদান ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত যাতে করে আমাদের ধর্মীয় সংগঠনটি আরও সম্পূর্ণ হতে পারে। অতএব আমার সারা জীবনের আকাঙ্ক্ষা এই যে সকলের সকলে মিলেমিশে কাজ করার মানসিকতা জয়ী হোক এবং বজায় থাকুক কোনরকম অভিযোগ বা আপশোস ছাড়াই। যেহেতু কেউই একা একা বাঁচতে পারে না, সকলের উচিত একে অপরকে শ্রদ্ধা ও সাহায্য করা যাতে করে সকলে সহাবস্থান ও উন্নতি করতে পারে। একমাত্র তখনই একজন বুদ্ধের শিক্ষার মূল কথাটি বুঝতে পারবে। বিহার বা জনগণের ক্ষতি হবার সুযোগ না দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে ত্যাগ করে সহিষ্ণু হওয়াই শ্রেয়। আমার নিজের শহরের পূর্বসূরীদের একজন তাং রাজবংশের মাস্টার চিয়ানজেনকে সংস্কৃতি প্রচারের জন্য অনেক কষ্ট করে জাপানে যেতে হয়েছিল। তাঁর গ্রামে ফিরে যাওয়ার আর কোন সম্ভাবনা ছিল না। তিনি নিম্নলিখিত গাথাটি লিখেছিলেন, “পর্বত, নদী, বিদেশ পার হয়ে; একই সূর্য, চাঁদ ও আকাশের নীচেbসমস্ত স্থানে। আমি বুদ্ধের সমস্ত সন্তানের উপর এই আশা রাখছি যে তারা একত্রে সাদৃশ্য তৈরী করবে। জীবনের প্রবাহ একটি নদীর মত যা কখনও ফিরে আসে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন ফিরেই আসতে হবে, যেহেতু একটি জীবনের শেষ অপর একটি জীবনের শুরুকে চিহ্নিত করে।”কোন মানুষেই দ্বীপ নয়; বাঁচবার জন্য আমাদের বিভিন্ন মানুষ যেমন পণ্ডিত, কৃষক, শিল্পী, বণিক এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তু যেমন সূর্য, চাঁদ, তারা, নক্ষত্র, পৃথিবী, জল, আগুন ও বাতাস ইত্যাদির সাহায্য প্রয়োজন। প্রকৃতির সমস্ত কিছু যেমন সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, পর্বত, নদী এবং পৃথিবী সকলেই আমাদের জীবনের অংশ। অতএব আমরা সেই পৃথিবীকে মর্যাদা দেব যাকে আমাদের বাড়ি বলি এবং এই গ্রহের সমস্ত প্রাণীকে সাহায্য করব হাতে করে আমরা সেই সমস্ত উপকার ও সুবিধার দয়ার প্রতিদান দিতে পারি যা আমরা পূর্বে লাভ করেছি। আমরা প্রত্যেকেই এই পৃথিবীতে এসেছি শূন্য হাতে এবং পৃথিবী ত্যাগ করেও যাব শূন্য হাতে। আমি আপনাকে একথা বলতে পারব না যে আমি এই পৃথিবীতে কী নিয়ে এসেছি। কিন্তু আমি আমার সঙ্গে আনন্দ নিয়ে যাব। আমি কখনই ভুলে যাব না সেই সমস্ত ভক্তদের যাঁরা খুশি হয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন; এবং সেই সমস্ত সহ অনুশীলনকারীদেরও মনে রাখব যাঁরা আমাকে আশীর্বাদ করেছেন।
আমি কখনই ভুলব না সেই সমস্ত পরিস্থিতিগুলিকে যেগুলি আমাকে সাহায্য করেছে কারণ এগুলি আমার হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করেছে। বুদ্ধের আশীর্বাদ এবং এই জীবনে পাওয়া বন্ধুত্বগুলি সত্যিই অসাধারণ; আমি অনুভব করি এই পৃথিবীতে আমার জীবন অত্যন্ত মূল্যবানভাবে অতিবাহিত হয়েছে। আমি শপথ করছি যে আমি জীবনের পর জীবন বুদ্ধকে উৎসর্গ করব এবং চার প্রকার কৃতজ্ঞতার প্রতিদান দিয়ে সমস্ত প্রাণীর সেবা করব। এই জীবনের পরিসমাপ্তি সম্পর্কে বলতে পারি যে কোন নিদর্শন থাকবে না এবং সমস্ত অপ্রয়োজনীয় ও জাঁকজমকপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা বাতিল হয়ে যাবে। শুধুমাত্র কয়েকটি সরল কথা লেখা বা যাঁরা আমার অভাব অনুভব করছেন পার্থিব জীবনের শব্দ থেকে বেছে নেওয়া বৌদ্ধ সঙ্গীত গাইতে পারেন। তবে আমার মতে আমাকে মনে রাখার সবচেয়ে ভাল উপায় যেটি আমার আন্তরিক ইচ্ছাও বটে সরল মনে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের শিক্ষাকে ধারণ করে রাখা এবং সর্বদাই সেগুলিকে অনুশীলন করা। ভক্তদের শান্তি ও সুখ ছাড়াও শেষে আমি যাদের জন্য চিন্তিত তারা হলেন মঠের সকলে—বিশেষত বৌদ্ধ কলেজের ছাত্র ও শিক্ষক সকলে যেহেতু তাঁরা হলেন ফো-কুয়াং শানের ভবিষ্যৎ বোধি বীজ, তাই তাঁদের অবশ্যই শক্তিশালী ও ইচ্ছুক হতে হবে যাতে করে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম ততদিন স্থায়ী হতে পারে যতদিন পৃথিবী স্থায়ী হবে এবং সর্বদা আমাদের একটি অংশ হতে পারে। ধর্মের পতাকা যেন উপড়ে না যায়। জ্ঞানের আলোক যেন কখনও নিভে না যায়। আপনারা সকলে মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্মের পথে অগ্রসর হতে থাকুন যাতে করে আপনারা পরস্পরকে উৎসাহিত করতে পারেন এবং বৌদ্ধধর্মের স্বার্থে ভালভাবে নিজের যত্ন নিতে পারেন।
অনুবাদ: সুমনপাল ভিক্ষু
বৌদ্ধধর্ম এবং মানবাধিকার
সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্য প্রাচীন ভারত
ভূমিকা
Preface
Preface
কথামুখ
কথামুখ
মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন
সুমনপাল ভিক্ষু
মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার বিরল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। দেশ ও কালের সীমানা অতিক্রম করে তাঁর মহান পান্ডিত্যের খ্যাতি চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। অন্তরে সঞ্চারিত জ্ঞান তৃষ্ঞার তৃপ্তি সাধনের উদ্দেশ্যে সুদীর্ঘ এবং কঠোর শ্রম সাপেক্ষ ভ্রমণ তিনি মাথা পেতে গ্রহণ করেছিলেন। কখনও তিনি দুর্গম গিরি, কখনও কান্তার মরু অতিক্রম করেছেন কিন্তু কখনও কোনো ক্লান্তি তাঁর যাত্রা পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেনি। তিনি বৌদ্ধ পূর্বসুরীদের সেই পথেই অগ্রসর হয়েছিলেন যে পথে জ্ঞানের সন্ধানে আচার্য কোন্ডিয় গিয়েছিলেন চম্পা (দঃ পূর্ব এশিয়া), আচার্য কুমার জীব গিয়েছিলেন সুদুর চীন এবং আচার্য অতীশ দীপঙ্কর গিয়েছিলেন ভোট (তিব্বত) দেশো বস্তুতঃ তিনি ছিলেন একজন মহান জ্ঞান তাপস এবং বিশ্ব নাগরিক। এই পৃথিবীতে যেন তাঁর জন্ম হয়েছিল দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণের জন্য এবং সেই সঙ্গে জ্ঞান তৃষ্ঞা পূরণের জন্য।
পারিবারিক ঐতিয্য
১৮৯৩ খ্রীঃ ৯ এপ্রিল তিনি অর্থাৎ রাহুল সাংকৃত্যায়ণ এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার প্রদত্ত নাম ছিল কেদারনাথ পান্ডে। তাঁর পিতার নাম ছিল গোবর্ধন পান্ডে এবং মাতা কুলবন্তী দেবী। উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত আজীমগড় জেলার পান্ধা গ্রামের মাতামহের গৃহে তাঁর জন্ম হয়। তবে যে গ্রামে তাঁর মাতা-পিতা বসবাস করতেন সেই গ্রামের নাম ছিল কনাইলা। তিনি তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু করেন ‘রাতী কী সরাই’ নামক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে তিনি নিজামবাদ উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। এই বিদ্যালয়ের প্রধান ভাষা ছিল উর্দু। অতঃ তিনি কাশীতে সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্যসহ দর্শন শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও ৩০টি ভাষা, বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র এবং সাহিত্যে বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছিলেন।
জ্ঞানার্জনের প্রতি তাঁর অতৃপ্ত তাঁর অতৃপ্ত বাসনা তাঁকে স্রোতের টানে নিয়ে হাজির করেছিলেন গুনীজনের সান্নিধ্যে। এদের মধ্যে ছিলেন আচার্য ধর্মপাল, স্বামী ভারতীকৃষ্ঞ তীর্থ প্রমুখ গুণীজন। অবাক করার বিষয় এই যে, রাহুল সাংসৃত্যায়নের অভ্যন্তরে নিহিত ছিল বিশেষ গুণের সমাহার।
একদিকে যেমন পর্যটন স্পৃহা তাঁর দেহের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয়েছিল অপরদিকে জ্ঞানান্বেষণ তাঁর সমগ্র অন্তর জুড়ে ক্ষুধা-তৃষ্ঞাসম বিরাজমান ছিল। বস্তুতঃ তাঁকে দুই অর্থে পর্যটক নামে অভিহিত করা যেতে পারে, প্রথমতঃ তিনি ভ্রমণ করতেন মনোজগতে; দ্বিতীয়ত, পার্থিব জগতে।
পর্যটনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি হিমালয় অজ্ঞালের বিভিন্ন অংশে পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি মনে করতেন হিমালয়’এর মহত্ব তাঁর জীবনের সকল প্রেরণার একমাত্র উৎসস্থল। হিমালয়ের মায়া তিনি কখনই পরিত্যাগ করতে পারেননি। হিমালয় তাঁকে বারংবার আহ্বান করেছে। বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে হিমালয়ের ন্যায় তাঁর জীবন ছিল মহান এবং গভীর জ্ঞান ভান্ডারে সমৃদ্ধ।
মাত্র ১১ বৎসর বয়সে কেদারনাথ পান্ডে ওরফে রাহুল সাংকৃত্যায়ন পরিনয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। যদিও এই বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক পুতিগন্ধময় প্রথাকে তিনি কোনভাবেই সমর্থন করেননি। পরবর্তীকালে তাঁকে এই সকল সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করতে বাধ্য করেছিল।
অধ্যাত্ম সাধনা
কেদারনাথ কাশী ভ্রমণের অভিপ্রায়ে প্রথম গৃহত্যাগ করলেও তাঁর এই যাত্রা কোনভাবেই ফলাদায়ী হয়নি ফলে একপর্যায় কপর্দক শূণ্য হয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়ে তিনি পুনঃ স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। এই ঘটনার কিছু দিন পরে তিনি পুণঃ গৃহত্যাগ করে কোলকাতার উদ্দেশ্যে মাত্রা করেন। এ মাত্রায় তিনি কোলকাতায় কিছু দিন অবস্থান করার পরে হরিদ্বার, হৃষিকেশ, গঙ্গোত্রী, যমুণেত্রী, কেদারনাথ, গৌরীকুন্ড প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করে অবশেষে কাশী উপস্থিত হন।
এখানে তিনি সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে সংস্কৃত ভাষা চর্চার প্রতি গভীর ভাবে মনোনিবেশ করেন। ১৯১৩ খ্রীঃ তিনি পুরী দর্শন করে রামেশ্বরম, তিরুপতি, পুনা, মুম্বাই, নাসিক সহ দক্ষিন ভারত, পূর্ব ভারত ও পশ্চিম ভারতের নগর সমূহ পরিভ্রমণ করেন। এই সময় কেদারনাথের জীবনে এক অদ্ভূত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এখন তাঁর অভ্যন্তরে ধ্বনিত হতে থাকে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ। এই সময়ে তিনি ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার প্রাচীন বিধি বিধানের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামী-কুসংস্কার’এর বিরুদ্ধে, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।
একসময় তিনি বৈষ্ঞব মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উক্ত ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করলে তাঁর পূর্ব নাম কেদারনাথ পান্ডের পরিবর্তে রামোদর দাস নাম গ্রহণ করেন। অতঃ তিনি একসময় আর্য সমাজ প্রচারক রূপে খ্যাত হন। প্রচারক হিসাবে তিনি লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন ও পরিভ্রমণ করেন। এই সময়ে বৌদ্ধ দর্শন এবং জীবনে বৌদ্ধদর্শনের বাস্তব প্রয়োগ তাঁকে ভয়ানক ভাবে আকৃষ্ট করলে তিনি তখন হৃদয়ের গভীর নিষ্ঠা নিয়ে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃ তাঁর নতুন নামকরণ হয় ‘রাহুল সাংকৃত্যায়ন’। পরবর্তীকালে তিনি এই নামে পরিচিত হন ও খ্যাতি লাভ করেন।
এত্বদ সত্বেও তিনি তাঁর মনের উদ্বেগ কাটিয়ে উঠতে পারেন নি কারণ ভারতীয় সমাজের সামাজিক পরিকাঠামো তাঁকে প্রবলভাবে পীড়া দিয়েছিল। এক সময় তিনি একজন একনিষ্ট মার্কসবাদী ভক্তে পরিণত হন। তিনি এ কথা স্বীকার করেছিলেন যে নতুন পরিস্থিতিতে নতুন ভাবনাকে তিনি অন্তর দ্বারা গ্রহণ করেছিলেন। তবে একথা বলা কঠিন যে এই সময় তাঁর সমতা গ্রহন বাস্তবিক অর্থে সঠিক ছিল কিনা তা মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তবে যে কথাটি দ্বিধাহীন কন্ঠে উচ্চারণ করা যেতে পারে তিনি ছিলেন যথার্থই একজন সত্যসন্ধানী পরিব্রাজক।
স্বাধীনতা সংগ্রামী
১৯১৯ খ্রীঃ তৎকালীন ইংরেজ সরকার লাহোরে সামরিক আইন জারী করলে তিনি ভারতের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন। ফলে তিনি রাজনৈতিক বন্দী রূপে বক্সার জেলে আটক হন। মহান অক্টোবর বিপ্লব তাঁর মনে অসীম সাহসের সঞ্চার করেছিল এবং সেই সময় তাঁর মনের চিন্তাধারা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হতে থাকলে তিনি কার্ল মাক্সের মতবাদের প্রতি প্রবল ভাবে আকৃষ্ট হয়ে ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির পার্টিজান কর্মীরূপে বিহার, উত্তরপ্রদেশের গ্রামাঞ্চলে পরিভ্রমণ করতে থাকেন। অতঃ তিনি বন্দী দশা মুক্তি লাভ করে বিহারের হাপড়া জেলার কংগ্রেস কমিটির সম্পাদকপদে আসীন হন।
বেশ কিছুদিন পরে তিনি ঐ কমিটির সম্পাদকের পদ পরিত্যাগ পূর্বক নেপালে গমন এবং সে দেশে কিছুকাল অবস্থান করেন। সেই সময় তিনি সেখানে বেশ কিছু লামার সান্নিধ্য লাভ করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মহাবুন্ডায় অবস্থিত কতিশয় চীনা লামাও। সেই সময় রাহুল সাংকৃত্যায়ন অতীন্দ্রিয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তের পর ইংরেজ সরকার কর্তৃক তাঁকে রাজদ্রোহের অভিযোগে আটক করে হাজারিবাগ জেলে বন্দী করে রাখা হয়। কারণ তিনি একসময় কংগ্রেস পরিষদীয় দলের সম্পাদকের পদে আসীন ছিলেন। এখানেই তাঁর সঙ্গে স্বামী ভারতী কৃষ্ঞতীর্থের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ইত্যবৎসরে তিনি বীজগণিত এবং আলোক বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং জ্যোর্তিবিদ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেন।
জেলজীবন অতিবাহিত হওয়ার পরে তিনি হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য সাধনের কাজে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এছাড়াও তিনি সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণের কাজেও নিজেকে সমর্থন করেছিলেন। ১৯২৬ খ্রীঃ তাঁর সঙ্গে ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদের সাক্ষাত্ ঘটে। ড. প্রসাদ তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত ইত্যাদি পাঠ করে এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি উক্ত বক্তৃতামালা মুদ্রিত আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন।
কৃষক আন্দোলন
১৯৩৪ খ্রীঃ বিহারে সমাজবাদী পার্টি গঠিত হয়। তিনি এই সংগঠনের সম্পাদকপদে যুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি বিহার কিষাণ সভা ও বিহার কমিউনিষ্ট পার্টি গঠন করেন। কমিউনিষ্ট পার্টি গঠনের মূল কারণ ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে মতাদর্শগত মতবিরোধ। ১৯৪৭ খ্রীঃ পর্যন্ত তিনি একান্ত ভাবে কমিউনিষ্ট সংগঠনের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন।
১৯৩৯ খ্রীঃ তিনি কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী সঙ্গে একত্রিত হয়ে কৃষ্ঞান সভার পতাকাতলে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করেন। সেই বছরেই তিনি আড়াই বৎসরকাল ব্যাপী কারাবাস ভোগ করেন। কারাবাসের সময়কালে তুলনামূলক দর্শন (Comparative Philosophy) ‘দর্শন দিগ্দর্শন’ নামক এক অসামান্য গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর জীবনের মহানব্রত ছিল দেশবাসীর উন্নয়ন। তিনি মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন যে ভারতবর্ষকে যথার্থ ভাবে উন্নত করার একমাত্র পথ হল এই দেশকে পরাধীনতার শৃংখল হতে মুক্ত করা। আর এরজন্য প্রবোজন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন।
শ্রীলংকা এবং তিব্বত পর্যটন
১৯২৭ খ্রীঃ রাহুল সাংকৃত্যায়ন শ্রীলংকা গমন করেন। এই দেশে কিছুকাল অবস্থান কালে তিনি গভীর উৎসাহের সঙ্গে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং উক্ত দেশ হতে তিনি ত্রিপিটকাচার্য উপাধি লাভ করেন। অতঃ তিনি ভিক্ষুধর্মে দীক্ষিত হয়ে আচার্যের নিকট হতে রাহুল সাংকৃত্যায়ন নামে ভূষিত হন। পরবর্তীকালে তিনি বহুবার শ্রীলংকা গমন করেছিলেন।
তিনি বেশ কয়েক বৎসর তিব্বত ভ্রমণ করেন। প্রথমবার তিনি তিব্বতে যান ১৯২৯ খ্রীঃ, দ্বিতীয়বার ১৯৩৪ খ্রীঃ, তৃতীয়বার ১৯২৬ খ্রীঃ এবং অন্তিম সময় ১৯৩৮ খ্রীঃ। তিনি তিব্বত যাত্রাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে মূল্যায়ণ করেছিলেন। তাঁর মতে এই দেশ ভ্রমণ অত্যন্ত জটিল তথাপি ফলপ্রসু। তিনি তাঁর তিব্বত যাত্রা হতে প্রত্যাবর্তন কালে অতি মূল্যবান তথা দুষ্প্রাপ্য পুঁথি ভারতে আনয়ন করেছিলেন। এই সকল পুঁথিপত্র বর্তমানে নেপাল ও নালন্দায় সংরক্ষিত রয়েছে। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন যে ৭ম শতাব্দীতে পৃথীবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ‘নালন্দা’ বখতিয়ার খলজি নামক তুর্কী মুসলমান শাসক দ্বারা সম্পূর্ণ ভাবে বিনষ্ট হয়েছিল।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৩১-১৯৩৮ খ্রীঃ সময়কালে এশিয়া এবং ইউরোপের বহুদেশ ভ্রমণ করেছিলেন।
রুশদেশ ভ্রমণ
১৯৩৫ খ্রীঃ রাহুল সাংকৃত্যায়ন সর্বপ্রধম রূশদেশ (তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন) গমন করেন। পুনঃরায় ২ বৎসর পরে তিনি রুশদেশে যান। এই সময় তিনি লেনিনগ্রাভ শহরে ২ বৎসর অবস্থানরত ছিলেন। লেনিনগ্রাভ শহরে অবস্থানকালে তিনি ‘ওরিয়েন্টাল ইনষ্টিটিউটে’ সংস্কৃত ভাষার শিক্ষকরূপে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় ‘ইলেনা নরভার টোভনা’ নামক এক রুশ মহিলা ‘ইন্দো-টিবেটান ষ্টাডিজ’এর সেক্রেটারী পদে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৩৮ খ্রীঃ তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর নামকরণ করা হয় ‘লগোর’। তিনি সেই বৎসর’ই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। নবজাতকশিশু এবং মাতা রুশদেশেই থেকে যান।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৪৫ খ্রীঃ পুনঃ রুশদেশে গমন করেন। তিনি এই সময় লেনিনগ্রাভের কোন এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনাকার্যে যুক্ত ছিলেন। তথায় তাঁর সঙ্গে বহু মনীষী এবং দার্শনিকের সাক্ষাৎ ঘটেছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন সারভেসিক, বারনিকোভ এবং কলিয়ানোভ প্রমুখ। সেই সময় মস্কো শহরে ড. টলস্টোভ নামক এক প্রখ্যাত ঐতিহাসিকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে এবং তাঁর অনুপ্রেরণায় তিনি এশিয়া সোভিয়েত বিষয় সম্পর্কিত গবেষণাধর্মী অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি উক্ত গবেষনার পরিনাম রূপে ‘মধ্য এশিয়ার ইতিহাস’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন এবং ‘সাহিত্য আকাডেমী’ পুরস্কার লাভ করে ছিলেন। বস্তুতঃ তিনি এই সময়কালে ভারতবর্ষ ও তার পার্শ্ববর্তী বহু দেশের ভূগোল এবং ইতিহাস সম্পর্কিত অনেক সৃজনশীল গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
তিনি ১৯৪৭ খ্রীঃ’র জুলাই মাসে শেষবারের ন্যায় রুশদেশ ত্যাগ করে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। এই সময় তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী-পুত্রের বিচ্ছেদ ঘটে যদিও এরপরেও তিনি মস্কো শহরে চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেছিলেন কিন্তু তাদের সঙ্গে আর তাঁর সাক্ষাৎ সম্ভব হয় নি।
স্বদেশে প্রত্যাবর্তন
যখন তিনি স্বাধীন ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন তখন তিনি দেখতে পান সমগ্রদেশে সাম্প্রদায়িক নাগপাশে জর্জরিত। তিনি তখন সাম্প্রদায়িক মিলনের পথের সন্ধানে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৭ খ্রীঃ তিনি মুম্বাই শহরে অনুষ্ঠিত হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতির আসন অলংকৃত করে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির আহ্বান জানান। কিন্তু এক সময় মতাদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে তিনি সক্রিয় রাজনীতি হতে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এরপর তাঁর জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। শুরু হয় এক নতুন পথে হাঁটা।
জীবনের সিংহভাগ সময় তিনি অতিবাহিত করেন কখনও দেশ পর্যটন করে আবার কখনও নেপাল, চীন, শ্রীলংকায় শিক্ষকতা বরত্তির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। অতঃ জীবনের অবশিষ্ট অংশ তিনি পুরোপুরি ব্যয় করেন কখনও বা ইতিহাস সম্পর্কিত গ্রন্থ প্রকাশ করে আবার কখনও বা ঐতিহাসিক ও ভারত সংস্কৃতি মূলক নিবন্ধগ্রন্থ ইত্যাদি রচনা করেন। এক সময় ভারতীয় সংবিধানকে হিন্দি ভাষায় রূপদানের প্রশ্নে তাঁর প্রতি ভার ন্যাস্ত করা হয় এবং সেই কাজ তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন।
হিমালয়ের প্রতি অকৃত্তিম ভালোবাসা তাঁকে কালিম্পং টেনে নিয়ে আসে। এখানে তাঁর বহুকালের বন্ধু জর্জ বোরিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে এবং কমলা নামক রমণীর সঙ্গে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন। কমলা ছিলেন তাঁর তৃতীয় পত্নী।
১৯৫০ খ্রীঃ তিনি মৌসুরীর ‘হ্যাপি ভ্যালি’ তে একটি গৃহ ক্রয় করেন। এখানে তিনি ভীষণভাবে লেখা’র কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। তাঁর কন্যা জয়া ১৯৫৩ খ্রীঃ জন্মগ্রহন করেন এবং পুত্র হেতা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৫ খ্রীঃ। রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৫৬ খ্রীঃ সপরিবারে নেপাল ভ্রমণ করেন। ১৯৫৮ খ্রীঃ তিনি গণতান্ত্রিক চীন গমন করেন এবং সেখানেই তিনি প্রথমবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন ১৯৫৯ খ্রীঃ শ্রীলংকার বিদ্যালংকার পরিবেন এর দর্শন বিভাগের বিভাগীয় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। শ্রীলংকা গমনের পূর্বে তিনি তাঁর স্ত্রী-পুত্র এবং কন্যাকে কালিম্পং এর গৃহে স্থানান্তরিত করে যান।
১৯৬১ খ্রীঃ তিনি শ্রীলংকায় পুনঃ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতঃ তিনি সরাসরি শ্রীলংকা হতে দার্জিলিং চলে আসেন। তাঁর ক্লান্তিহীন অবিরাম পরিশ্রম তাঁর শরীর আর গ্রহণ করতে পারল না। সেই বৎসর ডিসেম্বর মাসে তিনি পুণঃ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তখন তাঁকে চিকিৎসার নিমিত্তে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে মস্কো নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু এত্বদ স্বত্ত্বেও সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল এবং তাকে আর কোন ভাবেই সুস্থ করা সম্ভব হল না। ১৯৬৩ খ্রীঃ মার্চ’এ তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ১৯৬৩ খ্রীঃ ১৪ এপ্রিল তিনি তাঁর প্রিয় শহর কালিম্পং’এ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
সাহিত্যে সৃজনশীল অবদান :
যদিও তিনি সর্বদা পর্যটন কার্যে নিয়োজিত ছিলেন তথাপি তিনি কোন না কোন ভাবে লেখালেখির কার্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ১৯২০- ১৯৬১ খ্রীঃ পর্যন্ত তিনি সাহিত্য চর্চার কাজে মগ্ন ছিলেন। যতদিন না তিনি স্মৃতিভ্রম ব্যাধিতে আক্রান্ত না হয়েছেন ততদিন তিনি কোন না কোনো রচনাকার্যে ব্যপৃত থেকেছেন। এই কাল খন্ডের মধ্যে তিনি রচনা করেছেন একশত খন্ড পুস্তক। এই পুস্তক সমূহের মধ্যে ছিল উপন্যাস, ছোটগল্প, তাঁর নিজের জীবনী সহ অন্যজনের জীবনী। জীবনী গ্রন্থের সংখ্যা ছিল সুবৃহৎ ৫ খন্ড; ২০টির অধিক ভ্রমণ বৃন্তান্ত, ৮ খন্ড রচনা সংগ্রহ ভোজপুরী ভাষায় ৮টি নাটক এবং ৩টি দর্শন শাস্ত্র বিষয়ক নিবন্ধ। তাঁর রচিত উপন্যাস সমূহের মধ্যে ‘সিংহ সেনাপতি’ এবং ‘জয় মৌধেয়’ উল্লেখ্যনীয়। ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ এই কালজয়ী গল্প সমূহের সময়কাল বৈদিক পূর্বযুগ হতে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। এই গ্রন্থটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন কর্তৃক রচিত গ্রন্থপুঞ্জ কেবলমাত্র মৌলিক রচনার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তদুপরি তাঁর রচনার ধারাকে তিনি ব্যাপ্ত করে দিয়েছেন বৈচিত্রের মধ্যে। এই বৈচিত্রময় সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, নৃতত্ত্ব, ভাষা, ভ্রমণ কাহিনী, ভারততত্ত্ব, শিল্প-বিজ্ঞান, অভিধান, বৌদ্ধসাহিত্য, লোকসাহিত্য এবং আরও বহু বিভিন্ন ধর্মী রচনা।
ভারতীয় সাহিত্যে রাহুল সাংকৃত্যায়ন’এর উল্লেখনীয় অবদান হল সহজবোধ্য হিন্দি ভাষায় প্রাচীন সাহিত্যের সহজ সরল অনুবাদ। চিরায়ত পালি ভাষায় রচিত প্রাচীন বৌদ্ধ পুঁথি, সিংহলী এবং তিব্বতী গ্রন্থ তিনি উৎসুক পাঠক সমাজ ও গবেষকের কাছে সহজলভ্য এবং সহজবোধ্য করে দিয়েছেন। এই সকল রচনা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। সর্বোপরি তাঁর রচনার ভাষা ছিল সহজ ও সরল। সাহিত্যের এমন কোন অঙ্গন নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। সুতরাং এই অর্থে রাহুল সাংকৃত্যায়ন হলেন বিশ্ব নাগরিক এবং যার মূল্যায়ন কোনো অর্থেই সম্ভব নয়।
১২.০২.২০২৪
বড়ুয়া বেকারির গড়ে ওঠার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত
মাতৃত্ব বিভিন্ন ধর্মে