Thursday, June 19, 2025

চৈনিক বৌদ্ধধর্ম সম্প্রদায়: একটি আলোচনা

 

সুমনপাল ভিক্ষু

 

বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধধর্মের ও বিভিন্ন নিকায়ের বিকাশের আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দিক গুলিকে একটি অধ্যয়ন থেকে অনুধাবন করার পক্ষে সহায়ক। ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম যখন অন্যান্য এশীয় দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন বিভিন্ন প্রকারভেদ সৃষ্টি করেছিল। এই ভাবে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন নিকায়ের দার্শনিক বৈশিষ্ট্য, ধর্মীয় সংগঠন, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান চীনের উপর যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং একই সঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতির পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়েও প্রভাব পড়েছিল।

চীনদেশে বৌদ্ধধর্মের আগমন

বৌদ্ধধর্ম চীনদেশে বিস্তার হয়েছিল আনুমানিক খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকের মাঝামাঝি সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে যাঁরা চীনদেশকে একটি অতি উন্নত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দেশ হিসেবে আবিষ্কার করেছিলেন। শুরুতে বৌদ্ধধর্মকে সেই সমস্ত মানুষকে প্রভাবিত করতে হয়েছিল যাদের মনে কনফুসীয়বাদ' ও তাওবাদ' গভীরভাবে প্রোথিত ছিল এবং চীনদেশের জনগণ জনপ্রিয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে নতুন ধর্মটিকে স্থান করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। প্রথম দিকে বৌদ্ধধর্ম চীনদেশের উত্তরাংশে রাজকুমার ও সম্রাটদের থেকে এক সীমিত পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। জনপ্রিয় কাহিনী অনুসারে 'বুদ্ধ' হান রাজবংশের সম্রাট মিংতি'র স্বপ্নে একজন স্বর্ণ পুরুষের রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। চৈনিকরা বৌদ্ধধর্মকে তার দর্শনের থেকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছিল অতিপ্রাকৃত শক্তিলাভ অমরত্বলাভ ও দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের মন্ত্রের কারণে। বৌদ্ধধর্মকে তাও ধর্মের একটি অঙ্গ হিসেবে নেওয়া হয়েছিল এবং বুদ্ধকে তাও ধর্মের অনেক দেব দেবীর মতই পূজা করা হত অনেকটা কিংবদন্তীর পীত সম্রাট এবং দার্শনিক লাওৎসু।

চীন দেশে বৌদ্ধধর্মের বিধিবদ্ধ মত প্রচার শুরু হয়েছিল। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ বিদেশী ভিক্ষুরা চীনদেশে নিয়ে আসেন এবং চৈনিক মানুষদের সাহায্যে সেগুলির অনুবাদকর্ম শুরু হয়। এর সূত্রপাত করেছিলেন ভিক্ষু কাশ্যপ মাতঙ্গ ও ধর্মরক্ষ যাঁরা খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকের মধ্যভাগে মূল সংস্কৃত রচনা থেকে বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিকে অনুবাদ করেছিলেন।

পরবর্তীকালে মধ্য এশিয়া থেকে আগত ধর্মপ্রচারক আনশি-কাও, লোকরক্ষ, চি-চিয়েন এবং আন সুয়ান' চীনদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে এই অনুবাদ কার্য চালিয়ে গিয়েছিলেন এবং ধ্যানানুশীলনের জন্য রচনা প্রবর্তন করা ছাড়াও প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থগুলিকেও প্রবর্তন করেছিলেন।

প্রসার

খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শেষ ভাগের মধ্যেই চীনদেশের বিভিন্ন অংশে বৌদ্ধধর্ম বিস্তারলাভকরে যখন শ্বেতাঙ্গ বিহারের মত সংঘারাম নির্মিত হয়েছিল। ৩১৭ খ্রীষ্টাব্দে চীনদেশে ভাঙনের পর বৌদ্ধধর্ম ইয়াংসি উপত্যকায় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় দক্ষিণ চীনের অভিজ্ঞদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ এবং উত্তরে অচৈনিক শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী সমর্থন।

বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলিতে দীক্ষাদানের এবং বিহার জীবনের আচরণের প্রাথমিক নিয়ম পাওয়া গিয়েছিল মহাসাংঘিকদের প্রাতিমোক্ষ এবং ধর্মগুপ্ত নিকায় কর্মের ধর্মগুপ্ত বিনয় রচনা অনুবাদের মধ্যে দিয়ে। এই বিষয়ে পথ প্রদর্শকের কাজ করেছিলেন ভিক্ষু আনশিকাও (৩১২-৩৮৫) যিনি সর্বাস্তিবাদ, ধর্মগুপ্ত, মহাসংঘিক এবং মহিসাশক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিনয় রচনাগুলি সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ রচনাগুলির চৈনিক অনুবাদের একটি কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন এবং চৈনিক বৌদ্ধ শ্রেণির প্রথম পুস্তকতালিকা সংকলন করেছিলেন। সর্বাস্তিবাদ অভিধর্ম অনুবাদ এবং তার পূর্বে 'মহাযান প্রজ্ঞাপারমিতা' অনুবাদের দ্বারা চীনদেশে প্রবর্তিত বৌদ্ধ ধর্মের বিশ্লেষণাত্মক ধারণাগুলি চৈনিক পণ্ডিত মহলে জনপ্রিয়তা লাভ করে এদের মধ্যে ছিলেন চীনদেশের ভাঙনের পর ইয়াংসি উপত্যকার গোঁড়া কনফুসীয়বাদীরা এবং নব্য তাও পন্থী উত্তরদেশীয় অভিজাতরা যাঁরা ঐ উপত্যকায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধ ও চৈনিক উভয় প্রকার শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ আলোচনা এবং বৌদ্ধ ও তাও উভয় প্রকার উপাদানকে মিশ্রিত করে সাহিত্যিক রচনা ইত্যাদি 'সার্দান্দ্র বৌদ্ধধর্মের' প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। প্রথম দিকে বৌদ্ধধর্মের অধিবিদ্যা ভিত্তিক ধারণাগুলিকে বোঝাবার জন্য নব্য তাওবাদ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছিল' এবং শীলের মত নৈতিক পরিভাষা বোঝানোর জন্য কনফুসীয় পরিভাষা 'সিয়াও সুন' (পিতা মাতার প্রতি পুত্রের ভক্তি) পরিভাষাটি নির্বাচন করা হয়েছিল। বৌদ্ধ ও দেশীয় ধারণার সামঞ্জস্যপূর্ণ জোড়া (যা খুই) নামে পরিচিত বৌদ্ধধর্মকে স্থান করে দেওয়ার একটি কৌশল রূপে ব্যবহৃত হয়েছিল। দুজন বিখ্যাত বিদেশী ভিক্ষু সংঘভূতি ও সংঘদেবের অভিধর্মবিভাষা অভিধর্ম জ্ঞানপ্রস্থানের অনুবাদ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যার প্রবর্তন করেছিল দর্শনশাস্ত্রের এক ব্যাখ্যামূলক বৈশিষ্ট্যর উন্মুক্ত করেছিল যা চীনদেশে নতুন ছিল। যাই হোক, শূন্যতা ও প্রজ্ঞার সূক্ষ্ম দর্শন যা প্রজ্ঞাপারমিতা রচনাগুলি দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মানুষের কাছে আবেদন রেখেছিল। ক্রমশ তাঁরা বৌদ্ধ ধারণার সঙ্গে দেশীয় ধারণাকে মুক্ত করে বৌদ্ধধর্মের ধারক হয়ে উঠলেন। এছাড়াও বৌদ্ধধর্মের ধ্যানমূলক ও ভক্তিমূলক আচার অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা লাভ করল। এই পর্যায়ের বৌদ্ধধর্মের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব হলেন পূর্বতন কনফুসীয় পণ্ডিত হুই উয়ান (৩৩৪-৪১৬ খ্রীঃ) তিনি দক্ষিণ চীনের লুসানে তাঁর নিজস্ব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বৌদ্ধধর্মকে সম্পূর্ণ রূপে অনুধাবন করার জন্য তিনি নিজেকে সেই সমস্ত বৌদ্ধ রচনার সংগ্রহ, অনুবাদ ও শিক্ষাদানের কাজে ব্যাপৃত রেখেছিলেন যেগুলি অভিধর্ম, প্রজ্ঞাপারমিতা ও মাধ্যমিক দর্শনকে প্রবর্তন করেছিল বিশেষতঃ বিখ্যাত কূচদেশীয় ভিক্ষু কুমারজীব দ্বারা অনূদিত মাধ্যমিক দর্শন। তিনি বিশ্বাসের সঙ্গে চৈনিক শিক্ষিত সমাজের বিরোধিতার সামনে বিহারের আদর্শকে সমর্থন করেছিলেন এবং জনপ্রিয় স্তরে অনুগামীদের নিয়ে বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে শপথ গ্রহণের মত বিশ্বাসধর্মী আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

মহাপরিনির্বাণ সূত্রের অনুবাদের উপর ভিত্তি করে কিছু কিছু বৌদ্ধ ধারণা ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে শুরু করে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকের শেষে। এগুলি হল-

১। নির্বাণ হল বিশুদ্ধ, শান্তি ও চিরন্তন, ২। মানুষের মধ্যে বুদ্ধের প্রকৃতি রয়েছে এবং তারা বুদ্ধত্ব অর্জন করতে পারে, ৩। প্রজ্ঞাসূত্রের শূন্যতার পরম সত্য এবং নির্বাণ সূত্রের বুদ্ধ প্রকৃতি সমান, ৪। বোধিলাভ সম্পূর্ণ এবং অকস্মাৎ সেহেতু সত্য বিভক্ত নয়।

বৌদ্ধধর্মের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা সম্পর্কে বলা যায়, অচৈনিক শাসকেরা চীনদেশ ভেঙে যাওয়ার প্রথমদিকের বছরগুলিতে ধর্মীয় বৈধতা লাভের জন্য বৌদ্ধধর্মের সমর্থন করেছিলেন। শান্তি ও শৃঙ্খলা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে শাসকেরা বৌদ্ধধর্মের সর্বজনীন নৈতিকতাকে সম্মানিত করেছিলেন। তাঁরা বিশাল বিশাল সংঘরাম, বিহার ও গুহা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন যেখানে শাসকদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করতেন। একথা বিশ্বাস করা হত যে তাঁদের ধর্মীয় কাজকর্মের দ্বারা বুদ্ধের আদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁরা আদর্শ রাজা হিসেবে বিবেচিত হবেন।১৩

চীনে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় (১)

চীন দেশের বৌদ্ধধর্মের প্রথম দিকের ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে এটি পরিষ্কার হয় যে বৌদ্ধ দর্শন ও অনুশীলন চীনদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলির রচনাগুলির অনুবাদের মাধ্যমে। তবে বিভিন্ন রচনার বিভিন্ন প্রকার কখনও কখনও পরস্পরবিরোধী শিক্ষাগুলি চৈনিকদের বৌদ্ধধর্মের মূল শিক্ষা হিসেবে একটি মাত্র বিশেষ ধর্মগ্রন্থের উপর মনোনিবেশ করতে আগ্রহী করে। কখনও কখনও সমস্ত বৌদ্ধ রচনাগুলিকে এমন ভাবে সজ্জিত করা হত যে মনে হত কোন একটি বিশেষ রচনা বৌদ্ধ ধর্মের পরম শিক্ষাকে ধরে রেখেছে। এই পটভূমিকায় চীনদেশে বৌদ্ধধর্মের সমস্ত সম্প্রদায় মোটামুটি ভাবে ষষ্ঠ শতক থেকে নবম শতক পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। কোন কোন সম্প্রদায় তাদের ভারতীয় প্রতিরূপের বৈশিষ্ট্যগুলিকে অপরিবর্তিত রাখে এবং কোন কোন সম্প্রদায় সমসাময়িক চৈনিক মানসিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য মূল বৌদ্ধ নীতিগুলির চৈনিক রূপভেদের জন্ম দেয়। এদের মধ্যে ছিল তিয়েন তাই, পিওরল্যান্ড, হুয়া ইয়েন এবং ছেন যেগুলি চীনদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় নামে পরিচিত না হয়ে চৈনিক বৌদ্ধ সম্প্রদায় নামে পরিচিত হয়। বৌদ্ধধর্মের দশটি প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে চেং শি (সত্যসিদ্ধি) 'সত্যের সিদ্ধি'-র ভিত্তি ছিলো হরিবর্মণের সত্যসিদ্ধিশাস্ত্র যার অনুবাদ করেছিলেন কুমারজীব। এটি ধর্ম এবং আত্মা দুটিরই অবাস্তবতা শিক্ষা দেয়, এই দর্শন পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে জনপ্রিয় হয়। ১৪ অপর একটি অপ্রধান সম্প্রদায় চু'ছে (কোস) যার বিকাশ ঘটেছিল পরমার্থ এবং পরবর্তীকালে শুয়াং জাঙ অনূদিত বসুবন্ধুর অভিধর্মকোষের উপর ভিত্তি করে। এটি বাস্তববাদী সম্প্রদায় নামে পরিচিত যা অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ তিন কালেই ধর্মের বাস্তবতাকে স্বীকার করে তবে বাস্তবের অস্তিত্বকে ক্ষণস্থায়ী বলে বিবেচনা করা হয়। চীনদেশে এই সম্প্রদায়টি তাং যুগে জনপ্রিয় হয়েছিল।১৫

অপর একটি বিনয় সম্প্রদায় লুথার ভিত্তি হল ত্রিপিটকের বিনয় পিটক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাও সুয়ান (৫৯৬-৬৬৭ খ্রীঃ)। এর মধ্যে ছিল ভিক্ষুদের জন্য ২৫০টি বিনয় এবং ভিক্ষুণীদের জন্য ৩৪৮টি নিয়ম। এই তিনটি সম্প্রদায় যেগুলিকে হীনযান বা থেরবাদ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বলে মনে করা হয় যা চীনদেশে খুব বেশীদিন স্থায়ী হয়নি।

'সান লুন' হল চীনদেশের প্রাচীন মাধ্যমিক সম্প্রদায় যাকে নাগার্জুনের মাধ্যমিক দর্শনের এক বিশ্বস্ত প্রতিরূপ বলে মনে করা যেতে পারে।

শূন্যতা হল বাস্তবতা স্বয়ং কিন্তু পৃথিবীর সাংসারিক দৃষ্টি আপেক্ষিক। এ দর্শনাটির প্রচলন করেছিলেন কুমারজীব যিনি মাধ্যমিক মতের তিনটি রচনাকে চৈনিক ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন যথা মাধ্যমিক কারিকা, দ্বাদশনিকায়শাস্ত্র এবং শতশাস্ত্র এই তিনটি শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে জীনদেশে 'চিসাং' দ্বারা। (৫৯৯-৬২৩ খ্রীঃ) ত্রিশাস্ত্র সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বিশেষভাবে মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন যথা দুই প্রকার সত্য, আট প্রকার নঞথর্কতা, এবং অশুদ্ধে খণ্ডন ও শুদ্ধের প্রতিষ্ঠা। ১৬ মাধ্যমিক শূন্যতা তাও সম্প্রদায়ের নিকটবর্তী এবং চৈনিক বৌদ্ধধর্মকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। মাধ্যমিক দর্শনের সৃষ্টিশীল গ্রহণ এবং নীতিগত লঘুকরণ বৌদ্ধধর্মের তিয়েন তাই এবং হুয়া ইয়েন সম্প্রদায়ের দার্শনিক ব্যাখ্যা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।

চৈতসিক সম্প্রদায় যা প্রথমে ভারতবর্ষে বিজ্ঞানবাদ নামে পরিচিত ছিল মহাযান দর্শনের দুটি শাখার একটি প্রতিনিধিত্ব করত, অপরটি ছিল মাধ্যমিক দর্শন। ভারতবর্ষে অসঙ্গ ও বসুবন্ধ এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। অসঙ্গের রচনার অনুবাদের মাধ্যমে এটি চীনদেশে ছড়িয়ে পড়ার পরে 'শে লুন' সম্প্রদায়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত 'শে লুন' সম্প্রদায় 'ওয়ে শি' সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে যায় যে সম্প্রদায়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিখ্যাত ভিক্ষু পণ্ডিত শুয়াং জাঙ যিনি বিজ্ঞপ্তিমাত্রতার সর্বশ্রেষ্ঠ পথিকৃত ছিলেন। এই সম্প্রদায়টি ফা শিয়াং (ধর্মলক্ষণ) সম্প্রদায় নামেও পরিচিত। শুয়াং জাঙ রচিত 'ছেং উমেউ শি-লুন' (বিজ্ঞপ্তিমাত্রতা সিদ্ধি) সেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে 'ওয়েই শি' দাবী করে (১) চেতনার বাইরে কোন জগৎ নেই (২) বহির্জগৎ চেতনার প্রক্ষেপণ এবং (৩) অভ্যন্তরীন চেতনা নিজেকে বাহ্যিক বাস্তবতা রূপে প্রকাশ করে। শুয়াং সাং ব্যাখ্যা করেন যে বিভিন্ন প্রকার মানসিক ও শারীরিক ঐতিহ্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য আট প্রকার চেতনার প্রকাশ। প্রতিটি জিনিসের স্বরূপ (ফা-শিং) ধারণার অতীত।

চীনদেশে এই সম্প্রদায়টির পতন ঘটে তাং যুগে সেহেতু এটি সম্ভবত এটির সূক্ষ্ম দার্শনিক বিশ্বাসের কারণে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। তবে এটি কয়েকজন চৈনিক পণ্ডিতের দ্বারা বিংশ শতাব্দীতে পুনরুজ্জীবিত হয়।

ছেন ইয়েন (সত্য-জগৎ) চৈনিক বৌদ্ধধর্মের একটি সম্প্রদায় যেটি স্বল্প সময়ের জন্য সমৃদ্ধিলাভ করে। যোগাচার এবং বিজ্ঞানবাদের যোগ অভ্যাসের উপর ভিত্তি করা তন্ত্রযানকে বুদ্ধের তৃতীয় ও সর্বশেষ শিক্ষা বলে মনে করা হয়। মন্ত্র তন্ত্রযানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে সেইজন্য এটি মন্ত্রযান নামেও পরিচিত। ভক্তদের কাছে তন্ত্র অনুশীলনের মধ্যে রয়েছে মন্ত্র, মণ্ডল, মুদ্রা এবং অভিষেক। বোধিলাভের জন্য এটি হল গোপন রীতিনীতি যেটি একজনের প্রকৃত সত্তার চেতনা। নির্বাণকে প্রজ্ঞা ও করুণার সংমিশ্রণ বলে মনে করা হয়। ভারতের শুভকর সিংহ, বজ্রবোধি এবং অমোঘবজ্র অষ্টম শতাব্দীতে চীনে তন্ত্রযান প্রবর্তন করেন। তন্ত্রযানের অন্যতম মূল রচনা মহাবৈরোচন সূত্র শুভকর সিংহ দ্বারা অনূদিত হয়েছিল এবং অন্য দুজন শিক্ষক রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তান্ত্রিক আচর অনুষ্ঠান পালন করা ছাড়াও অনুবাদের মাধ্যমে বিভিন্ন তান্ত্রিক রচনার দর্শন প্রচার করেছিলেন এবং প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।১৮ 

চীনদেশে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় (২)

ভারতবর্ষের অন্যতম জনপ্রিয় মহাযান সূত্র সদ্ধর্মপুণ্ডরীক সূত্র (লোটাস সূত্র) এর উপর ভিত্তি করে চৈনিক ভিক্ষু প্রথম চি (৫৩৮ খ্রীঃ-৫৯৭ খ্রীঃ) চীনদেশে তিয়েনতাই সম্প্রদায় স্থাপন করেছিলেন। এই রচনার প্রথম চি কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ হয়েছিল তাঁর শিষ্যের দ্বারা সামঞ্জস্যের চৈনিক মানসিকতার উপর স্পষ্ট চিহ্ন রেখে এই সম্প্রদায় দর্শন ও ধ্যানানুশীলদের উভয়ের উপর সমান গুরুত্ব আরোপ করেছে।

এটি বিজ্ঞানবাদের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করেছে এবং এগুলিকে তার সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ তিন প্রকার সত্যের নীতির মধ্যে আত্তীকরণ করেছে। এই তিন প্রকার সত্য হল- ১। সমস্ত ধর্মই শূন্য কারণ তারা কার্যকারণনীতি দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে এবং তাদের নিজস্ব কোন সত্তা নেই, ২। তাদের কোন স্থায়ী অস্তিত্ব নেই, ৩। শূন্য এবং অস্থায়ী হওয়াই ধর্ম এবং Mean এর প্রকৃতি। অতএব শূন্যতা, অস্থায়ীত্ব ও Mean পরস্পরের সঙ্গে জড়িত তাই একের মধ্যেই তিন এবং তিনের মধ্যে এক। কোন একটি বস্তু শূন্য কিন্তু অস্থায়ীভাবে অস্তিত্বশীল। এটি অস্থায়ী কারণ এটি শূন্য, এবং এই বিষয়টি যে সব কিছুই শূণ্য এবং অস্থায়ী তাই হল মধ্যপথ বা পরম।' বিশাল বৌদ্ধ সাহিত্য গুলিতে পাওয়া যুদ্ধের শিক্ষার বিভিন্ন দার্শনিক মতপার্থক্যকে সমাধান করার জন্য প্রথম চি একটি পদ্ধতির কথা বলেছিলেন যেটি হল বুদ্ধের শিক্ষাকে ঐতিহাসিক কালক্রমে সাজানো যার উল্লেখ রয়েছে 'পাঁচটি পর্ব এবং আটটি শিক্ষার মধ্যে।

এই সম্প্রদায় অস্থায়ীত্বের জগতে তিন হাজার প্রকার অস্তিত্বের কথা বলে। এই দুটি এমনভাবে পরস্পরের সঙ্গে মুক্ত যে এগুলিকে চেতনার একটি মুহূর্তে এগুলিকে এক বলে মনে করা যেতে পারে। এই দর্শনের উদ্দেশ্য হল এরকম চেতনার মুহূর্তে পরম সত্যকে দর্শন করা। এই একের মধ্যে সব এবং সবের মধ্যে এক দর্শন এই শিক্ষা দেয় যে কোন একটি বস্তু এবং কোন একটি অস্তিত্বই হল প্রকৃত অবস্থা। তিয়েন তাই'তে সমস্ত বস্তু সম্পূর্ণ এবং একে অপরের কাছে যথেষ্ট। অধিবিদ্যাবিষয়ক বস্তুকে পার্থিব বস্তুর সঙ্গে একত্রিত করা হয়েছে। মাধ্যমিকের মত 'তিয়েন তাই' সত্যের তিনটি পর্যায়কে অভিন্ন শূন্যতায় নামিয়ে আনেননি, বরং তাদের এমন একটি সম্পর্কে একত্রিত করতে চেষ্টা করেছেন যে একের মধ্যেই সব এবং সবের মধ্যেই এক রয়েছে।১৯

তিয়েন তাইয়ে'র ধারণাকে বৌদ্ধধর্মের অন্তিম ও গোলাকার' নীতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেহেতু তারা অন্যসম্প্রদায়ের দর্শনকে সংশ্লিষ্ট করে তারা হল পরম ও চূড়ান্ত। তার গোলাকৃতি কারণ তারা জোরের সঙ্গে বিশ্বজনীন মুক্তির কথা বলেছে এই বিশ্বাস নিয়ে যে প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই বুদ্ধের প্রকৃতি বর্তমান এবং তারা মুক্তিলাভের সম্ভাব্য সমস্ত প্রকৃতিরই প্রয়োগ করে থাকে। বৌদ্ধধর্মের 'হুয়া ইয়েন' সম্প্রদায় (অবতংশক সম্প্রদায়) তিয়েন তাইয়ের মতই ভারতীয় বৌদ্ধ রচনা অবতংশক সুত্রের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা শাক্যমুনির শিক্ষাকে প্রচার করে যাকে বুদ্ধ মহাবৈরোচনের প্রকাশ বলে মনে করা হয়। ত-সুন (৫৫৭-৬৪০ খ্রীঃ) এই সম্প্রদায়ের প্রথম শিক্ষক বলে মনে করা হয় এবং 'ফা সাং' (৬৪৩-৭১২) কে সম্প্রদায়ের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা যেতে পারে। হুয়া ইয়েনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর তাঁরা উপদেশ ও রচনা চৈনিক বৌদ্ধধর্মের বিকাশকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করেছিল। ২০

হুয়া-ইয়েন বৌদ্ধধর্মের ও দর্শনের সমষ্টিগত দৃষ্টির প্রতিনিধিত্ব করেন সেখানে Phenomena (Shil) এবং (noumena (li) পরস্পর অভিন্ন এবং পরস্পরের মধ্যে প্রবেশ করে। পারস্পরিক অভিন্নতাকে শূণ্যতাকে রূপ বলে মনে করা হয় এবং শূন্যতা হল সেইরূপ। তাই প্রতিটি ধর্মই একই সঙ্গে এক ও সবকিছু এবং প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই কারণে যখন একটি ধর্মের উৎপত্তি হয় তখন সমস্ত ধর্মের একই সঙ্গে উৎপত্তি হয় এবং এর বিপরীত ও সত্য।” অল্প কথায় সমস্ত বিশ্বের উৎপত্তি একই সঙ্গে ঘটে থাকে। এই বিশ্বব্যাপী কার্যকারণই হল হুয়াইয়েনে'র মূল ধারণা। এই সামগ্রিক ধারণা হুয়ান ইয়েন'কে 'তিয়েন তাই' সম্প্রদায় থেকে পৃথক করেছে যা 'সামঞ্জস্যের দৃষ্টি প্রকাশ করে।

হুয়া হিয়েন বৌদ্ধ সম্প্রদায়গুলিকে পাঁচটি যানে বিভক্ত করে যার মধ্যে হুয়া ইয়েন হল সর্বশেষ কারণ এটি হল মহাযান মতের নিখুঁত দর্শন যা অন্যান্য সবকটি যানের যোগফল।

বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান একটি সম্প্রদায় হল 'পিওর ল্যান্ড' সম্প্রদায় বা বিশুদ্ধভূমি যার প্রধান গ্রন্থটি হল সূখাবতীব্যুহসূত্র। মহাযানের অনুগামীদের বিশ্বাস সে সূখাবতী হল সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্বের একটি জগৎ যার শাসক হলেন অমিতাভ বুদ্ধ (অসীম আলোক)। এই জগৎকে পিওর ল্যান্ড বলা হয় কারণ এটি সমস্ত অকুশল থেকে মুক্ত এবং চিরন্তন সুখ ও আনন্দে পরিপূর্ণ। এটি হল সমস্ত প্রাণীর প্রতি অসীম ভালবাসা ও সহানুভূতি থেকে অমিতাভ বুদ্ধ দ্বারা সৃষ্টি পশ্চিমের স্বর্গ। যে কোন মানুষের যদি অমিতাভ বুদ্ধের উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস থাকে তাহলে বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের সাহায্যে পিওর ল্যান্ডে পুর্নজন্ম হয়। ২২

খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতক থেকেই পিওর ল্যান্ড হয়েছিল। 'তুই উয়ান' ছিলেন প্রাচীন ভক্তদের মধ্যে একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব। তারপর এলেন 'তান লুয়ান' (৪৭৬-৫৪২ খ্রীঃ)। 'তাও চো' (৫৬২-৬৪৫ খ্রীঃ) নামে অপর এক পিওর ল্যান্ড গুরু এটি শিক্ষা দিয়েছিলেন অমিতাভের শরণ নিয়ে, কেউই সমসাময়িক পৃথিবীর যা কিছু মন্দ থেকে উদ্ধার লাভ করতে পারে না। পরবর্তীকালে সান তাও এর মত শিক্ষকদের দ্বারা পূজা, বুদ্ধের বন্দনা করা, ইত্যাদি যুক্ত হয়েছিল। চীনের বৌদ্ধধর্মের ছেন (ধ্যান সম্প্রদায়) ধর্মগ্রন্থ বা দার্শনিক আলোচনাকে গুরুত্ব দিত না বরং কোন একজন শিক্ষকের অধীনে ধর্মীয় নিয়মানুবর্তিতা পালন করে কোন একজনের অন্তরের চেতনার শান্ত অভিজ্ঞতা লাভ করে মনের শান্তিলাভ করতে চাইত। বোধিধর্ম যিনি খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে ভারতবর্ষ থেকে চীনদেশে এসেছিলেন তাঁকেই ঐতিহ্যগতভাবে ছেন সম্প্রদায়ের প্রথম শিক্ষক বলে মনে করা হয়। লঙ্কাবতার সূত্র দ্বারা প্রচারিত অভ্যন্তরীন বোধিজ্ঞানলাভ যা বোধিধর্ম তাঁদের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন 'দক্ষিণ ছেন' অকস্মাৎ বোধিলাভ ও 'উত্তর ছেন' ক্রমশ বোধিলাভ ঘটিয়েছিল সপ্তমশতকে।২০ চীন দেশে ছেনের প্রচার খ্রীষ্টীয় নবম শতকে চীনের সাতটি সম্প্রদায় আবির্ভাব পর্যন্ত চলেছিল।

প্রথমে ছেন ছিল ধ্যানে বসার একটি অভ্যাস যা পরবর্তীকালে 'চিন্তার অনুপস্থিতি' এবং 'নিজের অকৃত্রিম প্রকৃতি' কে দেখাতে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে 'Pulice case' (Koan), বা একটি প্রশ্ন উত্তর পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যেখানে একজন ভক্তের প্রশ্নের মধ্যে থাকত প্রহার, চীৎকার এবং অদ্ভুত উচ্চারণ।

চীনের মতে, একটি মন মুক্ত ও স্বতঃ স্ফূর্তভাবে কাজ করতে পারে যখন এটিকে শান্ত হতে দেওয়া হয় যার ফলে বুদ্ধ প্রকৃতি প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ঘটে যা প্রতিটি অস্তিত্বের জাতিগত বৈশিষ্ট্যবিহীন ঐক্য ভাবে যদি কেউ সরাসরি নিজের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির দিকে তাকায় তাহলে বুদ্ধকে খুঁজে পাওয়া যাবে।

খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে চীনদেশে বৌদ্ধধর্মের স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে যায় এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়গুলিকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। বৌদ্ধ ভক্তরা আধুনিক যুগ পর্যন্ত কিছু পরিমাণে তাঁদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে গিয়েছিলেন একজন ভিক্ষুর বিহারভিত্তিক কর্তব্য পালন, দেশীয় ও বিদেশী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা, বৌদ্ধ ইতিহাস রচনা, বৌদ্ধ গ্রন্থতালিকার প্রস্তুতি, পিওর ল্যান্ড ও ছেন সম্প্রদায়ের বিজ্ঞপ্তিমাত্রায় নতুন আগ্রহের সঞ্চার বৌদ্ধধর্মের গুপ্ত সম্প্রদায় উত্থান বিশেষত 'শ্বেত পদ্ম' সম্প্রদায়।২৫ বৌদ্ধধর্মের সম্প্রদায়গত ও জনপ্রিয় আন্দোলন চৈনিকদের প্রায় সমস্ত বিষয়কেই প্রভাবিত করেছিল- ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, ভাষা, শিল্পকলা, চিত্রশিল্প, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতিবিজ্ঞান, ইত্যাদি... এবং একই সঙ্গে চৈনিক সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে এটি নিজেকেও সমৃদ্ধ করেছিল।২৬

আকর কুঞ্চিকা:

১. কনফুসিয়াস (জন্ম ৫৫১ খ্রীঃ পূঃ) ছিলেন একজন মহান শিক্ষক এবং চীনদেশের প্রাচীন দর্শন ও সংস্কৃতির একজন ব্যাখ্যাকার। তিনি এক হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে চৈনিকদের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্র ও সমাজের এক যুক্তিপূর্ণ শৃঙ্খলা খুঁজে পাওয়ার জন্য জেনের (মানবতা) আদর্শের মাধ্যমে নৈতিকতায় ফিরে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। তাঁর শিক্ষাকে অনুসরণ করেছিলেন পণ্ডিত রাজকর্মচারীরা, যারা হান যুগে কনফুসীয়বাদকে সৃষ্টিত্বের ধারণার সঙ্গে একটি দার্শনিক মাত্রা দান করেছিলেন। ডব্লিড দ্যা বেরি, "চৈনিক ঐতিহ্যের উৎস, কলম্বিয়া, ১৯৬০, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ১৯১-২২৭।

২. তাওবাদ লাওৎসু শিক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। তাওয়ের পথ হল সমস্ত প্রাণীর উৎস এবং সমস্ত পার্থক্যের মূল ঐক্য। নিখুঁত ব্যক্তি শান্তভাবে তাওয়ের পথকে অনুসরণ করে এবং নির্জন স্থানে বসবাস করেন। পরবর্তীকালের প্রকৃতির সঙ্গে ঐক্যের তাও দর্শনে পৃথিবীর এক আধ্যাত্মিক ও অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য লাভ করে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা এবং জীবন ও মৃত্যুর প্রতি নিস্পৃহতা। ধর্মীয় তাওবাদ জনপ্রিয় হয়েছিল দেবতা, অপরসায়ন এবং অমরতায় বিশ্বাস সঙ্গে নিয়ে।

৩. ই.জিরখার, বৌদ্ধধর্মের চীনদেশ বিজয় লেইডেন, ১৯৫৯, পৃঃ ১৯-২৮।

৪. কাশ্যপ মাতঙ্গ একজন ভারতীয়, বিয়াল্লিশটি বিভাগের সূত্র চৈনিক ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, শ্বেতাঙ্গ বিহারের ধর্মরক্ষের সাহায্যে, Nanjio Bunyo : A catalogne of the Chinese translations of the Buddhist Tripitaka, New Delhi, 1980, p 380.

৫. চাও সিয়াং কুয়াং। চৈনিক বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস, এলাহাবাদ, ১৯৫৫, পৃঃ ২১-২৪।

৬. Charles, S. Prebish, বৌদ্ধধর্মের ঐতিহাসিক অভিধান, দিল্লী, ১৯৯৫, পৃঃ ৫৯, ১১৩, ১৩৫-৩৬, ২১৪।

৭. A Link, তাও আনের জীবনী, তাও পাওতে, ৪৬ (১৯৫৮), পৃঃ ১-৪৮।

৮. Tao (way) for bodhi (Enlightenment), wu-weil (non-action), for nirvana (calmness, extinction) etc. বৌদ্ধ ও নব্য তাওবাদী দর্শনের মিশ্রণের জন্য দেখুন কেনেথ চেন, "নব্য ও তাওবাদ এবং প্রজ্ঞা সম্প্রদায়' চৈনিক সংস্কৃতি' ১ঃ ২ (১৯৫৭) পৃঃ ৩৩-৪৬।

৯. তাং ইয়ং চুং On tho yi হল সর্বপ্রাচীন পর্ব যার দ্বারা ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম এবং চৈনিক দর্শনের সংমিশ্রণ ঘটেছিল Radhakrishnan comparative studies in philosophy: 1940, পৃঃ ২৭৬-২৮৬।

১০. শূন্যতা ও প্রজ্ঞা হল মহাযানীর ধারণা যা পারমিতা সূত্রগুলি দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল। শূন্যতা বোঝায় যে বস্তুর নিজস্ব অস্তিত্ব নেই এবং এদের আপেক্ষিক অস্তিত্ব রয়েছে। হল সজ্ঞা মূলক জ্ঞান যা অন্তর্দৃষ্টি থেকে আসে। প্রজ্ঞা পারমিতা বা সর্ব্বোচ্চ শূন্যতা জ্ঞান নিয়ে গঠিত।

১১. কৈফিয়ৎ মূলক রচনা বিদেশী ব্যবস্থাকে সমর্থন করে বৌদ্ধধর্মকে গ্রহণ করার একটি রাস্তা যা শুধুমাত্র তার গুণগুলির প্রশংসাই করেনি সেই সমস্ত পথনির্দেশও দিয়েছিল যাতে এটি ছিল হয় কোন কোন দেশীয় ধারণা এবং তাদের ক্ষেত্রে পরিপূরক কোন ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তুলনীয় Buddhism in Chinese History 'Stanfored 1959, পৃঃ ৩৮-৩৯।

১২. কুমার জীবের জীবন ও কর্ম, কেনেথ চেন, Buddhism in China, Prinception, 1964 পৃঃ ৮১-৮৩।

১৩. প্রাগুক্ত, অধ্যায় VI.

১৪. হরিবর্মন রচিত সত্য সিদ্ধাশস্ত্র, এন অজয় স্বামীশাস্ত্রী, বরোদা, ১৯৭৮, ভূমিকা।

১৫. কোশ সম্প্রদায়, যোগেন ইয়ামাকামি, বৌদ্ধ চিন্তার রীতিনীতি, কোলকাতা, ১৯১২, পৃঃ ১০৯-১২৫, ১৪৩-১৬৫।

১৬. W.T. de Berry. Op. cit. পৃঃ ২৯৫-৩০৩।

১৭. শুয়াং জাঙ (৫৯৬-৬৬৪) ছিলেন একজন বিখ্যাত চৈনিক ভিক্ষু ও তীর্থযাত্রী যিনি বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়নের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন এবং বৌদ্ধ রচনা ও শিক্ষা সঙ্গে নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। তিনি ভারতবর্ষে যথেষ্ট ভ্রমণ করেছিলেন এবং তা লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাঁর 'তা তাং সি ইয়ু চি' (পশ্চিমের অঞ্চলগুলির নথিপত্র)। ৬৪৫ খ্রীষ্টাব্দে চীনদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি তাঁর পাণ্ডিত্যকে সেই সমস্ত গ্রন্থগুলির অধ্যয়ন ও অনুবাদ করার কাজে নিয়োজিত করেছিলেন যা তিনি ভারতবর্ষ থেকে চীন দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্ম বিশেষত যোগাচার সম্প্রদায় সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান, সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা, এবং সঠিক কলাকৌশলের প্রয়োগ তাঁকে বৌদ্ধ রচনার একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুবাদক ও শিক্ষকের স্বীকৃতি দিয়েছিল তিনি তাঁর শিষ্য কুয়েই চির সঙ্গে চীনদেশে বৌদ্ধধর্মের 'ওয়েই সি' সম্প্রদায় স্থাপন করেছিলেন।

১৮. কেনেথ চেন, 'চীনদেশে বৌদ্ধ ধর্ম' op. cit., পৃঃ ৩২৫-৩৩৫।

১৯. J. Takakusu, Essentials of Buddhist Philosophy, Delhi p. 1975, P. 126-142.

২০. ফা-সাং জীবন ও কর্ম, সিয়াং কুয়াং Op. Cit., পৃঃ ১৩৪-১৩৫।

২১. তাকাকুসু, op. cit., pp. 108-125.

২২. De Barry, op. cit., pp. 4-368.

২৩. ফুং ইউ লাং 'চৈনিক দর্শনের ইতিহাস' দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৩৮৬-৪০৬।

২৪. এইচ দাওমলিন, ছেন বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস, (ইং অনুবাদ) পি. পিচি. নিউইর্য়ক, ১৯৬৩।

২৫. চাও সিয়াং কুয়াং op. cit., পৃঃ ১৬২-২৩৮।

২৬. ছেন "চৈনিক ইতিহাসে বৌদ্ধধর্ম', অধ্যায় XXVII.

No comments:

Post a Comment