সুমনপাল ভিক্ষু
হিউমের দর্শন বুঝতে গেলে মনে রাখতে হবে যে হিউম একজন অভিজ্ঞতাবাদী বা প্রত্যক্ষবাদী দার্শনিক (Empiricist)। অভিজ্ঞতাবাদ
দর্শনের সেই ধারা যেটির অনুসারে সত্যজ্ঞান
কেবলমাত্র অভিজ্ঞতার
মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব। এই মতানুসারে
যে বিষয় সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সম্ভব নয় সেই বিষয়কে বস্তুগত ভাবে সত্য (objectively real) বলা যায় না।
আধুনিককালে
চিন্তার এই ধারার প্রবক্তা হিউমের পূর্ববর্তী
কিছু ইংরেজ চিন্তাবিদ যাঁদের মধ্যে Mill (মিল), Bentham (বেন্থাম), Locke (লক) এবং Berkeley (বার্কলে) র নাম অগ্রগণ্য। Mill প্রত্যক্ষবাদকে প্রধানত তর্কবিদ্যার
ক্ষেত্রে এবং Bentham নীতিবিদ্যার
ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। দর্শনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটেছে Locke (লক), Berkeley (বার্কলে) এবং হিউমের দ্বারা। এঁদের মধ্যে হিউমকে সর্বমুখ্য (most prominent) এবং সর্বাধিক সংগতিপূর্ণ
(most
consistent) চিন্তাবিদরূপে স্বীকার করা হয়; তিনি প্রত্যক্ষবাদকে তার ন্যায়িক সিদ্ধান্তে
পৌঁছে দিয়েছেন। পরবর্তীতে প্রতীচ্যের
দর্শনচিন্তার জগতে হিউমের বিশ্লেষণের
প্রভাব এতখানি বৈপ্লবিক ও সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠেছিল যে আমরা দার্শনিক
(কাল্ট) Kant-কে বলতে শুনি হিউমের চিন্তা Kant-এর মননশক্তিকে
সংস্কারের আচ্ছন্নতা
থেকে জাগিয়ে তুলেছে (His thought aroused me from my
dogmatic slumber) যে দুটি বিষয়ে হিউমের চিন্তাধারা পরিস্কার ভাবে ব্যক্ত হয় তার একটি কার্যকারণ
সম্বন্ধীয় এবং অপরটি দ্রব্য সম্বন্ধীয়। দুটি বিষয় সম্বন্ধেই
বৌদ্ধ চিন্তার সঙ্গে হিউমের চিন্তার সমতা লক্ষণীয় হয়ে ওঠে।
কার্যকারণ
বিষয়ে প্রথমেই মনে আসে যে এটি একটি সম্বন্ধসূচক
বিষয় (a relation) যেখানে দু'টি ঘটনা যুক্ত হয় যার একটিকে বলি কারণ, অপরটিকে কার্য। কারণ সেটি যেটি পুরোগামী, আগে ঘটে Precedent বা Antecedent আর কার্যটি অনুগামী বা পরে ঘটে; স্থান, কাল এবং পাত্র ভিন্ন কারণের ধারণা করা যায় না। বিশেষ
স্থানে, বিশেষ কার্যে, বিশেষ দুটি, পাত্র বা ঘটনা ভিন্ন কার্যকারণ সম্বন্ধের
ধারণা সম্ভব নয়। অতএব কাল বা time পরিবর্তন বা change ঘটনা বা occurrences কারণ-কার্য ধারণার পূর্বশর্তরূপে স্বীকার্য।
কারণ-কার্য সম্পর্কটিকে
বিশ্লেষণ করলে আমরা কতগুলি ধারণার (notion এর) সন্ধান পাই। এই সম্পর্কের
এক স্থানিক এবং একটি কালিক (spatial and temporal) দিক রয়েছে। কারণ ও কার্যের মধ্যে এক অবস্থানগত নৈকট্য (contiguity in
space) থাকতে হবে। কোলকাতার আকাশে মেঘ আর কাশ্মীর অঞ্চলে বৃষ্টির মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক ভাবা যাবেনা- দুটি ঘটনার মধ্যে বহু দূরত্ব রয়েছে। তেমনই কালগতভাবে
কার্য ও কারণের মধ্যে নৈকট্য বা পারম্পর্য থাকতে হবে। সাতদিন আগে গুরুভোজন করে আজ যদি অস্বস্তি বোধ করি দুই এর মধ্যে কার্যকারণ
সম্পর্কের কথা ভাবা যাবে না; মাঝখানে রয়েছে খাদ্য সম্পর্কিত বহু অন্যতর ঘটনা।
এই দুই ধারণার সঙ্গে আরও একটি ধারণা যুক্ত থাকে সেটি হল necessity বা আবশ্যিকতার
ধারণা; মনে করা হয় কারণের মধ্যে কিছু থাকে যার প্রভাবে কারণ আর কার্য অবিন্যস্ত
ভাবে সম্পর্কযুক্ত হয়। ফল ফলার আগে ফুল ফোটা, অঙ্কুর গজানোর আগে বীজ পোঁতা, বৃষ্টি ঝরার আগে মেঘ জমা ইত্যাদি পরের ঘটনার মধ্যে এক অনিবার্যতার সম্পর্ক রয়েছে।
হিউম তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্লেষণ করে দেখান যে কারণ আর কার্যের মধ্যে স্থানিক আর কালিক সম্পর্ক অভিজ্ঞতার
গোচরীভূত অতএব অনস্বীকার্য। তিনি প্রশ্ন তোলেন কারণ ও কার্যর মধ্যে আবশ্যিকতার সম্পর্ক বা অনিবার্য্যতা বিষয়ে। আমরা ফুল ফোটার ঘটনা দেখি, তারপর কিছু সময় গত হলে সেই স্থানে ফল ধরার ঘটনা দেখি। কিন্তু ফুলের মধ্য থেকে কোন শক্তি বা প্রভাব সঞ্চারিত হয়ে ফল ফলায়-এমন আমাদের অভিজ্ঞতায় কখনোই আসেনা। বারবার দুটি ঘটনার নৈকট্য ও পারম্পর্য লক্ষ্য করে তাদের মধ্যে আবশ্যিকতার
সম্পর্ক আমরা ধারণা করি বা অনুমান করিমাত্র। তাঁর billiard ball এর উদহারণটা বিশ্লেষণ করে হিউম দেখান billiard খেলার সময় আমরা দেখি একটি ball অপর একটিকে যখন আঘাত করে তখন দ্বিতীয় বলটি গতিশীল হয়ে ওঠে। এখানে আমরা দুটি ball-এর সংযোগের ঘটনাই প্রত্যক্ষ করি। প্রথম বলটি থেকে নিশ্চিতভাবে
কিছু সঞ্চারিত হওয়ার কোন ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করিনা; শক্তি সঞ্চরণের বা আবশ্যিকতার
বিষয়টি সম্পূর্ণ মনোজাত, ঘটনার ওপরে ধারণার আরোপণ মাত্র।
Substance (পদার্থ):
পাশ্চাত্য
দর্শনে substance বা পদার্থ কে বলা হয় The
substratam of a thing where experienced or cognizabe qualities or attributes
are conceived to inhere in. It is the unseen core of a thing which holds the
qualities together. সহজ ভাবে বলা যায় এটি কোন বস্তুর অন্তঃস্থ অদৃশ্য সাররূপ যেখানে গুণসমূহ আশ্রিতরূপে থাকে। যেমন লাল রঙ, সুন্দর গন্ধ, কোমল স্পর্শ একটি ফুলের এই গুণগুলি হাওয়ায় ভাসেনা, একটি ফুলে সংহতভাবে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন এই গুণগুলির যেটি আধার বা আশ্রয় তাকেই বলা হয় পদার্থ Substance বা Substratum। ভারতীয় দর্শনে এটিকে বলা হয় দ্রব্য এবং এটিকে গুণাবলী ও কর্মসমূহের
আধার রূপে ধারণা করা হয়। স্পষ্টতঃই
দ্রব্য এবং বস্তু এক নয়; গুণযুক্ত দ্রব্য বস্তুরূপে
গণ্য, অপরদিকে দ্রব্যকে বস্তুসার বলা যেতে পারে। দুই প্রকার গুণ বাহ্য ও আন্তর- সেই অনুযায়ী দুই প্রকার দ্রব্যের ধারণা করা হয় জড়দ্রব্য ও চেতনদ্রব্য।
হিউম তাঁর প্রত্যক্ষবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্লেষণ করে দেখান substratum বা বস্তুসাররূপে জড় বা চেতন কোন প্রকার দ্রব্যের বাস্তব অস্তিত্ব নেই। আমরা যখন কোন বস্তু দেখি তখন প্রকৃতপক্ষে সেই বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন গুণ প্রত্যক্ষ করি; গুণগুলির অতিরিক্ত কোন বস্তুসত্ত্বার প্রত্যক্ষ হয়না। গুণগুলির একত্র অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য substance বা দ্রব্যের ধারণা করি মাত্র।
চেতনসত্ত্বা
বা mental substance এর ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইরূপ। মানসিক অবস্থা বা ক্রিয়াগুলির emotion, volition এবং cognition (অনুভব, ইচ্ছা ও মনন) এর ধারক এবং কারকরূপে এক মনোদ্রব্য বা চেতন দ্রব্যের ধারণা করা হয়। হিউম বলেন যখন আমরা আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করার চেষ্টা করি তখন আমরা কোন না কোন মনের ভাব বা অবস্থার সাক্ষাৎ পাই, মন রূপ কোন বিষয় বা দ্রব্যের যাকে self বা soul বলা হয় তার সাক্ষাৎ পাইনা।
এইভাবে হিউম সকল প্রকার (পদার্থ) substance বা দ্রব্যের বাস্তব অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। বৌদ্ধ অনাত্মবাদ এবং নামরূপ এর ধারণার সঙ্গে এই মতের সাম্য প্রকৃতই প্রণিধানের যোগ্য বিষয়। হিউম 'কার্যকারণ'কে 'স্বাভাবিক সম্বন্ধ' ও 'দার্শনিক সম্বন্ধ' (philosophical relation) এই দ্বিবিধ অর্থেই গ্রহণ করেছেন। স্বাভাবিক সম্বন্ধ এমন গুণ নির্দেশ করে যার সাহায্যে দুটি ধারণা কল্পনায় যুক্ত হয়। এই অর্থে অনুষঙ্গের
নিয়মগুলি স্বাভাবিক
সম্বন্ধের অন্তর্গত।
দার্শনিক সম্বন্ধে সামান্যতম সাদৃশ্য থাকলে দুটি ধারণাকে তুলনা করার স্বাধীনতা
ব্যক্তির থাকে।
হিউম কার্য-কারণ সম্বন্ধের বিশদ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন যে, এই সম্বন্ধের ভিত্তিতে ইন্দ্রিয়ের সম্মুখে উপস্থিত নয় এমন বাস্তব ঘটনা বিষয়ে আমরা অনুমান করি।
বৌদ্ধ দার্শনিকরাও হিউম-এর মতই বলেন যে প্রত্যক্ষসমূহের কোন আশ্রয়ের প্রয়োজন নেই। নৈয়ায়িকরা
সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যুক্তি জাল বিস্তার করে দেখাচ্ছেন
যে বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রভৃতির আশ্রয় আত্মা ভিন্ন অন্য কোন দ্রব্য হতে পারে না। পৃথিবী, জল, বায়ু প্রভৃতি দ্রব্যকে এইসব গুণের আধার বলে মনে না হলেও অন্তঃকরণ নামক দ্রব্যে এরা সমবেত হয়ে থাকে এটা ভাবা অস্বাভাবিক
নয়। নৈয়ায়িক এর বিপক্ষে বলেন অন্তঃকরণ একটি ইন্দ্রিয় মাত্র যার সাহায্যে আমাদের সুখ, দুঃখের অনুভব হয় ঠিক যেমন চক্ষুরিন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা দেখি। চক্ষুরিন্দ্রিয় কিন্তু নিজেকে দেখে না। কোন ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য ধর্মের আশ্রয় হতে পারে না।
কার্যকারণ
সম্বন্ধের ব্যাপারে হিউম এর বহুল পরিচিত বক্তব্যের সংক্ষেপ হল- ক) কোন কারণ থেকে তার নির্দিষ্ট কার্য যে অবশ্যই উৎপন্ন হবে একথা কোন পূর্বসিদ্ধ যুক্তির দ্বারা প্রমাণযোগ্য
নয়, কারণ এর অস্বীকৃতির
মধ্যে কোন স্ববিরোধ নেই, খ) সুতরাং দুটি ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ
সম্বন্ধ আছে জানতে হলে অবশ্যই অভিজ্ঞতার
উপর নির্ভর করতে হবে। গ) কিন্তু অভিজ্ঞতায় আমরা যতটুকু পেতে পারি তা হল, বড়জোর দুটি ঘটনার মধ্যে ১) সান্নিধ্য (contiguity) ২) পৌবাপর্য (succession) এবং ৩) নিয়ত সাহচর্য (consont conjunction) এর চেয়ে বেশীকিছু অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়। ঘ) অপরদিকে ঐ দৃষ্ট নিয়ত সাহচর্য যে বস্তুতপক্ষে আবশ্যিক সাহচর্য (that the observed constant
conjunction is really a necessary conjunction) একথা প্রমাণযোগ্য হবে না যদি আমরা ধরে নিই যে ভবিষ্যৎ সর্বদা অতীতেরই অনুরূপ হবে। অথচ এটা ধরে নিয়ে অভিজ্ঞতার
ভিত্তিতে কার্য ও কারণের মধ্যে ব্যতিক্রমহীন সাহচর্য আছে। এ সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা
করতে গেলে সাধ্য সিদ্ধি বা চক্রক দোষ হবে। ঙ) আমাদের সমস্ত জ্ঞানই বিভিন্ন ধারণার সম্বন্ধের উপর নির্ভরশীল (relations of ideas) এবং পূর্বতঃসিদ্ধ সত্যরূপ প্রমাণযোগ্য কিংবা বাস্তব তথ্য ভিত্তিক (matters of fact) কিন্তু (ক)-(ঘ) এর থেকে আমরা যে কার্যকারণের অবশ্যম্ভাবিত্য পাই তা পূ বতঃসিদ্ধও নয় আবার অভিজ্ঞতার
মাধ্যমেও লভ্য নয়।
এবার আমরা হিউম এর কার্যকারণ
সম্বন্ধের সঙ্গে বৌদ্ধ কার্যকারণ
তথা প্রতীত্যসমুৎপাদবাদ এবং হিউম যে দ্রব্যের বাস্তব অস্তিত্ব অস্বীকার করেন বা বৌদ্ধ অনাত্মবাদ
এবং নামরূপের ধারণার সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
বুদ্ধ পৃথিবীর অন্তর্গত রহস্যকে উদ্ঘাটন করে প্রথম দুঃখবাদ এবং দুঃখনিরোধবাদ প্রচার করেন। বৌদ্ধধর্মে
এই দুঃখবাদ তথা দুঃখনিরোধবাদ চারটি আর্যসত্যে সন্নিহিত করা হয়েছে। যদি বলি দুঃখের কারণকে বিশ্লেষণ করতে দুঃখ সমুদয় এই দ্বিতীয় আর্যসত্যের একটি সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করা হয়। এই সিদ্ধান্তকে
প্রতীত্যসমুৎপাদ (Dependent origination বা Cause and
effect) বলা হয় প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করলে প্রতীত্য এবং 'সমুৎপাদ' এই দুটি শব্দের সমাস পাওয়া যায়। 'প্রতীত্য'
পদের অর্থ 'কোন বস্তু উপস্থিত হলে পর' (Depending) 'সমুৎপাদ' শব্দের অর্থ 'অন্য কোন বস্তুর উৎপত্তি'
(Origination। সুতরাং সমস্ত পদটির অর্থ হচ্ছে 'একটি বস্তুর উপস্থিতিতে (আগমনে) অন্য কোন বস্তুর উৎপত্তি'।
প্রতীত্যসমুৎপাদকে দ্বাদশ নিদান, বা হেতু বা কার্য কার্যকারণ
শৃঙ্খলও বলা হয় (Twelve condition)। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে দ্বাদশ নিদান প্রত্যেকটি এক একটি সর্ত। এই সর্তটি বাস্তবায়িত না হলে, পরবর্তী সর্তটি প্রত্যক্ষীভূত হবে না। দুঃখের কারণের এক একটিকে নিদান বলা হয়। এই নিদান বা হেতুর সংখ্যা বারো। প্রথম 'জরামরণ' ও অন্তিম 'অবিদ্যা'কে বাদ দিয়ে অন্যান্য দশটি নিদানকে কখনো কর্মও বলা হয়।
দ্বাদশ নিদানের নামান্তর
'সংসার চক্র' (Wheel of the world)। কেননা এই প্রতীত্যসমুৎপাদে মানুষের সংসারে যাতায়াত বা জন্মমৃত্যু
কিভাবে হয় তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর অন্য নাম 'ভবচক্র' (Wheel of
existence)। কেননা এই সিদ্ধান্তে
মানুষের অস্তিত্ব বিচার করা হয়েছে। একে জন্ম মরণ চক্র'ও (Cycle of
birth and death) বলা হয়, কেননা এই সিদ্ধান্ত জীবের জীবনমৃত্যুর চক্রকে নিশ্চিত করে। একে ধর্মচক্রও
বলা হয়। কেন কি এটি ধর্মের বা নিয়মের স্থান গ্রহণ করেছে। প্রতীত্যসমুৎপাদের বারোটি নিদান অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনকে ব্যপ্ত করে রয়েছে। অবিদ্যা ও সংস্কার অতীত ক্ষণের সাথে সম্বন্ধযুক্ত, জরামরণ ও জাতির সম্বন্ধ ভবিষ্যৎ জীবনের সাথে এবং অবশিষ্টের
সম্বন্ধ বর্তমানের
সাথে। নিদানগুলি
হলো দুঃখের কারণ। বুদ্ধের প্রদর্শিত অষ্টাঙ্গিক
মার্গের অনুশীলনে তৃষ্ণার ক্ষয় হয় এবং ক্রমে অবিদ্যার ক্ষয় হয়।
প্রতীত্যসমুৎপাদে সর্বপ্রথম কর্মবাদের স্থাপনা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকারণরূপে তিনটি জীবনকে ব্যপ্ত করেছে। বর্তমান জীবন হচ্ছে অতীত জীবনের কর্মফল এবং ভবিষ্যৎ জীবন বর্তমানে জীবনের কর্মফলের দরুন উদ্ভূত হয়। এখানে কর্মবাদের
গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছে। প্রতীত্যসমুৎপাদ হতে অনিত্যবাদের স্থাপনা হয়েছে এবং এই অনিত্যবাদ
আবার ক্ষণিকবাদে
পরিবর্তিত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত
অনুসারে প্রত্যেক বস্তু কারণ হতে উৎপন্ন হয়, কারণ নিরুদ্ধ হলে বস্তুটির ধ্বংস হয় ও তাঁর অন্য রূপে পরিবর্তন হয়। এভাবে নিত্য ও স্থায়ী বস্তু অনিত্য ও অস্থায়ী হয়ে যায়।
প্রতীত্যসমুৎপাদ নামক সিদ্ধান্তটি বৌদ্ধদর্শনে
অনাত্মবাদের (Theory of Noself) স্থাপনায় সহায়ক হয়। বিশ্বের প্রত্যেক বস্তু ক্ষণিক হওয়ায় চিরস্থায়ী
সত্তারূপে আত্মা স্বীকার করা সমীচীন নয়। অতএব প্রতীত্যসমুৎপাদকে বৌদ্ধদর্শনের কেন্দ্রবিন্দু বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রতীত্যসমুৎপাদ অনুসারে প্রত্যেক বস্তু কারণানুসারী হয়ে থাকে। কারণের নাশে বস্তু কার্যের নাশ হয়। প্রত্যেক বস্তু হচ্ছে অনিত্য (কৃত্তক)। প্রতীত্যসমুৎপাদ সিদ্ধান্তটি অনিত্যবাদে প্রতিফলিত
হয়েছে। বুদ্ধ অনিত্যবাদের প্রসঙ্গে বলেছেন, 'যে বৃদ্ধ হতে পারে, সে বৃদ্ধ হয়ে থাকে। যে রোগী হবে সে রোগী হয়ে থাকে। যে মৃত্যুর অধীন সে অবশ্য মারা যাবে। যা নশ্বর তার নাশ অত্যাবশ্যক
হয়ে থাকে...'
(অঙ্গুত্তর নিকায় ২য় খণ্ড)।
অনিত্যবাদ
হলো নিত্যবাদ
(Eternalism) ও উচ্ছেদবাদের (Nihilism) মধ্য মার্গ। 'প্রত্যেক বস্তু হচ্ছে সৎ' এটি হচ্ছে একান্তিক মত এবং 'প্রত্যেক বস্তু হচ্ছে অসৎ' এটি হচ্ছে অন্য একান্তিক মত। জীবনকে পরিবর্তনশীল বলে শুদ্ধ সৎ (Being) ও অসতের (No being) সমন্বয় হয়েছে।
অনিত্যতার
প্রবল প্রবাহে বস্তুর অত্যন্ত পরিবর্তিত হবার পরও সেই নামে প্রসিদ্ধি
থাকে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের স্বার্থ সাধনা। যে যাবৎ আমাদের তৃষ্ণার অন্ত হয় না সে যাবৎ 'সৎকায় দৃষ্টি' অর্থাৎ 'বস্তুটি সেই' এরূপ প্রতীতির অবিদ্যা অব্যাহত থাকে এবং আমাদের মানসিক ও ভৌতিক অবস্থার অনিত্যতা চোখে পড়ে না।
মানুষের মধ্যে শুদ্ধ এক সত্তা থাকে না, কিন্তু সে মানসিক (Mental) ও ভৌতিক (Material) অনেক অবস্থার সমুদয় মাত্র; যা অবিচ্ছিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়ে থাকে। সমস্ত ভৌতিক অবস্থাকে সমষ্টিগতভাবে রূপ এবং মানসিক অবস্থা সমূহকে 'নাম' বলা হয়। নামের তিনটি অবস্থা। ১. বেদনা: বিষয়ের স্পর্শ (সম্বন্ধ) হতে যে সুখ -দুঃখ, সৌমনস্য, দৌর্মনস্য বা উপেক্ষা অনুভূতি হয় তাকে সামগ্রিকভাবে 'বেদনা' বলে। ২. সংজ্ঞা: বিষয়েক যে এরূপ করে জানা হয় তা হচ্ছে সংজ্ঞা। ৩. সংস্কার: বিতর্ক, বিচার, লোভ, দ্বেষ, করুণা ইত্যাদি মানসিক প্রবৃত্তিকে
একসাথে সংস্কার বলে। পাপ পুণ্য ইত্যাদি যত প্রকার চিত্ত আছে সকলকে এক সাথে বিজ্ঞান বলা হয়। এভাবে মানুষ হচ্ছে পাঁচ অবস্থায় সমুদয়। এদেরকে পঞ্চস্কন্ধ
বলা হয়। যেমন রূপস্কন্ধ,
বেদনাস্কন্ধ, সংজ্ঞাস্কন্ধ, সংস্কারস্কন্ধ ও বিজ্ঞান স্কন্ধ।
অনাত্মবাদকে
পুদ্গল প্রতিষেধবাদও বলা হয়। আত্মা বা পুদ্গল বস্তুসৎ নয় একথা বৌদ্ধ দার্শনিকগণ বলেন। বুদ্ধের বচন অনুসারে সংসারের সমস্ত বস্তু হচ্ছে ক্ষণিক। তাঁর মতে কোন বস্তুই দ্বিতীয় ক্ষণে এক থাকে না। আত্মা ও অন্য বস্তুর মত পরিবর্তনশীল। যদি আত্মায় অর্থ স্থায়ী তত্ত্বে বিশ্বাস করা হয় তবে বুদ্ধের উপযুক্ত মতকে অনাত্মবাদ
বলা যায়। কেননা তাঁর মতে স্থায়ী আত্মায় বিশ্বাস করা এক প্রকার ভ্রম। বুদ্ধ শাশ্বত আত্মাকে নিষেধ করে বলেছেন যে, বিশ্বে না কোন আত্মা বা আত্মার মত অন্য কোন বস্তু আছে। পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের আধার স্বরূপ হচ্ছে মন বা মনের বেদনা। এদের অতিরিক্ত আত্মা বা আত্মাসদৃশ কোন বস্তু নেই।
বুদ্ধের মতে একটি জীবন থেকে অন্য কোন জীবনে আত্মার প্রবেশ সম্ভব নয়, কেবল ঘটনা পরম্পরায় নূতন জীবনের উদ্ভব হয়। তিনি অস্থায়ী শরীর ও মনের সংকলনমাত্রকে আত্মা বলে স্বীকার করেছেন। উইলিয়ম জেমস্ বুদ্ধের মত বিজ্ঞান প্রবাহকে আত্মা বলেছেন। যেমন নদীর জলে বুদ্বুদ নিরন্তর পরিবর্তিত হতে থাকলেও তাতে একময়তা থাকে সেরূপ আত্মার বিজ্ঞানে নিরন্তর পরিবর্তন হলেও তাতে একময়তা থাকে। সে কারণে প্রত্যভিজ্ঞান প্রভৃতির অনুপত্তি হয় না।
নাগসেন আত্মার স্বরূপ ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, যেমন চাকা, রজ্জু, ধুর প্রভৃতি অবয়বের সমুদয় হচ্ছে রথ সেরূপ রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানস্কন্ধের সমুদয় হচ্ছে আত্মা। এই পঞ্চস্কন্ধ
ব্যতিরেখে আত্মা বলে কিছু নেই। এই স্কন্ধগুলি পরিবর্তনশীল
বলে আত্মাও পরিবর্তনশীল। একে দার্শনিক ভাষায় নৈরাত্মবাদ বলা হয়েছে।
বুদ্ধ অনিত্য আত্মার সত্যতা প্রমাণিত করেছেন। বুদ্ধ দৃশ্য জীবের সত্যতা স্বীকার করেছেন, কিন্তু উপনিষদে দৃশ্যাতীত
আত্মাকে সত্য বলে স্বীকার করা হয়েছে।
ডেভিড হিউমের আত্মবিচারে
বুদ্ধ সম্মত আত্মার প্রতিধ্বনি
শোনা যায়। কোন সময়ে সংবেদনের অতিরিক্ত আত্মা অবগত হয় না, কেবল সংবেদন অবগত হয়। বুদ্ধের মত হিউমও আত্মা নামক নিত্য দ্রব্যের খণ্ডন করেছেন। বৌদ্ধ দার্শনিকদের মত বাৎসীপুত্রীয় ছিলেন পুদ্গলবাদী। তিনি বলেন যে, আত্মা স্কন্ধ হতে অভিন্ন বা ভিন্ন নয়। তাঁর মতে পুদ্গলের কারিত্র থাকে না, কেবল বিত্তের কারিত্র থাকে। যদি পুদ্গল ভাব হয় তবে তাকে স্কন্ধ হতে অন্য কিছু বলতে হয়, কেননা তার লক্ষণ ভিন্ন। তা যদি হেতু প্রত্যয়ের দ্বারা উৎপন্ন হয় তবে তাকে শাশ্বত ও অধিকারী বলা যাবে না।
যদি তা অসংস্কৃত হয় তবে তাতে অর্থক্রিয়ার
যোগ্যতা থাকবে না, তার কোন প্রয়োজন নেই। তাঁর মতে পুদ্গল স্কন্ধ হতে অনন্য বা অন্য নয়। যদি তা স্কন্ধ হতে অন্য হয় তবে তা নিত্য ও অসংস্কৃত হবে। আর যদি স্কন্ধ হতে অনন্য (অভিন্ন) হয় তবে তার উচ্ছেদ প্রসঙ্গ হবে।
কিন্তু উপসংহারে বলতে হয়- এক কথায় হিউম কার্য-কারণ তত্ত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। তাঁর দৃষ্টিতে কারণ এবং কার্য নিছক পরিবর্তনের কথা বলে এবং সেক্ষেত্রে কারণ ও কার্য একে অন্যের সন্নিহিত। কিন্তু কারণের মধ্যে কার্য উৎপাদনের কোন শক্তি নিহিত নেই। এই কথাই হল হিউমের কথা।
এই প্রসঙ্গে শান্তরক্ষিত
এবং কমলশীলের কার্য-কারণ তত্ত্ব অনুধাবন যোগ্য। তাঁরা ক্ষণবাদে বিশ্বাসী।
যদি একটি বস্তু বা ব্যক্তি অসংখ্য ক্ষণ বা ধর্মের পরম্পরা হয় সেক্ষেত্রে
একটি ক্ষণ কি করে কোন কিছু উৎপাদন করার জন্য সময় পাবে। অতএব যেকোন সৃষ্টি বাস্তব নয় বা সত্য নয়। কোন কার্যের কর্তা নেই এবং কারণও থাকে না। একটি ঘটনা কতগুলি অন্য শর্তের উপর নির্ভরশীল
বা প্রতীত্যসমুৎপাদ। শান্তরক্ষিত এবং কমলশীল মনে করেন এর কারণ কতগুলি ঘটনা বা শর্ত যা এর আবির্ভাবের আগেই সংগঠিত হয়েছে। এর আবির্ভাব এই শর্তের উপর নির্ভরশীল।
এই শর্তগুলিও
আবার বিভিন্ন পূর্ববর্তী শর্তের উপর নির্ভরশীল।
কাজেই কোন শর্ত Substance নয়। এবং কোন পূর্ববর্তী ঘটনার মধ্যে কোন অনির্দেশ্য শক্তি বা কল্পনা করা যায় না যা ঘটনাকে রচনা করেছে।
প্রসঙ্গত শর্ত বা condition ও cause বা কারণের পার্থক্যটি
আমাদের স্পষ্ট করে বোঝা দরকার। কারণ এমন একটি ঘটনা বা অবস্থা যার মধ্যে কার্য উৎপাদন করার ক্ষমতা নিহীত আছে। অন্য পক্ষে condition বা শর্ত এমন একটা ঘটনা বা অবস্থাকে ব্যাখ্যা করে। কিন্তু এই শর্তের সঙ্গে পরবর্তী ঘটনা বা কার্যের কোন অনির্দেশ্য সম্পর্ক নেই।
আকর কুঞ্চিকা
১. সুনীল কুমার সরকার, ফ্রয়েড, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কোলকাতা ২০১২।
২. রমাপ্রসাদ সেন, হিউমের ইক্যুয়ায়ী
একটি উপস্থাপনা,
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কোলকাতা, ২০০৮।
৩. প্রহ্লাদ কুমার সরকার (সম্পা.) কাল্টের দর্শন, দর্শন ও সমাজ, বালি, হাওড়া, ২০১০।
৪. দিলীপকুমার মোহান্ত, মধ্যমকদর্শনের রূপরেখা ও নাগার্জুকৃত
সবৃত্তিবিগ্রহব্যার্বতনী, মহাবোধি বুক এজেন্সি, কোলকাতা, ২০০৬।
৫. দিলীপকুমার মোহান্ত, নাগার্জুনকৃত সবৃত্তিশূন্যতাসপ্ততি, রামকৃষ্ণমিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, বেলুড় মঠ, হাওড়া, ২০০১।
৬. মধুমিতা চট্টোপাধ্যায়, নাগার্জুনের দর্শন পরিক্রমা,
মহাবোধি বুক এজেন্সি, কোলকাতা ২০১৫।
৭. আচার্য বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির, বৌদ্ধদর্শনে সত্য-দর্শন, ধর্মাধার বৌদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশনী, কোলকাতা, ১৯৯৫।
৮. প্রহ্লাদ কুমার সরকার (সম্পা.) ডেভিড হিউমের দর্শন, দর্শন ও সমাজ ট্রাস্ট, কোলকাতা, ২০১১।
No comments:
Post a Comment