Thursday, June 19, 2025

চীনের বৌদ্ধধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়, দেবদেবী এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা


সুমনপাল ভিক্ষু


ইতিহাস:

বিভিন্ন কিংবদন্তি থেকে অতি প্রাচীনকালে চীনের মাটিতে বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। যদিও পণ্ডিতরা এই বিষয়ে সহমত যে ভারতবর্ষ থেকে আগত ধর্ম প্রচারকদের মাধ্যমেই প্রথম শতকে হান বংশের রাজত্বকালে বৌদ্ধ ধর্ম চীনে এসেছিল তবুও বৌদ্ধধর্ম ঠিক কবে চীনে প্রবেশ করেছিল তা এখনও সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।

প্রজন্ম ধরে পণ্ডিতমহলে মতানৈক্য রয়েছে যে, বৌদ্ধ ধর্ম সমুদ্র পথে নাকি রেশম পথ ধরে স্থলভাগের উপর দিয়ে চীন দেশে প্রবেশ করেছিল। লিয়াং কি চাও এবং পল পেলিয়টের দ্বারা সমর্থিত সমুদ্রপথের তত্ত্বটিতে বলা হয়েছে যে বৌদ্ধধর্ম দক্ষিণ চীনে ইয়াং-সি নদী ও হুয়াংহু নদী অঞ্চলে প্রথমে অনুসৃত হত। অন্য মতটি হল বৌদ্ধ ধর্ম খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে কাং-সু করিডর হয়ে পীত হলুদ নদী অববাহিকা ও উত্তর চীন সমভূমিতে প্রবেশ করেছিল। ছবিটি স্পষ্ট হয় দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যখন প্রথম জ্ঞাত ধর্মপ্রচারকরা রাজধানী লো-ইয়াং এ তাঁদের অনুবাদের কাজ শুরু করেছিলেন। The Book of the Later Hun গ্রন্থে বলা হয়েছে যে ৬৫ খ্রিস্টাব্দে চু (বর্তমান চিয়াং-সু)র রাজকুমার লিউ-ইং 'হুয়াং-লাও তাওবাদ" অনুশীলন করে আনন্দ পেতেন। তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু ও গৃহী মানুষ উভয়কে তাঁর রাজসভায় ঠাঁই দিয়েছিলেন যাঁরা বৌদ্ধ আচার অনুষ্ঠানগুলিকে পরিচালনা করতেন। তাং ইয়াং-তং দ্বারা সমর্থিত স্থলপথ তত্ত্ব অনুসারে, বৌদ্ধধর্ম মধ্য এশিয়া বিশেষত কুষাণ সাম্রাজ্যের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল যেটি প্রায়শই প্রাচীন চৈনিক উৎসে পরিচিত হয়েছিল তা ইউচি (বা মহান ইউচি) নামে এবং এটি হয়েছিল প্রতিষ্ঠাতা উপজাতিদের নামে। এই তত্ত্ব অনুসারে, বৌদ্ধধর্ম প্রথম অনুসৃত হয় চীনদেশের পশ্চিম প্রান্তে এবং হান রাজবংশের রাজধানী লো-ইয়াং (বর্তমান হেনান) এ যেখানে সম্রাট মিং-তি ৬৮ খ্রিস্টাব্দে শ্বেতাশ্ব (পাই-মা-শ্চি) বিহার নির্মাণ করেছিলেন।

 

২০০৪ সালে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক রং চিনচিয়াং গান্ধারীয় বৌদ্ধ রচনাসহ বর্তমান আবিষ্কার ও গবেষণার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্থলপথ ও সমুদ্রপথের তত্ত্বটিকে পুনরায় পরীক্ষা করেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে বৌদ্ধধর্ম জলপথে প্রচারিত হয়েছিল এই তত্ত্বের জোরালো প্রমাণের অভাব রয়েছে এবং কোন কোন যুক্তি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঐতিহাসিক গ্রন্থ এবং ১৯৮০-র দশক থেকে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক মূর্তিবিষয়ক উপাদান বিশেষত সম্প্রতি আফগানিস্তানে প্রাপ্ত প্রথম শতাব্দীর বৌদ্ধ পুঁথির উপর ভিত্তি করে ভাষ্যকার মত ব্যক্ত করেন যে সবচেয়ে সম্ভাব্য তত্ত্ব হল বৌদ্ধধর্ম উত্তর-পশ্চিম ভারতের বৃহত্তর ইউচি থেকে স্থলপথে হান রাজত্বকালে চীনে প্রবেশ করেছিল। চীনদেশে প্রবেশ করে বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন তাওবাদ এবং ঐতিহ্যবাহী চৈনিক শিল্পকলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।

ফরাসি চীনতত্ত্ববিদ মাসপেরো বলেন যে 'এটি একটি অত্যন্ত কৌতূহলজনক বিষয়, যে সমগ্র হান রাজবংশ জুড়ে তাওবাদ ও বৌদ্ধধর্মকে 'বারংবার মিশিয়ে ফেলা হয়েছিল এবং এগুলিকে অভিন্ন ধর্ম বলে মনে করা হয়েছিল।' এক শতক পর রাজকুমার লিউ ইয়াং-এর রাজসভা তাওবাদী ও বৌদ্ধ উভয়কেই সমর্থন করেছিল। ১৬৬ খ্রিস্টাব্দে হান রাজবংশের সম্রাট হুয়ান বুদ্ধকে পূজা এবং হুয়াং-লাও দেবতা পীত সম্রাট এবং লাওৎজিকে অর্ঘ্য দান করেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রথম চৈনিক প্রবক্তা দ্বিতীয় শতকের শেষদিকের গৃহী বৌদ্ধ মেডিজি বলেন যে তাওবাদের মাধ্যমেই তিনি বৌদ্ধধর্মের দিকে পরিচালিত হন- এবং এটিকে তিনি তা-তাও (্যা মহান তাও) আখ্যা দিয়েছেন।

ঐতিহ্যশালী বিবরণ:

ঐতিহাসিক চৈনিক সাহিত্যে প্রাপ্ত অনেকগুলি জনপ্রিয় বিবরণ চীনদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তন সম্পর্কে অনেকগুলি জনপ্রিয় কিংবদন্তির সৃষ্টি করেছে। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুসারে, হান রাজবংশের সম্রাট মিং-তি (২৮ খ্রিঃ ৭৫ খ্রিঃ) চীনদেশে বুদ্ধের শিক্ষার প্রবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। প্রাচীন মৌচি লিউলিন (খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতকের প্রথমার্ধ থেকে খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকের প্রথম) এ প্রথম এই কিংবদন্তিটি লিপিবদ্ধ করা হয়। এই কিংবদন্তিটি অনুসারে, প্রাচীনকালে সম্রাট মিং-তি স্বপ্নে একজন সুপুরুষকে দেখেছিলেন যাঁর দেহে সূর্যের ঔজ্জ্বল্য ছিল এবং যিনি তাঁর প্রাসাদের সামনে উড়ছিলেন। এই দৃশ্য দেখে মিং-তি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। পরের দিন তিনি তাঁর কর্মচারীদের প্রশ্ন করলেন, "উনি কোন মহান পুরুষ?” পণ্ডিত ফু-ই বললেন, "আপনার প্রজারা একথা শুনেছেন যে ভারতবর্ষে একজন মানুষ রয়েছে যিনি মহানত্ব অর্জন করেছেন। তিনি আকাশে ওড়েন। তাঁর দেহে সূর্যের ঔজ্জ্বল্য রয়েছে; ইনি নিশ্চয়ই সেই মহান পুরুষ।"

তারপর সম্রাট তিয়ান-জুতে (দক্ষিণ ভারত) বুদ্ধের শিক্ষার সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য দূত পাঠালেন। কথিত আছে, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলিকে শ্বেত অশ্বের পিঠে করে চীনদেশে পাঠান হয়েছিল এবং এদের নামানুসারে একটি বিহারের নাম রাখা হয়েছিল শ্বেতাশ্ব বিহার। তাদের সঙ্গে দুজন ভারতীয় ভিক্ষু চীনদেশে গিয়েছিলেন। তাঁরা হলেন ধর্মরত্ন বা ধর্মরক্ষা ও কাশ্যপ মাতঙ্গ।

কাং-সু'র তুন-হুয়াং-এর কাছে মো-কাও গুহার একটি অষ্টম শতাব্দীর চৈনিক ফ্রেস্কোতে দেখা যাচ্ছে যে হান রাজবংশের সম্রাট উ (১৪১ খ্রিঃ পূর্ব- ৮৭ খ্রিঃ পূর্ব) একজন 'সুবর্ণ নির্মিত- পুরুষের' প্রতিমূর্তিকে পূজা করছেন। এই 'সুবর্ণ নির্মিত পুরুষ'-এর প্রতিমূর্তিটিকে ১২১ খ্রিঃ পূর্বাব্দে নিয়ে এসেছিলেন একজন বীর হান সেনাপতি যিনি তাদের বিরুদ্ধে সমরাভিযান পরিচালনা করেছিলেন।

প্রথম অনুবাদ সমূহ:

পার্থিয়ান (পারসিয়ান বর্তমান ইরান) রাজপুত্র থেকে ভিক্ষুতে পরিণত হওয়া আন-শিকাও -এর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ১৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা থেকে চৈনিক ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের অনুবাদ শুরু হয়। তিনি লো-ইয়াং-এ কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিলেন এবং চৈনিক ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র অনুবাদের বন্দোবস্ত করেছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মান্তরণ যেটি কয়েক শতাব্দী স্থায়ী হয়েছিল। আন-শিকাও বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি নীতি, ধ্যান ও অভিধর্ম বিষয়ক বৌদ্ধ গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন। একজন পার্থিয়ান গৃহী বৌদ্ধ আন-চুয়ান যিনি আন-শিকাওয়ের পাশাপাশি বোধিসত্ত্ব পথের প্রাচীন মহাযানীয় গ্রন্থগুলিকে অনুবাদ করেছিলেন।

মহাযান বৌদ্ধধর্ম চীনদেশে সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় কুষাণ ভিক্ষু লোকক্ষেমের (১৬৪ খ্রিঃ-১৮৬ খ্রিঃ পর্যন্ত সক্রিয়) দ্বারা যিনি প্রাচীন বৌদ্ধ রাজ্য গান্ধার থেকে এসেছিলেন। লোকক্ষেম গুরুত্বপূর্ণ মহাযানীয় সূত্রগুলিকে চৈনিক ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন যেমন অষ্ট সাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র এবং সমাধি সূত্র ও বুদ্ধ অক্ষোভ্যের ধ্যান বিষয়ক দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন মহাযানী সূত্র। লোকক্ষেমের এই অনুবাদগুলি মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন পর্যায়ের উপর আলোকপাত করে। এই অনুবাদগ্রন্থগুলির বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে ভিক্ষুজীবনের অনুশীলন, জঙ্গলে বসবাস এবং ধ্যানে নিমগ্নতা ইত্যাদি রয়েছে।

প্রাচীন বৌদ্ধ সম্প্রদায়:

চৈনিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রাথমিক পর্বে প্রাচীন ভারতবর্ষের যে সমস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হত সেগুলি হল ধর্মগুপ্তক, মহিশাসক, কাশ্যপিয়, সর্বাস্তিবাদী এবং মহাসাংঘিক।

ধর্মগুপ্তক সম্প্রদায় অন্যান্য যে কোন সম্প্রদায়ের তুলনায় ভারতবর্ষের বাইরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের বিষয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিল যেমন মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান ও চীন এবং এই ব্যাপারে তারা ব্যাপক সাফল্যও লাভ করেছিল। অতএব, যে সমস্ত দেশ চীন থেকে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল তাদের অধিকাংশই ধর্মগুপ্তক বিনয় এবং ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের দীক্ষাগ্রহণ অনুষ্ঠান গ্রহণ করেছিল। Warder লিখেছেন যে ধর্মগুপ্তক সম্প্রদায়কে সফলভাবে চৈনিক বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে।

অনুবাদের প্রাথমিক পর্যায়:

প্রথম দিকে চীনদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে নানা ধরণের বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। এই ধর্মের সন্ন্যাস জীবনের আদর্শ এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রতি বিরাগ চৈনিক সমাজের দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের বিরোধিতা করেছিল বলে মনে হয়। এমনকি কেউ কেউ এমন কথাও ঘোষণা করেছিল যে বৌদ্ধধর্ম রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের পক্ষে ক্ষতিকর, বৌদ্ধধর্ম চীনদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন অবদানই রাখেনি এবং বৌদ্ধধর্ম হল একটি বর্বর ধর্ম যেটি চৈনিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পক্ষে উপযুক্ত নয়। তবে বৌদ্ধধর্মকে প্রায়ই তাও ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত করা হত তার সন্ন্যাসীসুলভ ধ্যানীয় ঐতিহ্যের কারণে এবং এই কারণে প্রাথমিক পর্বের কয়েকজন ভারতীয় অনুবাদক তাওবাদী ধারণা ও পরিভাষার সঙ্গে দেশীয় বৌদ্ধ ধ্যানধারণাকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য ধারণার সামঞ্জস্য বিধানকারী পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন।

চৈনিক পণ্ডিত ও অভিজাতদের কাছে বৌদ্ধধর্মের আবেদন ছিল এবং অন্ত্যজস্তরের বৌদ্ধ অভিজাতদের বিকাশকে কনফুসিয়াসবাদ ও তাওবাদের বিকল্প হিসেবে মনে করা হয়েছিল, যেহেতু নৈতিকতা ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব আরোপ করা কনফুসিয়বাদীদের কাছে আবেদন রেখেছিল এবং অন্তরের প্রজ্ঞা কর্ষণ করা তাওবাদীদের আকৃষ্ট করেছিল। অন্ত্যজস্তরের ও অভিজাতদের নিকট বৌদ্ধধর্ম ছিল চীনে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তনের শুরু এবং এটি সম্রাট ও রাজসভার সমর্থন লাভ করেছিল। খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকের শুরুতেই দক্ষিণ চীনে বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ে ভারতীয় ভিক্ষুরা বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা দেওয়ার জন্য রেশম পথ ধরে যাতায়াত করতেন এবং অনুবাদ কর্ম চৈনিক ভিক্ষুদের তুলনায় বিদেশি ভিক্ষুরাই বেশি করেছিলেন।

কুমারজীবের আগমন :

যখন বৌদ্ধ রাজ্য কুচ চৈনিকদের কাছে পরাজিত হয় তখন বিখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষু কুমারজীবকে আটক করে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। যখন ৪০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুক্তিপ্রাপ্ত হন তিনি চৈনিক বৌদ্ধধর্মে তৎক্ষণাৎ একটি উচ্চপদ লাভ করেন এবং পশ্চিমের একজন মহান শিক্ষকরূপে প্রশংসিত হতে শুরু করেন। তিনি বিশেষ সম্মান লাভ করেন পরবর্তী চ্ছিন বংশের সম্রাট হিয়াও চিং-এর কাছ থেকে যিনি তাঁকে একটি সাম্মানিক উপাধি প্রদান করেন এবং তাঁকে দেবতার মতই ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। কুমারজীব তাঁর উচ্চমানের অনুবাদ দ্বারা চৈনিক বৌদ্ধধর্মে বিপ্লব এনেছিলেন (৪০২ খ্রিঃ-৪১৩ খ্রিঃ)। যেগুলি আজও তাদের প্রবহমান মসৃণতা, অর্থের সুস্পষ্টতা, সূক্ষ্মতা ও সাহিত্যিক দক্ষতার কারণে প্রশংসিত হয়। কুমারজীবের প্রচেষ্টায় চীনদেশে বৌদ্ধধর্ম কেবল তার নিয়মকানুনের জন্যই নয় তার উচ্চমানের দর্শন ও ধর্মের জন্যও স্বীকৃতিলাভ করেছিল।

সম্পূর্ণ সূত্র পিটক:

কুমারজীবের কাছাকাছি সময়ে চারটি প্রধান সংস্কৃত আগম চৈনিক ভাষায় অনূদিত হয়। আগমগুলি বিভিন্ন ভিক্ষুর দ্বারা স্বাধীনভাবে অনূদিত হয়। এই আগমগুলি একমাত্র টিকে  যাওয়া সম্পূর্ণ অন্য সুত্ত পিটকটি নিয়ে গঠিত, যেটিকে সাধারণভাবে থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের পালি সুত্ত পিটকের সঙ্গে তুলনীয়।

সাধারণভাবে, সূত্র পিটকের শিক্ষাকে বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা এবং চীনদেশের প্রাচীন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি অবিচ্ছেদ্য রচনা বলে মনে করা হয়। এটি উল্লেখযোগ্য যে এই আগমগুলি তাদের হীনযানী ঐতিহ্যের কারণে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবহৃত হলেও অত্যন্ত কম ব্যবহৃত হত; যেহেতু চৈনিক বৌদ্ধধর্ম স্পষ্টতঃই নিজেদের মহাযানী বলে ঘোষণা করেছিল।

প্রাচীন চৈনিক বৌদ্ধ ঐতিহ্য:

চৈনিক ভাষায় বৌদ্ধ গ্রন্থের প্রাচুর্যের জন্য এবং যে সমস্ত বিদেশি ভিক্ষু চীনে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষাদানের জন্য এসেছিলেন তাঁদের জন্য গাছের একটি প্রধান গুঁড়ি থেকে বের হওয়া নতুন নতুন শাখার মত বিশেষ বিশেষ বৌদ্ধ ঐতিহ্যের আবির্ভাব হয়। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল হুই উয়ান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পিওর ল্যান্ড বা বিশুদ্ধি ভূমি বৌদ্ধ ধর্মের অনুশীলন অন্যান্য প্রাচীন ঐতিহ্য ছিল তিয়েনতাই, হুয়ায়েন এবং বিনয় সম্প্রদায়। এই সমস্ত সম্প্রদায়গুলির মূলে ছিল যথাক্রমে Lotus Sutra, অবতংশক সূত্র, এবং ধর্মগুপ্তক বিনয় এবং এর সঙ্গে ছিল পরিপূরক সূত্র ও ভাষ্য। তিয়েনতাইয়ের প্রতিষ্ঠাতা চিই অনেক গ্রন্থ রচনা করেন যেগুলি চীনদেশে গুরুত্বপূর্ণ ধ্যান সংক্রান্ত গ্রন্থে পরিণত হয় যেমন, 'Concise Samatha Vipassana এবং 'Great Samatha Vipassana'.

দক্ষিণ ও উত্তরের রাজবংশ (৪২০ খ্রিঃ- ৫৮৯ খ্রিঃ) এবং সুই রাজবংশ (৫৮৯ খ্রিঃ-৬১৮ খ্রিঃ)

খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকে চীনে ছেন (জেন) শিক্ষার সূত্রপাত হয় এবং এর ঐতিহ্যশালী সূত্রপাতের কৃতিত্ব দান করা হয় কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব বোধিধর্মকে। এই সম্প্রদায়টি যোগাচার ও তথাগতগর্ভ এই দুইয়ের শিক্ষা প্রয়োগকারী সূত্র লঙ্কাবতার সূত্রে প্রাপ্ত নীতিগুলিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে এবং এই সম্প্রদায় বুদ্ধত্বলাভের জন্য একটি মাত্র যান (এক যান) এর কথা প্রচার করে। অতএব প্রথম দিকে ছেনের শিক্ষাকে 'এক যান সম্প্রদায়' বলে উল্লেখ করা হত। ছেন সম্প্রদায়ের সর্বপ্রাচীন অভিভাবকদের বলা হত, 'লঙ্কাবতার অভিভাবক' কারণ তাঁরা 'লঙ্কাবতার সূত্র'-এর নীতিগুলিকে অনুসরণ করে অনুশীলনে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন।

পরবর্তীকালে ছেনের প্রধান শিক্ষা পরিচিতি লাভ করে তাদের তথাকথিত সাক্ষাৎ কাহিনি ও কোয়ানের ব্যবহার কারণে এবং সেখানে ব্যবহৃত শিক্ষাপদ্ধতির কারণে। নান হুই চীনে লঙ্কাবতার সূত্র ও হীরক সূত্রকে (বজ্রচ্ছেদিকা প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র) ছেন সম্প্রদায়ের প্রধান গ্রন্থ হিসেবে শনাক্ত করেছেন। জেন সম্প্রদায় ধর্মশাস্ত্র ভিত্তিক শিক্ষার থেকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে প্রচারিত হয়েছিল এবং এটি কোন লিখিত গ্রন্থকে পবিত্র বলে দাবি করে না। জেন সরাসরিভাবে মানুষের মনের দিকে নির্দেশ করে যাতে মানুষ তাদের প্রকৃত স্বরূপ দেখে বুদ্ধত্ব অর্জন করতে পারে।

তাং রাজবংশ (৬১৮ খ্রিঃ-৯০৭ খ্রিঃ)

শুয়াং জাঙ্-এর পশ্চিমদিকে যাত্রা:

তাং রাজবংশের রাজত্বকালের প্রথম পর্বে ৬২৯ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভিক্ষু শুয়াংজাত্ ভারতবর্ষে গিয়ে একশটিরও বেশি রাজ্য ভ্রমণ করেন এবং তাঁর আবিষ্কারের বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেন। সেগুলি পরবর্তীকালে এই পর্বের ইতিহাস অধ্যয়নে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাঁর এই যাত্রায় তিনি বিভিন্ন পবিত্রস্থান ভ্রমণ করেন, এই ধর্মের বিভিন্ন কাহিনিগুলি শোনেন, বিভিন্ন বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিতদের সঙ্গে অধ্যয়ন করেন বিশেষত বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নালন্দায়। যখন তিনি চীনদেশে ফিরে আসেন তখন তাঁর সঙ্গে ৬৫৭টি সংস্কৃত গ্রন্থ নিয়ে আসেন। এছাড়াও তিনি ২২টি ঘোড়ার পিঠে বোঝাই করে বিভিন্ন নিদর্শন, প্রতিমূর্তি ও অন্যান্য বৌদ্ধ সামগ্রী নিয়ে আসেন। সম্রাটের সহায়তায় তিনি চানে একটি (বর্তমান শিয়ান) বিশাল অনুবাদ কেন্দ্র স্থাপন করেন। সমগ্র এশিয়া থেকে শিক্ষার্থী ও সাহায্যকারীরা তাঁর সঙ্গে যোগদান করেছিল। তাঁকে চৈনিক ভাষায় ১৩৩০টি ধর্মশাস্ত্র অনুবাদের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। বৌদ্ধধর্মের মধ্যে তাঁর সর্বাপেক্ষা আগ্রহের স্থান ছিল যোগাচার।

তাঁর নিজের বৌদ্ধশাস্ত্রের অধ্যয়ন, অনুবাদ ও ভাষ্যের শক্তিতে শুয়াংজাত্ পূর্ব এশিয়ায় ফা-শিয়াং সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ঘটান। যদিও এই সম্প্রদায়টি দীর্ঘদিন সমৃদ্ধিলাভ করেনি, তাঁর সংবেদন, চেতনা, কর্ম, পুনর্জন্ম ইত্যাদি সংক্রান্ত তত্ত্ব অধিকতর সফল সম্প্রদায়গুলির দর্শনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। শুয়াংজাঙের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও সবচেয়ে প্রখ্যাত শিক্ষার্থী ছিলেন কুইজি যাঁকে ফা-শিয়াং সম্প্রদায়ের প্রথম নেতা বলে মনে করা হয়। কুইজির দ্বারা বর্ণিত শুয়াংজাঙের যুক্তিবিজ্ঞানকে চৈনিক বৌদ্ধধর্মের পণ্ডিতরা প্রায়ই ভুল বুঝতেন যেহেতু তাঁদের কাছে ভারতীয় যুক্তি বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় ভূমিকাটি অজানা ছিল। আরেক গুরুত্বপূর্ণ শিষ্য ছিলেন কোরিয় ভিক্ষু ওন-চিউক।

গুহা, শিল্পকলা ও প্রযুক্তি:

এই পর্বে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়করণ স্পষ্ট হয় ধর্মীয় শাস্ত্রপূর্ণ গুহা ও অন্যান্য নির্মাণ থেকে যেগুলি সেই যুগে নির্মিত হয়ে আজও টিকে রয়েছে। কাং-সু প্রদেশের তুনহুয়াং-এর নিকটবর্তী মো-কাও গুহা, হেনানের লো-ইয়াং-এর নিকটবর্তী লংম্যান গ্রোট্রোস, সানসি প্রদেশের তাতং-এর নিকটবর্তী ইয়ংকাং গ্রোট্রোস হল উত্তর সুং ও তাং রাজবংশের সবচেয়ে বিখ্যাত দৃষ্টান্ত। লেমানের বিরাটাকার বুদ্ধমূর্তি-যেটিকে অষ্টম শতকে তাং রাজবংশের রাজত্বকালে পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং যেটি তিন নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত সেটি হল পৃথিবীর বৃহত্তম প্রস্তর নির্মিত বুদ্ধমূর্তি। গল্প কথন ও সূত্র গ্রন্থগুলির প্রচারের মাধ্যমে ভিক্ষু ও ধার্মিক গহী ব্যক্তিরা বৌদ্ধ ধ্যান ধারণার প্রসার ঘটান। এই সমস্ত মৌখিক পরিবেশনাগুলি পিয়েন-ওয়েল নামে লিখিত হয় (পরিবর্তনের কাহিনি) যেগুলি তাদের গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণের মাধ্যমে নতুন পদ্ধতিতে গল্প বলার দ্বারা কল্পকাহিনির লিখনকে প্রভাবিত করে। এই শৈলীতে রচিত জনপ্রিয় কিংবদন্তির অন্তর্গত হল 'মুলিয়ান তার মাকে উদ্ধার করল' যেখানে একজন ভিক্ষু, সন্তানের কর্তব্যকে প্রকাশ করার জন্য নরকে অবতরণ করেছিলেন।

গূঢ় বৌদ্ধধর্মের আগমন:

কাইউয়ানের তিনজন আলোকপ্রাপ্ত প্রবীণ শুভঙ্কর সিংহ, বজ্রবোধি এবং অমোঘবজ্র সম্রাট শুয়াং-জাঙ্-এর রাজত্বকালে ৭১৬ থেকে ৭২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চীন দেশে গূঢ় বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। তারা তা-সিং শানসি (Great Propagating Goodness Temple) আসেন যেটি মহান আলোকিতকারী মহাবৈবোচনের মন্দিরের পূর্বসূরী ছিল। প্রাচীন রাজধানী চাঙ্-আন (বর্তমান শিয়ান) এ তা-সিং শানসি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাজসভা দ্বারা সমর্থিত ধর্মশাস্ত্র অনুবাদের চারটি মহান কেন্দ্রের অন্যতম হয়ে ওঠে। তাঁরা সংস্কৃত থেকে চৈনিকে বহু বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র, সূত্র ও তন্ত্র অনুবাদ করেন। তাঁরা তৎকালীন চীনদেশের প্রচলিত শিক্ষাকেও আত্তীকরণ করেন: বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তাওবাদ ও কনফুসিয়বাদকে মিশ্রিত করে এবং গূঢ় সম্প্রদায়ের অনুশীলনকে আরও বিকশিত করেন।

তাঁরা চীনদেশের রহস্যময়, গতিময় এবং জাদু শিক্ষা নিয়ে আসেন। এর অন্তর্গত ছিল মন্ত্র এবং বিস্তারিত আচার অনুষ্ঠান যার লক্ষ্য ছিল ব্যক্তি বা সাম্রাজ্যের সুরক্ষা, মৃত্যুর পর কোন ব্যক্তির ভাগ্যকে প্রভাবিত করা এবং বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল খরার সময় বৃষ্টি আনার অনুষ্ঠান। অতএব, এটি মোটেই আশ্চর্যজনক নয় তিনজন শিক্ষকই সম্রাট তাং শুয়াং জাঙ্-এর কাছ থেকে আন্তরিক অভ্যর্থনা লাভ করেছিলেন এবং তাদের শিক্ষা খুব দ্রুত তাং রাজসভায় গৃহীত হয়েছিল বিশেষত অভিজাতদের মধ্যে। রাজধানীর মন্দিরে মন্ত্রযানী বেদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সম্রাট তাং তাইজং (রাজত্বকাল ৭৬২ খ্রিঃ-৭৭১ খ্রিঃ)-এর সময়ের মধ্যের সমাজের উঁচুতলায়-এর প্রভাব তাওবাদ অতিক্রম করে গিয়েছিল। তাইজং ও অমোঘবজ্রের সম্পর্ক বিশেষভাবে ভালো ছিল। অমোঘবজ্রের জীবদ্দশায় সম্রাট তাঁকে উপাধি ও উপহার দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন এবং যখন ৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে অমোঘবজ্রের মৃত্যু হয় তখন তিনি তাঁর জন্য একটি স্মৃতি সৌধ বা স্তূপ নির্মাণ করে তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করেন। চীনদেশের গূঢ় বৌদ্ধধর্মের পরম্পরা (এবং সমসাময়িক সময়ের সমস্ত বৌদ্ধধর্মই) সম্রাট তাং উজং দ্বারা প্রায় মুছে যায়, যার ফলে বৌদ্ধদের উপর ভয়ংকর নির্যাতনের একটি অধ্যায় শুরু হয়। ঐতিহাসিকভাবে, হামনি চৈনিক সেই সময় হারিয়ে গিয়েছিল বলে মনে করা হয় যখন সম্রাট তাং উজং তার শিক্ষাদানকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিলেন। অমোঘবজ্রের সর্বশেষ জ্ঞাত শিষ্য মাস্টার হু-ইকো এটি পূর্বেই অনুমান করতে পেরেছিলেন। তিনি জাপানি শিক্ষার্থী ভিক্ষু শিক্ষা দিয়েছিলেন। যার মধ্যে ছিল দুটি বিভাগ গর্ভ লোক ও হীরক লোক। মাস্টার কুকাই জাপানে ফিরে গিয়ে বৌদ্ধধর্মের জাপানি গূঢ় সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীকালে শিঙ্খন বৌদ্ধধর্ম নামে পরিচিত হয়।

ভিক্ষু কুকাই ও সাইচো-র প্রচেষ্টায় জাপানে গূঢ় বৌদ্ধধর্মের যে পরম্পরা সঞ্চারিত হয়েছিল তা তাঁদের মাধ্যমেই শিত্রু সম্প্রদায় ও তেণ্ডাই সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।

তাং রাজবংশের নির্যাতন ৮৪৫ খ্রিস্টাব্দ:

বৌদ্ধধর্মের বিরোধিতার অনেকগুলি কারণ ছিল। একটি ছিল এই যে তাওবাদ ও কনফুসিয়বাদের মত বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি চীনদেশে হয়নি। হান তি লিখেছিলেন: “বুদ্ধ ছিলেন বর্বর জাতির একজন মানুষ যিনি চীন দেশের ভাষায় কথা বলতেন না এবং ভিন্ন ধরণের পোশাক পরতেন। তাঁর শিক্ষা আমাদের প্রাচীন রাজাদের শিক্ষার সঙ্গে মেলে না, বা তার পোশাকও তাঁদের নিয়মকে অনুসরণ করে না। তিনি সেই কর্তব্যকে বুঝতেন না যা রাজা ও প্রজাকে আবদ্ধ করে, সেই স্নেহ বুঝতেন না যা পিতা ও পুত্রকে আবদ্ধ করে।”

অন্যান্য কারণগুলি হল বৌদ্ধদের সমাজ বিচ্ছিন্নতা, তার কারণ চৈনিকরা বিশ্বাস করত যে তাদের দেশের মানুষকে পারিবারিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরের সম্পদ, বিভিন্ন কর দেওয়া থেকে অব্যাহতি এবং ক্ষমতা অনেক সমালোচকের বিরক্তির কারণ হয়েছিল।

পাঁচটি রাজবংশ ও দশটি রাজত্বের কাল পর্ব (৯০৭-৯৬০/৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ):

পাঁচটি রাজবংশ ও দশটি রাজত্বের পর্ব দিন চীনদেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার একটি সময়। এটি ঘটেছিল তাং রাজবংশের পতন ও সং রাজবংশের প্রতিষ্ঠার মধ্যবতী পর্যায়ে। এই পর্বে উত্তরদিকে পাঁচটি রাজবংশ অত্যন্ত দ্রুত পরস্পরকে স্থানচ্যুত করে এবং বিশেষত দক্ষিণে বারোটিরও বেশি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ঐতিহ্যগতভাবে ১০টির তালিকা দেওয়া হয়, এই কারণে এই নামকরণ।

তাং রাজবংশের পতনের পর-পাঁচটি রাজবংশ ও দশটি রাজত্বের যুগে চীনদেশে কোন সক্রিয় কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। চীনদেশ অনেকগুলি স্বশাসিত এলাকায় বিভক্ত ছিল। বৌদ্ধধর্মের প্রতি সমর্থন অল্প কয়েকটি এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হুয়ানে এবং তিয়েন তাই সম্প্রদায় দুটি এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যেহেতু তারা রাজসভার সমর্থনের উপর নির্ভর করত। তাং সমাজের পতনের কারণ স্বরূপ বলা যায় তারা অভিজাত সম্প্রদায়কে সম্পদ ও প্রভাব থেকে বঞ্চিত করেছিল এবং এই কারণে বৌদ্ধধর্ম আরও বেশি পিছিয়ে পড়ে ছিল। সিন-চিউয়ের উত্তর ছেন সম্প্রদায় এবং হেনশুইয়ের পূর্বের ছেন সম্প্রদায় এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারেনি। তবে, ছেন চৈনিক বৌদ্ধধর্মের সর্বপ্রধান শাখারূপে আবির্ভূত হয়। তবে তাদের মধ্যেও বিভিন্ন সম্প্রদায় ছিল যেগুলি সে যুগের আঞ্চলিক প্রবণতার কারণে তাদের শিক্ষায় পৃথক পৃথক বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিল। পা-ইয়েন ওয়েন-ই- (৮৮৫ খ্রিঃ-৯৫৮ খ্রিঃ)-এর নামে নামাঙ্কিত ফা-য়ান সম্প্রদায় নান-তাং (শিয়াংসি, চিয়াংসি) এবং উউয়ে (চেচিয়াং)-এর মত দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে প্রধান সম্প্রদায় হয়ে উঠেছিল।

সং রাজবংশ (৯৬০ খ্রিঃ - ১২৭৯ খ্রিঃ):

সং রাজবংশকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়: উদীচ্য সং ও পরবর্তী সং। উদীচ্য সং-এর রাজত্বকালে (৯৬০-১১২৭) সং-এর রাজধানী ছিল উত্তরের শহর পিয়ানজিং (বর্তমান কাই-ফেং) এবং এই রাজবংশ অভ্যন্তরীণ চীনের অধিকাংশ অংশকেই নিয়ন্ত্রণ করত। পরবর্তী সং রাজবংশ (১১২৭-১২৭৯) বলতে বোঝায় চিন রাজবংশের হাতে উত্তর চীনে সং রাজবংশের ক্ষমতা হারানোর পরবর্তী পর্যায়কে। এই সময়ে সং রাজসভা ইয়াং সি নদীর দক্ষিণে সরে যায় এবং লিনান (বর্তমান হাংতোউ) এ তাদের রাজধানী স্থাপন করে।

সং রাজবংশের শাসনের প্রথমদিকে ছেন-পিওরল্যান্ড বা বিশুদ্ধিভূমি একটি প্রধান আন্দোলনে পরিণত হয়। বৌদ্ধ দর্শন ও আদর্শ, কনফুসিয়বাদ ও তাওবাদের সঙ্গে মিশ্রিত হতে শুরু করে।

মোঙ্গল ইউয়ান শাসন (১২৭৯ খ্রিঃ-১৩৬৮ খ্রিঃ):

মোঙ্গল ইউয়ান শাসনকালে মোঙ্গল সম্রাটরা গূঢ় বৌদ্ধধর্মকে তাঁদের সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্মের স্থান দিয়েছিলেন। চীন এর একটি অংশ ছিল এবং তিব্বতীয় লামাদের রাজসভায় পৃষ্ঠপোষকতা করা হত। সাধারণ ধারণা হল এই যে লামাদের এই পৃষ্ঠপোষকতা তন্ত্রের দুর্নীতিপূর্ব রূপকে প্রচার করেছিল। যখন মোঙ্গল রাজবংশের উচ্ছেদ ঘটে মিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তিব্বতীয় লামাদের রাজসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়। এবং বৌদ্ধধর্মের প্রকৃত পথ না হওয়ার জন্য এই ধরণের বৌদ্ধধর্মকে সমালোচনা করা হয়।

মিং রাজবংশ (১৩৬৮ খ্রিঃ- ১৬৪৪ খ্রিঃ):

ওয়েনস্টেইনের মতে মিং রাজবংশের দ্বারা জেন সম্প্রদায় এত দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে সমস্ত ভিক্ষুরা হয় লিন-শ্চি সম্প্রদায় নয়ত কাওতাং সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হন।

ছিং রাজ বংশ (১৬৪৪-১৯১১ খ্রিঃ)

ছিং রাজবংশ তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের গেলুকপা সম্প্রদায়কে অনুসরণ করত। তাই-পিং বিদ্রোহের শুরুতে বিদ্রোহীরা বৌদ্ধধর্মকে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করেছিল। নানজিং-এর যুদ্ধ (১৮৫৩ খ্রিঃ) এ তাই-পিং সৈন্যবাহিনী হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করেছিল। কিন্তু তাই-পিং বিদ্রোহের মাঝামাঝি সময় থেকে তাই-পিং নেতারা অপেক্ষাকৃত মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা দাবি করেছিলেন যে ভিক্ষুদের স্বাধীনতা থাকা উচিত। ১৯০০ সালের আশেপাশে অন্যান্য এশীয় দেশের বৌদ্ধরা চৈনিক বৌদ্ধধর্মের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। অনাগরিক ধম্মপাল ১৮৯৩ সালে সাংহাইতে এসেছিলেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল চীনদেশ ভ্রমণ করে চৈনিক বৌদ্ধদের ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের পুনরুজ্জীবনের জন্য ধর্ম প্রচারক পাঠাতে উৎসাহিত করা।

চৈনিক প্রজাতন্ত্র (স্থাপিত ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ)

চীনদেশের আধুনিকীকরণের ফলে চৈনিক সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। চৈনিক প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়। এটি চীনের মূল ভূখণ্ডে চৈনিক বিপ্লব এবং ১৯৪৯ সালে চৈনিক প্রজাতন্ত্রের স্থাপন পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং এর ফলস্বরূপ তাইওয়ানে চীন প্রজাতন্ত্রের সরকারের স্থানান্তরণ ঘটে।

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে চৈনিক বৌদ্ধধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল তাইসু মানবতাবাদী বৌদ্ধধর্ম, এবং সু উনের দ্বারা চৈনিক জেনের পুনরুজ্জীবন। সু উনকে সাধারণভাবে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বৌদ্ধ শিক্ষকদের অন্যতম বলে গণ্য করা হয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (প্রতিষ্ঠা ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ)

চৈনিক বৌদ্ধ সংঘ

ক্যাথলিক ধর্ম ও খ্রিস্টধর্মের অন্যান্য শাখার মতো চীনদেশে এমন কোন সংগঠন ছিল না যারা চীনের সমস্ত সন্ন্যাসীকে এমনকি এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সন্ন্যাসীকে অঙ্গীভূত করেছিল। ঐতিহ্যের দিক থেকে প্রতিটি বিহার ছিল স্বশাসিত, এর কর্তৃত্ব ছিল সেই বিহারের অধ্যক্ষের হাতে। ১৯৫৩ সালে বেজিং-এ ১২১ জন প্রতিনিধির একটি সভায় চৈনিক বৌদ্ধ সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সভায় একজন চেয়ারম্যান, চারজন অবৈতনিক চেয়ারম্যান, ৭ জন সহকারী চেয়ারম্যান, একজন মহাসচিব, ৩ জন উপমহাসচিব, স্থায়ী পরিষদের ১৮ জন সদস্য এবং ৯৩ জন নির্দেশক ছিলেন। চারজন নির্বাচিত অবৈতনিক চেয়ারম্যান ছিলেন দলাই লামা, পাঞ্চেন লামা, অন্তঃস্থ মঙ্গোলিয়ার প্রধানতম লামা এবং ভদন্ত মাস্টার সু ইয়ুন।

সংস্কার এবং উন্মুক্তকরণ: দ্বিতীয় বৌদ্ধ পুর্নজাগরণ ১৯৭০-এর দশকের সংস্কার ও উন্মুক্ত করণের পর থেকে চৈনিক বৌদ্ধধর্মের একটি নতুন পুনর্জন্ম ঘটে চলেছে। প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারগুলির সংস্কার ও নতুন বৌদ্ধ বিহারের নির্মাণ ঘটছে।

বর্তমানে গণ প্রজাতন্ত্রী চীনে ১৪১ কোটি অধিবাসী রয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে বেশি সংখ্যক নাগরিক বৌদ্ধধর্ম অনুসরণ করে। এছাড়াও, সমীক্ষায় জানা গেছে যে জনসংখ্যার আরও ২১ শতাংশ চীনের লোকধর্মকে অনুসরণ করে যার মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের উপাদান মিশে আছে। 

গূঢ় বৌদ্ধ ধর্ম:

চীন এবং তাইওয়ান, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মত বৃহৎ চৈনিক অধিবাসীযুক্ত দেশসমূহে গূঢ় বৌদ্ধধর্মকে সাধারণভাবে চৈনিক পরিভাষা মিচং অর্থাৎ গূঢ় বৌদ্ধধর্ম বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলির মধ্যে রয়েছে তাং মি, তাং রাজবংশীয় গুঢ়ধর্ম বা হানচুয়ান মিচং, হান প্রতিস্থাপন গূঢ় সম্প্রদায় বা তোংমি পূর্বগূঢ় সম্প্রদায়, এটি নিজেকে তিব্বতীয় ও নিউয়ার ঐতিহ্য থেকে পৃথক করে। এই সম্প্রদায়গুলি মোটামুটিভাবে শিঙ-অঙ্কের আচার অনুষ্ঠানকে অনুসরণ করে।

অসনাক্তকৃত সম্প্রদায়:

এমন অনেক সম্প্রদায় ও সংগঠন রয়েছে যারা নিজেদের বৌদ্ধ বলে ঘোষণা করে এবং এদের চৈনিক বৌদ্ধ সংগঠন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সরকার বৈধ বৌদ্ধধর্মরূপে স্বীকার করে না।

এই সংগঠনগুলির মধ্যে রয়েছে:

কুয়ান্ য়িন বুদ্ধিজম্। কুয়ান্ য়িন চার্চ (কুয়ান হুই) ঝেনফো ঝো সাওসান ওয়ানলঙ্ থিয়েন ঝু ফো চিয়াও ওয়ালিয়ান ছিনবাঙ্ তাতাও।

মূল ধারণা:

চৈনিক বৌদ্ধধর্মের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম ও তাও ধর্মের ঐতিহ্যবাহী উপাদান রয়েছে। সাধারণ আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে: বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বদের আরাধনা ধূপ, ফুল ও খাদ্যদানের মাধ্যমে, স্বর্গবাসী দেবতাদের পূজা দান, কিংমিং ও ক্ষুধার্ত প্রেত উৎসবে মৃত পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, মৃত ব্যক্তিদের আত্মাদের শান্তিলাভে সাহায্য করার জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পাদন, উপহার ও সেবাদানের মাধ্যমে অন্যান্য মানুষদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করা, নিরামিষভোজন: সন্ন্যাসীদের নিরামিষভোজী হতে হবে, ভক্ত গৃহীরাও প্রায়শই নিরামিষভোজী হয়ে থাকেন, 'জীবন মুক্তি'র ধরণের কাজের মাধ্যমে সমস্ত জীবিত প্রাণীর প্রতি করুণা।

সাধারণ বিশ্বাসের অন্তর্গত হল: দেবতা, ভূত ও নরকের অস্তিত্বে বিশ্বাস।

মানুষের কর্ম অনুসারে পুনর্জন্ম: কর্মফল।

দেশীয় ধর্মের জাতিগত সংখ্যালঘু:

বিভিন্ন চৈনিক হানভুক্ত নয় এমন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নিজস্ব দেশীয় ধর্ম অনুশীলন করে। চীনের সরকার জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিজস্ব দেশীয় ধর্মকে পেনঝুইসম (পাই) : পেনঝুইসম্ (পেনঝুজিয়াও, পৃষ্ঠপোষকদের ধর্ম): পাই মানুষদের দেশীয় ধর্ম, এরা ইউনানের জাতিগত গোষ্ঠী। এর মধ্যে রয়েছে ngel zex-এর পূজা, এটি 'পৃষ্ঠপোষক' বা মূল প্রভু'র পাই শব্দ, চৈনিক ভাষায় এটি পেনঝু। এরা হলেন স্থানীয় দেবতা এবং পাই জাতির দেবীভূত পূর্বপুরুষ। পেনঝুইজমের সঙ্গে হান চৈনিক ধর্মের যথেষ্ট মিল রয়েছে।

পিমোইসম: পিমোইসম্ (পিমোচিয়াও) হল ই জাতির মানুষদের নিজস্ব ধর্ম। হান চৈনিকদের পর এরাই হল ইউনানের সর্ববৃহৎ জাতিগোষ্ঠী। তিন প্রকার ধর্ম বিশেষজ্ঞরা এই ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন: পিমো (আচার অনুষ্ঠান বিশারদ, পুরোহিত), সুনী (পুরুষ শ্রমণ) এবং মনিই (মহিলা শ্রমণ)।

পিমো ও শ্রমণদের মধ্যে পার্থক্যটি নিহিত রয়েছে তাঁদের কর্তৃত্বলাভের পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে। যদিও উভয়কেই 'মানুষ ও দেবতাদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী বলে মনে করা হয়, শ্রমণরা দীক্ষিত হল এক ধরণের স্বর্গীয় অনুপ্রেরণার মাধ্যমে (এর সঙ্গে যুক্ত হল অসুস্থতা ও দিব্যদৃষ্টি), অপরদিকে পিমোরা সকলেই পুরুষ এবং অল্প কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেকেই সাক্ষর যারা ঐতিহ্যশালী ই লিপি লিখতে ও পড়তে পারেন, তাদের ঈশ্বরতত্ত্ব বিষয়ক ও আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত শাস্ত্রের ঐতিহ্য রয়েছে এবং তাঁরা একটি কঠিন শিক্ষামূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দীক্ষালাভ করে থাকেন।

১৯৮০-র দশক থেকে পিমোইজমের সম্পূর্ণরূপে পুনর্জন্ম ঘটেছে এবং তা ঘটেছে জনপ্রিয় ও পণ্ডিত উভয় স্তরেই। বর্তমানে পিমোদের 'বিদ্বজনের শ্রেণি' তে ফেলা হয় এবং যারা ই উৎকৃষ্ট সংস্কৃতির স্রষ্টা, রক্ষক ও হস্তান্তরকের দায়িত্বপ্রাপ্ত।

বোন: বোন (তিব্বতীয়, চৈনিক: Benjiao পেনচিয়াও) হল প্রাক বৌদ্ধ পর্বের তিব্বতের লোক ধর্মের বৌদ্ধ পরবর্তী নাম। খ্রিস্টিয় সপ্তম ও অষ্টম শতক থেকে বৌদ্ধধর্ম তিব্বতে প্রচারিত হতে শুরু করে এবং বৌদ্ধ ইতিহাসে প্রাক্ বৌদ্ধ যুগের তিব্বতের দেশীয় ধর্মটি বোন নামে গৃহীত হয়। প্রথমে 'বোন' ছিল তিব্বত দেশীয় ধর্মের শ্রমণদের উপাধি। এটি তিব্বতীয়দের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য ব্যক্তিদের লোকধর্মের পুরোহিতদের নামের মত, যেমন, নাখিদের তংবা মঙ্গোলীয় এবং অন্যান্য সাইবেরীয় জনগোষ্ঠীর বো। বোনপো (বিন ধর্মে বিশ্বাসীরা) দাবি করে বো শব্দের অর্থ হল সত্য ও বাস্তবতা।

বোনের আধ্যাত্মিক উৎস হলেন কাল্পনিক চরিত্র টোনপা শেনরাব মিয়োচে। দশম শতকের পর থেকেই তখন 'বোন' নামে পরিচিত সম্প্রদায়টি একটি মঠের গঠনশৈলী ও ধর্মশাস্ত্রসহ তিব্বতীয় বৌদ্ধদের শৈলী গ্রহণ করে নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করে এবং এর ফলে এটি একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ ধর্মে পরিণত হয়। চৈনিক সন্ন্যাসী কনফুসিয়াসকে বোন ধর্মের একজন পবিত্র রাজা এবং জাদুবিদ্যায় ও ঈশ্বরতত্ত্বে পারঙ্গম একজন ব্যক্তিরূপে পূজা করা হয়। তং পাইজম (নাখি): তং পাইজম (তৎ পাচিয়াও, পূর্ব বায়ের ধর্ম) হল নাখির জনগণের প্রধান ধর্ম। তংবা (পূর্ব বা) রা সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং নাখি লিপিতে পারদর্শী। এদের উৎপত্তি হল তিব্বতীয় বোন ধর্মের শিক্ষক (নাখি ভাষায় বা) হিসেবে, এদের অনেকেই তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রধান ধর্মরূপে প্রতিষ্ঠিত হবার পর বিতাড়িত নির্বাসিত হয়ে পূর্বদিকে পলায়ন করে এবং নাখি এবং পূর্বের অন্যান্য স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

তংবার অনুগামীরা সি-লো-মি-উ নামে একজন স্বর্গীয় শ্রমণের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন এবং তাঁরা এই বিষয়ে নিঃসন্দেহ যে তিনি তিব্বতীয় সেনরাব মিয়োর সঙ্গে অভিন্ন। তারা দেবতা ও আত্মাররূপ প্রকৃতি ও পূর্বপুরুষকে পূজা করে আর পূজা করে ক্যাথলিক সু (চিমেরা-ড্রাগন-সর্পের রূপে পৃথিবীর আত্মা) কে।

 

মাঞ্চু লোক ধর্ম: মাঞ্চু লোক ধর্ম হল জাতিগত ধর্ম যা মাঞ্চু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ অনুসরণ করে। এদের মধ্যে প্রধান হল চীনের টুঙ্গুসিক মানুষ। এটি একটি সর্বেশ্বরবাদী ব্যবস্থা যেখানে আপকা এনডুরি নামে একটি মাত্র ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে ("স্বর্গের দেবতা) যিনি সমস্ত জীবন ও সৃষ্টির সর্বশক্তিমান ও সর্বত্র বিরাজমান উৎস। দেবতারা (এনডুরি) প্রকৃতির প্রতিটি বৈশিষ্ট্যকে জীবন্ত করে তোলেন এবং মানুষের বিশ্বাস এই দেবতাদের পূজা করলে সৌভাগ্য, স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি লাভ করা যেতে পারে। এই সমস্ত দেবদেবীদের অনেকেই মূল মাঞ্চু বংশের পূর্বপুরুষ এবং একই উপাধিধারী মানুষদের একই দেবতা দ্বারা সৃষ্ট বলে মনে করা হয়।

মিয়াও লোক কাহিনি: চীনের মিয়াও জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ তাদের ঐতিহ্যবাহী লোকধর্মটিকে টিকিয়ে রেখেছে। এটি একটি সর্বেশ্বরবাদী দর্শন যা চৈনিক ধর্মদ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। এখানে ইয়ার চেব এবং ইয়াজ চেবের ধারণার কথা বলা হয়েছে। প্রথমটি হল দেবলোকের তত্ত্বগত রূপ এবং পরিপূরক দ্বৈততা হিসেবে জীবিত প্রাণীদের বাস্তব জগৎ।

মিয়াওরা সাউব নামে একজন সর্বব্যাপী দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে যিনি হলেন ডিউস ওটিও সুস। তিনি বাস্তবতাকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেটিকে তার নিজের মতো বিকশিত হবার সুযোগ দিয়েছেন তবে প্রয়োজন হলে মানুষ তাঁর কাছে প্রার্থনাও জানাতে পারে।

মঙ্গোলীয় লোক ধর্ম: মঙ্গোলীয় লোক ধর্ম অর্থাৎ মঙ্গোলীয় শামন্যবাদ (মেঙ্গুজু সামানিচাও), যার বিকল্প নাম তেঙ্গেরিজম (তেঙ্গে লিচাও) হল চীন দেশের মোঙ্গলদের দেশীয় ও প্রধান ধর্ম। এঁদের অধিকাংশের বাসস্থান হল অর্ন্তমঙ্গোলিয়া অঞ্চলে।

এটি তেংরি (দেবতা) এবং সর্বোচ্চ তেঙ্গার (স্বর্গ, স্বর্গের দেবতা, দেবতা) বা কোমুস্তা তেংরি। মঙ্গোলীয় লোকধর্মে চেঙ্গিজ খানকে তেঙ্গারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও একটি অন্যতম অবতার বলে মনে করা হয়।

কিয়াং লোক ধর্ম: কিয়াং জনগোষ্ঠী প্রধানত দেশীয় কিয়াং ধর্মের অনুগামী। এটি সর্বেশ্বরবাদী এবং এরা প্রকৃতি ও মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রক বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করে থাকে যেমন কিয়াংদের পূর্ব পুরুষদের। সাদা পাথর পূজা করা হয় যেহেতু তাদের বিশ্বাস আচার অনুষ্ঠানের দ্বারা সেগুলির মধ্যে হয়ত দৈবশক্তি সঞ্চারিত করা সম্ভব। কিয়াং জনগোষ্ঠী একটি অতি ক্রুদ্ধ দেবতা মুরিয়াসীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে (স্বর্গের দেবতা), যেটি তিয়ানের চৈনিক ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং স্পষ্টতই কিয়াং জনগোষ্ঠী এটিকে তাওবাদীদের দ্বারা সৃষ্ট জেড দেবতাদের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেছে।

ইয়াও লোক ধর্ম: ইয়াও জনগোষ্ঠীর মানুষ যারা কুয়াংসি, হুনান সন্নিহিত প্রদেশগুলিতে বসবাস করে তারা একটি লোক ধর্ম অনুসরণ করে যেটি ত্রয়োদশ শতক থেকে তাও ধর্মের সঙ্গে এত গভীরভাবে সংযুক্ত যে এটিকে প্রায়শই (ইয়াও তাওধর্ম বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। একজন চৈনিক পণ্ডিত লোকধর্মকে গভীর তাওভবনের দৃষ্টান্তরূপে বর্ণনা করেছেন (তাওজিয়াহুয়া), ১৯৮০-র দশকে দেখা যায় ইয়াওরা স্পষ্টতই চৈনিক ভাষার তাওবাদী ঈশ্বরতত্ত্ব বিষয়ক সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের অভিন্ন বলে মনে করছে, যেটিকে সংস্কৃতির একটি মর্যাদাপূর্ণ দলিল বলে মনে করা হয়। ঝুয়াং লোকধর্ম: ঝুয়াং লোকধর্মের (যেটিকে কখনও কখনও মোহিজিম বলা হয়) বা সিগঙ্গিদমের দুটি রূপে অনুশীলন করে অধিকাংশ ঝুয়াং জনগণ। যারা চীনের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং এরা কুয়াংচি প্রদেশে বসবাস করে। এটি একটি বহু দেবতায় বিশ্বাসী এবং শামন্যবাদী ধর্ম যেটি একজন সৃষ্টিকর্তা দেবতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে যাকে সাধারণভাবে বুলুওটুও নামে ডাকা হয়। তিনি হলেন ঝুয়াং জনগোষ্ঠীর একজন আদিম পূর্বপুরুষ। এই ধর্মের বিশ্বাসগুলি সংকলিত হয়েছে কিংবদন্তি ও পবিত্র ধর্মশাস্ত্রে যেটি পুলুওটুও মহাকাব্য নামে পরিচিত। পুয়েই জনগোষ্ঠীর মানুষও একই নামের প্রায় একই একটি ধর্মের অনুসরণ করে এরাও ঝুয়াঙ্গ গোষ্ঠীর আত্মীয়।

ঝুয়াং ধর্ম তাওবাদের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বাস্তবিকই ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী বিশেষজ্ঞদের ধরণ অনুসারে এই ধর্মকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়: এই বিভাগগুলির মধ্যে রয়েছে সিম্ফোজিম, মোহিজিম, তাওগোনিজম, তাওকংজিয়াও এবং শমনিজম (উচিয়াও)। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশক থেকে ঝুং লোকধর্মের পুর্নজাগরণ ঘটেছে এবং এটি দুটি অভিমুখকে অনুসরণ করেছে। প্রথমটি হল শমনদের দ্বারা পরিচালিত স্থানীয় দেবতা ও পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত আচার অনুষ্ঠানের তৃণমূল স্তরে পুনরুজ্জীবন এবং দ্বিতীয়টি হল ঝুয়াং সরকারি আধিকারিক ও বিদ্বজনের দ্বারা বিস্তৃত মোহিজিমের বিধিবদ্ধ করণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে ধর্মের সমৃদ্ধি।

তাওবাদ: তাওবাদকে চীনের স্বদেশীয় বিশ্বাসরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তাওবাদ একটি প্রাচীন ধর্ম ও দর্শন যেখানে বিশ্বজগতের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বসবাসের কথা বলা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের আচার অনুষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাওবাদীরা অনেক দেবী দেবীর পূজা করে এবং অনেক চৈনিক বিশ্বাসকে উদযাপন করে। পা জিয়ান: আটজন অমর সত্ত্বা হল তাও দেব দেবীদের একটি গোষ্ঠী যাদের নিজস্ব শিল্পকর্ম তাদের প্রতিনিধিত্ব করে। সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনিটি হল তাদের পূর্ব সমুদ্র অতিক্রম করে পূর্ব ড্রাগন রাজার মোকাবিলা করা। 

স্বতন্ত্রভাবে তারা হলেন- লি তিয়ে কুয়াই: ক্রাচ যুক্ত একজন পঙ্গু ভিখারি হান জোঙ্গলি: একজন আমুদে ভূতপূর্ব সেনাপতি যার বহু চৈনিক ভক্ত রয়েছেন। লুডং পিন: তাওবাদী পুরোহিতের মতো একটি চরিত্র যার একটি যাদু যুগ্ম তলোয়ার রয়েছে। হে জিয়াঙ্গু: একজন সুন্দরী যুবতী একটি পদ্মফুল হাতে নিয়ে রেখেছে। লাল কাইহে: একটি তরুণ প্রায় উভলিঙ্গ বালক যার হাতে একটি ফুলের ঝুড়ি রয়েছে। হান চিয়াংচি: বাঁশের-বাঁশিযুক্ত একজন চৈনিক পণ্ডিত। ঝাং কুয়োলাও : একজন বৃদ্ধ সন্ন্যাসী যিনি একটি গাধায় চড়ে রয়েছেন এবং হাতে একটি মাছের ড্রাম ধরে রয়েছেন। চাওকুওচিও: একজন ভূতপূর্ব সভাসদ যিনি একটি চৈনিক করতাল ধরে রয়েছেন। তোউ মুনিয়াং নিয়াং: বৃহৎ দিপার নক্ষত্রদের মাতৃদেবী। প্রাচীন চৈনিকরা এদের পূজা করত মূলত নক্ষত্র ও নক্ষত্র মণ্ডলীর পূর্বসুরী হিসেবে। লিং পাও তিসান জুন: ইনি হলেন তাওবাদের বিশুদ্ধতার অন্যতমা। লিং পাও তিসানজুন হল মোটামুটিভাবে 'স্বর্গীয় সম্পদের স্বর্গীয় প্রভু। বলা হয়ে থাকে তিনি বিশ্বজগতের রহমৎকে চোখের মধ্যে ধরে রাখেন। সান কুয়ান: স্বর্গ, মর্ত্য ও পৃথিবীর তিনজন আধিকারিক। এই চৈনিক কল্পকথার দেবতারা যে কে সেই বিষয়ে মতভেদ আছে। যেমন কেউ কেউ বিশ্বাস করেন স্বর্গের আধিকারিক হলেন জেড সম্রাট, অন্যান্যরা তাঁকে একজন প্রাচীন সৈনিক দেবতারূপে দেখেন। তাই সাং লাও জুন: তাই সাং লাও জুন তাও তে তিয়ান চুন নামেও পরিচিত। এটি তাওবাদের কাল্পনিক প্রবক্তা লাও্যুৎসর সাধারণ তাওবাদী উপাধি। একথা বিশ্বাস করা হয় যে তিনি তাওবাদের প্রধান গ্রন্থ তাও তে চিঙের রচয়িতা। তাও সাং লাও হলেন তিন প্রকার বিশুদ্ধ অর্থাৎ তিনজন প্রধান দেবতার অন্যতম। তাও সাং লাও চুন ধর্মের সবচেয়ে বেশি পূজিত দেবতাদের একজন। তাঁকে অনেক ধ্রুপদী ও আধুনিক চৈনিক কল্পকাহিনির চরিত্র হিসেবে দেখা গিয়েছে। এখানে সাধারণভাবে তাঁকে সবুজ ষাঁড়ের উপর চড়ে থাকা একজন সন্ন্যাসীরূপে দেখা গিয়েছে এবং তাঁকে অমৃত সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করা হয়ে থাকে।

চি ওয়াং মু: তিনি হলেন পশ্চিমের রাজমাতা। তিনি মূলত ছিলেন একজন চৈনিক মাতৃদেবতা। পরবর্তীকালে তাওবাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং দীর্ঘজীবন ও অমরত্বের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কিংবদন্তি অনুসারে তিনি কুন লুনে বসবাস করেন। এটি তাওবাদের একটি কাল্পনিক পর্বতশ্রেণি।

হু উয়াং তা-তি: তিনি চীনের বাইরে 'জেড সম্রাট' নামে অধিকতর পরিচিত। তিনি স্বর্গের তাওবাদী। শাসক। তবে অন্যান্য সংস্কৃতির মতো তিনি চৈনিক কিংবদন্তির প্রধান দেবতা নন; কোন কোন সম্প্রদায় তাঁকে তিন প্রকার বিশুদ্ধতার একজন প্রতিনিধি মাত্র বলে মনে করে। চৈনিক কিংবদন্তি ও কল্পকাহিনিতে জেড সম্রাট বিশেষভাবে ঐতিহ্য সামাজিক স্তরবিন্যাস ও নিষেধের প্রতিনিধিত্ব করেন।

উয়ান শি তিয়ান চুন: এটিকে মোটামুটিভাবে 'আদিম শুরুর স্বর্গীয় প্রভু হিসেবে অনুবাদ ধরা যেতে পারে। বলা হয়ে থাকে উয়ান শি তিয়ান চুন হলেন তাওবাদের তিনটি বিশুদ্ধতার অন্যতম এবং বলা হয়ে থাকে (পরবর্তীকালে তিনি দায়িত্বটি অর্পণ করেন জেড সম্রাটকে) তিনি স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং বিশ্বাস করা হয় যে তিনি আদিম উপায়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন। দেবতাদের অভিষেকে তিনি চোউ শক্তির প্রধান আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন।

জাং তাওলিং: তাওবাদের জেঙ্গি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। সাধারণভাবে তাঁকে জাং তিয়ানসি নামে উল্লেখ করা হয়। তিয়ানসি শব্দের অর্থ হল 'স্বর্গীয় প্রভু"। জিয়াং হলেন তাওবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির অন্যতম।

বৌদ্ধধর্ম: ঐতিহাসিকদের বিশ্বাস যে বৌদ্ধধর্ম প্রথম চীনদেশে আসে হান রাজবংশের আমলে। পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে চীন দেশের বৌদ্ধধর্মের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলি বিকশিত হয় এবং একই সঙ্গে তাওবাদের সঙ্গে একটি কৌতুহলজনক সংমিশ্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। আজকে একই চৈনিক মন্দিরে চত্বরের মধ্যে তাওধর্মের দেবতাদের সঙ্গে বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব এবং অন্যান্য বিভিন্ন কিংবদন্তির অভিভাবকরা পূজিত হন।

অমি-তুও-ফো: এটি হল আমিতুর চৈনিক নাম যিনি Pure Land-এর স্বর্গীয় বুদ্ধ। অনেক চৈনিক কল্পকাহিনি এবং কাহিনিতে আমরা দেখতে পাই যে ভিক্ষুরা কোন একটি কথপোকথনের শুরুতে তাঁর নাম উচ্চারণ করেছেন।

তা শিচি: বোধিসত্ত্ব মহাস্থানপ্রাপ্তির চৈনিক বৌদ্ধধর্মের মহাযানী নাম। চৈনিক বিহারগুলিতে দা শিচি এবং কুয়ান ইন আমিতুর দুপাশে থাকেন। এই ত্রয়ীকে পশ্চিমের তিন মুনি বলে উল্লেখ করা হয় (চি ফাং সান সেং)।

তি চাং ওয়াং: তি চাং ওয়াং ক্ষিতিগর্ভ বোধিসত্ত্বের চৈনিক নাম। তিনি হলেন আত্মাদের অভিভাবক; চৈনিক বর্ণনায় তিনি অনিবার্যভাবে একজন ভিক্ষু যিনি একটি অতিসুন্দর পোশাক পরে রয়েছেন। এখানে লক্ষণীয় যে যদিও চৈনিক শব্দ 'ওয়াং' এর অর্থ রাজা, তি চাং ওয়াংকে নরকের রাজা বলে মনে করা হয় না।

কুয়াং ইন: কুয়াং ইন বোধিসত্ত্ব।  অবলোকিতেশ্বরের চৈনিক মহাযানী বৌদ্ধ নাম। তিনি সারা পৃথিবীতে 'দয়ার চৈনিক দেবী' নামে পরিচিত। চৈনিক পদ্ধতিতে কুয়ান শিনকে সাধারণত একজন উদার হৃদয় দেবী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে যিনি সাদা পোশাক পরে পবিত্র শিশিরের একটি পাত্র ধরে আছেন। এঁকে জাপান, কোরিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে ব্যাপকভাবে পূজা করা হয়, এই সমস্ত দেশে এই দেবীর অনেক বিখ্যাত মন্দির রয়েছে যেমন টোকিওর পেনসোজি।

চিকং: তিনি হলেন ছেঁড়াখোড়া পোশাক পরিহিত-একজন অর্হতের পুনর্জন্ম। তাঁর রোগ নিরাময় করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। বলা হয়ে থাকে চৈনিক লোককাহিনির সবচেয়ে প্রিয় দেবতাদের অন্যতম। এই দেবতার দেহের ময়লাও অলৌকিকভাবে রোগ নিরাময় করতে পারে।

মি লে ফো: তিনি হলেন মৈত্রেয় অর্থাৎ ভাবী বুদ্ধের চৈনিক নাম। চীন দেশে মি লে ফোকে প্রায়শই একজন হাস্যময় ভিক্ষুরূপে বর্ণনা করা হয়েছে যিনি একটি বড় ব্যাগ বহন করছেন। এর কারণ হল কিংবদন্তির ভিক্ষু পুতাইয়ের সঙ্গে তাঁর ঐতিহাসিক সংযোগ। জাপানে পুতাই হোতেই নামে পরিচিত এবং তিনি জাপানের সাতজন ভাগ্যবান দেবতাদের অন্যতম।

প চিয়ান: এটি হল বোধিসত্ত্ব সামন্তভদ্রের চৈনিক নাম। চৈনিক মহাযানী বৌদ্ধধর্মে চিয়ান অধ্যবসায়ের প্রতিনিধি এবং তিনি সাধারণত সাদা হাতি চড়ে থাকেন। তিনি ইমেই পর্বতের সঙ্গেও যুক্ত এবং বারোজন গুরু সন্ন্যাসীর অন্যতম হিসেবে ঈশ্বরের অভিষেকে খোদাই করা মূর্তিযুক্ত মণি হিসেবে কাজ করেন।

 

রু লাই ফো: আধুনিক চৈনিক জনপ্রিয় আমোদ প্রমোদে, রু লাই ফো বলতে বোঝায় গৌতম বুদ্ধকে। যদিও রু লাই ফো পরিভাষাটি কেবল বুদ্ধকে বোঝায় এবং তিনি বৌদ্ধ জগতের অন্যান্য আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যে কেউ হতে পারেন। এই প্রথা শুরু হয় পাশ্চাত্যের যাত্রার মাধ্যমে, সেখানে গৌতম বুদ্ধকে এই নাম দেওয়া হয়েছে।

সি তা তিয়ান কুয়াং: চৈনিক মন্দিরের প্রবেশ কক্ষের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল 'চারজন স্বর্গীয় রাজা। বিভিন্ন চৈনিক কল্পকাহিনিতে এরা বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন-

চিকাও তিয়ান ওয়াং: তিনি পৃথিবীর রক্ষক। তাঁর হাতে একটি চৈনিক পিপা ধরা রয়েছে।

চে চাং তিয়ান ওয়াং: যিনি প্রজ্ঞা ও কর্ষণ উৎপন্ন করেন। তিনি মূল্যবান তলোয়ার চালান।

গুয়ান মু তিয়ান ওয়াং: তিনি সর্বস্রষ্টা। তাঁর সঙ্গী এক চৈনিক সর্প।

তুও ওয়েন তিয়ান ওয়াং: তিনি সমস্ত কিছু শোনেন। তাঁর সম্পদ হল বৌদ্ধ ছাতা।

ওসেই তুও: তিনি স্কন্ধের চৈনিক বৌদ্ধ সংস্করণ। ইনি হলেন মঠগুলির অভিভাবক। তাঁকে দেখান হয়েছে একজন চৈনিক সেনাপতি রূপে। যাঁর অস্ত্র হল বজ্রদণ্ড

ওয়েন সু: সু হল বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রীর চৈনিক নাম। চৈনিক মহাযানী বৌদ্ধধর্মে তিনি সাধারণত আবির্ভূত হন প্রজ্ঞার প্রতীকরূপে। সাধারণভাবে তার প্রকাশ ঘটে সিংহের পিঠে চড়া অবস্থায়। তাঁর অস্ত্র হল তরবারি এবং এই তরবারি দিয়ে তিনি অজ্ঞতার আবরণ ছিন্ন করেন। দেবতাদের অভিষেক অনুষ্ঠানে তিনি খোদাই করা মূর্তিযুক্ত মণিবিশেষ এবং বারোজন ইউক্সি সাধুদের অন্যতম এবং চীনের অভ্যন্তরে তিনি উতাই পর্বতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

ইয়াও সি ফো: চিকিৎসক বুদ্ধ। চৈনিক মন্দিরে সাধারণত তাঁকে একটি ওষুধের পাত্র ধরে থাকতে দেখা যায়।

সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে চৈনিক কল্পকাহিনি ও প্রাচীন কিংবদন্তি:

সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে চৈনিক কল্পকাহিনি বৌদ্ধধর্ম ও তাওধর্মের থেকেও প্রাচীন। এর উৎস হল মৌখিক ঐতিহ্য যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চারিত হয়েছিল। এসব সত্ত্বেও তাও ধর্মের দেবদেবীদের তালিকায় আরও অনেক চৈনিক দেবতাকে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে যেমন তিনজন রাজা ও পাঁচজন সম্রাটকে। কল্পকাহিনির অন্যান্য চরিত্ররাও চৈনিক সংস্কৃতিতে স্থায়ী আসন ক্যাং চিয়ে হুয়াং তির একজন কিংবদন্তি ঐতিহাসিককে চৈনিক লিখিত চরিত্র সমূহের উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে তাঁর চারটি চোখ রয়েছে।

 

চ্যাঙ্গি: হোউ ই (নীচে দ্রষ্টব্য)

চ্যাং জি: ডি জুন এবং একজন প্রাচীন চান্দ্র দেবীর দুই স্ত্রীর অন্যতম। তিনি বারোটি চাঁদের জন্ম দিয়েছিলেন।

চি ইউ: তিনি প্রাচীন চিউলি উপজাতির কাল্পনিক শাসক। চি ইউ হুয়াং তির বিরুদ্ধে প্রাচীন চীনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন এবং যুদ্ধ চলাকালীন তিনি নিঃশ্বাসের মাধ্যমে একটি ঘন কুয়াশা ত্যাগ করেছিলেন যার মাধ্যমে হুয়াং তির সৈন্যদের ফাঁদে ফেলা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি একটি ভয়ানক ঝড়কেও আহ্বান করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন এবং তাঁর শিরচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিংবদন্তি অনুসারে তাঁর ব্রোঞ্জের মাথা, চারটি চোখ এবং দুটি হাত ছিল। তাঁর প্রতিটি হাতে মারাত্মক অস্ত্র ছিল।

তা ইউ: চৈনিক কিংবদন্তি অনুসারে ইউ ছিলেন চিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং চীনের মহাপ্লাবনের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিখ্যাত। রাজা ইয়াও তাঁর বাবা গুণকে চীনের মহাপ্লাবন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়ে ছিলেন এবং তিনি না পারলেও ইউ বয়ঃপ্রাপ্ত হলে সেই প্রচেষ্টায় যোগ দিয়ে পরবর্তীকালে সাফল্য লাভ করেছিলেন।

তিমুন: তিনি চীনের প্রাচীন প্রধান দেবতাদের অন্যতম এবং চ্যাং জি ও জিহির স্বামী। তিনি সেই নটি পুত্রের পিতা ছিলেন যাঁদের হোউ-ই তির বিদ্ধ করে হত্যা করেছিলেন।

ফ্যাং ফেং: তিনি হলেন একজন দৈত্য যাকে চীনের মহাপ্লাবন প্রতিরোধের প্রচেষ্টার সময় দেরি করে আসার জন্য তা ইউ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন।

ফুক্সি: কখনও কখনও তাঁকে প্রাচীন চৈনিক সম্রাট-দেবতারূপে বর্ণনা করা হয়; প্রায়ই তাঁকে সান ওয়াং উড়িদের অন্যতম রূপে বর্ণনা করা হয় এবং তাঁকে বহু বহু জিনিস আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় বলা হয়ে থাকে তিনি নুয়ার ভাই ও স্বামী এবং তাঁর নিম্নাঙ্গ সাপের মত বলে মনে করা হয়। নুয়ার সঙ্গে তিনি মনুষ্যজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন। দম্পতিরা এই কাজ করেছিলেন কাদার মূর্তিতে জাদু জীবন যুক্ত করে।

কং কং: প্রাচীন চীনের জল দেবতা। জু রং-এর সঙ্গে তাঁর মহাকাব্যিক যুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্থ একটি স্তম্ভকে ক্ষতিগ্রস্ত দিয়েছিল এবং নুয়া জাদুকরের মতো সেই ক্ষতি মেরামত না করলে সমস্ত মানবজাতিই ধ্বংস হয়ে যেত।

হে পো: পীত নদীর প্রাচীন চৈনিক দেবতা।

হোউ তু: পৃথিবীর চৈনিক দেবতা। চীনের মহাপ্লাবনের সময় হোউ তু তাউকে খালের জল নিষ্কাশনের পথ দেখিয়ে সহায়তা করেছিলেন। 

 

হোউ-ই: হোউ-ই হলেন প্রাচীন চীনের কল্পকাহিনির একজন তিরন্দাজ তার কার্যকলাপ সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী কাহিনি রয়েছে। যদিও সংস্করণের কথা বাদ দিলেও হোউ-ইর কাহিনি শুরু হয় যখন রাজা ইয়াও তাঁকে সেই দশটি সূর্যের মোকাবিলা করার দায়িত্ব দিয়ে ছিলেন যেগুলি পৃথিবীকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল। হোউ-ই অত্যন্ত সফলভাবে দশটির মধ্যে নটি সূর্যকে তিরবিদ্ধ করে হত্যা করেন।

হুয়াং তি: এই 'পীত সম্রাট' চৈনিক সংস্কৃতির অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ প্রতীক। তিন জন নিরঙ্কুশ সম্রাট ও পাঁচজন সম্রাটের অন্যতম হিসেবে তাঁকে অনেক জিনিসের উদ্ভাবন এবং সমগ্র চৈনিক জাতির পূর্বপুরুষ হওয়ার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তাঁর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হল দিক নির্ণয়কারী পথ যেটি চোউ উকে পরাজিত করতে ব্যবহৃত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। শেষত অনেকগুলি প্রাচীন গ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব তাঁকে দেওয়া হয়, যেমন, 'হুয়াং তি নেই হল' একটি প্রাচীন চৈনিক চিকিৎসা তত্ত্ব।

চিউ তিয়ান চুয়ান নু: 'নটি স্বর্গের রহস্যময় কুমারী হলেন প্রাচীন চৈনিক কিংবদন্তির দেবী যাঁকে হুয়াং তির শিক্ষিকারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই ভূমিকায় তিনি ছিলেন তাঁর পরামর্শদাত্রী যিনি তাঁকে চি ইউসের সঙ্গে মহাকাব্যিক যুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন। যদিও আজকাল তাঁকে চৈনিক চলচ্চিত্রে একজন অসামান্য সুন্দরী রমণী রূপে চিত্রিত করা হয়, তার আদি রূপটি ছিল একটি মানুষের মাথাযুক্ত পাখির।

কুয়া ফু: কুয়া ফু ছিলেন হোউ তুর নাতি। তিনি সূর্যকে ধরার জন্য অতিমাত্রায় ব্যগ্র ছিলেন। তিনি সূর্যকে তাড়া করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত শরীরের সমস্ত জল শুকিয়ে যাওয়ায় এবং ক্লান্তিতে তিনি মারা যান।

নুয়া: তিনি প্রাচীন চৈনিক বিশ্বাসের মাতৃদেবী, তিনি ফুক্সির বোন ও স্ত্রী। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কল্পকাহিনি হল পাঁচটি রংযুক্ত পাথর ও স্বর্গের খারাপ হয়ে যাওয়া একটি সেতু মেরামত করা।

পান-কু: কথিত আছে পান-কুর জন্ম হয়েছিল মহাজাগতিক ডিম থেকে। তিনি ছিলেন চৈনিক কল্পকাহিনিতে বর্ণিত বিশ্বস্রষ্টা এবং বিশ্বজগতের প্রথম প্রাণী। তাঁর জাদু কুঠারের সাহায্যে তিনি ইয়াং এবং ইনকে বিচ্ছিন্ন করেন এবং আকাশকে ততক্ষণ উঁচু করেন যতক্ষণ না সেটা পৃথিবীর থেকে অনেক উঁচুতে উঠে যায়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দেহের বিভিন্ন অংশ প্রাকৃতিক উপাদানে পরিণত হয় যেমন বাতাস ও নক্ষত্র।

সিজিয়ং: এঁরা ইংরাজিতে 'চার প্রকার বিপদ' নামে পরিচিত। এরা চারপ্রকার অশুভ শক্তি যাদের হুয়াং তি পরাজিত করেছিলেন। এরা হলেন হুন তুন- একটি ডানাযুক্ত রাক্ষস যার দুটি পা রয়েছে কিন্তু কোন মুখ নেই। কিয়ং কি: একটি মানুষ খেকো দানব। তাওউ-বাঘ সদৃশ একটি ভয়ানক জন্তু। তাওতাই: একটি অতি পেটুক দানব যে খ্রিস্টিয় কল্পকাহিনির আবাডানের সদৃশ।

 

চিয়াংশুই সেন: চিয়াংশুই সেন বলতে দুজন দেবীকে বোঝায় এরা হলেন এর ওয়াং এবং নু ইং। তাঁরা জিয়াং নদীর দেবী এবং সম্রাট ইয়াওয়ের কন্যা। তারা ইয়াওয়ের উত্তরসূরী সুনকে বিবাহ করেছিলেন।

চিহে: তিনি চীনের প্রাচীন সূর্য দেবী এবং ডি জুনের দুই স্ত্রীয়ের অন্যতম। বলা হয়ে থাকে যে 

চিং তিয়ান : তিনি একজন প্রাচীন  ভয়ানক দেবতা যিনি হুয়াং তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। পরাজয় ও অঙ্গহানির পরও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর স্তনবৃন্তকে চোখ ও নাভিকে মুখ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

চুরং: তিনি আগুনের প্রাচীন চৈনিক দেবতা। কংকং-এর সঙ্গে তার মহাকাব্যিক যুদ্ধের ফলে পথিবীর একটি স্তম্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে যে বিপর্যয় উৎপন্ন হয় তা মানবতাকে ধ্বংস করে দিতে পারত যদি না নুয়া তার জাদুশক্তির দ্বারা সেটি মেরামত করে দিতেন।

জনপ্রিয় চৈনিক পারিবারিক দেবদেবী:

চৈনিক কিংবদন্তির নিম্নলিখিত দেবদেবীরা চৈনিক কল্পকাহিনি এবং জনপ্রিয় পপ সংস্কৃতির আমোদপ্রমোদে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। এদের অনেকেই আজও বিভিন্ন চৈনিক পরিবারে সক্রিয়ভাবে পূজিত হয়ে থাকেন।

চাই সেন: অর্থের এই চৈনিক দেবতা আজকাল চৈনিক নতুন বছরের উদযাপনের সঙ্গে সমার্থক। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় মূর্তিটি হল রাজকীয় পোশাকে একজন আমুদে মানুষের।

চর সি পা চিং পিউ: চৈনিক জ্যোতিষের ২৮টি নক্ষত্র মণ্ডলীর কলুষিত জপকে বর্তমানে পূজা করা হয় না বললেই চলে। তবে চৈনিক কাহিনিতে মাঝে মাঝে তাঁরা স্বর্গীয় আধিকারিকরূপে আবির্ভূত হন।

ফুলু পোউ: তাঁরা বিকল্পভাবে সান চিং বা তিনটি নক্ষত্র নামেও পরিচিত। এই ত্রয়ী চৈনিক সংস্কৃতির তিনটি সদর্থক গুণের প্রতিনিধিত্ব করেন। এগুলি হল ফু (আশীর্বাদ) লু (সমৃদ্ধি) পোউ (দীর্ঘ জীবন)।

হুয়াকুয়াং তা তি: প্রভু হুয়া কুয়াং তাওধর্মের চারজন অভিভাবক সেনা দেবতার অন্যতম। তাঁকে ক্যান্টনের অপেরা ট্রুপ পারফরম্যান্স আর্টের দেবতা রূপে পূজা করে।

কুই চিং: তিনি পরীক্ষার চৈনিক দেবতা।

লু পান: জোউ রাজবংশের একজন চৈনিক উদ্ভাবক ও ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে তাঁকে নির্মাতাদের পৃষ্ঠপোষকরূপে শ্রদ্ধা করা হয়।

 

মানু: তিনি সাগরের চৈনিক দেবী। এছাড়াও, তিনি চীন ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দক্ষিণ পূর্ব উপকূল অঞ্চলের সবচেয়ে পূজিত দেবীদের অন্যতম। কথিত আছে যে মা-চু হলেন দক্ষিণ সং রাজার শের ফুচিয়ান গ্রামের একজন অধিবাসী যিনি ভবিষ্যদ্রষ্টা ও জাদুকর ছিলেন। তাঁকে সাধারণভাবে চৈনিক কিংবদন্তিতে চিসান হেতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি একটি উপাধি যার অর্থ হল স্বর্গের রাজকুমারী।

তাই সুই: তাই সুই বলতে বোঝায় বৃহস্পতির বিপরীতে ৬০টি নক্ষত্রের মনুষ্যে পরিণত রূপ এবং এটি ঘটে বৃহস্পতির ১২ বছরের আবর্তনে। চৈনিক জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে প্রতিটি বছরের নেতৃত্বদান করেন একজন করে তাই সুই। যে সমস্ত মানুষ চৈনিক রাশিচক্রের চিহ্নের সঙ্গে রয়েছেন এবং বর্তমানে প্রচলিত তাই সুইয়ের বিরোধী তাদের অবশ্যই প্রজার অনুষ্ঠান পালন করতে হবে অন্যায় তাদের দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। থু-তি: থু-তি একটি মাত্র দেবতা নয়, পৃথিবীর সমস্ত আত্মা অভিভাবক সর্বদাই তাঁদের বর্ণনা করা হয়েছে ছোট আকারে বয়স্ক মানুষ হিসেবেও।

ওয়েন চাং: সংস্কৃতি, সাহিত্য ও জ্ঞানের চৈনিক দেবতা।

উসে লাও: 'চাঁদের বৃদ্ধ মানুষ' হলেন চৈনিক বিবাহের দেবী। তিনি দম্পতিদের জাদু লাল

সুতো দিয়ে যুক্ত করেন।

চাও চুন: তিনি রান্নাঘরের চৈনিক দেবী। কথিত আছে চৈনিক নববর্ষের সাতদিন আগে বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সর্বদা স্বর্গের সভায় ফিরে যান। এর ফলে প্রয়োজন হয় সেদিনের আগে বাড়ি পরিষ্কার করার যাতে করে স্বর্গের শাস্তি এড়িয়ে যাওয়া যায়।

হুসেং নিয়াং: নিয়াং তিনি শিশুর জন্ম ও উর্বরতার চৈনিক দেবী। ফুচান ও তাইওয়ানেই সাধারণভাবে তাঁর পূজা হয়ে থাকে।

পাশ্চাত্যে যাত্রা:

তর্কযোগ্যভাবে এটি সবচেয়ে বিখ্যাত ধ্রুপদী চৈনিক কল্পকাহিনি। 'পাশ্চাত্যে যাত্রা' ১৬শ শতকে রচনা করে ছিলেন মিং রাজবংশের সময়ের লেখক উ চাঙেন। এই কাহিনিটিকে চৈনিক সাহিত্যের চারটি মহান ধ্রুপদী উপন্যাসের অন্যতম বলে মনে করা হয়।

পাইকু চিং: সাদা হাতের মহিলা রাক্ষস পাশ্চাত্যে যাত্রা'র অন্যতম বিখ্যাত খল নায়িকা। তিনি বারংবার তাং সা চাংকে জাদু করার প্রয়াসের জন্য কুখ্যাত। শেষ পর্যন্ত তাঁকে সুন উকং-এর সোনার দণ্ডের আঘাতে হত্যা করা হয়।

 

পাইলং মা: পূর্বে তাং সাইজানের শ্বেত অশ্ব ছিল একজন ড্রাগন রাজা। যেহেতু সে জেড সম্রাটের তার বাবাকে দেওয়া একটি দামী মুক্তা নষ্ট করে ফেলেছিল তাই তাকে একজন ভিক্ষুর ঘোড়া বানিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।

হং হাইয়ার: তিনি নিউ মো ওয়াং-এর অমিত শক্তিধর পুত্র যিনি সমস্ত চরণের আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। এমনকি শক্তিশালী সুন উকংও তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না এবং তাকে কুয়ান ইনের সাহায্য নিতে হয়েছিল। কুয়ান ইন তাকে একটি পদ্মের সাহায্যে পরাজিত করার পর দৈত্য শিষ্যটি পরিবর্তিত হন সান চাই চৌংচিতে, তিনি সম্পদের বৌদ্ধ দেবী।

নিউ মো ওয়াং: নিউ মো ওমাং বা ষাঁড় দেবতা রাজা ছিল সেই অসংখ্য দৈত্যদের অন্যতম যাদের সু উকং তার পাশ্চাত্যে যাত্রার সময়ে পরাজিত করে ছিলেন। তবে তিনি সূর্যের পাতানো ভাইদের অন্যতম হিসেবে ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছেন। তার স্ত্রী ও পুত্র বানর রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।

সা উচি তাং: তাং সানজাঙের এই তৃতীয় শিষ্যকে সর্বদা চীনের অরণ্যবিহারী ভিক্ষু রূপে বর্ণনা করা হয়েছে এবং কাহিনিতে তিনি যুক্তি ও ধ্যানের কণ্ঠস্বর। তীর্থ যাত্রার পূর্বে তিনি ছিলেন স্বর্গের সেনাপতি এবং রাগের মাথায় একটি পাত্র ধ্বংস করার কারণে তাঁকে শাস্তিস্বরূপ তীর্থযাত্রা করতে হয়েছিল।

সুন উকং: 'পাশ্চাত্য যাত্রা'র বিখ্যাত নায়ক বানররাজ সুন উকং একটি জাদু পাথর থেকে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। সুন ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত, দুষ্টু এবং সহজেই ক্রুদ্ধ হওয়া একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি তাও ধর্মের দেবদেবীদের সঙ্গে বারংবার যুদ্ধ করেছিলেন এবং গৌতম বুদ্ধ তাকে একটি জাদু পর্বতে বন্দী করে রেখেছিলেন। অপরাধের আরও প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য পরবর্তীকালে যখন পবিত্র ভিক্ষু বৌদ্ধধর্মের তীর্থস্থান গিয়েছিলেন তখন তাঁকে তাং সানজাং-এর সুরক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই তীর্থভ্রমণ সম্পূর্ণ হওয়ার পর সুন উকং বোধিলাভকরেন এবং তাঁকে উড জান সেং ফো (লড়াইয়ের বুদ্ধ) উপাধি দেওয়া হয়। আজও সুন উকং চৈনিক কিংবদন্তির সবচেয়ে প্রিয় চরিত্রগুলির অন্যতম রূপে রয়ে গিয়েছেন।

তাং সানজাং: তিনি পাশ্চাত্য জগতের কাছে ত্রিপিটক নামে বিখ্যাত। এর ভিত্তি হলেন বাস্তবের তাং রাজবংশের ভিক্ষু শুয়াং জাঙ্ যিনি বৌদ্ধ সূত্রগুলি সংকলনের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে গিয়ে ছিলেন। পাশ্চাত্যে যাত্রার সময়ে তিনি ছিলেন সুন উকং-এর দ্বিতীয় শিক্ষক। লেখক উ চেঙ্গেন ধারাবাহিকভাবে তাঁকে সরল, অসহায়, এবং অত্যধিক উদাররূপে চিত্রিত করেছেন।

সাং কংমু: তিনি ছিলেন লোহার পাখার রাজকুমারী এবং নিউ মো ওয়াং-এর স্ত্রী। তাঁর সঙ্গে সুন উকং-এর এবং তাঁর সহ শিষ্যদের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয় যখন তিনি তাঁকে জ্বলন্ত পর্বতের আগুন নেভানোর জন্য সূর্যকে সম্পদ ধার দিতে অস্বীকার করেছিলেন।

 

ঝু পেচিয়ে: এই কাহিনির বিদুষক শূকর মুখো পেচিয়ে হলেন লোভী কামুক, অলস এবং সুন উকং-এর প্রতি প্রতি অতিরিক্ত ঈর্ষাকাতর। পূর্বে তিনি ছিলেন স্বর্গের একজন সেনাপতি এবং কামার্ত অবস্থায় চেঙ্গিকে ধাওয়া করার শাস্তি স্বরূপ প্রাপ্ত অভিশাপের ফলে তিনি তাঁর বর্তমান ভয়ানক রূপটি লাভ করে। আথার ওয়েলেইয়ের অনুবাদে পেচিয়ের পুনঃনামকরণ হয় পিকসি।

দেবতাদের উত্তরাধিকার:

প্রাচীন শাং রাজবংশের পতনের পূর্বেকার ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের অলৌকিক কথন দেবতাদের উত্তরাধিকার রচিত হয় ষোড়শ শতকের মিং রাজবংশের লেখক চু চংলিন। যেহেতু জয়ের চরিত্রগুলির বেশ কয়েকটির ভিত্তি ছিলেন তাও ও বৌদ্ধ দেবদেবীগণ, এই কাহিনিগুলির অনেকগুলির চরিত্র এখনও বিভিন্ন চৈনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সক্রিয়ভাবে পূজিত হন।

তা চি: তা চি নটি লেজযুক্ত মনুষ্য অবতার। সর্বশেষ শাং সম্রাট দেবীকে তার নিজস্ব মন্দিরে অপমান করার পর নুয়া তা চিকে পাঠিয়ে ছিলেন তাকে জাদু করার জন্য। কাহিনিতে বলা হয়েছে যে তা চি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চীনে প্রচুর দুঃখের সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর অসংখ্য কুকর্মের দ্বারা। চু চঙ্গলিন জাতির চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাসের ডিজিনের উপপত্নীকে ভিত্তি করে যিনি একই রকমের বদমাশ ছিলেন বলে মনে করা হয়।

চিয়াং চিয়া: ঐতিহাসিক দিক থেকে চিয়াং চিয়া হলেন সেই অভিজাত যিনি জোড রাজবংশের প্রতিষ্ঠায় একটি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। দেবতাদের উত্তরাধিকার অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন শি থিয়ান মুনের একজন প্রধান শিষ্য যাকে চে-তি শক্তিকে সাহায্য করার জন্য মর্ত্যে পাঠান হয়েছিল। সমস্ত কাহিনিতে তিনি প্রধান রণকৌশলবিদের ভূমিকা পালন করেছিলেন যদিও কখনও কখনও তিনি যুদ্ধেও যোগ দিয়েছিলেন।

লেই চেনচি: লেই চেনচি ছিলেন চে-তি উ ওয়াং-এর একজন সৎভাই যিনি জাদু বাদাম খাওয়ার পর ডানা ও ঠোটযুক্ত বাজপাখির মতো একটি প্রাণীতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি আবহাওয়ার জাদুতে বিশারদ ছিলেন এবং তিনি তার সৎ ভাইকে সেনাবাহিনীর একজন যোগ্য পথপ্রদর্শকরূপে সাহায্য করেছিলেন। তিনি নিজেও যুদ্ধে অনেক উল্লেখযোগ্য জয়প্রাপ্ত হয়েছিলেন। বর্তমানে কোন কোন পাঠক মনে করেন যে কাহিনিতে সেই চিংচি লেই কং-এর রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন যিনি চৈনিক কল্পকাহিনির বক্রদেবতা।

লিচিং মূলত তিনি ছিলেন একজন উচ্চ পদস্থ শাং আধিকারিক। পরবর্তীকালে তিনি দলত্যাগ করে ওয়াং-এর একজন প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব লাভ করেন। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ ও বোঝা ছিল তাঁর বিদ্রোহী তৃতীয় পুত্র নেঝা যার সঙ্গে তিনি একসময় সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ছিলেন। নেঝাকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে লিকে এরপর একটি জাদু প্যাগোডা দান করা হয়েছিল সেখানে তৎক্ষণাৎ অধিকাংশ ব্যক্তিকে বন্দি করা যেতে পারে। অন্যান্য এশীয় কল্পকাহিনির সঙ্গে পরিচিত পাঠকেরা তৎক্ষণাৎ লির সঙ্গে জাপানি বৌদ্ধ অভিভাবক বিসামনের সাদৃশ্য খুঁজে পারেন লিং ছিংকে প্রায়শই তার উপাধি 'প্যাগোডা বহনকারী' স্বর্গীয় রাজা দ্বারা উল্লেখ করা হয়।

 

নান চি চিয়ান ওয়েং: তিনি দক্ষিণ মেরুর স্বর্গীয় সাধু যিনি দেবতাদের উত্তরাধিকার অনুষ্ঠানের একজন অপ্রধান চরিত্র। তিনি মাঝে মাঝে উয়ান শি থিয়ান চুনের বয়স্কতম শিষ্য হিসেবে মাঝে মাঝে শক্তিকে সহায়তা করেছেন। এছাড়া ঝোউ স্বর্গীয় কাহিনিটি অন্যান্য ধ্রুপদী রচনাতেও আবির্ভূত হয় এবং সাধারণভাবে এটিকে চৈনিকদের দীর্ঘ আয়ুর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কেউ কেউ তাকে কান চিং-এর শেতি বলেও বিবেচনা করেন। নেঝা তিনি হলেন কাহিনির সবচেয়ে বিখ্যাত প্রধান চরিত্র এবং চৈনিক সংস্কৃতির কল্পকাহিনির অন্যতম কিংবদন্তি চরিত্র। তিনি ছিলেন সেনাপতি লিচিং-এর আবেগপ্রবণ তৃতীয় পুত্র। তিনি ছিলেন একটি স্বর্গীয় আত্মার পুনর্জন্ম এবং তার মা তাঁকে ৪২ মাস গর্ভে ধারণ করার পর জন্ম দিয়েছিলেন। পিতার ও অন্যান্য অলৌকিক চরিত্রের সঙ্গে অনেক দ্বন্দ্বের পর নেঝা আত্মহত্যা করেন কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি একটি পদ্মনির্মিত দেহ ব্যবহার করে পুনর্জন্মলাভ করেন। তারপর তিনি অনেক ক্ষমতা ও অস্ত্রলাভ করেন এবং তাঁর বাবার সঙ্গে ঝোউ শক্তির সঙ্গে যোগ দেন। আজকে নেঝা বা তৃতীয় রাজকুমার তাইওয়ানের সবচেয়ে প্রিয় তাওবাদী দেবতাদের অন্যতম।

শেঙন পাও: শেঙন পাও ছিলেন চিয়াং চিয়ার সহশিষ্য। তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরোধিতা করে শেং শক্তির সঙ্গে যোগ দেন। তিনিও বারংবার চিয়াং চিয়ার এবং অন্যান্য ঝোউ সেনাপতিদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে দূর উত্তরে কারারুদ্ধ হন। শেঙন পাওয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত জাদু হল তাঁর মাথা কেটে পুনরায় জোড়া লাগানোর ক্ষমতা। তাই-ই জেন পেন: তাই-ই জেন পেন তাও ধর্মের একজন প্রধান দেবতা যাঁর ভূমিকা পরিত্রাতা হিসেবে অমিতা বুদ্ধের সমতুল্য। দেবতাদের উত্তরাধিকারের সময় তিনি নেঝার শিক্ষক ছিলেন এবং বারোজন উজুর সাধুদের অন্যতম ছিলেন। তিনি ছিলেন উয়ানশি তিয়ান চুনের প্রধান শিষ্য। তাঁকে স্মরণ করা হয় কারণ তিনি নেঝাকে অনেক জাদু অস্ত্র উপহার দিয়েছিলেন।

থং থিয়ান চিয়াও ঝু: এই কাহিনিতে, থং থিয়ান ছিলেন লাওচি ও উয়ানশির একজন সহ শিষ্য এবং স্যাঙের সেনাদলের আধ্যাত্মিক গুরু। এই কাহিনি সূত্র হল লাওচি ছেন সম্প্রদায় ও তং তিয়ান চিয়ে সম্প্রদায়ের মধ্যে অলৌকিক দ্বন্দ্ব। এই সম্প্রদায়গুলি যথাক্রমে ঝোউ ও শাং শক্তির পৃষ্ঠপোষক ছিল। দুটি জাদু শাখা শেষ পর্যন্ত কাহিনির সর্বশেষ তৃতীয়াংশে যুদ্ধ বিরতিতে পৌঁছোয়।

ইয়াং চিয়ান: তিনি ছিলেন ছৌ সেনাদলের সবচেয়ে শক্তিশালী যোদ্ধা এবং তাঁর চরিত্রটি নির্মিত হয়েছিল এরলেং সেনের উপর ভিত্তি করে যিনি ছিলেন তাও ধর্মের সবচেয়ে বেশি পূজিত দেবতা। তাঁর সবচেয়ে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যটি হল তাঁর কপালের একটি 'তৃতীয় স্বর্গীয় নয়ন'।

ইয়াং চিয়ান অনেক অলৌকিক কাজ করতে পারতেন এবং তাঁকে সহায়তা করত একটি স্বর্গীয় কুকুর। গোটা কাহিনিতেই ইয়াং চিয়ান ছিলেন প্রায় অপরাজেয়। পাশ্চাত্যের যাত্রায় ইয়াং চিয়ানের সঙ্গে সুন উকং-এর যুদ্ধ ছিল অতি বিখ্যাত। তিনি জেড সম্প্রদায়ের দেবতাদের মধ্যে একমাত্র যোদ্ধা ছিলেন যিনি বানর রাজাকে যুদ্ধ থামিয়ে দিতে সমর্থ হয়ে ছিলেন।

ঝোউ উ ওয়াং : তাঁকে তাঁর পূর্বপুরুষদের নাম চিফা নামে উল্লেখ করা হয়। তিনি ছিলেন প্রাচীন ঝোউ রাজবংশের প্রথম সম্রাট। তিনি দেবতাদের অভিষেকে তার পরিচয়ের অনেকটাই ধরে রাখতে পেরেছিলেন এবং জোট শক্তিকে শাং রাজবংশের বিরুদ্ধে তাদের অন্তিম বিজয় লাভে সাহায্য করেছিল।

চার প্রকার লোক কাহিনি চৈনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে চারটি লোককাহিনি মৌখিকভাবে প্রচলিত আছে। এগুলি হল: প্রজাপতি প্রেমিক, সাদা সাপের কিংবদন্তি, মহিলা মেং চিয়াং, গোপালক ও তন্তুবায় বালিকা।

লিউ ইর কিংবদন্তি : তং ইয়ং এবং সপ্তম পরি।

পাই সুজেন: একজন শ্বেত সর্প আত্মা যিনি বহু শতবর্ষের কর্ষণের ফলে মনুষ্যরূপ লাভকরেছিলেন। পাই সুজেন মনুষ্য চিকিৎসক জু নিয়ালকে ভালোবেসে বিয়ে করার ভুল করেছিলেন। তাঁর জন্য তিনি ফা-হাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন কারণ এই ওঝা ভিক্ষু তাদের বিয়েতে প্রবলভাবে বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি তাঁর বিহারকে প্লাবিত করার জন্য তাঁর জাদু ব্যবহার করেছিলেন। ফাই-হাইয়ের হাতে পরাজিত হওয়ার পর পাই সুজেনকে থাণ্ডার পার্ক প্যাগোডায় কারারুদ্ধ করে রাখা হয়।

তং ইয়ং : তাঁর বাবার শেষকৃত্যের অর্থ সংগ্রহের জন্য তং ইয়ং দাসরূপে নিজেকে বিক্রি করেছিলেন। তাঁর ধার্মিকতা সপ্তম পরিকে বা কি চিয়ান মুকে প্রভাবিত করেছিল এবং শেষোক্তজন রাতারাতি ঝকমকে কাপড়ের চোদ্দটি বোল্ট বুনে তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন। যুগল পরবর্তীকালে বিবাহে করেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয় যখন কি চিয়ানকে স্বর্গে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়।

ফা হাই: স্বর্ণ পর্বতের মন্দিরের অধ্যক্ষ ফা হাই দৃঢ়ভাবে চু চিয়ান এবং পাই সুজেনের বিবাহের বিরোধিতা করেন। তিনি মানুষ ও আত্মার এই বিবাহকে অত্যন্ত অস্বাভাবিক বলে মনে করেছিলেন। পাইকে পরাজিত করার পর তিনি তাঁকে থাণ্ডার পার্ক প্যাগোডায় কারারুদ্ধ করেন।

লিয়াং শানবো : বিখ্যাত প্রজাপতির প্রেমিক কাহিনির প্রধান পুরুষ চরিত্র। লিয়াং ছিলেন একজন গ্রন্থকীট যিনি পুরোপুরি দেখতে ব্যর্থ হয়ে ছিলেন যে তাঁর পাতানো ভাই এবং সহধ্যায়ী ছিলেন একজন মহিলা অর্থাৎ চু হংতাই। যখন তিনি এটি আবিষ্কার করেন তখন তিনি গভীরভাবে তাঁর প্রেমে পড়েন যদিও তিনি তাঁকে বিবাহ করতে পারেননি কারণ তিনি পূর্বেই বাগদত্তা ছিলেন। দুঃখে নিমজ্জিত হয়ে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে এবং তিনি শেষ পর্যন্ত মারা যান। যখন চু তাঁর বিবাহ শোভাযাত্রা নিয়ে তাঁর কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তিনি স্বর্গকে আবেদন করেন কবর উন্মুক্ত করতে এবং তার ইচ্ছা পূরণ হলে তিনি গর্তের মধ্যে লাফিয়ে পড়েন। তাঁদের আত্মা স্বর্গ থেকে অবিচ্ছেদ্য একজোড়া প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসে এবং এর ফলে কাহিনিটির সাধারণ নামের জন্ম হয়েছে।

লিউ ই: ভাষাতত্ত্ববিদ লিউ ই হঠাৎ ডং ডির হ্রদে তৃতীয় ড্রাগন রাজকুমারীর দুর্দশা আকস্মিক ভাবেই জানতে পারেন। এই কথা জেনে তিনি তাঁর পরিবারকে তা জানান এবং তারা তাঁকে মুক্ত করার জন্য এক বিশাল সৈন্যবাহিনী পাঠান। এই দয়ার জন্য রাজকুমারী লিউ ই-র প্রেমে পড়েন কিন্তু রাজকুমারীর অত্যাচারী স্বামী যিনি এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়ে ছিলেন তাঁর কথা মনে করে লিউ ই তার প্রেমকে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত রাজকুমারীর এক কাকার হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত এই বিয়ে হয়।

লং কং সানকং ঝু: তাঁর নামের আক্ষরিক অনুবাদটি হল ড্রাগন রাজসভার তৃতীয় রাজকুমারী। এই রাজকুমারীর সঙ্গে তাঁর স্বামী দুর্ব্যবহার করে তাঁকে তং থিং এ নির্বাসিত করেন। সেখানে তিনি লিউ ইর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার আগে পর্যন্ত দুঃখভোগ করেন।

মেং জাও: শ্বেত সর্পের কিংবদন্তির কোন কোন সংস্করণে মেং জাও ছিলেন চু চিয়ান ও পাই সুজেনের পুত্র। চৈনিক সাম্রাজ্যের পরীক্ষাগুলিতে প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি তাঁর মাকে রম্ভ চূড়া প্যাগোডা থেকে মুক্ত করেন। তাঁর নামের অর্থ হল স্বপ্ন পাইথন এবং তাঁকে শি নিন নামেও ডাকা হয়।

মেং চিয়াং হু: এই কাহিনিটিতে বলা হয়েছে মেং চিয়াং মহোদয়ার স্বামী চীনের বিশাল প্রাচীর নির্মাণের জন্য শ্ছি রাজবংশের কাছ থেকে দায়িত্বলাভ করেছিলেন। বহু বছর ধরে তাঁর কোন সংবাদ না পাওয়ার ফলে তিনি তাঁকে খুঁজে বের করার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। একটি স্থানে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে তাঁর স্বামী মারা গিয়েছেন এবং তাই তিনি দেওয়ালের একটি অংশ ভেঙে পড়ে এবং তার ফলে তার হাড় বেরিয়ে পড়ে। আধুনিককালে এই লোককাহিনিটিকে অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামরূপে দেখা হয়েছে।

নিউ লাং: নিউ লাং-এর অর্থ হল গোপালক। তিনি ছিলেন একজন মানুষ যিনি অমর জিনুর প্রেমে পড়েছিলেন যিনি ছিলেন একজন তত্ত্ববায় বালিকা। যেহেতু তাদের মধ্যে প্রেম নিষিদ্ধ ছিল, তাই তাঁদের ছায়াপথের বিপরীত দিকে নির্বাসিত করা হয়। তাঁদের কেবল বছরে একবার ম্যানপাইয়ের জাদু সেতুতে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্রের দিক থেকে দেখলে নিউ লাং আলতেয়ার নক্ষত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং জিনু ভেগা নক্ষত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। শেষেও এই দ্রুপদী কল্পকাহিনিটি পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অংশে ব্যাপকভাবে পরিচিত। যেমন জাপানে এটি তানাবাতা নামে পরিচিত।

শ্ছি চিয়ান নু: 'সপ্তম পরী' ছিলেন একজন স্বর্গীয় তাঁতি যিনি তং ইয়ঙের পিতামাতার প্রতি আত্মবলিদানকারী ভক্তি দেখে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। জাদুবিদ্যার সহায়তায় তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করার পর চ্ছি চিয়ান নু তং ইয়ংকে বিবাহ করেন এবং তাঁর সঙ্গে মর্তে বসবাস করেন যতদিন না তিনি স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন। অনেক চৈনিক তং ইয়ং এবং শ্ছি চিয়ান নুর কাহিনিকে গোপালক ও তত্ত্ববায় বালিকার একটি বিকল্প সংস্করণ বলে মনে করেন।

চিয়াও ছিন: চিয়াও ছিন পাই সুজেনের সবুজ সর্প সঙ্গী ছিলেন। যদিও তিনি বয়সে কনিষ্ঠ এবং শক্তিতে দুর্বল ছিলেন, তিনি তাদের পরাজয়ের পর ফা হাইয়ের দ্বারা কারারুদ্ধ হওয়ার হাত থেকে মুক্তি পান। কিংবদন্তির কোন কোন সংস্করণে, তিনি ছিলেন সেই চরিত্র যিনি পরবর্তীকালে পাই সুজেনকে মুক্ত করেন।

চু চিয়ান: চু চিয়ান ছিলেন একজন চিকিৎসক যার জীবন পাই সুজেনের সাক্ষাৎ হওয়া এবং তার প্রেমে পড়ার পর পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। যিনি ছিলেন একজন দয়ালু শ্বেত সর্প-আত্মা। যদিও তারা বিবাহ করেছিলেন, তাদের বিবাহ দুঃখের মধ্যে শেষ হয়েছিল এবং এর জন্য দায়ী ওঝা ভিক্ষু ফা হাইয়ের তীব্র বিরোধিতা।

চু চিং তাই: লিয়াং শানবো (উপরে) চৈনিক কিংবদন্তির নায়করা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে চৈনিক কিংবদন্তির অনেক দেবতাই বাস্তবে ঐতিহাসিক চরিত্র ছিলেন যাঁদের উপর পরবর্তীকালে দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। সাধারণত তারা ব্যাপকভাবে সমাহুত ধ্রুপদী গুণের মূর্ত প্রতীক হয়ে থাকেন।

পাওজেং: পাও ছিলেন উত্তর সং রাজবংশের সমকালীন একজন বিচারক যিনি তাঁর চরিত্রের ন্যায়পরায়ণতা ও সততার প্রতি অনুরাগের জন্য বিখ্যাত তাঁকে বিকল্পভাবে পাও হিংয়াথিয়ান নামেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে, কারণ হিংয়াথিয়ান শব্দটি হল ন্যায়ের চৈনিক উপমা। এ কথা বিশ্বাস করা হয় যে তিনি ওয়েন চাং-এর একজন অবতার ছিলেন এবং তিনি ইয়ান লুও ওয়াংরূপে মৃতদের বিচার করেন।

চুংকুই : চৈনিক লোককাহিনিতে চুং কুই ছিলেন একজন মেধাবী পণ্ডিত যিনি তাঁর বন্য চেহারার কুইকে অশুভ আত্মাদের একজন ধ্বংসকারী বানিয়েছিলেন। কাহিনিটির কোন কোন সংস্করণে রাগি পণ্ডিতকে ভূতেদের রাজা এই কাল্পনিক উপাধিও দেওয়া হয়েছে।

নরক : চৈনিক নরকের দুটি সংস্করণ রয়েছে। একটি হল নরকের দশটি আদালত যেটি বৌদ্ধ বিশ্বাসের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। অপরটি হল নরকের আরেকটি স্তর, যেটিরও ভিত্তি হল বৌদ্ধ বিশ্বাস এবং যেটির উৎপত্তি হয়ে ছিল তাং বংশের রাজত্বকালে। মূল বৌদ্ধ ধর্মে এর কোন অস্তিত্ব নেই। এগুলো পরবর্তীকালের সংযোজন।

চেং হুয়াং: নগরের তাওবাদী দেবতা বা আরও নিখুঁতভাবে বললে মোট নামে নগরের দেবতা। চেং হুয়ার কোন একক দেবতা নয় এটি একটি উপাধি। অনেক চৈনিক লোকবিশ্বাসে বলা হয়েছে চেং হুয়াং হলেন সমস্ত অমর সত্তা যাদের উপর দায়িত্ব হল নরকে দাখিল করার জন্য মানুষের পাপ ও পুণ্যের হিসাব রাখা।

 

হেই পাই-উ চাং: এটিকে অনুবাদ করা হয়েছে সাদা ও কালোর ক্ষণস্থায়িত্ব। হেই পাই উ চাং হলেন দুজন ভৌতিক নরকবাসী আধিকারিক যাদের দায়িত্ব হল পাপী আত্মাদের গ্রেপ্তার করা। পুণ্যবানদের পুরস্কৃত করা এবং পাপীদের শাস্তি দেওয়া তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হল দীর্ঘ জিব। কোন কোন লোকবিশ্বাসে তাদের চৈনিক সম্পদের দেবতারূপে মনে করা হয়।

মা মিয়ান: মা মিয়ানের অর্থ হল 'ঘোড়া মুখ' এবং এরা নরকের আধিকারিকদের একটি গোষ্ঠী যাদের দায়িত্ব হল বিচারের জন্য আত্মাদের নরকে নিয়ে আসা। অপর বিশ্বাস অনুসারে মা মিয়ান কোন গোষ্ঠী নয়, তিনি হলেন একজন আধিকারিক যিনি নরকে যাওয়ার সেতুটিকে পাহারা দিচ্ছেন।

মেং পো: চৈনিক নরকের কোন কোন সংস্করণে মেং পো হলেন একজন বয়স্কা মহিলা যিনি বিস্মৃতির দেবী। তিনি আত্মাদের একটি জাদু ঝোল খেতে দেন তাদের পুনর্জন্মের আগে যাতে করে এটি নিশ্চিত হয় যে তারা তাদের পূর্ব জীবন ও নরক সম্পর্কে সবকিছু ভুলে যাবে।

নিউ থেতি: নিউ থেতি-এর অর্থ হল ষাঁড়ের মতো মাথা এরা নরকের আধিকারিকদের একটি গোষ্ঠী যারা আত্মাদের বিচারের জন্য নরকে নিয়ে আসে। অন্যান্য বিশ্বাস অনুসারে নিউ থেতি কোন জাতি নয়, তিনি একজন আধিকারিক যিনি নরকে যাওয়ার সেতুটি পাহারা দেন।

পান কুয়ান: চৈনিক ভাষায় পান কুয়ান শব্দের অর্থ হল 'বিচারক'। নরকের চৈনিক লোককাহিনির বিবরণে পান কুয়ান কোন প্রকৃত বিচারক নন বরং একধরণের মোক্তার। তাঁর প্রাথমিক দায়িত্ব হল আত্মাদের পূর্ববর্তী পাপের তালিকাকরণের উদ্দেশ্য জাদু ইতিবৃত্তগুলি পরীক্ষানিরীক্ষা করা।

ইয়ান লুও ওয়াং: ইয়ান লু ওয়াং হল বৈদিক নাম 'যম'-এর লিপ্যন্তর এবং এটি নরকের রাজাকে বোঝানোর জন্য চৈনিক কথপোকথনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বংশানুক্রমিক উপাধি। যদিও চৈনিক নরকের দশটি সভা সংস্করণে ইয়ান লুও ওয়াং বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন সেই বিচারকের কথা যিনি পঞ্চম রাজসভার উপর সভাপতিত্ব করেন। কোন কোন চৈনিক লোককাহিনিতে এমনও দাবি করা হয়েছে যে ইয়ান লুও ওয়াং পাও জেং ছাড়া অন্য কেউ নয়।

 চৈনিক কল্পকাহিনির দেবতাগণ এবং জনপ্রিয় লোককাহিনির দেবতাগণ এবং জনপ্রিয় লোককাহিনি, কিংবদন্তি ইত্যাদির চরিত্রসমূহ:

আও কুয়াং: তিনি হলেন পূর্বের মহাসাগরের ড্রাগন রাজা। প্রায়শই তাঁকে চৈনিক লোককাহিনি ও কল্পকাহিনির অর্ধবিরোধী হিসেবে আবির্ভূত হতে দেখা যায়, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল দেবতাদের অভিষেক।

 

হুয়াং তাশিয়ান: ওষুধ ও চিকিৎসা শাস্ত্রের চৈনিক লৌকিক দেবতা। হংকং-এ তাঁর পূজা ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে এবং কুইলুন একটি পুরো জেলার নামকরণ তাঁর নামে করা হয়েছে।

হুয়া শান শেং মু: লোটাস ল্যান্টার্ণ অপেরার প্রধান চরিত্র জেড সম্রাটের অবৈধ ভ্রাতুষ্পুত্রী এবং একজন সর্বশক্তিমান জাদু লণ্ঠনের মালিক। একজন মরণশীল মানুষকে বিবাহ করার পর শাস্তিস্বরূপ তাঁকে হুয়া পর্বতে বন্দী করে রাখা হয়। কিংবদন্তির সবকটি সংস্করণে তাঁর পুত্র চেন চিয়াং শেষ পর্যন্ত পর্বত ফাটিয়ে তাঁকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন। হুয়া সান শেং মুয়ের ভাই (উপরে দ্রষ্টব্য) এরলাং শোনকে পরাজিত করে তিনি এই কাজটি করতে সমর্থ হল। শেষোক্ত জন পূর্বে মূল্যবান লক্ষণটি ঠকিয়ে নিয়ে নেন।

লুওশেন: তিনি ছিলেন ফুসির একজন কন্যা যিনি পীত নদীতে ডুবে যাওয়ার পর তাঁর কন্যা হয়ে ছিলেন। তিনি চাওঝছি তৃতীয় শতকের কবিতার জন্য আরও বেশি বিখ্যাত।

চীনের ধর্মীয় স্বাধীনতা:

চীনের ধর্মীয় স্বাধীনতা হল এমন একটি বিষয় যা আন্তর্জাতিক সংবাদ, সরকারি নথিপত্র এবং অসরকারি প্রতিবেদনে চীনের ভিতরে ও বাইরে পণ্ডিতদের দ্বারা প্রয়োজনের তুলনায় কম আলোচিত হয়েছে। চীনের অভ্যন্তরে এবং কিছু পরিমাণে চীনের বাইরেও অনেক পণ্ডিতকে এই বিষয়ে আলোচনা করতে ভীত বলে মনে হয়। যেহেতু চৈনিক সাম্যবাদী কর্তৃপক্ষের কাছে এতটাই স্পর্শকাতর একটি বিষয় যে এটি সম্পর্কে ছাপার অক্ষরে আলোচনা করাও অত্যন্ত বিপজ্জনক। যখন চীনের অভ্যন্তরের পণ্ডিতরা সাধারণভাবে ধর্মীয় ব্যাপারে লিখলে রাজনৈতিক নিন্দা ও তার ফলাফলের ভয় করেন, চীনের বাইরের পণ্ডিতেরা আশঙ্কা করেন যে চীনে ধর্মীয় স্বাধীনতার অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করলে সে দেশের দরজা তাদের সামনে বন্ধ হয়ে যাবে। পণ্ডিতরা যদি উপযুক্ত তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক সাহায্য পান তাহলে চীনের ধর্মীয় স্বাধীনতার ফলপ্রসু আলোচনার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এই ক্ষেত্রে আরও অগ্রসর হতে গেলে মুক্তচিন্তার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

প্রথমত, shi shi qiu shi-to seek truth from facts-এর নীতিকে অনুসরণ করা, যেটিকে দেং জিয়াও পিং ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকে চৈনিক সাম্যবাদী নতুন নীতি হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছিল। শত্রুতা ও আদর্শগত অবস্থান পোষণের সংকীর্ণ অর্থে সত্যের অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যাকে 'রাজনৈতিক হওয়ার প্রয়োজন হয় না। বরং এটি রাজনীতির বিস্তৃততম ও শ্রেষ্ঠতম অর্থে রাজনৈতিক যেটি জনস্বার্থের সঙ্গে জড়িত বা চিন্তিত। বাস্তবিকই সঠিকভাবে বুঝলে ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টিকে বর্তমান পৃথিবীর বিবেকবান নাগরিকরা এড়িয়ে চলতে পারবেন না।

এছাড়াও ধর্মীয় তর্কযোগ্যভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রথম স্বাধীনতা অর্থাৎ এটি আসে অন্য যেকোনো স্বাধীনতার পর্বে এবং এটি অন্যান্য স্বাধীনতার উৎস হিসেবে কাজ করে। (দ্রষ্টব্য যেমন Balmer, Grvgreg and Marby 2012)। যতদিন না চৈনিকরা ধর্মীয় স্বাধীনতার উন্নততর বোধ মূল্যায়ন লাভ করছেন ততদিন চীনের অধিকতর গণতান্ত্রিকীরণ অসম্ভব না হলেও কঠিন। ধর্মীয় স্বাধীনতার ঘাটতি অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক শৃঙ্খলাকে ব্যহত করবে। অপরদিকে, যদি ধর্মীয় স্বাধীনতা অন্যান্য স্বাধীনতাগুলির আগে যায় যেমন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা ইত্যাদি তাহলে তার ফলে গণতন্ত্রের দিকে একটি মসৃণতর এবং অপেক্ষাকৃত কম উদ্বায়ী সঞ্চরণ ঘটবে।

ধর্মীয় স্বাধীনতার তিনটি বৈশিষ্ট্য: conception, নিয়ন্ত্রণ এবং নাগরিক সমাজ। কোন কোন সমাজতত্ত্ববিদ ধর্মীয় স্বাধীনতার বিভিন্ন তত্ত্বের বিকাশ ঘটান এবং এটিকে আন্তর্জাতীয় মাধ্যম হিসেবে দেখেন (Barker 2003. Richardson 2006. Grim and Finke 2011) চীন এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে তিনটি প্রধান স্তরে বিভক্ত করা যেতে পারে, conception, নিয়ন্ত্রণ এবং নাগরিক সমাজ। এই স্বাধীনতাটিকে অর্জন ও স্থিতিশীল রাখতে গেলে তিনটি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটাতে হবে এবং এটি যে কোন সমাজেই প্রকৃতপক্ষে অর্জন করা ও রক্ষা করা কঠিন।

পাশ্চাত্যে সাধারণত ধর্মীয় স্বাধীনতার ধারণাটি আইন হবার পূর্বে আসে অর্থাৎ এটিকে রাষ্ট্র বলবৎ করবে এবং নাগরিক সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের অন্তর্গত প্রতিটি নাগরিক রক্ষা করবেন। এই ধারণাটিকে নাগরিকদের দ্বারা গৃহীত হতে হবে বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের অভিজাতদের দ্বারা এবং একমাত্র তারপরই আইন প্রণয়ন ও আইনের অনুশীলন সম্ভব হবে।

যে সমস্ত সমাজে বাইরের শক্তির মোকাবিলা করার জন্য আধুনিককরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে ছিল সেখানে লিখিত আইনকে গ্রহণ করা বা চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে কেবলমাত্র বিদেশি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে। চীনের ক্ষেত্রেও তাই। যদিও 'ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা' এই ধারাটিকে শুরু থেকেই গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানের অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাংবিধানিক অধিকারটিকে সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ হতে পারে ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে বিশেষত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিজাতদের একটি সাধারণ ধারণার অভাব এবং নাগরিক সমাজের বিকাশের অভাব যা সচেতনভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে।

তিনটি বিস্তৃত ক্ষেত্রের প্রতিটির জন্য প্রয়োজন আরও বেশি অভিজ্ঞতাভিত্তিক গবেষণা এবং তাত্ত্বিক চিন্তা: পরিবর্তনশীল ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ, চৈনিক অভিজাত এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে ধারণা এবং নাগরিক সমাজের উত্থান যার ফলে আরও বৃহৎ স্বাধীনতা লাভ করতে পারে। 

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরীশ্বরবাদের দ্বন্দ্বমূলক ধারণা:

বর্তমান চীনদেশে সমস্ত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিজাতরাই ধর্মীয় স্বাধীনতার অর্থ বুঝতে অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে, চৈনিক সাম্যবাদী সরকারের দলীয় রাষ্ট্রীয় নথিপত্রে এই সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় আলোচনা করা হয়েছে। যেমন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৯৮২ সালের ১৯ নম্বর নথির শীর্ষক হল "আমাদের দেশের সমাজতান্ত্রিক পর্বের সময়কার মূল লক্ষ্য ও নীতি” এবং এটি এই বিষয়ে ধর্মীয় নীতিকে তারপর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। এখানে একটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে।

ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা বলতে আমরা কী বুঝি? আমরা একথাই বুঝি যে প্রতিটি নাগরিকের ধর্মে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস করার স্বাধীনতা রয়েছে। তার এই ধর্ম বা ঐ ধর্মে বিশ্বাস করার স্বাধীনতা রয়েছে। একটি বিশেষ ধর্মের মধ্যে তার যে কোন একটি সম্প্রদায়ে বিশ্বাস করার স্বাধীনতা রয়েছে। যদি কোন ব্যক্তি পূর্বে ধর্মে অবিশ্বাসী হত তার পরবর্তীকালে ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার এবং পূর্বে ধর্মে বিশ্বাসী হলে পরবর্তীকালে তার ধর্মে অবিশ্বাসী হওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে।

এটি হল ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে একপ্রস্থ প্রজ্ঞালোকিত বিবৃতি যার মধ্যে রয়েছে একটি বিশেষ ধর্ম গ্রহণ করার স্বাধীনতা। এটি অনেকটাই আধুনিক সমাজের বোধ এবং জাতিসংঘের গ্রন্থগুলিতে প্রতিফলিত হওয়া আন্তর্জাতিক বিধিসমূহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। (ইভান্স ২০০২)।

এই প্রজ্ঞালোকিত অনুচ্ছেদটিকে অনুসরণ করে চৈনিক সমাজতন্ত্রী দলের আদেশনামায় বলা হয়েছে যে সমাজতন্ত্রী দলের সদস্যদের অতি অবশ্যই নিরীশ্বরবাদী হতে হবে এবং অব্যাহতভাবে নিরীশ্বরবাদ প্রচার করতে হবে। অন্য কথায় সমাজতন্ত্রী দলের সদস্যদের উপর নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রযোজ্য হবে না এবং তাদের অবশ্যই নিরীশ্বরবাদের প্রতি অনুগত থাকতে হবে। তবে এটি তেমন সম্ভব নাও হতে পারে যদি চৈনিক সমাজতন্ত্রী দল একমাত্র রাজনৈতিক দল না হত তাহলে সেক্ষেত্রে নাগরিকরা এই দলে যোগদান করতেও পারত বা নাও করতে পারত। তবে, বাস্তবে সমাজতন্ত্রী দলের একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে এবং প্রায়শই এই দলে যোগদান সমস্ত চীনদেশে প্রায় সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠানে সরকারি পদ ও নেতৃত্বলাভের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। যে কোন ব্যক্তি যার জনসেবায় বা নেতৃত্বদানের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে তার চৈনিক সমাজতন্ত্রী দলে যোগদান করার চেষ্টা ছাড়া আর কোন উপায় নেই এবং এই জন্য তাদের ধর্মকে সমালোচনা করে নিজেদের নিরীশ্বরবাদী হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।

সমাজতন্ত্রী দলের সদস্যদের উপর নাস্তিকতা জোর করে বলবৎ করা অসম্ভব। ২০০৭সালের চাইনিজ স্পিরিচুয়াল লাইফ সার্ভে অনুসারে প্রমাণিত হয় যে সমাজতন্ত্রী দলের প্রায় ৮৪ শতাংশ সদস্য এবং সাধারণ নাগরিকদের প্রায় ৮৫ শতাংশ স্বীকার করেছেন যে তাঁরা কোন না কোন ধর্মীয় বিশ্বাস পোষণ করেন এবং / অথবা কোন না কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন (ইয়াং ২০১০)।

চৈনিক সমাজতন্ত্রী দলের নিজস্ব সদস্যদের উপর নাস্তিকতা বলবৎ করা অসম্ভব হওয়া সত্বেও চৈনিক সমাজতন্ত্রী দল এই নিরীশ্বরবাদী দর্শনকে বলবৎ করেছে সমস্ত চৈনিক নাগরিকদের দ্বারা অনুসৃত রাষ্ট্র ও দলের ধর্মীয় নীতির ভিত্তি হিসেবে। কর্তৃপক্ষ যেভাবেই এটির যৌক্তিকতা প্রমাণ করার চেষ্টা করুন না কেন এই ধরনের ভিত্তি অবশ্যই ধর্মীয় স্বাধীনতার উপরোক্ত অনুচ্ছেদটিকে অনেকাংশে গুরুত্বহীন করে দেবে। সমাজতন্ত্রী দলের নীতিতে 'ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা' এবং তার নিরীশ্বরবাদী দর্শনের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব (এবং সংবিধান) হল একটি চিরন্তন সমস্যা, যেটি কেবল সমাজতান্ত্রিক দলের সদস্যদের বা সাধারণ জনগণের কাছেই নয় ধর্মীয় বিষয় সংক্রান্ত কাজকর্ম পরিচালনাকারী সেই আধিকারিকদের পক্ষেও বিভ্রান্তিকর যাঁরা প্রায়শই পরস্পরবিরোধী, নীতির মাঝখানে দ্ব্যর্থক, দোদুল্যমান এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।

বিভ্রান্তি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ নাস্তিকতার অনেকগুলি সংস্করণ রয়েছে সেগুলিকে সংগ্রামশীল নাস্তিকতা, আলোকিত নাস্তিকতা ও ঈষৎ নাস্তিকতা (ইয়াং ২০১১-এ) রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। চীনদেশের নাস্তিকতার মার্ক্সীয় সরকারি নীতিতে বলা হয়েছে ধর্মের মূল বিষয়বস্তু হল জনগণের আধ্যাত্মিক আফিম এবং এর ভাগ্য হল অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।

আলোচিত নাস্তিকতা মনে করে ধর্ম হল প্রবঞ্চক ও মিথ্যা ধারণা, এটি একই সঙ্গে অবৈজ্ঞানিক এবং পশ্চাদবর্তী, এই কারণে ভুল পথে চালনাকারী ধর্মীয় ধ্যানধারণাকে বিতাড়িত করার জন্য নিরীশ্বরবাদী প্রচারকার্য অতি আবশ্যক। তুলনায়, সংগ্রামশীল নিরীশ্বরবাদ মনে করে ধর্ম হল মানুষের পক্ষে একটি বিপজ্জনক আফিম ও মাদক দ্রব্য। এটি একটি ভ্রান্ত রাজনৈতিক দর্শন যেটি শোষক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে এবং বিপ্লববিরোধী কার্যকলাপকে পুষ্ট করে; এই কারণে ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োজন। (ইয়াং ২০১১, ৪৬)।

চীনের ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য নিরীশ্বরবাদের বিভিন্ন সংস্করণ প্রয়োজনীয়। যদিও প্রজ্ঞালোকিত নিরীশ্বরবাদ ১৯৮২-র ১৯ নং নথিতে উল্লিখিত হয়েছে, সংগ্রামশীল নিরীশ্বরবাদ যেটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় (১৯৬৬-১৯৭৬) প্রধান ছিল বিশেষত চৈনিক সমাজতন্ত্রী দলের যান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে চিরন্তন হয়ে উঠেছে। প্রধানত সমাজতান্ত্রিক দলের বিদ্যালয়গুলির দ্বারা সেখানে নেতৃত্বমূলক পদলাভের জন্য চৈনিক সমাজতন্ত্রী দলের সদস্যদের পর্যায়ক্রমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল এই বিষয়টি যে ধর্মীয় বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের একটা বড় অংশ সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মী এবং ধর্ম সম্পর্কে তাদের ধারণা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অমার্জিত ও শত্রুভাবাপন্ন। মাঝারি ও নিম্ন স্তরের এই সমস্ত আধিকারিকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সংগ্রামশীল নাস্তিক্য থাকার কারণে এটি শোনা মোটেই বিস্ময়কর নয় যে স্থানীয় আধিকারিকরা এই কথা বলে ধর্মকে দমিয়ে রাখছেন যে এই ধরণের মানসিকতাকে দল অনুমোদন করে না বরং এটি তার নীতি বিরোধী। দুটিই একই সঙ্গে সত্য যেহেতু-আলোচিত নাস্তিক্য ও সংগ্রামী নাস্তিক্য দুটিই একই সঙ্গে পরিচালক ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বর্তমান রয়েছে।

চৈনিক সমাজতন্ত্রী দলের ১৯ নং নথিতে আলোচিত নাস্তিক্যের ভিত্তি করে জনগণকে উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সেই সীমিত স্বাধীনতাকেও কার্যক্ষেত্রে সম্পূর্ণ প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি এবং এর জন্য আংশিকভাবে দায়ী হল এই যে ধর্মীয় বিষয়ের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের প্রবণতা হল মনে মনে এক ধরণের সংগ্রামী নাস্তিক্য পোষণ করা।

 

২০০০ সালে সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক জিয়াং জেমিন দলের যুক্তফ্রন্ট বিভাগের সদস্যদের সামনে একটি বক্তৃতায় ধর্মের একটি সাহসী ধারণাকে প্রকাশ করেন, নাস্তিক্যমূলক ভাষার উপর জোর দেওয়া সত্ত্বেও তিনি মন্তব্য করেন যে দূর ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ও সামাজিক শ্রেণি অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত ধর্মের মৃত্যু নাও ঘটতে পারে। এই মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে নাস্তিক্যমূলক ও ধর্মবিরোধী প্রচারের প্রয়োজন বর্তমানে নাও হতে পারে। এটি একটি আকর্ষণীয় ধারণা। তবে দলের অধিকাংশ তাত্ত্বিক এটিকে প্রত্যাখ্যান করেন। প্যান উয়ে জিয়াং-এর বক্তৃতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যার শীর্ষক ছিল "ধর্ম সম্পর্কে মার্কসবাদী মতবাদকে অবশ্যই সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অগ্রসর হতে হবে” (২০০১)। মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা অত্যন্ত দ্রুত প্যানের সমালোচনা করতে শুরু করেন এবং তাঁর কণ্ঠরোধ করতে সফল হন।

২০০৭ সালে কেন্দ্রীয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের একজন পণ্ডিত মোউ চর্জিয়ান একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যার শীর্ষক ছিল, "চৈনিক সমাজতন্ত্রীদের নরমপন্থী নিরীশ্বরবাদী হওয়া উচিত।” মৌউ বলেন যে নরমপন্থী নিরীশ্বরবাদীরা ধর্মে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু ধর্মের প্রতি তাঁদের মানসিকতা যুক্তিসঙ্গত। ধর্মকে সরাসরি আক্রমণ করার পরিবর্তে তাঁদের উচিত সেই সমস্ত প্রাকৃতিক ও সামাজিক শক্তিগুলিকে আক্রমণ করা যা মানুষকে ধর্মের দিকে চালিত করে। ধর্ম বিরোধী প্রচার কার্যে যুক্ত হওয়ার পরিবর্তে তাঁদের উচিত ধর্ম বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করা। আধুনিক সমাজের সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের আদর্শে বিশ্বাস করা এবং মানবাধিকার রক্ষা করা। মৌউ গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন এটিই মার্কসবাদের ধর্ম সম্পর্কে সনাতনী বোধ হওয়া উচিত। ২০০২ সালে জিয়াং জেমিনের নেতৃত্বের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কোন কোন মানুষ আশা করেছিলেন যে বৃহত্তম ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটতে পারে যেমন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের ধর্মে বিশ্বাসী হওয়া অনুমোদন করা, যেমনটা ঘটেছিল তখন যখন ব্যবসার মালিক বা পুঁজিপতিদের সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দেবার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। শেষোক্তটিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল ২০০২ সালের শেষদিকে সমাজতান্ত্রিক দলের ষষ্ঠ কংগ্রেসে, কিন্তু প্রথমোক্তটি কখনই বাস্তবায়িত হয়নি। সমাজতান্ত্রিক দলের তাত্ত্বিক ও কর্মীদের মধ্যে সংগ্রামী নাস্তিকতা ও আলোকিত নাস্তিকতার আধিক্য থাকার ফলে ধর্মীয় নীতিতে নতুন দিগন্তের উন্মোচনের ব্যর্থতা সম্ভবত অনিবার্যই ছিল।

১৯৯৯ সাল থেকে আচার অনুষ্ঠানের ধ্বংসের প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে স্কুল, কমিউনিস্ট যুবলিগ, স্কুল ছাত্রদের নতুন পথ প্রদর্শক এবং গণ মাধ্যমের মাধ্যমে প্রচার কার্য চালানো হয়েছে। আচার অনুষ্ঠান বিরোধী প্রচারের অংশ হিসেবে বিজ্ঞান ও নিরীশ্বরবাদ (Kexne yu Washeniun) নামে একটি নতুন পত্রিকাকে ২০০০ সাল থেকে প্রকাশ করতে শুরু করা হয় এবং এই পত্রিকাটি সংগ্রামী নিরীশ্বরবাদীদের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের চৈনিক অ্যাকাডেমির একটি অংশ হিসেবে অ্যাকাডেমি অফ মার্কসইজমে তারা একটি নতুন বিভাগও স্থাপন করেছে। এই ধরণের প্রচার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে ফলপ্রসূ হয়ে থাকতে পারে।

চীনদেশের বিভিন্ন অংশে আদানপ্রদান ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে কলেজ ছাত্র, স্নাতক ও শিক্ষকশ্রেণির মধ্যে আলোকিত নাস্তিক্যের প্রভাব বেশি এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে প্রভাব বেশি সংগ্রামী নাস্তিক্যের। এই পরীক্ষামূলক বিবৃতিটির যথার্থতা নিরূপণের জন্য সুশৃঙ্খল গবেষণার প্রয়োজন। ধর্মীয় বিষয়ের তত্ত্বাবধানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত সংগ্রামী নাস্তিক্য ১৯৮২ সালের চৈনিক সমাজতন্ত্রী দলের ১৯ নং নথিতে লিপিবদ্ধ ধর্মীয় নীতির বাস্তবায়নের পক্ষে বিশেষভাবে বাধাসৃষ্টি করেছে। কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক নিয়মকে পরিবর্তন করলেই তা প্রকৃত পরিবর্তনের পক্ষে যথেষ্ট নাও হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনা।

ধর্মের প্রকারভেদ:

কুসংস্কার ও অশুভ আচার অনুষ্ঠান:

যদিও চীনের সংবিধান ও সমাজতান্ত্রিক দলের নথিপত্রে 'ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা'র কথা উল্লেখ রয়েছে, চৈনিক কর্তৃপক্ষ মাত্র পাঁচটি ধর্মকে আইনগত বৈধ্যতাদান করেছেন যেমন বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম ধর্ম, ক্যাথলিক ধর্ম, তাওধর্ম এবং খ্রিস্টধর্ম (প্রোটেস্টান্ট ধর্ম)। এই সীমাবদ্ধতাকে বৈধতাদান করা হয়েছে ধর্ম সম্পর্কে একটি সংকীর্ণ ধারণার মাধ্যমে সেখানে তারা গুরুত্ব আরোপ করেছেন ধর্ম ও কুসংস্কার (মি-শিন) এবং ধর্ম ও অশুভ আচার অনুষ্ঠানের (শিয়ে-চিয়াও) মধ্যে সুস্পষ্ট প্রভেদের উপর। কুসংস্কার ও অশুভ আচার অনুষ্ঠান ধর্মের মধ্যে পড়ে না একথা বলে তারা স্পষ্ট করে দিচ্ছেন যে ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা-কুসংস্কারকপূর্ণ আচার অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

ধর্ম ও কুসংস্কারের মধ্যে এই পার্থক্যের শুরু হয়েছিল বিংশ শতকের শুরুতে যখন পাশ্চাত্য ও জাপানি শক্তির সামরিক চাপের ফলে চীনের অভিজাতরা চীনের আধুনিকীকরণের জন্য প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন। (Goasaert and Palmer 2012, Nedastup 2010)।

১৯৫০-এর দশকে সমস্ত ঐতিহ্যবাহী লোক ধর্মীয় গোষ্ঠী যেগুলিকে বৌদ্ধ ধর্ম বা তাওবাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না সেগুলিকে 'প্রতিক্রিয়াশীল সম্প্রদায়' বা আচার অনুষ্ঠান রূপে নিষিদ্ধ করা হয় এবং যে সমস্ত ঐতিহ্যশালী লোক বিশ্বাস এবং আচার অনুষ্ঠান দৈনন্দিন জীবনে পরিব্যাপ্ত ছিল সেগুলিকে 'সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কার' আখ্যা দেওয়া হয় ('ফেঙ্ ফিয়ান মি-শিন')। যে সমস্ত মানুষ এগুলিতে বিশ্বাস করত বা আচার অনুষ্ঠানে অংশ নিত তাদের সর্বসমক্ষে নিন্দা করা হয়। এমনকি ঐ পাঁচটি ধর্মকেও 'সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কার' এবং 'প্রতিবিপ্লবী শক্তির' প্রভাব থেকে মুক্ত করা হয়।

১৯৬৬ সালে তথাকথিত সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হয় 'চারটি প্রাচীন' কে ধ্বংস ও ঝেটিয়ে বিদায় করার অভিযানের মধ্যে দিয়ে যেমন 'প্রাচীন প্রথা, প্রাচীন সংস্কৃতি, প্রাচীন অভ্যাস ও প্রাচীন ধ্যানধারণা'। এটি অত্যন্ত দ্রুত সমস্ত ধর্মকে পরিত্যাগ করা পর্যন্ত অগ্রসর হয়। মাওয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লাল প্রহরীরা ঐতিহ্যশালী ইমারত ধ্বংস করে, ধর্মশাস্ত্র ও ধ্রুপদী গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলে এবং বিভিন্ন প্রাচীন বস্তুকে ভেঙে ফেলে। সমস্ত ধর্মীয় ভবনকে ধ্বংস করা হয় বা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত এই ১৩ বছর চৈনিক নাগরিকদের ধর্মীয় সমাবেশে অংশগ্রহণ করার কোন অধিকার ছিল না।

সমস্ত ধর্মের নিষিদ্ধ করণ রদ করা হয় ১৯৭৯ সালে যখন দেং জিয়াও পিং-এর অধীনে সমাজতান্ত্রিক দল অর্থনৈতিক সংস্কারের উপর মনোনিবেশ করতে শুরু করে। ঐ পাঁচটির ধর্মের কোন কোন উপাসনামূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়। তবে ধর্ম ও কুসংস্কারের মধ্যে পার্থক্যকে রাষ্ট্রের সরকারি নথি বা বিবৃতিতে পুনরাবৃত্তি করা হয় (Renmin Ribao ১৯৭৯; Ya ১৯৮১)।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বলা যায় যে, ১৯৯০ এর দশকে পার্টি রাষ্ট্র সরকারি আলোচনায় আরেকটি তকমা গৃহীত হয়- এটি হল অশুভ আচার অনুষ্ঠান (শিয়ে চিয়াও) এই তকমাটি ঐতিহ্যশালী লোক ধর্ম সম্প্রদায় এবং অনুশীলনের ক্ষেত্রে; এটি নতুন ধর্মীয় আন্দোলনে যেগুলিকে আমদানি করা হয়েছিল বিদেশ এবং সেই সমস্ত খ্রিস্টধর্ম প্রভাবিত দেশীয় সম্প্রদায়গুলির থেকে যেগুলি চীনদেশে আবির্ভূত হয়েছিল। ১৯৯৩ ফালুন ক্যাং কে বলা হত অশুভ সম্প্রদায় এবং এটি আচার অনুষ্ঠান বিরোধী প্রচারের মূল লক্ষ্য ছিল। তারপর থেকে অন্যান্য প্রধান শ্ছিকং গোষ্ঠীও এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কোন কোন নতুন ধর্ম যেমন মোরমোনিজম এবং পাহাই কে সরকারিভাবে 'অশুভ গোষ্ঠী' বলা না গেলেও তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

খ্রিস্টধর্ম ভিত্তিক দেশীয় সম্প্রদায়গুলি হল একটি মিশ্রণ যার মধ্যে রয়েছে প্রচলিত ধর্মমতবিরোধী সম্প্রদায় যেমন 'Established King', 'Three Grades of Servants' এবং 'Almighty God' এছাড়াও বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যেমন 'All Scope Church' এবং 'South China Church' যেগুলিকে অনেক বিদেশি খ্রিস্টানরাও গোঁড়া বা শিক্ষা এবং আচার অনুষ্ঠানের দিক থেকে চরমপন্থী বলে মনে করেন। বর্তমানের সরকারীভাবে নিষিদ্ধ খ্রিস্টধর্ম অনুপ্রাণিত গোষ্ঠীর সংখ্যা অন্তত ১৬ (দ্রষ্টব্য Yang ২০১১ a, ১০৩-১০৫)।

বর্তমান চীনের অধিকাংশ মানুষ অভিজাত ও সাধারণ নাগরিক উভয়ই 'অশুভ আচার অনুষ্ঠান' বা 'কুসংস্কারের মধ্যে সরকারের করা পার্থক্যকে গ্রহণ করে এবং সরকারের অশুভআচার অনুষ্ঠান ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যে কোন সমস্যা খুঁজে পায় না। এটি কর্তৃত্বমূলক শাসনকে কেবল মেনে নেওয়া নয়, দল রাষ্ট্রের ধারণা ও আলোচনাকে আত্তীকরণ করাও। এই ধরণের প্রশ্নহীন ধারণা ধর্মের সীমিত স্বাধীনতার জগদ্দল পাথরটিকে অপরিবর্তিত রাখতে সাহায্য করে। আজকের চীনদেশে অধিকাংশ মানুষই একথা ভেবে সন্তুষ্ট যে সে দেশে পৃথিবীর মাত্র পাঁচটি ধর্মকে পালনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং কোন কোন ধর্মের ক্ষেত্রে অন্যান্য ধর্মের তুলনায় নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর করা হয়েছে। এমনকি সেই সমস্ত ব্যক্তিরা যারা প্রচলিত ধর্ম নীতির সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং কিছু কিছু পরিবর্তনের দাবী করেন যেমন কোন বিশেষ ধর্মকে আইনগতভাবে অনুমোদন দেওয়া, এই ধরনের অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে কিছু বিধিনিষেধের প্রয়োজন রয়েছে এবং এই বিধিনিষেধগুলিকে সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ করার কোন প্রয়োজন নেই। আবারও সরকারী নিয়মের ঈষৎ পরিবর্তন প্রকৃত পরিবর্তনের পক্ষে যথেষ্ট নাও হতে পারে। এর জন্য চীনের ধর্মীয় জগতের খেলোয়াড়দের মানসিকতার পরিবর্তনের প্রয়োজনও রয়েছে।

ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ: সংবিধান ও সরকারী বিজ্ঞপ্তিনামা ধর্ম সংক্রান্ত সরকারি বিজ্ঞপ্তিনামাগুলিকে পাশ্চাত্যের চৈনিক গবেষক এবং চীনের কয়েকজন আইনজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তবে খুব কম সংখ্যক বিজ্ঞপ্তিনামাতেই চৈনিক প্রজাতন্ত্রের তিনটি প্রধান রূপের ব্যবস্থা ও পারস্পরিক গুরুত্বের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে। চৈনিক সমাজতান্ত্রিক দলের নথিপত্র বা বিজ্ঞপ্তিনামাতে লিখিত দলীয় নীতি, জনগণের কংগ্রেস দ্বারা অনুমোদিত আইন এবং কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকার বিভিন্ন সরকারি শাখার দ্বারা অনুমোদিত বিভিন্ন সরকারি বিজ্ঞপ্তিনামা। নীতি, আইন এবং বিজ্ঞপ্তিনামাকে অত্যন্ত সতর্কভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন কারণ তাদের নিয়মকানুনগুলি গণতান্ত্রিক সমাজে প্রচলিত নিয়মকানুনগুলির থেকে একেবারেই আলাদা। আইনের শাসনের অধীনে থাকা একটি গণতান্ত্রিক সমাজে আইনকেই সাধারণত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম বলে মনে করা হয়। তবে চৈনিক প্রজাতন্ত্রে চৈনিক সমাজতান্ত্রিক দলের নীতি ও আদর্শকে আইনের উর্ধে স্থান দেওয়া হয়। চৈনিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধান দলীয় নীতির একটি সরকারি উচ্চারণের প্রতিনিধিত্ব করে। (Petter 2003, 324)। যদি সরকারিভাবে অনুমোদিত আইনগুলির জনগণের কংগ্রেসের দ্বারা পরিবর্তিত হওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, দলীয় নীতিগুলিকে চৈনিক সমাজতান্ত্রিক দলের সামান্য প্রচেষ্টাতে সহজেই খাপ খাইয়ে নেওয়া যেতে পারে। শাসনতান্ত্রিক বিজ্ঞপ্তিনামার উচিত আইনকে বাস্তবায়িত করা। বাস্তবে বিজ্ঞপ্তিনামা, আইনের স্থান গ্রহণ করেছে এবং এর উদ্দেশ্য হল চৈনিক সমাজতান্ত্রিক দলের নীতিকে প্রয়োগ করা।

অনেকগুলি আইনের বিশ্লেষণ করলে সংবিধানের ১৯৮২ সালের ধর্মীয় স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতাটি স্পষ্ট হয়। ৩৬ নং ধারায় বলা হয়েছে চৈনিক প্রজাতন্ত্রের নাগরিকরা ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। রাষ্ট্রের কোন শাখা, সরকারি প্রতিষ্ঠান, বা ব্যক্তিমানুষ কেউই একজন নাগরিককে কোন ধর্মে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করতে বাধ্য করতে পারে না।

রাষ্ট্র স্বাভাবিক ধর্মীয় কার্যকলাপকে রক্ষা করে থাকে। কেউই এমন কোন বিষয়ের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করতে পারবে না যা দেশের শৃঙ্খলা, নাগরিকদের স্বাস্থ্য বা শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে কখনই বিদেশিদের দ্বারা প্রভাবিত করা যাবে না।

 

এটি লক্ষণীয় যে ৩৬ নং ধারার বিষয়বস্তু 'ধর্মীয় স্বাধীনতা' নয়, 'ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা'। কোন কোন চৈনিক রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক অভিজাত ব্যক্তি মনে করেন যে নাগরিকরা যা বিশ্বাস করতে চান তাই তাদের বিশ্বাস করতে দেওয়া উচিত কিন্তু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় সংগঠনগুলির কার্যকলাপ সামাজিক ঐক্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত (দ্রষ্টব্য Ye 1998, 2-3)। নীতিগতভাবে, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের উপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেই তা সর্বদা আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের বিরোধী নাও হতে পারে।

আধুনিক পৃথিবীতে এমন কোন দায়িত্বশীল সরকার নেই যারা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনরকম বাধা নিষেধ রাখেনি। (Beaman 2003, Beyer 2003; Gile 2003)। কিন্তু সমস্যা হল কোনটাকে স্বাভাবিক ধর্মীয় কাজকর্ম বলা যাবে আর কোনটিকে স্বাভাবিক ধর্মীয় কাজকর্ম বলা যাবে না তা নিয়ে। কারণ এটিকে সুষ্টভাবে সংবিধানে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি বরং ধর্মীয় বিষয় তত্ত্বাবধানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও অঞ্চলভেদে এই বিষয়ে ব্যাখ্যার পার্থক্য রয়েছে, এটিকে প্রায়ই সেই সমস্ত সাধারণস্তরের কর্মীরা প্রয়োগ করে থাকে যারা সংগ্রামী নাস্তিক্যে বিশ্বাস করে থাকে।

সংবিধানের ধারার অপর একটি সমস্যা হল এই যে "আদালত তাদের বিচারের রায়দানের ক্ষেত্রে সংবিধানের ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে পারে না বা তার উল্লেখ করতে পারে না। (O Brien 2010, 376-see also Kellagg 2009)। যেহেতু সংবিধানকে আদালতের মামলার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না এর ফলস্বরূপ, ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক বিতর্ককে সমাধান করবেন দল-রাষ্ট্র শাসনতান্ত্রিক আধিকারিকরা, যার ফলে ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতার সংবিধানগত সুরক্ষাদানের ব্যাপারটিকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে।

১৯৮০-র দশক থেকে যেহেতু চৈনিক সমাজতন্ত্রী দলের কয়েকজন নেতা, নেতাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার শাসনের পরিবর্তে আইনের শাসনকে ক্রমশ বৃদ্ধি করার পক্ষে সওয়াল করেছেন (Yang 2006, Ying 2006; Liu 2008)। তবে প্রচেষ্টার কোন ফল হয়নি এবং এর কারণ হল কয়েকটি মূল নীতি বা ধারণা সম্পর্কে মতভেদ যার মধ্যে রয়েছে ধর্মের সংজ্ঞা (কোন কোন ধর্মকে বৈধতা দান করা উচিত), স্বাভাবিক ধর্মীয় কার্যাবলী (যেগুলিকে অনুমোদন করা উচিত), সংবিধানের ভূমিকা বনাম চৈনিক সমাজতন্ত্রী দলের নীতি ও আদর্শ, জনগণের কংগ্রেসের ভূমিকা বনাম সমাজতন্ত্রী দলের ভূমিকা, সরকারী তত্ত্বাবধান, সরকার পোষিত গণ সংগঠন এবং চক্রাকার শাসনব্যবস্থা (O'Brien 2010)। আনুষ্ঠানিক আইনের পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ শাসনতান্ত্রিক বিজ্ঞপ্তিনামার দ্বারস্থ হয়েছেন। স্থানীয় সরকারগুলির দ্বারা 'অস্থায়ী বিজ্ঞপ্তিনামা' নিয়ে বহু বছর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর রাষ্ট্রীয় পরিষদ ব্যাপকভাবে 'ধর্মীয় ব্যবস্থা সংক্রান্ত-নিয়মকানুন জারি করেছে যা ২০০৫ সাল থেকে বলবৎ হয়েছে।

 

২০০৫ সালের 'ধর্মীয় ব্যবস্থা সংক্রান্ত' নিয়মকানুন প্রবর্তিত হওয়ার অব্যবহিত পরই ২০০৫ সালে কালসন (২০০৫) পরিশিষ্টে এর একটি সম্পূর্ণ ইংরাজি অনুবাদসহ এর বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছেন। কালসন একটি ভারসাম্যযুক্ত বিশ্লেষণ পেশ করেছেন এবং তিনি দেখিয়েছেন যে 'এই নিয়মগুলি একধরনের উন্নতির কারণ এখানে কেমন করে আবেদন ও অনুমোদন পদ্ধতির মাধ্যমে সরকার ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলি পরস্পরের সঙ্গে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করবে সে সম্পর্কে আরও নিশ্চয়তা ও স্পষ্টতা দান করবে। (৭৫৮)। পক্ষান্তরে, তিনি নতুন নিয়মের কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ সীমাবদ্ধতাকেও নির্দেশ করেছেন যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় স্থানের নিবন্ধীকরণের নিয়মের মাধ্যমে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জারি রাখা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, নিয়ম, পূজা পদ্ধতির উপর নজরদারি করা। বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্য করা এবং কঠোর ও স্বেচ্ছাচারীভাবে জরিমানা করা।

তাঁর রচনায় থং (২০১০) চীনের ধর্ম নীতিতে গুরুতর সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে শুরু করলেও এই যুক্তি পেশ করেছেন যে ২০০৫ সালের আইনে অনেকগুলি দিক থেকে এই বিষয়ে অগ্রগতি ঘটেছে: বর্তমানে ধর্মীয় সংগঠনগুলির সমাজতন্ত্র এবং চৈনিক সমাজতান্ত্রিক দলকে সমর্থন করার আর প্রয়োজন নেই, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে পূজা করার ব্যাপারেও আর বিধিনিষেধ নেই; ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত হয়েছে; ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরো বেশী স্বায়ত্বশাসন দান করা হয়েছে এবং ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে হ্রাস করা হয়েছে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে এই প্রগতির কারণ হল গোঁড়া সমাজতান্ত্রিক আদর্শের মৃত্যু, রাষ্ট্র-দলের দ্বারা গৃহীত পরিকল্পিত রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার যার উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্র ও সমাজকে পৃথক করা, মানব ও নাগরিক অধিকারকে রক্ষা করা, এবং আইনের দ্বারা শাসন করা। অধিকতর ধর্মীয় স্বাধীনতার দিকে প্রগতির ক্ষেত্রে এটি একটি অপেক্ষাকৃত আশাবাদী পদক্ষেপ। ২০০৫ সাল থেকে বাস্তবিক অনুশীলনকে পরীক্ষা করে হোমার (২০১০,৫৫) ২০০৫-এর নিয়মে ফাঁকা প্রতিশ্রুতির থেকে আর বেশি কিছু দেখতে পাননি।

অনিবন্ধীকৃত সম্মেলন এবং তাদের নেতারা প্রহার, কারাবাস, জরিমানা, সম্পত্তি ধ্বংস এবং প্রায়ই অন্যান্য ভয়ানক অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছেন। যারা যারা সরকারি দপ্তরে গিয়ে তাদের সম্মেলনকে নিবন্ধীকৃত করার চেষ্টা করার সাহস দেখিয়েছেন তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন, এমনকি তাঁদের কাউকে কাউকে এমনকি পূর্বের নিবন্ধন না করা কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বিভিন্ন গির্জার পক্ষে সওয়াল করা আইনজীবীদের হয় কারা রুদ্ধ করা হয়েছে নতুবা 'রাষ্ট্র বিরোধী' কার্যকলাপের দায়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ যদিও ২০০৫ সালের আইনে কিছু কিছু সম্ভাবনা ছিল, সেগুলিকে বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়নি।

নাগরিক সমাজ ও ধর্মীয় স্বাধীনতা:

চীনে নাগরিক সমাজ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার মধ্যেকার সম্পর্ক জটিল, এবং অঞ্চল ও জাতিসত্ত্বাভেদে তার যথেষ্ট পার্থক্য হয়। পক্ষান্তরে, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে আজকের চীনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তিব্বতীয় ও উইঘুরদের তাদের ধর্মের ঐতিহ্যশালী আচার অনুষ্ঠান পালন করতে গিয়ে প্রচণ্ড বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। চৈনিক সমাজতন্ত্রী দলের ধর্ম এবং জাতিগত বিচ্ছিন্নতার মধ্যে সম্ভাব্য যোগসূত্র সম্পর্কে তীব্র ভয় তিব্বত ও জিনজিয়াং স্বশাসিত অঞ্চলে ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকারের সাংবিধানিক নিশ্চয়তার উপর অনেক বিধিনিষেধ চাপিয়েছে (ওয়েলেনস ২০০৯, পৃ. ৪৩৪)। পক্ষান্তরে, ইউনান প্রদেশের জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে 'জাতিগত সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতার চিত্রটি আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে”। এই দাবি করা যেতে পারে, একাধিক দৃষ্টান্তে সংখ্যালঘু জাতিরা তাদের হান চৈনিক প্রতিবেশীদের তুলনায় ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। (প্রাগুক্ত পৃ. ৪৩৫)। নাশির জাতির তংবাদের মত কোন কোন জাতিগত ধর্মকে পর্যটন ও অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে স্থানীয় সরকারগুলি উৎসাহিত ও সমর্থন করেছে। প্রকৃতই, এমনকি বৌদ্ধ ধর্ম ও ইসলাম সরকারের জাতিগত পর্যটনের প্রবাহের সাহায্যে স্থানীয় সরকার প্রধান প্রধান বিহার ও মন্দির পুনঃনির্মাণে সাহায্য করেছে (প্রাগুক্ত পৃ. ৪৫১)। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে জাতিগত ধর্মের এই পুনরুজ্জীবন তাদের সামাজিক বন্ধন এবং জাতিগত অহংকারকে শক্তিশালী করেছে এবং এই কারণে তাদের খ্রিস্টধর্মের প্রচারের হাত থেকে রক্ষা করেছে। "এই প্রসঙ্গে একটি শর্তহীন স্বাধীনতা নিশ্চিতভাবেই দেশীয় ধর্মগুলিকে সমস্যায় ফেলবে যখন তাদের ধারণার বিশ্বব্যাপী বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে (প্রাগুক্ত পৃ. ৪৫৩)।” ওয়েলেনস ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্থাপন করেছেন। যদি জাতিগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ হয়, বা ধর্মীয় পছন্দের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার থেকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে চীন ও অন্যান্য দেশে খ্রিস্টিয় ও ইসলামিক ধর্মান্তরণের উপর সহকারি নিষেধাজ্ঞা যুক্তি সঙ্গত হবে। এই প্রশ্নটিকে নিয়ে সতর্কভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা ও গুরুতর বিতর্কের প্রয়োজন রয়েছে।

সংখ্যাগুরু হান জাতির মানুষদের ধর্মের ক্ষেত্রে চীনের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে অনেক গবেষণা করা হয়েছে এবং এগুলির মধ্যে কোন কোনটিতে ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, বর্তমান ধর্মীয় নীতির অধীনে কেমন করে কুয়াংতঙের হাল্কা গ্রামের একটি ক্যাথলিক গির্জার পক্ষে সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্দশার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে, (লোজাডা ২০০২), কেমন করে একটি খ্রিস্টিয় গির্জা কাং-সুর একটি প্রত্যন্ত গ্রামে টিঁকে থাকতে এবং পুনরুজ্জীবন লাভ করতে সমর্থ হবে (হুয়াং ২০০৫), কেমন করে হেবেইতে বহু যুগ ধরে পরিত্যক্ত প্রাচীন বৌদ্ধ ধ্বংসস্তূপের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি বৌদ্ধ বিহার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী একটি কেন্দ্রে পরিণত হবে (ইয়াং এবং ওয়েই ২০০৫), কেমন করে উত্তর শানসির লোক ধর্মের একটি মন্দির বহুভাবে কার্যকরী একটি সামাজিক কেন্দ্রে পরিণত হবে (চাউ ২০০৬) কেমন করে উপকূলবর্তী নগরী ওয়েন-ঝোউয়ের খ্রিস্টিয় গির্জার কর্তৃপক্ষ শাসক শক্তির মোকাবিলা করে ধর্মান্ত করণের জন্য প্রাপ্ত সামাজিক স্থানের বিস্তৃতি ঘটাবেন (চাও ২০১১)। যদিও এই সমীক্ষাগুলিতে প্রকৃত অর্থে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি, এগুলি বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনুশীলিত ধর্মীয় স্বাধীনতার স্তর সম্পর্কে সমৃদ্ধ বিবরণ ও অন্তর্দৃষ্টিমূলক বিশ্লেষণ উত্থাপন করা হয়েছে।

ধর্ম ও নাগরিক সমাজ বিষয়ক গবেষণা ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত কারণ ধারণাগতভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা নাগরিক সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ম্যাডসেন (১৯৯৮) ক্রমশ আবির্ভূত হওয়া নাগরিক সমাজে তার চৈনিক ক্যাথলিকদের পরীক্ষায় এই গবেষণার সূত্রপাত করেছেন। কোন কোন সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে গৃহ গির্জাতে রাজনৈতিক বিষয় আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা থেকে সক্রিয়ভাবে খ্রিস্টান ও অন্যান্যদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার প্রবণতায় পরিবর্তন ঘটেছে। (ইং ২০১২)।

একটি অনলাইন প্রকাশনা আইয়ানের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের মাধ্যমে ওয়েইল্যাণ্ডার (২০০৯) দেখিয়েছেন যে কয়েকটি গৃহ গির্জা অধিকার সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উদার গণতন্ত্রের দিকে প্রচেষ্টার সূত্রপাত করে প্রতিরোধের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আইয়ানের অনেক লেখক দাবি করেছেন, "ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে ঈশ্বর প্রদত্ত অধিকার বলে মনে করা হয় যেটির নিশ্চয়তা চৈনিক সংবিধানে দেওয়া হয়েছে এবং যেটিকে নিম্নতর স্তরের কোন শাসক গোষ্ঠীর সীমাবদ্ধ করার অধিকার নেই (প্রাগুক্ত পৃ. ১৭৫)। কোন কোন 'খ্রিস্টিয় আইনজীবী' সেই সমস্ত খ্রিস্টানদের মামলা গ্রহণ করেছেন যাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। চৈনিক খ্রিস্টানদের একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে এবং সেটির সদস্যদের নাম যোগাযোগের নম্বর আইয়ানে প্রকাশিতও হয়েছে। তাঁরা সকলেই সাংবিধানিক আইনের প্রধান পণ্ডিত এবং এঁরা দেশের অগ্রণী চিন্তক গোষ্ঠী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত। ইন্ডোবেন ও ইন্ডোবেন (২০০৯) ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকায় খ্রিস্টান আইনজীবীদের উত্থান এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের রক্ষায় তাঁদের কার্যকলাপ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে।

একবিংশ শতকের প্রথম দশকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে কয়েকটি নতুন অগ্রগতি চীনের নাগরিক সমাজকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, শহরাঞ্চলে গৃহ গির্জার জনসমাবেশের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছে এবং এগুলি গণসংগঠনের পরিণত হয়েছে (ইয়াং ২০১১)। ইতিমধ্যে খ্রিস্টিয় উদ্যোগপতি, অধ্যাপক আইনজ্ঞ, সাংবাদিক, কথক এবং শিল্পীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাঁরা প্রকাশ্যে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। অনেক খ্রিস্টিয় পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে (কেনেডি-২০১২) এবং খ্রিস্টধর্মবলম্বী অনেক পুস্তিকা ও পত্রিকা (মুদ্রিত ও অনলাইন) প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং নাগরিক সমাজের বিকাশ পরীক্ষা করে গবেষণার জন্য অনেক উপাদান ও তথ্যাদি যোগাড় করা সম্ভব হয়েছে।

গ্রন্থসূচি :

১। ইন্ট্রোডাকশন অফ বুদ্ধিজম ইন চায়না, আপটিল টেনথ সেঞ্চুরি এ.ডি., সুমনপাল ভিক্ষু, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, ২০১৫, কলকাতা।

২। দ্য বুদ্ধিষ্ট অ্যানালস্ অ্যান্ড ক্রোনিক্যালস অফ সাউথ-ইস্ট এশিয়া, কানাইলাল হাজরা, মুন্সিরাম মনোহর লাল পাবলিশার্স প্রা. লি., দিল্লি, ১৯৮৬।

 

৩। বুদ্ধিজম ইন ইন্ডিয়া অ্যাজ ডেসক্রাইবড বাই দা চাইনিজ পিলগ্রিমজ (এ.ডি. ৩৯৯-৬৮৯), কানাইলাল হাজরা, প্রাগুক্ত, দিল্লি, ১৯৮৩।

81 স্টাডিজ ইন চাইনিজ বুদ্ধিজম, অনুকূলচন্দ্র ব্যানার্জি, ফার্মা কে.এল.এম. (প্রা.) লি., ক্যালকাটা, ১৯৭৭।

۱ ইন্দ্রোডাকশন টু চাইনিজ ফিলোসফি, ক্যার্ণ এল লাই, ক্রেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি, ২০০৮।

৬। ট্রেড অ্যান্ড ট্রেডরুটস বিদুইন ইন্ডিয়া অ্যাণ্ড চায়না, (১৪০ বি.সি.-এ.ডি. ১৫০০), হরপ্রসাদ রায়, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৩।

৭। বুদ্ধিজম ইন চায়না, এ হিস্টোরিক্যাল সারভে ছেন ক্যানেথ, কে. এস., প্রিন্সেপটন ইউনিভার্সিটি, ১৯৭২।

৮। রিলিজিয়ন ইন দা মডার্ণ ওয়াল্ড: ট্রাডিশন অ্যান্ড ট্রান্সফরেমশন, ওডহেড, লিনডা, কাউয়ানামি হিরোকো, প্যাট্রিক, ক্রিস্টোফার এইচ, (সম্পা.), লন্ডন, রুটলেজ, ২০০৯।

৯। https://en.m.wikipedia.org/wiki/chinese_folk religion.

১০। https://www.cfr.org/background/religion_china.

১১। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Religion_in_china.

১২। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Freedom_of_religion_is_china.

১৩। https://www.justice.gov/eoir/page/file/106881/download.

১৪। https://www.cfr.org/bookgroundes/religion_china.

১৫। https://en.m.wikipedia.org/wike/chinese-laws_regading_religious_activities.