সুমনপাল ভিক্ষু
'পোষ্টমর্ডান' শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে উত্তর আধুনিক, উত্তরাধুনিক, আধুনিকোত্তর,
অধুনান্তিক শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। এই সকল শব্দের বিভিন্ন অর্থও রয়েছে কারণ শব্দের প্রয়োগ কৌশল এক অর্থে শব্দের অর্থ বা মানে নির্দ্ধারণ করে দেয়। পোষ্টমর্ডান
শব্দটি অত্যন্ত সচেতনভাবে প্রথম প্রয়োগ করেন ফরাসী চিত্রসমালোচক ও শিল্পী জন ওয়াটকিন চাম্পম্যান
১৮৭০ সালে, তিনি এই শব্দটি ফরাসী ইন্দ্রেশনিষ্ট ধারার বাইরের নতুন ধারার (আভাগর্দ) চিত্রের শৈলী বুঝাতে ব্যবহার করেছিলেন।
সাহিত্যের
ক্ষেত্রে 'পোষ্টমর্ডান'
প্রথম শব্দটি ব্যবহার করেন লাতিন আমেরিকান কবি ফেদেরিকো দ্য ওনিশ, তিনি সদ্যনিশ ভাষায় তরুণ কবিদের কবিতা সংকলনে ব্যবহার করেন শব্দটি, প্রচলিত ধারার বাইরের এই নতুন কবিদের 'উত্তর ঔপনিবেশিক
পরিসর ও তার বাক্শস্যের
উপনিকেশবাদ অতিক্রমীবৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরতেই এই শব্দটির প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। তবে ঐতিহাসিকভাবে পোষ্টমর্ডান
শব্দটি ফ্রাডেকা এশিয়ান যুদ্ধের প্রেক্ষিতে আর্নন্ড জেটয়েনবি ১৯৩৯ সালে তাঁর 'এ ষ্টাডি অফ্ হিস্ট্রি,
খণ্ড-৫ গ্রন্থে ব্যবহার করেছিলেন।
উত্তরাধুনিকতা শব্দটির অর্থ বিভিন্নজন
বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। তবে এর প্রবক্তাগণের মধ্যেই এর যথাযথ অর্থ নিয়ে মতপার্থক্য রেেছ, এমন কি কারো কারো মধ্যে বিরোধ রয়েছে এর অর্থ নিয়ে। উত্তরাধুনিকতা মতবাদের প্রবক্তা হলেন জ্যাঁ লিত্ততার,
ফ্রেডারিক, জেমপন, রোলাবার্থ, জ্যাঁ বদ্রিলার, জ্যাক লাকা, জ্যাক দেরিকা, গিলে দ্যেলুজ সহ আরও অনেকে।
উত্তরাধুনিকরা এক্ষেত্রে প্রেরণা সংগ্রহ করেছিলেন নীৎসের দর্শন থেকে, উনিশ শতকের আভাগর্দ থেকে। শুরুতে (১৯৫৩ ও ১৯৬০)-এর দশকে উত্তরাধুনিকতা বোঝাতো আধুনিকতা থেকে দূরত্ব। তবে উত্তরাধুনিকতা বলতে আধুনিকতার পরের সময়কে বোঝায় ঠিক এমন নয়। উত্তরাধুনিকতা হল এমন একটি দর্শন যা আধুনিকতা প্রতিষ্ঠিত
মৌলিক জ্ঞানকে প্রশ্ন করে, প্রশ্ন করে আধুনিকতার নীতিবোধ ও মূল্যবোধের
সমূহকে। স্বভাবতই এতে অনেকে আধুনিকতার সাথে উত্তরাধুনিকতার বিরোধের আভাস পান, যেটা সে পুরোপুরি সত্য তাও নয়। উত্তরাধুনিকতার মনে করা হয় আধুনিকতা মানুষকে অভীষ্ট মুক্তি প্রদান করতে সফল হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। আধুনিকতার
ফলেই ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি হয়েছে প্রভূত, এটা যেমন সত্য ঠিক তেমনই সত্য এর প্রভাবেই এশিয়া ও আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসন চূড়ায় উপনীত হয়েছে, আলোকায়নের
নাম করে। আধুনিকতা যেহেতু মূলত পাশ্চাত্য
প্রভাবিত আদর্শ তাই তাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ, জীবনদর্শন
প্রাধান্য পেয়েছে আধুনিকতার মাপকাঠি নির্ধারণে। সম্পতঃ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার জনগণের সকল সংস্কার, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, জীবনচর্চা
ইত্যাদি ইউরোপীয়দের
কাছে হয়ে উঠেছে অসভ্যতা এবং নিম্নমানের
বস্তু হিসেবে। মনে হয় তারা যেন উদ্ধারকর্তা হয়ে এসেছে এই অঞ্চলের মানুষের দুঃখ ইত্যাদিকে
সরিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নততর করে গড়ে তুলতে। এই করে তারা বিনষ্ট করেছে সমাজ কাঠামো, সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম ইত্যাদি। চাপিয়ে দিয়েছে পাশ্চাত্যের আদর্শ ও অনৈতিক মূল্যবোধ। এই আদর্শের ছোঁয়া পেয়ে অনেকে নিজস্ব সংস্কৃতির
প্রতি বিরূপ মনোভাব পালন করেছে, ফলে ক্রমান্বয়ে সে হয়েছে শিকড় বিচ্যুত।
এ হল আধুনিকতার
উপনিবেশবাদী একটি দিক, আরো একটা দিকের প্রতি উত্তরাধুনিকেরা মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে চান সেটা হল বিশ্বযুদ্ধ
ও অগণিত মানুষের মৃত্যু, এই যুদ্ধের মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়েছে মানুষের প্রচলিত সকল আদর্শ, পারমানবিক
বোমার ধ্বংস যজ্ঞ প্রত্যক্ষ
করেছে এই পৃথিবী, দেখেছে এক লহমার কেমন করে মিলিয়ে গেল লক্ষ মানুষের জীবন। এটা তো আধুনিকতার
ফল হিসেবেই এসেছে উত্তরাধুনিকদের বক্তব্য অনেকটা এমন।
যেহেতু আধুনিকতার যুদ্ধ, দারিদ্রতা, হিংসা ইত্যাদি বিষয়গুলিকে
বিলুপ্ত করে পারে নি তাই আধুনিকতাকে
নিরঙ্কুশ মান্যতা প্রদানের বিপক্ষে উত্তরাধুনিকরা, তারা বরং এর নানাদিক নিয়ে প্রশ্ন করে আরো ভালো কিছু মানবজাতিকে
দিতে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তাদের এই পথে সহায় বিভিন্ন তত্ত্ব ও দর্শন, যেহেতু উত্তরাধুনিকতা কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে ও মতাদর্শে স্থির নয়, তাই এর সুবিধা হল নিজের সুবিধা মত বিভিন্ন তত্ত্ব হতে জ্ঞান আহরণ ও তার প্রয়োগ। উত্তরাধুনিকদের মধ্যে সবচেয়ে জোরালো যে যুক্তি কাজ করে সেটা হল আধুনিকতার নির্যাস থেকে জ্ঞানকে অবমুক্ত করা, বিশিষ্ট উত্তরাধুনিক
তাত্ত্বিক রমেশচন্দ্র
মুখোপাধ্যায়কে বলেন প্রকৃত জ্ঞান রতিষ্ঠা করা অসম্ভব, তা প্রমাণ করা। অন্যদিকে যাতেই ক্যালিনেন্ধু মনে করেন উত্তরাধুনিকদের লক্ষ্য হল "জ্ঞানতাত্ত্বিক অসম্ভাব্যতাকে তুলে ধরা।"
রমেশচন্দ্র
মুখোপাধ্যায় আরও বলেছেন যে 'পোস্টমর্ডান ধারার তাত্ত্বিকদের মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ থাকলেও কিছু বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, তার মধ্যে অন্যতম হল আধুনিকতার বিপর্যয় ও ধ্বংস।' উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকদের মতে দুটি বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে আধুনিকতার পরিসমাপ্তি
ঘটেছে। তারা আবার লেখক ও পাঠকদের মধ্যে সাযুজ্য স্বীকার করেন না, তারা মনে করেন এই দুইয়ের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই। একটা টেক্সট যতবার পড়া হবে ততবার তার অর্থ বদলে যাবে বা নতুন অর্থ পাঠকের কাছে প্রতিভাত হবে। তাই ভাষার একক আধিপত্যের বিরোধী পোষ্টমর্ডানিষ্টরা, তারা ভাষার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ভাষার নির্দিষ্ট অর্থবাচকতাকে শেষ করতে চান। ভাষার সে বাইনরী অবজিশন সেটাকে তারা একদমই স্বীকার কনের না (নারীর বিপরীতে পুরুষ, মাদার বিপরীতে কালো একে বলে বাইনরী অপজিশন)। স্বভাবতই ভাষাশৃঙ্খলা অতিক্রম করে যায় পোষ্টমর্ডান ভাবনায়।
পোষ্টমর্ডান
ভাবনায় কোন একক সত্য, বাস্তব, মতবাদ আদর্শ নয়; বহুত্ববাদ ও বহুরৈখিকতায় বিশ্বাসী পোষ্টমর্ডানিষ্ট ভাবুকরা। তারা মার্কসবাদী
কর্তৃত্বের বিরোধী বিরোধী আধুনিকতার
নামে উপনিবেশ স্থাপনের। বিপরীতে তারা "বহুত্বের সম্মিলন" এই মতাদর্শে আস্থাশীল।
রতনতনু ঘোষ এ সম্পর্কে বলেছেন,
"উত্তরাধুনিকতা কোন মতবাদ নয়, বরাং মতাদর্শ।” পোষ্টমর্ডান
ভাবনায় যে দিকটি বিশেষভাবে
গুরত্বপূর্ণ তা হল মহাআখ্যান
বিরোধিতা, বর্তমান সমাজ বাস্তবতার
ও প্রযুক্তির
উৎকর্ষের যুগে মহাআখ্যান লোপ পেয়েছে ও এর প্রয়োজনও ফুরিয়ে গিয়েছে ঠিক এমনটাই মনে করেন পোষ্টমর্ডানিষ্টরা, তারা পরিবর্তন চান, সে পরিবর্তন যাবতীয় ডিসকোর্স,
টেক্সট ও বয়ানের। সবকিছু নতুন করে চিহ্নিত করার পক্ষপাতী তারা এতে মনে হয় তারা সম্পূর্ণভাবে নৈরাজ্যবাদী
কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তারা এমনটা নয়। আধুনিকতার নানা সীমাবদ্ধতা দেখেও পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের
জন্যই তারা নব মূল্যায়নে
আগ্রহী। সমালোচকদের
মতে "বাচনের বিপরীত বাচন গঠন করা, অবয়ববাদ পেরিয়ে অনুনান্তিক নারীবাদে পৌঁছানো, আন্তর্জাতিকতা পেরিয়ে বিশ্বায়য়ের পথ ধরা, মাষ্টার টেক্সটকে ভেঙে ইন্টার টেক্সটে রূপায়ন প্রচলিত সংস্কৃতিকে সংকার সংস্কৃতির পথে নিয়ে যাওয়া বহুজাতির সংস্থাকে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করা ও বৈশ্বিক ইস্যুও এজেণ্ডার ভিত্তিতে রাষ্ট্রও সরকারের ব্যর্থতাগুলো অতিক্রমের
প্রয়াস চালায় উত্তরাধুনিকতা।
বিশিষ্ট উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক
ফ্রেডরিক জেমস মার্কসবাদী আদর্শ বিশ্বাসী, তাই তিনি মনে করেন এই মতদর্শের সর্বশেষ ধাপ হল উত্তরাধুনিকতা। লিত্ততার মনে করেন নতুন প্রযুক্তি
নির্ভর পৃথিবীতে আর কোন 'গ্র্যান্ড ন্যারোটিভসৃষ্টি হবে না, যা হবে সব বিচ্ছিন্ন সূত্র ন্যারোটিভের সমন্বয়, তাই তিনি মনে করেন এমন সমন্বয়ের মধ্যেই রয়েছে প্রগতির মূল। উত্তরাধুনিকদের মধ্যে সংশয়বাদী ধারার চিন্তকদের অন্যতম জ্যাঁ বদ্রিলার,
তিনি স্যামুয়েল
পেকেটের অ্যাবসার্ড
নাটকের মতই জীবন দেখতে আগ্রহী, তাঁর মতে জীবন হল ক্ষুদ্র, অসংলগ্ন, অর্থহীন, ক্লান্তিকর ও নিঃশেষের দিকে ধাবমান। তাই তিনি ঘোষণা করেন উত্তরাধুনিক
জীবনে কমপক্ষে তিনটি বিষয়ের মৃত্যু হয়েছে আধুনিকতা, বাস্তবতা ও যৌনতা।
প্রযুক্তির
অবিশ্বাস্য উন্নতিতে মানুষের জীবনে বাস্তব আর অবাস্তবের ব্যবধান ঘুরে গেছে অনেকটাই, মানুষ চাইলেই এখন ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করে নিজের ইচ্ছে মত বিনোদন লাভ করতে পারে, যা বাস্তব নয় কিন্তু বাস্তবের থেকেও বেশী বাস্তব রূপেই প্রতিভাত হয়। মলয় রায় চৌধুরীর মতে,
"ফ্রেডকফার্ট স্কুলের ভাবুকরা এবং বদ্রিলার বলেছেন যে, এখনকার আমলাতান্ত্রিক, গণমাধ্যম প্রদূষিত, ভোগবাদী ভীড়ের চাপে ব্যক্তি নম্বাৎ হয়ে গেছে, উঠে গেছে। এই রকম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে
অহং ভেঙে চুরে গুঁড়িয়ে রাপান্তরিত হয়েছে হইচই পূর্ণ অস্থিরতায়, অসংলগ্নতায়।
আধুনিকতার উদ্বেগের জায়গায় এসেছে পোষ্টমর্ডান হিন্টিরিয়া।”
সবশেষে একটা কথা স্পষ্টভাবে
বলা যায় যে উত্তরাধুনিকতা হল জীবনকে সম্পূর্ণভাবে নতুনরূপে উপস্থাপনের একটা প্রয়াস মাত্র।
এরক্ষেত্রে
একটা কথা স্পষ্ট অর্থে বলা যায় যে, উত্তরাধুনিকতা হল জীবনকে সম্পূর্ণভাবে নতুন রূপে উপস্থাপনের
একটা প্রয়াস মাত্র। এর যথার্থ সংজ্ঞা এক অর্থে হয়ত নির্দ্ধারণ
করা সম্ভব নয় কিন্তু বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের লেখায় এর বৈশিষ্ট্য
এবং আদর্শ সমূহ স্ফুটিত হয়েছে। রমেশচন্দ্র
মুখোপাধ্যায়'এর মতে, 'উত্তরাধুনিকতা দুর্বোধ্য এমনটা বলার উপায় নেই। আধুনিকতার যে পাশ্চাত্য স্বভাব যা অবশিষ্ট পৃথিবীকে করেছে 'অপর', তাকে প্রশ্নবিদ করার সুযোগ করে দিয়েছে উত্তরাধুনিকতা। পাশ্চাত্যের বিষয়কে সভ্য করার নামে যে উপনিবেশ স্থাপন করার ও সংস্কৃতি চালিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে, সে জায়গাকে প্রশ্নবিব্দ করেছে উত্তরাধুনিকতা।'
বস্তুত, উত্তরাধুনিকতার বিষয়টি আমদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের কাছে ততটা পরিস্ফুট নয় যতটা ইউরোপ এবং আমেরিকায়।
স্বাভাবিকভাবেই একটা দূরত্ব আছে মূল চিন্তায়ও আমাদের চিন্তায়। তবে সে দূরত্ব মুছে ফেলার কাজে ব্রতী আছেন অনেক গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
ড. রমেশচন্দ্র
মুখোপাধ্যায় তার মধ্যে অন্যতম এবং মুখ্যও বটে। তিনি তার গবেষণা ও আমাদের দেশ কাল অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেছেন উত্তরাধুনিকতা তত্ত্বকে।
প্রচণ্ড রকম ন্যারোটিভ
ধ্যানবিন্দু দর্শন গ্রন্থমালা ও 'পোষ্টমর্ডানিজ' গ্রন্থে বলা হয়েছে 'ঔপনিবেশিক অতীতের কারণেই আমাদের দেশের সংবিধান, রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইন, শিক্ষা ব্যবস্থা,
চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য প্রতিটি ক্ষেত্র, পরাধীনতার সূত্রে প্রাপ্ত আধুনিকতার
জের আজও টেনে চলেছে। একদিকে এদেশের আট হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকার,
অন্যদিকে নব্য আধুনিকতার কয়েক শতকের ওলোটপালোট
করে দেওয়া অভিঘাত, এই দুইয়ের সংকট সন্ধিতে দাঁড়িয়ে পরিবেশ-প্রকৃতি-জীববৈচিত্র, সামাজিক-মূল্যবোধ বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা
যখন দ্রুত ভেঙে পড়ছে, তখন সর্ষের মধ্যে কোন ভূতটি আছে তা বুঝে নেওয়া আমাদের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। বিশেষত জোর করে চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়নের স্টিম বোলারে পিষে যেতে যেতে এই দানবীয় আধুনিকতার বিকল্প খোঁজা ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো রাস্তাই খোলা থাকে না। পশ্চিমী পোষ্টমর্ডান
ভাবুকরা তাঁদের নিজেদের জায়গা থেকে যে কাজটি করেছেন, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেই কাজটি করা তেমন একজন মানুষের পক্ষেই সম্ভব, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য
জ্ঞানতত্ত্বের দুটি ধারাতেই যাঁর সমান দীক্ষা। আর এক্ষেত্রে
তিনি হলেন ড. রমেশচন্দ্র
মুখোপাধ্যায়। আমার অত্যন্ত সৌভাগ্য যে পরম শ্রদ্ধেয় ড. রমেশচন্দ্র মুখোপাখ্যায়'এর ন্যায় প্রজ্ঞাবান শিক্ষকের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি। যাঁর লেখনীর প্রভাবে এমন একটি দূর্বোধ্য বিষয় অত্যন্ত সহজ ভাবে আমাদের সম্মুখে উদ্ভাষিত হয়েছে।
পোষ্টমর্ডানিজম্ এবং সাহিত্য চিন্তা নামক নিবন্ধে রঞ্জন চক্রবর্তী
মহাশয় বলেছেন, 'বিশ্বের নানা প্রান্তের সাহিত্যে প্রকাশভঙ্গী নিম্নে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বাংলার কবি সাহিত্যিকরা
সেইসব টেকনিক অনুকরণ করতে চাইতেই পারেন। আবার কোনও একটি পথ পরিত্যাগ করে বিকল্প পথের খোঁজও করতে পারেন। পোষ্টমর্ডানিজম' এই অর্থে একমুখী নয়, তার মধ্যেই সেই বিকল্প রয়েছে।
"মরচে পড়া জলাশয় থেকে উঠে এল গ্যারেজ খোলা চাবি, ঠান্ডা কাঁটাচামচ
দিয়ে প্রাতঃরাশ
- 'নক্সা কেটে ঢুকে যাও
উউতে থাকা মেঘদস্তানায়....।" আরোগ্য, ধীমান চক্রবর্তী
ড. রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
উত্তরআধুনিকতা, সাহিত্য এবং কবিতা বিষয়ক অনেকগুলি মূল্যবান গ্রন্থ উৎসাহী পাঠক কুলের হাতে তুলে দিয়েছেন। এই সকল মূল্যবান গ্রন্থসমূহের মধ্যে অন্যতম হল-
১. জ্যাঁ বদ্রিয়ার।
২. ফুকো।
৩. চিহ্নতত্ত্ব বা সেমিয়োলজি।
৪. বিকল্প অর্থনীতি।
৫. পোষ্টমর্ডানিজম্।
৬. লাঁকা।
৭. ডমরু ধ্বনি।
এছাড়া তিনি ইংরেজী ভাষায় ও বেশ কিছু গ্রন্থ, প্রায় শতাধিক নিবদ্ধ ইত্যাদিও রচনা করেছেন। আণ্ডার গ্রাউণ্ড নামক দ্বিভাষিক পত্রিকার
(বাংলা ও ইংরাজী) একটি সংখ্যায় তার কাজকর্ম বিষয়ক বিস্তর আলোচনাও করা হয়েছে। ড. রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
দেখিয়েছেন যে কেবলমাত্র ভাষার মধ্যেমেই চৈতন্যের অস্তিত্ব সম্ভব, কারণ আমরা চারপাশের জগতকে ভাষার মাধ্যমেই অনুধাবন করি। তিনি ভাষার বহিঃরঙ্গ হতে অধিবিদ্যক খোলস ছাড়িয়ে নিয়ে (ডিকনস্ট্রোক্ট করে) এর অভ্যন্তরের
দ্বন্ধসমূহকে দেখিয়েছেন।
তিনি এও দেখিয়েছেন মিশেল ফুকো ও ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ
হতে যুক্তিবাদকে
আক্রমণ করেছেন। তিনি ইতিহাসে মার্কস যেমন দেখেছিলেন তেমন কোন দ্বান্ধিক
ক্রমোন্নতি বা যৌক্তিক শৃংখলা খুঁজে পান নি। সুতরাং এই অর্থে ফুকো একটি উৎকেন্দ্রিক ও যুক্তিরহিত চিন্তনবিশ্বের কথাই বলেছেন। প্রকৃত অর্থে ড. রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
উত্তরাধুনিকতার জটিলতম বিষয়গুলিকে তার গবেষণার মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন, ব্যাখ্যা করছেন মিশেল ফুকোর সিদ্ধান্ত তথা ভাবনাগুলিকে। এক্ষেত্রে
তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন দূরান্বিত কল্পনা এবং সম্ভবতাকে।
আর এখানেই তিনি হয়েছেন সফল।
No comments:
Post a Comment