প্রথিতযশা
বৌদ্ধ ভিক্ষু অধ্যাপক মহাথের ধর্মকীর্তি ছিলেন সিংহলের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। বৌদ্ধ দেশ সিংহলে অনুকূল পরিবেশ ও তাঁর জন্মগত স্বভাব বৈরাগ্য তাঁকে পরিবারের বাইরে নিয়ে এসেছিল। তিনি ভোগের চাইতে ত্যাগই সমধিক উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন । ১৯৩৪ সাল ভদন্ত ধর্মকীর্তি
প্রথম আসেন বাংলাদেশে। তখন তিনি পালিভাষায়
এম.এ. ডিগ্রী নিয়েছেন এবং বেশ কিছুকাল সিংহল বিদ্যালঙ্কার কলেজে অধ্যাপনাও করে এসেছেন। তাঁর বয়স তখন ৩৪ বছর। আজন্ম বিবাগী মনের অধিকারী তিনি ছিলেন, যা তাঁর সেই বয়সেই গৃহত্যাগী স্বদেশত্যাগী অনুসন্ধিৎসু জীবনের মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে
তাঁর ত্যাগদীপ্ত
জীবনের একটি স্বচ্ছ উজ্জ্বল চিত্র এখানে প্রায় সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পরে বাংলাদেশের
বৌদ্ধ সমাজ বিমুগ্ধনেত্রেই অবলোকন করেছে আর বিস্মিত হয়েছে এই ভেবে যে মহাথের ধর্মকীর্তি তাঁর স্বদেশ সিংহল অপেক্ষা বাংলাদেশকে
কেন এত বেশী ভালোবাসতেন!
তিনি বাংলাদেশকে বিশেষ করে বাঙালী বৌদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতিকে
নিবিড় ভাবেই ভালবেসেছেন। তাঁকে সিংহল সমুদ্র দ্বীপের নারিকেল কুঞ্জ শোভিত আত্মীয় পরিজনের প্রীতিময় পরিবেশ থেকে আমরণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। অবশ্য মাঝে মধ্যে স্বদেশের কথা যে তাঁর মনে পড়ত।
প্রিয়দর্শী
অশোকের আমলের প্রাচীন বৌদ্ধ ভারত ও সিংহলের পটভূমিকায়
রচিত সেই গল্পের আখ্যান ভাগ হচ্ছে : সৌরসেন নামীয় একজন সিংহলী তরুণ মঞ্জুলানী
তার দয়িতা এবং বিপুল ভোগৈশ্বর্য ছেড়ে ভারতে উচ্চ শিক্ষার্থে এসে ভিক্ষু হয়ে যান। আর বৌদ্ধধর্ম ও শাস্ত্রচর্চ্চায় তিনি এমন নিবিষ্ট হয়ে পড়েন যে, স্বদেশে ফিরে যাবার কথাটুকুও তাঁর কোনদিন মনে পড়েনি। কিন্তু গুরুর নির্দেশে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রচারার্থে আবার তাঁকে সিংহলে ফিরে যেতে হয়।
ভিক্ষু সৌরসেন ও মহাথের ধর্মকীর্তির
জীবনের মধ্যে তেমন কিছু মিল নেই। মিল ছিল শুধু বৌদ্ধধর্ম,
দর্শন শাস্ত্রকে
এবং তার লালন ভূমি বুদ্ধের দেশকে তাঁরা দুজনেই অন্তর দিয়ে ভালবেসেছিলেন।
স্বদেশ প্রত্যাগত ভিক্ষু সৌরসেনকে সেদিন তাঁর স্বদেশবাসীরা অনুরাধাপুরে বিপুল ভাবে সম্বর্ধনা জানিয়েছিল।
সিংহল সমুদ্রদ্বীপ
থেকে দূর্বার প্রাণশক্তি নিয়ে এখানে বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে এসে তিনি কেবল রেখে গেলেন একটি নাম : ধর্মকীর্তি।
তিনি জীবিতাবস্থায় স্বদেশে ফিরে যাননি। ১৯৫৯-৬০ সালের দিকে তিনি শেষবারের মতো যখন কলকাতার মহাবোধি সোসাইটির প্রচারণা বিভাগে নিয়োজিত ছিলেন তখনো তাঁর স্বদেশ, তাঁর আত্মীয় স্বজন বিশেষতঃ তাঁর ভাই ও বোনের কাছ থেকে বারংবার আহ্বান আর অনুরোধ এসেছিল : এবার আপনি সিংহলে চলে আসুন।
১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সিংহলে নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দর নায়কের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য সিংহলের অর্থমন্ত্রী মি. এস.এস. পেরেরা শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পরেই ধর্মকীর্তি
ভন্তেকে তারবার্তায়
নিজের সেই সুখবরটা জানিয়ে তাঁকে সিংহলে চলে আসার জন্য অনুরোধ জানান। সে সময় ভদন্ত ধর্মকীর্তি তাঁর ভাতুষ্পুত্র মিঃ পেরেরাকে অভিনন্দন জানিয়ে যে তারবার্তা প্রেরণ করেন তাতে শেষদিকে এই কথা ক’টি উল্লেখ ছিল : আমার আসার জন্য তোমরা উদ্বিগ্ন হয়ো না। আমি এখানে থাকলেও তোমাকে সব সময় আশীর্বাদ করবো, যেন ভবিষ্যতে উত্তরোত্তর উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধির
পথে অগ্রসর হয়ে সিংহলের প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ অলংকৃত করতে পারো।
সিংহলের সেই আত্মীয় পরিজনদের প্রতি তাঁর একধরনের আশীর্বাণী ছাড়া আর কোন মোহ ছিল না। মোহ ছিল না বলেই তিনি বাংলাভাষাকে সম্পূর্ণ অধিগত করার মানসে ঐ বিষয়ে প্রবেশিকা
পরীক্ষা পাশ করেছিলেন এবং “মুক্তিপথ”, “ধম্মপদ অটট কথা” ইত্যাদি পুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশনায় ব্রতী হয়েছিলেন। তারপর রাঙ্গুনীয়া কলেজে পালিভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনায়
নিযুক্ত থেকেও তিনি চেষ্টা করেছিলেন চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ে পালির অধ্যাপক পদে উন্নীত হতে।
১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধীনে পালি বিভাগ খোলার যে জল্পনা কল্পনা চলছিল তখন মহাথের ধর্মকীর্তি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের তদানীন্তন
প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান সাহেবকে সিংহলী বর্ণমালা ও প্রাথমিক ভাষা শেখাবার এবং “মিলিন্দ পঞ্ঞ” মূল পালি গ্রন্থটি অনুবাদের ব্যাপারে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত দিয়ে আসেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় তিনি বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবেন এই ছিল তাঁর সংকল্প।
..... আজ বিশেষ কথা হল, গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সংবাদপত্র
গুলোতে একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একজন পালি লেক্চারার প্রয়োজন। যারা সেই খবর জানতে পেরেছে, তাদের মধ্যে কেহ কেহ আমার কাছে খবর দিল যে আমি যেন সেই পদের জন্য প্রার্থী হই। কিন্তু তখন পরিস্থিতি
ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। পরিস্থিতির
অচলাবস্থা দেখে আর দরখাস্ত করলাম না।
এখন খবর পেয়েছি যে পয়লা ফেব্রুয়ারীতে বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে। অনেকে মনে করেছে যে ইত্যবসরে পালি অধ্যাপক বা পালি কথিকাচার্য
পদের জন্য বিজ্ঞাপন দিতে পারে। এ সম্পর্কে কোন খবর তোমার পত্রিকাতে কিংবা অন্য কোন পত্রিকাতে উঠলে সহসা আমার কাছে জানাবে। এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখবে। .. একবার এদিকে আসতে চেষ্টা করো। জেঠিমারা এক প্রকার ভাল আছে। ইতি, -মহাস্থবির ধর্মকীর্তি।
৪ঠা ফেব্রুয়ারী তারিখেই তিনি সেই বাসনাকে চিরতরে বিসর্জন দিয়ে নির্বাণেই বুঝি বিলীন হয়ে গেলেন। সদাহাস্যময়,
সদালাপী প্রদীপ্ত একটি জীবন প্রদীপ, চিরতরেই নির্বাপিত হয়ে গেল। গ্রামবাংলার
বৌদ্ধদের ঘরে ঘরে, প্যাগোডায়-বিহারে, সংঘদানে-সমাবেশে, কঠিন চীবর দানোৎসবে,
ধর্মীয় সভা-সম্মেলনে আর কোনদিন চারদিক উজ্জ্বল করে জ্বলবেনা এ দীপ। আর কোনদিন শোনা যাবে না ধর্মকীর্তির ধর্মদেশনার
সেই উদাত্ত কণ্ঠস্বর। আর কোন কালেই কেউ দেখবে না নোয়াপাড়া বৈদ্যপাড়া রাঙ্গুনীয়ার
পথে পথে এই প্রতিভাদীপ্ত জ্ঞানতাপসের নিত্য বিচরণ। এসব কেবল আমাদের অন্তর্লোকে
একটি অনাবিল স্মৃতি হয়েই যুগ যুগ ধরে বিরাজ করছে।
No comments:
Post a Comment