সুমনপাল ভিক্ষু
তাম্রলিপ্ত বা বর্তমান তমলুক একই অঞ্চল কিনা এই বিষয়ে নানাবিধ মতানৈক্য দেখতে পাওয়া যায়। হিন্দু পুরাণ সাহিত্য রামায়ণ এবং মহাভারতেও তাম্রলিপ্তের নাম রয়েছে। এছাড়া বিষ্ণুপুরাণ ইত্যাদিতেও এই অঞ্চলের উল্লেখ বর্ণিত আছে। বৌদ্ধগ্রন্থেও তাম্রলিপ্তসহ আরও কয়েকটি বন্দরের নাম পাওয়া যায়। শুয়াং জাঙের ভ্রমণ বৃত্তান্তে এই বন্দরের নাম তমোলিত্তি বা তমোলিতি বলা হয়েছে।
ইসলামিক শাসনের পূর্বে 'বাংলা' নামে রাজ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। সেই সময় সমগ্র বঙ্গদেশ বেশ কিছু স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। সম্ভবত তাম্রলিপ্তও সেগুলির মধ্যে পরিগণিত হত। মহাভারতে অঙ্গ, বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত, কলিঙ্গ ইত্যাদি বিভিন্ন রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়।
তাহলে প্রশ্ন এসেই যায় যে, এই তাম্রলিপ্ত প্রাচীনকালে কোথায় বা সঠিক কোন্ অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। বিশ্বকোষ নামক গ্রন্থের ৬৯ পৃষ্ঠায় মহার্ণব শ্রীনগেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন:
তাম্রলিপ্ত প্রদেশশ্চ বাণিজশ্চ নিবাস ভূঃ।
দ্বাদশযোজনে যুক্তঃ রূপানদ্যাঃ সমীপতঃ।।
অর্থাৎ, তাম্রলিপ্তের অবস্থান ছিল রূপনারায়ণ নদের তীরে। আবার ভবিষ্যৎ পুরাণের ব্রাহ্মখণ্ডে লিখিত আছে-
তাম্রলিপ্ত-প্রদেশে চ বর্গভীমা বিরাজতে।
গোবিন্দপুর-প্রান্তে চ কালী সুরধনী তটে।। ৯।। -দ্বাবিংশোহধ্যায়ঃ
বর্গভীমা দেবী বিরাজ করেন তাম্রলিপ্তে। সেই তাম্রলিপ্ত গোবিন্দপুরের অন্তিম সীমানায় সুরধনীর তীরে। 'বর্গভীমা দেবী' রূপনারায়ণপুর নদীর তীরে বর্তমান তমলুক ব্যতীত আরও কোনো 101 অঞ্চলে রয়েছেন বলে মনে হয় না। সুতরাং, বর্তমান তমলুকই হয়তো প্রাচীন তাম্রলিপ্ত।
বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত আছে :
তাম্রলিপ্তান্ সমুদ্রতটপুরীশ্চ দেবরক্ষিতো রক্ষিষ্যাতি।।১৮
-চতুর্বিৎশোহধ্যায়ঃ ।২০
এছাড়া বায়ুপুরাণেও রয়েছে :
ব্রহ্মোত্তরাংশ বঙ্গাংশ্চ তাম্রলিপ্তানং স্তথৈব চ।
জ্ঞান জনপদানায্যানাম গঙ্গা শুভান্।। ৪৯-সপ্তচত্বারিংশোহধ্যায়ঃ। ২১
'জন্মভূমি' (১ম খণ্ড)-র ৩৯২ পৃষ্ঠায় তাম্রলিপ্ত প্রসঙ্গে এই বিবরণ পাওয়া যায় :
"এখন দেখিতে পাওয়া যায়, ভাগীরথী-স্রোতঃ হুগলী প্রভৃতি হইয়া প্রবাহিত, পূর্বে কিন্তু এই মহাকায় স্রোতস্বতী সপ্তপদগ্রাম বিধৌত করিয়া তমোলুক প্রভৃতি জনপদ অতিক্রম করিয়া বহমানা ছিল।"
জেনারেল কানিংহাম সাহেবের বিবরণ হতে জানা যায় যে-তাম্রলিপ্তী-হুগলী নদীর পশ্চিমদিকে এবং উত্তরে বর্ধমান এবং কালনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ঐতিহাসিক হান্টারের মতে: তমলুক রাজ্য পূর্বে ২০০ মাইল পরিধি বিশিষ্ট ছিল এবং তৎকালে সমুদ্রও তমলুকের নিকটবর্তী ছিল। এখন সমুদ্র তমলুক থেকে ৬০ মাইল দূরে সরে গেছে। অতএব তমলুকের পশ্চিমস্থ ময়নাগড়ের পুরাতন রাজ্যাংশ-সবঙ্গদেশা বা সবং পরগনা-ব্যতীত তমলুক রাজ্যকে ২০০ মাইল পরিধি বিশিষ্ট করতে হলে, ২০ পরগনার অন্তর্গত মাতলা শহর পর্যন্ত সীমানা ধরতে হয়।
বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক শুয়াং জাঙ্ (খ্রি. ৬২৯ অব্দে) বিবরণে রয়েছে যে-“এই রাজ্যের পরিধি ১৪০০ লি (২৮০ মাইল) এবং এর রাজধানী ১০ লি (২ ক্রোশ)'র অধিক বিস্তৃত।"
এই সকল তথ্য হতে মনে হয় তাম্রলিপ্তের একদিকে ছিল কলিঙ্গ রাজ্য। উত্তরে কালনা ও বর্ধমান, দক্ষিণে সমুদ্র এবং পশ্চিম-দক্ষিণে কলিঙ্গ, পূর্বে গঙ্গা। সুতরাং, সেই সময় এই অঞ্চলের পরিধি ছিল ১২৫ ক্রোশ।
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তমলুক অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত লিপিযুক্ত একটি মৃৎপাত্রতে খরোষ্ঠী লিপিতে লিখিত 'তমুলিপ্তস্' শব্দটি পাওয়া গেছে। সম্ভবত ব্রাহ্মী 'তমুলিপ্তস্' বা তাম্রলিপ্ত একই অঞ্চলের পরিচয় বহন করছে।
তাম্রলিপ্ত নগরের উৎপত্তির সময়কাল সম্পর্কিত কোনো তথ্যই আমাদের হতে আসেনি। তবে এই অঞ্চল সম্পর্কে যে সকল তথ্যসমূহ আমরা পেয়েছি তা হতে জানা যায় যে, মৌর্য ও পূর্ববর্তী রাজাদের সময়কালে এই নগরীর অস্তিত্ব ছিল। তবে এই স্থানের নাম কেনই বা তাম্রলিপ্ত হয়েছিল, তাও জানা যায়নি।
বড়জোর (বিহার অঞ্চলের কুমরাজার)'এ একটি মন্দিরের চিত্রযুক্ত ফলকে খরোষ্ঠী লিপিযুক্ত মৃৎপাত্র এবং শিলমোহর পাওয়া গেছে। অপরদিকে বাংলার চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত শিলমোহরগুলিও বড়জোর-এর শিলমোহরের ন্যায় একই গোত্রের। উভয় শিলমোহরেই 'ধনমিত্রেন' এবং 'তমুলিপ্তস্' শব্দ দুটি রয়েছে। এগুলি খ্রিস্টের জন্মের পূর্বেকার। সুতরাং এই দুটি তথ্য হতে আমরা অবগত হতে পারি যে, খ্রিস্টের জন্মের পূর্বেও তাম্রলিপ্ত (তমুলিপ্তস্) নগরীর অস্তিত্ব ছিল।
খ্রিস্টীয় ৬২৯ অব্দে শুয়াং জাঙ্ তাম্রলিপ্ত অঞ্চলে বেশ কিছু বৌদ্ধবিহার ও স্তূপ দেখেছিলেন। এই সকল বিহার ও স্তূপের মধ্যে কতকগুলি ছিল অশোক (মৌর্যসম্রাট) নির্মিত। সম্ভবত মৌর্যযুগে তাম্রলিপ্ত অঞ্চল মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল।
তাম্রলিপ্তের নামোৎপত্তির বিবরণ
তাম্রলিপ্ত অঞ্চলের নামোৎপত্তি প্রসঙ্গে নানাবিধ কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। 'দ্বিগ্বিজয় প্রকাশ' নামক সংস্কৃত ভৌগোলিক গ্রন্থের উপাখ্যান হল এইরূপ :
বৃন্দাবনে বাসুদেব যখন রাসলীলায় মগ্ন তখন তাঁর ইচ্ছায় স্তম্ভন হয়েছিল সূর্যচন্দ্র। অতএব সূর্যদেব বললেন, ভারতে আমি প্রকাশিত হব। অর্থাৎ, সৃষ্টি করব দিন। তুমি শীঘ্র এসো উদয়াচলে। তখন রশ্মিজাল নিয়ে উত্থিত হলেন সারথি। তাতে পতিত হল জ্যোৎস্না। (তাম্রবর্ণ) অরুণ দূরীভূত হয়ে সমুদ্র প্রান্তে হলেন লিপ্ত। যে স্থানে লিপ্ত হয়েছিলেন সূর্যদেব, সে স্থানই তাম্রলিপ্ত নামে হল কীর্তিত।
এই নামের উৎপত্তি সম্পর্কে আরও একটি অভিমত হল :
প্রাচীনকালে 'দামল' নামক এক জনগোষ্ঠী তাম্রলিপ্তে বসবাস করত। এই দামল জাতির নামানুসারে এই অঞ্চলের নাম হয় তাম্রলিপ্ত। তবে এই ধারণাটি সমর্থনযোগ্য নয়।
আবার অনেকের মতে তমোলিপ্ত কথাটির অর্থ তমসাচ্ছন্ন অর্থাৎ অন্ধকারময় বা পাত্রে পরিপূর্ণ। সম্ভবত এই অঞ্চলটি বৌদ্ধপ্রধান হওয়ার কারণে ব্রাহ্মণ্যবাদীগণ তাম্রলিপ্তি শব্দটি বিকৃত করে 'তমোলিপ্ত' কথাটি উচ্চারণ করতেন।
"তমলুক মঙ্গল” রচয়িতা গিরিশচন্দ্র সরস্বতী ভট্টাচার্য লিখেছেন "তাম্রধ্বজ রাজা লুপ্ত হলে তাঁর নামানুসারে এই স্থান তাম্রলিপ্তীরূপে আখ্যাত হয়েছে।"
কোনো কোনো পণ্ডিতের অভিমত হল এই অঞ্চলে পূর্বকালে অধিক পরিমাণে তাম্র পাওয়া যেত, তাই কালক্রমে এই স্থানটি তাম্রলিপ্ত নামে পরিচিত হয়।
তাম্রলিপ্ত প্রসঙ্গে পৌরাণিক উপাখ্যান
তাম্রলিপ্ত বন্দর তথা নগরের কথা বিভিন্ন হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যানে যাওয়া যায়। মহাভারতের অনেক স্থানে তাম্রলিপ্তের উল্লেখ পাওয়া যায়।
......তাম্রলিপ্তঞ্চ রাজানং কব্বচিধিপতিং তথা।। ২৪।।
সর্বান্ ম্লেচ্ছগণাংশ্চৈব বিজিত্যে ভরতর্ষভ।। ২৫।।
ইতি সভাপর্ব্বনি দ্বিগ্বিজয় পর্ব্বনি ভীমদ্বিগ্বিজয়ে ত্রিংশোহধ্যায়ঃ
মহাভারতের এই তথ্য হতে জানা যায় যে, সেই সময় তাম্রলিপ্ত অঞ্চলের জনগণ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছিলেন, সম্ভবত সেই কারণে তাদের ম্লেচ্ছ বলা হয়েছে।
অষ্টাদশ পুরাণ রচিত হয়েছিল ভারতবর্ষ হতে বৌদ্ধধর্মকে বিতাড়িত করার জন্য। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়েছিল বৌদ্ধযুগ হতে। বৌদ্ধযুগ হতেই প্রকৃত অর্থে নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া যায়। কারণ বৌদ্ধ সাহিত্য হল জনগণের সাহিত্য। এখানে তথাকথিত দেবতা প্রাধান্য বড়ো নয়, প্রাধান্য পেয়েছে জনগণ অর্থাৎ, রক্তমাংসের মানুষ কিন্তু হিন্দু পুরাণের চরিত্রগণ সকলেই দেবতা। পুরাণে তাম্রলিপ্তের সঙ্গে ম্লেচ্ছ এবং দেবতা ইত্যাদির মাহাত্ম্যমূলক ইতিহাস পাই। এর কারণ পুঁথির মধ্যে ছল, কপটতা ইত্যাদি নিহিত আছে।
বৌদ্ধযুগে তাম্রলিপ্ত অঞ্চল ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বন্দর অপরদিকে ছিল বৌদ্ধপ্রধান অঞ্চল। সুতরাং, এই অঞ্চলটিকে করায়ত্ত করার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদীগণ নানাপ্রকার কাল্পনিক উপাখ্যানের পটভূমি তৈরি করেছিল। নিম্নে এই বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হল। যেমন :
১. ব্রহ্মপুরাণে তাম্রলিপ্তকে বলা হয়েছে 'কপাল মোচন তীর্থ'।
২. কৃষ্ণ অর্জুন সংবাদে কৃষ্ণ তাম্রলিপ্তকে প্রীতিপদ স্থানরূপে উল্লেখ করেছেন।
৩. পিল হরিবংশে হিরণ্যকশিপু বধ প্রসঙ্গে তাম্রলিপ্তের নাম পাওয়া যায়।
৪. পদ্মপুরাণ ও মৎস্য পুরাণেও তাম্রলিপ্তের নাম রয়েছে।
৫. মার্কণ্ডেয় পুরাণে এবং বৃহৎ সংহিতাতে তাম্রলিপ্তের নাম নানাভাবে উঠে এসেছে।
অষ্টাদশ পুরাণের ন্যায় ৪-৫টি পুরাণেও তাম্রলিপ্তের নাম পাওয়া যায়, কিন্তু অবশিষ্ট পুরাণগুলিতে (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বায়ুপুরাণ, গরুড়পুরাণ ইত্যাদি) তাম্রলিপ্তের নাম পাওয়া যায় না। সম্ভবত পালযুগের অন্তিমক্ষণে বৌদ্ধ ইতিহাস ভারতবর্ষ হতে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে বৌদ্ধস্থানগুলিকে হিন্দুদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র বা হিন্দু দেবতাদের লীলাক্ষেত্র রূপে বর্ণনা করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই পুরাণগুলি রচিত হয়েছিল। ফলে এই সকল পুরাণ পুথির মধ্যে ঐতিহাসিক সত্যতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
তবে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু পুরাণগুলিতে যেভাবে তাম্রলিপ্ত সম্পর্কে পুনঃপুনঃ উল্লিখিত হয়েছে, ফলে সঙ্গত কারণেই আমরা বলতে পারি তাম্রলিপ্ত প্রাচীনকালে অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগর এবং বন্দররূপে আসীন ছিল।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে ভারতের পূর্বদিকে প্রসিদ্ধ জনপদসমূহের বর্ণনা প্রসঙ্গে তাম্রলিপ্তের নাম এইভাবে বর্ণিত হয়েছে-
প্রাগজ্যোতিষাশ্চ মদ্রাশ্চ বিদেহাস্তম্রলিপ্তকাঃ।
মল্লা মগধ গোমস্তাঃ প্রাচ্য জানপদাঃ স্মৃতাঃ।। ৪৪।
আবার জ্যোতিস্তত্বে আছে-
রর্দ্ধমান তমোলিপ্ত প্রাগজ্যোতিষাদয়াদ্রয়ঃ।।
তাম্রলিপ্ত ও বৌদ্ধযুগ
প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধযুগ বাংলায় তাম্রলিপ্ত জনপদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এই যুগেই তাম্রলিপ্ত সম্পর্কিত সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য এবং তথ্যবহুল ইতিহাস পাওয়া যায়। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ বৌদ্ধযুগের বিভিন্ন ভ্রমণ কাহিনিগুলিকে গবেষণা করে তাম্রলিপ্তের ঐতিহাসিকত্ব প্রমাণ করেছেন। কারণ বৌদ্ধ যুগেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে আগত পরিব্রাজক ও বৌদ্ধভিক্ষু ভারতে এসেছিলেন এবং ভারত হতেই অন্যান্য অঞ্চলে পরিভ্রমণ করেছিলেন।
ভারতীয় সম্রাটগণ ভারতবর্ষ ব্যতীত আফগানিস্তান, মিশর এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। মহামানব গৌতমবুদ্ধ এবং বুদ্ধযুগ ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে গৌরবময় যুগ। বৌদ্ধযুগ এবং বৌদ্ধগ্রন্থ হতে জানা যায় যে, যীশুখ্রিস্টের জন্মের বহু শত বছর পূর্বে তাম্রলিপ্তবাসীগণ অদম্য কুশলী ও রণনৈপুণ্য জাতিতে পরিণত হয়েছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে গ্রিকবীর আলেকজাণ্ডারের আগমনের পূর্বেই ভারতীয় নাবিকগণ তাম্রলিপ্ত বন্দর হতে সিংহলসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অর্ণবপোত সহযোগে যাতায়াত করতেন। গ্রিক, রোমান এবং আরবগণ তখনও উক্ত অঞ্চলের জলপথ আবিষ্কার করতে পারেননি।
মহাভারত এবং অন্যান্য বৌদ্ধগ্রন্থ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, প্রাচীনকালে তাম্রলিপ্ত ছিল পূর্ব ভারতের উল্লেখযোগ্য বন্দর।
রোমান ঐতিহাসিক তাসিতাস উত্তরপ্রদেশের ইতিহাস উদ্ধার করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি লিখেছেন-খ্রিস্টপূর্ব ৬০ অব্দে কতকগুলি ভারতবাসী বাণিজ্য প্রসঙ্গে সমুদ্রপথে জার্মান উপকূলে পতিত হয়েছিলেন। যদিও এই তথ্যটি বিতর্ক বহুল, তবুও মনে হয় প্রাচীনকালে ভারতীয় বণিকগণ এই সকল অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য সপক্ষে যাতায়াত করতেন।
কালিদাস রচিত রঘুবংশে এইরূপ বর্ণিত আছে
'বিজয়ী রঘু এইরূপ অপ্রতিহত পরাক্রমে প্রাচ্য দেশসমূহ জয় করতে করতে ক্রমে তালীবন সন্নিবেশে শ্যামবর্ণ পূর্বমহোদধির বেলাভূলিতে উপনীত হলেন।।' ৩৪।। (চতুর্থ সর্গ)
বঙ্গদেশের রাজন্যবর্গ রণতরীর সহায়তায়, প্রতিদন্দ্বী রঘুর সহিত যুদ্ধার্থ উপস্থিত হলে, তিনি সবলে তাদের পরাজয় সাধনপূর্বক গঙ্গা প্রবাহ মধ্যবর্তী দ্বীপপুঞ্জে স্বীয় বিজয়স্তম্ভ প্রোথিত করলেন।।' ৩৬।।
প্রসিদ্ধ চৈনিক পরিব্রাজক যখন ভারতবর্ষে আসেন, তখন বঙ্গদেশ ৫টি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল।
যেমন-(১) পুণ্ড্র, (২) সমতট, (৩) কামরূপ, (৪) কর্ণসুবর্ণ এবং (৫) তাম্রলিপ্ত। খ্রিস্টীয় শতক আরম্ভ হওয়ার ফলে বঙ্গদেশে ৪টি প্রদেশে বিভক্ত হয়ে যায়। যথা-গঙ্গার উত্তর ভূভাগ বরেন্দ্র এবং বঙ্গ এবং দক্ষিণ ভূভাগ রাঢ় এবং জলঙ্গী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল। খ্রিস্টীয় ৭৩২ অব্দে গৌড়াধিপতি আদিশূরের সময়কালে বঙ্গদেশ রাঢ়, বঙ্গ, বরেন্দ্র এবং গৌড় এই ৪টি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল।
ভগবান বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণকালে দেবরাজ শত্রুকে বললেন, "আজ বিজয় লংকা দ্বীপে নামিল। সে সেখানে আমার ধর্ম প্রচার করিবে, তুমি তাহাকে রক্ষা করিও” (বাংলার গৌরব, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ১৩৫৩ এবং মহাবংশ)।
কথিত আছে তদানীন্তন বঙ্গদেশের রাজা সিংহবাহুর পুত্র ছিলেন বিজয় সিংহ। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দে সিংহবাহু সিংহপুর অঞ্চলের অধীশ্বর ছিলেন। অনেকের মতে তদানীন্তন সিংহপুর বর্তমান হুগলি জেলার অন্তর্গত সিঙ্গুর অঞ্চল। (হুগলি জেলার ইতিহাস, ২ খণ্ড)।
দশকুমার চরিত নামক গ্রন্থে এক রাজকুমারের তাম্রলিপ্ত নগর হতে অর্ণবপোতে সমুদ্রযাত্রার বিবরণের কথা বর্ণিত আছে।
শুয়াং জাহ্ তাম্রলিপ্ত নগরে অশোকের তাম্রশাসন স্তম্ভ দেখেছিলেন। যদিও সেই স্তম্ভটির পঞ্চাশ ভাগও পাওয়া যায়নি। বর্গভীমা দেবীর স্থানে স্তম্ভটি ছিল অনুমান করা হয়।
সিংহলী বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবংশ হতে জানা যায় যে খ্রিস্টজন্মের ৩০৭ বছর পূর্বে তাম্রলিপ্ত নগর সমুদ্র উপকূলবর্তী একটি নগররূপে বিখ্যাত ছিল। এই নগর হতেই মহবোধি বৃক্ষের একটি শাখা সিংহলে প্রেরণ করা হয়েছিল।
সিম্রাট অশোক স্বয়ং একবার তাম্রলিপ্ত নগরে এসেছিলেন। ড. নীহার রঞ্জন রায় বলেছেন-
"সিংহলী মহাবংশ' গ্রন্থের একটি গল্পে দেখিতেছি সম্রাট অশোক সিংহলী কয়েকজন দূতকে বিদায় সম্বর্ধনা জানাইবার জন্য নিজে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত আসিয়া সেই বন্দরে তাহাদিগকে জাহাজে তুলিয়া দিয়াছিলেন।” (বাংলার ইতিহাস, আদি পর্ব, পৃ. ৩৬৯)।
মহামতি অশোক সিংহলে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে (খ্রিস্টপূর্ব ২৪৩ অব্দে) পুত্র মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে সিংহলে দ্বীপে প্রেরণ করেছিলেন। (ফা-শিয়েনের ভ্রমণ বৃত্তান্ত, পৃ. ৫৩)।
"মালীবুড়োই বৌদ্ধ তাম্রলিপ্তের ইতিহাসকার প্রথম বলেন যে হিউয়েন সাঙ ভারত ভ্রমণ কালে তাম্রলিপ্তে এসে যে ২০০ ফিট উচ্চ অশোকস্তম্ভ দেখেছিলেন, অশোক স্তম্ভের বর্তমান অবস্থিতির কথা বলতে গিয়ে স্থান তথা স্তম্ভ পরিচয় এভাবে দেখিয়েছেন গুমাই, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দকুমার ব্লকের নন্দকুমার থেকে মাত্র দু কিলোমিটার দূরে মেচাদা- হলদিয়া জাতীয় সড়কের দক্ষিণ দিকে একটি গ্ৰাম। ভারতের অসংখ্য গ্ৰামের মতোই এত সাধারণ, যে সে গ্ৰাম নিয়ে আলাদা করে কিছুই বলতাম না, যদি না সেখানে গোমায়েশ্বর শিব অবস্থান করতেন। এরকমই ধারণার মধ্যে গুমায়েশ্বর শিব অসাধারণ রহস্যময় হয়ে উঠলেন, যখন ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত্বের অনুসন্ধানে জানলাম, আসলে গুমায়ের পাতালে প্রোথিত স্বয়ম্ভু শিব হলেন প্রাচীন বৌদ্ধ তাম্রলিপ্ত নগরীর মহামতি সম্রাট অশোক নির্মিত দুইশত ফুট উচ্চ অশোকস্তম্ভের ভগ্নাবশিষ্ট।
এই লিঙ্গ তো ভাঙা কালো পাথরের স্তম্ভেরই অবশিষ্টাঅংশ দৃশ্যমান। নিচের দিকের পুরোটাই সিমেন্টের বাঁধানো মেঝে ঢেকে রেখেছে। ওপরের প্রায় দু ফিট পাথর যে ভাবে এবড়ো খেবড়ো ভাবে উপর দিকে উঠে আছে। পরিস্কার বৌদ্ধ ধর্মের অবক্ষয়ের যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদী আক্রমণে তাম্রলিপ্তের সেই অশোক স্তম্ভটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। বাকি অংশ মাটির নিচে প্রোথিত রয়েছে। বিস্ময়ে ভয়ে আনন্দে ভক্তিতে বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় প্রাচীন তাম্রলিপ্তের সেই মহামতি অশোক নির্মিত ভারতবর্ষীয় শান্তির প্রতীক অশোক স্তম্ভেরই কাছে প্রণত হস্তে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। (অধ্যাপক সুস্নাত জানা, প্রবন্ধ, রহস্যঢাকা গোমায়েশ্বর শিব)।
"ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে জনগণ যে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন, তাঁরা সম্ভবত খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে তমলুক থেকেই যাত্রা আরম্ভ করেন।" (হান্টারর্স ওড়িশা, খণ্ড ১, পৃ. ৩১০)।
তাম্রলিপ্ত এবং ভগবান বুদ্ধের দন্তধাতু
মহান বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর পবিত্র দন্তধাতু তমলুক বা তাম্রলিপ্ত হতে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে সিংহলে প্রেরিত হয়েছিল। বৌদ্ধগ্রন্থ দাঠাবংশ পাঠ করে এই তথ্য পাওয়া যায়।
প্রাচ্যবিদ্যা মহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু বলেছেন : "বৌদ্ধগ্রন্থ মতে প্রাচীন কলিঙ্গ একটি সুপ্রসিদ্ধ নগর ছিল। কলিঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্তের সময় এই স্থানে বুদ্ধের দন্ত স্থাপিত ও তদুপরি মন্দির নির্মিত হয়েছিল বলে এই স্থানের নাম হয় "দন্তপুর" বা "দন্তপুরী"। পরবর্তীকালে রাজা গুহাশিবের জামাতা দন্তকুমার ব্রাহ্মণদের অত্যাচার হতে পবিত্র দন্তধাতুকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কলিঙ্গ হতে তা তাম্রলিপ্ত পথে সিংহলে নিয়ে যায়। (বিশ্বকোশ, ভাগ ৮০, পৃ. ৩৩৪)।
চৈনিক পরিব্রাজক ফা-শিয়েন সিংহল দ্বীপে মহাসমারোহের সঙ্গে বুদ্ধ দন্তধাতু প্রতিষ্ঠার বার্ষিক উৎসব 'দালাদপিষ্কয়া' দর্শন করেছিলেন।
তাম্রলিপ্ত প্রসঙ্গে চৈনিক পরিব্রাজকগণের মূল্যায়ন :
গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়কালে তাম্রলিপ্তের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সময় সুপ্রসিদ্ধ চৈনিক পরিব্রাজক ফা-শিয়েন ভারতে আসেন। তিনি ৩৯৯-৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর এই সুদীর্ঘ সময় ভারতবর্ষে অবস্থানকালে প্রায় ২ বছর তাম্রলিপ্ত অঞ্চলে অতিবাহিত হয়েছিল। এই সময় তিনি তাম্রলিপ্ত নগরীর বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারে অবস্থান করে বহুমূল্যবান বৌদ্ধগ্রন্থের প্রতিলিপি প্রস্তুত করেছিলেন। ফা-শিয়েন তাম্রলিপ্তে ২৪টি সংঘারাম ও বহু বৌদ্ধাচার্যের সংস্পর্শে এসেছিলেন। যদিও সেই সময়কালে কোন্ কোন্ বৌদ্ধসম্প্রদায় তাম্রলিপ্তে অবস্থান করতেন, সেই সম্পর্কে ফা-শিয়েন কোনোকিছুই বলে যাননি। তবুও যে তথ্য আমরা পাই তা হল গুপ্তযুগে পূর্বভারতে থেরাবাদী ও মহাযানী বৌদ্ধসম্প্রদায় বিদ্যামান ছিল, তবে সেই সময় বৌদ্ধধর্মে মহাযানী মতাদর্শের হাত ধরে বুদ্ধমূর্তি বোধিসত্ত্ব এবং বহুবিধ বৌদ্ধদের-দেবী পুজোর প্রচলন ঘটেছিল।
ফা-শিয়েনের ভারতবর্ষ ত্যাগের এক শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার পর হোই সেং এবং সং-উন নামক দুইজন চৈনিক পরিব্রাজক উত্তর ভারতে এসেছিলেন কিন্তু তাদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে তাম্রলিপ্তের উল্লেখ ছিল না। সম্ভবত তাঁরা পূর্ব ভারত তথা তাম্রলিপ্ত অঞ্চলে আসেননি বলেই প্রতীয়মান হয়।
বিশ্বকোশ গ্রন্থের (১৭শ ভাগের পৃ. ৪১১) বিবরণ হতে জানা যায় যে, আচার্য বোধিধর্ম নামক ভারতীয় বৌদ্ধভিক্ষু খ্রিস্টীয় ৫২৬ অব্দে তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকেই সমুদ্রপথে ক্যান্টন যাত্রা করেছিলেন।
তিনি এদেশ হতে বঙ্গাক্ষরে লিখিত ২খানি বৌদ্ধগ্রন্থ "প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয়সূত্র" ও "উষ্ণীষ বিজয়ধারণী” চিন জাপানে নিয়ে যান। অনেকের মতে আচার্য বোধিধর্ম বাঙালি এবং তাম্রলিপ্ত অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন।
শুয়াং জাঙ আগমনকালে বঙ্গদেশ ৫টি প্রধান রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ফা-শিয়েন ভারতে এসেছিলেন ৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে এবং শুয়াং জাঙ ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে (অর্থাৎ, ২৩০ বছর পরে) ভারতে আসেন। এই সুদীর্ঘ সময় তাম্রলিপ্তের ইতিহাসে বহু বিপর্যয় ঘটেছিল তার সম্পূর্ণ ইতিহাস কোনো এক অজ্ঞাত কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। কারণ ফা-শিয়েন তাম্রলিপ্তে ২৪টি বৌদ্ধবিহার দেখেছিলেন, সেখানে শুয়াং জাঙ্ এসে দেখলেন ১০টি বৌদ্ধবিহার এবং এক হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। অর্থাৎ, এই ২৩০ বছরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রবল ভাবধারায় ১৪টি বৌদ্ধবিহার সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বস্তুত ফা-শিয়েনের সময়কালে তাম্রলিপ্ত বৌদ্ধপ্রধান অঞ্চল ছিল বলেই জানা যায়। কেননা ফা-শিয়েনের ভ্রমণ বৃত্তান্তে হিন্দু তথা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সম্পর্কে কোনো অভিমতই ব্যক্ত করেননি।
শুয়াং জাঙ তাম্রলিপ্ত অঞ্চলে ৫০টি হিন্দু মন্দির দেখেছিলেন সম্ভবত তাম্রলিপ্ত অঞ্চলে সেই সময় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম রাজানুগ্রহ লাভ করেছিল। তবে এই পরিবর্তনের কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস আজও পাওয়া যায়নি। কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ব্রাহ্মণগণ 'ভগবান বুদ্ধকে অবতার' রূপে গ্রহণ করে এবং, মহাযানী বৌদ্ধ দেব-দেবীগুলিকে অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেদের বলে বিভিন্ন গল্পকাহিনি প্রচারের মাধ্যমে সমাজের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল, তাছাড়া বিভিন্ন দেব-দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের মাধ্যমে বৌদ্ধ ভাবকে 'নাস্তিক, পাষণ্ড' 'ম্লেচ্ছ' ইত্যাদি অপবাদে ভূষিত করে ভারতবর্ষ হতে বৌদ্ধমতকে বিতাড়িত করেছিল।
দুইশত ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি অশোক স্তম্ভ শুয়াং জাঙ্ তাম্রলিপ্তে দর্শন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই স্তম্ভটির চিহ্নমাত্র পাওয়া যায় না। বর্তমানে হ্যামিল্টন সর্বার্থসাধক বিদ্যালয়ের সম্মুখে একটি প্রস্তর নির্মিত স্তম্ভ রয়েছে। এই স্তম্ভটি তমলুকের রাজা সুরেন্দ্রনারায়ণ রায় রাজবাড়ির সীমার মধ্যে মৃত্তিকা খননকালে পেয়েছিলেন। হয়তো এই স্তম্ভটি শুয়াং জাঙ্ বর্ণিত সেই অশোক স্তম্ভ। তবে উক্ত স্তম্ভটিতে কোনো লিপি খোদিত নেই। ফলে স্তম্ভটির কালনির্ণয় সম্ভব হয়নি।
ইতিহাসের এই বিশাল পরিসরে শত শত বৎসরের নানা ভূস্তরিয় পরিবর্তন ও সামাজিক, ধর্মীয় বিপ্লবের পরও বৌদ্ধ তাম্রলিপ্তের প্রাচীন অশোকস্তম্ভটি আজও এভাবেই মহাকালকে ফাঁকি দিয়ে বেঁচে আছে।"
চৈনিক পরিব্রাজক ইৎ-সিঙ্ ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধদর্শন শিক্ষার উদ্দেশ্যে ভারতে আসেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে তাম্রলিপ্ত অঞ্চলের বৌদ্ধবিহার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাঁর আগমনকালে তাম্রলিপ্তে মতান্তরে 'বরাহ' নামক এক সুবিখ্যাত মহাযানী বৌদ্ধবিহার ছিল। তিনি সেই বিহারে অবস্থানকালে বৌদ্ধভিক্ষু সংঘের নিয়ম শৃঙ্খলা, রাহুল মিত্র নামক জনৈক বৌদ্ধভিক্ষুর পাণ্ডিত্য, তাম্রলিপ্ত ভারহা বিহারে প্রত্যহ ভিক্ষুগণ দ্বারা 'রত্নকূট সূত্র' পাঠ সম্পর্কে বর্ণনাও করেছেন। বর্তমানে বাহিরী স্থান বা গ্রামটি বরাহ বিহারের অপভ্রংশ।
ইৎ-সিঙ্ এই ভারহা বিহারে অবস্থান কালে ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে আচার্য নাগার্জুনের 'সুহৃল্লেখ' গ্রন্থটি চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন।
ভরাহ বৌদ্ধবিহার পরবর্তীকালে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এই সুপ্রসিদ্ধ বিহারের অবস্থান এবং ধ্বংসাবশেষ আজও মেলেনি। অনেকের মতে দেবী বর্গভীমার মন্দিরটিই হয়তো সেই বৌদ্ধবিহারের অংশ। কারণ ইৎ-সিঙ্-এর সময়কালে মাত্র ৫টি সংঘারাম অবশিষ্ট ছিল। এই তথ্য প্রমাণ করে বৌদ্ধ অধ্যুষিত স্থানগুলিতে ব্রাহ্মণগণ প্রবলভাবে নিজেদের প্রতিপত্তি বিস্তার করেছিল।
পরিব্রাজক ইৎ সিঙ্-এর ভ্রমণ কাহিনি হতে জানা যায় সে সময়ে ৫৬ জন চৈনিক পরিব্রাজক ভারতবর্ষে (তাও লিপ, তাং চেং তেং চাং মিন, হুই থুন প্রমুখ) এসেছিলেন। তাওলিন যবদ্বীপ এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ পথে ভারতবর্ষের তাম্রলিপ্তে উপস্থিত হয়েছিলেন। হুই খুন কোরিয়া হতে তাম্রলিপ্তে আসেন। তাং চেং তেং তাম্রলিপ্তের বরাহ বিহারে অবস্থান করেছিলেন।
দেবী বর্গভীমার মন্দির এবং তাম্রলিপ্তের ভারহা বৌদ্ধবিহার :
তমলুক বা তাম্রলিপ্ত অঞ্চলে দেবী বর্গভীমাকে অত্যন্ত জাগ্রত এবং অভীষ্টদায়িনী দেবীরূপে অত্যন্ত ভক্তি সহকারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। মানুষের মনের উপর এই তথাকথিত দেবীর এতই প্রভাব যে এর সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য প্রদান করাই অসম্ভব।
বর্তমান আলোচনায় এই দেবী এবং মন্দিরটি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করা প্রয়োজন বলেই মনে হয়। যাইহোক ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে যে, এই মন্দিরটি সম্ভবত হিন্দু মন্দির নয়। বৌদ্ধদের বিহার ছিল। পরবর্তীকালে বৌদ্ধপ্রভাব হ্রাস এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধবিহারটিকে অত্যন্ত সুচতুরভাবে কিংবদন্তির মোড়কে হিন্দুমন্দিরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।
এই মন্দিরটির নির্মাণ সম্পর্কেও কোনো ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য আমাদের হাতে উপস্থিত নেই। অনেকের অভিমত হল মহারাজ তাম্রধ্বজ কর্তৃক এই দেবী এবং মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। (তমলুকের প্রাচীন ও আধুনিক বিবরণ, পৃ. ১৬-১৭)।
ঐতিহাসিক হান্টারসাহেবের মতে, "নতুন রাজা কালু ভূঞা নূতন ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করে পূজারম্ভ করেন, ঐ ঠাকুর বর্গভীমা নামে বিরাজ করছেন।"
ভূরিশ্রেষ্ঠের ইতিহাস লেখক বিধুভূষণ ভট্টাচার্য মহাশয় বলেছেন, "ভূরিশ্রেষ্ঠের ব্রাহ্মণরাজ বংশের অষ্টম পুরুষ রাজা শ্রীকৃষ্ণনারায়ণের ভ্রাতা রাজা শ্রীমন্তনারায়ণ রায় দেবী বর্গভীমার প্রতিষ্ঠা করেন।"
আবার অনেকের মতে ধনপতি সওদাগর এই মন্দির ও দেবী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এখন এই বির্গভীমার মন্দিরের বর্ণনা প্রদান করা একান্তভাবে প্রয়োজন। এই মন্দিরের অবস্থান এবং নির্মাণের কৌশল প্রমাণ করে যে, এইটি কোনো মতেই হিন্দু মন্দির হতে পারে না। বরং মন্দিরটিকে বৌদ্ধবিহারের অংশ বিশেষ মতোই মনে হয়। কারণ মন্দিরটির অভ্যন্তরীণস্থ গঠনশৈলী অবিকল বৌদ্ধ বিহার সদৃশ্য এবং বুদ্ধগয়ার বৌদ্ধমন্দিরের অনুরূপ। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের সম্মুখে প্রধান এবং স্তূপ বিহারের অনুকরণে একটি ক্ষুদ্র বিহার রয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, এইরূপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিহার মন্দিরটির অন্যান্য দিকেও উপস্থিত ছিল। পরে এই অঞ্চল হতে বৌদ্ধভিক্ষু এবং উপাসকদের বিতাড়িত করে তাদের পরিত্যক্ত বিহারটিকে ব্রাহ্মণ্যবাদীগণ করায়ত্ত করে নেয় এবং বিহারটির বেশকিছু অংশের পরিবর্তন সাধন করে হিন্দু মন্দিরের রূপ প্রদান করেছিল।
বর্গভীমার মন্দিরটি প্রকৃত অর্থেই বৌদ্ধবিহার তথা সংঘারাম ছিল তার আরও প্রমাণ রয়েছে। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকায় এটি বুদ্ধমন্দির বা বিহার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্গভীমাদেবী আসলে হল উগ্রতারা মহাযান বৌদ্ধদেবী। সেগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে আলোচনা করব।
১. মূল মন্দিরের চতুর্দিকে অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহ এবং বিহার ছিল বর্তমানে সেগুলির অস্তিত্ব নেই। সম্ভবত হিন্দুরা তাদের মন্দির নির্মাণকার্যে সেই গৃহগুলিকে বিনষ্ট করে তার ইটগুলিকে ব্যবহার করেছিল।
২. বর্তমান মন্দিরের অভ্যন্তরে একটি উঁচু বেদীর উপরে বুদ্ধমূর্তি স্থাপিত ছিল পরে তা সরিয়ে দিয়ে হিন্দুমূর্তি প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল। কারণ এই ধরনের উঁচু বেদী কেবল বৌদ্ধসংঘ বা বৌদ্ধ উপাসনা স্থলেই দেখতে পাওয়া যায়, হিন্দু মন্দিরে নয়।
৩. বর্গভীমা দেবীর মূর্তিটি পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই অনুমান করা যায় যে, মূর্তিটির গঠনশৈলী বৌদ্ধ তন্ত্রযান দেবী উগ্রতারার অনুরূপ। মূর্তিটি একটি প্রস্তর ভাগের সম্মুখে খোদাই করে নির্মিত হয়েছে। এই ধরনের মূর্তি নির্মাণের কৌশলও হিন্দু স্থাপত্যের নিদর্শন নয়।
৪. বর্গভীমা দেবী হিন্দুপীঠের ৫১ পীঠরূপে উল্লেখিত নয়। কারণ চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি মঙ্গলকাব্যে কেবল দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।
জৈনধর্ম এবং তাম্রলিপ্ত :
প্রাচীন তাম্রলিপ্তে জৈনধর্মের অস্তিত্ব সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে বাংলায় জৈন ধর্মের প্রভাব সম্পর্কিত অনেক প্রমাণ রয়েছে।
জৈনগ্রন্থ 'কল্পসূত্র' অনুসারে জানা যায় যে, মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সমসাময়িক জৈন আচার্য ভদ্রবাহুর শিষ্য গোদাস 'গোদাস-গণ' নামক যে জৈন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেছিলেন সেই সম্প্রদায় কালক্রমে ৩টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই সম্প্রদায়গুলি হল যথাক্রমে-
১. তাম্রলিপ্তিক শাখা (তমলুক অঞ্চল)।
২. কোটীবর্ষীয় শাখা (দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত দেওকোট)।
৩. পুণ্ড্রবর্ধনীয় শাখা (মালদহ ও বগুড়া অঞ্চল)।
৪. দাসীকর্বটীয় শাখা (মানভূম অঞ্চল)।
বর্তমান বাংলাদেশের পাহাড়পুরে প্রাপ্ত একটি তাম্রশাসন হতে জানা যায় যে, খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী কিংবা তারও পূর্বে এই অঞ্চলে জৈনদের অস্তিত্ব ছিল। শুয়াং জাঙের বিবরণ হতে যাওয়া যায় যে, সেই সময়ে (খ্রি. ৬২৯ অব্দে) বাংলাদেশে দিগম্বর জৈনের সংখ্যা বেশি ছিল।
তাম্রলিপ্ত অঞ্চল থেকে “ঋষভনাথের বেশ কিছু জৈনমূর্তি পাওয়া গেছে। সম্ভবত তাম্রলিপ্তীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের পূজার আধিক্য ছিল।”
তাম্রলিপ্ত অঞ্চলে বৌদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন :
১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে তাম্রলিপ্ত অঞ্চলের রূপনারায়ণপুর পারের পরিত্যক্ত খাদ থেকে সর্বপ্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। এগুলি ছিল সচ্ছিদ্র তাম্র এবং রৌপ্যমুদ্রা। মুদ্রাগুলিতে পদ্ম, ধর্মচক্র চৈত্য, হস্তী, গুড়া ও সিংহ অঙ্কিত রয়েছে। এই সকল মুদ্রাগুলি বৌদ্ধযুগের (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দী) এছাড়া যে সকল পোড়ামাটির মূর্তি পাওয়া গিয়াছে, তার মধ্যে অন্যতম হল সিদ্ধার্থ গৌতম বা বুদ্ধ জননী মায়াদেবীর মূর্তি, জঞ্জাল, মার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে "পুরাণ" নামক কতকগুলি মুদ্রা তমলুক হতে আবিষ্কৃত হয়। মুদ্রাগুলি তাম্রনির্মিত এবং আকারে চতুষ্কোণ। মুদ্রাগুলিতে বোধিবৃক্ষ, ধর্মচক্র ইত্যাদি অঙ্কিত আছে। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চল হতে কুষানযুগের রৌপ্যমুদ্রা এবং গুপ্তযুগের বেশ কিছু তাম্র এবং রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে।
আচার্য ত্রৈলোক্যনাথ রক্ষিত লিখেছেন। "বাস্তবিকই নদের ভাঙ্গনে ও পুষ্করিন্যাদি খননকালে ১০-১৫ ফুট মৃত্তিকার নিম্নে বহুসংখ্যক কুশ, প্রস্তর নির্মিত ভগ্ন স্তন্ত, বৌদ্ধযুগের সমকালীন মুদ্রা, প্রস্তর এবং ধাতুনির্মিত বুদ্ধ ও তৎসম্পর্কিত নানাবিধ মূর্তি ইত্যাদি যা পাওয়া গিয়েছে, সেগুলি তমলুকের প্রাচীনত্বের বড় প্রমাণ বলেই মনে হয়।" (বৃহৎবঙ্গ, খ্রি. ১১০২)।
তমলুকে আবিষ্কৃত নিদর্শনসমূহ উল্লেখ করতে গিয়ে ঐতিহাসিক হান্টারসাহেব বলেছেন-"তমোলুক যে বৌদ্ধবন্দর ছিল, আজ পর্যন্ত তার নিদর্শন পাওয়া যায়; এবং জনৈক ইউরোপিয়ান কর্মচারী ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে গভর্নমেন্টে রিপোর্ট করেন যে, 'তমোলুক বাস্তবিকই বৌদ্ধবন্দর ও তথায় পূর্বাঞ্চলের বিস্তৃত বাণিজ্য স্থান, এবং অনেক সুন্দর মঠ ছিল।"
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে, মার্চ মাসে পূর্ব সার্কেলের পুরাতত্ত্ব বিভাগ বর্তমান তমলুক শহরের নিকটবর্তী বেশ কিছু অঞ্চলে গবেষণা তথা খনন কার্য চালিয়ে প্রাচীন তাম্রলিপ্ত নগরীর বহুপ্রাচীন সম্পদ উদ্ধার করা সম্ভবপর হয়েছে। সেগুলির মধ্যে রয়েছে :
১. নিওলিথিক যুগের প্রস্তর নির্মিত বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য।
২. মৌর্য, শুঙ্গ, কুযাণ ও গুপ্তযুগের পোড়ামাটির মূর্তি, পুতুল, বাসনপত্র ইত্যাদি।
৩. ঢালাই করা বিভিন্ন ধাতব মুদ্রা, মূল্যবান প্রস্তর নির্মিত গহনা, জীবজন্তুর পাথর এবং মাটির মূর্তি।
তাম্রলিপ্ত অঞ্চল হতে খ্রিস্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীর যেসকল পোড়ামাটির দ্রব্য পাওয়া গিয়েছে, সেগুলির মধ্যে গুপ্ত এবং কুষাণযুগের প্রভাব রয়েছে।
১৩৬০ সনের (বাংলা) শেষদিকে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র সরকার তমলুক ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে খননকার্য চালিয়ে যে সকল বস্তুর সন্ধান পেয়েছিলেন তা অমূল্য।
১. পোড়ামাটির বিভিন্ন মূর্তি।
২. যক্ষিণী মূর্তি-শুঙ্গ যুগ। মূর্তিটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১ম-২য় শতাব্দীতে নির্মিত।
৩. দণ্ডায়মান পুরুষ মূর্তি। ব্রোঞ্জনির্মিত এবং গ্রিক ধাঁচের।
৪. উপবিষ্ট গ্রিক পুরুষ মূর্তি। প্রস্তর নির্মিত। সময়কাল খ্রিস্টীয় ১ম-২য় শতাব্দী।
৫. চতুষ্কোণ মৃৎফলক-মৌর্যযুগ। চিত্রের বিষয়বস্তু বৌদ্ধজাতক। (যুগান্তর, ১০ শ্রাবণ, ১৩৬০ সন, বাংলা)।
তমলুকের আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তুর নিদর্শনগুলি বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটি (কলিকাতা), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ এবং তমলুক স্থিত রাজবাড়িতে সংগৃহীত আছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে ভগ্ন অশোক চক্র, মাটির খেলনা, জীবজন্তু, মৃৎনির্মিত সিংহের ভগ্ন নিম্নদেশ, প্রস্তর ও ব্রোঞ্জনির্মিত বুদ্ধমূর্তি, মিথুন মূর্তি, গুপ্ত ও কুষান যুগের স্বর্ণমুদ্রা, পোড়ামাটির পাত্র, দণ্ডায়মান যামিনী মূর্তি (খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীর)। (দেশ, ১ম জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬২ সন, বাংলা)।
ইতিকথার পরের কথা :
প্রসঙ্গ নাটশাল (তাম্রলিপ্ত) এক অনাস্বাদময় উপহার তাম্রলিপ্তের নাটশাল অঞ্চল একসময় ছিল গহন জঙ্গলাকীর্ণ এবং হিংস্র শ্বাপদকূলে পরিপূর্ণ। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণ উৎপাদকগণ এই অঞ্চল পরিষ্কার করতে উদ্যোগী হলে এক সুবিশাল অঞ্চল জুড়ে প্রাচীন জনপদের সন্ধান মেলে। যদিও এই অঞ্চল সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার হয়েছিল ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তদানীন্তন লেফটেন্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার জে. রবার্টসন এই অঞ্চল সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রদান করলেও বাস্তবিক অর্থে কোনোপ্রকার কার্যসিদ্ধি হয়নি।
১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে মিশনারি ধর্মপ্রচারক উইলিয়াম কেরি এই অঞ্চলটি সম্পর্কে একটি ছবি তুলে ধরেন। তাতে ছিল গেঁওখালির কিছু ঘরবাড়িসহ নদীতীরের পঞ্চরত্ন মন্দির।
যাইহোক, সর্বপ্রথম এই নাটশালকে আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে তুলে আনেন তমলুকের বিশিষ্ট গবেষক প্রশান্তকুমার মণ্ডল। তিনি এই অঞ্চল থেকে পেয়েছিলেন বিভিন্ন পশুর হাড়, মানবদেহের জীবাশ্ম, শিকারসামগ্রী, অস্ত্রশস্ত্র ও প্রসাধন সামগ্রী। 'আজকাল' পত্রিকায় সব্যসাচী সরকার (১৬ মে, ২০০৪) লিখেছিলেন- "এমন একটি আদিম গোষ্ঠী হাজার হাজার বছর পূর্বে এই বাংলার নাটশাল গ্রামে কেন বসতি স্থাপন করেছিল, তা আজও অজানা রয়েছে।" নাটশাল গ্রামে সন্ধান পাওয়া প্রমাণ সাক্ষ্য দেয় তৎকালীন মানবজীবনের সংগ্রামের রূপরেখা।
ড. প্রদ্যোতকুমার মাইতির অভিমত নাটশালে পাওয়া হাড় ও হরিণ শিংয়ের শিল্পসামগ্রীর বয়স ১২ হাজার বছরেরও প্রাচীন। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধ থেকেই এই অঞ্চলের সঙ্গে মিশর, ক্রীট ইত্যাদির ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র ছিল। সর্বোপরি এই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত মাটির তৈরি বিশেষ পাত্র, তাম্র-ব্রোঞ্জ নির্মিত অশোকচক্রের ন্যায় প্রতীক বৌদ্ধযুগেরও সাক্ষ্য বহন করে। তবে তমলুক সংলগ্ন রূপনারায়ণপুর নদীসংলগ্ন নাটশাল, অমৃতেবেড়িয়া ইত্যাদি অঞ্চল থেকে অনেক বৌদ্ধযুগের প্রত্নসামগ্রীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তবে এই অঞ্চলের সিংহভাগ প্রত্নবস্তুই হল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের।
নাটশালে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী যে এই অঞ্চলের একটি প্রাচীন জনপদের ইঙ্গিত প্রদান করে তা একপ্রকার নিশ্চিতরূপেই প্রতীয়মান হয়।
তমলুকের রাজপরিবার এবং ঐতিহ্য-ভূমিকা :
তাম্রলিপ্ত বা তমলুকের রাজপরিবারের ঐতিহ্য অত্যন্ত সুপ্রাচীন এবং গৌরবমণ্ডিত। জাপানের রাজ গ্রন্থাগারে তাম্রলিপ্তের ময়ূর রাজবংশের কথা বারংবার উল্লেখিত হয়েছে। ঐতিহাসিক হান্টারের মতে মহাভারতীয় যুগের বিষ্ণুভক্ত রাজা ময়ূরধ্বজ ছিলেন এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। মহাভারতের দুর্যোধনের সৈন্যতালিকায় তাম্রলিপ্তের সেনাবাহিনীর উল্লেখ মেলে। এপিক বা মহাকাব্য দিয়ে সঠিক কোন ইতিহাস ও সভ্যতা রচিত হতে হয় না হতে পারে না। মুসলমান যুগে আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরী-তেও তমলুক রাজবংশের অনেক ইতিহাস পাওয়া যায়।
রাজ্য ভাঙে এবং গড়ে, তবে তমলুকের প্রথম রাজা ময়ূরধ্বজের সাম্রাজ্য ঠিক কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তা বলা দুষ্কর। সপ্তম শতাব্দীতে শুয়াং জাঙ্ তাম্রলিপ্ত সম্পর্কে লিখেছেন, তাম্রলিপ্তের ব্যাপ্তি ছিল ২০০ মাইল।
বিজয় সিংহ খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে এই তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে সিংহল যাত্রা করেছিলেন। মেগাস্থিনিস এই অঞ্চলে এসেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে। ইংরেজ শাসনের তথ্যপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্রবংশীয় এই রাজপরিবার প্রায় ৫,১০০ বছরের পুরাতন।
তাম্রলিপ্ত অঞ্চল একসময় বৌদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হলে তমলুক রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু বৌদ্ধবিহার ও সংঘারাম গড়ে উঠেছিল। কথিত আছে এই রাজপরিবার ৬৪,০০০ বিঘা জমি হিন্দুমন্দির ও বিহার স্থাপনে দান করেছিলেন। তবে তমলুকের রাজপরিবার প্রকৃত অর্থে বৌদ্ধ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সেই বিষয়ে কোনো উল্লেখ্যনীয় তথ্য মেলে না।
তাম্রলিপ্ত রাজপরিবারের ইতিহাসের প্রাচীন নিদর্শনগুলির অনেকাংশই ভারতীয় মহাফেজখানায় রয়েছে। তবে ব্রিটিশকালে এই রাজপরিবারের বহু মূল্যবান পুঁথি নষ্ট তথা বিলোপ হয়ে যায়। ফলে তমলুকের অনেক কিছুই আজও অন্ধকারে রয়ে গেছে। যে সকল তথ্যগুলি পাওয়া যায় সেগুলির সিংহভাগ অংশই কাল্পনিক এবং অতিকথনপূর্ণ।
তমলুক রাজপরিবার ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হলে ব্রিটিশদের চক্ষুশূল হয়ে পড়ে। তবে ভারত স্বাধীন হলেও স্বাধীন ভারত সরকার এই রাজপরিবারের অবদানকে সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করলেন ফলে ইতিহাসের পাতা হতে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল এক সুপ্রাচীন রাজবংশের ইতিহাস এবং তাদের গৌরবময় অধ্যায়গুলি।
নবম থেকে দ্বাদশ-এই ৪ শতাব্দীতে নির্মিত নানাবিধ ধাতব বৌদ্ধমূর্তি (পালযুগের) তমলুক অঞ্চলের বিভিন্ন পুষ্করিণী হতে পাওয়া গিয়েছে। এগুলির মধ্যে তামলোকিতেশ্বর মহাযান বৌদ্ধ দেবতা অবলোকিতেশ্বর তাম্রলিপ্তিতে তামলোকিতেশ্বর বলে পূজিত হয়েছিল এবং পূজিত হয়ে আসছে। বজ্রপাণি, তারা, উগ্রতারার মূর্তি উল্লেখনীয়। বর্তমানে এই মূর্তিগুলি জিষ্ণুহরি, লক্ষ্মীদেবী, বিষ্ণু ইত্যাদি হিন্দু দেবতায় পরিণত হয়ে তমলুকের বিভিন্ন মন্দিরে বিরাজিত রয়েছে।
তথ্য সূত্র :
১. বাঙলার ইতিহাস, আদিপর্ব, নীহার রঞ্জন রায়।
২. বৃহত্তর তাম্রলিপ্তের ইতিহাস, যুধিষ্ঠির জানা (মালিবুড়ো)।
৩. প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস, এ. কে. শাহনাওয়াজ।
৪. প্রাচীন বাঙলার জনপদ ও জনগোষ্ঠী, কাবেদুল ইসলাম।
৫. বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম এবং প্রাচীন বৌদ্ধ সমাজ, শ্রীশান্তিকুসুম গুপ্ত (সংশোধিত সংস্করণ সুমনপাল ভিক্ষু)।
৬. বাংলায় বৌদ্ধধর্ম, ড. নলিনীনাথ দাশগুপ্ত।
৭. মেদিনীপুর: ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিবর্তন, ১ম খণ্ড, বিনোদশঙ্কর দাস ও প্রণব রায়।
৮. বাঙলাদেশের ইতিহাস, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ১ম খণ্ড।
৯. মালীবুড়ো, তাম্রলিপ্তের অজ্ঞাত প্রত্নস্থল এবং বিতর্কিত প্রত্নবস্তু, সূর্যদেশ, ৩ অক্টোবর ২০১৩ পৃ.- ১১।
১০. মালীবুড়ো, মলঙ্গী বিদ্রোহের ইতিহাস - নিমকি মালের দিনরাত, বৃন্দবাক, ১৯৯৭, পৃ.- ৪১।
No comments:
Post a Comment