বৌদ্ধ সাহিত্য দুটি ধারায় বিদ্যমান—থেরবাদ বা হীনযান সাহিত্য ও মহাযান সাহিত্য। থেরবাদ বৌদ্ধ সাহিত্য ও ধর্মদর্শন শাস্ত্র তথা প্রাচীন থেরবাদী সম্প্রদায়ের মূল পালি সাহিত্যে যেমন জাতক ও অপদান কাহিনি আছে তেমনি সর্বাস্তিবাদী সম্প্রদায়ের তথা মহাযান ধর্মদর্শন শাস্ত্রেও সমান্তরালভাবে বৃহদাকার আয়তনে সংস্কৃত অবদান সাহিত্য পরিলক্ষিত হয়। পালি অপদান ও সংস্কৃত অবদান সাহিত্য প্রায় সমার্থক। জাতক কাহিনির মতো অবদান কাহিনিগুলো একই রীতিতে রচিত।
অপদান খুদ্দকনিকায়ের ষোড়শতম গ্রন্থ হলেও এটি একটি বিশাল গ্রন্থ। অপদান গ্রন্থে সর্বসাকুল্যে ৫৫৯ শ্রাবক, ৪০ জন শ্রাবিকার জীবনবৃত্তান্ত উপলব্ধ হয়। অপদানকে চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়—পচ্চেক বুদ্ধাপদান, বুদ্ধাপদান ও থের অপাদান ও থেরী অপদান। থের অপদানে ৫৫৯ জন স্থবিরের জীবন কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
থের-থেরীদের জীবনাচরণ ও জীবনাদর্শন সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে ‘অপদান’ এর পাশাপাশি বিমলাচরণ লাহা রচিত 'A history of Pali Literature' ও M. H. Bode রচিত 'Legends of Rastrapala in the Pali Apadana and Buddhaghosa's commentary' গ্রন্থদ্বয় অধ্যয়ন করা উচিত।
পালি পিটক সাহিত্যে জাতক ও অপদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। ঠিক তদ্রুপ বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্যে অবদান সাহিত্যও সমান তাৎপর্যবহ। অপদান বা অবদান শব্দের অর্থ প্রশংসনীয় ও প্রশস্তিমূলক কীর্তিগাথা। বিষয়বস্তুর নিরিখে অপদান ও জাতক পালি ও বৌদ্ধ সাহিত্য সম্ভারে ঐতিহাসিক গ্রন্থরাজি।
পালি অপদান সাহিত্য পালিভাষায় পদ্যাকারে, অন্যদিকে সংস্কৃত অবদান সাহিত্য গদ্যে রচিত হলেও স্থানে স্থানে ছন্দোবদ্ধশ্লোক পরিদৃশ্যমান। অপদান সাহিত্য মূলকথা গাথায় রচিত হলেও গল্পের ছলে পরিবেশিত হয়েছে। পাঠক পাঠ করলে মনে হবে যেন গাথাগুলো কেউ গল্পের মতো করে পড়ে শোনাচ্ছেন। এখানে গল্পের আকারে পরিবেশনের অন্যতম কারণ হলো সাধারণ মানুষের কাছে যেন বোধগম্য ও সহজবোধ্য করে তোলা এবং মানুষ যাতে সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়। নির্বাণ, অনাত্ম, বা শূন্যতার তত্ত্বের মতো দুরূহ তত্ত্ব অপদানের আলোচ্য বিষয় নয়। অবদানের তুলনায় অপদানে গাথা গল্পগুলো সরল ও ক্ষুদ্র, পৌরাণিক জটিল ও দীর্ঘ নয়।
বুদ্ধের প্রতি অপার শ্রদ্ধা ও অনুরাগজনিত নানা সৎকর্মের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের অন্তরে বিশ্বাস ও ভক্তির উদ্রেকভাব উৎপন্ন করাই অপদানের উদ্দেশ্য।
অপদানকে চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়—পচ্চেক বুদ্ধাপদান, বুদ্ধাপদান ও থের অপাদান ও থেরী অপদান । শেষ দুটি অপদানে যথাক্রমে ৫৫৯ জন ভিক্ষু ও ৪০জন ভিক্ষুণী অপদান রয়েছে। এটি লক্ষ্য করা যায় যে অন্যান্য জায়গায় প্রাপ্ত অনেকগুলি ভিক্ষু কাহিনি অপদান গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। ধম্মপূজকের কাহিনি ও নাগিত স্হবির কাহিনি এই দুটি উদাহরণ।
থের অপাদান ও থেরী অপদান দুটিতে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী এই তালিকাটির দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ১। কিছু কিছু কাহিনি যদিও অভিন্ন নামযুক্ত বিষয়বস্তুর দিক থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, ২। এমন অনেকগুলি কাহিনি রয়েছে যেগুলি থেরগাথা ও থেরীগাথার কাহিনির সঙ্গে তুলনীয়।প্রথমটির উদাহরণ হল চিত্তপূজক সংখ্যা ২৭৭, ২৯১, ৩৭৭, ৪৬২; মঞ্চদায়ক সংখ্যা ৩৫৮ ও ৪৩০; বুদ্ধসঞ্ঞক সংখ্যা ৩০৯, ৪৮২; এবং দ্বিতীয়টির উদাহরণ হল সারিপুত্ত, অপদান ১এবং থেরগাথা ২৫৯; মহামোগ্গল্লান ২ ও ২৬৩; মহাকাস্যপ ৩ ও ২৬১; উপালি ৬ ও ১৮০; আনন্দ ১০ ও ২৬০; রাহুল ১৬ ও ১৯৩; সিবলি ৫৪৩ ও ৬০; কুমারকাস্যপ ৫৩৫ ও ১৬১; নন্দিকাস্যপ ৫৫২ ও ২০৩; বক্কলি ৫৩২ ও ২০৫; এই সংখ্যা নিরূপণ কাহিনিগুলির কয়েকটি দ্বিতীয় ও তৃতীয় সঙ্গীতিতে মূল রচনার সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে।
বুদ্ধ তথা তাঁর শ্রাবক শ্রাবিকাদের জীবনাচরণ ও জীবনচর্যা ভাষান্তরিত করা সত্যি দূরূহ কার্য। বিশেষত পরবর্তীতে পালি সাহিত্য সংকলক ও অর্থকথাকারগণের অপরিমিত পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানভাণ্ডারের কুঞ্চিকা খোলার চেষ্টা মানে পঙ্গুর গিরি লঙ্ঘনের মতো স্পর্ধা।
অলং ইতি বিত্থারেন।
No comments:
Post a Comment