ভিক্ষু সুমনপাল
প্রাককথন : ভারতবর্ষের শিক্ষা ইতিহাসের প্রকৃত প্রামাণ্য চালচিত্রের একান্ত অভাব বোধ করি আমাদের দেশে রয়ে গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে এক একটি যুগের প্রতিচ্ছবি উপস্থিত থাকলেও তার ইতিহাস রয়েছে অতিকথনের প্রাচুর্যতা। তবে তার মধ্যে শিখন চিন্তার মূল্যায়ন একেবারে যে অনুপস্থিত তাও বলা চলে না। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, সামগ্রিকভাবে ভারতের শিক্ষা ইতিহাসের একটা মাইলস্টোন সন্ধান করতে হলে আমাদের অনেকটাই পথ অতিক্রম করতে হবে। নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এবং জটিল। কারণ এই প্রসঙ্গে ভারতবর্ষের ধর্মচিন্তা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামজিক পরিকাঠামোর বিষয়টিকে গভীরভাবে অধ্যায়ন এবং অনুশীলন একান্তভাবে আবশ্যক। হয়তো এই অনুশীলনের মধ্যেই উঠে আসতে পারে ভারতের শিক্ষণ ইতিহাসের কালখণ্ড, বিবর্তন চিত্র অর্থ বা শিক্ষণচিন্তা ও শিক্ষা পরিকল্পনার রূপরেখা।
প্রসঙ্গত আমাদের স্মরণে রাখতে হবে যে, ভারতবর্ষ এমন একটি ভূখণ্ড, যেখানে অবৈচিত্র্যের রঙ পরিপূর্ণভাবে সুসজ্জিত। অথচ তার অন্তঃপ্রবাহে রয়েছে দ্বিমুখী সংস্কৃতির আভূত এক প্রতিমূর্তি। পৃথিবীর কালচক্রে ভারতের এই অন্তঃবাহী ধারটি সত্যই আভূত অনুসম এবং সুন্দর।
তবে একথা সত্য যে, ভারতবর্ষের আদি ইতিহাস ঠিক কোন সময়কাল হতে শুরু হয়েছিল তার প্রামাণ্য বিবরণ আমরা আজও পাইনি। ফলে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব নিয়ে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতানৈক্য দেখতে পাওয়া যায়। তবুও ইতিহাসের প্রকৃত উপাদান সংগ্রহ করে ভারতের মানবসমাজ সম্পর্কে আদিযুগের একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা বিজ্ঞানসম্মতভাবে নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন পণ্ডিতরা। কিন্তু সেখানেও এসে উপস্থিত হয়েছে ধর্মমোহ। ফলে প্রশ্নচিহ্নের ইতিহাসের উপর আরো কিছু প্রশ্নচিহ্ন এসে উপস্থিত হয়েছে। কেননা ভারতবর্ষের আদিযুগের যা কিছু চিত্র আমরা পেয়েছি তার মধ্যে সিংহভাগ অংশই জুড়ে রয়েছে পৌরাণিক অতিকথন এবং তা নির্ণয় হয়েছিলো ধর্মচেতনার মাধ্যমে। এই চেতনা ভারতবর্ষের সমাজ সংস্কৃতির সর্বস্তরেই প্রবাহমান ছিল এবং বর্তমানেও আছে। আর তার পিছনে কাজ করছে একটাই সারগর্ভ নীতি, তাঁর নাম হল ধর্মচেতনা। ভারতবর্ষের সিংহভাগ জনগণের মনে তাই ধর্মচেতনা এতটাই প্রবল যে, সেখানে প্রকৃত মুক্ত চিন্তার অভাব বারবার প্রকট হয়েছে।
সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার একটি বিশেষ স্তর অতিক্রম করার পর আমরা বাহিত হয়ে এসেছি তথাকথিত আর্যসভ্যতা বা বৈদিকসভ্যতায়। অতএন জৈন, বৌদ্ধ এবং মধ্যযুগের ইতিহাস ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করার পর আমরা উপস্থিত হই পাশ্চাত্য সভ্যতার আঙ্গিকময় গতিপ্রবাহে। এই পর্বে আমরা দেখতে পাই, ভারতের ইতিহাসে ক্রিয়াশীলময় কয়েকটি বিশেষ লক্ষণ। একদিকে উঠে এসেছে পাশ্চাত্য সংস্পর্শে পাশ্চাত্যের জ্ঞানদীপ্ততার প্রতি ক্রমাগত আকর্ষণ, অপরদিকে পাশ্চাত্যসভ্যতার আলোকে উদ্দীপিত হয়ে নিজেদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে পুনঃ নতুনভাবে গ্রহণের প্রবণতা। শিক্ষার বাস্তব ব্যবস্থাপনায় এই মানসিকতাগুলির নানা অভিব্যক্তি ঘটলেও তার পরিণতি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আশানুরূপ হয়নি। বিশেষ করে কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে, বোধকরি ইতিহাসের বৌদ্ধিক শিক্ষাকে কোনভাবেই আমরা গ্রহণ করতে সক্ষম হইনি, ফলে জাতির মানসিকতায় আত্নীকরণের কোনভাবেই উপস্থিত হয়ে ওঠেনি। কারণ এখানেও উপস্থিত হয়েছে ধর্মমোহ। যার যের চলে এসেছে স্বীয় অর্থে স্বাধীনতাত্তোর যুগে অর্থাৎ এক অর্থে বলা যায় ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় এক অদ্ভূত আঁধারময় চালচিত্র পরিলক্ষিত হয়। এর কারণগুলিকে বিশ্লেষণ করলে অনেকগুলি প্রশ্নচিহ্ন উঠে আসে।
এই প্রশ্নচিহ্ন গুলিকে ক্রমান্বয়ে পর্যালোচনা করার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, ভারত রাষ্ট্রের পরিকাঠামোয় আধা সামন্তবাদী এবং আধা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং ধর্মমোহতাই মূল কারণ।
তবে একটি সংক্ষিপ্ত অথচ নিটোল পরিসরে ভারতের শিক্ষা ইতিহাসের মূল প্রবাহমান ধারাগুলিকে চিহ্নিত করা এই সময়ে একান্ত ভাবে প্রয়োজন এবং এই কাজ নিঃসন্দেহভাবে অত্যন্ত কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারতীয় শিক্ষা ইতিহাসের যে ইতিবাচক দিকগুলি একথা সয়ে এই সভ্যতার বুকে প্রবাহমান ছিল তার কথানির্ভর এবং যুক্তিপূর্ণ দিকগুলিকে নিয়েই আমাদের এই প্রতিকোণটিকে পাঠককূলের প্রতি তুলে ধরতে হবে। কারণ ইতিহাস বলে কথা।
প্রাচীন ভারতবর্ষের শিক্ষাচিন্তার আঙ্গিক : প্রাচীন ভারতের জনগণের বিকাশ এবং জীবনচর্চার প্রশ্নে প্রকৃত অর্থে ধর্মচেতনা বা আধ্যাত্মময় চেতনা কতকখানি প্রাসঙ্গিক তথা অপ্রাসঙ্গিক ছিল তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা কোনভাবেই সম্ভবপর নয়। কারণ ভারতীয় নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় (শিশুসভ্যতা) সেই অর্থে ধর্মচেতনা ছিল অনুপস্থিত। তবে ঐশ্বরিক ধর্মচেতনার পরিবর্তে জ্ঞানদীপ্ত মানবিক মূল্যবোধযুক্ত ধর্মচেতনা উপস্থিত থাকার ফলে সিন্ধুসভ্যতা আধুনিক এবং উন্নতসভ্যতায় পরিণত হয়েছিল। তবে ঠিক কোন্ কারণের ফলে এই সভ্যতার বিনাশ সাধন হয়েছিল তা এখনও সঠিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
তবে বর্তমান সময়কালে আমরা যে ধরণের সমষ্টিগত চেতনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছি গণতন্ত্রের মাধ্যমে, তার সুস্পষ্ট সামাজিক অবস্থান প্রাচীন ভারতে লক্ষ্য করা যায় স্মরণাতীত
কাল থেকেই, যা বিশ্বসভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসে প্রকৃত অর্থে বিস্ময়কর।
সুতরাং সেই অর্থে অর্থাৎ সেই সময়কালে প্রাচীন ভারতবর্ষ এমন একটি দেশ ছিল যেখানে তার রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক,
শিক্ষাতান্ত্রিক ইত্যাদি সর্বপ্রকার জীবনচর্চার
ক্ষেত্রে একটা বিরাট রকমের আদর্শগত ব্যাপ্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই বৈশিষ্ট্যকে আমরা বলতে পারি মানবিক মূল্যবোধের
পরিমণ্ডল।
আধুনিক গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতায় যেখানে ব্যক্তিভাবনা এবং সমাজভাবনাকে পৃথক সত্তার আঙ্গিকে দেখা হয়, সেক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতের গণতান্ত্রিকতা ছিল অত্যন্ত উন্নতমানের। কেননা, যেখানে ব্যক্তিত্ববোধ এবং জৈবিক ব্যক্তিত্ব সমষ্টিগতভাবে মানবীয় চেতনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। যার কারণে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছিল আদর্শগত সুশৃঙ্খল এক সমাজব্যবস্থা। শিক্ষাচিন্তা বলতে প্রাচীনকালে যা বোঝাতো তার নিগুঢ় অর্থ হলো আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করা। জীবনের পরম উৎকর্ষতা লাভের মূল কথা ছিল বন্ধন মুক্তি। জীবন উপলব্ধি ও স্বার্থকতার মধ্যে দিয়ে আরও গভীরতম ও সুদৃঢ়ময় প্রসারনায় ছিল তার গন্তব্যস্থল। এই মহান লক্ষ্য অর্জনের প্রশ্নে তৎকালীন দার্শনিকগণ তুলে ধরেছিলেন তাদের মতাদর্শগত সুবিপুল সাহিত্য সম্ভার এবং সুশৃঙ্খলময় জীবনবোধের প্রতিষ্ঠা। এই জীবনবোধ গড়ে উঠেছিল এমন সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ প্রাচীন ভারতের আদি শিখন চিন্তনের অভ্যন্তরে আমরা যে শ্রমণ চেতনার বীজ পাই, তার উদার বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণতায় ছিল এক সুমহান বিরাটত্বের পরিকল্পনা। জীবনবোধের প্রশ্নে এমন শিক্ষার মূল অর্থ ছিল আত্মিক এবং মানবিক জ্ঞানার্জন, কিন্তু এই জ্ঞানার্জন, কখনও সংকীর্ণ অর্থে জ্ঞানার্জন নয়। তা ছিল অনেক বেশি পরিশীলিত, উদার, সুবিশাল এবং মহৎ পরিকল্পনা রসায়নের বাস্তব পথনির্দেশের দিকচিহ্ন।
সিন্ধুসভ্যতার পতনের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যমণ্ডিত শ্রমণ সংস্কৃতি কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং এর পরিবর্তে উত্থান ঘটে বৈদিক সংস্কৃতির। এই সংস্কৃতির মূল সূত্র ছিল ইহলোক এবং পরলোক। পরবর্তী সময়ে এই তত্ত্বের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল দেবত্ববাদের অলৌকিকময় কল্পনা। আর এই দেবত্ববাদের কল্পনা ক্রমশই ভারতীয় মুক্তচিন্তার শিক্ষায় সংযুক্ত হয়ে পরিণত হল এক আনন্দহীন অপূর্ণতার। যার অবাস্তবময় পটভূমি রচনা করেছিল বৈদিক শিখন।
বৈদিক শিক্ষার অভ্যন্তরে মানবিক মুক্তির পরিবর্তে এমন এক অসাধারণ কল্পনার বুনন সৃষ্টি করা হয়েছিল যা ছিল মূলতঃ গোলকধাঁধার জিনিষ বা অবাস্তব জিনিষ। আসলে সেখানে মনকে এমনভাবে অ- সৃষ্টিশীল করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেখানে বুদ্ধিদীপ্ত সজ্ঞানতার পরিবর্তে অজ্ঞানতাই হয়েছিল মূখ্য। অর্থাৎ বৈদিক ঋষিরা যে শিক্ষার পথনির্দেশ করেছিলেন তা ছিল শুধুমাত্র অ-মস্তিষ্কচর্চার এক আভূত চিন্তা।
মানব ব্যক্তিত্বকে বিশ্বজনীন
চেতনার গভীর মর্মমূলে প্রোথিত করে তার সত্তার সকল দিকগুলি উন্মুক্ত বাসাতে সুরভিত ও আভাসিত করে তোলার এক অপূর্ব জীবন সমন্বিত শিক্ষার যে আদর্শ শ্রমণ সংস্কৃতি স্থাপন করেছিল, তার পরিবর্তে ভারতের ভূমিতে প্রোথিত হল এক অলীক সত্ত্বার প্রতি আত্মসম্পূরণের অ-বোধময় মাতলামি। যেখানে মনের মৌলিক সৃষ্টিশীল
শক্তি হয়ে উঠল অ-ক্রিয়াশীল এবং আত্মসমর্পণবাদী।
বৈদিক সভ্যতার কাল নির্ণয় প্রসঙ্গঃ একটি আলোচনা : ভারতবর্ষ অতীতকাল থেকেই এমন একটি বিশাল আয়তনের দেশ যার ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে তার এক অদ্ভূত ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের দ্বারা। বিভিন্ন পণ্ডিত এবং বৈজ্ঞানিকদের মননশীল যুক্তি অনুধাবন করলে উপলব্ধি করা যায় যে, ভারতীয় সভ্যতা অনেক পুরাতন দিনেই ঐতিহাসিক স্মৃতি বহন করে এসেছে নানাভাবে।
পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে, প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার কাল অন্তত খ্রিষ্টের জন্মের তিন হাজার বছরের পূর্বের। সুতরাং নৃবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় মানবজাতির বস্তুগত ব্যবহারিক প্রযুক্তি বা প্রকৃতিগত সংস্কৃতির উদ্ভব এবং বিকাশ সাধন হয়েছে আরো অনেককাল পূর্বেই এবং তার সংস্কৃতিগত সাহিত্যগত তথা মননশীলগত কর্মপদ্ধতিও শুরু হয়েছিল অনেককাল পূর্বেই। প্রাক্-ঐতিহাসিক যুগের প্রমাণ বলতে যা বোঝায় তা হল নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং পুঁথিগত, লোকগাথা ইত্যাদি। এই সকল প্রমাণাদি হতে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রায় দশ হাজার বছরের পুরাতন।
তথাকথিত বৈদিক সভ্যতার বিকাশ সাধনের পূর্বেও এই ভূখণ্ডে সিন্ধু সভ্যতা ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর
সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। অনেকে মনে করেন ১৪০০-১৫০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে।
আবার অনেকের মতে এই সভ্যতার পূর্ণবিকাশ
সম্ভব হয়েছিল ১২০০-৯০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে।
তবে বৈদিক সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কিত সঠিকতথ্য আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নেই। ফলে এই সভ্যতার কালনির্ণয়
করা সম্ভবপর নয়।
সিন্ধু সভ্যতার যে ধরণের নাগরিক সংস্কৃতির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, তার দ্বারা এই সত্য উপনীত হওয়া যায় যে, এখানে বস্তুগত সংস্কৃতি ও গঠনগত সংস্কৃতির সুষম একটি উৎকর্ষ মিশরীয় ও সুমেরীয় সভ্যতার বঙ্গ পূর্বেই জন্মলাভ করেছিল। রেভারেণ্ড হোরাসের ধারণা, এই সভ্যতার আদি জনক দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী। কারণ উত্তর ভারতে আর্যগণের প্রত্যক্ষ প্রভাব এসেছিল অনেক পরে।
স্যার জন মার্শালের
ধারণা, বৈদিক সভ্যতার জন্মকাল হল খ্রিষ্ট পূর্ব ৩২৫০ বছর। তাঁর মতে, সিন্ধু সভ্যতার জন্মকাল খ্রিষ্ট পূর্ব ৩২৫০ বছর। সুতরাং সিন্ধু এবং বৈদিক সভ্যতা সম্পূর্ণ অর্থে পৃথক দুটি সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতা ছিল উন্নত নগরকেন্দ্রিক, বৈদিক সভ্যতা ছিল গ্রামীণ। সিন্ধু সভ্যতায় লৌহের ব্যবহার অনুপস্থিত
( তাম্র এবং ব্রোঞ্জ),
বৈদিক সভ্যতায় দেখা যায় লৌহের ব্যবহার। সর্বোপরি সিন্ধুলিপি
এবং বৈদিক লিপির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। এই সকল কারণে অনেক পণ্ডিত মনে করেন, বৈদিক সভ্যতার উদ্ভব তথা জন্ম সিন্ধু সভ্যতার অনেক পরে। তবে সিন্ধু সভ্যতা বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে তার প্রভাব বৈদিক সভ্যতায় দেখতে পাওয়া যায়।
ম্যাক্সমুলার তাঁর 'অরিজিন অ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট অফ্ রিলিজিয়ন' গ্রন্থে পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন গ্রন্থ রূপে 'বেদ' কে চিহ্নিত করেছেন। তবে ম্যাক্সমূলার তাঁর এই দাবীর পিছনে কোন সুনির্দিষ্ট যুক্তি স্থাপন করতে পারেননি। রুডলফ্ স্টেনারের ধারণা, ভারতের প্রাচীন প্রজ্ঞাধর্মী সভ্যতার জন্মকাল- ঋগবেদ রচনারও শত শত শতাব্দীকাল পূর্বেই। কারণ বস্তুগত উন্নতির প্রশ্নে সিন্ধু সভ্যতার যে নিদর্শন চোখে পড়ে তাতে উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না যে, মিশর বা অ্যামিরীয় সভ্যতার ন্যায় ভারতীয় সভ্যতা ও জ্ঞান- বিজ্ঞান, শিক্ষা - সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিগত প্রশ্নে উন্নত ছিল। সর্বোপরি তার প্রস্তুতিকাল ছিল সূদুর অতীতের অনেক গভীরেই।
ম্যাকডোনাল্ড বলেছিলেন, ঋগবেদের প্রস্তুতিপর্বের সময়কাল হল খ্রিষ্ট পূর্ব ৭০০ বছর। পরবর্তী সময় শ্রুতির মাধ্যমে সেই সৃষ্টিশীলতার গ্রন্থিকরণ,
শ্রেণীবিন্যাস, সংরক্ষণ ও সমালোচনার
পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। বৈদিক শিক্ষার মূল কথা ছিল ঈশ্বরতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা।
অর্থাৎ মনুষ্যজীবন
পরিকল্পনার বাইরে এমন এক জগতের পরিকল্পনা
উদ্ভাসিত হল, যার মূল নিয়ন্ত্রক ছিল দেবতা বা দেবী। এই দেবতা বা দেবীর মনুষ্যজীবনের নিয়ন্ত্রক এবং তার পাপপুণ্যের বিচারক। ফলে এই অদৃশ্য বিচারককে তুষ্ট করার নিরিখে সৃষ্টি হল মন্ত্র পাঠ, যাগ- যজ্ঞ, আচার- নিয়ম এবং দিনক্ষণ। মরিস মেটারলিভক এই সকল বিষয়ের একত্রিভূত রূপকেই বৈদিক শিক্ষার মূল যোগান রূপে চিহ্নিত করেছেন। তিনি আরোও বলেছেন যে, একটি পশ্চাৎপদ গ্রামভিত্তিক সভ্যতার মহাবিশ্বের রহস্যতন্ত্র
এবং প্রাকৃতিক
পরিবর্তন গুলিকে অনুশীলন করা ছিল অত্যন্ত দুস্কর এবং সেই কারণেই হয়তো সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই বেদভিত্তিক
তত্ত্বের জন্ম হয়েছিল।
ভারতে ঈশ্বরভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রশ্নে আর্যদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা চলে না। তবে শিক্ষার অনুশীলনে ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক পরিবেশও যথেষ্ট সহয়তা করেছিল। সর্বোপরি সপ্তসিন্ধু অঞ্চলটি ছিল উর্বর। প্রথমত পর্যাপ্ত খাদ্যশষ্য অনায়াসে পাওয়ার ফলে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের কখনও জীবিকা অর্জনের জন্য অধিকমাত্রায় পরিশ্রম করতে হত না। দ্বিতীয়ত প্রাকৃতিক পরিবেষ্টনীর বিশিষ্টতায় এই অঞ্চল বাহিরের প্রভাব হতে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ছিল। সুতরাং সঙ্গত কারণে আর্যগণ ভারতবর্ষে উপস্থিত হয়ে অনেকটাই আত্মসমহিত হয়ে পড়েছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। আর্যধর্মে প্রকৃতি পূজার সূচনা এখানেই হয়েছিল। আর্যগোষ্টিভুক্ত পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক এবং পরিবারের শিক্ষার ভার ছিল পরিবারের কর্তার উপরে। গোষ্ঠী সংস্কৃতির বাহক ছিলেন পুরোহিত বা শিক্ষক। তিনি গোষ্ঠীর মঙ্গলের জন্য পূজা ইত্যাদি সম্পাদন করতেন এবং গোষ্ঠী শৌর্য বীর্যের কাহিনী প্রচার করে সকলকে উৎসাহিত করতেন। গোষ্ঠীর ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির ধারক বাহক ছিলেন বলে অনেক সময় পুরোহিত বা শিক্ষকদের অন্ধ বা মূক-বধির করে দেওয়া হত (বৈদিক বা বৌদ্ধ শিক্ষণ,পৃ. ৭) সম্ভবত প্রথমদিকে আর্যগোষ্ঠীগুলিতে দলপতির প্রভাব ছিল।
চতুরাশ্রম ছিল আর্য সমাজের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রথার মধ্যে অন্যতম। এই প্রথার মাধ্যমে আর্যরা তাদের সমগ্র জীবনকে বিভক্ত করেছিল। ব্রহ্মচর্যাশ্রম অধ্যয়নের কাল। গার্হস্থ্যাশ্রম ছিল গৃহী হয়ে সংসার যাত্রা নির্বাহের সময়। বাণপ্রস্থাশ্রম সংসার পরিত্যাগ করে নির্জনে ঈশ্বর চিন্তার সময় যাপন, 'যতি' বা সন্ন্যাস ছিল 'মোক্ষ' বা মুক্তি কামনায় অবশিষ্ট দিন যাপন। তবে এই ক্ষেত্রে বৈশ্য, শূদ্র এবং নারীগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
গুরুগৃহে শিক্ষার সূত্রপাত হত ব্রহ্মচর্যাশ্রমের মাধ্যমে। গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ,
যতি বা সন্ন্যাস ইত্যাদি পরবর্তী সোপানগুলিতে
আরও গভীরভাবে এর অনুশীলন চলত।
আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি যে বৈদিক শিক্ষণ ব্যবস্থায় ধর্মের প্রভাব সর্বত্রই বিদ্যমান ছিল। আর্য সন্তানের পক্ষে ব্রহ্মচর্য গ্রহণের মূল লক্ষ্য ছিল ঈশ্বরচিন্তামূলক ধর্মীয় জীবনের প্রস্তুতি। গুরুরা আচার্যের আধ্যাত্নিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রশ্নে আর্য পুত্র সন্তানকে 'দ্বিজ' হতে হত। উপনয়নের দ্বারা এই 'দ্বিজত্ব' লাভ সম্ভব ছিল। অতঃপর ব্রহ্মচারীর শিক্ষা এবং তৎসঙ্গে ধর্মীয় জীবন সংগঠনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আচার্যের উপরেই প্রদত্ত হত। দ্বিজত্ব লাভের পর সন্তানের প্রতি পিতামাতার কোন কর্তব্যই থাকত না।
ব্রহ্মচারী শিক্ষার্থীকে গুরুগৃহে অবশ্য পালনীয় বেশ কিছু অনুষ্ঠানে যোগদান করতে হত। এই অনুষ্ঠানগুলি ছিল এক একটি ধর্মীয় অনুজ্ঞা।
'পরিদান' অনুষ্ঠানে ব্রহ্মচারীর
পিতামাতা তার ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের জন্য তাঁকে আচার্যের হাতে প্রদান করতেন।
আদি বৌদ্ধিক শিক্ষার পটভূমি : হিন্দু আাচার্য তথা ঋষিকুলের মনোজগতে বেদ প্রতিভাত হয়েছিল। বৈদিক সূত্রের বর্ণনানুসারে জানা যায় যে, ঋক্বেদ (ঋগ্বেদ) আর্যগণের সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বসবাসকালে রচিত হয়েছিল। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের মতে, ঋক্ বেদ ১৫০০-৭০০ খ্রীস্টপূর্ব অব্দের প্রাচীন নয়।
ঋক্বেদে মোট সূত্রের সংখ্যা ১০২৮। এর মধ্যে একশোটি সূত্র পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছে বলে সেগুলিকে 'বালখিল্য'
বলা হয়। সমগ্র ঋক্বেদ ১০টি মণ্ডলে বিভক্ত। এক একটি ঋষি বা ঋষিবংশের রচনা এক-একটি মণ্ডলে সংগৃহীত হয়েছে। কেবল প্রথম দশম মণ্ডলে বহু ঋষির রচনা একত্রে স্থান পেয়েছে।
আদি বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় বেদ বিদ্যা অর্জনের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হত। পরাবিদ্যা
লাভই ছিল বেদ বিদ্যালাভের
চরম লক্ষ্য। তবে পরাবিদ্যা
লাভে সকলে সমর্থ হতেন না বলে মন্ত্রবিদ্যা অর্জনে ব্রতী হতেন। বেদ মন্ত্র উচ্চারণই সে যুগে অধিকতর কাম্য ছিল।
অনেক শত বৎসর ব্যাপী মৌখিক আকারেই সংরক্ষিত ছিল বলে জানা যায় এবং কালক্রমে তা লিপিবদ্ধ হয়ে ভারতীয় জনগণের একটি বিশেষ ধর্মীয় শ্রেণির মূল ধর্মগ্রন্থে পরিণত হয়েছে।
বৈদিক শিক্ষা ব্যবস্থায়
বলতে ঋষিগৃহকেই
বোঝানো হয়েছে। ঋষিদের উপলব্ধিজাত
সম্পদ শ্রুতর্ষি
বা 'অবরগণ' সযত্নে রক্ষা করতেন এবং অতঃপর অন্যান্য যোগ্য ব্যক্তিদের
দান করতেন। এই সম্পদ লাভ করার অভিপ্রায়ে অন্যান্য উচ্চকুলজাত ব্যক্তিরা
ঋষিকুলের সমীপে উপস্থিত হয়ে বেদবিদ্যা অর্জন করতেন ও তাদের সমকক্ষ হওয়ার প্রচেষ্টা
করতেন। যোগ্যতম ছাত্রগণ দার্শনিকদের
ন্যায় বেদবিদ্যার
প্রচার করতেন। ফলে বেদবিদ্যা
সেই সময় বৈদিক সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরিণত হয়েছিল।
সংহিতার মন্ত্র বা স্ত্রোত্র সমূহকে গ্রহণ করে বৈদিক পূজা পদ্ধতি বিকাশ লাভ করতে থাকে। পূজা পদ্ধতির উপর অধিকতর গুরুত্ব অর্পিত হওয়ার ফলে প্রত্যেকটি সংহিতায় যজ্ঞ ইত্যাদির কথা এবং মন্ত্র সমূহের ব্যাখ্যা সমন্বিত একটি গদ্যাংশ সংযোজিত হয়। এটিই 'ব্রাহ্মণ' নামে পরিগণিত। সাধারণতঃ 'বিধি' এবং 'অর্থবাদ' হল ব্রাহ্মণের বিষয়। 'বিধি' এবং ' অর্থবাদ' এর প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, যজ্ঞশেষে ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা স্বরূপ সুবর্ণ (স্বর্ণ) এবং রজত (রৌপ্য) দানের বিধি প্রথমদিকে প্রচলিত না থাকলেও সম্পূর্ণ হতো না।
ঋত্বিক বা পুরোহিতদের নেতৃত্বে শির করেছিল, তখন হতে যজুঃ ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে।বিভিন্ন সংযুক্ত হতে থাকার ফলে বৈদিক সাহিত্যের ক্রমশই দীর্ঘায়িত হয়ে পড়ে এবং এই সময় হতেই ব্রাহ্মণগণের অনুকূলে দৃঢ় মত প্রতিষ্ঠা ও ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাকে বজায় রাখার প্রশ্নে এক নতুন সাহিত্যের সৃষ্টি হল, যা 'সূত্র ' সাহিত্য নামে অভিহিত।
সূত্র সাহিত্যের কয়েকটি বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করলে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার পাঠ পরিকল্পনা
সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা সম্ভবপর হবে।
১. শ্রৌত সূত্র : সংহিতার ব্রাহ্মণ খণ্ডকে অবলম্বন করে এটি রচিত হয়েছে। এখানে বেদ বিদিত যজ্ঞানুষ্ঠানে অনুশাসনগুলি বর্ণিত হয়েছে।
২. গৃহ্য সূত্র : গৃহস্থের অনুষ্ঠিত জ্ঞাতকর্ম হতে আরম্ভ করে গার্হস্থ্য আশ্রমের বিভিন্ন স্তরের কার্য এতে বর্ণিত আছে। হিন্দুদের পারিবারিক
ও সামাজিক জীবনে গৃহসূত্রের
প্রভাব বর্তমানেও
বিদ্যমান রয়েছে।
৩. ধর্মসূত্র: ধর্ম ও সমাজ জীবনের নিয়ামক নানাবিধ বিধি উপন্যস্থ হয়েছে।
সূত্রাকারগণের মধ্যে মনু, যাজ্ঞবল্কা, পরাশর প্রভৃতি ঋত্বিকগণের নাম পাওয়া যায়। সরাবিদ্যায় পানিনি, পতঞ্জলি প্রমুখ বৈয়াকরণদের ভূমিকাকেও ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ সোপান বলে মনে করা হয়।
ব্রাহ্মণ্যবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা : বৈদিক যুগে প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুর কর্মপ্রবৃত্তি লক্ষ্য করে পাঠ্যসূচী
প্রণয়ন ও পাঠদানের ব্যবস্থা করা হতো। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাতে শিশুর এই সহজাত প্রবৃত্তিকে
উপেক্ষা করা না হলেও ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় ব্যতীত অন্যান্যদের শিক্ষার অধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সনাতন ব্যবস্থায়
শুচিতা জ্যডন বেদবাক্যের শিক্ষণ বহুদিন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে পঠন ও শিক্ষণ উভয় পদ্ধতিই প্রাথমিক তুল্য মর্যাদা লাভ করল। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় ব্যাকরণ, গণিত, জ্যোতিষবিদ্যা, বাস্তশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়সমূহ শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থান পেয়েছিল।
বৈদিক কর্মকাণ্ডের বিধি অনুসারে ত্রিবর্ণকে
নিত্য যজ্ঞাদি আচরণ পালন করতে হত, অন্যতা তাদের 'ব্রাত্যজন' বা 'পতিত' বলে চিহ্নিত করা হত। আচরণ শুদ্ধ কর্তব্যনিষ্ট ব্যতীত আর কোন অর্থের সংস্কৃত ভাষায় 'আর্য' শব্দটি কখনই প্রযুক্ত হয়নি। বশিষ্ঠ সংহিতা'য় বলা হয়েছে -
"কর্তব্যমাচরণ্ কামম্ অকর্ত্তব্যম্ অনাচরণ্।
তিষ্ঠতি প্রকৃতাচারে যঃ স আর্য্য ইতি স্মৃত।।"
প্রথমদিকে বৈদিক সমাজ স্ত্রীলোকের উপনয়ন সংস্কার গ্রহণ করলেও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তা বিলুপ্ত হতে থাকে। এই প্রসঙ্গে মনুসংহিতায় (দ্বিতীয় অধ্যায়, শ্লোক সংখ্যা ৬৭) বলা হয়েছে -
"বৈবাহিকো-বিধিঃ স্ত্রীনাং সংস্কারো বৈদিককঃস্মৃতঃ।
পতিসেবা গুরৌ বাসো গৃহার্পোগ্নিপরিক্রিয়া।"
খ্রিষ্টীয় সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর পূর্বে বিদ্যারম্ভ
বা অক্ষর স্বীকরণ অনুষ্ঠানের
প্রচলন সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে উপনয়ন অনুষ্ঠান অতি প্রাচীনকাল হতেই বৈদিক সমাজে প্রচলিত ছিল।
ব্রহ্মচারীর শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ এবং শৃঙ্খলবদ্ধ জীবনযাপনের
প্রস্তুতি। দীক্ষা এবং অধ্যবসায়ের
বলে গুরুশিষ্য
সমীপবর্তী হতেন,
'তপোদীক্ষামুপনিষেনুঃ'।
গুরু তথা আচার্যের আশ্রমে ব্রহ্মচারীর
পক্ষে কতকগুলি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ছিল। যেমন-
১. আচার্যের পূর্বে অতি প্রত্যুষে
গাত্রোত্থান।
২. রাত্রিভাগে আচার্য নিদ্রিত হলে অতঃপর শয্যাগ্রহণ।
৩. আচার্য গুরুরক্ষা
ও গোপালন।
৪. যজ্ঞের জন্য সমিধ রক্ষা এবং যজ্ঞাগ্নি
রক্ষা।
মনু প্রভৃতি ব্রাহ্মণবাদী ধর্ম - সূত্রকারগণ ব্রহ্মচর্যাশ্রমে বেশ কিছু দণ্ড বিধানের প্রচলন করেছিলেন। সেগুলি সংশোধনমূলক ছিল কিনা বলা সম্ভব নয়। তবে উপবাসাদি এবং আচার্য আশ্রম হতে বহিষ্কারের প্রথা প্রচলিত ছিল।
আচার্য গৃহের ব্যয় নির্বাহ সম্রাটদের একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ছিল। অভিষেক এবং অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠানের সময়কালে সম্রাটগণ ব্রাহ্মণ আচার্যগণকে কয়েকটি গ্রাম, অর্থসম্পদ, গো সম্পদ ইত্যাদি দান করতেন। এই সকল দানকৃত গ্রামসমূহকে 'অগ্রাহার গ্রাম' বলা হত।
বৈদিক এবং ব্রাহ্মণ্য
শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল আচার্যকেন্দ্রিক। আচার্যদের প্রাধান্য লাভের মূলে নানাবিধ কারণ বিদ্যমান ছিল। যেমন - রাজতন্ত্রের পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাজমন্ত্রণা
সভায় ব্রাহ্মণদের
অংশগ্রহণ, যুদ্ধকৌশল
প্রণয়ন, অর্থব্যবস্থার সকল প্রয়োগ, গুপ্তচর বৃত্তিতে যোগদান ইত্যাদি নানান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে
ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য
লাভের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে তাদের প্রভাব পতিপত্তি ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমতাবস্থায়
আচার্যগণ শিক্ষাপ্রদানের পাশাপাশি যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষাকেও
ধর্মশিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন। রামায়ণ এবং মহাভারতে এইরূপ অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়।
পরিশেষে একথা বলা যায় যে, বৈদিক শিক্ষার অভ্যন্তরেই ব্রাহ্মণ্যবাদী মনুশিক্ষার বীজ লুক্কায়িত
ছিল। কালক্রমে তা ক্ষত্রিয় শ্রেণীর সহযোগিতায়
তা মহীরূপে পরিণত হয়ে বনভূমিরূপে বিনাশ লাভ করেছিল। এই বনভূমি ছিল কণ্টকাকীর্ণ
এবং বিষবৃক্ষে
পরিপূর্ণ। যেখানে পশু-পাখি এবং অন্যান্য জীবকূলের তীব্র আর্তনাদ ও পুতিগন্ধময় মৃতশবের অস্থি পাঞ্জর পরিপূর্ণ থাকত।এক সুদীর্ঘ কালরাত্রি
চতুর্দিকে গ্রাস করল।
২. এই ধর্মের মূল কথা ছিল মানব দুঃখের উৎপত্তি এবং তার নিবারণ।
৩. গৌতম বুদ্ধ বর্ণাশ্রম প্রথাকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছিলেন।
৪. পূজা, যাগ-যজ্ঞ, পশু হত্যা বৌদ্ধধর্মে
সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছবি।
৫. বৌদ্ধধর্ম ছিল সম্পূর্ণভাবে বস্তুবাদী।
এই ধর্মে পরাজাগতিক বিষয়গুলি ছিল অপ্রাসঙ্গিক।
৬. বুদ্ধ প্রবর্তিত
দুঃখ নিবৃত্তির
উপায়সমূহ ছিল অনাড়ম্বর।ফলে তা সহজেই জনচিত্তকে
আকৃষ্ট করেছিলেন।
গৌতমবুদ্ধের জীবিতাবস্থায় এই ধর্ম ভারতবর্ষে একটি প্রধান ধর্মে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু তাঁর মহাপরিনির্বাণের পরবর্তী ১০০০ বৎসরের মধ্যে এই ধর্মের জনপ্রিয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরিশেষে এই ধর্ম বহিঃবিশ্বে প্রাধান্য লাভের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ধর্মে পরিণত হয়। যা আজও প্রবাহমান।
বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল এই ধর্মের একটি বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। গৌতম বুদ্ধ গণশিক্ষার মাধ্যমে ধর্মপ্রচারে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি জনগণের ভাষা মাগধী, প্রাকৃত এবং পালি ভাষায় তাঁর ধর্ম প্রচার করেছিলেন। অশোকের সময়কালে ব্রাহ্মী,
খরোষ্ঠী এবং পালি ভাষা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়েছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধগণ সংস্কৃত ভাষাকেই গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন।
কিন্তু মুখ্য বুদ্ধবচন পালি ভাষাতেই সংরক্ষিত হয়েছিল।
শিক্ষানীতি ও শিক্ষা পরিচালনার দিক হতে বিচার করলে দেখা যাবে যে, সংঘশিক্ষাই ছিল বৌদ্ধ শিক্ষা
ব্যবস্থার মূল কেন্দ্র। ভগবান বুদ্ধ তাঁর পরিনির্বাণের পূর্বে ভিক্ষু আনন্দের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন যে, তাঁর অবর্তমানে
বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘই
শিষ্য এবং জনগণের শিক্ষার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করবে।
বৌদ্ধসংঘে কোনপ্রকার জাতি ভাগ বা বর্ণবিভাগকে স্থান দেওয়া হয়নি। সমাজের সকল স্তরের মানুষ সংঘে প্রবেশ করার পর কেশ-শুশ্রূ পরিত্যাগ, ত্রিচীবর ধারণ এবং ভিক্ষাপাত্র গ্রহণ করতে হত। একই প্রকার পরিচ্ছদের সাদৃশ্য হওয়ার সংঘ শিক্ষায় গণতান্ত্রিক আদর্শ রক্ষিত হয়েছিল।
বুদ্ধের পূর্বে পৌরোহিত্য
এবং শিক্ষার চাবিকাঠি মূলতঃ ব্রাহ্মণদের অধিকারেই ছিল। কিন্তু বৌদ্ধ জাতিপ্রথার
মূলোচ্ছেদ করে মানবিক এবং মনুষ্যত্ব বিকাশের অধিকার সকলের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। বুদ্ধের শিষ্যগণের মধ্যে সারিপুত্র এবং মৌদ্গল্লায়ণ ছিলেন ব্রাহ্মণ। আনন্দ, রাহুল, অনুরুদ্ধ ছিলেন ক্ষত্রিয়,
যশ ও অনাথপিণ্ডিক ছিলেন শ্রেষ্ঠি এবং উপালী ছিলেন শূদ্র- সকলেই মহান বুদ্ধের অনুকম্পায় ভিক্ষু সংঘে যোগদানের অধিকার লাভ করেছিলেন।
বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘে যোগদানের পূর্বে শিক্ষার্থীকে তার পিতা-মাতার নিকট হতে অনুমতি গ্রহণ করতে হত। পিতা মাতার অবর্তমানে পরিপারের মুখ্য সদস্য -সদস্যা হতে সম্মতি লাভ করার পর সেই শিক্ষার্থীকে ভিক্ষুসংঘে উপস্থিত হয়ে কোন একজন মহাপ্রাজ্ঞ ভিক্ষুর নিকট সংঘে যোগদানের অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে হত। সাথে যোগদানের উপযুক্ততার
বিষয়ে কতকগুলি মূখ্য শর্ত ছিল। সেই শর্তগুলি নিম্মরূপ-
২. শিক্ষার্থী ব্যাধিমুক্ত
হবেন।
৪. তিনি ব্রহ্মচর্য
বৃত্তি পালন করবেন।
শিক্ষার্থী সংঘে প্রবেশ করার পর ১০ দিন বা কোন কোন ক্ষেত্রে মাসার্ধ কালব্যাপী উপাসক থাকত। এইসময় তাকে পঞ্চশীল পালনের উপদেশ প্রদান করতে হত। এই পঞ্চশীল হল নিম্মরূপ-
৩. মুসাবাদা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিয়ামি- মিথ্যা কথা হতে বিরতি ও শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৪. কামেসু মিচ্ছাচারা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিয়ামি- ব্যাভিচার হতে বিরতি ও শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
৫. সুরামেরেয় মজ্জপমাদট্ঠনা বেরমণী সিক্খাপদং সমাদিয়ামি- সুরা মেরেয় ও মদ্যাদি প্রমাদের কারণ হতে বিরতি ও শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।
উপাসকের জীবন সমাপ্ত হলে বিদ্যার্থী ভিক্ষুর পরিচ্ছদ ধারণ করে ভিক্ষুসংঘের অন্যান্য সভ্যদের সম্মুখে উপস্থিত হতেন। ভিক্ষুসংঘ বিদ্যার্থীকে গ্রহণের অভিধায় প্রকাশ করলে শিক্ষক বিদ্যার্থীর পক্ষ গ্রহণ করে সংঘ পর্যদিগকে অনুরোধ করতেন প্রাথমিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে। এই অনুষ্ঠানে বিদ্যার্থীকে মস্তক মুণ্ডন পূর্বক কাষায় বস্ত্র পরিধান এবং ভিক্ষাপাত্র গ্রহণ করতে হত। এই সময়ে বিদ্যার্থী শ্রমণ নাম গ্রহণ করতেন। শিক্ষককে বলা হয় উপাধ্যায়। উপাধ্যায়ের সম্মুখেই সংঘচার্যগণ ভিক্ষু বিনয় ব্যবহারের নিয়মাদি শ্রমণকে পাঠ করে শোনাতেন।
বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘে প্রবেশের মূল দুটি পর্যায়
: প্রথমটি প্রব্রজ্যা এবং অপরটি উপসম্পদা।
এই দুইটি পর্যায়ের মাধ্যমে বিনির্মিত হত ভিক্ষু জীবন উপাধ্যায় ও আচার্য নামক দুই প্রকার বৌদ্ধ শিক্ষকের কথা বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। তবে তিব্বতি বৌদ্ধ গ্রন্থে দুই প্রকার উপাধ্যায় ব্যাতীত অতিরিক্ত পাঁচ প্রকার আচার্যের উল্লেখ রয়েছে।
২. যিনি উপসম্পদা প্রদান করেন।
২.যিনি গৃঢ়তত্ত্ব
শিক্ষা দেন,
৩. যিনি সংঘকর্ম সম্পর্ক উপদেশ দেন,
৪. যিনি নিশ্রয় প্রদান করেন,
৫. যিনি শাস্ত্র অধ্যায়নের ব্যবস্থা করেন।
বৌদ্ধ শিক্ষা গুরুর যোগ্যতা সম্পর্কে জানা যায় যে, যিনি অন্তেবাসী ও সহবিহারীকে বিভিন্ন নিয়ম বিষয়ক শিক্ষা দিতে পারতেন। অর্থাৎ যিনি বিনয় অভিধর্ম শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী।
যিনি শ্রদ্ধাশীল,
বীর্যশীল, স্মৃতিশীল,
যিনি বিবিধ জ্ঞানসম্পন্ন। তিনিই প্রকৃত শিক্ষা দানে নিযুক্ত হতেন। 'মিলিন্দপঞহো'
গ্রন্থে অন্তেবাসীর
প্রতি শিক্ষা গুরুর ২৫ প্রকার যোগ্যতার বিষয়ে জানতে পারা যায়। সেগুলি হল
বৌদ্ধশিক্ষায় গুরু বা আচার্য শিক্ষার্থীকে শিক্ষা প্রদাব করতেন এবং শ্রমণরা নিশ্রয় উপসম্পদা দ্বারা অভিষিক্ত হতেন। শিক্ষার্থীর
নিমিত্তে শিক্ষণের একটি প্রারম্ভিক
স্তর নিদিষ্ট ছিল এবং কঠোরতম অনুশাসন পালন করতে হত। কঠোর বিধান বৌদ্ধ শিক্ষার বৈশিষ্ট্য
করা যায়। সংঘ জীবনে শিক্ষা কোন কোন বিষয়ের অনুশাসন মান্য করবেন তারও সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে বিনয় পিটক ও চুল্লবর্গ গ্রন্থে।
বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের শিখন ব্যবস্থার প্রশ্নে উপাধ্যায় এবং কর্মাচার্য নামক দুই শ্রেণীর শিক্ষকের উল্লেখ পাওয়া যায়। উপাধ্যায় ছাত্রকে বিদ্যা এবং কর্মাচার্য ছাত্রকে বিনয় শিক্ষা প্রদান করতেন।
ইংসিঙের বর্ণনানুসারে জানা যায় যে, ছাত্র প্রতিদিন প্রত্যুষে এবং সন্ধ্যায় অধ্যায়নের নিমিত্তে শিক্ষকের সমীপবর্তী হতেন। উপাধ্যায় ও কর্মাচার্যগণ সমগ্র জীবনব্যাপী অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনার কাজে যুক্ত থাকতেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের সকল ভিক্ষুকে আজীবন কৌমার্যব্রত দৃঢ়ভাবে পালন করতে হত। ফলে শিক্ষার প্রশ্নে কোনরূপ বিঘ্ন সৃষ্টি হত না। তাদের প্রয়োজনও ছিল যৎসামান্য। বৌদ্ধ ভিক্ষার ইতিহাস ছিল পৃথিবীর পাঠশালা। মহান বুদ্ধের দর্শনের ফসল রূপে ভারতবর্ষের প্রথম এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নালন্দা, তক্ষশীলা, বিক্রমশিলার ন্যায় আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল।
সময়ানুসারে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, সম্রাট অশোকের সময়কাল হতে বাংলার পাল রাজাদের রাজত্বকাল পর্যন্ত প্রায় ১২ শতাব্দীকাল ব্যাপী বৌদ্ধ ধর্মের কল্যাণে ভারতীয় সংস্কৃতি বহিবিশ্বেও
প্রচারিত হয়েছিল। গণশিক্ষার প্রচার এবং প্রসারের প্রশ্নে বৌদ্ধ ধর্ম ব্রাহ্মণ্য
ধর্মের ন্যায় কোনরূপ কুপমণ্ডুকতা
অবলম্বন করেনি। সর্বোপরি বৌদ্ধধর্ম
উদার শিক্ষার পরিকল্পনা রসায়নে যে সকল পদক্ষেপগুলি যে সকল পদক্ষেপগুলি
গ্রহণ করেছিল, সেগুলি হল এইরূপ-
দ্বিতীয়ত, সংঘ বর্হিভূত জনসাধারণের গড়ে ওঠার ফলে বিদ্যার্থীর সহানুভূতি
লাভের প্রচেষ্টা।
শিক্ষা প্রদান সম্ভবপর হয়েছিল।
বৌদ্ধশিক্ষা সেই সময়ে ভারতের যুব এবং রাজশক্তিকে
প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত
করতে সমর্থ হয়েছিল বলে তাদের বিদগ্ধতায়
ব্রাহ্মণ নৈয়ায়িকদের
মতো পণ্ডিত হয়েছিল এবং ভারত ও বহির্ভারতে এই দর্শনের জনপ্রিয়তা
উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বৌদ্ধসংঘে শ্রেণিশিক্ষণ বিশেষভাবে
গড়ে ওঠার ফলে বিদ্যার্থীর
ব্যক্তিগত গুণাবলি লক্ষ্য করে শিক্ষাদান সম্ভবপর হয়েছিল। বৌদ্ধশিক্ষায় সর্বপ্রথম জনশিক্ষা (গণশিক্ষার
আদর্শ) গ্রহণ করেছিল। মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়ায় শিক্ষিতের
হার বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বৌদ্ধশিক্ষা ব্যবস্থার ফলে এই সময় ভারতীয় সংস্কৃতি আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছিল। মহাবিহারগুলিতে বৌদ্ধ দর্শন অধ্যায়ন ও অধ্যাপনার সুবন্দোবস্ত থাকার ফলে চিন, জাপান, তিব্বত, সিংহলসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বহুদেশ হতে ছাত্র ভারতবর্ষে অধ্যয়নের জন্য উপস্থিত হতেন।
এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শরীর ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। সর্বোপরি এই শিক্ষার অনুপ্রেরণায় ভারতীয় শিল্প, ভাস্কর্য আন্তর্জাতিকভাবে বিকাশ লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। মগধ সম্রাট অশোককালীন সিংহস্তম্ভ, গুহা, ভাস্কর্য, স্তম্ভলিপি, কুরান যুগের গান্ধার শিল্প, পাল যুগের চিত্র ভাস্কর্য ইত্যাদি উল্লেখনীয়। বৌদ্ধ চিকিৎসক জীবন,চরক প্রভৃতি নাম সুপ্রসিদ্ধ।
বৌদ্ধ শিক্ষার ফলে বৌদ্ধ সাহিত্যের
(পিটক ও অনুপিটক) শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। পালি এবং পরবর্তী সময়ে সংস্কৃত ভাষায় বিকাশ সাধন বৌদ্ধযুগেই সম্ভবপর হয়েছিল।
উপসংহারে বলা যেতে পারে যে, ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বিকাশ সাধন মহামানব গৌতম বুদ্ধের উদার এবং গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার ফলশ্রুতির ফলে সম্ভবপর হয়েছিল। সর্বোপরি, প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার উন্নতির প্রশ্নে মহান বুদ্ধের অবদান সত্যিই অনস্বীকার্য। অধ্যাপক ফিলিপস্প্রাট এর মতে "বুদ্ধ ছিলেন পৃথিবীর প্রথম বিশ্ব নাগরিক। তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার ফসল হল বৌদ্ধদর্শন। যে দর্শন ছিল মানব মুক্তির দর্শন, বিশ্ব শিক্ষার দর্শন।"
বৌদ্ধসংঘে শিক্ষার মাধ্যম ছিল স্ব-স্ব শিক্ষার্থীগণের মাতৃভাষা। বৌদ্ধসংঘে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা আসতেন। সেই কারণে শিক্ষার মাধ্যম কি হবে সেই বিষয়ে একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। বুদ্ধের মূল নির্দেশ ছিল নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের অনুশীলন এবং সেই কারণেই পরবর্তীকালে
সম্রাট অশোকের নেতৃত্বে বিকশিত হয়েছিল জ্ঞান - বিজ্ঞান ও শিক্ষা সংস্কৃতিতে
উচ্চতর লোকশিল্প।
ভারতের বিশ্ব বিস্তারের ইতিহাসে বইটি একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। বৌদ্ধশিক্ষার দ্বারাই ভারতবর্ষে সহজভাবে মাতৃভাষার দ্বার উম্মুক্ত হয়েছিল। সর্বোপরি শিক্ষার কর্মসূচি হতে অবাস্তব, অপ্রাসঙ্গিক,
কুসংস্কার এবং কুরুচিমূলক বিষয়গুলি দূরীভূত হয়েছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষু বা শিক্ষার্থীর
শিক্ষার মূল পাঠ্যসূচী ছিল - সুত্তন্ত, ধর্ম ও বিনয় এবং সুত্ত ও সুত্তবিভঙ্গ
পাঠ এবং আলোচনা।
তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় : খ্রিষ্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন বৌদ্ধ গ্রন্থ সমূহে গান্ধার রাজ্যের নাম পাওয়া যায়। গান্ধার অঞ্চলটি বর্তমান আফগানিস্তান হতে কাশ্মির উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গান্ধারের রাজধানী ছিল তক্ষশীলা (বর্তমান পাকিস্তান) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়কালে তক্ষশীলা গ্রীক অধিকার হতে মৌর্য সাম্রাজ্য ভুক্ত হয়ে পড়ে।তবে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর পুনঃ ব্যাকট্রীয় গ্রীকদের (খ্রীষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী) নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। আনুমানিক খ্রীষ্ট পূর্ব সপ্তম হতে তৃতীয় অব্দ পর্যন্ত প্রায় চারশ বছর তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্ররূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে বৌদ্ধদর্শন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, ভূগোল ও ব্যবহারিক বিষয়সমূহ স্থান পেয়েছিল। সমসাময়িক পরবর্তীকালের নানা সাহিত্য, বৌদ্ধ দর্শন সাহিত্যে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস পাওয়া যায়। মগধ সম্রাট বিম্বিসারের চিকিৎসক ও বৌদ্ধশাসক জীবক অর্থশাস্ত্রবিদ্ চাণক্য (বিষ্ণুগুপ্ত বা কৌটিল্য) ও বৈয়াকরণিক পানিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ছিলেন।
বর্তমান বৌদ্ধ শিক্ষার প্রভাব : রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থাকে দীর্ঘদিন অনুশীলন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষাকে একটি নিদিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখলে সেই শিক্ষার পরিবেশ কূপমুণ্ডুক জগৎ সৃষ্টি করে। সুতরাং তিনি গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত গণশিক্ষাকে গ্রহণ করে নির্মাণ করেছিলেন শান্তিনিকেতন।
রামমোহন হতে বিদ্যাসাগর স্ত্রী শিক্ষার প্রচার এবং প্রসারে যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তা ছিল গৌতম বুদ্ধের স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তিত রূপ। কারণ মুক্তশিক্ষা মুক্তচিন্তার প্রশ্নে স্ত্রীশিক্ষা একান্তই আবশ্যক। অন্যথায় জাতির বিকাশ স্তিমিত হয়ে পড়ে।
বর্তমানে জাপান, চীন ইত্যাদি পূর্বএশিয়ার দেশগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে, কীভাবে তারা গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থাকে জনমানসে অনুশীলন করে দেশের ও দশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ইউরোপও ক্রমাগত বুদ্ধের শিক্ষাপদ্ধতিতে অনুশীলন ও আত্মস্থ করেছে।
ইউরোপ বুদ্ধের শিক্ষাকে পর্যায়ক্রমে অনুশীলন করার মধ্যে দিয়ে জনগণ ও রাষ্ট্রিক চেতনার বিকাশকে সম্ভব করেছে।
বর্তমান ভারতবর্ষে বহুিমুখী এবং অন্তঃমুখী -অর্থাৎ উভয় প্রকারের যে শিক্ষার অনুশীলন দেখতে পাওয়া যায়, তা তো বৌদ্ধ শিক্ষার পুঞ্জিভূত রূপ পরিলক্ষিত হয়।
শিশু শিক্ষার আঙ্গিক হতে উচ্চতর বিদ্যাশিক্ষার সর্বত্রই বৌদ্ধশিক্ষার প্রভাব সুস্পষ্ট। সর্বোপরি সকলের জন্য শিক্ষা -এ তো মহান গৌতম বুদ্ধেরই অবদান।
আন্তর্জাতিক শিক্ষার ইতিহাস এবং বৃটিশ ভারত : আন্তর্জাতিক
শিক্ষা ইতিহাসের সূচনাপর্ব হল সেনযুগ তুর্কীদের
হাতে (১৪৫৩ খ্রিঃ) বাইজাইটান
সাম্রাজ্যের পতন এবং তার পরবর্তী সময়কালে অনুষ্ঠিত ধর্মযুদ্ধ
বা ক্রসেড (৪০০বৎসর) এই সুদীর্ঘ সময়কালে ইউরোপীয় মানচিত্রের
এক বিরাট উন্নয়ন ঘটে। একদিকে গ্রীক ও ইতালির ভাবধারায় অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় রেনেসাঁস বা নবজাগরণ এবং অপরদিকে অষ্টাদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের শিল্পবিপ্লব
ইউরোপের ভাগ্যাকাশে
পুঁজিতন্ত্রের উন্মেষ ঘটানোর পক্ষে সহায়ক হয়েছিল।
ইংরেজ তথা বৃটিশ পূর্ব ভারতে দেশীয় শিক্ষা কেমন ছিল সে সম্পর্কে বাস্তব সমীক্ষা ইংরেজরা অবশ্যই করেছিলেন। ফলে শিক্ষার বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণকালে তারা বৌদ্ধ স্থাপত্য ও দর্শনের সংস্পর্শে আসেন। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে থমাস উইলিয়াম রীস ডেভিডস্ ইংল্যাণ্ড
পালি টেক্সট সোসাইটির প্রতিষ্ঠা
এবং প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থগুলির অনুসন্ধান
তথা গবেষণার সম্বলরূপে ইউরোপীয় পণ্ডিতবর্গের নিকট বৌদ্ধশিক্ষার বিষয়গুলি উঠে আসে। তখন পাশ্চাত্য
পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, ভারতীয় সংস্কৃতি হিন্দু ইসলাম সংস্কৃতি নয়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে
এই সকল সংস্কৃতি আবির্ভাবের
পূর্বেও বৌদ্ধ শিক্ষা সংস্কৃতির
আন্তর্জাতিকভাবে বিকাশ লাভ করেছিল এবং সেই শিক্ষা সংস্কৃতি ছিল আধুনিক ইউরোপীয় শিক্ষা হতে অনেক বেশি আধুনিক তথা প্রগতিশীল।
ব্রিটিশ আবির্ভাবের ফলে ভারতবর্ষে উন্নত চিন্তা ভাবনার স্রোত, বৃহত্তর জগতের আধুনিকতার সংযোগ একটি নতুন ধরণের অভূতপূর্ব রূপ পরিগ্রহ করেছিল এবং নতুন সুযোগ আমদানি করেছিল। এই পটভূমিতে ভারতে ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে ভারতীয় জাতীয় নেতৃবৃন্দের আবির্ভাব এবং নবজাগরণীয় চেতনার আবির্ভাবের শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের আমদানি হয়েছিল এবং সেই ক্ষেত্রে শিক্ষার ইতিহাসের দিক হতে মেকলের শিক্ষা ভাবনা মিশনারীদের তৎপরতা, রামমোহন বিদ্যাসাগর প্রমুখের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অধ্যাপক যদুনাথ সরকারের মতে, পলাশীর যুদ্ধের পর ভারতে মধ্যযুগের অবসান হয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তাদের শাসনতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, শিক্ষা, দর্শন ভারতের মাটিতে আমদানি করতে থাকে।
১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে মানবতাবাদী
বেস্থামের শিষ্য লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক ভারতবর্ষের
শাসনভার গ্রহণ করেন এবং ভারতীয় জনগণের হিতার্থে শিক্ষা ও সমাজ সম্পর্কিত নানা সংস্কারমূলক কাজে অগ্রণী হন।
খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার ও ভারতবর্ষ তথা বাংলায় শিক্ষাবিস্তারের প্রশ্নে উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ডের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। উইলিয়াম কেরী অনেকগুলি ভারতীয় ভাষায় পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে উল্লেখনীয় - কথোপকতন (১৮০১), ইতিহাসমালা (১৮১২ খ্রিঃ), বাংলা ইংরেজি অবদান (১৮১৮ খ্রিঃ) ইত্যাদি। এছাড়াও বাংলা ভাষায় রামায়ণ, মহাভারত, অন্নদামঙ্গলও তিনি রচনা করেছিলেন। ইংরেজি সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট (১৮১৮খ্রিঃ), সমাচার দর্পণের ন্যায় পত্রিকা প্রকাশের প্রশ্নেও মিশনারীদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
১৮১৮-১৮৩৬ খ্রীঃ সময়কালে ভারতবর্ষে মিশনারীদের উদ্যোগে প্রায় ১৩০ টি বিদ্যালয় এবং ৪৩ টি মহাবিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল।
বাংলা ভাষার প্রচার এবং প্রসারের প্রশ্নে উইলিয়াম কেরী এবং বিদ্যাসাগরের ভূমিকা ছিল উল্লেখনীয়।
বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বাংলালিপির জনক বলা হয়।
রামমোহনের ভাবনা ছিল ইংরেজদের আমলাতান্ত্রিক শিক্ষার পরিবর্তে ইউরোপীয় কায়দায় ভারতীয় শিক্ষানীতি নির্মিত হোক। তিনি অবস্থার দাশ হিসেবে ইংরেজি শিক্ষকদের মেনে নেননি, তাঁর দূরদর্শিতার কাজ করেছিল আগামী দিনের অগ্নিশপথ, যা বিদ্যার জগাখিচুড়িপনা নয়, জাতীয় সাধনার মহত্ত্বের দ্বারাই যা গড়ে উঠতে পারে বলে তিনি মনে করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন 'জগতের মধ্যে ভারতবাসীর
যে বিশেষ অধিকার আছে সেই অধিকারের জন্য আমাদের জাতীয় বিদ্যালয় আমাদের প্রস্তুত করবে। (শিক্ষা)
কি সেই বিশেষ অধিকার, কি সেই জাতীয় বিদ্যালয়ের
"সিন্ধির আদর্শ)"? যে জাতীয় শিক্ষা ও বিশেষ অধিকারের কথা আমাদের জাতীয় মনীষীরা উচ্চারণ করেছিলেন, সেই শিক্ষার কোথায় এবং কিভাবে ভূলুণ্ঠিত হল তা আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে নতুবা ভারতীয়গণ 'আলমামেটার'
আদর্শে ক্লীব এবং মেরুদণ্ডহীন
জাতিতে পরিণত হইবে। '
বাংলার রেনেসাঁস ছিল ভারতীয় চিত্ত উদ্বোধনের পথিকৃৎ। ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে সেই সময় বাঙ্গালী যা চিন্তা করেছিল, তা ছিল সমগ্র ভারতের ক্ষেত্রে অগ্রণী। মহামতি গোখেল একসময় যথার্থই বলেছিলেন 'বাঙ্গালী আজ যা চিন্তা করে, ভারতবাসী তা আগামী দিনে চিন্তা করবে'। রবীন্দ্রনাথ কখনই খণ্ডদীর্ণ জ্ঞানের উপাসক ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন জ্ঞানের রাজ্যে সম্পূর্ণ ধরণের ঐক্যবদ্ধ।
আমরা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার মধ্যে বৌদ্ধচিন্তার প্রতিফলন দেখতে পাই। সেই আদর্শ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, "প্রাচীন ভারতে বিদ্যাচর্চার একটি ঐক্যবদ্ধ আদর্শ ছিল, যা পরবর্তী কালে বিনষ্ট হয়ে গেছে। আধুনিক যুগ যে সুযোগ এনে দিয়েছে নতুনভাবে তার দ্বারা আমাদের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিন্তাধারার মূল সূত্রকে মানবতার আদর্শে উজ্জীবিত করতে হবে। কারণ জাতীয় আবেষ্টনী বা পরিপার্শ্ব ব্যতীত কোন জাতির শিক্ষা গড়ে ওঠা সম্ভব নয়।"
স্বাধীন ভারতে শিক্ষার পুনর্গঠন ও ব্যর্থতা :
স্বাধীন ভারতে শিক্ষার পুনর্গঠন তদানিন্তন ইংরেজ শিক্ষা কমিশনের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই গঠিত হয়েছিল স্বাধীন ভারতে তিনটি উল্লেখনীয় কমিশন হল রাধাকৃষ্ণান কমিশন (১৯৪৮ খ্রিঃ), মুদালিয়র কমিশন (১৯৫২-৫৩খ্রিঃ), ও কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬ খ্রিঃ)।
রাধাকৃষ্ণান কমিশন বা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের মূল তথা প্রধান বক্তব্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পথ উদ্দেশ্য,
পাঠক্রম, প্রশাসন, পরীক্ষা পদ্ধতি, জীবিকার সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক, মাধ্যমিক শিক্ষার পুনর্গঠন ইত্যাদি। স্বাধীন ভারতে এই কমিশন ছিল প্রথম শিক্ষা কমিশন।
মুদালিয়র কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতি বিধানে গঠিত হয়েছিল। এই কমিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ নতুনভাবে জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রণয়ন।
কোঠারি কমিশন ছিল ভারতের সর্বপ্রথম
এবং সর্বস্তরের
শিক্ষা কমিশন, যারা প্রাথমিক শিক্ষা হতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার ধারায় পুনর্গঠন সম্পর্কে বিশদ ও তথ্যবহুল সুপারিশ গুলি প্রকাশ করেছিলেন।
স্বাধীন ভারতে চিন্তা এবং চেতনার জাগরণে এই কমিশনের পদক্ষেপ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই কমিশনটি সমগ্র শিক্ষাকেই
মানবধর্মী, আধুনিক ধর্মী, গণতন্ত্রধর্মী, মূল্যবোধধর্মী করতে সচেষ্ট হয়েছিল। অনেকের মতে এই, কমিশনের মৌলিক বক্তব্যগুলি,স্পষ্ট না হওয়ার ফলে ভারতীয় জাতীয় শিক্ষানীতির
প্রশ্নে এই কমিশন ছিল একপেশে এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। ফলে উপরোক্ত তিনটি কমিশনই সুযোগ্য পরিকল্পনার অভাবে সাফল্য লাভ করতে অসমর্থ হয়েছিল। বিখ্যাত মার্কসবাদী পণ্ডিত শিবনারায়ণ ঘোষ মহাশয়ের মতে (সোশ্যালিষ্ট উইকলি গেজেট ১৮৬৬,খন্ড- ২) পর্বত মুষিক প্রসব করল। কারণ এই কমিশন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপাতদুষ্ট এবং ক্রীড়ানক।
প্রথমত : ভারতবর্ষ এখন পর্যন্ত বহুত্ববাদ,
উগ্রধর্মান্ধতা, হিন্দি ভাষার আগ্রাসন, দিল্লি কেন্দ্রিক
রাজনৈতিক বাতাবরণ হতে মুক্ত হননি।
তৃতীয়ত : উন্নত বিদ্যাশিক্ষার অভাব, শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ,
একপেশে পাঠ্যক্রম
এবং মুক্ত শিক্ষার ক্রটি বিচ্যুতি ইত্যাদি। এছাড়া কেন্দ্ররাজ্যগুলির মধ্যেকার সম্পর্কগুলি সুমধুর না হওয়ার ফলে এই সমস্যাগুলি জটিল থেকে জটিলতর আকার নিয়েছে।
শিক্ষার উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে একে অপরের পরিপূরক এই সাধারণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এই রাষ্ট্র ভাবনা চিন্তা করেনি কখনই। ফলে শিক্ষার সামগ্রিক চরিত্রে একটি একাত্মবোধ
সেইভাবে প্রতিফলিত
হয়নি। রাজ্যে রাজ্যে শিক্ষার এক অদ্ভূত রূপ ভারতের জাতীয় জীবনে নানা ক্ষেত্রে অজস্র জটিলতা সৃষ্টি করেছে। ফলে, মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক দিক হতে ভারতীয় রাষ্ট্র স্বাধীনতার
এতগুলি বছর পরেও ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে, অর্থাৎ উজ্জ্বল ও অর্থপূর্ণ
হতে পারেনি।
১. কোঠারী কমিশন প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা চেয়েছিলেন ৩-৫ বৎসরের শিশুদের জন্য। আরও চেয়েছিলেন, প্রত্যেকটি রাজ্যে প্রাক্ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে শুধু বিদ্যাশিক্ষা নয়, শিশুদের মানবিক প্রতিভারও বিকাশ সাধন হবে খেলাধূলা, নিত্যগীত ও সঙ্গিত শিক্ষার মাধ্যমে কিন্তু সরকারি ক্ষেত্রের ঔদাসিন্যতা এবং উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব থাকার কারণে গ্রাম এবং শহরাঞ্চলে এই উদ্যোগ সাফল্য লাভ করতে পারেনি।
২. জাতীয় শিক্ষা নীতি নির্ধারণের প্রশ্নে ভারতীয় শিক্ষা মত্তক, পেষ্টলজি, গেসেল, মন্তেসরী প্রমুখ শিক্ষাবিদদের শিশুশিক্ষা পাঠ্যক্রমের বৌদ্ধিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণায় অন্ধ অনুকরণ নীতির প্রভাবে ভারতবর্ষের শহরাঞ্চল ও নগরগুলিতে ৯০ এর দশকের প্রথম হতে বেসরকারি উদ্যোগে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিকভাবে মন্তেসরী প্রাক-প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানগুলি সেভাবে গড়ে উঠতে থাকে তার মূল লক্ষ্য ছিল ব্যবসার সম্প্রসারণ। ফলে শিশু শিক্ষা কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
৩. প্রাথমিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কি, সেখানে কি পদ্ধতিতে কোন কোন শিক্ষা প্রদান করা উচিত, এই বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতি থাকার প্রয়োজন রয়েছে। ভারতবর্ষে কাগজে কলমে এই নীতি থাকলেও আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক প্রভাবে সেই প্রচেষ্টা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে সরকারিবিদ্যালয় গুলির ক্রমাগত সংকোচন এই ব্যর্থতাকে আরোও প্রকট করেছে।
৪. মাধ্যমিক শিক্ষাকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। প্রথমটি হল মাধ্যমিক পর্যায় (ষষ্ঠ হতে দশম শ্রেণী) এবং দ্বিতীয়টি হল উচ্চতর মাধ্যমিক পর্যায় (একাদশ হতে দ্বাদশ শ্রেণী)। উভয় ক্ষেত্রেই কারিগরি তথা বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও পেশাদারিত্বের অভাব তথা পর্যাপ্ত শিক্ষক ও নানাবিধ জটিলতার কারণে নতুন যুগের নতুন শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেনি ফলে বিদ্যাশিক্ষার মান ক্রমশই নিম্নগামী হয়েছে। এছাড়া অর্থনৈতিক অসাম্যের কারণে বিদ্যালয়ছুট ছাত্র ছাত্রীরা সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৫. যে যুগে গণমুখী শিক্ষার ব্যাপক ব্যবস্থাপনা নির্মিত হয়নি সেখানে উচ্চশিক্ষাকে (একাদশ ও দ্বাদশ) দুইভাগে বিভক্তকরণ বিজ্ঞানসম্মত নয়। যেমন কলা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য এই তিনটি ভাগে সাধারণ উচ্চশিক্ষা বিভক্ত। এছাড়া রয়েছে পেশাদারী বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই পেশাদারিত্বের অভাব এবং চাকুরির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থাকার ফলে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নেই বললেই চলে। ফলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞতার ভিড় ক্রমশই প্রকট হতে শুরু করেছে।
৬. ভারতবর্ষের উচ্চশিক্ষার সুযোগ কেবলমাত্র নির্বাচিত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। মুক্তবিদ্যালয়, মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি ও বিজ্ঞানমুখী প্রতিষ্ঠান থাকলেও তার ভর্তির প্রক্রিয়া এবং পাঠ্যক্রম জটিলতর হওয়ার কারণে উচ্চশিক্ষার বিকাশ সম্ভবপর হয়নি।
৭. গণতন্ত্র কখনও আদর্শবিহীন হতে পারে না। আবার আদর্শও কখনও কোন বিশেষ শ্রেণির অর্থনৈতিক সুবিধার ভিত্তিভূমি হতে পারে না। ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার পুনর্গঠনে এই সকল চিন্তাভাবনাগুলি করার প্রয়োজন আছে।
৮. উচ্চশিক্ষার বিকাশের প্রশ্নে ইংরেজি পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি প্রত্যেকটি রাজ্যের মূল স্থানীয় ভাষার ব্যবহার এর মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের বিষয়টি সরকারি ঔদাসিন্যতার জনপ্রিয় হতে পারেনি। সর্বোপরি শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে হিন্দি ভাষায় আগ্রাসনের ফলে জাতিসত্তার মত বিষয়গুলি ক্রমশই প্রকট হয়ে পড়েছে।
৯. উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বৃহৎ রকমের সমস্যা হল পরীক্ষা গ্রহণ পরীক্ষা পদ্ধতির সমস্যা। এই সমস্যাগুলি হতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালগুলি মুক্ত হতে পারেনি। আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটিকেই নতুনভাবে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। নতুবা এই বিভ্রান্তি বজায় থাকবে।
১০. ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার ফলে শিক্ষার মান ক্রমশই নেতিবাচক দিকে অবস্থান করছে। সর্বোপরি শিক্ষার ক্ষেত্রে ক্রমাগত ব্যয় সংকোচনের ফলে শিক্ষার বিকাশ নেই বললেই চলে। সর্বোপরি একটি পশ্চাৎপদ জাতির শিক্ষার সমস্যা বিদ্যমান থাকা তার মতিহীনতার প্রমাণ।
সমস্যাগুলি হল - প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক উচ্চতর শিক্ষা, বৃত্তি মূলক ও পেশাদারি শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, নারী শিক্ষা, বিধি বর্হিভূত শিক্ষা, অনগ্রসর শ্রেণির শিক্ষা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের
শিক্ষা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষা প্রভৃতি এই সকল বিষয়গুলির
সমাধান হয়নি বরং সমস্যাগুলি
ক্রমশই প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।
আমাদের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাটিকে
জাতীয় শিক্ষার সমস্যা রূপে দেখা হয়নি এবং সে সমস্যার সমাধান কল্পে কোন দৃঢ় পদক্ষেপও গৃহীত হয়নি। ফলে জাতীয় শিক্ষানীতির ফাঁক- ফোকড়গুলি ক্রমশই প্রকট হয়েছে।
অনগ্রসর শ্রেণি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার সংরক্ষণের বিষয়টি ড. বি. আর. আম্বেদকর এর দলিত মুক্তিসংগ্রাম এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত আন্দোলনের পরিণামস্বরূপ প্রস্ফুটিত হলেও তার সামান্যতম সুফল পাওয়া গেছে। কিন্তু ভারতের এই সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণ আজও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অঙ্গুলি হেলনে নির্যাতিত এবং অবহেলিত প্রায়।
উচ্চবর্ণের হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদী দলগুলি শিক্ষা সংরক্ষণ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশেষ সংরক্ষণের বিলোপ সাধনের তীব্র প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হল শিক্ষা ব্যবস্থায় পুনঃ বর্ণপ্রথাকে ফিরিয়ে আনা।
ড. আম্বেদকরের মূল উদ্দেশ্য ছিল সকলের জন্য মুক্ত শিক্ষার প্রচলন। এই অভিপ্রায়ে তিনি সমাজের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর নির্ণায়ক চালিকাশক্তি হয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে যদি সমাজের মূল কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা না যায় তাহলে ভারতের কার্যত স্তব্ধ হয়ে যাবে।
আর এই কারণেই শিক্ষা ও চাকুরির প্রশ্নে দলিত তথা পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর
অগ্রাধিকার চেয়েছিলেন।
তিনি মনে করতেন যে, যতদিন পর্যন্ত এই পশ্চাৎপদ শ্রেণি উচ্চবিত্ত
বর্ণবাদীদের সমকক্ষ না হয়ে উঠবে ততদিন এই সংরক্ষণ বজায় থাকবে।
জাতিগত শংসাপত্র প্রদানের প্রশ্নেও লাল ফিতের ফাঁস থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে তা পাওয়া সম্ভবপর না হওয়ার কারণে শিক্ষার সার্বজনীন
অধিকারের বিষয়টিও কার্যত অলীক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।