Tuesday, September 2, 2025

ভূমিকা

 ভূমিকা

"তুমি নির্মাণ করো আলো, 

তুমি জানো অনুপ্রবেশ 

জানো সব অতিক্রমণ, 

তুমি অনুভব করো, 

এই শিক্ষার জ্ঞান, 

এই তোমার ধর্ম 

ভেঙ্গে ফেল আলস্যভাব 

শ্রদ্ধায় নতজানু হও, 

অনুসরণ করো সেই 

আলোময় মানববিধান'।

      --প্রথম বাঙালী কবি, বঙ্গীশ থের।

"য়ুরোপ হইতে একটা ভাবের প্রবাহ আসিয়াছে এবং স্বভাবতই তাহা আমাদের মনকে আঘাত করিতেছে। এই রূপ ঘাত-প্রতিঘাতে আমাদের চিত্ত জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে, সে কথা অস্বীকার করিলে নিজের চিত্তবৃত্তির প্রতি অন্যায় অপবাদ দেওয়া হইবে। .... এ কথা যখন সত্য তখন আমরা হাজার খাঁটি হইবার চেষ্টা করি না কেন, আমাদের সাহিত্য কিছু না কিছু নতুন মূর্তি ধরিয়া এই সত্যকে প্রকাশ না করিয়া থাকিতে পারিবে না। ঠিক সেই সাবেক জিনিসের পুনরাবৃত্তি আর কোনো মতেই হইতে পারে না। (সাহিত্য সৃষ্টি প্রবন্ধ, আষাঢ় ১৩১৪)।

নবজাগরণের এই ধারা আমাদের দেশে আজ হতে ২৫৬৯ বৎসরের অধিক পূর্বে একটা নতুন যুগ পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে এসেছিল। যার মূল কথা ছিল 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই'। এসেছিল নতুন চেতনা। একটা নতুন জীবনবোধের উদ্ধোধন ঘটেছিল। কেনো অতিপ্রাকৃত সত্ত্বা নয়, জীবনটা হবে মানবকেন্দ্রিক। মানুষের পরিচয় জাত-পাত-বর্ণ-গোত্রের গণ্ডীতে আর বেঁধে রাখা যাবে না। তার বিচারের মাপকাঠি হবে তার মনুষ্যত্ব (মানবিক সত্তা)। মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন ধর্মীয় কুসংস্কার ছিন্ন করে অজ্ঞানতার অন্ধকারের বুকে প্রথম আলোক শিখা মহামানব গৌতম বুদ্ধ। তিনিই প্রথম দেখালেন, 

'...সোকাবতিন্নং অপেত সোকো অবেক্খস্সু জাতিজরাভিভূতং।'

তাহলে দুঃখহীন জীবন গড়ে তুলতে গেলে আমাদের জীবন কেমন হওয়া দরকার? কী ধরণের সংকৃতি, কী ধরণের জীবনবোধের চর্চা আমাদের করতে হবে। এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন----

মনঃ পূর্বঙ্গমা ধর্মাঃ মনঃ শ্রেষ্ঠা মনোময়াঃ।

মনসা চেত্ প্রদুষ্টেন, ভাষতে বা করোতি বা।

ততস্তং দুঃখমন্বেতি, চক্রবদ বহতঃ পদম্।।

জড়ত্বের অতল অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকা মনুষ্য সমাজকে তিনি শিখিয়েছেন, কেমনভাবে দুঃখ হতে চিরতরে মুক্তি লাভ করতে হবে। কী তার প্রকৃত উপায়। সেই অর্থে মনুষ্যজীবনের পদে পদে সীমাহীন দুঃখের বাঁধন হতে মুক্তি পেতে সদ্ধর্মের চর্চার প্রয়োজনীয়তা তিনিই (বুদ্ধ) প্রথম মানুষের সামনে এনেছিলেন। এপ্রসঙ্গে আন্তন চেখড'এর একটি কথা অবশ্যই স্বরণযোগ্য। তিনি বলেছেন,

"প্রত্যেকটি তৃপ্ত সুখী মানুষের দ্বারের পেছনে হাতুড়ি হাতে কারো দাঁড়িয়ে থাকা উচিত। বারবার আঘাত করে সে কেবল বুঝিয়ে দেবে, পৃথিবীতে দুঃখী মানুষ আছে, স্মরণ করিয়ে দেবে, সুখী মানুষ আজ যতই সুখে থাকুক, কয়েকদিন আগেই হোক আর পরেই হোক, জীবন তার অনাবৃত নখর প্রদর্শন করবেই, তার বিপর্যয় ঘটবেই আসবে পীড়া, দারিদ্র, ক্ষয়ক্ষতি, আর তখন কেউ তা দেখবে না শুনবে না। যেমন আজ সে অন্যের দুঃখের কথা শুনছে না।"

'ন তত্ কর্ম কৃতং সাধু, যত্ কৃত্বা হ্যনুতপ্যতে।

রূদন্নশ্রুমুখো যস্য, বিপাকং প্রতিসেবতে।।

এমন কর্ম সম্পাদন সমীচীন নয় যার প্রভাবে মনুষ্যকে পরবর্তী সময়ে অনুশোচনা করতে হয়। তথা যার পরিনাম (বিপাক ফল) অশ্রুপাত (ক্রন্দন) হয়।

এ লেখায় অনেক রকম ভাঁজ। শূন্যতার বিরাট ভূমিকা এখানে। অনাবিল শূন্যতা। শূন্যতা দিয়ে শুরু, শূন্যতা দিয়ে শেষ। তাহলে কবিতার স্বপ্নলোক?

'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি: কবি- কেনা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং করার অভ্যন্তরে চিন্তা এবং অভিজ্ঞতার একটি স্বতন্ত্র সারবস্তু নিহিত রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে বহু বিগত শতাব্দী ধরে ও তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য বিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। সাহায্য করেছে, কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না, যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতের অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্য প্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।

বলতে পারা যায় কি এই সম্যক্ কল্পনা আভা কোথা থেকে আসে? কেউ কেউ বলেন, আসে পরমেশ্বরের কাছ থেকে। সেকথা যদি স্বীকার করি তাহলে একটি সুন্দর জটিল পাককে যেন হীরের ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম। হয়তো সেই হীরের ছুরি পরিদেশের, কিংবা হয়তো সৃষ্টির রক্ত চলাচলের মতোই সত্য জিনিস। কিন্তু মানুষের জ্ঞানের এবং কাব্য সমালোচনা নমুনার নতুন নতুন আবর্তনে বিশ্লেষকেরা এই আশ্চর্য গিঠকে আমি যতদূর ধারণা করতে পারছি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খসাতে চেষ্টা করবেন। ব্যক্তিগতভাবে এ সম্বন্ধে আমি কি বিশ্বাস করি কিংবা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবার মতো কোনো সুস্থিরতা খুঁজে পেয়েছি কিনা--....। কিন্তু যাঁরা বলেন সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে পৃথিবীর কিংবা স্বকীয় দেশের বিগত ও বর্তমান কাব্য বেষ্টনীর ভিতর চমৎকার রূপে দীক্ষিত হয়ে নিয়ে, কবিতা রচনা করতে হবে তাঁদের ও দাবীর সম্পূর্ণ মর্ম আমি অন্তত উপলব্ধি করতে পারলাম না। কারণ আমাদের অনুভব করতে হয়েছে যে, খণ্ড বিখণ্ডিত এই পৃথিবী, মানুষ ও চরাচরের আঘাতে উত্থিত মৃদুতম সচেতন অনুনয় ও এক এক সময় যেন থেমে যায়, একটি পৃথিবীর অন্ধকার ও শুদ্ধতায় একটি মোমের মতন যেন জ্বলে ওঠে হৃদয়, এবং ধীরে ধীরে কবিতা-জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায়।

কবির প্রণালী অন্য রকম, কোনো প্রাক্ নির্দিষ্ট চিন্তা বা মতবাদের জমাট দানা থাকে না কবির মনে কিংবা থাকলে ও সেগুলোকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করে থাকে কল্পনার আলো ও আবেগ, কাজেই চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ প্রকৃত কবিতার ভিতর শিরা, উপশিরা ও রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে যেন। লুকিয়ে থাকে, কিন্তু বিশিষ্ট পাঠক তাদের সে সংস্থান অনুভব করে, বুঝাতে পারে যে তারা সঙ্গতির ভিতর রয়েছে, অসংস্থিত পীড়া দিচ্ছে না, কবিতার ভিতর আনন্দ পাওয়া যায়, জীবনের সমস্যা ঘোলা জলের মুষিকাঞ্জলির ভিতর শালিকের মতো স্নান না করে বরং যেন করে আসন্ন নদীর ভিতর বিকেলের সাদা রৌদ্রের মতো সৌন্দর্য ও নিরাকরেণর স্বাদ পায় (এবং জীবনানন্দ অথবা সংবাদই কাব্য)।

তাহলে জোর করে কি মানুষের মন থেকে কবিতাকে মুখে ফেলা যায়, মনে তো হয় না। কেননা তার দৃষ্টান্ত, কবির প্রায় অজান্তেই, তার কবিতা সমূহে উঠে এসেছে। এই অর্থবোধটিকে আরও বর্শামুখ করতে ব্রেশট'কে ব্যবহার করা যেতে পারে।

'বর্ণনামূলক ভংগি, যেমন মন্তাজ, মনোলোগ বা অ্যালিয়েনেশন পদ্ধতি ইত্যাদি সম্বন্ধে সব রকম সম্ভাব্য অভিযোগ তোলা যেতে পারে, কিন্তু বাস্তববাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোনো অভিযোগ আনা অসম্ভব যদি না অবশ্য আমরা আপাদ মস্তক আংশিক সর্বস্ব সংজ্ঞা করতে স্বীকৃত হই। স্পষ্টতই মনোলোগের আংগিকসর্বস্বতা বলে নস্যাৎ করে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু এমন অনেক অন্তঃস্থিত মনোলোগ ব্যবহার হতে পারে যা সথার্থ অর্থে বাস্তববাদী।'

কবি অনুভব করেছেন তার চারিদিকে অযৌক্তির অন্ধ সমাজ ও ব্যক্তির অসহায় অবস্থার টানাপোড়েন। সমাজ, যদি ধরি, একটি পূর্বাপর সম্পর্ক যুক্ত নিয়মানুগ সংগঠন, আর তাই, ঠিকমতো দেখলে, সামাজিক আবেগ ও ব্যক্তির অন্তর্গত আবেগ আসলে দ্বান্ধিক। কবি নানা অভিজ্ঞতায় ক্রমশ উপলব্ধি করতে পারে ব্যক্তি মানুষ একা আবার যুগপৎ সামাজিকও। এই জটিলতায় সে তার নিজস্ব সত্তাকেই সত্য এবং স্থিত, আর ভোগ করে চলে এক শর্তহীন শাস্তি, যা আপেক্ষিক অর্থে অদৃশ্য আবার বিমূর্তও বটে। কবি জন্মগত ভাবেই এই উপলব্ধির সন্ধান এবং বিশেষভাবে সৎ বলেই তার তথাকথিত কল্প জগৎও বিশেষভাবে সত্য।

তাঁর লেখার কোনো কোনো স্তর পরস্পর অদ্ভুত রহস্যমণ্ডিত, জীবনের প্রতি বিবমিষা বোধে আচ্ছন্ন, এক ধরনের ফ্যান্টার্সি। কিন্তু এসবই তাঁর কবিতার শেষ কথা নয়। কেননা তিনি কখনই তার কবিতায় কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্রয় দেন নি। তাঁর কাব্য চেতনা, বিষণ্ণতা আবর্ত এই সবকিছুই যেমন সত্য, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে আশ্চর্য রকম এক পজিটেভ দৃষ্টিভঙ্গি, উজ্জ্বল জীবনের জন্য এক তীব্র আকাঙ্খা ও তেমনি সুতীব্র। সুতরাং এই অর্থবোধ হতে উত্থিত মূল্যায়নের ম্যানিফেষ্টো'টিকে বাস্তবতার দৃষ্টিতে বলতেই হয়:

কবিতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে কবির মতাদর্শ ও

শব্দ জগতের মধ্যে তৈরী হয়ে যায় 

এক অভ্যন্তরীণ দূরত্বায়ন, এক আপেক্ষিক বিস্তারবোধ, যা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার এক অবিভাজ্য অংশ, যা সমগ্র 

শাব্দিক সৃষ্টিকর্মের ওপর যুগপৎ আলো আঁধারী,

যা ছায়াপাত ঘটায়, কখনো কখনো।

কেননা তাহল একটা কবিতার মধ্যে কত যে অন্য মানুষ লুকিয়ে থাকে, কত ভিন্ন ভিন্ন মেরুও তার দোষ গুণ, ভালোবাসা, ঘৃণা, দৃঢ়তা-দুর্বলতা সব মিলিয়েই সে একটা সম্পূর্ণ মানুষ অথবা কবিতা। এটা বুঝতে না পারলে কবিতা বিষয়টি উপলব্ধির বাইরে যেতে বাধ্য। কেননা তাহলে আবার ম্যানিফেষ্টোর পথেই হাঁটতে হবে।... সেই সময় ইঞ্জিনের তীব্র আলো, প্রাচীন বৃক্ষের ঘাত ঋষিকল্প নেই আলো তাহাদের শরীরে আসিয়া পড়িবে। তাহারা সেই আলোর চত্ত্বরে দাঁড়াইয়া আকাংখিত, পরস্পর রক্ত সান্নিধ্যের জন্য অপেক্ষা করিবে (সুবিমল মিশ্র, ১৯৭০)।'

তাহলে কবিও তার কবিতার প্রতিটি শব্দের অস্তিত্ব বাস্তব অথবা কোনো না কোন অন্য আর একটি বাস্তব-অস্তিত্বের দ্বারা অতিনির্ণীত। একের সঙ্গে অন্য আর একটার আন্তসংযোগ রয়েছে। মনে হয় আমার, আর আমি তা এইভাবে, উপরে দিলাম। হয়তো এটাও একটা ম্যানিফেস্টো, হয়তো....।

'দোকানের পথে অনেকগুলি কৌতূহলী বালক দ্বারা

পরিবৃত একদল যমপটক বা যমপটব্যবসায়ী 

পথ দেখাইতেছে। লম্বা লাঠিতে ঝুলানো পট

যা হাতে ধরিয়া আছে, ডান হাতে একটি শরকাঠি

দিয়া চিত্র দেখাইতেছে। বাঁ হাতে ভীষণ মহিষারূঢ়।

     প্রেতনাথ প্রধান মূর্তি।' -গুরুসদয় দত্ত (পটুয়া সংগীত)।

এমন বিস্তারিত উত্তরের পর আর কোনো আলোচনার প্রয়োজন আছে কি? তবুও আরও কিছু ইঙ্গিত এবং বেশ কিছু পদ্ধতির কথা বলে এই আলোচনা শেষ করব। কেননা আমি বিষয়টা ঠিক বোঝাতে পারলাম কিনা জানি না, অনুসন্ধান হীন অথচ মননবিমুখ...।

'হে মহান করুণাঘন বুদ্ধ

নববর্ষের প্রারম্ভে

আমি অতীতের সব কিছুকেই

গতকাল বলে মনে করি,....।

তাঁর (পরম পূজ্যপাদ শিক্ষক শিং য়ুন) এই লেখার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই নবজাগরণের বলিষ্ঠ সুর। আলোচ্য পংতিতে ক্ষুদ্র পরিসরে তৈরী হয়েছে বৌদ্ধ চেতনার ভাব।

'...এবং পৃথিবীর সাহায্যের জন্যে

যেন ভালো কাজ করি....।'

এখানে শব্দের ধাঁচ অতি সরলীকরণ হলেও ভাষার চিত্রায়ন উপস্থাপন করেছে ইতিহাস ক্রমগতিময়তা। অর্থাৎ অবক্ষয়ী পৃথিবীর সিংহদ্বার ভেঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হোক 'বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি।' তাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে......।

'বুদ্ধ চেতনার প্রাচুর্য

এবং সকল প্রাণীর মুক্তি.....।

তাঁর উপলব্ধি যথার্থ অর্থে সঠিক, কারণ মহাকারুণিক বুদ্ধের যথার্থ শিক্ষা অর্জনের মধ্য দিয়েই সমাজ সভ্যতা উন্নত হতে পারে।

'আমাদের দৃঢ় হতে হবে

আমাদের ব্যর্থতার জন্য দায়ী

গতকালকের শ্রমবিমুখতা

এই বিশ্বাস নিয়ে....।'

এখানে প্রকৃত জীবনবোধের উজ্জ্বল উপস্থিতি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বুদ্ধালোকে তিনি উজ্জীবিত। জীবনের সোপান এ ফুটে উঠেছে কবির উমা '... সুখে উপনীত হওয়ার পথ খুঁজে পাওয়ার জন্য বুদ্ধের কাছে যাচনা করো কেন?' কবির মতে বুদ্ধ চেতনায় উন্নীত হয়ে মানুষকে জ্ঞান মার্গে পৌঁছাতে হবে। কেননা একজন প্রকৃত মানুষের চিন্তা সকল সমর মহত্তর অনুভূতির দ্বারাই চালিত হয়, বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে নয়, কবিও এই ধরণের পদ্ধতি দিতে চেয়েছিলেন, সমজাতীয় এক প্রয়োজনে, তাঁর নিজের মেজাজ মর্জি অনুযায়ী।

এই কবিতায় কবি প্রচলিত ধ্যান-ধারণার ছক ভেঙ্গে বলেছেন,

'পবিত্র শরীর এবং মনই পথ,

এক পা পিছিয়ে যাওয়া

আসলে এক পা এগিয়ে যাওয়া'।

কারণ তিনি মানুষের এই মাটির পৃথিবীর জন্য আস্থাবান এক উচ্চারণ রেখেছেন। কেননা তাঁর মনে উদ্ভাসিত চিরন্তন এক প্রশ্ন: স্বাধীনতা, উদ্যম এবং অনুসন্ধান। অপর অর্থে তিনি বোঝেতে চেয়েছেন, মানুষ নিজেকে জানুক, নিজেকে বিশ্লেষণ করতে শিখুক।

'মনই বুদ্ধ

আমার একটা কাপড়ের ফলে আছে

সেটি উদ্বেগ শূন্য.....।

এখানে কোনো শাব্দিক যান্ত্রিকতা নেই, চর্যাযুগীন ভাবধারার রসে পুষ্ট সহজ অথচ গম্ভীর। অনেক কথাই বলে দেওয়া হয়েছে এখানে, এভাবে।

'একটা ভিক্ষাপাত্র নিয়ে সহস্র গেরস্থালী থেকে,

ক্ষুন্নিবৃত্তি করি...।

অনেক কবির কবিতার কোলাজ, কখনো সম্পূর্ণ, আবার কখনো ম্যানিফেষ্টোর ন্যায় প্রাণবন্ত। শিক্ষক শিং য়ুন'এর প্রচেষ্টায় সেগুলি হয়ে উঠেছে শব্দ, বাক্য, বিন্যাস এবং দর্শন। অন্য অর্থে কবিতার ভাষাকে ভাষার ভেতর থেকে বের করে আনার চেষ্টা।

.... আমরা সবাই আগামীকালের বোঝায় ভারাক্রান্ত,

বার্দ্ধক্য এগিয়ে আসছে 

সে ব্যাপারে খেয়াল নেই 

আমরা সংখ্যাতীত আগামীকালের

ছলনায় মুগ্ধ।

কবি সমাজ পরিবেশ থেকে তাঁর শিল্পের রস সংগ্রহ করেন। এমনকি যে রূপাশ্রয়ে তাঁর কবিতা সৃষ্টি, সেটিও সমাজ জমিন থেকে আরহিত। জগৎ সংসারের সব কিছুর মতো কবির চেতনা, বোধ, মনন সকলই নিয়ম শাসিত। তাই কবি বলতে পারেন-

'আমি জানি না ভদ্রলোক কথাটার মানে কি

কিন্তু দেখি.....।'

এরূপ অভিনব শব্দবান আর কেউ দিয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। কারণ মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে।

ড. রমেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং ড. মৌসুমী ঘোষ'এর প্রতি অপার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, কারণ তাঁরা যেভাবে এই অনুবাদ কর্মটি সম্পাদন করেছেন। তাঁদের এই সৃজনশীল কর্মের প্রতি এই কৃতজ্ঞতা'র বিষয়টি অতিশয় ক্ষুদ্র বলে মনে হয়েছে। সর্বোপরি পাঠক কূলের প্রতি আমার বিনম্র নিবেদন আপনার আপনাদের বুদ্ধি বিচার ও তাত্ত্বিক বিজ্ঞতা দ্বারা এই কবিতাগুচ্ছের তাৎপর্য বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করবেন তাহলে বিষয়টির গুরুত্ব সার্থক হবে। ৩৬৫ দিন এই মূল কবিতা রচনা এবং অনুবাদ সময়ের চিন্তন, মনন ও মস্তিষ্কের খোরাক এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। অলং ইতি বিত্থারেণ। 

 

পোর্ট ব্লেয়ার,

আন্দামান নিকোবর 

১৫ অগাস্ট ২০২৫

২৫৬৯ বুদ্ধাব্দ।

সুমনপাল ভিক্ষু

অতিথি অধ্যাপক 

পালি বিভাগ ও বৌদ্ধবিদ্যা অধ্যয়ন বিভাগ,

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, 

ও পালি বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

 

 

No comments:

Post a Comment