Tuesday, September 2, 2025

গ্রন্থ সমীক্ষা

 গ্রন্থ :  বৌদ্ধ দর্শনের ইতিহাস :  উপক্রমনিকা

লেখদক : ড. সুমনপাল ভিক্ষু
প্রকাশক : বোধি-নিধি পাবলিকেশন। 
প্রকাশকাক : ড. বেনীমাধব বড়ুয়া।
অনুবাল : ২০২৫।
পৃষ্ঠা : ৭২।
ভাষা : বাংলা।
মূল্য :  ২৫০/-।

ড. বেনীমাধব বড়ুয়া (১৮৮৮-১৯৪৮), এম.এ., ডি.লিট. (লন্ডন), কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১৯১৮ সালে উক্ত বিভাগে প্রথম যোগদান করেন এবং ১৯২৫ সালে উক্ত বিভাগের প্রথম স্থায়ী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। অধ্যাপক বড়ুয়া ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত পালি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর সুদীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে তিনি পালি ভাষা ও সাহিত্য, বৌদ্ধ দর্শন এবং প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলির উপর মৌলিক গবেষণা, পাঠদান এবং মুল্যায়ন করার মধ্য দিয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের পালি বিভাগকে পরিনত ও সম্পদশালী করে তোলেন। তিনি ১৯১৪ সালে বৌদ্ধবিদ্যার (Buddhology) একজন গবেষক হিসাবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তাঁর গবেষণাপত্র "Indian Philosophy-Its Origin and Growth from the Vedas to the Buddha" ১৯১৭ সালে গৃহীত হয়। তিনি উক্ত গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৭ সালে প্রথম ভারতীয় হিসাবে Doctor of Literature উপাধি লাভ করেন। তিনি উপরিউল্লিখিত গবেষণাপত্রটি পরিমার্জন করেন এবং তদনুসারে ১৯২১ সালে A History of Pre-Buddhistic Indian Philosophy নামে গ্রন্থটি লেখেন। উক্ত গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ড. বেনীমাধব বড়ুয়া প্রাচ্যবিদ্যায় (Oriental Studies) সুপরিচিতি লাভ করেন এবং বৌদ্ধবিদ্যায় একজন পথিকৃৎ হিসাবে পণ্ডিতমহলে অভিনন্দিত হন। পরবর্তীতে বহু মূল্যবান গবেষণামূলক গ্রন্থ লেখেন এবং বৌদ্ধবিদ্যায় সর্বজনীন খ্যাতি ও সম্মান অর্জন করেন। তিনি ১৯১৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগে যোগদানের সময় থেকেই বৌদ্ধবিদ্যায় নিজস্ব মৌলিক চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করতে থাকেন। Prolegomena to a History of Buddhist Philosophy প্রবন্ধটি ড. বেনীমাধব বড়ুয়ার অন্যতম পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ হিসাবে মূল্যায়িত হয়ে থাকে। 

বিনয়-এর বাংলা অনুবাদ। অনুবাদক দেখিয়েছেন যে A History of Pre-Buddhistic Indian Philosophy কিভাবে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। অনুবাদক Prolegomena to a History of Buddhist Philosophy প্রবন্ধটির অনুবাদ শুরু করেন আট বছর আগে। যদিও মূল ইংরাজি প্রবন্ধটি মোট সাতচল্লিশ পৃষ্ঠার, তবু এতটা সময় লেগে যাওয়ার কারন অবশ্যই প্রবন্ধটির বিষয়ের গভিরতা ও ভাষার উৎকর্ষতা। তাছাড়া প্রুফ সংশোধন করেতেও বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়। অবশেষে Prolegomena প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ "বৌদ্ধদর্শনের ইতিহাসঃ উপক্রমনিকা" সম্পূর্ণ হয়। ১৯১৮ সালে প্রথম প্রকাশিত এই মুল্যবান প্রবন্ধটিকে অনুবাদক সুমনপাল ভিক্ষু বাঙালি পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করলেন ২০২৫ সালের মে মাসে। বিলম্বিত হলেও অনুবাদকের এই কাজ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

"বৌদ্ধদর্শনের ইতিহাসঃ উপক্রমনিকা"-র বিষয়বস্তু নির্বাচিত হয় দুটি সম্প্রসারিত বক্তৃতার মধ্যে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিকিবিদ্যার স্নাতকোত্তর কোর্সের সভাপতির বিশেষ অনুরোধে ১৯১৮ সালের জুন মাসে উক্ত বক্তৃতাদুটির নির্ঘণ্ট প্রস্তুত হয়। মূল প্রবন্ধে কোন সূচিপত্র নেই কিন্তু ড. বড়ুয়া সমগ্র লেখাটিকে অনেকগুলি অনুচ্ছেদে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদের জন্য বিষয়ভিত্তিক ভাবে শিরোনাম রাখেন। বাংলা অনুবাদে ঐসকল বিষয়ভিত্তিক শিরনামগুলোকে সূচীপত্রে রাখা হয়েছে। উদাহরন হিসাবে দেখানো যেতে পারে যে, মূল ইংরাজি প্রবন্ধে প্রথম অনুচ্ছেদের শিরোনাম রাখা হয়েছে "The two-fold limitation of our subject of investigation" যার বাংলা ভাষান্তর করা হয়েছে "বৌদ্ধদর্শনের ইতিহাসবিষয়ক আমাদের দ্বিবিধ সীমায় অনুসন্ধান"। প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক বৌদ্ধদর্শনের চর্চাকে ঐতিহাসিক গৌতম বুদ্ধের লব্ধ জ্ঞ্যান ও চিন্তার উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর মতে বৌদ্ধদর্শনের যা কিছু বর্তমান তা ঐতিহাসিক গৌতম বুদ্ধের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত। যদিও বুদ্ধ-পূর্ববর্তী দার্শনিক চিন্তার ধারাকে কখনই প্রসঙ্গ থেকে আলাদা করা সমীচীন নয়। তবুও বুদ্ধ-পূর্ববর্তী বৈদিক বা উপনিষদিক দর্শনের বা বুদ্ধের সমসাময়িক জৈন বা লোকায়ত দর্শনের প্রতিপাদ্য বিষয়সমূহ থেকে বৌদ্ধদর্শনকে আলাদা করা সম্ভম। যেমন করে দুধ থেকে মাখন বা ঘি তৈরি হলেও ঘি কে কখনোই দুধ বলে আখ্যায়িত করা হয় না। ড. বড়ুয়ার মতে বৌদ্ধদর্শন তার পূর্ববর্তী বা পরবর্তী দর্শনের ধারাগুলো থেকে আলাদা কারন এটি আত্মা বা soul কে অস্বীকার করে। মধ্যপন্থার জীবনশৈলী হোল বৌদ্ধদর্শনের বিশেষ মৌলিক আবিষ্কার। এটি চরম ইন্দ্রিয়সুখ ও ভোগবিলাসের ধারাকে এবং চরম তপস্যা ও কৃচ্ছসাধনের ধারাকে বর্জন করে। এই দুটি পন্থার বিলল্প হিসাবে বৌদ্ধদর্শন একটি মধ্যপন্থার নির্দেশ দেয়। নির্বাণলাভ যা কোন অর্থেই পুনর্জন্ম নয়-তা বৌদ্ধদর্শনের প্রধানতম আবিষ্কার। লেখক মনে করেন যে, বৌদ্ধবাদকে (Buddhism) একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্মমত (organized religion) হিসাবে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ততোটা গুরুত্ব একটি স্বতন্ত্র দর্শনশাস্ত্র (philosophy) বা তত্ত্ব (theory) হিসাবে দেওয়া হয়নি। বর্তমান প্রবন্ধটি সেই প্রসঙ্গে বৌদ্ধবিদ্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

বৌদ্ধদর্শনের বিকাশ ও বিস্তার প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধারাবাহিক ভাবে ঘটেছে। ড. বড়ুয়া নিম্নলিখিত পর্বে সেটিকে বিভাজন করে বিশ্লেষণ করেছেন প্রথম পর্ব হোল রাজা বিম্বিসার থেকে রাজা কালাশোক পর্যন্ত; দ্বিতীয় পর্ব হোল বিরুদ্ধ মতবাদের যুগ যা রাজা কালাশোক থেকে রাজা কনিষ্ক পর্যন্ত বিস্তৃতি; তৃতীয় পর্ব হোল সর্বোৎকৃষ্ট পর্ব বা ক্লাসিক্যাল যুগ যা রাজা কনিষ্ক থেকে রাজা হর্ষবর্ধন পর্যন্ত বিস্তৃত; এবং সর্বশেষ বা চতুর্থ পর্ব হোল যুক্তিগত পর্ব যা গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে পাল সাম্রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রথম পর্বে বৌদ্ধ দর্শনের মূল উৎস পবিত্র ত্রিপিটক এবং মহাকাচ্চায়ানার তিনটি গ্রন্থ। দ্বিতীয় পর্বে আঠেরোটি বিশ্লেষক গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রসঙ্গত এই পর্বের মূল্যবান গ্রন্থরাজি বিলুপ্ত হয়েছে; শুধুমাত্র চীনা ও তিব্বতীয় ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে তা কিছুটা সংরক্ষিত হয়েছে। তৃতীয় পর্বে চারটি বিশেষ মতবাদের উত্থান হয়, যথা মাধ্যমিক, যোগাচার সৌত্রান্তিক, এবং বৈভাষিক। সর্বশেষ বা চতুর্থ পর্বের প্রধানতম উৎস বিদ্যাভূষণের ভারতীয় অর্থশাস্ত্রর উপর গবেষণা।

Prolegomena to a History of Buddhist Philosophy প্রবন্ধটি ইংরাজি ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সালে। বাংলায় অনুবাদের অভাবহেতু এই মূল্যবান প্রবন্ধটি বাঙালি পাঠকদের কাছে প্রায় ওজানা অথবা অল্পপরিচিত ছিল। সেই অভাবটি অবশেষে পূরণ করলেন সুমনপাল ভিক্ষু। ১৯২৫ সালের ১২ইমে, ২৫৬৯ বুদ্ধাব্দে কলকাতার বোধি-নিধি পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয় "বৌদ্ধদর্শনের ইতিহাস : উপক্রমনিকা" যা Prolegomena-র বাংলা ভাষান্তর বা বঙ্গানুবাদ। অনুবাদক সুমনপাল ভিক্ষু সাম্প্রতিককালে বাঙালি বৌদ্ধ সমাজের একজন উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তিত্ব হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। পালি, সংস্কৃত, হিন্দি, বাংলা, ইংরাজি, চীনা এবং তিব্বতী ভাষায় সুপণ্ডিত, সুমনপাল ভিক্ষু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহন করেন। বর্তমানে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগে এবং সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগে অতিথি প্রভাষক পদে কর্মরত। "বৌদ্ধদর্শনের ইতিহাসঃ উপক্রমনিকা" তাঁর অনেকগুলি অনুবাদকর্মের মধ্যে একটি অন্যতম কাজ। "বৌদ্ধদর্শনের ইতিহাস : উপক্রমনিকা" শুরু হয় 'অনুবাদকের কথা' দিয়ে, যা অনেকটা অনুবাদটির ভুমিকা। সেখানে অনুবাদক সুমনপাল ভিক্ষু ড. বেনীমাধব বড়ুয়ার মহতি জীবনের উপর বিশেষ ভাবে আলোকপাত করেন। বিশেষ ভাবে উল্লিখিত হয়েছে ড. বড়ুয়া-কৃত মধ্যম নিকায় এর ১ম খণ্ড এবং গৃহী প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার, চতুর্থ পর্বের মৌলিক গ্রন্থরাজি অধিকাংশই বিলপ্ত হয়েছে। শুধুমাত্র চীনা ও তিব্বতীয় পণ্ডিতদের লিখিত উপাদানে তা অবশিষ্ট আছে। প্রবন্ধটির শেষে বৌদ্ধদর্শনের মূল্যায়ন করা হয়। এটি বিশেষ করে উল্লেখ করা হয় যে, ঐতিহাসিক বুদ্ধের সময় থেকে পাল যুগ বা তারও পরবর্তী সময়ে ভারতীয় সমাজ, তার আভ্যন্তরীণ গঠন ও সামাজিক উপাদান, বিভিন্ন সংস্কৃতির উত্থান ও পতন এবং সর্বোপরি ভারতীয় সংস্কৃতির আধ্যাত্মবাদ ও যুক্তিবাদের ধারাকে গভীর ভাবে বুঝতে গেলে বৌদ্ধদর্শনের সামগ্রিক ইতিহাসকে মনোযোগের সহিত অধ্যয়ন করা আবশ্যক। তা না হলে, ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজের স্বরূপ আমাদের কাছে অসমাপ্ত রয়ে যাবে।

Prolegomena to a History of Buddhist Philosophy প্রবন্ধটি অতন্ত্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা। এর ভাষা অতি জটিল এবং ভাবনার জাল অতি সূক্ষ্ম। ড. বেনীমাধব বড়ুয়া লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধবিদ্যায় উৎকর্ষতা অর্জন করেছিলেন বৌদ্ধবিদ্যার সমকালীন মহান গবেষকগনের সাহচর্যে, যথা থমাস উইলিয়াম রাইস ডেভিডস, লেডি রাইস ডেভিডস, ফ্রেডেরিখ ওয়িলিয়াম থমাস, লিওনেল ডেভিড বারনেট এবং অন্যান্য। স্বীয় মেধা ও উল্লিখিত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে তিনি উন্নতমানের ভাষা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যুক্তি, ও গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত Prolegomena প্রবন্ধে উল্লিখিত তিনটি বৈশিষ্ট্যের সুস্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। এই প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ তাই যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য। অনুবাদক সুমনপাল ভিক্ষু এই দুরুহ কাজটি সাধ্যমত সম্পন্ন করেছেন। তবে বাংলা ভাষান্তরের ক্ষেত্রে অনুবাদক যদি প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য বাক্য গঠন করতেন, সঠিক শব্দচয়ন করতেন এবং ব্যাকরণগত ত্রুটিগুলোকে এড়িয়ে যেতে পারতেন, তাহলে পাঠকসমাজের কাছে অনুবাদকর্মটি অনেক বেশি আস্বাদিত হতে পারতো।

সমীক্ষক : ড. জ্যোতি বিশ্বাস
সহকারি অধ্যাপক
ইংরাজি বিভাগ
শেঠ সুরাজমল জালান গার্লস কলেজ
কলকাতা-৭০০০৭৩

No comments:

Post a Comment