সুমনপাল ভিক্ষু
পৃথিবীতে এমন কিছু ক্ষণজন্মা ও বিদগ্ধজন আছেন যাঁরা আপন গতিপথ থেকে এতটুকু বিচ্যুত হন না। ড. দীপক কুমার বড়ুয়া তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর। কোলকাতায় কে.জি স্কুলে পড়াশুনোর গোড়াপত্তন হয়। বউবাজার হাইস্কুল থেকে ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সহিত মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৫৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন (ইন্টারমিডিয়েট)। ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে পালিতে বি.এ. অনার্স পাশ করেন। ১৯৬০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম.এ. পাশ করেন। ১৯৬২ সালে লাইব্রেরী সায়েন্স পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা লাভ করেন ও স্বর্ণপদকসহ পি.আর.এস সম্মান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাউন্ট গোল্ড মেডেল লাভ করেন। ১৯৬১-৬২ সালে গবেষণার জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল “An Anlytical Studies of Four Nikayas.”
তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আজীবন সদস্য। তিনি একাডেমী কমপারেটিভ রিলিজিয়ন অব ইণ্ডিয়ার জীবন সদস্য। ২০০৩ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত হন। মহাবোধি সোসাইটি অব ইণ্ডিয়ার জীবন সদস্য ও লণ্ডন পালি টেক্সট সোসাইটির ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. বড়ুয়া বাঙালী বৌদ্ধ সমাজের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।
তাঁর গবেষণা কর্মের অবদান নেহাত কম নয়। এযাবৎ বাংলা-ইংরেজী মিলে তাঁর প্রায় ২৫ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। Buddhist Art in Central Asia, 1981 সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি নিয়েই সূক্ষ্ম আলোচনার অবকাশ রাখবো।
ড. দীপক বড়ুয়া কৃত Buddhist Art in Central Asia গ্রন্থটিতে মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধ শিল্পকলার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাই। এই মূল্যবান গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে prologue বা অবতরণিকা যেখানে মধ্য এশিয়ার অবস্হান এবং সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা তিনি পরিবেশন করেছেন। প্রথম অধ্যায়ের শুরুতেই ড. দীপক বড়ুয়া, ইউরোপ ও এশিয়ার ইতিহাস নির্মাণে মধ্য এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায়," Being
a connecting link between the East and West' from even the hoary prehistoric
antiquity Central Asia has been the great source of racial movement and
cultural diffusion and thereby has largely to contribute to the shaping of
history in Asia and Europe." অর্থাৎ অত্যন্ত প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন জাতির যাতায়াত এবং সাংস্কৃতিক ব্যাপনের মাধ্যমে মধ্য এশিয়া ইউরোপ ও এশিয়ার ইতিহাস নির্মাণে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে এসেছে। এরপরই ড. দীপক বড়ুয়া বৌদ্ধ শিল্পকলা বলতে কি বোঝায় তা সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কথায়, "... by 'Buddhist art we are inclined to take
into consideration here the art objects created on the Buddhist themes and by
the Buddhists only". অর্থাৎ বৌদ্ধ শিল্পকলা হল সেই শিল্পকর্ম যার বিষয়বস্তু এবং শিল্পী উভয়ই বৌদ্ধ। যেহেতু মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের গভীর সম্পর্ক রয়েছে তাই গ্রন্থটিতে এশিয়ার এই অংশে এই মহান ধর্মের অবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করা হয়েছে। মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস অতি প্রাচীন যা সূত্রপাত খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে। সেই সময়কাল তিনি সুচারুভাবে ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণ করতে তৎপর থেকেছেন, যা আদ্যপান্ত পাঠ করলেই অবগত হওয়া যায়।
সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, এর সূচনা হয়েছিল গ্রীক ব্যাক্ট্রিয় রাজ্যগুলির সমসাময়িককালে তবে সম্ভবত কয়েকজন প্রাচীন শিষ্য এখানে অনেক পূর্বে আকামেনীয় যুগেই এসে পৌঁছেছিলেন। পালি মিলিন্দপঞ্হে রাজা মিনান্দারের ধর্মান্তরণের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি এই গ্রন্থে পালি সাহিত্যের ঐতিহাসিকতা ও বিবরণও উপস্থাপন করেছেন।
মধ্য এশিয়ার সঙ্গে চীনের প্রাচীনকাল থেকেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রুশ ঐতিহ্য অনুসারে চীনের লো-য়াঙের প্রাচীন বৌদ্ধ প্রচাররকদের মধ্যে পশ্চিম তুর্কীস্তানের একটা বড় দল ছিল। গ্রন্থটিতে ড. দীপক বড়ুয়া মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং নিঃসন্দেহে এর ফলে এটির উৎকর্ষ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অধ্যায়টিতে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন স্থান এবং সেখানে আগত বিভিন্ন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কথা বর্ণনার উল্লেখ দেখা যায়।
গ্রন্থটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ড. দীপক বড়ুয়া, মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক যোগাযোগের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য, "But the cultural or otherwise relation between India
and Central Asia was established in very hoary days. We find that the dispersal
of Indian culture in Soviet Central Asia may be traced back to the earliest
period, i.e. to the Early Stone Age."
ড. দীপক বড়ুয়া গ্রন্থটিতে মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধ শিল্পকলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করে উপস্থাপন করেছেন, যথা--- চিত্রকলা বা painting, ভাস্কর্য বা sculpture, স্থাপত্য বা architecture.
এগুলির সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে যথাক্রমে গ্রন্থটির তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে। এগুলির মধ্যে চিত্রকলা সম্পর্কে অধ্যায়টি দীর্ঘতম, প্রায় ৩১ পৃষ্ঠাব্যাপী। (৬০ থেকে ৯১)। অবশিষ্ট অধ্যায় দুটি তুলনায় ছোট। Sculpture সংক্রান্ত অধ্যায়টি ৮ পৃষ্ঠার (৯২--৯৯) এবং architecture বা স্থাপত্যবিদ্যা সংক্রান্ত অধ্যায়টি ৬ পৃষ্ঠার( ১০০---১০৫)।
তৃতীয় অধ্যায়ে মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধ চিত্রকলার একটি বিস্তারিত বিবরণ উপস্থাপন করেছেন অধ্যাপক বড়ুয়া। এই অধ্যায়টির সূচনা তিনি করেছেন এইভাবে: "Painting is probably the richest and most varied
of the arts of Buddhist Central Asia", অর্থাৎ চিত্রকলা হল মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধ শিল্পকলার সবচেয়ে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় মাধ্যম। এই অধ্যায়ে অধ্যাপক বড়ুয়া প্রথমে আলোচনা করেছেন 'Central Asian Painting' বা মধ্য এশিয়ার চিত্রকলা বলতে কি বোঝায়। মধ্য এশিয়ার চিত্রকলা হল, "an
art tradition originating exclusively in Central Asia and developing in a
linear fashion", মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধ চিত্রকলাকে মূলত দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন স্থানীয় বৌদ্ধ শিল্পীদের আঁকা চিত্র এবং ভারতবর্ষ, ইরাণ হেলেনীয় প্রাচ্য এবং চীন থেকে আগত শিল্পীদের আঁকা চিত্র। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যদিও বিভিন্ন দেশের এবং বিভিন্ন ঐতিহ্যের চিত্রশিল্পীরা পরস্পরকে প্রভাবিত করেছে ভারতীয় বৌদ্ধ ঐতিহ্যকেই বিশুদ্ধ বলে মনে করা হয়।
বৌদ্ধ চিত্রকলা মধ্য এশিয়ার সাংস্কৃতিক জীবন নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রেও মধ্য এশিয়া ভারতবর্ষ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। লেখক কতৃর্ক এখানে আমরা বৌদ্ধ বিষয়ের পরিবেশনা দেখতে পাই, যেমন বুদ্ধের জীবন ও জাতক কাহিনীর চিত্রায়ণ। বৌদ্ধ স্থাপত্য শিল্পের উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় মধ্য এশিয়ার আফগানিস্তান, কুচ এবং খোটানে। খোটানের ক্ষেত্রে চিত্রকলার বিষয়বস্তু ছিল মূলত মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম থেকে নেওয়া কিন্তু মহেশ, গণেশ এবং সূর্যের চিত্রও দেখতে পাওয়া যায়।
স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে বলা যায় এই অঞ্চলে বৌদ্ধ শিল্পীরা অসংখ্য বিহার, মন্দির ও স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন যা এই এলাকার ধার্মিক মানুষকে একত্রিত হবার সুযোগ দিয়েছিল। স্থাপত্য শিল্পেভর মাধ্যমেও মধ্য এশিয়ার শিল্পীদের শৈল্পিক দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছিল। এক্ষেত্রে আমরা বামিয়ান ও কিজিলের কথা উল্লেখ করতে পারি। কিজিলে ভারতীয় ও ইরাণীয় ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটেছে।
ড. দীপক বড়ুয়া প্রণীত এই অমূল্য গ্রন্থটিতে অত্যন্ত সংক্ষেপে মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধ শিল্পকলা সম্পর্কে প্রাণবন্ত আলোচনা করে তিনি আমাদের মত সাধারণ পাঠককে ঋদ্ধ হতে সুযোগ করে দিয়েছেন। গ্রন্থটি পণ্ডিত ও সাধারণ পাঠক উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয়।
No comments:
Post a Comment