ভূমিকা
“যস্য সূর্যসমা দীপ্তর্যেন লোকঃ প্রকাশিতঃ।
পাবকোহপি মুনেস্তস্য চাস্হিমাত্রঃ জহৌ বপুঃ।”
– বুদ্ধচরিত, সপ্তবিংশ সর্গ
বহুচর্চিত কথাসাহিত্যিক হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত বিরচিত শেষ চিহ্ন উপন্যাসটি মূল অর্থে ভগবান বুদ্ধ সম্পর্কিত একটি বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসনির্ভর লৌকিক দলিল। এই উপন্যাসটিকে কোনভাবেই কল্পতরু বা ঔপনষদীয় আখ্যান বলা চলে না। কারণ ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাসে সমসাময়িক স্বপ্ন এবং কল্পনার পরিবর্তে ‘সূত্রধর’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যুক্তি-বুদ্ধি ও অগ্নিআখরে আসক্ত হয়েছেন। এক্ষেত্রে বলা যায় তাঁর এই সূত্রধরকামী ভূমিকা এক অর্থে নতুন গদ্যভূমি নির্মাণ করেছে। ফলে উপন্যাসটির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে তাকে সমৃদ্ধ ও শাখায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়। কারণ, তিনি বাস্তবিক অর্থে উপলব্ধি করেছেন সেই অমোঘ সত্যটি – “বিসংবাদ, বিকর্ষণ আর্য্যসত্য জাগ্রত জগতে।”
পালি সাহিত্যে দাঠাবংস গ্রন্থটি ধর্মকীর্তি মহাথের রচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ পালি কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে ভগবান বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ সম্পর্কিত বিস্তৃত আলোচনা পরিলক্ষিত হয়। উপন্যাসকার হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তের শেষচিহ্ন উপন্যাসে ভগবান বুদ্ধের সন্ন্যাসজীবনের সূচনা অর্থাৎ ঊনত্রিশ বছরের পরবর্তী জীবনবৃত্তান্ত অত্যন্ত সুন্দর এবং মর্মস্পর্শীভাবে উপস্থাপনের পাশাপাশি তাঁর মহাপরিনির্বাণের বিষয়টিও সূত্রধরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে উপস্থাপন করেছেন। তবে একটি বিষয়ের উল্লেখ না করলে বোধহয় মিথ্যাচার করা হবে। দুরযানী দৃষ্টির অধিকারী হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত বিষজর্জর একবিংশ শতকের একজন নৈষ্ঠিক ও দুঃসাহসিক কথাসাহিত্যিক হয়ে উঠেছেন। এই দুঃসাহস তারুণ্যের ক্ষণজীবী আবেগের স্ফুরণ নয়, ক্রমোন্নত হয়ে ওটা সুদৃঢ় চেতনায় চৈত্যের মতো স্হানকালব্যাপী একটি শাশ্বত জীবনের বোধে স্থিত।
হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত শেষ চিহ্ন উপন্যাসটিতে ইঙ্গিত করেছেন যে স্বপ্ন আর কল্পনা পৃথক হলেও তারা এক ঘরেরই বাসিন্দা, পরিপূরকও বটে। স্বপ্নের পরিশ্রুত বা বিশুদ্ধ রূপ কল্পনার এলাকায় চলে আসে। কল্পনায় যুক্তি বিচার সক্রিয় থাকে, স্বপ্নের অবস্থা সত্য হলেও তা অনেক ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক হতে পারে। সেই অর্থে তা সত্য বলেই গ্রাহ্য হয় কিংবা হয় না। স্বপ্ন যেমন সর্বজনের অভিজ্ঞতায় আছে তেমনই অযৌক্তিক ও সর্বমানবিক হয়েও সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত। সাহিত্য বা শিল্পকলা যুক্তির পরিসরকে পেরিয়ে যায় বলেই স্বপ্নের পথে বিচরণ করবার সাহস লাভ করে। এই অর্থে হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তের সারস্বত কল্পনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাস্তব স্বপ্নিল হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকদের কাছে বিষয়টি কিন্তু স্বপ্নে বিচরণ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন এবং পাথুরে প্রমাণ ও অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ হতে হয়। শেষ চিহ্ন উপন্যাসে ইতিহাস ও সাহিত্যের গতায়াতের এই বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবেই প্রতীয়মান হয়েছে।
পালি বৌদ্ধসাহিত্যের মতো মহাযান বৌদ্ধসাহিত্য (সংস্কৃত বৌদ্ধসাহিত্য) সেই অর্থে ততটা পরিপুষ্ট না হলেও অলৌকিকতা এবং কল্পনার বিষয়টি সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে এক্ষেত্রে বাস্তবতাকে সন্ধান বা অনুশীলন করা এক অর্থে অসম্ভব। কিন্তু এই অর্থে শেষ চিহ্ন উপন্যাসটি মহাযানের কল্পনাশ্রয়ীরূপে পরিপুষ্ট হয়নি। কারণ হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত মূল বৌদ্ধসাহিত্য বা পালি সাহিত্যসমূহের একটি অংশকে অত্যন্ত গভীর অর্থে অনুশীলন এবং হৃদয়ঙ্গম করেছেন। ফলে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে পরিশীলিত ভাবনার শীর্ষক অথবা বোধশব্দ। তবে অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়েছে এই উপন্যাসটি মূল অর্থে কোন উপন্যাস নয় বরং সৌন্দরানন্দ কাব্যের ন্যায় একটি সুদীর্ঘ গদ্যকাব্য। বাস্তবকে স্বপ্নাচ্ছন্ন করবার কৌশল বা স্বপ্নকে বাস্তবে নিয়ে আসবার ক্ষমতাই বা কতটুকু, তারই পরীক্ষা নিরীক্ষা করার অভিপ্রায় নিয়ে কথাসাহিত্যিক হিমাদ্রিকিশোর হয়ে উঠেছেন এক অর্থে ‘সূত্রধর’ আবার অন্য অর্থে ‘চারণকবি’।
হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তের শেষ চিহ্ন উপন্যাসটি কিশোর ভারতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলেও নানা কারণে তা গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হয়নি। ফলে বৃহত্তর পাঠক-পাঠিকাদের একাংশ অর্থাৎ যারা তাঁর সাহিত্যকর্মের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত তাঁরা ভগবান বুদ্ধের জীবনবৃত্তান্ত এবং দন্তধাতু সম্পর্কিত বাস্তবনির্ভর ইতিহাসনির্ভর শেষ চিহ্ন উপন্যাসের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত বা সমৃদ্ধ করতে পারবেন। সর্বোপরি উপন্যাসটির পরিকাঠামো ভাষা বিন্যাসের সরলতায় মুগ্ধ ও বিস্মিত হতে হয়। এই উপন্যাসটি কেবল তরুণ পাঠক-পাঠিকা নয়, সকল স্তরের পাঠক সমাজের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠুক।
সুমনপাল ভিক্ষু
No comments:
Post a Comment