Sunday, August 13, 2023

"আত্মজা" (এক অনুরণন - এক অনুধ্যান)

 ভূমিকা 


"অত্তনি অত্তমানং পস্স লোকং সদেবক,
নিবিট্ঠং নামরূপম্হি ইদ সচ্চ তি মঞ্ঞতি,
তং হি তস্স মুসা হোতি মোসধম্ম হি ইত্তর, 
অমোসধম্মং নিব্বানং তদরিয়া সচ্চতোবিদূ,
তে বে সচ্চাভিসময়া নিচ্ছাতা পরিনিব্বুতা তি। - সুত্তনিপাত, দেবতানুপস্স সুত্ত।

" আত্মজা" অর্থ পুত্রী বা কন্যা।  তবে এক্ষেত্রে তা তাঁর অর্থাৎ রীতা বড়ুয়া'র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছবি।  যোগ্য শক্তির পরাক্রম, বিনয় ও সদিচ্ছাকৃত জগৎ সেই অভিজ্ঞতা হতে তুলে আনতে পারা যায়। সুতরাং সেই অর্থে আত্মজা'র বোধ বা রীতা বড়ুয়া'র স্বাতন্ত্র্যতার স্বীকৃতি (নির্জ্জলা গদ্য কবি তার বাক্য) অত্যন্ত নমনীয় এবং চমৎকার। শব্দ ধ্বনি কোথায় এবং কিরূপে প্রযুক্ত হলে সাহিত্য তথা বাক্যরীতি লঙ্ঘিত হয় না, সেই জ্ঞান আত্মজাতে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান রয়েছে। যেমন 'মা' বিষয়ক কবিতাটি এক্ষেত্রে উজ্জ্বল........ হতে পারে - 
"......তোমার 
অন্তর এত আধুনিক 
সত্যের আলোয় উজ্জ্বল, 
ভুবন ভোলানো এত রূপ।"

অনুরূপভাবে বুদ্ধ বিষয়ক কবিতাগুচ্ছ সমূহে মহাকবি অশ্বঘোষ বিরচিত 'বুদ্ধচরিত' এর ভাবধারা সুস্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। 
"ততঃ প্রসন্নশ্চ বভূব পুষ্যস্তস্যাশ্চ দেব্যো ব্রতসংস্কতায়াঃ।
পার্শ্বাৎ সুতো লোকহিায় জঞে নির্বেদনং চৈব নিবাময়ং চ।।"

আবার এইভাবে - 
"উরোর্যথৌর্বস পৃথোশ্চ হস্তাত্থন্ধাতুরিন্দ্র প্রতওমস্য মূ্ধ্নঃ।
কক্ষীবতশ্চৈব ভূজাংসদেশাত্তথাবিধং তস্য ব্রভূব জন্ম।।"

অপেক্ষা (বুদ্ধবিষয়ক) কবিতাটি অনুরূপ আঙ্গিকে নির্মিত।

যেমন - "বৈশাখী পূর্ণিমার শুভ্র জ্যোৎস্নায়
আপ্লুত চরাচর 
ধরিত্রী মাতার প্রতিটি  অনুলোম
উম্মুখ মহাপুরুষের আবির্ভাব প্রত্যাশায়।"

আত্মজা'র কবিতা সংকলন গুলির প্রতি যথার্থ দৃষ্টি নিয়ে অবলোকন করলে সেগুলিকে সমৃদ্ধ শাখায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়। মূল কাণ্ডের শ্রেষ্ঠ ফলমূল যে অর্থে কাব্য -সাধনার অন্তর্গত হয়ে পরবর্তী কাব্য গুলিতে এক অনবদ্য প্রাণেরস্ফূরণ দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, ধম্মপদকেই দেখা যাক তার স্বাদই সম্পূর্ণ অর্থে ভিন্ন হলেও তা আস্বাদের অভিপ্রায়ে এক অনাবিল শাখাঙ্কুর উদ্গমে সাহায্য করেছে। রীতা বড়ুয়া এক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবলীল এবং পরিনত, কারণ তিনি সদ্ধর্মের বিশুদ্ধ রূপকেই যুক্তি বুদ্ধির মাধ্যমে পরিস্ফুট করেছেন।  সুতরাং এই অর্থে  বলা যায় যে সাহিত্য বা শিল্প কলা ( তা যে কবিতাই হোক অথবা অন্য কিছু)  যৌক্তিক স্বপ্নের পথে বিচরণ করতে করতে এক লহমায় যা জীবনমুখী বাস্তব রাজ্যে উপস্থিত হয় বা হতে পারে তা রীতা বড়ুয়ার লেখনীতে নব যৌবনা প্রকৃতির ন্যায় স্ফুরিত হয়েছে। এ ধরনের রচনার ক্ষেত্রে, বলা বাহুল্য, স্বপ্নে অবগাহন নয় বরং মনোভঙ্গীতে তিনি হয়ে উঠেছেন ' প্রি-রাফালিট' কবি। 
".......হয়ত ছিলাম 
বৈশালীর জেতবন বিহারের
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উদ্ভিদ হয়ে।
কিংবা হিরন্যবান্ধব সমুদ্র সৈকতে 
বিস্তীর্ণ বালুকা রাশি হয়ে। 

পুনঃ

জাতিস্মর নই তবু মনে হয় 
ছিলাম আমি, নিশ্চয়ই ছিলাম 
তথাগতের আসমুদ্র হিমাচলে
সাম্রাজ্য বিস্তার কালে।"

জীবন তার ইচ্ছাশক্তি দাবি করে। আর এই ইচ্ছাশক্তির অদম্য তাড়নার প্রতিফলিত রূপ হিসেবে আত্মজা'তে উদ্ভাসিত হয়েছে বৌদ্ধ আচার্যগণের বর্ণময় জীবনের কর্মসাধনা। শ্রীমৎ ধর্মাধার মহাস্থবির, সমন পুন্নানন্দ স্বামী, সত্যপাল মহাথের, ড. জিনবোধি মহাস্হবির,  প্রমুখ অগ্গমহাপণ্ডিতগণের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলীতে এই অভিপ্রায় দৃষ্ট হয়। এক্ষেত্রে কবি সুধীন্দ্রনাথের একটি  গুরুত্বপূর্ণ কাব্য 'নান্দীমুখ' এর কয়েকটি ছত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়। রীতা বড়ুয়া সম্ভবত সুধীন্দ্রনাথের প্রভাবকেই স্বীকার করেছেন। 

"তোমার যোগ্য গান  বিরচিত বলে
বসেছি বিজনে নব নিপবনে
পুষ্পিত তৃণদলে।"---- সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নান্দীমুখ। 

আত্মজা'র বুদ্ধ এবং অন্যান্য কবিতা সমূহের (কবিতা গুচ্ছ) বিষয়বস্তুতে এক উচ্ছাসময় পটভূমি আমাদের মনের অভ্যন্তরে পাঠসুখের উৎসুখতা তৈরী করে। এক্ষেত্রে তার ব্যাস ও অতীত -বর্তমান -অনাগত যা জীবনের জলছবি তথা নিজের মনোদর্পণে সুস্পষ্টভাবে ফলিত করার বিষয়টি যেভাবে তিনি অঙ্গনমঞ্চে উপস্থাপন করেছেন তা সত্যঅর্থে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছবি। যোগ্য শক্তির পরাক্রম, বিনয় ও সদিচ্ছাপূত একটি জগৎ আমরা সে অভিজ্ঞতা হতে মনের উপর তুলে আনতে পারি। তাছাড়া অনবদ্য শাব্দিক ভঙ্গিতে 'পিওরপ্রোজ' (নির্জ্জলা গদ্য ভঙ্গীর বাক্য) ব্যবহারের রীতি ও কৌশল যে অর্থে তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে তাতে মনে হয়েছে শব্দ-ধ্বনি কোথায়  কীরূপে প্রযুক্ত হলে কাব্যরীতি লঙ্ঘিত হয় না এজ্ঞান রীতা বড়ুয়া অত্যন্ত সুন্দর ভাবেই রপ্ত করেছেন। এক্ষেত্রে উদাহরণ রূপে তাঁর কবিতাগুচ্ছের 'চাষী'  কবিতাটির ছত্র ব্যবহার করতে পারি। যেমন -

".......তারপর, 
যাকে স্নেহছায়ায় লালন করেছি 
নিঠুর আমি, নিপীড়ন করতে থাকি 
দু'হাত দিয়ে 
অবশেষে,......। "

রীতা বড়ুয়া কবিতা রচনার পাশাপাশি ছোটগল্প রচনার প্রশ্নে যেভাবে আধুনিক তার পরিচয় দিয়েছেন তাতে 'ডায়াসপোরিক' চিন্তা চেতনার বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়েছে তিনি রচনা সত্তাকে কোন একটি নির্দিষ্ট আঙ্গিকে গড়ে তোলেন নি বরং তিনি তাঁর রচনাকে প্রকৃতির সত্ত্বার প্রশ্নে মুক্তি না দিয়ে বিরাট বিপরীত যাত্রা পথের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর এই গল্প রচনার আঙ্গিককে তিন ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন - তিনি বাস্তববাদী শব্দ রচনায় প্রাচীনত্ব ও নবীনত্বের প্রভাব এবং তীব্র মনস্তত্ব অতিমাত্রায় দৃষ্ট। এক্ষেত্রে টমাস হার্ডির রচনার মনস্তাত্ত্বিক ছায়া ও দৃশ্য বিন্যাস অনেক ক্ষেত্রেই তাকে প্রভাবিত করে বলেই মনে হয়। অর্থাৎ এই অর্থে রীতা বড়ুয়া এবং আত্মজা একে অপরের পরিপূরক বা মাইলস্টোন বলা যেতেই পারে। 

অলং ইতি বিত্থারেন

সুমনপাল ভিক্ষু

No comments:

Post a Comment