সুমনপাল ভিক্ষু
নিভৃত, প্রচারের আলো থেকে অনেক দূরে থাকা এ কবির নাম তরুণ সান্যাল। একান্ত সাধনায়, পরম অভিনিবেশে যারা উজ্জ্বল করে গেছেন বাংলা কবিতার ভাণ্ডার তিনি তাদেরই একজন।
অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের
পাবনার পোরজনা গ্রামে কবি তরুণ সান্যালের
জন্ম ১৯৩২ সালের ২৯ অক্টোবর। প্রাথমিক পড়াশুনা নওগাঁতে, পনেরো-ষোলো বছর বয়সে দেশত্যাগ করেছিলেন দেশভাগের সেই উত্তাল সময়ে। শৈশবের সেই স্মৃতিমাখা জন্মভূমির
কথা তাঁর সত্তার মধ্যে চিরজাগ্রত ছিল।
১৯৭১ সালে, বাঙালি যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, তরুণ সান্যাল তখন ছিলেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ আলোড়িত করেছিলো ১৯৬৮ সালেই ‘তোমার জন্যই বাংলাদেশ’ নামের কাব্যগ্রন্থের জনককে।
তাঁর জন্মভূমি, গ্রাম, তাঁর চিন্তাচেতনায় চিরজাগরূক ছিল ছেড়ে আসা স্বদেশ।
১৯৭১-এ পাকিস্তানের অপশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার অনুপুঙ্খ ছবি তাঁর মানসপটে উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়েছিল।
১৯৪৭-এ ভারত ও পাকিস্তান
রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে
বঙ্গ বিভাগের মতো নির্মম ঘটনা ঘটেছিল। তরুণ সান্যালের
মতে "আমার মনে আছে দেশভাগের পরে বাবা বলতেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান
টিকবে না’। দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলার সম্পন্ন হিন্দুরা দলে দলে চলে আসে ভারতে। দেশের একটা বড় অংশ বুদ্ধিজীবী তার মধ্যে ছিল। বাবা বলতেন, একটা বাড়ি বানাতে যা খরচ হয় তারচেয়ে অনেক বেশি খরচ হয় একজন ডাক্তার, উকিল বা ইঞ্জিনিয়ার
তৈরি করতে। আমার ধারণা, বঙ্গ বিভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে যে বুদ্ধিজীবী সমাজের সংকট তৈরি হয়েছিল সেটি পূরণ করতে তাঁদের বহু কষ্ট করতে হয়েছে। ক্ষুদিরাম,
সূর্য সেনের নতুন মুখাবয়ব পেয়েছিল ভাষা-আন্দোলন তথা স্বাধিকারের লড়াই। তাই-ই ক্রমে জন্ম দিয়েছিল ১৯৭১। বঞ্চনা আর অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল বাঙালি।"
তিনি ‘মাটি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন, তার খানিকটা অংশ–
প্রত্যাশায় বৃষ্টি হয়? মাঠ রুক্ষ ফাটা হাত
অঞ্জলি সাজালে বৃষ্টি আসে?
এবড়ো থেবড়ো জমি, ধুলো ওলোটপালট
কোন দক্ষিণের হাওয়ায় উদোম
এবং নয়ানজুলি বেয়ে নেমে গেছে ঘাস, দাম,
হলদে কচুরিপানায়
পরিণাম
দিনক্ষণ চলে যায় অশ্লেষা-মঘায় বারবেলায়
রবিবার বহে যায় অন্য এক শনিবারে
জলের ঢলক নোনা গাঙে
নামগুলি বহে যায় পিতামহ থেকে পৌত্রে
এমনি করে ঢেউ ওঠে ভাঙে
শালতির উপরে কার পায়ে সোনা জ্বলে
আউসে আমনে
বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিলেন মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সঙ্গে। তাই ‘বাংলাদেশ’ নামের ওই কবিতায় ধরা পড়েছে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের
ছবি।
তরুণ সান্যালের ‘মা আমার বাংলাদেশ’
নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশ কোনোরকমে
উঠে দাঁড়াচ্ছে তখন, তিনি লিখেছিলেন–
সদ্যোজাত বাছুরের টলমল দাঁড়ানো দেখে
স্নেহার্দ সে বিশালাক্ষী,
প্রতিরক্ষা তীক্ষ্ণ শিঙে গম্ভীর হাম্বায়
মা আমার বাংলাদেশ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাদ মোছে তারই
ও-কি মরচে জ্বলে যাওয়া অঙ্গারকুসুম
খর খঙ্গে ঝকমকায়,
ওকি করশান শুদ্ধ তরবারি!
এই ভালোবাসার সাথে গভীর বেদনাময় উপলবদ্ধিও। যেখানে ভারতভাগের ঐতিহাসিক যন্ত্রণাকে দেখতে পাই। তাঁর অনবদ্য গদ্যসংকলন
যা এযুগের যুবাদেরও অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত সেই ‘রেনেসাঁস স্বদেশে বিদেশে’ গ্রন্থে তিনি লেখেন – “রেনেসাঁস যে জাতি গড়তে চেয়েছে সেই জাতিগঠন বিড়ম্বিত হয়ে গেল সামন্ততান্ত্রিক পিছুটানে।...
আমাদের দেশে রেনেসাঁসের মানবমুখিনতাকে আঘাত করেছিল ধর্মকে বাহন করে রাজনীতি।... বাঙালী নবজাগরণের প্রধান পুরুষেরা প্রথম রাউন্ডে পরাজিত হয়েছিলেন জিন্নাহ-শ্যামাপ্রসাদের কাছে। ভাবা হয়েছিল বুঝি এবার সেই মহানেরা জয়ী হতে চলেছেন ১৯৭১-এ। সে ধারণা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।
তরুণ সান্যালের ভাষায়– ‘আমার লেখা ও প্রায় প্রতিটি কবিতাই নিসর্গ, প্রকৃতি, সমাজ ও আত্মবিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে
রচনা’ এবং তরুণ সান্যালের
মতে কবি হলো "এক বিপ্লবী ব্যক্তিস্বরূপ"। তরুণ সান্যাল মতে, ‘কবিতা তো মানবসমাজের
এক ভিন্ন ধরনের ভাষা, বিশেষ জাতি বা সমাজ অংশে জন্ম নেওয়া স্পর্শপ্রবণ
ব্যক্তির হয়ে ওঠে, যা কবিতা রচনার ভিত্তি।’
কবি বেড়ে উঠেছেন সাম্যবাদী চেতনায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ ১৯৫৬ সালে। সাম্যময় এক উজ্জ্বল সমাজ গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায় কবি হয়ে উঠেছেন তরুণ সান্যাল। তরুণ সান্যালের
কবিতায় স্পষ্ট হয়েছে প্রতিবাদী
ও সমাজবিশ্লেষণ, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক অসন্তোষ ও উদ্বাস্তু
সমস্যা। আসলে সামাজিক ইতিহাসে সচেতন অধ্যাপক কবি জানেন এক সময় মানুষের মনুষ্যই ছিল সব কিছুর পরিমাপের একক; এখন পোষ্ট মর্ডাণ যুগে বা ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পর মুনাফাই সব। পুঁজিবাদি শাসন কাঠামোয় সব কিছু ব্যাক্তি মালিকানায় এখন বিশ্বাসি হয়ে পড়ছে সমাজ। তিনি তাঁর ‘ভবিষ্যৎ সমাজ’ প্রবন্ধে সুচিন্তিত
মতামত দিয়ে বলেন- “ মানুষ তার নিজ দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ করবে অভাবমুক্ত
সমাজে’’। তাঁর স্বপ্ন জাগরণে ছিল মানব মুক্তি –
“পুর্নবার ফিরে আসে তিতুমীর, বিরসা, সিধু
দিব্যক, মঙ্গল পাঁড়ে. রোডেসীয়া,
লুমুম্বা, লেনিন
একেকটি তরঙ্গ”। (সময়ের হাতে)
তাঁর কাব্যভাবনায় পঞ্চাশ দশক-চিহ্নিত যৌবনের যে অতৃপ্তি ও যন্ত্রণাবোধ তা-ই যেন এ কবিতার
পঙক্তিতে ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন:
কৈশোর গেছে উনপঞ্চাশী
বজ্রে
সে যে কী জ্বালার দুঃসহতম ভ্রান্তি
তাঁর কবিতা রচনায় শব্দ ও শব্দ-প্রকরণ, ছন্দ ও ধ্বনিময়তার বিন্দুমাত্র
বিচ্যুতি ছিল না। প্রেমের কবিতাতেও তিনি জানাতে ভোলেন না: ‘মানুষের শত ক্ষুধিত মিছিলে মুক্ত/ প্রবাহের ধ্বনি শুনেছি।’
পঞ্চাশের হয়েও তরুণ সান্যাল ‘কৃত্তিবাস’
এবং ‘শতভিষা’— যে দুইটা গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যস্রোত তার থেকে তিনি একেবারে আলাদা ছিলেন এবং কখনোই প্রচলিত ধাঁচের কবিতা লেখেননি।
১৯৫৪ সালে বা ৫৩ সালে ‘কৃত্তিবাস’ বেরোলো, তিনি ‘কৃত্তিবাস’-এর কয়েকটা সংখ্যায় লিখেছিলেন
পরপর। এদিকে ‘পরিচয়’-এ নিয়মিত লিখতেন। ‘সাহিত্যপত্র’-এ লিখতেন। দেশেও লিখতেন। ফলে তাঁর মধ্যে পরস্পরের কবিতা নিয়ে খুব বিরোধিতা ছিল না। তাঁর মতে "আমরা সবাই একটা পরাধীন দেশ থেকে স্বাধীন দেশে এসেছিলাম।
এবং আমার অধিকাংশ কবিবন্ধু পূর্ববঙ্গের অধিবাসী ছিল। যে দেশের প্রকৃতিতে
তারা বড় হয়েছিল সেই তরুণ বয়সে তারা পশ্চিমবঙ্গে
চলে গিয়েছিল। ফলে আমাদের কবিতা আদতে বাংলাদেশী কবিতা ছিল। ফলে জীবনানন্দের মাছরাঙা, আমাদের দেশে নদী, আমাদের দেশের পশ্চিমবঙ্গের এটা ওটা সব মিলিয়ে সেগুলো আমাদের কবিতাতে আসত। ফলে এই কবিতার ভেতরে সুনীলও যা লিখেছে, আমি যা লিখেছি, শক্তিও যা লিখেছে, যদিও শক্তি পশ্চিমবঙ্গবাসী কিন্তু তার ঝোঁকটা ছিল আমাদের সাথে, সে যা লিখছে তার সঙ্গে জীবনানন্দ দাসের কোনো তফাত নেই।"
তরুণ সান্যাল, এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
"আল মাহমুদ আমার সমবয়সী বন্ধু। একই সময়ে লিখেছি। শামসুর রাহমান সামান্য বড়। আর অনেকেই একই প্রজন্মের মানুষ। কিন্তু ঘটনা হলো যে, আমি কবছর আগে বাংলা একাডেমিতে এসেছিলাম,
৯১ না কোন সালে যেন, আমাকে অনেক কবিরা প্রশ্ন করেছিল, আমাদের কবিতা এবং পশ্চিমবঙ্গের কবিতার ভেতর মৌলিক তফাৎ কী দেখেন? আমি যদিও খুব তফাৎ দেখি না, তবু তোমাকে একটা কথা বলি, তোমার লড়াইটা আমাদের চেয়ে বেশি। তার কারণ, ধরো, আমার পেছনের দিকে তাকিয়ে আমি বাল্মিকী থেকে শুরু করে মধ্যযুগের
সমস্ত কবিদের পেয়ে যাই। তারপর ধরো ঈশ্বরগুপ্ত থেকে ধরে একদম রবীন্দ্রনাথকে পাই। তার আগে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে পাই। পরবর্তীকালে সত্যেন দত্ত হয়ে একদম জীবনানন্দ
আমি পড়েছি। এটা উত্তরাধিকার। আর তোমাদের উত্তরাধিকার,
তুমি ক্ষমা করে দিও, বললাম, তোমার উত্তরাধিকার হলো পাকিস্তান হওয়ার পর। তোমাকে ধাক্কা দিয়ে একদম পাকিস্তানি
করে দিয়েছিল। ফলে তোমার উত্তরাধিকারে রবীন্দ্রনাথ
তো নেই-ই, বরঞ্চ রবীন্দ্রসঙ্গীত বন্ধ করেছিল। নজরুল ইসলামও তোমার নেই। এবং তোমার জীবনানন্দও
নেই। তোমার এগুলো ছিল না। তোমাকে লড়াই করে দখল করতে হয়েছে। ফলে দুটো দুরকম হবে।"
তিনি আরও বলেছেন,
"আমি শুধু তরুণ কবিদের বলব, যারা কবিতা লেখে তাদের জনজাতির গভীরে গোপনে আছে যে মহাস্রোত,
তা হলো যে, তারা চিত্র-বিচিত্র-চিত্রকল্পের ভেতর দিয়ে বিভাসিত হয়, সে বিষয়ে দারুণভাবে
চৈতন্যধর হতে হবে। দ্বিতীয়ত এগুলোকে প্রকাশ করতে গেলে পরে কবিতার ছন্দ সম্পর্কে খুব সচেতন হওয়া দরকার। রবীন্দ্রনাথের গানের অধিকাংশই স্বরবৃত্ত
ছন্দে লেখা। আদতে আমার মনে হয় বাঙালি কবিদের স্বরবৃত্ত ছন্দটা পরীক্ষা করা উচিত। আর অক্ষরবৃত্ত তো স্বাভাবিক, আমাদের দেশের ধর্মই ছিল, আগে বলা হতো মায়ের ছন্দ মেয়েলি ছন্দ, স্বরবৃত্ত। ওটা হলো শূদ্রছন্দ।
আর ব্রাহ্মণ ছন্দ হলো অক্ষরবৃত্ত। যাতে সমস্ত পণ্ডিতদের
বইপুস্তক লেখা। পাঁচটা বৃত্ত রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে বিকশিত হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে শুরুতে স্বরবৃত্ত,
পরে অক্ষরবৃত্ত,
এরপর দুটো মিলে মাত্রাবৃত্ত। কথনের ভেতর অক্ষরবৃত্ত।
উভয় মিলে মাত্রাবৃত্ত। এগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার। প্রত্যেকটি কবিতাই একটি বিস্তৃত চিত্রকল্প। কবিতাটা যেন সেই চিত্রকল্পের উপযুক্ত প্রাসঙ্গিকতা পায়। আর মানুষকে ছাড়া কবিতা হয় না। ফলে মানুষকে বাদ দিয়ে অন্যকিছু হতে পারে, কবিতা হবে না। একেকটা কবিতার ভেতরে একেকটা বিশ্বজগত ঘুমায়।"
তরুণ সান্যাল নিজেই বলেছেন, তিনি খুব দুঃখী প্রজন্মের মানুষ। কারণ দেশ ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একটা বড় দুর্ভিক্ষ
দেখেছেন। আন্দোলন দেখেছেন। মানুষকে মরতে দেখেছেন। এবং নানা রকম আর্ত অবস্থায় তাদের দেখেছেন। তাঁর কাছে দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্ট— স্বদেশ।
কবিতা লেখা নিয়ে তিনি বলেছেন,
"তুমি যা লিখবে আমি যা লিখব, এই সমস্ত ক্ষেত্রে একটা প্রজন্মের
পর প্রজন্ম মানুষের সৃজনধর্মিতা
থাকবে।"
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের অশেষ আশার অভিব্যক্তি হৃদয়ে অনুভব করে কবি, যখন ‘মানুষ দুঃসহ ক্রোধে মাথা ঠোকে রাতের তিমিরে’, প্রার্থনা
শুধু রৌদ্রের।
........................... ‘তোমাকেই দীর্ণ দীন জীবনের নক্ষত্রবিলাসে/ বারবার উন্মোচন করি’।
ব্যক্তিগত
বেদনার সঙ্গে মানুষের বেদনায় কবি লেখেন– ‘এমন অকাল মৃত্যু স্বদেশের স্বকীয় শিবিরে/ জুড়ে আছে।’ তবু আশা জাগে– ‘আমার বিশ্বাসে প্রেম/আমার সত্তায় বিজয়িনী।’
তাঁর কাব্যগ্রন্থেই অসাধারণ চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে:
"বেদনার নিখিলে মিশিয়ে
আমার কুণ্ঠিত প্রেম এককোণে শিশিরের জলে
কালের পাষাণে ম্লান ছবি আঁকে।"
‘অন্ধকার উদ্যানে যে নদী’ (১৯৬১) ও ‘রণক্ষেত্রে দীর্ঘবেলা
একা’ (১৯৬৮) কাব্যগ্রন্থদু’টিতে ‘অতি ব্যক্তিগত’
কথারা ফুটে ওঠে:
"বাতাস দিয়ো না আমার শিওরে দোলা,
শোনো টুপটাপ রাতের শিশির ঝরে,
কার হৃদয়ের দুয়ার এখনও খোলা
আলোছায়া মুখ, কার মুখ মনে পড়ে"
কিংবা
"ভালোবাসা সবুজ কলম, ঠোঁটে কালি
কিন্তু আলো যদি ছোঁয় তোমার চিবুক
সব কালি ম্লান হয়ে যায়।"
চতুর্থ পেরেক (১৯৮১), কায়া নৌকায় (১৯৮৯), নিতান্ত পুঁতির টায়রা (১৯৯০) এবং কবি এক জাগে (১৯৯৫) কাব্যগ্রন্থগুলিতে আশাহতের বেদনা জাগে। ‘সর্বনাশ ও সর্বস্ব’ সমাজজীবনে
যেখানে কবিমন ক্ষয়িষ্ণু, আত্মসর্বস্ব,
স্বার্থজর্জরিত মানব সভ্যতার সমাধি-লিপি রচিত হয়েছে-
“প্রভু চলেছেন কাঁধে ক্রূশকাঠ গলগোদার দিকে / প্রভু চলিছেন / মুক্তি কাঁটার মুকুটে বিঁধে আছে / না, তোমারও মুক্তি নেই, যাও / সিংহের দাঁতের নীচে, ঘাতকের খড়গের তলায়, যাও / প্রভুর নির্দেশ (
চতুর্থ পেরেক)। তাঁর চেতনায় তৈরি হয়েছে তাঁর জীবনবোধ ও কাব্যভাবনায় আচ্ছন্ন কবির মন দোলাচলে, সংশয়ে।
কবি তরুণ সান্যালের
কাব্যভাষা পঞ্চাশের অন্য কবিদের থেকে শত মাইল দূরে। তিনি তাঁর সময়ের মধ্যেই এক স্বতন্ত্র
কণ্ঠস্বর। তিনি নির্দ্বিধায় জনতার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের
ভূমি থেকে। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিচ্যুতি তাঁকে উদ্বেল করেছে, শ্রেণি ও সমাজের প্রতি তাঁর যে দায়বদ্ধতা,
শুধু কাব্যজীবনের
মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, আর আমরা পেয়েছি এক প্রতিবাদী
কণ্ঠস্বরকে, যিনি নির্দ্বিধায় জনতার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের
ভূমি থেকেই। তাই বলতে পারি তিনি স্বাধীনতা সময়বর্তী কবি হলেও আজও কবির ভাবনা অমিল, কালগত দিক থেকে এখনও তাঁর ভাবনা, জীবন-দর্শন সমান ভাবে প্রযোজ্য।
No comments:
Post a Comment