সুমনপাল ভিক্ষু
অর্থকথা আচার্য বুদ্ধঘোষ তথা ভিক্ষু নাগসেনের ধর্মকথায় ধুতাঙ্গ বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন- "সাধারণের মন সদা চঞ্চল-বিক্ষুদ্ধ। এই অস্থিররতা কেন? লোভ-দ্বেষ-মোহ তথা অবিদ্যা আর তৃষ্ণার তাড়নায়। সুখ, শান্তি, বিমুক্তি ও নির্বাণের বিমল আনন্দ লাভের পথে এই অন্তরায় সমূহের সংক্ষিপ্তত নাম ক্লেশ বা ‘কিলেস’। বুদ্ধ এই ক্লেশকে মার বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই মার প্রাণীকুলকে অহরহ দুঃখ তাপে ক্ষত বিক্ষত করে বলেই মার। এই ক্লেশ-মারকে “ধুনন” ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করণে যে শীল সংযমতা অনুশীলন অপরিহার্য তারই নাম ধুতাঙ্গ”। ধুত শব্দের অর্থ বিশুদ্ধভাবে ধোয়া। ধুতাঙ্গ হচ্ছে চিত্তের অবিদ্যা, তৃষ্ণা , ক্লেশাদি নীবরণ ও সংযোজনকে তুলোর ন্যায় ধুনন নিধুনন করবার বিশুদ্ধভাবে ধোয়ার অঙ্গকে বুঝায়। ধুতাঙ্গ অনন্ত, অসীম, আয়ত, বিপুল, বিস্তৃত, নির্মল, অতুল্য, অপ্রতিরূপ, অপ্রতিভাগ, অতি উত্তম, শ্রেষ্ঠ, প্রধান, মহৎ ও মহান হয়ে থাকে। ধুতাঙ্গ উচ্চতর শীল সংযম ও ত্যাগের অঙ্গ। ধুতাঙ্গ শীল মনের পাপমল বিধৌতকরণে উৎকৃষ্ট ঔষধের ন্যায় কাজ করে। স্মৃতি সংযম রক্ষার জন্য, সংশয় সমুচ্ছেদের জন্য, তৃষ্ণা পিপাসা নিবারণের জন্য, শ্রামণ্য ফল বৃদ্ধি প্রাপ্তির জন্য, ক্লেশমল ধৌত করার জন্য, ধর্মজ্ঞান অর্জনের জন্য, চার প্রকার স্রোত উত্তরণের জন্য, নির্বাণ সুখ লাভের নিমিত্ত, জন্ম, জরা, ব্যাধি, মরণ, শোক, পরিদেবন, দুঃখ, ভয় নিবারণের জন্য, শ্রমণ্য গুণ সমূহ রক্ষার নিমিত্ত, অসন্তোষ ও কুচিন্তা রোধ করার জন্য, সমথ, বির্দশন, মার্গ, ফল ও নির্বাণ দর্শনের জন্য, মারকে পরাস্ত করার জন্য, লোভ-দ্বেষ-মোহ তথা অবিদ্যাদি যন্ত্রণা হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য, সপ্ত বোধ্যঙ্গ সহ সাইত্রিশ প্রকার বোধিপক্ষীয় ধর্ম আয়ত্বের জন্য, প্রভৃতি গুণরাশি আয়ত্ব করতে ধুতাঙ্গাদি সাহায্য করে।
শীল পালনের প্রতি অধিষ্ঠান গ্রহণের প্রতি আন্তরিক থাকা। পঞ্চশীল পালন করব এই অধিষ্ঠানের মধ্যে স্থির থাকা এটাও ধুতাঙ্গ। একাধিক বছরের জন্য অষ্টশীল নেওয়া এই বছরের মধ্যে কোন প্রকার ইতস্ততা না করে আন্তরিকভাবে শীলের প্রতি ব্রত পালনের প্রতি আস্থা উৎপন্ন করাই ধুতাঙ্গ। বুদ্ধ অনেক শীলের ব্যাখ্যা করেছেন যেগুলির প্রতি সাধারণ পুদগলের ধারনা নেই।
যেমন:-
১। পঞ্চশীল
২। অষ্টশীল
৩। দশশীল
৪। দশ সুচরিতা শীল
৫। দশ চারিত্র শীল
৬। দশ বারিত্রশীল
৭। প্রাতিমোক্ষশীল
৮। ইন্দ্রিয় সংবরনশীল
৯। ইন্দ্রিয় পারিশুদ্ধিশীল
১০। প্রত্যয়সন্নিশ্রিত শীল
১১। আজীব পরিশুদ্ধশীল
১২। ১৩ প্রকার ধুতাঙ্গশীল
১৩। ১৪ প্রকার খন্ধকব্রতশীল
১৪। ৮২ প্রকার মহাব্রতশীল
১৫। ক্ষুদ্রশীল, মধ্যম শীল ও মহাশীল ভেদে শীল অনেক প্রকার রয়েছে (ব্রহ্মজাল সূত্র)।
এখানে ১৩ প্রকার ধুতাঙ্গের মধ্যে :-
১। পাংশু কুলিক ধুতাঙ্গ
২। ত্রৈচীবরিক ধুতাঙ্গ
৩। পিণ্ডপাতিক ধুতাঙ্গ
৪। সপদানচারিক ধুতাঙ্গ
৫। একাসনিক ধুতাঙ্গ
৬। পাত্রপিণ্ডিক ধুতাঙ্গ
৭। খল্লপচ্ছ ভতিক ধুতাঙ্গ
৮। আরণ্যিক ধুতাঙ্গ
৯। বৃক্ষমুলিক ধুতাঙ্গ
১০। মুক্তগগন তলে বাস ধুতাঙ্গ
১১। শ্মশানিক ধুতাঙ্গ
১২। যথাসন্থাতিক ধুতাঙ্গ
১৩। নৈসজ্জিক ধুতাঙ্গ।
কথিত আছে, বুদ্ধের সাথে মহাকাশ্যপের চীবর বিনিময় হয়। বুদ্ধের চীবর মহাকাশ্যপকে দেওয়া হয়, মহাকাশ্যপের চীবর বুদ্ধকে প্রদান করা হয়। মহাকাশ্যপ নতুন শ্রমন হওয়ার সাতদিন পর চার প্রতিসম্ভিদা সহ অরহত্ব ফল লাভ করেন। তখন মহাকাশ্যপ ভগবানের নিকট হতে তের প্রকার ধুতাঙ্গ ব্রত গ্রহণ করেন।
বুদ্ধ ভিক্ষুদের বলতেন চার স্মৃতি প্রস্থান সাধনা ভাবনা ছাড়া জীবন ব্যাপী শুধুমাত্র ধুতাঙ্গ শীল পালন করে কোন ভিক্ষু শ্রমন যদি মারা যায় কোন লাভ হবে না, সংস্কার উৎপন্ন হবে সত্য, যদি বিদর্শন ভাবনা না থাকে তাহলে শ্রোতাপত্তি, সকৃদাগামি, অনাগামি, অরহত হতে পারবে না। ভিক্ষুদের বুদ্ধ অনেক সময় বলতেন, আমি যে এত শীলের ব্যাখ্যা করেছি; চার ঈর্যাপথ চারস্মৃতি প্রস্থান অর্থাৎ বিদর্শন ভাবনা যখন অনুশীলন করা হয় তখন সমস্ত শীল তার হাতের মুঠোয় চলে আসে, শীল বিশুদ্ধি না হলে সঠিক বিদর্শন হবে না।
মহাকাশ্যপ অরহত্বফল লাভ করে ভিক্ষুত্ব জীবনের করণীয় কর্তব্য শেষ করেন মনের প্রশান্তির জন্য মাতৃজাতি যেমন দেহের বা অঙ্গের অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে গলার হার অথবা সোনার গয়না কিংবা সাজ সজ্জা করেন, অনুরূপ মহাকাশ্যপও অতিরিক্ত ধর্মের বিষয় হিসাবে ১২টি ধুতাঙ্গ ব্রত পালন করতেন। (কারণ ধুতাঙ্গের প্রকারভেদ লক্ষ্য দেখা যাবে যে কোন ভিক্ষু বা ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়, যেমন ৯ এবং ১০ এক সঙ্গে পালন করা কোন মতেই সম্ভব হতে পারে না, যে কোন ধুতাঙ্গ ব্রত পালনকারী)। কাউকে দেখানোর জন্য, তিনি কখনোই বলেননি যে আমি অমুখ শ্মশানে আছি অমুক দিন অমুক গ্রামে পিণ্ডাচরণে যাব, অমুখ অনুষ্ঠানে যোগদান করব। এই সমস্ত কথা মুখে আসার সাথে সাথে অন্তরায় সৃষ্টি হয় এবং ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠানের ব্রতকর্ম নষ্ট হয়। বিনয়কর্ম ছাড়া আর অন্য কোন অনুষ্ঠানে ঐ ভিক্ষু যোগদান করতে পারবেন না। ধুতাঙ্গ পালনকারী ভিক্ষু পিণ্ডাচরণে আসবে এই কথা কেউ না জানে মত মাত্র ১০/১২ পরিবার থেকে পিণ্ডাচরণ করতে পারবেন। কারো নিকট কিছু খাদ্য দ্রব্য ভাত, তরকারী, ফলমুল, এক মুষ্টি মুড়ি, কদলী বা কলা বাড়ীতে থাকলে দিতে পারলে দান হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন, তাতে আপত্তি নেই। দান যদি পাওয়া না যায় তাহলে পাত্র ধুয়ে জল পান করবেন। আগামীকাল তোমাদের গ্রামে পিণ্ডাচরণের জন্য আসব এই খবর কোন সেবকও দিতে পারবে না। বিনা খবরে অর্তকিতভাবে পিণ্ডাচরণে যেতে হবে, আগে থেকে জানাজানি হয়ে গেলে ধুতাঙ্গের অধিষ্ঠান শেষ হয়ে যায়। কোন কোন ধুতাঙ্গ দায়কের নিকট থেকে জায়গা জমি দান হিসাবে পাওয়ার জন্য আবেদন নিবেদন করে। জায়গা জমি তো দূরের কথা। দায়কের দেওয়া কোন কিছুই গ্রহণ করতে পারবে না। গ্রামে দান পাত্র বসাতে পারবেনা। পথে ঘাটে পরে থাকা ময়লা আর্বজনা থেকে কুড়িয়ে সংগ্রহ করে এগুলি ব্যবহার করবে।
কিন্তু বর্তমান অন্য চিত্র দেখতে পাচ্ছি বুদ্ধ বা বৌদ্ধ মতের পরিপন্হি। আজকাল এও দেখা যাচ্ছে যাঁরা ধ্যান সাধক আছেন নিজেদের আচার্য বলে জাহির করেন তাঁরাও নানাভাবে সমাজে মিথ্যা চর্যার আশ্রয় নিচ্ছেন বিপথে চালিত করছেন। এসব ভিক্ষুকে বিনয় সাহিত্যে মহাচোর বলে আখ্যায়িত করেছেন। মহাচোর বলতে বুদ্ধ কাদের বুঝিয়েছেন; যে সকল ভিক্ষু, বুদ্ধ শাসনে সংঘের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভূমি, বিহার ও দ্রব্যাদি গৃহীদের মন তোষণে দিয়ে থাকে, তেমন ভিক্ষুকে বুদ্ধ শাসনে মহাচোর বলা হয় এবং যে সকল ভিক্ষু এই বুদ্ধ শাসনে ধ্যান, সমাধি, মার্গ -ফল ইত্যাদি লাভ না করেও লাভ- সৎকার প্রত্যাশী হয়ে এসকল লাভ করেছে বলে আত্মপ্রশংসা করে থাকে এবং নিজেকে আমি ধ্যান শিক্ষক, ধ্যানাচার্য, আমি এতটা কোর্স করেছি, এত দিনের কোর্স করেছি; এবং দেবতা-ব্রহ্মা-মার এ সকলের সাথে তার জানা পরিচয় ও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ইত্যাদি আছে বলে, ঠকবাজ ও প্রবঞ্চনামূলক আচরণ করে থাকে; তেমন ভিক্ষুই বুদ্ধ শাসনের সবচেয়ে হীন, মহাচোর বলে আখ্যায়িত হয়। আর তেমন মহাচোর শাসনে পারাজিকা প্রাপ্ত বলে উল্লেখ করে ভগবান চতুর্থ পারাজিকা শিক্ষা প্রজ্ঞাপিত করেছেন।
মহাপ্রাজ্ঞ অর্হৎ ভদন্ত নাগসেন রাজা মিলিন্দকে বলেছিলেন–মহারাজ ধুতাঙ্গ গুণরাজির দ্বারা যারা বিশুদ্ধ হননি তাদের ধর্মজ্ঞান লাভ হয় না। যেমন, জল সেচন ব্যতীত বীজ সমূহের অন্কুরোদ্গম হয় না, সেরূপ ধুতাঙ্গ গুণরাজি দ্বারা যাদের আত্নশুদ্ধি হয় নি তাদের ধর্মজ্ঞান সম্ভব নয়।
“বিশুদ্ধ মার্গ” গ্রন্থের ধুতাঙ্গ বর্ণনায় আছে—“আরণ্যিক ধুতাঙ্গের অনুকূল কোনো খোলা জায়গা যদি শ্নাশান হয়, তাহলে একজন ভিক্ষু একবারে সবগুলো ধুতাঙ্গ পালন করতে পারে। ভিক্ষুণীদের শিক্ষাপদে আরণ্যিক ও খলুপচ্ছাভত্তিক এই দুটো ধুতাঙ্গ নিষিদ্ধ। অবভোকাশিক, বৃক্ষমূলিক, শ্মশানিক এই তিনটি ধুতাঙ্গ রক্ষা করাও তাদের জন্য কঠিন। কারণ ভিক্ষুণীরা দ্বিতীয় কোনো সঙ্গী ছাড়া একা বিহার করতে পারে না। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় কোন সমমনা সঙ্গী পাওয়াও কঠিন। আর পাওয়া গেলেও একসাথে বাস করা থেকে মুক্ত হতে পারে না। এভাবে যে উদ্দেশ্যে ধুতাঙ্গ পালন করার কথা, সে উদ্দেশ্য পূরণ হয় না এভাবে পালন করতে না পারায় পাঁচটি ধুতাঙ্গ বাদ দিয়ে ভিক্ষুণীদের জন্য আটটি ধুতাঙ্গ বলে জানতে হবে। উপরোক্তভাবে ত্রিচীবরিক বাদ দিয়ে বাদবাকি বারটি ধুতাঙ্গ শ্রামণদের জন্য, আর সাতটি হচ্ছে শিক্ষামনা ও শ্রামণেরীদের জন্য বলে জানতে হবে। উপাসক/উপাসিকাদের জন্য একাসনিক ও পাত্রপিণ্ডিক এই দুটো হচ্ছে উপযুক্ত ও পালনযোগ্য"।
No comments:
Post a Comment